03 January, 2019

শরৎ হেমন্তে বাংলাদেশ,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; প্রকৃতিতে শরৎ; শরৎকালের রূপবৈচিত্র্য; শরৎ বন্দনায় গ্রাম বাংলা; ঋতু বৈচিত্র্যে হেমন্ত; হেমন্তের নবান্নে বাংলাদেশ; হেমন্তের রূপবৈচিত্র্য; উপসংহার।)
ভূমিকা: বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এখানে প্রতিটি ঋতু তাঁর নিজস্ব আবেদন নিয়ে হাজির হয়, নিজস্ব সৌন্দর্য দিয়ে প্রকৃতিকে আপন মনে সাজিয়ে তোলে। বাংলার প্রকৃতিতে রূপ-বৈচিত্র্যের তৃতীয় ও চতুর্থ অন্তরায় শরত ও হেমন্তের আগমন। বাংলাদেশে বর্ষার পরেই শরতের আগমন। ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। শরতের স্নিগ্ধতা আর শিউলী ফুলের মিষ্টি আমেজে শরৎকাল সমগ্র প্রকৃতির বুকে এক অসাধারণ স্বপ্নিল জগৎ সৃষ্টি করে তোলে। শরতের বিদায়ী পথের বাঁকে শিশিরের শাড়ি পরে হেমন্ত আসে। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ আর ভোরের ঘাসে শিশিরের মুক্তোমালা জানান দেয় শীতের আগমন বার্তা। কার্তিক, অগ্রহায়ণ এই দুই মাস জুড়ে হেমন্তকাল। বুনো ফুল ছাতিমের মৌ মৌ গন্ধ হেমন্তকে অন্যসব ঋতু থেকে আলাদা করে দেয়। ভোরের কোমল, কাঁচা রোদ আর মৃদু হিম স্পর্শ মনে শিহরণ জাগায়।
প্রকৃতিতে শর: বর্ষার পরে শরৎকালের আগমন ঋতু পরিক্রমার একটি সাধারণ নিয়ম। ঘনঘোর বর্ষায় কালের প্রবাহ ধীরে ধীরে শরতে প্রবিষ্ট হয়। শরৎকালে প্রকৃতি হয় শান্ত। ক্ষণিকের জন্য মাঝে মধ্যে সামান্য বৃষ্টিপাত হয়। চারদিকে সবুজের সমারোহ। নদী-বিল বা হাওড়ের স্বচ্ছ পানির বুকে শুভ্র শাপলার মন মাতানো হাসি কিশোর-কিশোরির হৃদয়কাড়া হাসির মতোই মনে হয়। শরৎকাল আমাদের মাঝে অসাধারণ সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হয়। শরতের সকাল আমাদের মাঝে এক অভূতপূর্ব আনন্দময় অনুভূতির সৃষ্টি করে। শরতের সকালে শিশির ভেজা ধান, শিউলী ফুল, কোমল রোদে পুকুরে ভাসমান শুভ্র শাপলার হাসি সব মিলে আমাদের হৃদয়কে উচ্ছ্বসিত করে। আমরা পরম তৃপ্তির সাথে শরতের সকালের এ মিষ্টি আমেজ গ্রহণ করি।
শরৎকালের রূপ বৈচিত্র্য: শরৎকালের কথা আসলেই মেঘযুক্ত নির্মল আকাশের কথা মনে পড়ে। শরতের মেঘ যেন এক ঝাঁক উড়ন্ত শুভ্র বলাকা। দূরে মাঠের উপর দিয়ে বিস্তীর্ণ আকাশকে যেন বিশাল সামিয়ানার মতোই মনে হয়। মাথার উপরে সীমাহীন নীলাকাশ, মাঝে মাঝে উড়ন্ত সাদা মেঘ এবং সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া শালিক, ময়না, ফিঙে ও টিয়ের ঝাঁক। কি অসাধারণ সৌন্দর্যময় উপমা তা কখনো ভোলার নয়। শরৎকালের নয়নাভিরাম আরেকটি রূপ, অবারিত সবুজ মাঠ। মাঠের পর মাঠ, যেন এর শেষ নেই। মাঠের চতুর্দিকে সবুজের প্রাচীর সদৃশ দূরের গ্রাম যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। মাঠের প্রান্তে বিশাল বটগাছটি যেন উদার আকাশের নিচে বিরাট সবুজাভ ছাতার মতো দাঁড়িয়ে আছে । এর নিচেই রাখাল বালকের চিরন্তন খেলাঘর। শরতের শিউলী ফুলকে নিয়ে তো এ দেশে কাব্যের আর শেষ নেই। শরতের শিউলির উপস্থিতি ভিন্ন বাংলা কবিতার ছন্দ কোনো গতিই পায় না। শরতের সকালের হালকা শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের উপর যেন শুভ্র শিউলী ফুল ছড়িয়ে পড়ে। শরৎকালের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন কাশফুল। আশ্বিন মাসে নদীর চরে সাদা কাশফুলের অবারিত বন যেন অজস্র শুভ্র পালক শোভিত উদ্যান। শরতের হালকা বাতাসে যখন সাদা কাশফুল ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকে তখন বাংলার প্রতিটি মানুষ যেন কবি হয়ে যায়। মোহাবিষ্ট সবুজ ঘাস ফড়িংটি লাফ দিয়ে পড়ে কাশফুলের ডগায়। সবুজ ঘাস ফড়িং শিহরণ তোলে সাদা কাশফুলের বনে।
শরৎ বন্দনায় গ্রাম-বাংলা:বর্ষার স্রোতস্বিনী শরতেও পূর্ণ থাকে। শরতে নির্মল পানিরাশি সাগরের সাথে মিলনের উদ্দেশ্যে নদী হয়ে বয়ে যায়। নদীর বুকে মাঝি ভাটিয়ালী গান গেয়ে পাল তোলা নৌকা ছাড়ে মনের আনন্দে। দু’ কূলে সবুজ বনরাশি যেন সবুজের স্বর্গপুরী। কখনো শরতের নদী কিষাণীর শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে অবারিত সবুজ মাঠের বুক চিরে বয়ে যায় দূরে বহুদূরে। শরৎ আমাদের মাঝে বিভিন্ন উৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। এ দেশের মানুষ তখন উৎসবের আয়োজনে মেতে ওঠে। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কবি মনে শরতের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। এদেশের কাব্য-কাহিনীতে বসন্ত আর শরতের সৌন্দর্য বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শরতের সকালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্বেলিত করে শরৎ বন্দনায়-
“আজিকে তোমার মধুর মুরতি/ হেরিনু শারদ প্রভাতে।
হে মাত বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ/ ঝলিছে অমল শোভাতে।”

ঋতু বৈচিত্র্যে হেমন্ত: নদীমাতৃক এ দেশের প্রধান কৃষি ফসল ধান। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমান-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে তাতে পাক ধরে। কার্তিকের শেষ দিকে তাই গ্রামের মাঠে মাঠে ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। চারিদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার সনের হেমন্ত ঋতুর দু’টি মাস, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ। ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আর্দ্রা’ তারার নাম অনুসারে নাম রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের। ‘মরা’ কার্তিকের পর বাংলাদেশের সকল মানুষ প্রবেশ করে এক সর্বজনীন লৌকিক উৎসব নবান্নে। হেমন্তে গ্রাম বাংলার ফসল ঘরে তোলার পরে মাঠের দৃশ্যটিও কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পেয়েছে অনন্য রূপ, যাকে বলা হয়ে থাকে রূপসী বাংলার কবি-
“প্রথম ফসল গেছে ঘরে
হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে।”

হেমন্তের নবান্নে বাংলাদেশ:সাধারণত কার্তিক ও অগ্রহায়ণে ধান কাটা ও মাড়াই করে ধান থেকে আতপ চাল তৈরি করা হয়। এরপর শুরু হয় নবান্ন উৎসব। নতুন চালে রান্না করা হয় সুঘ্রাণী ও সুস্বাদু পায়েশ। এ সময় গ্রাম বাংলার গৃহবধূরা বানাতে বসে নানা রকম পিঠা। দেশের অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নামের এ পিঠা তৈরি হয়। তৈরি করা হয় মুড়ি-মুড়কি নানা রকম সুস্বাদু খাবার। যেগুলো গ্রামবাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবহমান বাংলার আনন্দ উৎসবের ঋতু হলো হেমন্ত। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে এত আনন্দ আর উৎসবের রঙ হেমন্ত ছাড়া আর কোনো ঋতুতে দেখা যায় না। ফসল কাটার পর অফুরন্ত অবসর বাংলার ঘরে ঘরে উৎসবের তাই কোনো কমতি দেখা যায় না। বরং আয়োজন আর নবান্নকে বর্ণিল করে তুলতে সবার মাঝে দেখা যায় এক ধরণের প্রতিযোগিতা। যার ভেতর দিয়ে ফুটে উঠে রূপসী বাংলার নতুন এক রূপ।
হেমন্তের রূপ বৈচিত্র্য: বাংলার রূপময়তায় হেমন্তকে ধরা হয় রিক্ত ঋতু হিসেবে। মাঠ ভরা সোনার ফসল উজাড় করে দিয়ে হেমন্ত ধরা দেয় সম্পূর্ণ রিক্ত-শূন্য হয়ে। কৃষকের শূন্য গোলা সোনার ফসলে ভরে দিয়ে হেমন্ত বিদায় নেয়। কুয়াশার নিঃশব্দ চাদরে মুখ ঢেকে হেমন্তের বিদায় প্রকৃতিকে শীতের আগমনী গান শুনিয়ে যায়। হেমন্ত কখনো কখনো মমতাময়ী নারীর সাথে তুলনা করা হয়। নিজেকে উজাড় করে দিতেই যেন পৃথিবীতে তার আগমন।
উপসংহার: রূপময় বাংলাদেশের প্রতিটি ঋতুই যেন নিজস্ব সৌন্দর্যের তুলি নিয়ে বাংলার রূপ সাজাতে ব্যস্ত। শরৎ আসে সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে কাশবনের মোহনীয়তা নিয়ে। শিউলির ঘ্রাণে বিমোহিত করে বাংলার রূপ পিপাসু মানুষের মন। বাংলার রূপ বৈচিত্র্যের মাঝে শরৎ, হেমন্ত এই দুই ঋতু যেন অন্য রকম এক আবহ তৈরি করে। প্রকৃতি প্রেমী মানুষ, কবি সাহিত্যিকের মন বীণায় ঝঙ্কার তুলতে শরৎ হেমন্তের অপার্থিব সৌন্দর্যের তাই জুড়ি নেই। কবি জীবনানন্দ দাশ তাই ব্যাকুল কণ্ঠে বলেছেন-
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই
পৃথিবীর রূপ খুজিতে যাই না আর।”

ইসমাইল হোসেন