(সংকেত: ভূমিকা; শৈশব কাল; আনন্দময় স্মৃতি; কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি; শৈশব স্মৃতির গুরুত্ব ও প্রভাব; উপসংহার।)
ভূমিকা: বয়স, সময় ও পরিস্থিতি প্রভৃতির বিবেচনায় মানুষের জীবনকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে মানুষকে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। যেমন: শৈশব থেকে মানুষ কৈশরে পদার্পণ করে, এর পর যৌবন চলে আসে এবং পরিশেষে বার্ধক্যে উপনীত হয়। এসব পর্যায়ের মধ্যে শৈশবকাল সবচেয়ে আনন্দময় এবং জীবনের বাকিটা সময় জুড়ে মধুর স্মৃতি বহন করে। শৈশবকাল অতীত হয়ে গেলে চোখের সামনে শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত নানা দিনগুলো ভেসে ওঠে। অন্যদের মতো শৈশবকে ঘিরে আমারও অনেক স্মৃতি রয়েছে। সেসব স্মৃতিময় দিনগুলো মনে হলে আমি কল্পনা প্রবণ হয়ে উঠি এবং শত ব্যস্ততার ভিড়ে শৈশবের স্মৃতিগুলো খুঁজে ফিরি।
শৈশবকাল: শৈশবের সেই সোনালি সময়গুলো আমার জীবন থেকে বিদায় গ্রহণ করলেও শৈশবের আবেগমাখা স্মৃতিগুলো আমার হৃদয়-মাঝারে চির অম্লান। আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে দাদার বাড়িতে। ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর থানা, গ্রামের নাম কাকনী। গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে প্রকৃতির সাথে আমার এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল। পাখির গান আর এক চিলতে রোদের ঝলকানীতে ভোরবেলা আমার ঘুম ভাঙতো। আমরা একান্নবর্তী পরিবারে বাস করতাম। সঙ্গত কারণেই আমাদের বাড়িটা ছিল বিশাল। আর বাড়িটার চারপাশে ছিল সবুজের সমারোহ এবং ফুল ফলের গাছে পরিপূর্ণ। গ্রামের বাড়িতে আমরা দাদা-দাদু, চাচা-চাচী ও ফুপীসহ অন্য আত্মীয়দের সাথে থাকতাম। ছোট বেলায় আমার খেলার সাথী ছিল আমার চাচাতে ভাইবোনগুলো। ছোট বড় মিলে আমরা মোট দশ জন ছিলাম। যখন বড় ফুপীর ছেলে মেয়েরা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতো তখন আমাদের আনন্দময় দিনগুলোতে একটা নতুন মাত্রা যোগ হতো। সব ভাইবোনদের মধ্যে আমি ছিলাম সবার চেয়ে ছোট কিন্তু সব চেয়ে আদরের। আমি সবার সাথে মিলেমিশে থাকতাম এবং পরিবারের সকলেই আমাকে খুব ভালোবাসতো। শিশু সুলভ কোমলতা ও পবিত্রতার কারণেই এ সময় একজন মানব শিশু বড়দের কাছ থেকে আলাদাভাবে নজর কাড়তে পারে। আমি আমার শৈশব থেকে এখন যথেষ্ট দূরে কিন্তু যখনই গ্রামে ফিরে যাই শৈশবের স্মৃতি জড়িত স্থানগুলো আমার মনকে দোলা দিয়ে যায় এবং শৈশবের স্মৃতিগুলো আমার চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ভাসতে থাকে। শৈশবকাল সত্যিই খুব সুখের।
আনন্দময় স্মৃতি: আমার শৈশবকালীন অসংখ্য আনন্দময় স্মৃতির মধ্যে প্রথমে যেটা মনে আসে তা হলো আমার পুতুল খেলা। পুতুল দিয়ে খেলতে আমি খুব ভালোবাসতাম। বাবা শহর থেকে প্রতি সপ্তাহে যখন বাড়ি ফিরতেন তখন আমার জন্য নতুন নতুন বিভিন্ন ধরণের পুতুল কিনে আনতেন। আমার পুতুলগুলোর বিয়ে দেওয়া নিয়ে সে কি মহা আয়োজন এবং যার পর নাই চিন্তা। এসব কথা এখন যখন মনে আসে তখন নিজের অজান্তে একাই হেসে উঠি। আমরা যতগুলো চাচাতো ভাইবোন ছিলাম সবাই বেশির ভাগ সময় দাদুর ঘরে ঘুমাতাম বিশেষ করে ছোটরা। দাদুর ঘরে মেঝেতে ঢালাও বিছানা এবং কে কার পাশে শোবে এ নিয়ে প্রতিদিনই লড়াই চলতো। তবে আমি দাদুর পাশে ঘুমাতেই বেশি পছন্দ করতাম। দাদু আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন এবং তার পাশে শুয়ে থাকতে পারার সুবাদে নানা রকম রূপকথার গল্প শুনতে পারতাম। আমি খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। কারণ প্রতিদিনই চাচাতো ভাইবোনদের সাথে নিত্য নতুন অভিযানে বের হতাম এবং এর ফলে আমার নাগাল পাওয়া আমার মায়ের পক্ষে খুবই দুষ্কর হতো। শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে মা প্রতিদিন আমাকে গোসল করিয়ে দিতেন। সুযোগ পেলেই আমার অন্যান্য ভাইবোনদের সাথে পুকুরে নেমে দু-একটা ডুব দিয়ে আসতাম। ঝড়ের দিনে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে আমি খুব পছন্দ করতাম। বৃষ্টি নামলে আমাকে যে ভিজতে দিতেই হবে একথা মা খুব ভালোভাবেই জানতেন। ঝড়ের মধ্যে আম কুঁড়াতে পারাটাকে একটা বিশাল অর্জন মনে করতাম। আমি যদিও একটু দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম, স্কুলে পড়াশোনার দিক দিয়ে বাবা-মাকে সন্তুষ্ট রাখতে পারতাম। স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও আমি খুব স্নেহভাজন ছিলাম। স্কুলেও আমার অন্য একটা জগৎ তৈরি হয়েছিল। আমার অনেকগুলো বান্ধবী ছিল। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ছিল ময়না। যদিও ওর সাথে এখন আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। ছোটবেলায় তখনও আমার রেল গাড়িতে ভ্রমণ করা হয়নি। এটাকে একটা রহস্যময় যানবাহন মনে করতাম। আমাদের গ্রামে ধান ক্ষেতের বুক চিরে বয়ে গেছে রেলপথ। হঠাৎ ট্রেন আসার শব্দ পেলে সব খেলা ছেড়ে ছুড়ে সবাই দৌড়ে আসতাম রেলগেটে। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে নানা রকমের মানুষ দেখতাম। হকাররা অন্যান্য জিনিসপত্র ও খাদ্যদ্রব্য নিয়ে ট্রেনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করত। মাঝে মাঝে এদের হাতে খাবার দেখে লোভ লাগতো। এসব কথা এখন মনে হলে মনের অজান্তেই খুব লজ্জাবোধ করি। গ্রামে যখন কোনো মেলা হতো তখন চাচা আমাদের সব ভাইবোনকে মেলায় নিয়ে যেতেন। মেলায় গিয়ে নাগর দোলায় উঠা আর সার্কাস দেখা ছিল আমার প্রধান কাজ। মোট কথা সবার কাছ থেকে অনেক আদর পেয়েই আমি বড় হয়েছি। শৈশবের স্মৃতিগুলো আজ পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের স্মৃতি বহন করছে।
কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি: আমার শৈশবকালের শেষের দিকে, যখন আমি ভালোভাবে সব কিছু বুঝতে শিখেছি, বাবা আমাকে আর মাকে নিয়ে শহরে চলে এলেন। এতদিনের মায়া মমতা ভরা স্মৃতি বিজড়িত জায়গা আর সবাইকে ছেড়ে আসার সময় আমার বুকের ভেতরটা ভীষণভাবে আহত হয়েছিল। আমার দুই চোখের বাঁধ ভাঙা জল আমি সবার মাঝখানে থেকেও আড়াল করতে পারিনি। ঐ দিনটির কথা মনে পড়লে এখনও আমার খুব কষ্ট লাগে। দাদুর প্রয়াণেও আমি খুব কেঁদেছিলাম। যেহেতু তার সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল এবং অল্প হলেও কিছুটা সময় আমি তার সাথে হাসি আনন্দে অতিবাহিত করতে পেরেছিলাম। আর একটি বেদনাতুর ঘটনা হচ্ছে আমার এক চাচাতো ভাই মিরাজের আকস্মিক মৃত্যু। আমাদের গ্রাম থেকে বড় নদী খুব কাছেই ছিল। মিরাজ বাড়ির কাউকে না জানিয়ে ওর বন্ধুদের সাথে ঐ নদীতে গোসল করতে যায়। ভালোভাবে সাঁতার না জানার কারণে মাঝ নদীতে গিয়ে ডুবে যায় মিরাজ। অবশেষে নির্মম মৃত্যু। মিরাজের সাথে ঝগড়া আর মারামারিটা একটু বেশি হলেও সে আমার নিয়মিত খেলার সাথী ছিল, মাঝে মধ্যে প্রতিযোগীতাও হতো। আর নিজের বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায় একদিন বৃষ্টির মধ্যে সবাই মিলে হা-ডু-ডু খেলতে খেলতে খেলাচ্ছলে পড়ে গিয়ে পা টা মচকে গেল। এ নিয়ে বাড়িসুদ্ধ সবাই ভয়ে অস্থির। পা মচকানোর ব্যথা নিয়ে অনেক দিন ঘরে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে এবং বাইরে অন্যদের সাথে খেলতে যেতে পারিনি। অন্য একদিনের ঘটনা ও বেশ মনে আছে। তখন আমি নতুন নতুন স্কুলে যেতে শুরু করেছি। একদিন একা একা স্কুল থেকে ফিরে আসতে গিয়ে ভুল পথে পাশের গ্রামে চলে এসেছিলাম। আমি তখন খুব ছোট ছিলাম বলে ভয় পেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করেছিলাম। আমার ভাগ্য ভালো যে ছোট মামা মাকে দেখতে সেদিন ঐ পথ দিয়ে আসছিলেন। একা দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে মামা আমাকে কোলে তোলে নিলেন। তার পর বাসায় ফিরে আসতে পারলাম। দুঃখ-সুখের সংমিশ্রণেই আমার শৈশব কেটেছে। আনন্দের স্মৃতিগুলোর পাশাপাশি দুঃখে স্মৃতি ও আমার হৃদয়ে এখনও অম্লান হয়ে রয়েছে।
শৈশব স্মৃতির গুরুত্ব ও প্রভাব: শৈশবকাল যতটা আনন্দময় ততটা গুরুত্বপূর্ণও বটে। শৈশবে একটি মানব শিশুর হৃদয় থাকে কোমল ও পরিষ্কার। পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাদেরকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে। এ সময় শিশুদেরকে যেমন ইচ্ছা সেভাবে গড়ে তোলা যায়। শিশু যদি তার পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে সদগুণাবলির শিক্ষা লাভ করে তাহলে পরবর্তীতে সে সঠিক পথে জীবন পরিচালনা করতে পারে। কোনো বিষয় সম্পর্কে শৈশবে তাকে যে ধারণা দেওয়া হয় পরবর্তীতে মনের মধ্যে সে তাই লালন করে। সুতরাং বড়দের উচিত তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করা, নিয়মিত ধর্ম চর্চা করার শিক্ষা দেওয়া, লেখাপড়ায় মনোযোগী করা এবং বড়দের প্রতি সদাচরণের শিক্ষা দেওয়া। শৈশবের স্মৃতি মানুষ সহজে ভুলে না। তাই শিশুরা যাতে মনে কোনো দুঃখ-কষ্ট না পায় সে দিকে নজর রাখতে হবে। শৈশবেই তাদেরকে এমন কিছু নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে যেন ভবিষ্যতে বড় মাপের সুশিক্ষিত মানুষ হওয়ার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় সে।
উপসংহার: শৈশবকাল খুব সংক্ষিপ্ত হলেও এর স্মৃতিজড়িত আবেগময় সময়গুলো বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। আমার খেলার সাথী, আমার ভাই বোনগুলোও আমার মতো বড় হয়ে গেছে কিন্তু শৈশবের স্মৃতিজড়িত আমার সেই গ্রামের বাড়ি, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ, সেই রেল গেট ঠিক আগের মতোই আছে। এখন শহর থেকে যখন গ্রামে বেড়াতে আসি ট্রেনে করে তখন সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। আর রেল গেটের কাছে ছোটছোট শিশুদের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবি একদিন এরাও আমার মতো বড় হবে। শৈশব থেকে দূরে চলে যাবে এবং এ সবকিছুই স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে।