অতীতকে ভুলে যাও। অতীতের দুশ্চিন্তার ভার অতীতকেই নিতে হবে।
অতীতকে ভুলে যাও। অতীতের দুশ্চিন্তার ভার অতীতকেই নিতে হবে। অতীতের কথা ভেবে ভেবে অনেক বোকাই মরেছে। আগামীকালের বোঝার সঙ্গে মিলে আজকের বোঝা সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। ভবিষ্যৎকেও অতীতের মতো দৃঢ়ভাবে দূরে সরিয়ে দাও। আজই তো ভবিষ্যৎ-কাল বলে কিছু নেই। মানুষের মুক্তির দিন তো আজই। ভবিষ্যতের কথা যে ভাবতে বসে সে ভোগে শক্তিহীনতায়, মানসিক দুশ্চিন্তায় ও স্নায়ুবিক দুর্বলতায়। অতএব অতীতের এবং ভবিষ্যতের দরজায় আগল লাগাও, আর শুরু করো দৈনিক জীবন নিয়ে বাঁচতে।
সারাংশ: মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো বর্তমান। অতীত এবং ভবিষ্যতের ভাবনা মানুষের জীবনে কোনো সুফল বয়ে আনে না। বরং তা মানুষকে শক্তিহীন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং স্নায়ুবিকভাবে দুর্বল করে তোলে। তাই জীবনকে সফল করে তুলতে হলে অতীত ও ভবিষ্যতের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বর্তমানকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ভবিষ্যত দরজায় খিল তুলে পরম নিশ্চিন্তে বর্তমানে বাসরসজ্জা রচনা করো।
অতীতকে ভুলে যাও। ভবিষ্যত দরজায় খিল তুলে পরম নিশ্চিন্তে বর্তমানে বাসরসজ্জা রচনা করো। নদীর দিকে তাকাও-যে স্রোত চলে যায়, তা আর ফিরে আসে না। দূর নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকাও, তার রহস্য এক অচিন্তনীয় তমসায় আচ্ছন্ন। কী লাভ অন্ধকারে? স্বচ্ছ সুন্দর বর্তমানকে ভালবাস। প্রতি মুহূর্তের কর্মই তোমার বর্তমান।
সারাংশ: অতীত বা অজানা ভবিষ্যতের ভাবনা নয় বর্তমানের ভাবনাই মানুষের জীবনকে সার্থক করে তোলে। তাই অতীতের স্মৃতিচারণা নয়, ভবিষ্যতের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টাও নয়, স্বচ্ছ সুন্দর বর্তমানই আমাদের জীবনের প্রকৃত সত্য।
অর্ধ শতাব্দীর অধিককাল ধরিয়া বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ-সকল প্রচারিত হইতেছে
অর্ধ শতাব্দীর অধিককাল ধরিয়া বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ-সকল প্রচারিত হইতেছে; কিন্তু ইহাতে বিশেষ কিছু ফলাফল হইয়াছে কি? বিজ্ঞান-বিষয়ক যে-সকল পুস্তকের কিছু কাটতি আছে, তাহা পাঠ্য-পুস্তক নির্বাচিত কমিটির নির্বাচিত তালিকাভুক্ত। সুতরাং পুস্তক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার সোপান স্বরূপ। আসল কথা এই যে, আমাদের দেশ হইতে প্রকৃত জ্ঞানস্পৃহা চলিয়া গিয়াছে। জ্ঞানের প্রতি একটা আন্তরিক টান থাকিলেও কেবল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অঙ্গীভূত বিদ্যালয়সমূহে বহুকাল হইতে বিজ্ঞান অধ্যাপনার ব্যবস্থা হইয়াছে। তথাপি এই জ্ঞানস্পৃহার অভাবেই বিজ্ঞানের প্রতি আন্তরিক অনুরাগসম্পন্ন ছাত্র আদৌ দেখিতে পাওয়া যায় না; কেননা ঘোড়াকে জলাশয়ের নিকট আনিলে কি হইবে? উহার তৃষ্ণা নাই। পরীক্ষা পাশ করাই যেখানকার ছাত্রজীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য, সেখানকার যুবকগণের দ্বারা অতীত বৈজ্ঞানিক বিদ্যার শাখা-প্রশাখাদির উন্নতি হইবে, এই হাস্যোদ্দীপক উন্মত্ততা অন্য কুত্রাপিও দেখিতে পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে অপরাপর দেশের লোকেরা একথা সম্যক উপলব্ধি করিয়াছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার হইতে বাহির হওয়াই জ্ঞানসমুদ্রে মন্থনের প্রশস্ত সময়। আমরা দ্বারকেই গৃহ বলিয়া মনে করিয়াছি, সুতরাং জ্ঞানমন্দিরের দ্বারেই অবস্থান করি, অভ্যন্তরস্থ রত্মরাজি দৃষ্টিগোচর না করিয়াই ক্ষুন্ন মনে প্রত্যাবর্তন করি।
সারাংশ: আমাদের দেশে প্রকৃত জ্ঞান চর্চার প্রতি মানুষের আগ্রহ নেই বললেই চলে। জ্ঞানস্পৃহার অভাবে এদেশে বিজ্ঞানচর্চা প্রসার লাভ করেনি। সকলেই পরীক্ষায় পাশ করার জন্য ব্যগ্র বলেই এদেশে প্রাপ্ত গ্রন্থসমূহও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত তালিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহকে জাগিয়ে তুলে উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশকেও বিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে।
অনেকের ইন্দ্রিয় সংযত, তাঁহাদের চিত্ত শুদ্ধ নয়।
অনেকের ইন্দ্রিয় সংযত, তাঁহাদের চিত্ত শুদ্ধ নয়। ইন্দ্রিয়-সুখ ভোগ করব না, কিন্তু আমি ভালো থাকব এবং আমার ইন্দ্রিয়গুলো ভালো থাকবেÑএই বাসনা তাদের মনে প্রবল। আমার ধন হউক, আমার মান হউক, আমার সম্পদ হউক, আমার সৌভাগ্য হউক, আমি বড় হই, আর সবাই আমার চেয়ে ছোট হউক, তাঁরা এরূপ কামনা করেন। এই সকল অভীষ্ট যাতে সিদ্ধ হয়, তাঁরা চিরকাল সেই চেষ্টায় সেই উদ্যোগে ব্যস্ত থাকেন। সেই জন্য না করেন এমন কাজ নেই, তদ্ভিন্ন মন দেন এমন বিষয় নেই। যারা ইন্দ্রিয়াসক্ত তাদের অপেক্ষাও এরা নিকৃষ্ট। এদের নিকট ধর্ম কিছুই নয়, জ্ঞান কিছুই নয়, ভক্তি কিছুই নয়। তাঁরা আল্লাহকে বাহ্যত মানেন বটে, কিন্তু কার্যত তাঁদের ধর্ম বলে কিছুই নেই। কেবল আপনি আছেন, আপনি ভিন্ন আর কিছুই নেই। ইন্দ্রিয়াসক্তি অপেক্ষাও এই স্বার্থপরতা চিত্ত-শুদ্ধির অন্তরায়। পরার্থ ভিন্ন চিত্ত-শুদ্ধি নেই।
সারাংশ: জীবনকে সার্থক করে তুলতে হলে কেবল ইন্দ্রিয়াসক্তি থেকে মুক্ত হলেই চলবে না মনকেও শুদ্ধ করে তুলতে হবে। যাদের ইন্দ্রিয় সংযত কিন্তু মন শুদ্ধ নয় তারা নিজ স্বার্থের জন্য সব কিছুই করতে পারে। বাইরে নিজেদের ধার্মিক বলে পরিচয় দিলেও ধর্মের মূল যে কথা পরোপকার তা থেকে তারা অনেক দূরে। সেই মানুষই সার্থক যার ইন্দ্রিয় সংযত, মন শুদ্ধ এবং পরার্থ চিন্তাই যার ব্রত।
অনেকে বলেন, স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নাই।
অনেকে বলেন, স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নাই। মেয়েরা চর্বচোষ্য রাঁধিতে পারে, বিবিধ প্রকার সেলাই করিতে পারে, দুই-চারিখানা উপন্যাস পাঠ করিতে পারে, ইহাই যথেষ্ট, আর বেশি আবশ্যক নাই। কিন্তু ডাক্তার বলেন যে, আবশ্যক আছে, যেহেতু মাতার দোষ-গুণ লইয়া পুত্রগণ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়। এইজন্য দেখা যায় যে, আমাদের দেশে অনেক বালক শিক্ষকদের বেত্রতাড়নায় কণ্ঠস্থ বিদ্যার জোরে এফএ, বিএ পাস হয় বটে; কিন্তু বালকের মনটা তাহার মাতার সহিত রান্নাঘরেই ঘুরিতে থাকে।
সারাংশ: যারা নারীদের চার দেয়ালে বন্দি রাখার পক্ষে তারা মনে করে যে নারীদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সন্তান যেহেতু মায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয় সেহেতু নারীদের উচ্চশিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে মায়ের ক্ষুদ্র গন্ডিতে সন্তানের মনও আবদ্ধ থাকবে। হয়ত সে উচ্চশিক্ষা লাভ করবে ঠিকই কিন্তু তার মন প্রসার লাভ করবে না।
অনেকের ধারণা এই যে, মহৎ ব্যক্তি শুধু উচ্চবংশেই জন্মগ্রহণ করে থাকেন;
অনেকের ধারণা এই যে, মহৎ ব্যক্তি শুধু উচ্চবংশেই জন্মগ্রহণ করে থাকেন; নীচকুলে মহত্ত্বের জন্ম হয় না। কিন্তু প্রকৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, মানুষের এ ধারণা ভ্রমাত্মক। পদ্ম ফুলের রাজা; রুপে ও গন্ধে সে অতুলনীয়। কিন্তু এর জন্ম হয় পানের অযোগ্য পানিভরা এঁদো পুকুরে। পক্ষান্তরে বটবৃক্ষ বৃক্ষকুলের মধ্যে বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন বটে। অথচ বহু বৃক্ষের ফল আমরা আস্বাদন করি। কিন্তু এত খ্যাতনামা যে বটবৃক্ষ তাহার ফল আমাদের অখাদ্য।
সারাংশ: বংশমর্যাদা মানুষের মহত্ত্বের পরিচায়ক নয়। মানুষ তার হৃদয়ের বিশালতা, প্রতিভা, গুণাবলি প্রভৃতির মাধ্যমেই মহৎ হয়ে ওঠে। কেবল মানবসমাজই নয় প্রকৃতির মধ্যেও এ বিষয়টি লক্ষণীয়।
অপরের জন্য তুমি তোমার প্রাণ দাও, আমি বলতে চাই নে।
অপরের জন্য তুমি তোমার প্রাণ দাও, আমি বলতে চাই নে। অপরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ তুমি দূর করো। অপরকে একটুখানি সুখ দাও। অপরের সঙ্গে একটুখানি মিষ্টি কথা বলো। পথের অসহায় মানুষটির দিকে একটা করুণ কটাক্ষ নিক্ষেপ করো। তাহলেই অনেক হবে। চরিত্রবান, মনুষ্যত্বসম্পন্ন মানুষ নিজের চেয়ে পরের অভাবে বেশি অধীর হন, পরের দুঃখকে ঢেকে রাখতে গৌরববোধ করেন।
সারাংশ: অন্যের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই ।জীবন উৎসর্গ না করে ছোট ছোট দুঃখ দূর করার মধ্য দিয়েও অন্যকে সুখী করা যায়। নিজের কথা না ভেবে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হলে অসহায় মানুষ উপকৃত হয়। মহৎ ব্যক্তিরা এভাবে সর্বদাই নিজের সুখ-দুঃখকে উপেক্ষা করে পরের কল্যাণ কামনায় ব্রতী হন।
অভাব আছে বলিয়া জগৎ বৈচিত্র্যময় হইয়াছে।
অভাব আছে বলিয়া জগৎ বৈচিত্র্যময় হইয়াছে। অভাব না থাকিলে জীব-সৃষ্টি বৃথা হইত। অভাব আছে বলিয়া অভাব-পূরণে এত উদ্যোগ। সংসার অভাবক্ষেত্র বলিয়া কর্মক্ষেত্র। অভাব না থাকিলে সকলেই স্থানু-স্থবির হইত, মনুষ্যজীবন বিড়ম্বনাময় হইত। মহাজ্ঞানীগণ অপরের অভাব দূর করিতে সর্বদা ব্যস্ত। জগতে অভাব আছে বলিয়াই মানুষ সেবা করিবার সুযোগ পাইয়াছে। সেবা মানবজীবনের পরম ধর্ম। সুতরাং অভাব হইতেই সেবাধর্মের সৃষ্টি হইয়াছে। আর এই সেবাধর্মের দ্বারাই মানুষের মনুষ্যত্বসুলভ গুণ সার্থকতা লাভ করিয়াছে।
সারাংশ: অভাব মানুষকে কর্মের পথে চালিত করে জগতকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। অভাব আছে বলেই মানবজীবন চলমান। এ অভাব থেকেই সেবাধর্ম উৎপত্তি লাভ করেছে। অপরের অভাব পূরণের ইচ্ছা এবং তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার মধ্য দিয়েই মানুষ মহান হয়ে ওঠে।
অভ্যাস ভয়ানক জিনিস।
অভ্যাস ভয়ানক জিনিস। একে হঠাৎ স্বভাব থেকে তুলে ফেলা কঠিন। মানুষ হবার সাধনাতেও তোমাকে সহিষ্ণু হতে হবে। সত্যবাদী হতে চাও? তাহলে ঠিক করো, সপ্তাহে অন্তত এক দিন মিথ্যা বলবে না। ছ’মাস ধরে এমনই করে নিজে সত্য কথা বলতে অভ্যাস করো। তারপর এক শুভ দিনে আর একবার প্রতিজ্ঞা করো, সপ্তাহে তুমি দুদিন মিথ্যা বলবে না। এক বছর পরে দেখবে সত্য কথা বলা তোমার কাছে অনেকটা সহজ হয়ে পড়বে। সাধনা করতে করতে এমন একদিন আসবে যখন ইচ্ছে করলেও মিথ্যা বলতে পারবে না। নিজেকে মানুষ করার চেষ্টায় পাপ ও প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রামে তুমি হঠাৎ জয়ী হতে কখনও ইচ্ছা করো না, তাহলে সব প- হবে।
সারাংশ: মানুষ এমনভাবে অভ্যাস দ্বারা বশীভূত সে সহজে তার অভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে পারে না। তবে প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য খারাপ অভ্যাসগুলো অবশ্যই বর্জন করতে হবে। হঠাৎ করেই মানুষ তার খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে গেলে সব পন্ড হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অনুশীলনের মাধ্যমেই বদ অভ্যাস পরিবর্তন করে একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব।
অমঙ্গলকে জগৎ হইতে হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিও না।
অমঙ্গলকে জগৎ হইতে হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিও না। তাহা হইলে মঙ্গলসমেত উড়িয়া যাইবে। মঙ্গলকে যেভাবে গ্রহণ করিয়াছ, অমঙ্গলকেও সেইভাবে গ্রহণ করো। অমঙ্গলের উপস্থিতি দেখিয়া ভীত হইতে পার, কিন্তু বিস্মিত হইবার হেতু নাই। অমঙ্গলের উৎপত্তি অনুসন্ধান করিতে যাইয়া অকূলে হাবুডুবু খাইবার দরকার নাই। যেদিন জগতে মঙ্গলের আবির্ভাব হইয়াছে, সেই দিনই অমঙ্গলের যুগপৎ উদ্ভব হইয়াছে। একইদিনে, একই ক্ষণে, একই উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত উভয়ের উৎপত্তি। এক কে ছাড়িয়া অন্যের অস্তিত্ব নাই, এক-কে ছাড়িয়া অন্যের অর্থ নাই। যেখান হইতে মঙ্গল ঠিক সেখান হইতেই অমঙ্গল। সুখ ছাড়িয়া দুঃখ নাই, দুঃখ ছাড়িয়া সুখ নাই। একই প্রয়োজনে, একই নির্ঝর ধারাতে উভয় স্রোতস্বিনী জন্মলাভ করিয়াছে, একই সাগরে উভয়ে গিয়া মিশিয়াছে।
সারাংশ: মঙ্গল-অমঙ্গল, সুখ-দুঃখ পরস্পর বিপরীতমুখী হলেও একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। মঙ্গলের পথে যাত্রায় যেমন অমঙ্গলকে এড়ানো যায় না তেমনি দুঃখ না পেলেও সুখের মর্ম অনুধাবন করা যায় না। এদের একটির উপস্থিতিতে আরেকটির মূল্য আমরা উপলব্ধি করি। তাই মঙ্গল ও সুখের পাশাপাশি অমঙ্গল ও দুঃখকেও জীবনে বরণ করে নিতে হবে।
অমঙ্গলের অপলাপ করিও না; অমঙ্গল তোমার সহচর, তুমি ছাড়িতে চাহিলেও সে তোমাকে ছাড়িবে না।
অমঙ্গলের অপলাপ করিও না; অমঙ্গল তোমার সহচর, তুমি ছাড়িতে চাহিলেও সে তোমাকে ছাড়িবে না। মঙ্গল ও অমঙ্গল সমানভাবে তোমাকে জড়াইয়া থাকিবে। যতদিন তোমার জাগ্রতাবস্থা স্ফুর্তি পাইবে, ততদিন মঙ্গলের সঙ্গে অমঙ্গলও নিত্য ফুটিয়া উঠিবে। যখন অমঙ্গলের তিরোধান হইবে তখন মঙ্গলেরও তিরোধান হইবে; তোমার জাগরণ তখন সুষুপ্তিতে বিলীন হইবে। যতদিন জাগিয়া আছ ততদিন তোমার ব্যাপ্তি; ততদিন মঙ্গল তোমার ডান হাত ধরিয়া থাকিবে, অমঙ্গল তোমার বাম হাত ধরিয়া থাকিবে। উভয়ই তোমাকে জীবনের পথে লইয়া যাইবে। একের বুঝি আকর্ষণ অপরের বুঝি বিকর্ষণ। উভয়ের মধ্যে তোমার গমনীয় পথ।
সারাংশ: মানুষের জীবনে মঙ্গল ও অমঙ্গল সর্বদাই পাশাপাশি অবস্থান করে। মানুষ চাইলেই অমঙ্গলকে উপেক্ষা করতে পারে না। তাই আমঙ্গলকে ভয় পাওয়া বা এর জন্য দুঃখ পাওয়ার কোনো কারণ নেই। কেবল মৃত্যুতেই এর শেষ, তাই একে বরণ করেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে আমাদের উপমহাদেশ ছিল সভ্যতার সূতিকাগার।
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে আমাদের উপমহাদেশ ছিল সভ্যতার সূতিকাগার। মানুষের জ্ঞান কতদিকে কতভাবে কতকিছুর অনুসন্ধান যে করেছে, সেকালের উত্তর-পশ্চিম ভারতের অধিবাসীদের কীর্তি খ্যাতি থেকে তা আজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেকালের ভারতের ইয়াঙ্ক, পাণিনি এবং পতঞ্জলি প্রভৃতি গুণিজনেরাই প্রথমে ধ্বনি বিজ্ঞানের চর্চা করেন। ইউরোপ আমেরিকা আজ যা করছে আড়াই হাজার বছর আগে ওঁরা তাই করে গেছেন। তফাতের মধ্যে এই যে তাঁদের ধ্বনি বিজ্ঞান সাধনার ভিত্তি ছিল অনুভূতি আর একালে এঁদের হাতে আছে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার।
সারাংশ: আড়াই হাজার বছর আগের মানব সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীদের কীর্তি এবং উদ্ভাবন মূলত আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার অন্যতম বিষয়। ইয়াঙক, পানিনি, পতজ্ঞলি প্রমুখ ছিলেন সেকালের ভারতের ধ্বনি বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ। ইউরোপ-আমেরিকার মতো গবেষণাগার না থাকলেও তাদের চর্চার মাধ্যমেই ধ্বনি বিজ্ঞান আজ এ পর্যায়ে পৌছেছে।
আজকের দুনিয়াটা আশ্চর্যভাবে অর্থের বা বিত্তের ওপর নির্ভরশীল।
আজকের দুনিয়াটা আশ্চর্যভাবে অর্থের বা বিত্তের ওপর নির্ভরশীল। লাভ ও লোভের দুর্নিবার গতি কেবল আগে যাবার নেশায় লক্ষ্যহীন প্রচ-বেগে শুধু আত্মবিনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। মানুষ যদি এই মূঢ়তাকে জয় না করতে পারে, তবে মনুষ্যত্ব কথাটাই হয়তো লোপ পেয়ে যাবে। মানুষের জীবন আজ এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে সেখান থেকে আর হয়তো নামবার উপায় নেই, এবার উঠবার সিঁড়ি না খুঁজলেই নয়। উঠবার সিঁড়িটা না খুঁজে পেলে আমাদের আত্মবিনাশ যে অনিবার্য তাতে আর কোনো সন্দেহ থাকে না।
সারাংশ: অর্থ-বিত্তের লোভে মানুষ এতটা উন্মত্ত হয়েছে যে, সে তার বাস্তব জ্ঞানও হারিয়ে ফেলছে। মানুষ তার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে ক্রমশ আত্মবিনাশের পথে এগিয়ে চলেছে। এ অবস্থা থেকে পিছিয়ে আসার উপায় হয়তো নেই। কিন্তু গোটা মানব জাতির মঙ্গলের জন্য এ নেশা পরিত্যাগের পথ খোঁজাটা আজ অপরিহার্য।
আমরা যখন তর্ক করি তখন অপরকে আত্মমতাবলম্বী করিয়া জয়লাভের জন্য ব্যগ্র হই,
আমরা যখন তর্ক করি তখন অপরকে আত্মমতাবলম্বী করিয়া জয়লাভের জন্য ব্যগ্র হই, যখন আত্মমত প্রকাশ করি তখন অপরের মতকে বশে আনিয়া প্রবল হইবার চেষ্টা করি এবং যখন অপ্রয়োজনীয় গল্প বলি তখনও অপরের হৃদয়কে আশ্রয়প্রার্থী করিয়া আশ্রয়দাতা প্রভু হইতে চাই। সংসারের কাজে আমরা অপরের অভাব ও আকাক্সক্ষার উদ্রেক বৃদ্ধি করিয়া সফল হইবার নিমিত্তে প্রভু সাজিয়া আপনাদিগকে দুর্লভ করি। আমাদের নিজেদের অভাব থাকিলেও পাছে বিপক্ষ আমাদের অভাব বুঝিতে পারিয়া প্রবল হয় এই ভয়ে আমরা সেই ভাবটিকে হৃদয়ের এক প্রান্তে লুকায়িত রাখিয়া বাহিরে কপট বিমুখতার ভাবটিকে প্রকাশ করি। সংসারে প্রত্যেকেই জয়লাভের উদ্যোগে ব্রতী, কিন্তু তাই বলিয়া সকলেই জয়লাভ করিতে পারে না। একের জয়ে অন্যের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। সম্পূর্ণ জয়লাভ কদাচিৎ ঘটে। আংশিক জয়লাভই নিত্য ঘটনা। সংসার-সংগ্রামী আড়ম্বরের যদিও অভাব নাই কিন্তু শেষ ফল সন্ধি। এই সন্ধিতে যাহার লাভের ভাগ অধিক তিনিই জয়ী এবং যাহার লাভের ভাগ অল্প তিনি পরাজিত।
সারাংশ: নিজের চিন্তার বীজ অন্যের মনে বপণ করাই আমাদের বিতর্কের উদ্দেশ্য। আপন অভাবকে সংগোপন রেখে বাইরের জগতে রাজা হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা আমাদের। জয়ী হওয়ার আকুলতাই অন্যকে পরাজিত করে, আর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে পরাজয়ের ইতিহাসই বেশি। পরস্পর সন্ধির ফলে নির্ণিত হয় শেষ ফল, সেখানে অধিক ভাগের অধিকারী সর্বদা জয়ী।
আমরা যে কত শিক্ষালোভী তার প্রমাণ আমাদের পাঁচ বৎসর বয়সে হাতেখড়ি হয়।
আমরা যে কত শিক্ষালোভী তার প্রমাণ আমাদের পাঁচ বৎসর বয়সে হাতেখড়ি হয়। আর কমসে কম একুশ বৎসর বয়সে হাতে কালি মুখে কালি মেখে আমরা সেনেট হাউস থেকে লিখে আসি। কিন্তু এতেও আমাদের শিক্ষার সাধ মেটে না। এরপরে আমরা সারাজীবন যখন যা কিছু পড়ি তা কবিতাই হউক, আর গল্প হউক-আমাদের মনে স্বতঃই এ প্রশ্নের উদয় হয় যে, আমরা এ পড়ে কী শিক্ষা লাভ করলুম, এ প্রশ্নের উত্তর মুখে মুখে দেওয়া অসম্ভব; কেননা, সাহিত্যের যা শিক্ষা তা হাতে হাতে পাওয়া যায় না। সাহিত্য যা দেয় তা আনন্দ; কিন্তু ও বস্তু আমরা জানি নে বলে মানি নে। আমাদের শিক্ষার ভিতর আনন্দ নেই বলে আনন্দের ভিতর যে শিক্ষা থাকতে পারে তা আমাদের বুদ্ধির অগম্য। আমাদের আকাঙক্ষাকে শিশুকাল থেকেই কোমর বেঁধে আমরা খর্ব করি। অর্থাৎ সেটাকে কাজে খাটাবার আগেই তাকে খাটো করে দিই। অনেক সময়ে বড়ো বয়সে সংসারের ঝড়-ঝাপটার মধ্যে পড়ে আমাদের আকাঙক্ষার পাখা জীর্ণ হয়ে যায়, তখন আমাদের বিষয় বুদ্ধি অর্থাৎ ছোট বুদ্ধিটাই বড় হয়ে ওঠে; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, শিশুকাল থেকেই আমরা বড়।
সারাংশ: আমাদের শিক্ষার সম্পর্ক প্রয়োজনের কারণেই আনন্দের সাথে নয়। আর এ কারণেই সাহিত্য পাঠ করে সবাই শিক্ষাকে খোঁজে আনন্দকে নয়। শিক্ষার সাথে আনন্দের যোগের অভাবে তাই জীবনটাও নিরানন্দময় হয়ে পড়েছে। আমাদের শিক্ষা প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে বলে এর মূল তাৎপর্যকে আমরা কখনোই উপলব্ধি করতে পারি না।
আমার বলিতে দ্বিধা নাই যে, আমি আজ তাহাদেরই দলে, যাহারা কর্মী নন ধ্যানী।
আমার বলিতে দ্বিধা নাই যে, আমি আজ তাহাদেরই দলে, যাহারা কর্মী নন ধ্যানী। যাহারা মানবজাতির কল্যাণসাধন করেন সেবা দিয়া, কর্ম দিয়া, তাহারা মহৎ যদি নাই হন, অন্তত ক্ষুদ্র নন। ইহারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির ধারার মতো গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতা রসের মতো অলক্ষ্যে।
সারাংশ: মানবজাতির কল্যাণসাধনে কর্মীরা সেবা, কর্ম দিয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ধ্যনীরা থাকেন পরোক্ষে। তারা কর্মীদের প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করে যান।
আমরা ছেলেকে স্কুল কলেজে পাঠিয়ে ভাবি যে, শিক্ষা দেওয়ার সমস্ত কর্তব্য পালন করলাম।
আমরা ছেলেকে স্কুল কলেজে পাঠিয়ে ভাবি যে, শিক্ষা দেওয়ার সমস্ত কর্তব্য পালন করলাম। বৎসরের পর বৎসর পাস করে গেলেই অভিভাবকরা যথেষ্ট তারিফ করেন। কিন্তু তলিয়ে দেখেন না যে, কেবল পাস করলেই বিদ্যার্জন হয় না। বাস্তবিক পক্ষে ছাত্রের বা সন্তানের মনে জ্ঞানানুরাগ বা জ্ঞানের প্রতি আনন্দজনক শ্রদ্ধার উদ্রেক হচ্ছে কিনা, তাই দেখবার জিনিস। জ্ঞানচর্চার মধ্যে যে এক পরম রস ও আত্মপ্রসাদ আছে, তার স্বাদ কোনো কোনো শিক্ষার্থী একবিন্দুও পায় না।
সারাংশ: শিক্ষা বিষয়টিকে আমরা সার্টিফিকেট অর্জনের সাথে একাত্ম করে ফেলেছি। কিন্তু সার্টিফিকেট অর্জন আর প্রকৃত শিক্ষা এক নয়। আনন্দের সাথে জ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে যে শিক্ষা অর্জিত হয় সেটিই প্রকৃত শিক্ষা।
আমরা সকলেই ভ্রমণকারী। সকলেই পথ চলিতেছি।
আমরা সকলেই ভ্রমণকারী। সকলেই পথ চলিতেছি। কেবল শিক্ষাভেদে, সংসর্গভেদে, লক্ষ্যভেদে কেহ সুপথে, কেহ বিপথে চলিতেছি। বিপথে চলিলে যে শেষে হিংস্র জন্তু সমাকুলে গহীন বনে প্রবেশ করিয়া অকালে প্রাণ হারাইতে হইবে, পাপ পশু আমাদিগকে গ্রাস করিবে, ইহা নিশ্চিত। আবার সুপথে চলিলে যে অপ্রমেয় পুরুস্কার লাভ হইবে সত্য সুন্দর শান্তিদাতার প্রেমের নন্দনকাননে প্রবেশের সৌভাগ্য ঘটিবে, ইহাও সত্য কথা। কিন্তু ভ্রমণে সব সময়ে যদি পথের কিনারা হয়, যেই হিরন্ময় চিরঅজ্ঞাত দেশের যতটুকু ভৌগোলিক সন্ধান মিলিয়াছে, তাহা উপযুক্ত ভ্রমণকারীর মুখে বা লিখিত বিবরণ হইতে অবগত হইতে পারি, তবে বোধ হয় দুর্বল মন অনেক বল পাইবে, পথের দুর্গমতা আতঙ্কের কারণ হইবে না, দীর্ঘদিন ঘুরিয়া হয়তো-বা বিপথে পড়িয়া ব্যর্থকাম ভগ্নহৃদয়ে অনুশোচনার তীব্র দংশন জ্বালা সহিতে হইবে না।
সারাংশ: প্রতিটি মানুষই জীবনের পথে চলমান- কেউ পাপের পথে, কেউ পূণ্যের পথে। তাই পাপের পথে চললে যেমন মানুষকে শাস্তি ভোগ করতে হয় তেমনি পূণ্যের পথে চললে সে স্বর্গের সন্ধান পায়। আর পূণ্যের পথে চলার জন্য পূণ্যবান ব্যক্তির অথবা ধর্মগ্রন্থের উপদেশ গ্রহণ করাই উত্তম।
আমার মনে হয়, যে দেশের নরনারীর মধ্যে পরস্পরের হৃদয় জয় করিয়া বিবাহ করিবার রীতি নাই,
আমার মনে হয়, যে দেশের নরনারীর মধ্যে পরস্পরের হৃদয় জয় করিয়া বিবাহ করিবার রীতি নাই, বরঞ্ছ তাহা নিন্দার সামগ্রী, যে দেশে নরনারী আশা করিবার সৌভাগ্য, আকাঙ্ক্ষা করিবার ভয়ঙ্কর আনন্দ হইতে চিরদিনের জন্য বঞ্ছিত, যাহাদের জয়ের গর্ব, পরাজয়ের ব্যথা কোনটাই জীবনে একটিবারও বহন করিতে হয় না, যাহাদের ভুল করিবার দুঃখ, আর ভুল না করিবার আত্মপ্রসাদ, কিছুরই বালাই নাই, যাহাদের প্রাচীন এবং বহুদর্শী সমাজ সর্ব প্রকারের হাঙ্গামা হইতে অত্যন্ত সাবধানে দেশের লোককে তফাৎ করিয়া, আজীবন কেবল ভালোটি হইয়া থাকিবারই ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, তাই বিবাহ ব্যাপারটা যাহাদের শুধু নিছক ইংরেজি তা সে যতই বৈদিক মন্ত্র দিয়া ইংরেজি পাকা করা হোক, সে দেশের লোকের সাধ্যই নাই মৃত্যুঞ্চয়ের অন্নপাপের কারণ বোঝে। বিলাসীকে যাঁহারা পরিহাস করিয়াছিলেন, তাঁহারা সাধু গৃহস্থ এবং সাধ্বী গৃহিণী। অক্ষয় সতীলোক তাঁহারা সবাই পাইবেন, তাও আমি জানি, কিন্তু সেই সাপুড়ের মেয়েটি যখন একটি পীড়িত শয্যাগত লোককে তিল তিল করিয়া জয় করিতেছিল, তাহার তখনকার সেই গৌরবের কণামাত্র হয়তো আজিও ইহাদের কেহ চোখে দেখেন নাই। মৃত্যুঞ্জয় হয়তো নিতান্তই একটা তুচ্ছ মানুষ ছিল, কিন্তু তাহার হৃদয় জয় করিয়া দখল করার আনন্দটাও তুচ্ছ নহে, সেই সম্পদও অকিঞ্চিৎকর নহে।
সারাংশ: হৃদয় জয় করে কাউকে আপন করে পাওয়ার আনন্দ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে বিরল। মৃত্যুঞ্জয়ের হৃদয় জয়ের যে অসামান্য গৌরব বিলাসী অর্জন করেছিল তা আধুনিক যুগের মানুষের কাছে বোধগম্য নয়। বৈদিক মন্ত্র দিয়ে হৃদয় জয়ের বিরল অনুভূতি বোঝার সাধ্যও তাই কারো নেই।
আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে শিশুকাল থেকেই কোমর বেঁধে আমরা খর্ব করি।
আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে শিশুকাল থেকেই কোমর বেঁধে আমরা খর্ব করি। অর্থাৎ সেটাকে কাজে খাটাবার আগেই তাকে খাটো করে দিই। অনেক সময় বুড়ো বয়সে সংসারের ঝড়-ঝাপটার মধ্যে পড়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষার পাখা জীর্ণ হয়ে যায়, তখন আমাদের বিষয়-বুদ্ধি অর্থাৎ ছোট বুদ্দিটাই বড়ো হয়ে ওঠে; কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, শিশুকাল থেকেই আমরা বড়ো রাস্তায় চলবার পাথেয় হালকা করে দিই। প্রথম কয় বৎসর এক রকম বেশ চলে। ছেলেরা যেই থার্ড ক্লাসে গিয়ে পৌঁছায় অমনি বিদ্যা অর্জন সম্বন্ধে তাদের বিষয়-বুদ্ধি জেগে ওঠে। অমনি তা হিসেব করে শিখতে বসে। তখন তারা বলতে আরম্ভ করে, আমরা শিখবো না, আমরা পাশ করবো। অর্থাৎ যেপথে যথাসম্ভব কম জেনে যতদূর সম্ভব বেশি মার্ক পাওয়া যায়, আমরা সেই পথে চলব। এইত দেখছি শিশুকাল থেকেই ফাঁকি দেবার বুদ্ধি অপবলম্বন।
সারাংশ: মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পরীক্ষায় ভাল ফলাফলকে শিশুকাল থেকে লক্ষ হিসেবে নেওয়ায় শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জন ব্যহত হচ্ছে, যা আমাদেরকে মেরুদন্ডহীন জাতিতে পরিণত করবে।
আমাদের মনের ভাবে একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এই, সে নানা মনের মধ্যে নিজেকে অনুভূত করিতে চায়।
আমাদের মনের ভাবে একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এই, সে নানা মনের মধ্যে নিজেকে অনুভূত করিতে চায়। প্রকৃতিতে আমরা দেখি, ব্যাপ্ত হইবার জন্য, টিকিয়া থাকিবার জন্য প্রাণীদের মধ্যে সর্বদা একটা চেষ্টা চলিতেছে। যে জীব সন্তানের দ্বারা আপনাকে বহুগুণিত করিয়া যত বেশি জায়গা জুড়িতে পারে, তাহার জীবনের অধিকার তত বেশি বাড়িয়া যায়, নিজের অস্তিত্বকে সে তত অধিক সত্য করিয়া তোলে। মানুষের মনোভাবের মধ্যেও সেই রকমের একটা চেষ্টা আছে। তফাতের মধ্যে এই যে, প্রাণের অধিকার দেশে ও কালে মনোভাবের অধিকার মনে এবং কালে। মনোভাবের চেষ্টা বহুকাল ধরিয়া বহু মনকে আয়ত্ব করা।
সারাংশ: নিজ মনের অনুভূতি অন্যের মনে ছড়িয়ে দেয়ার অপরিসীম আনন্দ মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। প্রাণী জগতে নিজেদের বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই আকাঙ্ক্ষার জন্ম। এই বিস্তার যত অধিক হয় নিজেদের প্রতিষ্ঠার ভীত তত সুদৃঢ় হয়। মনোভাবের এই সুনিপুণ বীজ মন থেকে মনে বপন হয়।
আমাদের মধ্যে বিলাসিতা বাড়িয়াছে বলিয়া অনেকে কল্পনা করেন যে, ইহা আমাদের ধন-বৃদ্ধির লক্ষণ।
আমাদের মধ্যে বিলাসিতা বাড়িয়াছে বলিয়া অনেকে কল্পনা করেন যে, ইহা আমাদের ধন-বৃদ্ধির লক্ষণ। কিন্তু এ কথা বিচার করিয়া দেখিতে হইবে যে, পূর্বে যে অর্থ সাধারণের কাজে ব্যয়িত হইত, এখন তা ব্যক্তিগত ভোগে ব্যায়িত হইতেছে। ইহাতে ফল হইতেছে, দেশের ভোগ-বিলাসের স্থানগুলি ফাঁপিয়া উঠিতেছে কিন্তু পল্লীগুলিতে দারিদ্র্যের অবধি নাই। দেশের অধিকাংশ অর্থ শহরে আকৃষ্ট হইয়া কোঠাবাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া, সাজ-সরঞ্জাম, আহার-বিহারেই উড়িয়া যাইতেছে। অথচ যাঁহারা এরূপ ভোগ-বিলাস ও আড়ম্বরে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন, তাঁহাদের প্রায় কেহই সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে নাই, তাঁহাদের অনেকেরই টানাটানি, অনেকেরই ঋণ, অনেকেরই পৈতৃক সম্পত্তি মহাজনের দায়মুক্ত করিবার জন্য চিরজীবনই নষ্ট। কন্যার বিবাহ দেওয়া, পুত্রকে মানুষ করিয়া তোলা, পৈতৃক কীর্তি রক্ষা করিয়া চলা, অনেকেরই পক্ষে বিশেষ কষ্টসাধ্য হইয়াছে। যে ধন সমস্ত দেশের বিচিত্র অভাব মোচনের জন্য চারিদিকে ব্যাপ্ত হইত, সেই ধন সঙ্কীর্ণ স্থানে আবদ্ধ হইয়া যে ঐশ্বর্যের মায়া সৃজন করিতেছে তাহা বর্ণনাযোগ্য নহে। সমস্ত শরীরকে প্রতারণা করিয়া কেবল মুখেই যদি রক্ত সঞ্চার হয়, তবে তাহাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না। দেশের ধর্মস্থানকে, বন্ধুস্থানকে, জন্মস্থানকে কৃষ করিয়া কেবল ভোগস্থানকে স্ফীত করিয়া তুলিলে বাহির হইতে মনে হয় যেন দেশের শ্রীবৃদ্ধি হইতে চলিল। সেই জন্যই এ ছদ্মবেশী সর্বনাশ আমাদের পক্ষে অতিশয় ভয়াবহ। মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাম ধন নহে।
সারাংশ: ধন সম্পদ জড়ো করে আমরা ভোগ বিলাসের শহর গড়ছি ঠিকই, কিন্তু গ্রামগুলোকে বানাচ্ছি দরিদ্র পল্লী। আড়ম্বরের কাছে আত্মসমর্পিত মানুষগুলোও তাই ঠিক সুখের ঠিকানা খুঁজে পায় না। কেননা অন্যের মঙ্গল সাধনের আনন্দ ভোগ বিলাসের মাঝে নেই। সুখের ঐশ্বর্য্য ছড়িয়ে আছে সকল মানবের মাঝে।
আমাদের দেশের শিল্পকারের উপদেশ হলো- পরিপাটি করে মূর্তি গড়,
আমাদের দেশের শিল্পকারের উপদেশ হলো- পরিপাটি করে মূর্তি গড়, পরিচ্ছন্ন করে পালিশ কর পাথরের দেবমূর্তি, কিন্তু খবরদার মানুষ মূর্তি গড় না নোংরা কাজ সেটা। গ্রিক শিল্পকার ঠিক এর উল্টো কথা বললে মানুষগুলোকে করে তোলো দেবতার মতো সুন্দর। আবার চীনের শিল্পকার বললে খবরদার, দেবভাবাপন্ন মানুষকে গড় তো দৈহিক সৌন্দর্যকে একটু স্থান দিও না চিত্রে বা মূর্তিতে। নিগ্রোদের গড়া মূর্তি, যার আদর আর কাটতি খুব ইউরোপে, তার মধ্যে বেঢপ বেয়াড়া রূপই আশ্চর্য কৌশলে সুন্দরভাবে দেখিয়েছে মানুষ। মন এই তেমাথা পথে ত্রিশঙ্কুতে পড়ে বলতে চায়- ‘মন বেচারার কি দোষ’ আছে। নিজের মন ছাড়া যখন সুন্দর অসুন্দরের আদর্শ কোথাও নেই, কোনকালেই নেই এবং ছিলও না, থাকবেও না এটা নিশ্চয় তখন ও নিয়ে মাথা ঘামানো কেন? বিচার-বিতর্কে নিষ্পত্তি হলো গিয়ে এক কথা। তিনিই রস, তিনিই সুন্দর, তাঁর সৃষ্টি হলো অসুন্দরে মিলিয়ে অপরূপ সুন্দর। সৌন্দর্যে পূর্ণচন্দ্র কুত্রাপি, নাস্তি, পরিপূর্ণতা অপরিপূর্ণতা অস্তি।
সারাংশ: শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে শিল্পীর মনের ক্যানভাসে যে চিত্র অংকিত হয় তার বাস্তব রূপ না পেলে শিল্পের সৌন্দর্য্য বাধাগ্রস্ত হয়। সৌন্দর্য প্রকাশের প্রকৃত পট হল মানুষের মন। একমাত্র মনেই শিল্পের আসল বহি:প্রকাশ ঘটে।
আমাদের জন্য এদেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা,
আমাদের জন্য এদেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কুরআন শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলোর অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টিয়াপাখির মতো আবৃত্তি কর। কোন পিতার হিতৈষণার মাত্রা বৃদ্ধি হইলে, তিনি দুহিতাকে ‘হাফেজা’ করিতে চেষ্টা করেন। সমুদয় কুরআনখানি যাঁহার কণ্ঠস্থ থাকে, তিনিই ‘হাফেজ’। আমাদের আরবি শিক্ষা ঐ পর্যন্ত। পারস্য এবং উর্দু শিখিতে হইলে, প্রথমেই ‘করিমা ববখশা-এ বরহালে মা’ এবং একেবারে (উর্দু) ‘বানাতন্ নাস’ পড়। একে আকার ইকার নাই, তাতে আবার আর কোন সহক পাঠ্যপুস্তক পূর্বে পড়া হয় নাই, সুতরাং পাঠের গতি দ্রুতগামী হয় না। অনেকের ঐ কয়খানি পুস্তক পাঠ শেষ হওয়ার পূর্বেই কন্যা-জীবন শেষ হয়। বিবাহ হইলে বালিকা ভাবে, ‘যাহা হোক, পড়া হইতে রক্ষা পাওয়া গেল।’ কোন কোন বালিকা রন্ধন ও সূচিকর্মে সুনিপুণা হয়। বঙ্গদেশেও বালিকাদিগকে রীতিমতো বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। কেহ কেহ উর্দু পড়িতে শিখে, কিন্তু কলম ধরিতে শিখে না। ইহাদের উন্নতির চরমসীমা সল্মা চুমকির কারুকার্য, উলের জুতা-মোজা ইত্যাদি প্রস্তুত করিতে শিক্ষা পর্যন্ত।
সারাংশ: নারীদের পশ্চাদপদতার প্রধান কারণ ভুল শিক্ষা গ্রহণ করা। কোন কিছু বুঝার চেয়ে মুখস্ত করাতেই মেয়েদের আগ্রহী করে তোলা হয়। ফলে নারীদের বিদ্যার দৌড় হয় দু’ একটি বই মুখস্ত করা পর্যন্ত। বিয়ের পর তাদের প্রধান শিক্ষার বিষয় হয় রান্না এবং সেলাই কাজ।
আমাদের প্রচলিত পাঠ্যবিষয়সমূহ নীরস প্রকৃতির।
আমাদের প্রচলিত পাঠ্যবিষয়সমূহ নীরস প্রকৃতির। এ কারণে তা হৃদয়গ্রাহী হয় না। খাদ্য হজমের প্রয়োজনে যেমন পরিমিত নির্মল বায়ু সেবন আবশ্যক, তদ্রুপ পাঠ্যবিষয় বোঝার প্রয়োজনে আনুষঙ্গিক কিছু সহায়ক গ্রন্থ পাঠ করা দরকার, যা আনন্দদায়ক।
সারাংশ: আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্য বিষয়সমূহের সাথে আনন্দের কোনো সম্পর্ক নেই বলে তা আমাদের হৃদয়গ্রাহ্য হয় না। তাই পাঠ্য বিষয়কে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে এর পাশাপাশি সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে সাহিত্য ও অন্যান্য আনন্দদায়ক গ্রন্থ পাঠ করা অত্যাবশ্যক।
আমার বিবেচনায় স্বাস্থ্যরক্ষার উপায় গৃহ ও পল্লী পরিষ্কার;
আমার বিবেচনায় স্বাস্থ্যরক্ষার উপায় গৃহ ও পল্লী পরিষ্কার; বিশুদ্ধ জল ও বায়ুর ব্যবস্থা নির্ধারণ। এইসব বিষয়ে শিক্ষাবিস্তার এবং আদর্শ গঠিত পল্লী প্রদর্শন অতি সহজেই হইতে পারে। ইহার উপায় মেলা স্থাপন। পর্যটনশীল মেলা দেশের একপ্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া অল্প দিনেই অন্যপ্রান্তে পৌঁছিতে পারে। এই মেলায় স্বাস্থ্যরক্ষা সম্বন্ধে ছায়াচিত্রযোগে উপদেশ, স্বাস্থ্যকর ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যায়াম প্রচলন, যাত্রা, কথকতা,গ্রামের শিল্প-বস্তুর সংগ্রহ, কৃষি-প্রদর্শনী ইত্যাদি গ্রামহিতকর বহুবিধ কার্য সহজেই সাধিত হইতে পারে। আমাদের কলেজের ছাত্রগণও এই উপলক্ষে তাহাদের দেশ পরিচর্যা বৃত্তিকার্য পরিণত করিতে পারেন।
সারাংশ: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর-বাড়ি, বিশুদ্ধ জল এবং বায়ুর ব্যবস্থা স্বাস্থ্য রক্ষার অন্যতম পূর্বশর্ত। এসব বিষয়ে গ্রামবাসীকে সচেতন করার অন্যতম মাধ্যম হলো মেলা। যেখানে আদর্শ গঠিত পল্লি প্রদর্শন, স্বাস্থ্যরক্ষার উপর নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও স্বাস্থ্যকর ক্রীড়া-কৌতুক প্রদর্শনের মাধ্যমে সহজেই গ্রামবাসী সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও এ কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
আমাদের চাষী বলে, মাটি হইতে বাপ-দাদার আমল ধরিয়া যাহা পাইয়া আসিতেছি
আমাদের চাষী বলে, মাটি হইতে বাপ-দাদার আমল ধরিয়া যাহা পাইয়া আসিতেছি তাহার বেশি পাইব কী করিয়া? এই কথা চাষীর মুখে শোভা পায়, পূর্বপ্রথা অনুসরণ করিয়া চলা তাহাদের শিক্ষা। কিন্তু সেই কথা বলিয়া আমরা নিষ্কৃতি পাইব না। এই মাটিকে এখনকার প্রয়োজন অনুসারে বেশি করিয়া ফলাইতে হইবে, না হইলে আধপেটা খাইয়া, জ্বলে অজীর্ণ রোগে মরিতে কিংবা জীবন্মৃত হইয়া থাকিতে হইবে। এই মাটির ওপরে মন এবং বুদ্ধি খরচ করিলে এই মাটি হইতে যে আমাদের দেশের মোট চাষের ফসলের চেয়ে অনেক বেশি আদায় করা যায় তাহার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। আজকাল চাষকে মূর্খের কাজ বলা চলে না, চাষের বিদ্যা এখন মস্ত বিদ্যা হইয়া উঠিয়াছে।
সারাংশ: মাটির ফসল ফলানোর ক্ষমতা যে সুনির্দিষ্ট নয় এ কথা আমাদের দেশের চাষীদের ধারণার অতীত। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান দেখিয়েছে যে, কৃষিবিদ্যার সঠিক প্রযোগে এই মাটি থেকেই অধিক ফসল ফলানো সম্ভব। আর এর মাধ্যমেই দূর হতে পারে চাষীদের দুঃখ-দুর্দশা।
আমি ভালোবেসেছি এ জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে
আমি ভালোবেসেছি এ জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে- আমি কামনা করেছি মুক্তিকে। যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদনে- আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য মহামানবের মধ্যে যিনি ‘সদা জানানং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট’। আমি আবাল্য অভ্যস্ত ঐকান্তিক সাহিত্য সাধনার গন্ডিকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্ঘ্য, আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেছি- তাতে বাইরের থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অন্তর থেকে পেয়েছি প্রসাদ। আমি এসেছি এই ধরণীর মহাতীর্থে- এখানে সর্বদেশ, সর্বজাতি ও সর্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন নরদেবতা, তারাই বেদীমূলে নিবৃত্তে বসে আমার অহংকার, আমার ভেদবুদ্ধি ক্ষালন করবার চেষ্টায় আজও প্রবৃত্ত আছি।
সারাংশ: একজন জীবনসাধকের কাছে এ জগতই সত্য। তিনি মানুষের সত্যে বিশ্বাস করেছেন, মানুষও তার মনুষ্যত্বকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। আর তাই মহামানবের কাছে তিনি তাঁর সকল কিছু সমর্পণ করে ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতার গন্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করার সাধনায় রত।
আমি ভাগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাহাদের ধর্মবন্ধন
আমি ভাগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাহাদের ধর্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না, মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুত্ব বা খ্রিষ্টানকে খ্রিষ্টানি ছাড়িতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।
সারাংশ: উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে নারী তার মনের স্বাধীনতা হারিযেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ধর্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করার কোনো প্রয়োজন নেই। নিজ ধর্মে বা সমাজে থেকেই সুশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মানসিক উন্নতি সাধন করা যায়।
আমি লাইব্রেরিকে স্কুল কলেজের উপরে স্থান দিই
আমি লাইব্রেরিকে স্কুল কলেজের উপরে স্থান দিই এই কারণে যে, এ স্থানে লোক স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ পায়। প্রতিটি লোক তার স্বীয় শক্তি ও রুচি অনুসারে নিজের মনকে নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। স্কুল কলেজে বর্তমানে আমাদের যে অপকার করছে সে অপকারের প্রতিকারের জন্য শুধু নগরে নগরে নয়, গ্রামে গ্রামে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা কর্তব্য। আমি পূর্বে বলেছি যে লাইব্রেরি হাসপাতালের চাইতে কম উপকারী নয়, তার কারণ আমাদের শিক্ষার বর্তমান অবস্থায় লাইব্রেরি হচ্ছে এক রকম মনের হাসপাতাল।
সারাংশ: স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নেই। পুথিগত শিক্ষা থেকে বের হয়ে এসে স্বেচ্ছায় ও স্বচ্ছন্দে লেখাপড়ার জন্য দরকার লাইব্রেরি। শিক্ষার বর্তমান রুগ্নদশার চিকিৎসার জন্য শহর, গ্রাম সর্বত্র লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
Posted By Md.Ripon Mia
Posted By Md.Ripon Mia
No comments:
Post a Comment