17 June, 2018

বদর হতে ওহোদ


(২হিঃ ১৭ই রামাযান হ’তে ৩হিঃ ৭ই শাওয়াল)
বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভূতপূর্ব বিজয়ে ৪টি পক্ষ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়। মক্কার কুরায়েশরা, মদীনার ইহুদী ও মুনাফিকেরা এবং মদীনার আশপাশের নাজদ প্রভৃতি এলাকার বেদুঈনরা। তারা সাধ্যমত সকল উপায়ে মদীনায় একটি স্থিতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে থাকে। এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা নিম্নে সংক্ষেপে উদ্ধৃত হল-

(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র : বদর যুদ্ধে গ্লানিকর পরাজয়ে এবং শীর্ষ নেতাদের হারিয়ে কুরায়েশরা যখন ক্ষোভে-দুঃখে আত্মহারা, তখন এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অন্যতম নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া বদর যুদ্ধের সামান্য পরে একদিন কা‘বা গৃহের রুকনে হাতীমে বসে ওমায়ের বিন ওহাব আল-জামহীর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করল যে, তুমি তোমার ছেলেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে মদীনায় গিয়ে মুহাম্মাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাকে হত্যা করবে। বিনিময়ে আমি তোমার যাবতীয় ঋণ পরিশোধের ও তোমার পরিবার পালনের দায়িত্ব নিচ্ছি। উল্লেখ্য যে, ওমায়ের-এর পুত্র ওহাব বদর যুদ্ধে বন্দী হয়ে মদীনায় ছিল। দুজনের মধ্যে এই চুক্তি হওয়ার পরে এবং তা সম্পূর্ণ গোপন রাখার শর্তে ওমায়ের বিন ওহাব ভালভাবে বিষ মাখানো একটা তরবারি নিয়ে মদীনায় গিয়ে হাযির হল। হযরত ওমর (রাঃ) তাকে ঘাড় ধরে রাসূলের কাছে নিয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ছেড়ে দিতে বললেন। অতঃপর ওমায়ের তাঁর নিকটে এসে আরবদের রীতি অনুযায়ী বলল, ‘সুপ্রভাত’। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ আমাদেরকে এর চাইতে উত্তম অভিবাদন রীতি প্রদান করেছেন অর্থাৎ সালাম, السلام عليكم যা হল জান্নাতীদের অভিবাদন(ইউনুস ১০/১০)।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তার আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে তার ছেলের মুক্তির জন্য রাসূলের সহানুভূতি কামনা করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাহলে তরবারি কেন এনেছ? সে বলল, এর ধ্বংস হৌক। এটা কি আমাদের কোন কাজে লেগেছে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বারবার সত্য কথা বলার তাকীদ দিলেও সে চেপে যায়। তখন তিনি মক্কায় তাদের দুজনের মধ্যকার গোপন শলা-পরামর্শের কথা ফাঁস করে দেন। এতে সে হতবাক হয়ে গেল। অতঃপর কলেমা পাঠ করে মুসলমান হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে উত্তম রূপে দ্বীন ও কুরআন শিখতে বললেন এবং তার ছেলেকে মুক্তি দিলেন। কিছুদিন পর সে রাসূলের অনুমতি নিয়ে মক্কায় গিয়ে ওমরাহ করল এবং সেখানে তার হাতে অনেকে মুসলমান হল। ছাফওয়ান শপথ করল যে, তার সঙ্গে কখনো কথা বলবে না এবং তার কোন উপকার করবে না। অবশ্য ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর ছাফওয়ান মুসলমান হয়ে যান।

(২) ইহুদী চক্রান্ত :

কয়েকটি নমুনা :
(ক) মক্কার কাফেরদের প্রদত্ত নানাবিধ অপবাদের ন্যায় মদীনার ইহুদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে রা‘এনা (راعنا) বলে ডাকতে থাকে। আরবী ভাষায় যার অর্থ ‘আমাদের তত্ত্বাবধানকারী’। মাদ্দাহ الرعاية والحفظ। এই লকবে ডেকে তারা বাহ্যতঃ মুসলমানদের খুশী করতে চাইত। কিন্তু এর দ্বারা তারা নিজেদের হিব্রু ভাষা অনুযায়ী راعينوا অর্থাৎ شريرنا ‘আমাদের দুষ্ট ব্যক্তিটি’ অর্থ গ্রহণ করত। তাদের এই চালাকি বন্ধ করার জন্য আল্লাহ পাক এটাকে নিষিদ্ধ করে ‘উনযুরনা’ (انظرنا) অর্থাৎ ‘আমাদের দেখাশুনা করুন’- লকবে ডাকতে নির্দেশ দিলেন (বাক্বারাহ ২/১০৪)।

(খ) ইবনু ইসহাক বর্ণনা করেন যে, শাস বিন ক্বায়েস (شاس بن قيس) নামক জনৈক বৃদ্ধ ইহুদী মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করত। একদিন সে ছাহাবায়ে কেরামের একটি মজলিসের নিকট দিয়ে গমন করছিল, যেখানে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের ছাহাবী ছিলেন। দুই গোত্রের লোকদের মধ্যকার এই প্রীতিপূর্ণ বৈঠক তার নিকটে অসহ্য ছিল। কেননা উভয় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা টিকিয়ে রেখে উভয় গোত্রের নিকটে অস্ত্র বিক্রি ও সূদ ভিত্তিক ঋণদান ব্যবসা চালিয়ে আসছিল তারা দীর্ঘদিন ধরে। ইসলাম আসার পর এসব বন্ধ হয়েছে এবং তারা পুনরায় ভাই ভাই হয়ে গেছে। যাতে দারুণ আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়ে যায় মদীনার কুসিদজীবী ইহুদী গোত্রগুলি।

ঐ বৃদ্ধ একজন যুবক ইহুদীকে উক্ত মজলিসে পাঠাল এই নির্দেশ দিয়ে যে, সে যেন সেখানে গিয়ে উভয় গোত্রের মধ্যে ইতিপূর্বে সংঘটিত বু‘আছ (بعاث) যুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী অবস্থা আলোচনা করে এবং ঐ সময়ে উভয় পক্ষ হ’তে যেসব বিদ্বেষমূলক ও আক্রমণাত্মক কবিতা সমূহ পঠিত হ’ত, তা থেকে কিছু কিছু পাঠ করে শুনিয়ে দেয়। যুবকটি যথারীতি তাই-ই করল এবং উভয় গোত্রীয় ছাহাবীদের মধ্যে লড়াইয়ের পরিবেশ তৈরী হয়ে গেল। এমনকি উভয় পক্ষ ‘হার্রাহ’ (الحرة) নামক স্থানের দিকে ‘অস্ত্র অস্ত্র’ (السلاح السلاح) বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।

এ খবর পেয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কয়েকজন মুহাজির ছাহাবীকে সাথে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন এবং সবাইকে শান্ত করলেন। তখন সবাই বুঝলেন যে, এটি শয়তানী প্ররোচনা (نزغة من الشيطان) ব্যতীত কিছুই নয়। তারা তওবা করলেন ও পরস্পরে বুক মিলিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলেন। এভাবে শাস বিন ক্বায়েস ইহুদী শয়তানের জ্বালানো আগুন দ্রুত নিভে গেল।


ওহোদ যুদ্ধ

বদর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়, ‘সাভীক্ব’ যুদ্ধে ছাতুর বস্তাসহ অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম ফেলে আবু সুফিয়ানের জান নিয়ে পালিয়ে আসার গ্লানিকর তিক্ত অভিজ্ঞতা ও সবশেষে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার নেতৃত্বে মদীনার পথ ছেড়ে নাজদের পথ ধরে সিরিয়া যাত্রী কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম বাহিনী কর্তৃক লুট হওয়া এবং দলনেতা ছাফওয়ানের কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার লজ্জাষ্কর পরিণতির প্রেক্ষাপটে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের সাথে কালবিলম্ব না করে একটা চূড়ান্ত ফায়ছালাকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে। সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে বদর যুদ্ধে নিহত নেতা আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা, উৎবাহর ভাই আব্দল্লাহ ও সাভীক যুদ্ধে পালিয়ে আসা আবু সুফিয়ান এবং সর্বশেষ বাণিজ্য কাফেলা ফেলে পালিয়ে আসা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে বিবেচিত কুরাইশের যে বাণিজ্য কাফেলা আবু সুফিয়ান স্বীয় বুদ্ধিবলে মুসলিম বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলের, সেই বাণিজ্য সম্ভারের সবটুকুই মালের মালিকদের সম্মতিক্রমে ওহোদ যুদ্ধের পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়। যার বিক্রয়লব্ধ মাল ও অর্থের পরিমাণ ছিল ১,০০০ উট ও ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা। এ প্রসঙ্গে সূরা আনফাল ৩৬ আয়াতটি নাযিল হয়। যাতে বলা হয়,

إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللهِ فَسَيُنْفِقُوْنَهَا ثُمَّ تَكُوْنُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُوْنَ وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُوْنَ-
আল্লাহর রাস্তা হ’তে লোকদের ফিরানোর জন্য কাফেররা যত ধনসম্পদ ব্যয় করুক না কেন, সবই ওদের মনস্তাপের কারণ হবে। ওরা পরাভূত হবে। অতঃপর কাফেররা জাহান্নামে একত্রিত হবে’(আনফাল ৮/৩৬)।

দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আসতেই মক্কায় তিন হাযার সুসজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত হয়ে গেল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দার নেতৃত্বে ১৫ জন মহিলাকেও সঙ্গে নেওয়া হল, যাতে তাদের দেওয়া উৎসাহে সৈন্যরা অধিক উৎসাহিত হয় এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে সৈন্যরা জীবনপণ লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়। অতঃপর যুদ্ধ সম্ভারের মধ্যে ছিল বাহন হিসাবে ৩০০০ উট, ২০০ যুদ্ধাশ্ব এবং ৭০০ লৌহবর্ম। খালেদ ইবনু ওয়ালীদ ও ইকরিমা বিন আবু জাহলকে অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক করা হয়। আবু সুফিয়ান হলেন পুরা বাহিনীর অধিনায়ক এবং যুদ্ধের পতাকা অর্পণ করা হয় প্রথা অনুযায়ী বনু আব্দিদ্দার গোত্রের হাতে।

কুরায়েশ নেতাদের এই ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্ত্ততির খবর রাসূলের চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (যিনি তখনো প্রকাশ্যে মুসলমান হননি) একজন বিশ্বস্ত পত্রবাহকের মাধ্যমে দ্রুত মদীনায় পাঠিয়ে দেন এবং তাতে তিনি সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দেন। ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র তিনদিনে অতিক্রম করে পত্রবাহক সরাসরি গিয়ে রাসূলের হাতে পত্রটি পৌঁছে দেয়। তিনি তখন ক্বোবায় অবস্থান করছিলেন।

মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের উক্ত পরামর্শ বৈঠকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথমে নিজের দেখা একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি একটি ভাল স্বপ্ন দেখেছি’। আমি দেখি যে, কতগুলি গরু যবেহ করা হচ্ছে। দেখি যে, আমার তরবারির মাথায় কিছুটা ভগ্নদশা। আরো দেখি যে, আমার হাতখানা একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছি’। এর ব্যাখ্যা এই হ’তে পারে যে, আমার কিছু ছাহাবী এ যুদ্ধে নিহত হবে। তরবারির মাথা ভাঙ্গার অর্থ আমার পরিবারের কেউ নিহত হবেন। আর সুরক্ষিত বর্ম অর্থ মদীনা সুরক্ষিত থাকবে। অতঃপর যুদ্ধ কৌশল হিসাবে তিনি প্রথমে নিজের মত প্রকাশ করে বলেন, নগরীর অভ্যন্তরে থেকেই যুদ্ধ করা সমীচীন হবে। অতঃপর উপরোক্ত প্রস্তাবের বিষয়ে মতামত তলব করলে একদল বুযর্গ ছাহাবী , বিশেষ করে যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি, তাঁরা দ্রুত বলে উঠলেন, হে রাসূল! আমরা তো এদিনের অপেক্ষাতেই ছিলাম এবং আল্লাহর নিকটে দো‘আ করছিলাম। আজ সেটা আমাদের কাছে এসে গেছে এবং অতীব নিকটবর্তী হয়েছে। অতএব ‘আপনি শত্রুদের দিকে বের হউন। যাতে তারা আমাদেরকে কাপুরুষ ও দুর্বল বলে ধারণা করতে না পারে’। রাসূলের চাচা হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব, যিনি বদর যুদ্ধে নিজের তরবারির চমক দেখিয়েছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, ‘সেই সত্তার কসম! যিনি আপনার উপরে কিতাব নাযিল করেছেন। আমি খাদ্য গ্রহণ করব না, যতক্ষণ না আমি মদীনার বাইরে গিয়ে আমার তরবারি দ্বারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব’। আনছারদের বাকী প্রায় সবাই বললেন, আমরা জাহেলী যুগে বাইরে গিয়ে শত্রুর মুকাবিলা করতাম। এখন ইসলামী যুগে আমরা বাইরে গিয়ে মুকাবিলার অধিক হকদার। অতএব শত্রুদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাঁর পূর্বমত পরিবর্তন করলেন এবং অধিকাংশের মত অনুযায়ী (رأي الأغلبية) মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন। অতঃপর একটি জানাযা শেষে পোষাক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এতে ছাহাবীগণ লজ্জিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনাকে বাধ্য করতে চাই না। আপনি চাইলে মদীনাতে থেকেই যুদ্ধ করুন। কিন্তু তিনি বললেন, কোন নবীর জন্য এটা সঙ্গত নয় যে, যুদ্ধের পোষাক পরিধানের পর তা খুলে ফেলেন’। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বৈষয়িক ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অধিকাংশের রায় মেনে নেওয়া আমীরের জন্য সঙ্গত। এর পরেও তাঁকে বাধ্য করা যাবে না। বরং তাঁর সিদ্ধান্ত সকলকে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে হবে। তবে বিধানগত বিষয়ে অধিকাংশের রায় মেনে নেওয়া বৈধ নয়’ (আন‘আম ১১৫-১১৬)।

শেষ রাতে ফজরের কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাহিনীসহ আবার চলতে শুরু করেন এবং শাওত্ব (الشوط) নামক স্থানে পৌঁছে ফজর ছালাত আদায় করেন। এখান থেকে মাক্কী বাহিনীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিশাল কুরায়েশ বাহিনী দেখে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই ৩০০ জনকে অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ সেনা দলকে ফিরিয়ে নিয়ে এই কথা বলতে বলতে চলে গেল যে, ‘জানি না আমরা কিসের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি’? তারপর সে এ যুক্তি পেশ করল যে, ‘রাসূল (ছাঃ) তার কথা পরিত্যাগ করেছেন ও অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন’। অর্থাৎ তিনি আমাদের মূল্যায়ন করেননি। অথচ এখানে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীতে ফাটল সৃষ্টি করা, যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার আগ্রাসী বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীরা ধ্বংস হয়ে যায়। অতঃপর অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করেন ও সেখানে শিবির স্থাপন করেন। শত্রু সেনারা যাতে পিছন দিক হ’তে হামলা করতে না পারে, সেজন্য তিনি পূর্ব-দক্ষিণের সংকীর্ণ ও স্বল্পোচ্চ গিরিপথে আউস গোত্রের বদরী ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের আনছারীর নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি তীরন্দায দলকে নিযুক্ত করেন। যে স্থানটি এখন ‘জাবালুর রুমাত’ (جبل الرماة) বা তীরন্দাযদের পাহাড় বলে পরিচিত। তাদেরকে বলে দেওয়া হয় যে, জয় বা পরাজয় যাই-ই হৌক না কেন, তারা যেন নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ঐ স্থান পরিত্যাগ না করে এবং শত্রুপক্ষ যেন কোনভাবেই এপথ দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। এমনকি আমাদের মৃত লাশে যদি পক্ষীকূল ছোঁ মারতে থাকে, তথাপি তোমরা উক্ত স্থান পরিত্যাগ করবে না। অথবা আমরা বিজয়ী হয়ে যদি গণীমত কুড়াতে থাকি, তথাপি তোমরা তাতে শরীক হবে না’। فلا تبرحوا حتى أرسل إليكم ‘অতএব তোমরা হটবে না, যতক্ষণ না আমরা তোমাদের ডেকে পাঠাই’।[4] কেননা শত্রুপক্ষ পরাজিত হলে কেবলমাত্র এপথেই তাদের পুনরায় হামলা করার আশংকা ছিল। দূরদর্শী সেনাপতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটা বুঝতে পেরেই তাদেরকে এমন কঠোর হুঁশিয়ারী প্রদান করেন। তিনি পাহাড়কে আড়াল করে পিছন ও দক্ষিণ বাহুকে নিরাপদ করেন। আর যে গিরিপথ দিয়ে শত্রুপক্ষের প্রবেশের আশংকা ছিল, সেপথটি তীরন্দাযদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে নেন। আর শিবির স্থাপনের জন্য একটি উঁচু জায়গা নির্বাচন করেন। যাতে পরাজিত হলেও শত্রুপক্ষ সেখানে পৌঁছতে না পারে এবং তেমন কোন ক্ষতি করতে না পারে। এভাবে অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে তিনি শিবির সন্নিবেশ করেন। অতঃপর তিনি মুনযির বিন ‘আমরকে ডান পার্শ্বের এবং যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামকে বাম পার্শ্বের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদকে তার সহকারী নিয়োগ করেন। বাম বাহুর প্রধান দায়িত্ব ছিল কুরায়েশ অশ্বারোহী বাহিনী ও তাদের অধিনায়ক খালেদ বিন ওয়ালীদকে ঠেকানো। তিনি বড় বড় যোদ্ধাগণকে সম্মুখ বাহিনীতে রাখেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নয়জন দেহরক্ষী নিয়ে পিছনে অবস্থান নেন ও যুদ্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করতে থাকেন।

কুরায়েশদের রাজনৈতিক চাল :

(১) যুদ্ধ শুরুর কিছু পূর্বে আবু সুফিয়ান আনছারদের কাছে এই মর্মে পয়গাম পাঠান যে, তোমরা আমাদের ও আমাদের স্বগোত্রীয়দের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের থেকে সরে আসব। তোমাদের সাথে আমাদের যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই’। কিন্তু আনছারগণ তাদের কূটচাল বুঝতে পেরে ভীষণভাবে তিরষ্কার করে বিদায় করলেন।

(২) প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কুরায়েশ পক্ষ দ্বিতীয় পন্থা গ্রহণ করল। ইসলামের পূর্বে আউস গোত্রের অন্যতম নেতা ও পুরোহিত ছিল ‘আবু আমের’ আর-রাহিব। আউস গোত্র ইসলাম কবুল করলে সে মক্কায় চলে যায় এবং কুরায়েশদের সঙ্গে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তার ধারণা ছিল যে, সে ময়দানে উপস্থিত হলে আনছাররা ফিরে যাবে। সেমতে সে ময়দানে এসে আনছারদের উদ্দেশ্যে উচ্চকণ্ঠে ডাক দিয়ে তাদেরকে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। সংখ্যার আধিক্য ও সরঞ্জামের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের ব্যাপারে কুরায়েশরা কিরূপ ভীত ছিল, উপরোক্ত ঘটনায় তা কিছুটা আঁচ করা যায়।

যুদ্ধ শুরু :

৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকালে যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী এবং তাদের সেরা অশ্বারোহী বীরদের অন্যতম তালহা বিন আবু তালহা আব্দুল্লাহ আল-আবদারী উটে সওয়ার হয়ে এসে প্রথমে দ্বৈরথ যুদ্ধে মুকাবিলার আহবান জানান। মুসলিম বাহিনীর বামবাহুর প্রধান যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এগিয়ে যান এবং সিংহের মত এক লাফে উটের পিঠে উঠে তাকে সেখান থেকে মাটিতে ফেলে যবেহ করে হত্যা করেন। এ অভাবনীয় দৃশ্য দেখে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ খুশীতে তাকবীর ধ্বনি দেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যুবায়েরের প্রশংসায় বলেন, ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক নবীর একজন নিকট সহচর থাকেন। আমার সহচর হল যুবায়ের’।

প্রধান পতাকাবাহীর পতনের পর তার পরিবারের আরও পাঁচ জন পরপর নিহত হয় এবং এভাবে দশ/বারো জন পতাকাবাহী মুসলিম বাহিনীর হাতে খতম হয়। যার মধ্যে একা কুযমান ৪ জনকে এবং আলী (রাঃ) ৮ জনকে হত্যা করেন। আউস গোত্রের বনু যাফর বংশের কুযমান ইবনুল হারেছ ছিল একজন মুনাফিক’। সে এসেছিল নিজ বংশের গৌরব রক্ষার্থে, ইসলামের স্বার্থে নয়।

মাক্কী বাহিনীর পতাকাবাহীদের একে একে নিহত হওয়ার পর মুসলিম সেনাদল বীরদর্পে এগিয়ে যান ও মুশরিকদের সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই শুরু হয়ে যায়। এই সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকলকে আহবান করে বলেন, কে আছ আমার এই তরবারি তার হক সহ গ্রহণ করবে? আলী, যুবায়ের, ওমর সহ বহু ছাহাবী একযোগে এগিয়ে এলেন তরবারি নেবার জন্য। কিন্তু এ সময় আবু দুজানাহ বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ তরবারির হক কি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তুমি এর দ্বারা শত্রুদের মুখে মারবে, যাতে ওরা আমার থেকে সরে যায়’। তখন আবু দুজানাহ বললেন, ‘আমি এর হক আদায় করব হে আল্লাহর রাসূল’। তখন তিনি তাকেই তরবারি দিলেন। রাসূলের তরবারি হাতে পেয়ে আবু দুজানা খুশীতে আত্মহারা হয়ে মাথায় লাল পাগড়ী বেঁধে নিম্নের কবিতা বলতে বলতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যান।

‘আমরা যখন খেজুর বাগানের প্রান্তে ছিলাম, তখন আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ আমার নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, কখনোই আমি পিছনের সারিতে থাকবো না। বরং সর্বদা সম্মুখ সারিতে থেকে আল্লাহ ও রাসূলের তরবারি দ্বারা প্রতিপক্ষকে মারব’।[5]

এই যুদ্ধে হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের বীরত্ব ছিল কিংবদন্তীতুল্য। প্রতিপক্ষের মধ্যভাগে প্রবেশ করে তিনি সিংহ বিক্রমে লড়াই করছিলেন। তাঁর অস্ত্রচালনার সামনে শত্রু পক্ষের কেউ টিকতে না পেরে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কিন্তু আল্লাহর এই সিংহকে কাপুরুষের মত গোপন হত্যার মাধ্যমে শহীদ করা হয়। তাকে হত্যাকারী ওয়াহ্শী বিন হারব ছিল মক্কার নেতা জুবায়ের ইবনু মুত্ব‘ইমের হাবশী গোলাম। যার চাচা তু‘আইমা বিন ‘আদী বদর যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। ওয়াহ্শী ছিল বর্শা নিক্ষেপে পারদর্শী, যা সাধারণতঃ লক্ষ্যভ্রষ্ট হ’ত না। মনিব তাকে বলেছিল, তুমি আমার চাচার বিনিময়ে যদি মুহাম্মাদের চাচা হামযাকে হত্যা করতে পার, তাহলে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে’।

ওয়াহশী বলেন যে, আমি কেবল আমার নিজের মুক্তির স্বার্থেই যুদ্ধে আসি এবং সর্বক্ষণ কেবল হামযার পিছনে লেগে থাকি। আমি একটি বৃক্ষ বা একটি পাথরের পিছনে ওঁৎ পেতে ছিলাম। ইতিমধ্যে যখন তিনি আমার সম্মুখে জনৈক মুশরিক সেনাকে এক আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন এবং তাকে আমার আওতার মধ্যে পেয়ে যাই, তখনই আমি তাঁর অগোচরে তাঁর দিকে বর্শাটি ছুঁড়ে মারি, যা তাঁর নাভীর নীচে ভেদ করে ওপারে চলে যায়। তিনি আমার দিকে তেড়ে আসেন। কিন্তু পড়ে যান ও কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আমি তার দেহ থেকে বর্শাটি বের করে নিয়ে চলে যাই’। এরপর মক্কায় ফিরে গেলে আমাকে আযাদ করে দেওয়া হয়।[7]

‘সাইয়িদুশ শুহাদা’ হযরত হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওহোদ যুদ্ধে তিনি একাই ৩০ জনের অধিক শত্রু সেনাকে হত্যা করেন।[9] কেবল আবু দুজানা ও হামযা নয়, অন্যান্য বীরকেশরী ছাহাবীগণের অতুলনীয় বীরত্বের সম্মুখে কাফির বাহিনী কচুকাটা হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমনকি তারা তাদের সেনা শিবির ছেড়ে সবকিছু ফেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকে। বারা ইবনু আযেব (রাঃ) বলেন, মুশরিক বাহিনীর মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে গেল। তাদের নারীরা পায়ের গোছা বের করে ছুটতে লাগল। মুসলিম বাহিনী তাদের পিছনে তরবারি নিয়ে ধাওয়া করল। অতঃপর সবাই তাদের পরিত্যক্ত মালামাল জমা করতে শুরু করল।[10]

তীরন্দাযদের ভুল ও তার খেসারত :

কাফিরদের পলায়ন ও গণীমত জমা করার হিড়িক দেখে গিরিপথ রক্ষী তীরন্দায দল ভাবল, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। অতএব আর এখানে থাকার কি প্রয়োজন? গণীমতের মাল ও দুনিয়ার লোভরূপী শয়তান সাময়িকভাবে তাদের মাথায় চেপে বসল। ‘গণীমত’ ‘গণীমত’ বলতে বলতে তারা ময়দানের দিকে ছুটে চলল। অধিনায়ক আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের (রাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে ১০ জন বাদে বাকী ৪০ জনের সবাই ছুটলো ময়দানের দিকে। শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীর ধুরন্ধর সেনাপতি খালেদ ইবনু ওয়ালীদ সুযোগ বুঝে নক্ষত্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ঐ ক্ষুদ্র বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ও তাঁর সাথীগণ সকলে প্রাণপণ লড়াই করে শহীদ হয়ে গেলেন। অতঃপর খালেদ ও তার পশ্চাদবর্তী কুরায়েশ সেনাদল অতর্কিতে এসে অপ্রস্ত্তত মুসলিম সেনাদলের উপরে হামলা করল। ঐ সময় আমরাহ বিনতে আলক্বামা নাম্মী জনৈকা কুরায়েশ মহিলা তাদের ভূলুণ্ঠিত পতাকা তুলে ধরলে চারদিক থেকে মাক্কী বাহিনী পুনরায় ময়দানে ছুটে আসে এবং অগ্র-পশ্চাৎ সবদিক থেকে মুসলিম বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। শুরু হল মহা পরীক্ষা। মুসলিম বাহিনীর উপর নেমে আসে মহা বিপর্যয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ সময় আহত হন। অতঃপর সুকৌশলে স্বীয় বাহিনীকে উচ্চভূমিতে তাঁর ঘাঁটিতে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হন। ফলে মুসলিম বাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ও সাক্ষাৎ পরাজয় থেকে বেঁচে যায়। তীরন্দাযদের ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনীর নিশ্চিত বিজয় এভাবে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে শেষ হয়।

ইবনু হাজার বলেন, বিদ্বানগণ বলেন যে, ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের মধ্যে আল্লাহর বিশেষ রহস্য ও তাৎপর্য সমূহ নিহিত ছিল। যেমন-

(১) রাসূলের অবাধ্যতার পরিণাম সম্পর্কে মুসলমানদের হুঁশিয়ার করা। কেননা তীরন্দাযগণের অবাধ্যতার ফলে আকস্মিক এই বিপর্যয় নেমে আসে (২) রাসূলগণের জন্য সাধারণ নিয়ম এই যে, তারা প্রথমে বিপদগ্রস্থ হন এবং শেষে বিজয়ী হন। কেননা যদি তাঁরা সর্বদা কেবল বিজয়ী হ’তে থাকেন, তাহলে মুমিনদের মধ্যে এমন লোকও ঢুকে পড়বে, যারা তাদের নয়। আবার যদি তারা কেবল পরাজিত হ’তেই থাকেন, তাহলে রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্যই হাছিল হবে না। সেকারণ জয় ও পরাজয় দু’টিই একত্রে রাখা হয়, যাতে প্রকৃত ঈমানদার ও কপট বিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। [11]

ছাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে আক্বীদা :

ছাহাবায়ে কেরাম নিষ্পাপ মা‘ছূম ছিলেন না। শয়তান সাময়িকভাবে হলেও তাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে (আলে ইমরান ৩/১৫৫)। সেজন্য আল্লাহ পাক মাঝে-মধ্যে পরীক্ষায় ফেলে তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান করে দেন, যেমন ওহোদের যুদ্ধে করেছেন। তবে আল্লাহ তাদের মাফ করে দিয়েছেন(আলে ইমরান ৩/১৫২) এবং তাদের উপরে সন্তুষ্ট হয়েছেন (তওবা ৯/১০০)। তাদের বিশাল সৎকর্ম সমূহ ছোট খাট গোনাহ সমূহকে ধুয়ে ছাফ করে নিয়ে গেছে (হূদ ১১/১১৪)।

রাসূলের ভাষায় ‘ওহোদ পাহাড়ের সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করলেও ছাহাবায়ে কেরামের কোন একজনের (সৎকর্মের) সমপরিমাণ বা তার অর্ধেকও হবে না।[12]ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, আমার নিকট খবর পৌঁছেছে যে, শাম বিজয় কালে সেখানকার নাছারাগণ ছাহাবীগণকে দেখে বলেছিল, ‘আল্লাহর কসম! এঁরা আমাদের হাওয়ারীদের চাইতে উত্তম’ ইবনু কাছীর বলেন, তারা সত্য কথাই বলেছিল। কেননা ছাহাবীগণ সম্পর্কে বিগত এলাহী কিতাব সমূহেও বর্ণনা রয়েছে।[13]


ফুটনোট

[1] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৫১-৫৭; বুখারী হা/৪০৩৭ ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’ অধ্যায় ১৫ অনুচ্ছেদ; মুসনাদে আহমাদ হা/২৩৯১; ইরওয়া হা/১১৯১।
[2] ইবনু হিশাম ২/৬৩।
[3] ইবনু হিশাম ২/৬৬।
[4] বুখারী, ‘জিহাদ’ অধ্যায় ১/৪২৬, হা/৩০৩৯; ফাৎহুল বারী ৭/৪০৩।
[5] ইবনু হিশাম ২/৬৭-৬৮।
[6] আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৬০-৬১।
[7] ইবনু হিশাম ২/৭১-৭২।
[8] ইবনু হিশাম ২/৭২-৭৩; বায়হাক্বী ৯/৯৭-৯৮; ফাৎহুল বারী ৭/৪২৭।
[9] আল-ইছাবাহ, ২/২৮৬, ক্রমিক সংখ্যা ১১০২।
[10] বুখারী হা/৪০৪৩, ২/৫৭৯।
[11] যাদুল মা‘আদ ২/৯৯-১০৮; ফাৎহুল বারী ৭/৩৪৭ পৃঃ।
[12] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৯৮।
[13] ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা ফাৎহ ২৯ আয়াত।

রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যা প্রচেষ্টা সমূহ


(১) হিজরতের রাতে : ১৪শ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর মোতাবেক ৬২২ খৃষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত মধ্যরাতের পর।
(২) পরদিন ১৩ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছওর পাহাড়ের গুহামুখে উপস্থিত শত্রুদের ব্যর্থ চেষ্টা। যারা ১০০ উট পাওয়ার লোভে তাঁর সন্ধানে বের হয়েছিল।

(৩) ৬২২ খৃষ্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর বুধবার বনু মুদলিজ গোত্রের নেতা সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম কর্তৃক হিজরতের পথিমধ্যে হামলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।

(৪) পরদিন ১৯শে সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার সাক্ষাত যমদূত হিসাবে দেখা দেয় বিখ্যাত আরব বীর বুরাইদা আসলামী ও তার ৭০ জনের একটি পুরস্কার লোভী দল। কিন্তু রাসূলের সঙ্গে কথা বলার পর বুরাইদা তার দলবলসহ ওখানেই মুসলমান হয়ে যায় ও রাসূলের দেহরক্ষী বনে যায়।

(৫) ২য় হিজরীর ১৭ই রামাযানে সংঘটিত বদর যুদ্ধের কয়েক দিন পরে মক্কার নেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার কুপরামর্শে দুষ্টমতি ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জামহী তীব্র বিষ মিশ্রিত তরবারি নিয়ে মদীনা আগমন করে। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তাকে দেখেই কাছে ডেকে নিয়ে মক্কায় বসে ছাফওয়ান ও তাঁর মধ্যকার গোপন পরামর্শ এবং তার হত্যা পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন। এতে সে হতবাক হয়ে আত্মসমর্পণ করে ও মুসলমান হয়ে যায়। পরে মক্কায় ফিরে গিয়ে তার দাওয়াতে বহু লোক ইসলামে দাখিল হয়।

(৬) ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২৫ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে পূর্বের সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী রক্তমূল্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বনু নাযীরের ইহুদীদের কাছে এলে অর্থ প্রদানের ওয়াদা দিয়ে তাঁকে বসিয়ে রেখে দেওয়ালের উপর থেকে বড় পাথর ফেলে তারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু অহি-র মাধ্যমে জানতে পেরে রাসূল (ছাঃ) সেখান থেকে দ্রুত ফিরে আসেন।

(৭) ৬ষ্ঠ হিজরীর মুহাররম মাসে ইয়ামামাহর হানীফা গোত্রের নেতা ছুমামাহ বিন আছাল হানাফী ইয়ামামার নেতা মুসায়লামাহর নির্দেশে রাসূলকে হত্যা করার জন্য ছদ্মবেশে মদীনায় আসছিল। কিন্তু পথিমধ্যে সে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর সেনাদলের হাতে ধরা পড়ে যায়। মদীনায় আনার পর তিনদিন মসজিদে নববীতে তাকে বেঁধে রাখা হয়। তারপর তাকে মুক্তি দিলে সে মুসলমান হয়ে মক্কায় ওমরাহ করতে যায় এবং ইসলামের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(৮) ৬ষ্ঠ হিজরীর রামাযান মাসে বনু ফাযারাহ গোত্রের একটি শাখার নেত্রী উম্মে কুরফা রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে এবং এজন্য ৩০ জন সশস্ত্র ব্যক্তিকে নিয়োগ করে। কিন্তু তারা আবুবকর অথবা যায়েদ বিন হারেছাহর সেনাদলের হাতে গ্রেফতার হয়ে নিহত হয়।

(৯) ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর বিজয়ের পরে সেখানেই তাঁর পূর্বপরিচিত ইহুদী নেতা সালাম বিন মুশকিমের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ রাসূলকে হাদিয়া দেওয়ার জন্য তাঁর প্রিয় খাদ্য বকরীর ভূনা রান বিষমিশ্রিত করে নিয়ে আসে। রাসূল (ছাঃ) তা চিবানোর পর না খেয়ে ফেলে দেন। এভাবে আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে যান।

(১০) ৭ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে যাতুর রেক্বা যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে বিশ্রাম স্থলের একটি গাছে ঝুলানো রাসূলের তরবারি হাতে নিয়ে গাওরাছ ইবনুল হারেছ নামক জনৈক বেদুঈন রাসূলকে হুমকি দিয়ে বলে, এবার তোমাকে কে রক্ষা করবে? রাসূল (ছাঃ) দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, আল্লাহ। তখন তরবারি খানা তার হাত থেকে পড়ে যায় এবং পরে সে মুসলমান হয়ে যায়।

(১১) ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মক্কা বিজয়ের পর কা‘বা গৃহ ত্বাওয়াফকালে ফাযালাহ বিন ওমায়ের রাসূলকে হত্যার জন্য তাঁর নিকটবর্তী হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে তার কুমতলবের কথা ফাঁস করে দিলে সে মুসলমান হয়ে যায়।

(১২) ৯ম হিজরীর রামাযান মাসে তাবূক অভিযান থেকে ফেরার পথে এক সংকীর্ণ গিরিসংকটে ১২ জন মুখোশধারী মুনাফিকের একটি দল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিরিবিলি পেয়ে তাঁকে হত্যার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।

(১৩) ১০ম হিজরী সনে বনু ‘আমের বিন ছা‘ছা‘আহর প্রতিনিধি দলের নেতা ‘আমের বিন তোফায়েল ও আরবাদ বিন ক্বায়েস রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মদীনায় মসজিদে নববীতে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু বারবার চেষ্টা করেও তরবারি কোষ হ’তে বের না হওয়ায় তারা ব্যর্থ হয় এবং রাসূলের বদদো‘আয় মদীনা থেকে ফেরার পথে তাদের প্রথমজন হঠাৎ ঘাড়ে ফোঁড়া উঠায় এবং দ্বিতীয় জন বজ্রাঘাতে নিহত হয়।


রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে জাদু

হত্যা প্রচেষ্টা ছাড়াও তাঁকে জাদু করে পাগল বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করে ষড়যন্ত্রকারীরা। ইহুদীদের মিত্র বনু যুরায়েক্ব গোত্রের লাবীদ ইবনুল আ‘ছাম নামক জনৈক মুনাফিক তার মেয়েদের মাধ্যমে এই জাদু করে। প্রথমে সে রাসূলের বাসার কাজের ছেলের মাধ্যমে কয়েকটি চুল সহ রাসূলের ব্যবহৃত চিরুনীটি সংগ্রহ করে। অতঃপর তার কন্যাদের দ্বারা উক্ত চুলে ১১টি জাদুর ফুঁক দিয়ে ১১টি গিরা দেয় ও তার মধ্যে ১১টি সুচ ঢুকিয়ে দেয়। অতঃপর চুল ও সুচ সমেত চিরুনীটি একটি খেজুরের কাঁদির খোলা আবরণীর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ‘যারওয়ান’ কূপের তলায় একটি বড় প্রস্তর খন্ডের নীচে চাপা দিয়ে রাখে। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, উক্ত জাদুর প্রভাবে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মাঝে মধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়তেন। যে কাজ করেননি, তা করেছেন বলে অনুভব করতেন। একরাতে স্বপ্নে দু’জন ফেরেশতা এসে নিজেদের মধ্যে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাঁকে জাদুর বিষয়ে সবকিছু অবহিত করেন। ফলে পরদিন আলী, যুবায়ের ও আম্মার ইবনে ইয়াসির সহ একদল ছাহাবী গিয়ে উক্ত কূয়া সেঁচে পাথরের নীচ থেকে খেজুরের কাঁদির খোসা সহ চিরুনীটি বের করে আনেন। ঐ সময় সূরা ফালাক্ব ও নাস নাযিল হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঐ দুই সূরার ১১টি আয়াতের প্রতিটি পাঠ শেষে এক একটি গিরা খুলতে থাকেন। অবশেষে সব গিরা খুলে গেলে তিনি স্বস্তি লাভ করেন। লোকেরা ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করতে চাইলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করে বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে রোগমুক্ত করেছেন (এটাই যথেষ্ট)। লোকদের মধ্যে মন্দ ছড়িয়ে পড়ুক, এটা আমি চাই না’।[1]


ফুটনোট

[1] ছহীহ বুখারী, হা/৬৩৯১; আহমাদ, বায়হাক্বী দালায়েল ও তাফসীরে ইবনে কাছীর অবলম্বনে।

16 June, 2018

পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ঈদ মোবারক


পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ঈদ মোবারক

পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ঈদ মোবারক


২নং কিচক ইউনিয়ন পরিষদের সর্বস্তরের জনগনকে জানাই পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন ঈদ মোবারক

15 June, 2018

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুদ্ধ ও অভিযান সমূহ


(১ম হিজরীর রামাযান হ’তে ১১ হিজরীর ছফর পর্যন্ত)
শুধুমাত্র রাসুল (সঃ) এর সরাসরি অংশগ্রহন করা বিখ্যাত যুদ্ধ সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে।

১। গাযওয়া ওয়াদ্দান : ২য় হিজরীর ছফর মাসে (৬২৩ খৃঃ আগষ্ট মাস) রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে একটি কুরায়েশ কাফেলার বিরুদ্ধে পরিচালিত ৭০ জনের মুহাজির বাহিনী। যুদ্ধ হয়নি। তবে স্থানীয় বনু যামরাহ গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটাই ছিল রাসূলের জীবনে প্রথম যুদ্ধাভিযান। এই সফরে তিনি ১৫ দিন অতিবাহিত করেন। পতাকাবাহী ছিলেন হামযাহ (রাঃ)।

২। গাযওয়া সাফওয়ান : ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে রাসূলের নেতৃত্বে ৭০ জনের দল। প্রতিপক্ষ মক্কার নেতা কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী পালিয়ে যায়। সে ছিল মদীনার উপকণ্ঠে প্রথম হামলাকারী এবং গবাদি-পশু লুটকারী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই লুটেরাদের ধাওয়া করে বদরের উপকণ্ঠে সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত গমন করেন। এজন্য এই অভিযানকে গাযওয়া বদরে ঊলা বা প্রথম বদর যুদ্ধ বলা হয়।

৩। গাযওয়ায়ে বদর : ২য় হিজরীর ১৭ রামাযান মোতাবেক ৬২৪ খৃষ্টাব্দের ১১ মার্চ শুক্রবার। রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্বে ৩১৩, ১৪ বা ১৭ জনের অপ্রস্ত্তত বাহিনী। কুরায়েশ পক্ষে আবু জাহলের নেতৃত্বে ১০০০ লোকের সুসজ্জিত বাহিনী। মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার সহ ১৪ জন শহীদ এবং কুরায়েশ পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন বন্দী হয়। আবু জাহল সহ নিহতদের অধিকাংশ ছিল মক্কার শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। বদর যুদ্ধ উপলক্ষে সূরা আনফাল নাযিল হয়। যাতে গনীমতের বিধান বর্ণিত হয়।

৪। গাযওয়া বনু কায়নুক্বা : ২য় হিজরীর ১৫ই শাওয়াল শনিবার থেকে ১৫ দিন অবরোধ করে রাখার পর এই প্রথম চুক্তি ভঙ্গকারী এবং তাদের বাজারে এক দুধ বিক্রেতা মুসলিম মহিলাকে বিবস্ত্রকারী এই নরাধম ইহুদী গোত্রটি ১লা যিলক্বা‘দ আত্মসমর্পণ করে। এরা ছিল খায়বার গোত্রের মিত্র। ফলে মাত্র একমাস পূর্বে ইসলাম কবুলকারী খাযরাজ গোত্রভুক্ত মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের একান্ত অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রাণদন্ড মওকুফ করে মদীনা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। এদের মধ্যে ৭০০ জন ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা এবং মদীনার সেরা ইহুদী বীর। এরা সবকিছু ফেলে সিরিয়ার দিকে চলে যায় এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সেখানে মৃত্যুবরণ করে। মানছূরপুরী বলেন, তারা খায়বরে যেয়ে বসতি স্থাপন করে।[1]

৫। গাযওয়া ওহোদ: ৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকাল। কুরায়েশ বাহিনী আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদীনার তিন মাইল উত্তরে ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির সন্নিবেশ করে। এই বাহিনীর সাথে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওৎবার নেতৃত্বে ১৫ জনের একদল মহিলা ছিল, যারা নেচে-গেয়ে ও উত্তেজক কবিতা পাঠ করে তাদের সৈন্যদের উৎসাহিত করে। এই যুদ্ধে রাসূলের নেতৃত্বে প্রায় ৭০০ সৈন্য ছিলেন। প্রচন্ড যুদ্ধ শেষে একটি ভুলের জন্য মুসলমানদের সাক্ষাৎ বিজয় অবশেষে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মুসলিম পক্ষে ৭০ জন শহীদ ও ৪০ জন আহত হন। কুরায়েশ পক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়। যাদের মধ্যে হামযা একাই ৩১ জনকে হত্যা করেন ও নিজে শহীদ হন। মুসলমানদের ক্ষতি হলেও কুরায়েশরা বিজয়ী হয়নি। বরং তারা ভীত হয়ে ফিরে যায়। এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে সূরা আলে ইমরানের ১২১-১৭৯ পর্যন্ত ৬০টি আয়াত নাযিল হয়।

৬। সারিইয়া রাজী‘: ৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। কুরায়েশরা ষড়যন্ত্র করে আযাল ও ক্বারাহ (عضل وقارة) গোত্রের সাতজন লোককে রাসূলের দরবারে পাঠায়। তারা গিয়ে আরয করে যে, আমাদের গোত্রের মধ্যে ইসলামের কিছু চর্চা রয়েছে। এক্ষণে তাদের অধিক তা‘লীমের প্রয়োজন। সেকারণ কয়েকজন উঁচু মর্তবার ছাহাবীকে পাঠালে আমরা উপকৃত হ’তাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সরল বিশ্বাসে তাদের গোত্রে আছেম বিন ছাবিতের নেতৃত্বে ১০ জন বুযর্গ ছাহাবীকে প্রেরণ করেন।

তারা রাবেগ ও জেদ্দার মধ্যবর্তী ‘রাজী’ নামক প্রস্রবণের নিকটে পৌঁছলে পূর্ব পরিকল্পনা মতে হুযায়েল গোত্রের শাখা বনু লেহিয়ানের ১০০ তীরন্দায তাদেরকে হামলা করে। যুদ্ধে আছেম সহ আটজন শহীদ হন এবং দুজন কে তারা মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়। তারা হলেন হযরত খোবায়েব বিন আদী ও যায়েদ বিন দাছনা। সেখানে ওকবা বিন হারেছ খোবায়েবকে এবং ছাফওয়ান বিন উমাইয়া যায়েদকে হত্যা করে বদর যুদ্ধে তাদের স্ব স্ব পিতৃহত্যার বদলা হিসাবে। শূলে চড়ার আগে খোবায়েব দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন এবং বলেন, আমি ভীত হয়েছি এই অপবাদ তোমরা না দিলে আমি দীর্ঘক্ষণ ছালাত আদায় করতাম। তিনিই প্রথম এই সুন্নাতের সূচনা করেন। অতঃপর কাফেরদের বদ দো‘আ করেন এবং সাত লাইনের মর্মন্তুদ কবিতা বলেন, যা ছহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন হাদীছ ও জীবনী গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। খোবায়েবের বদ দো‘আ ছিল নিম্নরূপ- ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে এক এক করে গুণে রাখ। তাদেরকে এক এক করে হত্যা কর এবং এদের একজনকেও বাকী রেখো না’।[2]

৭। সারিইয়া বিরে মাঊনা : ৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। পূর্বোক্ত ঘটনাটির চাইতে এটি ছিল আরও বেশী মর্মন্তুদ এবং দু’টি ঘটনা একই মাসে সংঘটিত হয়। নাজদের নেতা আবু বারা আমের বিন মালেকের আমন্ত্রণক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজদবাসীদের দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য মুনযির বিন আমের (রাঃ)-এর নেতৃতেব ৭০ জনের একটি দল প্রেরণ করেন। যাদের সকলে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় ক্বারী ও বিজ্ঞ আলেম। মাঊনা নামক কুয়ার নিকটে পৌঁছলে বনু সুলাইমের তিনটি গোত্র উছাইয়া, রে‘ল ও যাকওয়ান (চতুর্দিক হ’তে তাদের উপরে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে সবাইকে হত্যা করে। একমাত্র আমর বিন উমাইয়া যামরী রক্ষা পান মুযার গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে। এতদ্ব্যতীত কা‘ব বিন যায়েদ জীবিত ছিলেন। তাঁকে নিহতদের মধ্য থেকে উঠিয়ে আনা হয়। এই সময় রাসূলের পত্র বাহক হারাম বিন মিলহানকে প্রাপক গোত্র নেতা আমের বিন তোফায়েল-এর ইংগিতে অতর্কিতে পিছন থেকে বর্শাবিদ্ধ করে হত্যা করা হলে তিনি বলে ওঠেন, ‘আল্লাহু আকবর! কা‘বার রবের কসম! আমি সফল হয়েছি’। হারাম বিন মিলহানের মৃত্যুকালীন শেষ বাক্যটি হত্যাকারী জাববার বিন সুলমা -এর অন্তরে এমনভাবে দাগ কাটে যে, পরে তিনি মদীনায় গিয়ে রাসূলের নিকটে ইসলাম কবুল করেন।[3]

মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পরপর দু’টি হৃদয় বিদারক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দারুনভাবে ব্যথিত হন এবং বনু লেহিয়ান, রে‘ল ও যাকওয়ান এবং উছাইয়া গোত্র সমূহের বিরুদ্ধে এক মাস যাবত বদ দো‘আ করে ফজরের ছালাতে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।

৮। গাযওয়া বনু নাযীর : ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। মদীনার মুনাফিক ও মক্কার কুরায়েশ নেতাদের চক্রান্তে বনু নাযীরের ইহুদীরা চুক্তি ভঙ্গ করে এবং রাসূল (ছাঃ) তাদের কাছে এলে তারা তাঁকে শঠতার মাধ্যমে বসিয়ে রেখে দেওয়ালের উপর থেকে পাথর ফেলে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তখন সেখান থেকে ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। অতঃপর ছয় বা পনের দিন অবরোধের পরে তারা আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে মদীনা থেকে চিরদিনের মত বহিষ্কার করা হয় ও তারা খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। এ ঘটনা উপলক্ষে সূরা হাশর নাযিল হয়। এই যুদ্ধে ফাই-য়ের বিধান নাযিল হয়।

৯। গাযওয়া আহযাব বা খন্দকের যুদ্ধ : ৫ম হিজরীর শওয়াল ও যুলক্বা‘দাহ মাস। বিতাড়িত বনু নাযীর ইহুদী গোত্রের নেতাদের উস্কানীতে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কেনানাহ ও তেহামার মিত্র গোত্র সমূহ মিলে ৪০০০ কুরায়েশ বাহিনী এবং বনু গাত্বফান ও নাজদীদের ৬০০০ সৈন্যের সম্মিলিত বাহিনীর ১০,০০০ সৈন্য মদীনা অবরোধ করে। যা ছিল মদীনার মোট লোকসংখ্যার চাইতে বেশী। কিন্তু সালমান ফারেসীর পরামর্শক্রমে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনার উত্তর পার্শ্বে ওহোদের দিকে দীর্ঘ খন্দক বা পরিখা খনন করে তার পিছনে ৩০০০ সৈন্য সমাবেশ করেন। এই নতুন কৌশল দেখে কাফের বাহিনী হতচকিত হয়ে যায়। পরিখা অতিক্রম করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে উভয় পক্ষে তীর চালনায় ৬ জন মুসলিম ও ১০ জন কাফির মারা যায়। অতঃপর দীর্ঘ প্রায় এক মাস অবরোধে খাদ্যকষ্টে পতিত কাফের বাহিনীর উপরে হঠাৎ একরাতে উত্তপ্ত বায়ুর ঝড় নেমে আসে। তাতে তাদের তাঁবু সমূহ উড়ে যায় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে যায়। সম্মিলিত বাহিনীর এই পরাজয়ের ফলে সমগ্র আরবে মদীনা রাষ্ট্রের সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং সম্ভাব্য শত্রুরা মুখ লুকাতে বাধ্য হয়। কেননা আহযাব যুদ্ধের ন্যায় বিশাল বাহিনীর সমাবেশ ঘটানো পুনরায় আরবদের জন্য সম্ভবপর ছিল না।

১০। গাযওয়া বনু কুরায়যা : ৫ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ ও যিলহাজ্জ মাস। মদীনার সর্বশেষ এই ইহুদী গোত্রটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে আহযাব যুদ্ধে আক্রমণকারী বাহিনীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় ও তাদেরকে নানাভাবে সাহায্য করে। বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের নেতা হুয়াই বিন আখত্বাবের প্ররোচনায় তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। আহযাব যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় ফিরে আসেন যুলক্বা‘দাহ মাসের শেষ সপ্তাহের বুধবারে। এসে যোহরের সময় যখন তিনি উম্মে সালামার গৃহে গোসল করছিলেন, তখন জিব্রীলের আগমন ঘটে এবং তাকে তখনই বনু কুরায়যার উপরে হামলা পরিচালনার আহবান জানিয়ে বলেন, আপনি দ্রুত আসুন! আমি আগে গিয়ে দুর্গে কম্পন সৃষ্টি করে ওদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দিই’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাথে সাথে সবাইকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, যেন সবাই বনু কুরায়যায় গিয়ে আছর পড়ে। এই সময় রাসূলের সাথে ৩০০০ সৈন্য ছিলেন। ২৫ দিন অবরোধের পর তারা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের মিত্র সা‘দ বিন মু‘আযের সিদ্ধান্ত মতে তাদের বয়স্ক পুরুষ বন্দী ছয় থেকে সাত শতের মত লোককে হত্যা করা হয়। বাকীদের বহিষ্কার করা হয়। এই অবরোধকালে মুসলিম পক্ষে একজন শহীদ ও একজন স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে হযরত সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) মৃত্যু বরণ করেন। যিনি ইতিপূর্বে খন্দকের যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন।

১১। গাযওয়া হুদায়বিয়া : ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস। ১৪০০ (মতান্তরে ১৫০০) সাথী নিয়ে ওমরাহর উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ১লা যুলক্বা‘দাহ সোমবার স্ত্রী উম্মে সালামাহ সহ মদীনা হতে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত তাদের সাথে অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। কিন্তু মক্কার অদূরবর্তী হুদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে কুরায়েশ নেতাদের বাধার সম্মুখীন হন। অবশেষে তাদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে চুক্তির শর্তানুযায়ী তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং পরের বছর ওমরা করেন। এই সময় ‘আসফান’ নামক স্থানে সর্বপ্রথম ছালাতুল খাওফের হুকুম নাযিল হয় (নিসা ১০১-১০২)। কেননা খালেদ বিন ওয়ালীদ আছরের ছালাতের সময় ছালাতরত অবস্থায় মুসলমানদের উপরে হামলা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। উল্লেখ্য, খালিদ তখনও মুসলমান হননি।

১২। গাযওয়া খায়বর : ৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তির পর সকল ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি খায়বরের ইহুদীদের প্রতি এই অভিযান পরিচালিত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও বায়‘আতে রিযওয়ানে উপস্থিত ১৪০০ ছাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং এই অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যদের নেননি। এতে মুসলিম পক্ষে ১৮ জন শহীদ ও ৫০ জন আহত হন। ইহুদী পক্ষে ৯৩ জন নিহত হয়। ইহুদীদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাদের আবেদন মতে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ দেবার শর্তে তাদেরকে সেখানে বসবাস করার সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয়। যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গনীমত লাভ হয়। যাতে মুসলমানদের অভাব দূর হয়ে যায়। এই সময়ে ফিদাকের ইহুদীদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাইছাহ বিন মাসঊদকে প্রেরণ করেন। খায়বর বিজয়ের পরে তারা নিজেরা রাসূলের নিকটে দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং খায়বরবাসীদের ন্যায় অর্ধেক ফসলে সন্ধিচুক্তি করে। বিনাযুদ্ধে ও স্রেফ রাসূলের দাওয়াতে বিজিত হওয়ায় ফিদাক ভূমি কেবল রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।

১৩। সারিইয়া মুতা : ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মোতাবেক ৬২৯ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট অথবা সেপ্টেম্বর মাস। রোম সম্রাট ক্বায়ছারের পক্ষ হ’তে সিরিয়ার বালক্বায় নিযুক্ত গবর্ণর শোরাহবীল বিন আমর আল-গাসসানীর নিকটে পত্র সহ প্রেরিত রাসূলের দূত হারেছ বিন উমায়ের আযদীকে হত্যা করা হয়। যা ছিল তৎকালীন সময়ের রীতি-নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। এটা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। অতএব যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরিত হয়। পক্ষান্তরে শোরাহবীলের ছিল প্রায় ২ লাখ সৈন্যের এক বিশাল খৃষ্টান বাহিনী। বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নিকটবর্তী ‘মুতা’ নামক স্থানে সংঘটিত এই যুদ্ধে সেনাপতি যায়েদ বিন হারেছাহ, অতঃপর সেনাপতি জাফর বিন আবু ত্বালিব, অতঃপর সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা পরপর শহীদ হলে সকলের ঐক্যমতে খালিদ বিন ওয়ালীদ সেনাপতি হন। তিনি সম্মুখের দলকে পিছনে, পিছনের দলকে সম্মুখে ডাইনের দলকে বামে এবং বামের দলকে ডাইনে নিয়ে এক অপূর্ব রণকৌশলের মাধ্যমে মুসলিম বাহিনীকে সসম্মানে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনেন। নতুন সেনাদল যুক্ত হয়েছে ভেবে এবং মুসলমানেরা তাদেরকে মরু প্রান্তরে নিক্ষেপ করবে সেই ভয়ে রোমানরা পিছু হটে যায়। মুসলিম বাহিনীর মাত্র ১২ জন শহীদ হন। রোমক বাহিনীর হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও একা খালেদ বিন ওয়ালীদের যেখানে নয় খানা তরবারি ভেঙ্গেছিল, তাতে অনুমান করা চলে কত সৈন্য তাদের ক্ষয় হয়েছিল।

১৪। গাযওয়া ফাৎ হে মাক্কা বা মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ : ৮ম হিজরীর ১০ই রামাযান মঙ্গলবার ১০,০০০ ছাহাবী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনা হ’তে রওয়ানা হন এবং ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার আকস্মিকভাবে মক্কায় উপস্থিত হন ও একপ্রকার বিনা যুদ্ধে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়। মুসলিম পক্ষে দলছুট ২ জন শহীদ ও কাফের পক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে অগ্রবর্তী ১২ জন নিহত হয়। মক্কা বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ৬ষ্ঠ হিজরীর যুল-ক্বা‘দাহ মাসে অনুষ্ঠিত হোদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করার অপরাধেই কুরায়েশদের বিরুদ্ধে এই অভিযান পরিচালিত হয়।

১৫। গাযওয়া হোনায়েন বা হুনায়েন যুদ্ধ : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হাওয়াযেন ও ছাক্বীফ গোত্রের আত্মগর্বী নেতারা মক্কা হ’তে আরাফাতের দিকে ২৬ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে হুনায়েন উপত্যকায় মালেক বিন আওফের নেতৃত্বে ৪০০০ দুঃসাহসী সেনার সমাবেশ ঘটায়। ফলে মক্কা বিজয়ের ১৯তম দিনে ৬ই শাওয়াল শনিবার আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মক্কার ২০০০ নও মুসলিম সহ মোট ১২,০০০ সাথী নিয়ে হুনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ১০ই শাওয়াল বুধবার রাতে গিয়ে উপস্থিত হন। যুদ্ধে শত্রুপক্ষে ৭১ জন নিহত হয় ও মুসলিম পক্ষে ৬ জন শহীদ হন। যুদ্ধে বিশাল পরিমাণের গনীমত হস্তগত হয়।

১৬। গাযওয়া ত্বায়েফ : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হুনায়েন যুদ্ধে শত্রুপক্ষের নেতা মালেক বিন আওফ সহ পরাজিত ছাক্বীফ গোত্রের লোকেরা পালিয়ে গিয়ে ত্বায়েফের দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথমে খালিদের নেতৃত্বে ১০০০-এর একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে গমন করেন। তারা তায়েফের দুর্গ অবরোধ করেন। এই অবরোধ কতদিন স্থায়ী ছিল এ বিষয়ে ১৫ দিন থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত মতামত রয়েছে। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১২ জনের অধিক শহীদ হন ও অনেকে আহত হন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে ফিরে আসেন। এ সময় ছাহাবীগণ তাঁকে ছাক্বীফ গোত্রের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার আবেদন জানালে তিনি উত্তম দো‘আ করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি ছাক্বীফদের হেদায়াত কর এবং তাদেরকে নিয়ে এসো’।[18] আল্লাহ সেটাই কবুল করলেন এবং কিছুদিন পর তারা নিজেরা এসে ইসলাম কবুল করল।

১৭। গাযওয়া তাবূক : ৯ম হিজরীর রজব মাস। এটাই ছিল রাসূলের জীবনের শেষ যুদ্ধ এবং যা রোমকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এ সময় মুসলিম বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩০,০০০ এবং রোমকদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪০,০০০-এর বেশী। গত বছরে মুতার যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য তারা সরাসরি মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নেয়। তাতে মদীনার সর্বত্র রোমক ভীতির সঞ্চার হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রতিরোধে রোমান সীমান্ত অভিমুখে যাত্রা করলে তারা ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। রামাযান মাসে মুসলিম বাহিনী মদীনায় ফিরে আসে।

অভিযান সমূহ পর্যালোচনা:

অভিযানগুলির মধ্যে ১ হ’তে ৭২-এর মধ্যে মোট ২১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে কুরায়েশদের বিরুদ্ধে। ১১ হ’তে ৫৩-এর মধ্যে মোট ৮টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে ইহুদীদের বিরুদ্ধে। ৪৪ হ’তে ৮৬-এর মধ্যে ৬টি অভিযান খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে এবং ১০ হ’তে ৮৩-এর মধ্যে মোট ৫১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে নাজদ ও অন্যান্য এলাকার বেদুঈন গোত্র ও সন্ত্রাসী ডাকাত দলের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ২৪, ২৫ ও ৩৭ নং সারিইয়াহ তিনটি ছিল স্রেফ তাবলীগী কাফেলা এবং প্রতারণামূলকভাবে যাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়। বদর সহ প্রথম দিকের ৯টি অভিযান ছিল কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলা লুট করে তাদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি ভন্ডুল করার জন্য।

শুরুতে কুরায়েশদের মূল লক্ষ্য ছিল তাদের ভাষায় ছাবেঈ (صابئي) বা বিধর্মী মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথী মুষ্টিমেয় মুহাজিরদের নির্মূল করা এবং সেখানে আক্রোশটা ছিল প্রধানতঃ ধর্মবিশ্বাস গত। কিন্তু পরে তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মদীনা হয়ে সিরিয়ায় তাদের ব্যবসায়িক পথ কণ্টকমুক্ত করা। সেই সাথে ছিল তাদের বড়ত্বের অহংকার। কেননা মুহাম্মাদ তাদের বহিষ্কৃত সন্তান হয়ে তাদের চাইতে বড় হবে ও তাদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করবে, এটা ছিল তাদের নিকটে নিতান্তই অসহ্য। তাদের এই ক্ষুব্ধ ও বিদ্বেষী মানসিকতাকেই কাজে লাগায় ধূর্ত ইহুদী নেতারা ও অন্যান্যরা। ফলে মক্কা বিজয়ের পূর্বেকার মুসলিম অভিযানগুলির অধিকাংশ ছিল প্রতিরোধ মূলক।ইহুদীদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলি হয় তাদের চুক্তিভঙ্গের কারণে এবং অবিরত ভাবে তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে। খৃষ্টানদের কোন তৎপরতা মদীনায় ছিল না।মুতার যুদ্ধ ছিল সিরিয়া অঞ্চলে রোমক গবর্ণর শোরাহবীলের মুসলিম দূত হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে। তাবূক যুদ্ধ ছিল আগ্রাসী রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে এবং তার প্রেরিত বিশাল বাহিনীর মদীনা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। অবশেষে রোমকরা ভয়ে পিছু হটে গেলে কোন যুদ্ধ হয়নি।

পরিশেষে বলা চলে যে, ইসলামের দাওয়াত মক্কায় ছিল কেবল প্রচারমূলক। কিন্তু মদীনায় ছিল প্রচার ও প্রতিরোধ উভয় প্রকারের। যুগে যুগে ইসলামী দাওয়াতে উভয় নীতিই প্রযোজ্য হয়েছে। এখানে হারাম মাসে যুদ্ধ করার অনুমতিও পাওয়া গেছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে।

ফুটনোট ________________________________________
[1] রহমাতুল লিল আলামীন ১/১৩০।
[2] বুখারী হা/৩৯৮৯।
[3] রহমাতুল্লিল আলামীন ১/১১৪।
[4] মুসলিম ২/৮৯।
[5] মুসলিম, আনাস হ’তে ২/৮৯ পৃঃ।
[6] বুখারী ২/৬২৫ ও মুসলিম ২/১৪৫। মুবারকপুরী বলেন যে, চরিতকারগণ এটিকে ৮ম হিজরীর রজব মাসের ঘটনা বলে থাকেন। কিন্তু পূর্বাপর সম্পর্ক (السياق) বিবেচনায় দেখা যায় যে, এটি হুদায়বিয়ার পূর্বের ঘটনা। কেননা ৬ষ্ঠ হিজরীর যুল ক্বা‘দাহ মাসে হোদায়বিয়ার সন্ধি হওয়ার পরে কুরায়েশ কাফেলাকে হামলা করার জন্য আর কোন মুসলিম বাহিনী প্রেরিত হয়নি’।
[7] বুখারী, মানছূরপুরী এটা ধরেননি।
[8] বুখারী ২/৫৯২; মুসলিম ২/১১৮।
[9] মুবারকপুরী এটা ধরেননি। মানছুরপুরী সাল-তারিখ ও সেনা সংখ্যা বলেননি।
[10] মানছূরপুরী মুনক্বা‘আহ (منقعة) বলেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন, ৩/১৯৭।
[11] মুসনাদ আবু ইয়া‘লা হা/১৫২২ সনদ হাসান; মুসলিম হা/২৭৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ৪৩ অনুচ্ছেদ; বুখারী হা/৬৮৭২-এর ব্যাখ্যা, ফাৎহুল বারী ১২/২০৩; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৪৫০, ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়; মানছূরপুরী এটাকে পৃথক ‘খারবাহ অভিযান’ (سرية خربة) বলেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৭।
[12] মানছূরপুরী এটি ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাস লিখেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৫।
[13] কিন্তু মানছূরপুরী বলেন যে, মুসলিম বাহিনীর ১ জন আহত ও ৪৯ জন শহীদ হন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৮।
[14] নাসাঈ কুবরা হা/১১৫৪৭; তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ২/১৪৫-৪৬।
[15] আহমাদ হা/২১২৬৯, সনদ হাসান।
[16] বুখারী হা/৪৩৩৯; মিশকাত হা/৩৯৭৬ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৫ অনুচ্ছেদ।
[17] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪৩১; ছাহাবীগণের উচ্চ মর্যাদায় বর্ণিত উক্ত মর্মে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
[18] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪৮৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৯৮৬।

বদর যুদ্ধ, ক্বিবলা পরিবর্তন ও ঈদ-উল-ফিতরের উৎসব


যুদ্ধের অনুমতি

কুরায়েশদের সন্ত্রাসমূলক অপতৎপরতা ও প্রকাশ্যে হামলা সমূহ মুকাবিলার জন্য আল্লাহ পাক মুসলমানদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে এ সময় নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেন,

أُذِنَ لِلَّذِيْنَ يُقَاتَلُوْنَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوْا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيْرٌ-
‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হল ঐ লোকদের। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে, একারণে যে, তারা অত্যাচারিত হয়েছে। আর তাদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে অবশ্যই আল্লাহ ক্ষমতাবান’ (হজ্জ ২২/৩৯)।

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটাই প্রথম আয়াত, যা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে নাযিল হয়।[5] বস্ত্ততঃ জিহাদ হয়ে থাকে সন্ত্রাস দমনের জন্য। আর সন্ত্রাস হয় সমাজ ধ্বংসের জন্য। এই যুদ্ধ বা সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি দানের কারণ ছিল তিনটি :

(১) মুসলমানেরা ছিল মযলূম এবং হামলাকারীরা ছিল যালেম।
(২) মুহাজিরগণ ছিলেন নিজেদের জন্মস্থান ও বাসগৃহ হতে বিতাড়িত তাদের মাল-সম্পদ ছিল লুণ্ঠিত। তারা ছিলেন অপমানিত ও লাঞ্ছিত। স্রেফ বিশ্বাসগত পার্থক্যের কারণে। দুনিয়াবী কোন স্বার্থের কারণে নয় (হজ্জ ৪০)।
(৩) মদীনা ও আশপাশের গোত্রসমূহের সাথে রাসূলের সন্ধিচুক্তি ছিল। যাতে পরস্পরের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছিল। এক্ষণে পূর্বের ধারণা ও রীতি-নীতি পরিবর্তন করে মুসলমান হওয়ার কারণে অথবা মুসলমানদের সহযোগী হওয়ার কারণে যদি তাদের উপরে হামলা হয়, তাহলে চুক্তি ও সন্ধি রক্ষার স্বার্থে তাদের জান-মালের হেফাযতের জন্য রাসূলকে যালেমদের হামলা প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়াটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল।


ক্বিবলা পরিবর্তন

২য় হিজরীর শা‘বান মুতাবিক ৬২৪ খৃঃ ফেব্রুয়ারী মাসে ক্বিবলা পরিবর্তনের আদেশ সূচক আয়াতটি (বাক্বারাহ ১৪৪) নাযিল হয়। যাতে ১৬/১৭ মাস পরে বায়তুল মুক্বাদ্দাস হতে কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছালাত আদায়ের নির্দেশ জারি করা হয়। এই হুকুম নাযিলের মাধ্যমে কপট ইহুদীদের মুখোশ খুলে গেল। যারা মুসলমানদের কাতারে শামিল হয়েছিল স্রেফ ফাটল ধরানো ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য। একই সময়ে সূরা বাক্বারাহ ১৯০-১৯৩ আয়াত নাযিল হয়। যাতে বলা হয় وَأَخْرِجُوْهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوْكُمْ ‘যে স্থান হতে তারা তোমাদের বহিষ্কার করেছে, সে স্থান হতে তোমরাও তাদের বহিষ্কার কর’। বলা বাহুল্য ক্বিবলা পরিবর্তনের হুকুম নাযিলের পরে রাসূলের মধ্যে এবং সাধারণভাবে সকল মুসলমানের মধ্যে আশা ও আনন্দের ঢেউ জেগে ওঠে এবং তাদের অন্তরে মক্কায় ফিরে যাওয়ার আকাংখা ও উদ্দীপনা তীব্র হয়ে ওঠে, যা আসন্ন বদর যুদ্ধে তাদেরকে বিজয়ী হতে সাহায্য করে।


বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সিরিয়া ফেরত মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাদের পুরা খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তালহা বিন উবায়দুল্লাহ ও সাঈদ বিন যায়েদকে প্রেরণ করেন। তারা ‘হাওরা’ (الحوراء) নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন যে, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে বিরাট এক ব্যবসায়ী কাফেলা সতবর ঐ স্থান অতিক্রম করবে; যাতে রয়েছে এক হাযার উট বোঝাই কমপক্ষে ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রার মাল-সম্পদ এবং তাদের প্রহরায় রয়েছে আমর ইবনুল আছ সহ মাত্র ৪০ জন সশস্ত্র জোয়ান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চিন্তা করলেন যে, এই বিপুল মাল-সম্পদ মক্কায় পৌঁছে গেলে তার প্রায় সবই ব্যবহার করা হবে মদীনায় মুহাজিরগণকে ধ্বংস করার কাজে। অতএব আর মোটেই কালক্ষেপন না করে তখনই বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন ওই কাফেলাকে আটকানোর জন্য।


বদর যুদ্ধের বিবরণ

মাদানী বাহিনীর অগ্রযাত্রা : ২য় হিজরীর ১৭ রামাযান ৬২৪ খৃঃ ১১ মার্চ শুক্রবার (মানছূরপুরী ৩ মার্চ মঙ্গলবার বলেছেন)। অবশেষে ৮ অথবা ১২ই রামাযান তারিখে ৩১৩ জনের কাফেলা নিয়ে সাধারণ প্রস্ত্ততি সহ তিনি রওয়ানা হলেন। যার মধ্যে ৮২, ৮৩ বা ৮৬ জন ছিলেন মুহাজির এবং বাকীগণ ছিলেন আনছার। আনছারগণের মধ্যে ৬১ জন ছিলেন আউস গোত্রের এবং ১৭০ জন ছিলেন খাযরাজের। তিন শতাধিক লোকের এই বাহিনীতে মাত্র ২টি ঘোড়া ছিল যুবায়ের ইবনুল আওয়াম এবং মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদের এবং ৭০টি উট ছিল। রাসূল (ছাঃ), আলী ও মারছাদ বিন আবী মারছাদ গানাভীর জন্য একটি উট বরাদ্দ ছিল। যাতে পায়ে হাঁটার পালা আসলে রাসূল (ছাঃ) নিজেও হাঁটতেন। কাফেলার পতাকা বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মদীনার প্রথম দাঈ মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে। ইতিপূর্বেকার সকল পতাকার ন্যায় আজকের এ পতাকাও ছিল শ্বেত বর্ণের। ডান বাহুর সেনাপতি নিযুক্ত হন যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম এবং বাম বাহুর জন্য মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রাঃ)। পুরা বাহিনীতে এ দুজন েরই মাত্র দু’টি ঘোড়া ছিল। আর পশ্চাদ্ভাগের সেনাপতি নিযুক্ত হন ক্বায়েস ইবনু আবী ছা‘ছা‘আহ (রাঃ)। এতদ্ব্যতীত মুহাজিরগণের পতাকা বাহক হন আলী (রাঃ) এবং আনছারগণের সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ)। আর সার্বিক কম্যান্ডের দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)।


কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা

অন্যদিকে কুরায়েশ কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছিলেন। যাকেই পেতেন, তাকেই মদীনা বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি একটি সূত্রে জানতে পারলেন যে, কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য মুহাম্মাদ নির্দেশ দিয়েছেন। এ সংবাদে ভীত হয়ে আবু সুফিয়ান একজনকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন, যাতে দ্রুত সাহায্যকারী বাহিনী পৌঁছে যায়। এরপর বদর প্রান্তর অতিক্রম করার আগেই তিনি কাফেলা থামিয়ে দিয়ে নিজে অগ্রসর হন ও মদীনা বাহিনীর খবর নেন এবং জানতে পারেন যে, দুজন উষ্ট্রারোহীকে তারা দেখেছিল, যারা টিলার পাশে তাদের উট বসিয়ে মশকে পানি ভরে নিয়ে চলে গেছে। সুচতুর আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে টিলার পাশে গিয়ে উটের গোবর থেকে খেজুরের আটি খুঁজে পেয়ে বুঝে নিলেন যে, এটি মদীনার উট। ব্যস! তখনই ফিরে এসে কাফেলাকে নিয়ে বদরের পথ ছেড়ে ডান দিক দিয়ে উপকূলের পথে চলে গেলেন এবং এভাবে তিনি স্বীয় কাফেলাকে মদীনা বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হলেন। অতঃপর তিনি নিরাপদে পার হয়ে আসার খবর মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। যাতে ইতিপূর্বে পাঠানো খবরের রেশ ধরে তারা অহেতুক যুদ্ধে বের না হয়।


মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রা

কিন্তু এখবর যখন পৌঁছল, তখন আবু জাহলের নেতৃত্বে ১৩০০ মাক্কী ফৌজ রওয়ানা হয়ে জুহফা নামক স্থানে পৌঁছে গেছে। অতঃপর আবু সুফিয়ানের এ খবর পেয়ে মাক্কী বাহিনীর সবাই মক্কায় ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করল। কিন্তু আবু জাহলের অহংকারের ফলে কারু মতামত গ্রাহ্য হল না। তবু তার আদেশ অগ্রাহ্য করে আখনাস ইবনে শুরায়েক্ব-এর নেতৃত্বে বনু যোহরা গোত্রের ৩০০ লোক মক্কায় ফিরে গেল। বনু হাশেমও ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু মুহাম্মাদ-এর স্বগোত্র হওয়ায় তাদের উপরে আবু জাহলের কঠোরতা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশী। ফলে তারা ক্ষান্ত হন। অতঃপর আবু জাহল বদর অভিমুখে রওয়ানা হন এবং দর্পভরে বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা বদরে যাব ও সেখানে তিনদিন থাকব ও আমোদ-ফূর্তি করে পান ভোজন করব। এর ফলে সমগ্র আরব জাতির উপরে আমাদের শক্তি প্রকাশিত হবে ও সকলে ভীত হবে। এই সময় সব মিলিয়ে মাক্কী বাহিনীতে এক হাযার ফৌজ ছিল। তন্মধ্যে দু’শো অশ্বারোহী, ছয়শো লৌহবর্ম ধারী এবং গায়িকা বাঁদী দল তাদের বাদ্যযন্ত্রাদি সহ ছিল। প্রতি মনযিলে খাদ্যের জন্য তারা ১০টি করে উট যবেহ করত। উল্লেখ্য যে, মাক্কী বাহিনীতে বনু ‘আদী ব্যতীত মক্কার সকল গোত্রের লোক বা তাদের প্রতিনিধি যোগদান করেছিল। অথবা যোগদানে বাধ্য করা হয়েছিল। যেমন রাসূলের চাচা আববাস, হযরত আলীর দু’ভাই তালেব ও আক্বীল। রাসূলের জামাতা আবুল ‘আছ সহ বনু হাশেমের লোকেরা। কেননা আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলায় সকল গোত্রের লোকদের মালামাল ছিল।[8]

বাদরের প্রান্তরে মাক্কী বাহিনী যখন মাদানী বাহিনীর নিকটবর্তী হল, তখন আবু জাহল আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যকার অধিক আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী এবং অজানা বিপদ সমূহের আনয়নকারী যে দল, তুমি তাদেরকে আগামীকাল সকালে ধ্বংস করে দাও’। এভাবে তিনি নিজের প্রার্থনা দ্বারা নিজের উপর ধবংস ডেকে নিলেন।[18]


যুদ্ধ শুরু

কুরায়েশ পক্ষের জনৈক হঠকারী আসওয়াদ বিন আব্দুল আসাদ আল-মাখযূমী দৌড়ে এসে বলল, আমি এই হাউয থেকে পানি পান করব, অথবা একে ভেঙ্গে ফেলব অথবা এখানেই মরব’। তখন হামযা (রাঃ) এসে তার পায়ে আঘাত করলেন। এমতাবস্থায় সে পা ঘেঁষতে ঘেঁষতে হাউযের দিকে এগোতে লাগল। হামযা তাকে দ্বিতীয় বার আঘাত করলে সে হাউযেই মরে পড়ল ও তার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হল। এরপর যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠলো এবং সে যুগের নিয়ম অনুযায়ী কুরায়েশ পক্ষ মুসলিম পক্ষের বীরযোদ্ধাদের দ্বৈতযুদ্ধে আহবান করল।

তাদের একই পরিবারের তিনজন সেরা অশ্বারোহী বীর উৎবা ও শায়বাহ বিন রাবী‘আহ এবং অলীদ বিন উৎবা এগিয়ে এল। জবাবে মুসলিম পক্ষ হতে মু‘আয ও মু‘আবিবয বিন আফরা কিশোর দুই ভাই ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা তিনজন আনছার তরুণ যুবক বীরদর্পে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কুরায়েশ পক্ষ বলে উঠলো হে মুহাম্মাদ! আমাদের স্বগোত্রীয় সমকক্ষদের পাঠাও’।
তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, হে ওবায়দাহ, হে হামযাহ, হে আলী তোমরা যাও। অতঃপর আলী তার প্রতিপক্ষ অলীদ বিন উৎবাহকে, হামযাহ তার প্রতিপক্ষ শায়বাহ বিন রাবী‘আহকে এক নিমিষেই খতম করে ফেললেন। ওদিকে বৃদ্ধ ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ তার প্রতিপক্ষ উৎবা বিন রাবী‘আহর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হলেন। তখন আলী ও হামযাহ তার সাহায্যে এগিয়ে এসে উৎবাহকে শেষ করে দেন ও ওবায়দাহকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। কিন্তু অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে যুদ্ধশেষে মদীনায় ফেরার পথে ৪র্থ বা ৫ম দিন ওবায়দাহ শাহাদাত বরণ করেন।[22]
প্রথম আঘাতেই সেরা তিনজন বীরযোদ্ধা ও গোত্র নেতাকে হারিয়ে কুরায়েশ পক্ষ মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে আকুলভাবে নিম্নোক্ত প্রার্থনা করেন,

‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছিলে তা পূর্ণ কর। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণের প্রার্থনা জানাচ্ছি। … হে আল্লাহ! যদি এই ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আজকের দিনের পরে তোমার ইবাদত করার মত কেউ আর ভূপৃষ্ঠে থাকবে না’। তিনি প্রার্থনায় এমন আত্মভোলা ও বিনয়ী হয়ে ভেঙ্গে পড়লেন যে, তার স্কন্ধ হতে চাদর পড়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে আবুবকর ছুটে এসে তার চাদর উঠিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

হে রাসূল! যথেষ্ট হয়েছে, আপনার পালনকর্তার নিকটে আপনি চূড়ান্ত প্রার্থনা করেছেন’। এ সময় আয়াত নাযিল হল-

إِذْ تَسْتَغِيْثُوْنَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّيْ مُمِدُّكُمْ بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلآئِكَةِ مُرْدِفِيْنَ-
‘যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করলেন। আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাযার ফেরেশতা দ্বারা, যারা হবে ধারাবাহিক ভাবে অবতরণকারী’।[23]


ফেরেশতাগণের অবতরণ

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছালাত অবস্থায় এক সময় সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি হাসতে হাসতে জেগে উঠে বলেন,
আবুবকর! সুসংবাদ নাও। আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। ঐ যে জিব্রীল যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে টিলার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর তিনি سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ- (‘সত্বর দলটি পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালাবে’) ১৭ আয়াতটি পড়তে পড়তে সামিয়ানার বাইরে এলেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বাইরে এসে আঙ্গুলের ইশারা করে করে বলেন, ওটা আবু জাহলের বধ্যভূমি, ওটা অমুকের, ওটা অমুকের’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, তাদের কেউ ঐ স্থান অতিক্রম করতে পারেনি, যেখানে যেখানে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ইশারা করেছিলেন। [25]

তারপর তিনি এক মুষ্টি কংকরময় বালু হাতে নিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে ছুঁড়ে মারলেন আর বল্লেন, شاهت الوجوه ‘চেহারাগুলো বিকৃত হৌক’। ফলে শত্রুবাহিনীর মুশরিকদের এমন কেউ থাকলো না, যার চোখে ঐ বালু প্রবেশ করেনি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল ফেরেশতাদের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ সাহায্য। তাই আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَـكِنَّ اللهَ رَمَى-
‘তুমি যখন বালু নিক্ষেপ করেছিলে, প্রকৃতপক্ষে তা তুমি নিক্ষেপ করোনি, বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছিলেন’।[26]

বালু নিক্ষেপের পর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় বাহিনীকে জান্নাতের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বলেন,

قُوْمُوا إلَى جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ- ‘তোমরা এগিয়ে চলো ঐ জান্নাতের পানে যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত’। রাসূলের এ আহবান মুসলমানের দেহমনে ঈমানী বিদ্যুতের চমক এনে দিল। তিনি আরও বললেন, وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يُقَاتِلُهُمُ الْيَوْمَ رَجُلٌ فَيُقْتَلُ صَابِرًا مُحْتَسِبًا مُقْبِلًا غَيْرَ مُدْبِرٍ إلاَّ أَدْخَلَهُ اللهُ الْجَنَّةَ- ‘যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন নিহিত, তার কসম করে বলছি, যে ব্যক্তি আজকে দৃঢ়পদে নেকীর উদ্দেশ্যে লড়াই করবে, পিছপা হবে না, সর্বদা সম্মুখে অগ্রসর হবে, অতঃপর যদি সে নিহত হয়, তবে আল্লাহ তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’।

জান্নাত পাগল মুমিন মৃত্যুকে পায়ে দলে শতগুণ শক্তি নিয়ে সম্মুখে আগুয়ান হল। এমন সময় জনৈক ছাহাবী উমায়ের বিন হোমাম বাখ বাখ (بخ بخ) বলে উঠলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি জান্নাতবাসী হতে চাই’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সুসংবাদ দিয়ে বললেন, فَإِنَّكَ مِنْ أَهْلِهَا ‘নিশ্চয়ই তুমি তার অধিবাসী’। একথা শুনে ছাহাবী থলি হতে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। কিন্তু জান্নাত পাগল এই ছাহাবীর তর সইছে না। এক সময় বলে উঠলেন, لَئِنْ أَنَا حَيِّيْتُ حَتَّى آكُلَ تَمَرَاتِيْ هَذِهِ إِنَّهَا لَحَيَاةٌ طَوِيْلَةٌ، ‘যদি আমি এই খেজুরগুলি খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে সেটাতো দীর্ঘ জীবন হয়ে যাবে’ বলেই সমস্ত খেজুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে শহীদ হয়ে গেলেন’।[28]


ফেরেশতাগণের যুদ্ধে যোগদান

মুসলিম বাহিনীর এই হামলার প্রচন্ডতার সাথে সাথে যোগ হয় ফেরেশতাগণের হামলা। ইকরিমা বিন আবু জাহল (যিনি ঐ যুদ্ধে পিতার সাথে শরীক ছিলেন এবং মক্কা বিজয়ের পরে মুসলমান হন) বলেন, ঐদিন আমাদের লোকদের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যেতো, অথচ দেখা যেতো না কে মারলো (তাবাক্বাতে ইবনু সা‘দ)। আবু দাঊদ আল-মাযেনী বলেন, আমি একজন মুশরিক সৈন্যকে মারতে উদ্যত হব। ইতিমধ্যে তার ছিন্ন মস্তক আমার সামনে এসে পড়ল। আমি বুঝতেই পারলাম না, কে ওকে মারল’। রাসূলের চাচা আববাস যিনি বাহ্যিকভাবে মুশরিক বাহিনীতে ছিলেন, জনৈক আনছার তাকে বন্দী করে আনলে, তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে এ ব্যক্তি বন্দী করেনি। বরং যে ব্যক্তি বন্দী করেছে, তাকে এখন দেখতে পাচ্ছি না। তিনি একজন চুল বিহীন মাথাওয়ালা ও সুন্দর চেহারার মানুষ এবং বিচিত্র বর্ণের একটি সুন্দর ঘোড়ায় তিনি সওয়ার ছিলেন। [30]


মাক্কী বাহিনীর পলায়ন

সুরাক্বা বেশী ইবলীসের পলায়নে এবং মুসলিম বাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমনে পর্যুদস্ত মুশরিক বাহিনী প্রাণভয়ে পালাতে থাকল। এ দৃশ্য দেখে তাদের ধরে রাখার জন্য আবু জাহল তার লোকদের উদ্দেশ্যে জোরালো ভাষণ দিয়ে বলে উঠলো, সোরাক্বার পলায়নে তোমরা ভেঙ্গে পড়ো না। সে আগে থেকেই মুহাম্মাদের চর ছিল। ওৎবা, শায়বা, ওয়ালীদের মৃত্যুতেও ভীত হওয়ার কারণ নেই। কেননা তাড়াহুড়োর মধ্যে তারা মারা পড়েছেন। লাত ও উযযার শপথ করে বলছি, ওদেরকে শক্ত করে রশি দিয়ে বেঁধে না ফেলা পর্যন্ত আমরা ফিরে যাব না। অতএব তোমরা ওদেরকে মেরো না। বরং ধরো এবং বেঁধে ফেল’।

কিন্তু আবু জাহলের এই তর্জন-গর্জন অসার প্রমাণিত হল। বর্ষিয়ান ছাহাবী আব্দুর রহমান বিন ‘আওফকে আনছারদের বানু সালামাহ গোত্রের কিশোর দুভাই মু‘আয ও মু‘আউভিয বিন ‘আফরা পৃথকভাবে এসে জিজ্ঞেস করল ‘চাচাজী! আবু জাহল লোকটিকে আমাকে দেখিয়ে দিন। সে নাকি আমাদের রাসূলকে গালি দেয়’? তারা প্রত্যেকে পৃথকভাবে গোপনে এসে চাচাজীর কানে কানে একই কথা বলল। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ বলেন, আমি ওদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিন্তু ওরা নাছোড় বান্দা। ফলে বাধ্য হয়ে দেখিয়ে দিলাম। তখন ওরা দুজন তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং মু‘আয প্রথম আঘাতেই আবু জাহলের পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। এ সময় তার কাঁধে ইকরিমা বিন আবু জাহলের তরবারির আঘাতে মু‘আযের একটি হাত কেটে ঝুলতে থাকলে সে নিজের পা দিয়ে চেপে ধরে এক টানে সেটাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তারপর ছোট ভাই মু‘আউভিযের আঘাতে আবু জাহল ধরাশায়ী হলে তারা উভয়ে রাসূলের কাছে এসে গর্বভরে বলে উঠলো হে রাসূল! আবু জাহলকে আমি হত্যা করেছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমাদের তরবারি মুছে ফেলেছ কি? তারা বলল, না। তারপর উভয়ের তরবারি পরীক্ষা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, كلاكما قتله ‘তোমরা উভয়ে তাকে হত্যা করেছ’। অবশ্য এই যুদ্ধে মু‘আউভিয বিন আফরা পরে শহীদ হন এবং মু‘আয বিন আফরা হযরত ওছমানের খেলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।

জানা আবশ্যক যে, মু‘আয ও মু‘আউভিয উভয়ে তাদের বীরমাতা ‘আফরা’-র দিকে সম্বন্ধিত হয়ে ইবনু ‘আফরা নামে পরিচিত।[32]

পরে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ গিয়ে দেখেন আবু জাহলের তখনও নিঃশ্বাস চলছে। তিনি তার দাড়ি ধরে মাথা কেটে নেবার জন্য ঘাড়ে পা রাখলে সে বলে ওঠে, রে বকরীর রাখাল, তুই এতদূর বেড়ে গিয়েছিস? উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মক্কায় বকরীর রাখাল ছিলেন। তারপর বলল, ওহ্! আমাকে যদি (মদীনার) ঐ চাষারা হত্যা না করে অন্য কেউ হত্যা করতো![33] আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ তার মাথাটা কেটে নিয়ে রাসূলের দরবারে হাযির হলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলে ওঠেন,‘আল্লাহর শপথ, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। একথা তিনবার বলার পরে তিনি বললেন, ‘আল্লাহু আকবার, যাবতীয় প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য, যিনি তাঁর ওয়াদা বাস্তবায়িত করেছেন, তার বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং শত্রু সেনা দলকে একাই পরাভূত করেছেন’। এই দো‘আটি হজ্জ বা ওমরাহ কালে ছাফা-মারওয়া সাঈ করার শুরুতে ছাফা পাহাড়ে উঠে কা‘বা গৃহের দিকে ফিরে দু’হাত উঠিয়ে তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলার পর পাঠ করতে হয় মূলতঃ মক্কা বিজয়ের স্মৃতি মনে করিয়ে দেবার জন্য।[35]

এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার শহীদ হন। কাফের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয়। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধময় কূপে (القليب) নিক্ষেপ করা হয়। তাদের মধ্যে হিজরতের প্রাক্কালে মক্কায় রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহল সহ ১৪ নেতার ১১ জন এই যুদ্ধে নিহত হয়। বাকী তিনজন আবু সুফিয়ান, জুবায়ের বিন মুতব‘ইম ও হাকীম বিন হেযাম পরে মুসলমান হন।


যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে ফায়ছালা

রাসূল (ছাঃ)-এর আগমনের একদিন পরে বন্দীদের কাফেলা মদীনায় পৌছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে ছাহাবীগণের মধ্যে বণ্টন করে দেন এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের আদেশ দেন। তাঁর নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হয় এবং ছাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খাওয়ান। কেননা ঐ সময় মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল মূল্যবান খাদ্য। অতঃপর তিনি ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন। আবুবকর (রাঃ) তাদেরকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দিতে বলেন। কেননা এর ফলে কাফেরদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের হেদায়াত নছীব করতে পারেন এবং তারা আমাদের জন্য সাহায্যকারী হতে পারে। কিন্তু ওমর ফারূক (রাঃ) স্ব স্ব আত্মীয়কে স্ব স্ব হস্তে হত্যা করার পরামর্শ দেন। দয়ার নবী আবু বকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং অধিকাংশ বন্দীকে রক্তমূল্য নিয়ে ছেড়ে দেন।

রাসূলের জামাতা আবুল ‘আছের রক্তমূল্য বাবদ তাঁর কন্যা যয়নবের যে কণ্ঠহারটি পেশ করা হয়, তা ছিল হযরত খাদীজার দেওয়া। তা দেখে রাসূল (ছাঃ) কেঁদে ফেলেন এবং সবাইকে অনুরোধ করেন রক্তমূল্য ছাড়াই তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। বিনিময়ে কন্যা যয়নবকে মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়ার শর্ত করা হয় এবং তা যথারীতি পূরণ হয়।

বন্দী মুক্তির পরের দিনই সূরা আনফালের ৬৭ ও ৬৮ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে হযরত ওমরের পরামর্শের প্রতি আল্লাহর সমর্থন প্রকাশ পায়। যাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) ক্রন্দন করতে থাকেন। উক্ত আয়াতে বলা হয়,

مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ أَسْرَى حَتَّى يُثْخِنَ فِي الأَرْضِ تُرِيْدُوْنَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللهُ يُرِيْدُ الآخِرَةَ وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ- لَوْلاَ كِتَابٌ مِّنَ اللهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيْمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيْمٌ- (الأنفال
‘দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দী রাখা কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান আখেরাতের কল্যাণ। আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’। ‘আল্লাহর পক্ষ হতে পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ, তজ্জন্য তোমাদেরকে ভয়ংকর শাস্তি গ্রেফতার করত’(আনফাল ৮/৬৭-৬৮)।


বদর যুদ্ধের গুরুত্ব

(১) এটাই ছিল মুসলমানদের সাথে মুশরিকদের সর্বপ্রথম মুখোমুখি সশস্ত্র সংঘর্ষ।
(২) এটি ছিল ইসলামের টিকে থাকা না থাকার ফায়ছালাকারী যুদ্ধ
(৩) এটি ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী অথচ একটি অসম যুদ্ধ। এ কারণেই এ যুদ্ধের দিনটিকে পবিত্র কুরআনে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ‘ফায়ছালাকারী দিন’ (আনফাল ৮/৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে ।
(৪) বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন,

وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)।
(৫) বদরের যুদ্ধ ছিল কাফেরদের মূল কর্তনকারী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানকারী। এ যুদ্ধের পরে কাফের সমাজে এমন আতংক প্রবেশ করে যে, তারা আর কখনো বিজয়ের মুখ দেখেনি। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُّحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ- ‘আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে আর তোমরা কামনা করছিলে যাতে কোনরূপ কণ্টক ছাড়াই সেটা তোমাদের হাতে আসে। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় কালামের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফেরদের মূল কর্তন করে দিতে’। ‘যাতে করে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপীরা তাতে নাখোশ হয়’ (আনফাল ৮/৭-৮)।
(৬) এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। এমনকি মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলে বাধ্য হয়। শত্রুরা ভীত হয়ে চুপসে যায়।
(৭) বদরের যুদ্ধের বিজয় ছিল মক্কা বিজয়ের সোপান স্বরূপ। এই সময় শা‘বান মাস থেকে কা‘বার দিকে কিবলা পরিবর্তিত হয় এবং বদর যুদ্ধের মাত্র ছয় বছর পরেই ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান তারিখে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে যা পূর্ণতা লাভ করে।

ফুটনোট ________________________________________
[1] আবুদাঊদ, হা/৩০০৪, ‘খারাজ’ অধ্যায়।
[2] বুখারী, হা/৩৯৫০ ‘মাগাযী’ অধ্যায়, ২ পরিচ্ছেদ।
[3] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬১০৫।
[4] মায়েদাহ ৫/৬৭; তিরমিযী হা/৩৩২০ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[5] নাসাঈ, হা/৩০৮৫ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ১ অনুচ্ছেদ।
[6] রাহমাতুল লিল আলামীন ২/১৮৬।
[7] আর-রাহীক্ব ১৯৮।
[8] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬১৮-১৯।
[9] কাশশাফ, নাসাফী, বাহরুল মুহীত্ব, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আনফাল ১৯ আয়াত; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৮২।
[10] আহমাদ হা/৮৪৭; ছহীহাহ হা/৩৩৪০।
[11] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬১৫ পৃঃ।
[12] আনফাল ৮/৫-৬; ঐ, তাফসীর ইবনে কাছীর; ফাৎহুল বারী হা/৩৭৩৬ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; হায়ছামী বলেন, ত্বাবারাণী বলেছেন, সনদ হাসান।
[13] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬১৬-১৭; আহমাদ হা/৯৪৮ সনদ ছহীহ- আহমাদ শাকির।
[14] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২০-২১।
[15] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২২; বাক্বারাহ ২/২৪৯।
[16] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২৩; আল-বিদায়াহ ওয়ান নেহায়াহ ৩/২৬৯।
[17] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২১।
[18] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২৮।
[19] আর-রাহীক্ব পৃঃ ২১৬।
[20] হাকেম ২/৩২৮; কাশশাফ প্রভৃতি।
[21] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৭০-৭১।
[22] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৭২।
[23] তাফসীর সূরা আনফাল ৮/৯; তিরমিযী হা/৩০৮৯, সনদ হাসান।
[24] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২৭; বুখারী, মিশকাত হা/৫৮৭২-৭৩ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায় মু‘জেযা অনুচ্ছেদ-৭; ক্বামার ৫৪/৪৫।
[25] মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৭১।
[26] আনফাল ৮/১৭; হাদীছটির সনদ মুরসাল। কিন্তু ইবনু কাছীর বলেন, আয়াতটি যে বদর যুদ্ধের ঘটনায় নাযিল হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। বিদ্বানগণের নিকট যা মোটেই গোপন নয়। ঐ, তাফসীর; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬২৮।
[27] তাফসীর ত্বাবারী হা/১৫৮২৩, সনদ মুরসাল; তাফসীর ইবনু কাছীর আনফাল ১৭ আয়াত; মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৯১।
[28] মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
[29] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৩৩; মুসলিম মিশকাত হা/৫৮৭৪।
[30] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৩৩।
[31] তাফসীর ইবনে কাছীর, আনফাল ৪৮; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৮৩।
[32] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৩৪-৩৫; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪০২৮।
[33] মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪০২৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৭ অনুচ্ছেদ।
[34] সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৩৫-৩৬।
[35] মুক্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪০২৮-২৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায় ৭ অনুচ্ছেদ।

রাসূল (ছাঃ) -এর মাদানী জীবন


রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাদানী জীবনকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।

এক.

১লা হিজরী সনের ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খৃষ্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার হ’তে ৬ষ্ঠ হিজরীর যিলক্বা‘দ মাসে অনুষ্ঠিত হোদায়বিয়ার সন্ধি পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর। এই সময় কাফের ও মুনাফিকদের মাধ্যমে ভিতরে ও বাইরের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও সশস্ত্র হামলা সমূহ সংঘটিত হয়। ইসলামকে সমূলে উৎখাত করার জন্য এ সময়ের মধ্যে সর্বমোট ৪৮টি বড় ও ছোটখাট অনেকগুলি যুদ্ধ সংঘটিত ও অভিযান পরিচালিত হয়।

দুই.

মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে সন্ধি চলাকালীন সময়। যার মেয়াদকাল ৬ হিজরী থেকে ৮ হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয় পর্যন্ত প্রায় দু’বছর। এই সময়ে প্রধানতঃ ইহুদী ও তাদের মিত্রদের সাথে বড়-ছোট ২১টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

তিন.

৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর থেকে ১১ হিজরীতে রাসূলের মৃত্যু পর্যন্ত তিন বছর। এই সময়ে দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। চারদিক থেকে গোত্রনেতারা প্রতিনিধি দল নিয়ে মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদেশী রাজন্যবর্গের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দূত মারফত পত্র প্রেরণ করেন। এই সময়ে মানাত, উযযা, সুওয়া‘ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ মূর্তিগুলি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সময় হোনায়েন যুদ্ধ এবং রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে তাবূক যুদ্ধে গমন সহ বড়-ছোট ১৩টি অভিযান পরিচালিত হয়। এভাবে মাদানী জীবনের ১০ বছরে ছোট-বড় ৮২টি যুদ্ধ ও অভিযান পরিচালিত হয়। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে ইসলাম রাষ্ট্রীয় রূপ পরিগ্রহ করে এবং তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি সমূহকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকার মত শক্তিশালী অবস্থানে উপনীত হয়।

মদীনার সামাজিক অবস্থা :

মক্কা ও মদীনার সামাজিক অবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কার সমাজ ব্যবস্থাপনায় কুরায়েশদের একক প্রভুত্ব ছিল। ধর্মীয় দিক দিয়ে তাদের অধিকাংশ মূর্তি পূজারী ছিল।

পক্ষান্তরে মদীনায় সমাজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কারু একক কর্তৃত্ব ছিল না। ধর্মীয় দিক দিয়েও তারা এক ছিল না বা বংশধারার দিক দিয়েও এক ছিল না। ইহুদীদের চক্রান্তে আউস ও খাযরাজের মধ্যে বহুদিন ধরে যুদ্ধ চলে আসছিল। সর্বশেষ বু‘আছের যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে ধ্বংসকারী। যার পরেই তাদের আমন্ত্রণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করেন।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়াছরিবে এই সময় মূলতঃ দুদল লোক বসবাস করত। একদল ছিল ইয়াছরিবের আদি বাসিন্দা পৌত্তলিক মুশরিক সম্প্রদায়। যারা প্রধানতঃ আউস ও খাযরাজ দু’গোত্রে বিভক্ত ছিল।

দ্বিতীয় ছিল ইহুদী সম্প্রদায়। খৃষ্টানরা যাদেরকে মেরে-কেটে ফিলিস্তীন ও সিরিয়া এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা শেষনবীর আগমনের অপেক্ষায় এবং তাঁর নেতৃত্বে পুনরায় তাদের হৃত গৌরব ফিরে পাওয়ার আকাংখায় ইয়াছরিবে হিজরত করে এসেছিল বহুদিন পূর্বে। এরা ছিল হিব্রুভাষী। কিন্তু পরে আরবী ভাষী হয়। এদের প্রসিদ্ধ গোত্র ছিল তিনটি :

(১) বনু ক্বায়নুক্বা‘
(২) বনু নাযীর ও
(৩) বনু কুরায়যা।

এরা মদীনার উপকণ্ঠে তৈরী স্ব স্ব দুর্ভেদ্য দুর্গসমূহে বসবাস করত। সেই সময় ইয়াছরিবে পৌত্তলিক মুশরিক ও ইহুদীদের বাইরে কিছু সংখ্যক খৃষ্টানও বসবাস করত। চতুর্থ আরেকটি উপদল গড়ে উঠেছিল খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন উবাই ইবনে সুলূলের নেতৃত্বে।

মাক্কী ও মাদানী জীবনের প্রধান পার্থক্য সমূহ :

মাক্কী ও মাদানী জীবনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কায় জন্মস্থান হলেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানগণ সেখানে ছিলেন দুনিয়াবী শক্তির দিক দিয়ে পরাজিত ও নির্যাতিত। পক্ষান্তরে মাদানী জীবনের প্রথম থেকেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বাগডোর ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানদের হাতে। এখানে বিরোধীরা ছিল নিষ্প্রভ। ফলে মদীনার অনুকূল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে ইসলামকে পূর্ণতা দানের সুযোগ আসে। আল্লাহ্‌ বলেন -الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِيْنًا،
‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপরে আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)।

ইহুদীদের কপট চরিত্র :

হিজরতের পূর্ব থেকেই ইহুদীরা মক্কায় রাসূলের আবির্ভাব সম্পর্কে জানত। এখন যখন তিনি মদীনায় হিজরত করে এলেন এবং মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার পথ অবলম্বন করলেন। যার ফলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ও হিংসা-হানাহানিতে বিপর্যস্ত ইয়াছরিবের গোত্র সমূহের মধ্যকার শীতল সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ-মধুর ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকল, তখন তা ইহুদীদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল।

দুটি দৃষ্টান্ত :

(১) ইহুদী নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব সম্পর্কে তার কন্যা ছাফিয়াহ যিনি পরবর্তীতে রাসূলের স্ত্রী হয়ে উম্মুল মুমেনীন রূপে বরিত হন, তিনি বলেন, আমি আমার বাপ-চাচাদের নিকটে তাদের সকল সন্তানের মধ্যে অধিক প্রিয় ছিলাম এবং সকলের আগেই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে তারা আদর করতেন। যেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথম ইয়াছরিবে আগমন করেন ও ক্বোবায় বনু আমর বিন আওফের গোত্রে অবতরণ করেন, সেদিন অতি প্রত্যুষে আমার পিতা ও চাচা রাসূলের দরবারে উপস্থিত হন। অতঃপর সন্ধ্যার দিকে তারা ক্লান্ত ও অবসন্নচিত্তে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। আমি ছুটে তাদের কাছে গেলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম তারা এত চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন যে, আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। এ সময় আমি আমার চাচাকে বলতে শুনলাম তিনি আমার আববাকে বলছেন, ‘ইনিই কি তিনি? আববা বললেন,‘আল্লাহর কসম, ইনিই তিনি’। চাচা বললেন, ‘এখন তাঁর সম্পর্কে আপনার চিন্তা কী’? আববা বললেন, ‘স্রেফ শত্রুতা। আল্লাহর কসম যতদিন আমি বেঁচে থাকব’।

(২) আব্দুল্লাহ বিন সালাম-এর অনুসারীগণ : ক্বোবার পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ইয়াছরিবে বনু নাজ্জার গোত্রে অবতরণ করেন, তখন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন ইহুদীদের সবচেয়ে বড় আলেম আব্দুল্লাহ বিন সালাম। তিনি রাসূলকে এমন কিছু প্রশ্ন করলেন, যা নবী ব্যতীত কারু পক্ষে বলা সম্ভব নয়। রাসূলের নিকট থেকে সঠিক জবাব পেয়ে তিনি সাথে সাথে মুসলমান হয়ে গেলেন। তিনি রাসূলকে সাবধান করে দিলেন এই মর্মে যে, ‘ইহুদীরা হল মিথ্যা অপবাদ দানকারী এক ঘৃণিত সম্প্রদায়। আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করার আগেই যদি তারা আমার ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়টি জেনে ফেলে, তাহলে তারা আপনার নিকটে আমার সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিবে’।

তখন তিনি আব্দুল্লাহকে পাশেই আত্মগোপন করতে বলে ইহুদীদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি তাদের নিকটে আব্দুল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তারা বলল, ‘আমাদের নেতা এবং নেতার পুত্র নেতা। আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পুত্র’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ، আচ্ছা যদি আব্দুল্লাহ মুসলমান হয়ে যায়? তারা দুবার বা তিনবার বলল,‘আল্লাহ তাকে এ থেকে রক্ষা করুন’! অতঃপর আব্দুললাহ বিন সালাম গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চকণ্ঠে কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করলেন। এটা শোনামাত্র ইহুদীরা বলে উঠলো, ‘আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি ও নিকৃষ্ট ব্যক্তির পুত্র’।[4]

আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) তখন তাদেরকে বললেন, ‘হে ইহুদী সম্প্রদায়! আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহর কসম, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, নিশ্চয়ই তোমরা ভালভাবেই জানো যে, ইনি আল্লাহর রাসূল এবং তিনি অবশ্যই সত্য সহ আগমন করেছেন’। জবাবে তারা বলল,‘তুমি মিথ্যা বলছ’।[5]

মসজিদে নববীর নির্মাণ :

মদীনায় প্রবেশ করে রাসূলের উটনী যে স্থানে প্রথম বসে পড়েছিল, সেই স্থানটিই হল মসজিদে নববীর কেন্দ্রস্থল। স্থানটির মালিক ছিল দু’জন ইয়াতীম বালক। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দশ দীনার মূল্যে স্থানটি খরীদ করলেন। আবুবকর (রাঃ) মূল্য পরিশোধ করলেন।[6] ১৬ বা ১৭ মাস পরে ক্বিবলা পরিবর্তিত হলে উত্তর দেওয়ালের বদলে দক্ষিণ দেওয়ালের দিকে ক্বিবলা ঘুরে যায়। কেননা মক্কা হল মদীনা থেকে দক্ষিণ দিকে। মসজিদ নির্মাণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সশরীরে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নিজ হাতে ইট ও পাথর বহন করেন।

নবীগৃহ নির্মাণ : এই সময় মসজিদের পাশে একই নিয়মে কতগুলি ঘর তৈরী করা হয়। এগুলি ছিল নবীপত্নীগণের জন্য আবাসিক কক্ষ। এগুলি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আবু আইয়ূবের গৃহ ছেড়ে সপরিবারে এখানে চলে আসেন।

আযানের প্রবর্তন : মসজিদ নির্মিত হওয়ার পর মুছল্লীদের পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে আহবানের জন্য পরামর্শ সভা বসে। বিভিন্ন জনে বিভিন্ন পরামর্শ দেন। কিন্তু কোনরূপ সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক স্থগিত হয়ে যায়। পরে একই রাতে ১১ জন ছাহাবী বর্তমান আযানের স্বপ্ন দেখেন। পরদিন আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন আবদে রবিবহী (রাঃ) প্রথমে এসে রাসূলকে স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনালে তিনি উচ্চকণ্ঠের অধিকারী বেলালকে আযান দেওয়ার নির্দেশ দেন। আযানের ধ্বনি শুনে কাপড় ঘেঁষতে ঘেঁষতে ওমর (রাঃ) দৌড়ে এসে বললেন ‘হে রাসূল! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, সেই আল্লাহর কসম করে বলছি, আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি’।

আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন :

মসজিদে নববীর নির্মাণ কার্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, তাকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আনাস বিন মালেকের গৃহে আনছার ও মুহাজির উভয় দলের নেতৃস্থানীয় ৯০ জন ব্যক্তির এক আনুষ্ঠানিক বৈঠক আহবান করেন, যেখানে উভয় দলের অর্ধেক অর্ধেক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের (المؤاخاة الإسلامية) বন্ধন স্থাপন করেন এই শর্তে যে, ‘তারা পরস্পরের দুঃখ-বেদনার সাথী হবেন এবং মৃত্যুর পরে পরস্পরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন’। তবে উত্তরাধিকার লাভের শর্তটি ২য় হিজরীতে সংঘটিত বদর যুদ্ধের পর অবতীর্ণ আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে যায়। যেখানে বলা হয়, وَأُوْلُوا الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِيْ كِتَابِ اللهِ إِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ-
‘বংশ সম্পর্কীয় আত্মীয়গণ পরস্পরের অধিক হকদার আল্লাহর কিতাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে অধিক জ্ঞাত’(আনফাল ৮/৭৫)। তবে উত্তরাধিকার লাভের বিষয়টি রহিত হলেও তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল অটুট এবং অনন্য। বিশ্ব ইতিহাসে এইরূপ নিঃস্বার্থ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের কোন তুলনা নেই। দু’একটি দৃষ্টন্ত প্রদত্ত হল-

ভ্রাতৃত্বের নমুনা :

(১) আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাজির আব্দুর রহমান বিন আওফকে আনছার সা‘দ বিন রাবী‘-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করে দেন। অতঃপর সা‘দ তার মুহাজির ভাইকে বললেন, ‘আনছারদের মধ্যে আমি সর্বাপেক্ষা ধনী। আপনি আমার সম্পদের অর্ধেক গ্রহণ করুন এবং আমার দুজন স্ত্রীর মধ্যে যাকে আপনি পসন্দ করেন বলুন, তাকে আমি তালাক দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষে আপনি তাকে বিবাহ করবেন’। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দো‘আ করলেন, ‘আল্লাহ আপনার পরিবারে ও ধন-সম্পদে বরকত দান করুন’! আপনি আমাকে আপনাদের বাজার দেখিয়ে দিন। অতঃপর তাঁকে বনু ক্বায়নুক্বা-র বাজার দেখিয়ে দেওয়া হল। তিনি সেখানে গিয়ে পনীর ও ঘি-এর ব্যবসা শুরু করলেন এবং কিছু দিনের মধ্যে সচ্ছলতা লাভ করলেন। এক সময় তিনি বিয়ে-শাদীও করলেন।[12]

(২) খেজুর বাগান ভাগ করে দেবার প্রস্তাব : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আনছারগণ একদিন রাসূলের কাছে এসে নিবেদন করল যে, আপনি আমাদের খেজুর বাগানগুলি আমাদের ও মুহাজির ভাইগণের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করে দিন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। তখন তারা বলল যে, তবে এমন করুন যে, মুহাজির ভাইগণ আমাদের কাজ করে দেবেন এবং আমরা ফলের অংশ দিব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে সম্মত হলেন।[13]

(৩) জমি বণ্টনের প্রস্তাব : বাহরায়েন এলাকা বিজিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এখানকার পতিত জমিগুলি আনছারদের অনুকূলে বরাদ্দ দিতে চাইলে তারা আপত্তি করে বলল, আমাদের মুহাজির ভাইদের উক্ত পরিমাণ জমি বরাদ্দ দেওয়ার পরে আমাদের দিবেন। তার পূর্বে নয়।[14]

ফুটনোট ________________________________________
[1] আর রাহীক্ব ১৩৫।
[2] বুখারী হা/৩৯৪১, ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৫২ অনুচ্ছেদ।
[3] ফাৎহুল বারী হা/… ৭/২৭৫।
[4] বুখারী, মিশকাত হা/৫৮৭০, ‘রাসূল (সাঃ)-এর মর্যাদা অধ্যায়, ‘মু‘জিযা’ অনুচ্ছেদ।
[5] বুখারী হা/৩৯১১ ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৪৫ অনুচ্ছেদ।
[6] কুতুবুদ্দীন, তারীখুল মদীনা আল-মুনাওয়ারাহ, পৃঃ ৯২।
[7] তারীখুল মদীনা আল-মুনাওয়ারাহ, পৃঃ ৯২-৯৩।
[8] তারীখুল মদীনা আল-মুনাওয়ারাহ, পৃঃ ৯৩।
[9] তাহযীবুত তাহযীব ১২/২৪০ পৃঃ; মিশকাত হা/৮৩৯।
[10] আর-রাহীক্ব পৃঃ ১৮৪।
[11] ছহীহ আবুদাঊদ হা/৪৬৯; ঐ, আওন সহ হা/৪৯৫।
[12] বুখারী, হা/৩৭৮০-৮১ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৩৩ অনুচ্ছেদ ও হা/২৬৩০ ‘হেবা’ অধ্যায়, ৩৫ অনুচ্ছেদ।
[13] ঐ, হা/৩৭৮২।
[14] বুখারী হা/২৩৭৬ ‘জমি সেচ করা’ অধ্যায়, ১৪ অনুচ্ছেদ।

রাসূল (ছাঃ) -কে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং মদীনায় হিজরত


ছাহাবীগণের ইয়াছরিবে কষ্টকর হিজরত শুরু :

বায়‘আতে কুবরা সম্পন্ন হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্যাতিত মুসলমানদের ইয়াছরিবে হিজরতের অনুমতি দিলেন। মক্কার কাফেররা ইয়াছরিবে হিজরতে বাধা দিতে থাকল। ইসলামের প্রসার বৃদ্ধিতে বাধা দেওয়া ছাড়াও এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক।

অর্থনৈতিক কারণ ছিল এই যে, মক্কা থেকে ইয়াছরিব হয়ে সিরিয়ায় তাদের গ্রীষ্মকালীন ব্যবসা পরিচালিত হত। এ সময় সিরিয়ায় তাদের বার্ষিক ব্যবসার আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ দীনার। এছাড়াও ছিল ত্বায়েফ-এর ব্যবসা। উভয় ব্যবসার জন্য যাতায়াতের পথ ছিল ইয়াছরিব। আল্লাহ পাক এমন এক স্থানে নির্যাতিত মুসলমানদের হিজরতের ব্যবস্থা করেন, যা হয়ে ওঠে এক অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ভূমি।

এই হিজরতের রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল এই যে, ইয়াছরিবে মুহাজিরগণের অবস্থান সুদৃঢ় ে এবং ইয়াছরিববাসীগণ ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিলে তা মক্কার মুশরিকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিবে। ফলে তা মক্কাবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। যাতে তাদের জান-মাল ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু হুমকির মধ্যে পড়বে। হযরত আবুবকর (রাঃ) হিজরতের মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে নিষেধ করে বলেন, ‘থেমে যাও! আমি আশা করছি যে, আমাকেও অনুমতি দেওয়া হবে’। এভাবে রাসূল, আবুবকর ও আলী ব্যতীত মক্কায় আর কোন মুসলমান অবশিষ্ট থাকলেন না।

রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র কুরায়েশ নেতারা বায়‘আতে কুবরা-র প্রায় আড়াই মাস পর চতুর্দশ নববী বর্ষের ২৬শে ছফর মোতাবেক ১২ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খৃষ্টাব্দ বৃহস্পতিবার দিনের প্রথম ভাগে তাদের অবিসংবাদিত সাবেক কুরায়েশ নেতা কুছাই বিন কিলাব প্রতিষ্ঠিত বৈঠক ঘর দারুন নাদওয়াতে কুরায়েশ-এর অধিকাংশ গোত্রনেতাদের এক যরূরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, এই বৈঠকে রাসূলের গোত্র বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিবকে ডাকা হয়নি। কুরায়েশ সাত গোত্রের ১৪ জন নেতা দারুন নাদওয়াতে পূর্বাহ্নে বসে আলোচনা শুরু করে। আবু জা প্রস্তাব দিয়ে বলল, প্রতি গোত্র থেকে একজন করে সুঠামদেহী যুবক বাছাই করে তাদেরকে তরবারি দেওয়া হৌক। অতঃপর তারা এসে একসাথে আঘাত করে তাকে শেষ করে দিক। এতে তিনটা লাভ হবে।
এক- আমরা তার হাত থেকে বেঁচে যাব।
দুই- তার গোত্র আমাদের সব গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহস করবে না।
তিন- একজনের রক্তমূল্য বাবদ একশত উট আমরা সব গোত্র ভাগ করে দিয়ে দেব। যা কারু জন্য কষ্টকর হবে না’।
আবু জাের এই প্রস্তাবকে সকলে সানন্দে কবুল করল এবং এর উপরেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সবাই নিষ্ক্রান্ত হ’ল।

ষড়যন্ত্রকারী ১৪ জন নেতার পরিণতি : উপরোক্ত ১৪ জন নেতার মধ্যে ১১ জন মাত্র দু’বছর পরে ২য় হিজরীর ১৭ রামাযানে সংঘটিত বদরের যুদ্ধে একদিনেই নিহত হয়। বাকী তিনজন জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম, হাকীম বিন হেযাম ও আবু সুফিয়ান ইবনু হারব পরবর্তীতে মুসলমান হয়ে যান। আল্লাহ বলেন,

إِنَّهُمْ يَكِيدُوْنَ كَيْداً، وَأَكِيدُ كَيْداً-
‘তারা জোরালো কৌশল করেছিল। আর আমিও কৌশল করি’। ‘অতএব কাফেরদের … কিছুদিনের জন্য অবকাশ দিন’ (ত্বারেক ৮৬/১৫-১৭)।


রাসূলের গৃহ অবরোধ ও হিজরত :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার নির্দয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর নেতারা সারা দিন প্রস্ত্ততি নিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা অন্ধকার রাতে এসে চারদিক থেকে বাড়ী ঘেরাও করে ফেলে। যাতে মধ্য রাত্রির পরেই হামলা করে নবীকে ঘুমন্ত অবস্থায় শেষ করে দেয়া যায়। এই অবরোধ কার্যে সশরীরে অংশ নেয় মোট ১১ জন।

আল্লাহর কৌশল :

কাফেররা তাদের কৌশলে পাকাপোক্ত ছিল। ওদিকে আল্লাহর কৌশল ছিল অন্যরূপ। যেমন তিনি বলেন,

وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِيُثْبِتُوْكَ أَوْ يَقْتُلُوْكَ أَوْ يُخْرِجُوْكَ وَيَمْكُرُوْنَ وَيَمْكُرُ اللهُ وَاللهُ خَيْرُ الْمَاكِرِيْنَ-
‘স্মরণ কর সেই সময়ের কথা, যখন কাফেররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল এজন্য যে, তোমাকে বন্দী করবে অথবা হত্যা করবে অথবা বিতাড়িত করবে। এভাবে তারা নিজেদের ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিল, আর আল্লাহ স্বীয় কৌশল করছিলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ হ’লেন শ্রেষ্ঠ কেŠশলী’ (আনফাল ৮/৩০)।

পূর্বাহ্নে যখন দারুন নাদওয়াতে রাসূলকে হত্যার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তখনই জিব্রীল মারফত রাসূলকে তা জানিয়ে দেওয়া হয় এবং রাতে নিজ শয্যায় ঘুমাতে নিষেধ করা হয়। এতেই হিজরতের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুপুরেই আবুবকর (রাঃ)-এর গৃহে তাশরীফ আনেন এবং হিজরতের সময়-সূচী ও অন্যান্য আলোচনা সম্পন্ন করেন। সেমতে আবুবকর (রাঃ) পূর্ণ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। রাত্রি বেলায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হযরত আলীকে তাঁর বিছানায় শুতে বলেন এবং তাঁর নিকটে রক্ষিত প্রতিবেশীদের আমানত সমূহ যথাস্থানে ফেরত দেবার দায়িত্ব দেন।

হিজরত শুরু :

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মধ্যরাতের সামান্য পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এবং শত্রুদের মাথার উপরে এক মুঠি কংকরযুক্ত মাটি ছড়িয়ে দিলেন সূরা ইয়াসীনের ৯নং আয়াতটি পাঠ করে (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬)। যেখানে বলা হয়েছে,

وَجَعَلْنَا مِنْ بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ سَدّاً وَّمِنْ خَلْفِهِمْ سَدّاً فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُوْنَ-
‘আর আমরা তাদের সম্মুখে ও পিছনে প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করালাম। অতঃপর তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেললাম। ফলে তারা দেখতে পেল না’ (ইয়াসীন ৩৬/৯)।

তিনি নির্বিঘ্নে বেরিয়ে এসে আবু বকরের গৃহে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর তাকে নিয়ে উত্তরমুখী ব্যস্ত পথ ছেড়ে দক্ষিণ মুখী ইয়ামানের পথ ধরে পদব্রজে যাত্রা করলেন। অতঃপর মক্কার দক্ষিণ-পূর্বে ৩ কি:মি: দূরত্ব পাড়ি দিয়ে অন্ধকার থাকতেই ছওর পাহাড়ে পৌছে গেলেন। অতঃপর পাহাড়ের পাদ দেশে পৌঁছে আবুবকর রাসূলকে কাঁধে উঠিয়ে নেন ও ধারালো পর্বতগাত্র বেয়ে উঠে খাড়া পাহাড়টির শীর্ষদেশে একটি গুহা মুখে উপনীত হন। যাতে তার দু’পা ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। আবুবকর প্রথমে একাকী অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করে অতিরিক্ত একটি কাপড় ছিঁড়ে ছোট ছোট ছিদ্র মুখগুলো বন্ধ করে দিলেন। তারপর রাসূলকে ভিতরে ডেকে নিলেন। এই গুহাটিই ইতিহাসে ‘গারে ছওর’ নামে পরিচিত। সেখানে তাঁরা শুক্রবার, শনিবার ও রবিবার তিনদিন তিন রাত অবস্থান করেন।

গৃহ থেকে গুহা- কিছু ঘটনাবলী :

(১) অবরোধকারীদের প্রতিক্রিয়া : রাসূলের গৃহ অবরোধকারীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় প্রহর গুণছে মধ্যরাত্রি পার হওয়ার। ওদিকে তার আগেই রাসূল (ছাঃ) তাদের সামনে দিয়ে চলে গেছেন। অথচ ওরা টেরই পায়নি। সকাল পর্যন্ত সেখানেই অপেক্ষা করল। কিন্তু পরে তারা আলীকে দেখে হতাশ হয়ে গেল। রাগে ও ক্ষোভে তারা আলীকে মারতে মারতে কা‘বা গৃহ পর্যন্ত নিয়ে কিছু সময় আটকে রেখে পরে ছেড়ে দেয়। এরপর তারা আসে আবু বকরের গৃহে। সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেও কিছু জানতে না পেরে নরাধম আবু জা ছোট্ট মেয়ে আসমা বিনতে আবুবকরের মুখে এমন জোরে চপেটাঘাত করে যে, তার কানের দুল ছিঁড়ে পড়ে যায় এবং কানের লতি ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়।

(২) মক্কা ত্যাগকালে রাসূলের প্রতিক্রিয়া : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মক্কা থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন, তখন মক্কার জনবসতি ও বায়তুল্লাহকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘হে মক্কা নগরী! দুনিয়ার সমস্ত নগরীর চাইতে তুমিই আমার কাছে অধিক প্রিয়। যদি মক্কার লোকেরা আমাকে বের করে না দিত, তবে আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে কখনো পরিত্যাগ করতাম না’। এই সময় যে আয়াতটি নাযিল হয় তা নিম্নরূপ-

وَكَأَيِّنْ مِّنْ قَرْيَةٍ هِيَ أَشَدُّ قُوَّةً مِّنْ قَرْيَتِكَ الَّتِيْ أَخْرَجَتْكَ أَهْلَكْنَاهُمْ فَلاَ نَاصِرَ لَهُمْ-
‘যে জনপদ তোমাকে বহিষ্কার করেছে, তার চাইতে কত শক্তিশালী জনপদকে আমরা ধ্বংস করেছি। অতঃপর তাদেরকে সাহায্য করার কেউ ছিল না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৩)।

(৩) গুহার মুখে শত্রু দল : রাসূলকে না পেয়ে কোরায়েশ নেতারা চারিদিকে অনুসন্ধানী দল পাঠায় এবং ঘোষণা করে দেয় যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ ও আবুবকরকে বা দুজনের কাউকে জীবিত বা মৃত ধরে আনবে তাকে একশত উট পুরস্কার দেওয়া হবে। সন্ধানী দল এক সময় ছওর গুহার মুখে গিয়ে পৌঁছে। এমনকি আবুবকর (রাঃ) তাদের পা দেখতে পান। তাদের কেউ নীচের দিকে তাকালেই তাদের দেখতে পেত। ফলে তিনি রাসূলের জীবন নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, لاَ تحزن إن الله معنا ‘দুঃখিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। বিষয়টির বর্ণনা আল্লাহ দিয়েছেন এভাবে-

إِلاَّ تَنْصُرُوْهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَار إِذْ يَقُوْلُ لِصَاحِبِهِ لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا فَأَنزَلَ اللهُ سَكِيْنَتَهُ عَلَيْهِ وَأَيَّدَهُ بِجُنُوْدٍ لَّمْ تَرَوْهَا وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِيْنَ كَفَرُواْ السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللهُ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌِ-
‘যদি তোমরা তাকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফেররা তাকে বহিষ্কার করেছিল। তিনি ছিলেন দু’জনের একজন। যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় ‘সাকীনাহ’ (প্রশান্তি) নাযিল করলেন এবং তার সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখোনি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কাফেরদের মাথা নীচু করে দিলেন আর আল্লাহর কথা সদা সমুন্নত। আল্লাহ েন পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৪০)।

রক্তপিপাসু শত্রুকে সামনে রেখে ঐ সময়ের ঐ নাযুক অবস্থায় ‘দুঃখিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’ এই ছোট্ট কথাটি মুখ দিয়ে বের হওয়া কেবলমাত্র তখনই সম্ভব, যখন একজন মানুষ সম্পূর্ণ রূপে কায়মনোচিত্তে আল্লাহর উপরে নিজেকে সোপর্দ করে দেন।

গুহা থেকে মদীনা :

তিনদিন ধরে খোঁজাখুজির পর ব্যর্থ মনোরথ হয়ে কাফেররা একপ্রকার রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। আব্দুল্লাহর (আবুবকরের (রাঃ) পুত্র) মাধ্যমে সব খবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এবার ইয়াছরিব যাত্রার নির্দেশ দিলেন। এজন্য আবুবকর (রাঃ) পূর্বেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। দুটি হৃষ্ট-পুষ্ট উট তিনি ঠিক করেছিলেন। তাছাড়া রাস্তা দেখানোর জন্য দক্ষ পথ প্রদর্শক আব্দুল্লাহ বিন আরীক্বত লায়ছীকে উপযুক্ত মজুরীর মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। যদিও সে তখন কাফেরদের দলভুক্ত ছিল। চুক্তি মতে সে চতুর্থ রাত্রিতে দুটি উট নিয়ে যথাসময়ে উপস্থিত । একটি উটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) এবং অন্যটিতে গোলাম আমের বিন ফুহায়রা ও পথপ্রদর্শক আব্দুল্লাহ বিন আরীক্বত সওয়ার েন।
পথ প্রদর্শক আব্দুল্লাহ ইয়াছরিব যাওয়ার পরিচিত পথ ছেড়ে লোহিত সাগরের উপকূলের দিকে ইয়ামনের পথ ধরে চললেন। অতঃপর এমন এক পথে গেলেন, যে পথের সন্ধান সাধারণভাবে কেউ জানত না।

ছওর গুহা থেকে মদীনা :

পথিমধ্যের কিছু ঘটনা
(১) যাত্রাবস্থায় আবুবকর (রাঃ) সর্বদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পিছনে বসেন। কেননা আবুবকরের মধ্যে বার্ধক্যের চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু রাসূলের চেহারা-ছূরতে তখনো ছিল যৌবনের চাকচিক্য। তাই রাস্তায় লোকেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে মুরববী ভেবে আবু বকরকেই করতো। সামনের লোকটির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলতেন, এ ব্যক্তি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন’।[5] এর দ্বারা তিনি হেদায়াতের পথ বুঝাতেন। কিন্তু লোকেরা ভাবত রাস্তা দেখানো কোন লোক হবে। এর দ্বারা তিনি রাসূলের পরিচয় গোপন করতেন।

(২) উম্মে মা‘বাদের তাঁবুতে : খোযা‘আহ গোত্রের খ্যাতনাম্নী অতিথিপরায়ণ মহিলা উম্মে মা‘বাদের খীমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পানাহারের কিছু আছে কি-না? ঐ মহিলার অভ্যাস ছিল তাঁবুর বাইরে বসে থাকতেন মেহমানের অপেক্ষায়। মেহমান পেলে তাকে কিছু না খাইয়ে ছাড়তেন না। কিন্তু এইদিন এমন হয়েছিল যে, বাড়ীতে পানাহারের মত কিছুই ছিল না। ঐ সময়টা ছিল ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সময়। বকরীগুলো সব মাঠে নিয়ে গেছে স্বামী আবু মা‘বাদ। একটা কৃশ দুর্বল বকরী যে মাঠে যাওয়ার মত শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, সেটা তাঁবুর এক কোনে বাঁধা ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটাকে দোহন করার অনুমতি চাইলেন। উম্মে মা‘বাদ বললেন, ওর পালানে কিছু থাকলে আমিই আপনাদের দোহন করে দিতাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বকরীটির বাঁটে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে হাত রাখলেন ও বরকতের দো‘আ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইচ্ছায় বকরীটির পালান দুধে পূর্ণ হয়ে গেল। তারপর তিনি দোহন করতে থাকলেন। তাতে দ্রুত পাত্র পূর্ণ হয়ে গেল। প্রথমে বাড়ীওয়ালী উম্মে মা‘বাদকে পান করালেন। তারপর সাথীদের এবং সবশেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে পান করলেন। এরপরে এক পাত্র পূর্ণ করে উম্মে মা‘বাদের কাছে রেখে তারা পুনরায় যাত্রা করলেন। অল্পক্ষণ পরেই আবু মা‘বাদ বাড়ীতে ফিরে সব ঘটনা শুনে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠলো- ‘আল্লাহর কসম! ইনিতো কুরায়েশদের সেই মহান ব্যক্তি। যাঁর সম্পর্কে লোকেরা বিভিন্ন কথা বলে থাকে। আমার দৃঢ় ইচ্ছা আমি তার সাহচর্য বরণ করি এবং সুযোগ পেলে আমি তা অবশ্যই করব’।

(৩) সুরাক্বা বিন মালেকের পশ্চাদ্ধাবন : বনু মুদলিজ গোত্রের নেতা সুরাকা বিন মালেক বিন জু‘শুম জনৈক ব্যক্তির কাছে রাসূল গমনের সংবাদ শুনে পুরস্কারের লোভে দ্রুতগামী ঘোড়া ও তীর-ধনুক নিয়ে রাসূলের পিছে ধাওয়া করল। কিন্তু কাছে যেতেই ঘোড়ার পা দেবে গিয়ে সে চলন্ত ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ল। তখন তীর ছুঁড়তে গিয়ে তার পসন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না। ইতিমধ্যে মুহাম্মাদী কাফেলা অনেক দূরে চলে গেল। সে পুনরায় ঘোড়া ছুটালো। কিন্তু এবারও একই অবস্থা । কাছে পৌঁছতেই ঘোড়ার পা এমনভাবে দেবে গেল যে, তা আর উঠাতে পারে না। আবার সে তীর বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু আগের মতই ব্যর্থ । তার পসন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না। তখনই তার মনে ভয় উপস্থিত হল এবং এ বিশ্বাস দৃঢ় হল যে, মুহাম্মাদকে নাগালে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে তখন রাসূলের নিকটে নিরাপত্তা প্রার্থনা করল। এ আহবান শুনে মুহাম্মাদী কাফেলা থেমে গেল। সে কাছে গিয়ে রাসূলকে কিছু খাদ্য-সামগ্রী ও আসবাবপত্র দিতে চাইল। রাসূল (ছাঃ) কিছুই গ্রহণ করলেন না। সুরাকা বলল, আমাকে একটি ‘নিরাপত্তা নামা’ (كتاب أمن) লিখে দিন। তখন রাসূলের হুকুমে আমের বিন ফুহায়রা একটি চামড়ার উপরে তা লিখে দিলেন। অতঃপর রওয়ানা হলেন।[8]লাভ হল এই যে, ফেরার পথে সুরাকা অন্যান্যদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল, যারা রাসূলের পিছু নিয়েছিল। এভাবে দিনের প্রথম ভাগে যে ছিল রক্ত পিপাসু দুশমন, দিনের শেষভাগে সেই হল দেহরক্ষী বন্ধু।

সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-কেনানী যখন তার রাবেগ এলাকায় ফিরে যাচ্ছিল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমার অবস্থা তখন কেমন হবে, যখন তোমার হাতে কিসরার মূল্যবান কংকন পরানো হবে?[9] বস্ত্ততঃ ওহোদ যুদ্ধের পরে সুরাক্বাহ মুসলমান হন। অতঃপর ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে যখন মাদায়েন বিজিত হয় এবং পারস্য সম্রাট কিসরার রাজমুকুট ও অমূল্য রত্নাদি তাঁর সম্মুখে আনা হয়, তখন তিনি সুরাকাকে আহবান করেন। অতঃপর তার হাতে কিসরার কংকন পরিয়ে দেন। এ সময় তার যবান থেকে বেরিয়ে যায়- আল্লাহু আকবর! আল্লাহর কি মহত্তব যে, সম্রাট কিসরার কংকন আজ বেদুইন সুরাকার হাতে শোভা পাচ্ছে’।[10] সুরাক্বা বিন মালেক যখন পিছু পিছু আসছিল, তখন আবুবকর ব্যস্ত হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, لاتحزن إن الله معنا ‘চিন্তিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’।[11] এতে বুঝা যায় যে, উক্ত সান্ত্বনা বাক্যটি কেবল ছওর গিরিগুহায় নয়, অন্যত্র সংকটকালেও তিনি বলেছিলেন। ছওর গুহা থেকে রওয়ানা হওয়ার তৃতীয় দিনে ঘটনাটি ঘটেছিল।

(৪) বুরাইদা আসলামীর ইসলাম গ্রহণ : এরপর পথিমধ্যে বুরাইদা আসলামীর কাফেলার সাথে সাক্ষাৎ হয়। বুরাইদা ছিলেন একজন বীরপুরুষ ও নিজ সম্প্রদায়ের নেতা। তিনি মক্কাবাসীদের ঘোষিত পুরস্কারের লোভে মুহাম্মাদের মাথা নেওয়ার জন্য অনুসন্ধানে ছিলেন। কিন্তু শিকার হাতে পেয়ে তিনিই ফের শিকারে পরিণত হলেন। রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে কিছু কথাবার্তাতেই তার মনে দারুণ রেখাপাত করে এবং সেখানেই তার সত্তর জন সাথী সহ ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর মাথার পাগড়ী খুলে বর্শার মাথায় বেঁধে তাকে ঝান্ডা বানিয়ে ঘোষণা বাণী প্রচার করতে করতে চললেন, ‘শান্তি ও নিরাপত্তার বাদশাহ আগমন করেছেন। দুনিয়া এখন ইনছাফ ও ন্যায়বিচারে পূর্ণ হয়ে যাবে’।

(৫) যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামের সাথে সাক্ষাত : পরবর্তী পর্যায়ে ছাহাবী যোবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, যিনি মুসলমানদের একটি বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে সিরিয়া থেকে মদীনায় ফিরে আসছিলেন। ইনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর (রাঃ)-কে এক সেট করে সাদা কাপড় প্রদান করেন। যোবায়ের ছিলেন হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর জামাতা এবং আসমা (রাঃ)-এর স্বামী এবং আশারায়ে মুবাশ্শারাহর অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মহাবীর ছাহাবী ও মা আয়েশার পালিতপুত্র আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের স্বনামধন্য পিতা।


ক্বোবায় অবতরণ

একটানা আটদিন চলার পর ১৪ নববী বর্ষের ৮ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খৃষ্টাব্দের ২৩শে সেপ্টেম্বর সোমবার দুপুরে ক্বোবা। উপশহরে শ্বেত-শুভ্র বসন পরিহিত অবস্থায় তাঁরা অবতরণ করেন। এইদিন রাসূলের বয়স ৫৩ বছর পূর্ণ হয়। কোবায় মানুষের ঢল নামে। হাজারো মানুষের অভ্যর্থনার মধ্যেও রাসূল (ছাঃ) ছিলেন চুপচাপ। তাঁর উপরে হযরত আবুবকর চাদর দিয়ে ছায়া করলে লোকেরা রাসূলকে চিনতে পারে। এ সময় তাঁর উপরে ‘অহি’ নাযিল হয়-

فَإِنَّ اللهَ هُوَ مَوْلاَهُ وَجِبْرِيْلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمَلاَئِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيْرٌ- জেনে রেখ, আল্লাহ, জিব্রীল ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ তার সহায়। উপরন্তু ফেরেশতাগণও তার সাহায্যকারী’।[12]

এদিকে হযরত আলীও মক্কায় তিনদিন অবস্থান করে গচ্ছিত আমানত সমূহ স্ব স্ব মালিককে ফেরত দানের পর মদীনায় চলে আসেন এবং রাসূলের সাথে কুলছূম বিন হাদামের বাড়ীতেই অবস্থান করতে থাকেন। তিনি সোমবারে কোবায় অবতরণ করেন এবং শুক্রবারে সেখান থেকে ইয়াছবিরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এ সময়ে তিনি সেখানে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন ও সেখানে ছালাত আদায় করেন। অতঃপর তিনি ইয়াছরিবে তাঁর দাদা আব্দুল মুত্ত্বালিবের মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারকে সংবাদ দেন। বনু নাজ্জার ছিল খাযরাজ গোত্রভুক্ত। তারা সশস্ত্র প্রহরায় তাঁকে সাথে নিয়ে ইয়াছরিবের পথে যাত্রা করেন।

১ম জুম‘আ আদায়: ইয়াছরিবের উপকণ্ঠে পৌঁছে বনু সালেম বিন ‘আওফ গোত্রের ‘রানূনা’ (رَانُونَاء) উপত্যকায় ইসলামের ইতিহাসের ১ম জুম‘আ আদায় করেন।[13] যাতে একশত জন মুছল্লী শরীক ছিলেন। জুম‘আ পড়ে পুনরায় যাত্রা করে দক্ষিণ দিক থেকে তিনি ইয়াছরিবে প্রবেশ করেন। এদিন ছিল ১২ই রবীউল আওয়াল শুক্রবার। ইয়াছরিবের শত শত মানুষ তাকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানায়। হযরত বারা বিন আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূলের আগমনে আমি মদীনাবাসীকে যত খুশী হতে দেখেছি, এত খুশী তাদের কখনো হতে দেখিনি। এমনকি ছোট্ট শিশু-কিশোররা বলতে থাকে, هذا رسول الله قد جاء ‘এই যে, আল্লাহর রাসূল এসে গেছেন’।[14] উচ্ছ্বসিত মানুষ ঐদিন থেকে তাদের শহরের নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘মদীনাতুর রাসূল’ বা সংক্ষেপে মদীনা। এই সময় মদীনার ছোট ছোট মেয়েরা রাসূলকে স্বাগত জানিয়ে যে কবিতা পাঠ করে, তা ছিল নিম্নরূপ:

طلع البدر علينا + من ثنيات الوداع
ছানিয়াতুল বিদা টিলা সমূহ হ’তে আমাদের উপরে পূর্ণচন্দ্র উদিত হয়েছে।
وجب الشكرعلينا + مادعا لله داع
আমাদের উপরে শুকরিয়া ওয়াজিব হয়েছে, এজন্য যে, আহবানকারী (রাসূল) আল্লাহর জন্য (আমাদেরকে) আহবান করেছেন।
ايها المبعوث فبنا + جئت با لأمرالمطاع
হে আমাদের মধ্যে (আল্লাহর) প্রেরিত পুরুষ! আপনি এসেছেন অনুসরণীয় বিষয়বস্ত্ত (ইসলাম) নিয়ে।[15]


‘ছানিয়াহ’ অর্থ টিলা। মদীনায় লোকেরা তাদের মেহমানদেরকে নিকটবর্তী এই টিলা সমূহ পর্যন্ত এসে বিদায় জানাতো। এজন্য এই টিলা ‘ছানিয়াতুল বিদা’ বা বিদায়া দানের টিলা নামে পরিচিত হয়। ইয়াছরিবে প্রবেশের পর প্রত্যেক বাড়ীওয়ালা তার বাড়ীতে রাসূলকে মেহমান হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে উটের লাগাম ধরে টানতে থাকে। কিন্তু উট নিজের গতিতে চলে বর্তমানের মসজিদে নববীর স্থানে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু রাসূল নামেননি। পরে উট পুনরায় উঠে কিছু দূর গিয়ে আবার সেখানেই ফিরে এসে বসে পড়ে। এটি ছিল রাসূলের মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারের স্থান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) চেয়েছিলেন এখানে অবতরণ করে তার মামুদের বংশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে।

আবু আইয়ূবের বাড়ীতে অবতরণ : অবশেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, কার বাড়ী নিকটে? আবু আইয়ূব বললেন, ‘এই তো আমার বাড়ী, এইতো আমার দরজা।’ তখন রাসূল (ছাঃ) তার বাড়ীতে গেলেন। আবুবকরও তাঁর সাথে গেলেন। এই সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করেন, ‘আল্লাহর বরকতের উপরে তোমরা দুজন (রাসূল ও আবুবকর) দাঁড়িয়ে যাও’।[16] এর মাধ্যমে তিনি সেখানে অবস্থান করার কথা ঘোষণা দেন।

নবী পরিবারের আগমন : কয়েক দিনের মধ্যেই নবীপত্নী হযরত সওদা বিনতে যাম‘আহ এবং নবীকন্যা উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা এবং উসামা বিন যায়েদ ও উম্মে আয়মন (উসামার আম্মা) মদীনায় পৌঁছে যান। এদের সকলকে আব্দুল্লাহ বিন আবুবকর তার পারিবারিক কাফেলার সাথে নিয়ে এসেছিলেন। যাদের মধ্যে হযরত আয়েশাও ছিলেন। কেবল নবী কন্যা যয়নব তার স্বামী আবুল ‘আছের সঙ্গে রয়ে গেলেন। যারা বদর যুদ্ধের পরে চলে আসেন।

মদীনার আবহাওয়ার পরিবর্তন : মদীনায় এসে মুহাজিরগণের অনেকে অসুখে পড়েন। হযরত আবু বকর (রাঃ) কঠিন জ্বরে কাতর হয়ে কবিতা পাঠ করেন, ‘প্রত্যেক মানুষকে তার পরিবারে ‘সুপ্রভাত’ বলে সম্ভাষণ জানানো হয়। অথচ মৃত্যু সর্বদা জুতার ফিতার চাইতে নিকটবর্তী’। বেলালও অনুরূপ বিলাপ ধ্বনি করে কবিতা পাঠ করেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) এসব কথা রাসূলের কাছে তুলে ধরেন। তখন তিনি আল্লাহর নিকটে দো‘আ করেন- ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের নিকটে মদীনাকে প্রিয় করে দাও, যেমন মক্কা আমাদের প্রিয় ছিল। বরং তার চাইতে বেশী প্রিয়। তুমি মদীনাকে স্বাস্থ্যকর করে দাও, তার খাদ্য-শস্যে বরকত দাও এবং তার অসুখকে (রোগ-ব্যাধিকে) সরিয়ে দাও! বরং (দূরে) জোহফায় পৌঁছে দাও’।[17] ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় মদীনার অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায় এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরী হয়ে যায়।

আনছারগণের অপূর্ব ত্যাগ : আল্লাহ পাক ঈমানের বরকতে আনছারগণের মধ্যে এমন মহববত সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন যে, মুহাজিরগণকে ভাই হিসাবে পাওয়ার জন্য প্রত্যেকে লালায়িত ছিল। যদিও তাদের মধ্যে সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু তারা ছিল প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। সবাই মুহাজিরগণকে স্ব স্ব পরিবারে পেতে চায়। অবশেষে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং মুহাজিরগণকে আনছারদের সাথে ভাই ভাই হিসাবে ঈমানী বন্ধনে আবদ্ধ করে দেওয়া হয়। তারা তাদের জমি, ব্যবসা ও বাড়ীতে তাদেরকে অংশীদার করে নেন। এমনকি যাদের দুই স্ত্রী ছিল, তারা এক স্ত্রীকে তালাক দিয়ে স্ত্রীহারা মুহাজির ভাইকে দিয়ে দেন। আনছারগণের এই ত্যাগ ও কুরবানীর প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন,

وَيُؤْثِرُوْنَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَن يُوْقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ-
‘তারা নিজেদের উপরে মুহাজিরগণকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা নিজেরা ছিল অভাবগ্রস্ত। বস্ত্ততঃ যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই হল সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)।

________________________________________ [4] বুখারী হা/৩৯০৫। [5] বুখারী হা/৩৯১১। [6] যাদুল মা‘আদ ২/৫৩-৫৪। [7] হাকেম ৩/৯-১০; ফিক্বহুস সীরাহ পৃ: ১৩১, আলবানী ছহীহ বলেছেন। [8] বুখারী হা/৩৯০৬ ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ৪৫। [9] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/৬৯ ‘মাদায়েন বিজয়ের কাহিনী’। [10] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/৬৯ ‘মাদায়েন বিজয়ের কাহিনী’। [11] বুখারী হা/৩৬৫২। [12] তাহরীম ৬৬/৪, যাদুল মা‘আদ ৩/৫২; আর-রাহীক্ব পৃ: ১৭১। [13] আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ২/২১১। [14] বুখারী হা/৪৯৪১ ‘তাফসীর’ অধ্যায়। [15] আর-রাহীক্ব পৃ: ১৭২; যঈফাহ হা/৫৯৮। [16] বুখারী হা/৩৯১১। [17] বুখারী হা/৫৬৭৭।

আক্বাবাহর বায়‘আত, ইসরা ও মিরাজ


আক্বাবাহর বায়‘আত, ইসরা ও মিরাজ

আক্বাবাহর ১ম বায়‘আত (দ্বাদশ নববী বর্ষ) :

গত বছরে হজ্জের মওসুমে ইসলাম কবুলকারী ছয়জন যুবকের ব্যাপক প্রচারের ফলে পরবর্তী বছর নতুন সাত জনকে নিয়ে মোট বারো জন ব্যক্তি হজ্জে আসেন। দ্বাদশ নববী বর্ষের যিলহজ্জ মাসের (মোতাবেক জুলাই ৬২১ খৃঃ) এক গভীররাতে মিনার পূর্ব নির্ধারিত আক্বাবাহ নামক স্থানে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এই স্থানটিকে এখন জামরায়ে আক্বাবাহ বা বড় জামরাহ বলা হয়। এখানেই আইয়ামে তাশরীক্বের এক গভীর রাতে আলো- আঁধারীর মধ্যে আক্বাবাহর ১ম বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়, যা ছিল পরবর্তী পর্যায়ে মাদানী জীবনে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের বীজ বপন সমতুল্য।

এই বায়‘আতে জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) ব্যতীত গত বছরের বাকী পাঁচজন ছাড়াও এ বছরের নতুন সাতজন উপস্থিত ছিলেন। দুজন ছিলেন আওস গোত্রের এবং বাকীগণ ছিলেন খাযরাজ গোত্রের।


বায়‘আত অনুষ্ঠান:

‘আক্বাবায়ে ঊলা :
বায়‘আতে অংশগ্রহণকারী ছাহাবী উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বললেন যে, তোমরা এসো আমার নিকটে বায়‘আত কর এই মর্মে যে,
(১) তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না
(২) চুরি করবে না
(৩) যেনা করবে না
(৪) নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না
(৫) কাউকে মনগড়া অপবাদ দিবে না
(৬) সঙ্গত বিষয়ে আমার অবাধ্যতা করবে না।
তোমাদের মধ্যে যারা এগুলি পূর্ণ করবে, আল্লাহর নিকটে তার জন্য পুরস্কার রয়েছে। আর যদি কেউ এগুলির কোনটি করে বসে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি হয়ে যায়, তাহলে সেটি তার জন্য কাফফারা হবে। পক্ষান্তরে যদি কেউ এগুলির কোনটি করে, অতঃপর আল্লাহ তা ঢেকে রাখেন, তবে তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপরেই ন্যস্ত থাকবে। চাইলে তিনি বদলা নিবেন, চাইলে তিনি ক্ষমা করবেন।’ রাবী ওবাদাহ বিন ছামেত বলেন, অতঃপর আমরা উক্ত কথাগুলির উপরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট বায়‘আত করলাম’।

গুরুত্ব :

বায়‘আতে বর্ণিত ছয়টি বিষয়ের প্রতিটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি শুধু সেযুগেই নয়, বরং সর্বযুগেই গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণিত বিষয়গুলি সমাজে ব্যপ্তি লাভ করলে সমাজে শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্ট হয়। জাহেলী আরবে এগুলি বিনষ্ট হয়েছিল বলেই আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এগুলি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। আজকালকের কথিত সভ্য দুনিয়ায় এগুলি প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে যা ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে বিশ্বব্যাপী সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। অতএব দুনিয়াপূজারী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার গতি আখেরাতমুখী করার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজ ও রাষ্ট্র নেতাগণ আল্লাহর নামে অঙ্গীকারাবদ্ধ না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজে ও রাষ্ট্রে কাংখিত শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

বায়‘আতকারী নওমুসলিমদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একজন উদ্যমী ও ধীশক্তিসম্পন্ন যুবককে পাঠালেন শিক্ষক ও প্রচারক হিসাবে। যার নাম ছিল মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ)।

মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ)-এর দাওয়াত :

১ম আক্বাবাহর বায়‘আত সম্পাদিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছ‘আবকে তাদের সাথে ইয়াছরিবে প্রেরণ করেন। তিনি সেখানে গিয়ে তরুণ দলনেতা আবু উমামাহ আস‘আদ বিন যুরারাহ (রাঃ)-এর বাড়ীতে অবস্থান করেন এবং উভয়ে মিলে ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে থাকেন। তাঁর দাওয়াতের ফল এই হয়েছিল যে, পরবর্তী হজ্জ মৌসুম আসার সময়কালের মধ্যেই ইয়াছরিবের আনছারদের এমন কোন বাড়ী ছিল না যার পুরুষ ও মহিলাদের কিছু সংখ্যক মুসলমান হননি। তাঁর প্রচারকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-

একদিন আস‘আদ বিন যুরারাহ তাঁকে সাথে নিয়ে বনু আব্দুল আশহাল ও বনু যাফরের (بنو ظفر) মহল্লায় গমন করেন ও সেখানে একটি কূয়ার পাশে কয়েকজন মুসলমানকে নিয়ে বসলেন। মুবাল্লিগদের আগমনের খবর জানতে পেয়ে সা‘দ উসায়েদকে বললেন, আপনি যেয়ে ওদের নিষেধ করুন যেন আমাদের সরল- সিধা মানুষগুলিকে বোকা না বানায়। আস‘আদ আমার খালাতো ভাই না হ’লে আমি নিজেই যেতাম’। উসায়েদ বর্শা উঁচিয়ে সদর্পে সেখানে গিয়ে বললেন, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে এক্ষুণি পালাও। তোমরা আমাদের বোকাগুলোকে মুসলমান বানাচ্ছো’। মুছ‘আব শান্তভাবে বললেন, আপনি কিছুক্ষণের জন্য বসুন ও কথা শুনুন। যদি পসন্দ না হয়, তখন দেখা যাবে’। উসায়েদ তখন মাটিতে বর্শা গেড়ে দিয়ে বসে পড়লেন। অতঃপর মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে কিছুটা পাঠ করে শুনালেন। তারপর তিনি আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও তাঁর ইবাদত ও আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। ইতিমথ্যে উসায়েদ চমকিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘কতই না সুন্দর কথা এগুলি ও কতই না মনোহর।’ এরপর তিনি সেখানেই ইসলাম কবুল করলেন।

অতঃপর তিনি সা‘দ বিন মু‘আয-এর নিকটে এসে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তাদের মধ্যে অন্যায় কিছু দেখিনি’। তবে আমি তাদের নিষেধ করে দিয়েছি এবং তারাও বলেছে, আপনারা যা চান তাই করা হবে’। এ সময় উসায়েদ চাচ্ছিলেন যে, সা‘দ সেখানে যাক। তাই তাকে রাগানোর জন্যে বললেন, আমি জানতে পারলাম যে, বনু হারেছাহর লোকজন আস‘আদ বিন যুরারাহকে হত্যা করার জন্য বের হয়েছে এজন্য যে, সে আপনার খালাতো ভাই। সা‘দ ক্রুদ্ধ হয়ে তখনই বর্শা হাতে ছুটে গেলেন। যেয়ে দেখেন যে, আস‘আদ ও মুছ‘আব নিশ্চিন্তে বসে আছে। বনু হারেছাহর হামলাকারীদের কোন খবর নেই। তখন তিনি বুঝলেন যে, উসায়েদ তার সঙ্গে চালাকি করেছে তাকে এদের কাছে পাঠানোর জন্য। তখন সা‘দ ক্রুদ্ধ স্বরে উভয়কে ধমকাতে থাকলেন এবং আস‘আদকে বললেন, তুমি আমার আত্মীয় না হ’লে তোমাদের কোনই ক্ষমতা ছিল না আমার মহল্লায় এসে লোকদের বাজে কথা শুনাবার’।

আস‘আদের ইঙ্গিতে মুছ‘আব অত্যন্ত ধীর ও নম্র ভাষায় সা‘দকে বললেন, আপনি বসুন এবং আমাদের কথা শুনুন! অতঃপর পসন্দ হলে কবুল করবেন, নইলে প্রত্যাখ্যান করবেন’। অতঃপর তিনি বসলেন এবং মুছ‘আব তাকে কুরআন থেকে শুনালেন ও তাওহীদের মর্ম বুঝালেন। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সা‘দ বিন মু‘আয ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলেন। অতঃপর সেখানেই দুরাক‘আত নফল ছালাত আদায় করে নিজ গোত্রে এলেন ও সবাইকে ডেকে বললেন, হে বনু আব্দুল আশহাল!

তোমরা আমাকে তোমাদের মধ্যে কেমন মনে কর? তারা বলল, ‘আপনি আমাদের নেতা, সর্বোত্তম সিদ্ধান্তের অধিকারী ও নিশ্চিন্ততম কান্ডারী’। তখন তিনি বললেন, তোমাদের নারী ও পুরুষ সকলের সঙ্গে আমার কথা বলা হারাম, যে পর্যন্ত না তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনবে’। এ কথার প্রতিক্রিয়া এমন হল যে, সন্ধ্যার মধ্যে সবাই ইসলাম কবুল করল। মাত্র একজন ব্যতীত। যার নাম ছিল উছাইরাম (الأصيرم)। ইনি পরে ওহোদ যুদ্ধের দিন ইসলাম গ্রহণ করেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও শাহাদত বরণ করেন। কলেমায়ে শাহাদত পাঠ করা ব্যতীত আল্লাহর জন্য একটা সিজদা করারও সুযোগ তিনি পাননি। রাসূল (ছাঃ) তার সম্পর্কে বলেন, ‘অল্প আমল করল ও পুরস্কার অধিক পেল’।


ইসরা ও মি‘রাজ (১৩ নববী বর্ষ) :

মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তীনের বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বুরাক্বের সাহায্যে স্বল্পকালীন নৈশ ভ্রমণকে ‘ইসরা’ বলা হয় এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদ থেকে ঊর্ধ্বমুখী সিঁড়ির মাধ্যমে মহাকাশের সীমানা পেরিয়ে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকে মে‘রাজ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে সূরা বনু ইসরাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নজমের ১৩ থেকে ১৮ আয়াতে মি‘রাজ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। বাকী বিশদ ঘটনাবলী ছহীহ হাদীছ সমূহে বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
سُبْحَانَ الَّذِيْ أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِيْ بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيْعُ البَصِيْرُ-
‘পরম পবিত্র সেই মহান সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রির একাংশে ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মসজিদুল হারাম থেকে (ফিলিস্তীনের) মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত। যার চতুস্পার্শ্বকে আমরা বরকতময় করেছি, যাতে আমরা তাকে আমাদের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (ইসরা ১৭/১)।

উক্ত আয়াতে চারটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে।
এক- ইসরা ও মিরা‘জের পুরা ঘটনাটি রাতের শেষাংশে স্বল্প সময়ে সম্পন্ন হয়েছিল, যা ليلاً শব্দের মধ্যে বলা হয়েছে।
দুই- ঘটনাটি সশরীরে ঘটেছিল, যা بعبده শব্দের মাধ্যমে বলা হয়েছে। কেননা রূহ ও দেহের সমন্বিত সত্তাকে ‘আব্দ’ বা দাস বলা হয়। স্বপ্নযোগে বা রূহানী ব্যাপার হলে কেউ একে অবিশ্বাস করত না এবং কুরআনে তাঁকে ‘আব্দ’ না বলে হয়ত ‘রূহ’ (بروح عبده) বলা হত। এখানে عبده ‘তাঁর দাস’ বলে রাসূলকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মক্কার কাফেররা প্রথমে বিশ্বাস করেনি, অবশেষে যারা ইতিপূর্বে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ভ্রমণ করেছেন এমন কিছু অভিজ্ঞ লোক তাকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা করল। সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে তারা চুপ হল বটে। কিন্তু তাদের হঠকারী অন্তর প্রশান্ত হয়নি। পক্ষান্তরে হযরত আবুবকর (রাঃ) জোরগলায় মে‘রাজের সত্যতার ঘোষণা দিতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুশী হয়ে তাকে ‘ছিদ্দীক্ব’ (صديق) বা সর্বাধিক সত্যবাদী উপাধি দেন। এটি অত্যন্ত বড় বিষ্ময়কর ঘটনা ছিল।
তিন- বায়তুল মুক্বাদ্দাস-এর আশপাশ ভূমি অর্থাৎ ফিলিস্তীন সহ পুরা সিরিয়া অঞ্চল বরকতময় এলাকা, যা باركنا حوله বাক্যাংশের মাধ্যমে বলা হয়েছে।
চার- আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে পরজগতের অলৌকিক নিদর্শন সমূহের কিছু অংশ স্বচক্ষে দেখিয়ে দেন। যা لنريه من آياتنا বাক্যাংশের মাধ্যমে বলা হয়েছে। উক্ত নিদর্শন সমূহের মধ্যে ছিল মক্কা থেকে বুরাকে সওয়ার হওয়ার পূর্বে সীনা চাক করা এবং তা যমযম পানি দিয়ে ধৌতকরণ, অতঃপর বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে ঊর্ধারোহণের পূর্বে তাঁকে দুধ ও মদ পরিবেশন। কিন্তু রাসূলের দুধ গ্রহণ, অতঃপর জিব্রীলের সাথে সপ্তাকাশ পরিভ্রমণ, বিগত নবীদের সাথে মুলাক্বাত, জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন, সিদরাতুল মুনতাহায় একাকী আল্লাহর নিকটতম সান্নিধ্যে উপনীত হওয়া এবং আল্লাহর সাথে সরাসরি কথোপকথন। অতঃপর উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের উপঢৌকন নিয়ে পৃথিবীতে প্রত্যাগমন এবং বিদায় কালে বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে ফজরের ছালাতে নবীগণের ইমামতি করণ ও তাদের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে পুনরায় বোরাক অশ্বে সওয়ার হয়ে রাত্রি কিছুটা বাকী থাকতেই মক্কায় প্রত্যাবর্তন।

হিজরতের প্রাক্কালে মাক্কী জীবনের শেষপ্রান্তে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল। মে‘রাজের তাৎপর্য অনুধাবন করে আখেরাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস এবং মে‘রাজের অমূল্য তোহ্ফা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের মাধ্যমে গভীর অধ্যাত্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সর্বদা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে দুনিয়াবী জীবন পরিচালনা করা। মে‘রাজ ছিল ইসলামী বিজয়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত এবং মাদানী জীবনের সূচক ঘটনা।


বায়‘আতে কুবরা (ত্রয়োদশ নববী বর্ষ) :

দ্বাদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে অনুষ্ঠিত আক্বাবাহর ১ম বায়‘আতে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের সাথে রাসূলের প্রেরিত দাঈ মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)-এর দিন-রাত প্রচারের ফলে পরের বছর ত্রয়োদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে (জুন ৬২২ খৃঃ) অনুষ্ঠিত আক্বাবাহর ২য় বায়‘আতে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলা সহ মোট ৭৫ জন ইয়াছরিববাসী ইসলামের উপর বায়‘আত করেন। এটিই ইতিহাসে বায়‘আতে কুবরা বা বড় বায়‘আত নামে খ্যাত। যা ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাদানী যিন্দেগীর ভিত্তি স্বরূপ এবং আগামীতে ঘটিতব্য ইসলামী সমাজ বিপ্লবের সূচনাকারী। এই সময় মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ) মক্কায় ফিরে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে ইয়াছরিবে দাওয়াতের অবস্থা এবং গোত্র সমূহের ইসলাম কবুলের সুসংবাদ প্রদান করেন। যা রাসূলকে হিজরতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। মূলতঃ আক্বাবাহর বায়‘আত তিন বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়।
একাদশ নববী বর্ষে আস‘আদ বিন যুরারাহর নেতৃত্বে ৬ জন ইয়াছরিববাসীর ১ম বায়‘আত।
দ্বাদশ বর্ষে ১২ জনের দ্বিতীয় বায়‘আত এবং
ত্রয়োদশ নববী বর্ষে ৭৩+২=৭৫ জনের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ বায়‘আত-
যার মাত্র ৭৫ দিনের মাথায় মক্কা হ’তে ইয়াছরিবের উদ্দেশ্যে রাসূলের হিজরতের সূত্রপাত হয়।

ঘটনা :

১২ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হলে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় পূর্বোক্ত ৭৫ জন ইয়াছরেবী হাজী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাক্ষাতের জন্য বের হন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্বাবাহর সুড়ঙ্গ পথে অতি সঙ্গোপনে হাযির হন। অল্পক্ষণের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় চাচা আববাসকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হন, যিনি তখনও প্রকাশ্যে মুসলমান হননি। কুশলাদি বিনিময়ের পর প্রথমে আববাস কথা শুরু করেন। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ আমাদের মাঝে কিভাবে আছেন তোমরা জানো। তাকে আমরা আমাদের কওমের শত্রুতা থেকে হেফাযতে রেখেছি এবং তিনি ইযযতের সাথে তার শহরে বসবাস করছেন। এক্ষণে তিনি তোমাদের ওখানে হিজরত করতে ইচ্ছুক। এ অবস্থায় তোমরা তার পূর্ণ যিম্মাদারীর অঙ্গীকার করলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু যদি এমনটি হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে গেলে, অতঃপর বিপদ মুহূর্তে তাকে পরিত্যাগ করলে, তাহলে তোমরা তাকে নিয়ে যেয়ো না। তিনি আমাদের মধ্যে সসম্মানেই আছেন’।

আববাসের বক্তব্যের পর প্রতিনিধি দলের মধ্য থেকে কা‘ব বললেন, হে রাসূল (ছাঃ)! আমরা আববাসের কথা শুনেছি। এক্ষণে - আপনি কথা বলুন এবং আপনার নিজের জন্য ও নিজ প্রভুর জন্য যে চুক্তি আপনি ইচ্ছা করেন, তা করে নিন’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথমে কুরআন থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করেন। অতঃপর তাদেরকে ইসলাম কবুলের আহবান জানান। অতঃপর তিনি বললেন,

‘আমি তোমাদের বায়‘আত নেব এ বিষয়ের উপরে যে, তোমরা আমাকে হেফাযত করবে ঐসব বিষয় থেকে, যেসব বিষয় থেকে তোমরা তোমাদের মহিলা ও সন্তানদেরকে হেফাযত করে থাক’। সাথে সাথে বারা বিন মা‘রূর রাসূলের হাত ধরে বললেন,
‘হাঁ! ঐ সত্তার কসম যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, অবশ্যই আমরা আপনাকে হেফাযত করব ঐসব বিষয় থেকে, যা থেকে আমরা আমাদের মা-বোনদের হেফাযত করে থাকি’। এ সময় আবুল হায়ছাম বিন তায়হাম বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের সঙ্গে ইহুদীদের সন্ধিচুক্তি রয়েছে। আমরা তা ছিন্ন করছি। কিন্তু এমন তো হবে না যে, আমরা এরূপ করে ফেলি। তারপর আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন তখন আপনি আবার আপনার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবেন ও আমাদের পরিত্যাগ করবেন।

জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুচকি হেসে বললেন, ‘না! বরং তোমাদের রক্ত আমার রক্ত, তোমাদের ধ্বংস আমার ধ্বংস। আমি তোমাদের এবং তোমরা আমাদের। তোমরা যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, আমিও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যাদের সঙ্গে সন্ধি করবে, আমিও তাদের সঙ্গে সন্ধি করব’। এরপর লোকজন যখন বায়‘আত গ্রহণের জন্য এগিয়ে এলো,
তখন আববাস বিন ওবাদাহ বিন নাযলাহ সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা কি জানো কোন কথার উপরে তোমরা এই মানুষটির নিকটে বায়‘আত করছ? সবাই বলল, হাঁ। তিনি বললেন, তোমরা লাল ও কালো (আযাদ ও গোলাম) মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তার নিকটে বায়‘আত করতে যাচ্ছ। যদি তোমাদের এরূপ ধারণা থাকে যে, যখন তোমাদের সকল সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করা হবে, তখন তোমরা তার সঙ্গ ছেড়ে যাবে, তাহলে এখনই ছেড়ে যাও। কেননা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পরে যদি তোমরা তাকে পরিত্যাগ কর, তাহলে ইহকাল ও পরকালে চরম লজ্জার বিষয় হবে। আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে যে, তোমাদের মাল-সম্পদ ধ্বংসের ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা সত্ত্বেও এ চুক্তি অক্ষুণ্ণ রাখবে, যার প্রতি তোমরা তাঁকে আহবান করছ, তাহলে অবশ্যই তা সম্পাদন করবে। কেননা আল্লাহর কসম! এতেই তোমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে।’ আববাস বিন ওবাদাহর এই ওজস্বিনী ভাষণ শোনার পর সকলে সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আমরা তাকে গ্রহণ করছি আমাদের মাল-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের হত্যার বিনিময়ে। কিন্তু এর বদলায় আমাদের কি রয়েছে হে আল্লাহর রাসূল!’ তিনি বললেন, জান্নাত। তারা বলল, হাত বাড়িয়ে দিন হে রাসূল! ‘ব্যবসা লাভজনক হয়েছে। আমরা কখনো তা রহিত করব না বা রহিত করার আবেদন করব না’।

এ সময় দলনেতা এবং কাফেলার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আস‘আদ বিন যুরারাহ পূর্বের বক্তার ন্যায় কথা বললেন এবং পূর্বের ন্যায় সকলে পুনরায় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করলেন, অতঃপর তিনিই প্রথম বায়‘আত করলেন। এরপর একের পর এক সকলে রাসূলের হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়। মহিলা দু’জনের বায়‘আত হয় মৌখিক অঙ্গীকার গ্রহণের মাধ্যমে। সৌভাগ্যবতী এই মহিলা দু’জন হ’লেন উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবা বিনতে কা‘ব (أم عمارة نسيبة بنت كعب) এবং উম্মে মানী‘ আসমা বিনতে আমর (أم منيع أسماء بنت عمرو) । প্রথম জন ছিলেন বনু মাঝেন গোত্রের এবং দ্বিতীয়জন ছিলেন বনু সালামা গোত্রের।

বায়‘আতের কথা শয়তান ফাঁস করে দিল :

ইবলীস শয়তান এই বায়‘আতের সুদূরপ্রসারী ফলাফল বুঝতে পেরে দ্রুত পাহাড়ের উপরে উঠে তার স্বরে আওয়ায দিল হে তাঁবুওয়ালারা! মুহাম্মাদ ও তার সাথী বিধর্মীদের ব্যাপারে তোমাদের কিছু করার আছে কি? তারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একত্রিত হয়েছে’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, - এটা সুড়ঙ্গের শয়তান। হে আল্লাহর দুশমন। অতি সতবর আমি তোর জন্য বেরিয়ে পড়ছি’। একথা শুনে আববাস বিন উবাদাহ বিন ওবাদাহ বিন নাযলাহ (রাঃ) বলে উঠলেন, ‘হে রাসূল! সেই সত্তার কসম করে বলছি যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, আপনি চাইলে আগামী কালই আমরা মিনাবাসীদের উপরে তরবারি নিয়ে হামলা চালাব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘আমরা সেজন্য আদিষ্ট হইনি’। তোমরা স্ব স্ব তাঁবুতে ফিরে যাও (আর-রাহীক্ব)।

শয়তানের এই তির্যক কণ্ঠ কুরায়েশ নেতাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করার সাথে সাথে তারা ছুটে এল এবং ইয়াছরেবী কাফেলার লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটা খুব গোপনে রাতের অন্ধকারে ঘটেছে, তাই খাযরাজ নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইসহ সকলে অজ্ঞতা প্রকাশ করল। এতে নেতারা আশ্বস্ত হয়ে ফিরে গেল। কিন্তু তারা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে না পেরে পুনরায় এলো। কিন্তু তখন কাফেলা মদীনার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সা‘দ বিন ওবাদাহ ও মুনযির বিন আমর পিছনে পড়েন। পরে মুনযির দ্রুত এগিয়ে গেলে সা‘দ ধরা পড়ে যান। কুরায়েশরা তাকে পিছনে শক্ত করে হাঁত বেধে মক্কায় নিয়ে আসে। কিন্তু মুত্ব‘ইম বিন আদী ও হারেছ বিন হারব বিন উমাইয়া এসে তাঁকে ছাড়িয়ে নেন। কেননা তাদের বাণিজ্য কাফেলা মদীনার পথে সা‘দের আশ্রয়ে থেকে যাতায়াত করত। এদিকে যখন ইয়াছরেবী কাফেলা তার মুক্তির ব্যাপারে পরামর্শ করছিল, ওদিকে তখন সা‘দ নিরাপদে তাদের নিকটে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর তারা সকলেই নির্বিঘ্নে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। এই ঐতিহাসিক বায়‘আতকে স্বাগত জানিয়ে আল্লাহ পাক স্বীয় রাসূলের নিকটে আয়াত নাযিল করে বলেন,

إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَيَقْتُلُوْنَ وَيُقْتَلُوْنَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقّاً فِي التَّوْرَاةِ وَ الإِنجِيْلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوْا بِبَيْعِكُمُ الَّذِيْ بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন মুসলমানদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়। অতঃপর মারে ও মরে। এই সত্য প্রতিশ্রুতি রয়েছে তওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে। আর আল্লাহর চাইতে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? অতএব তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর সেই লেন-দেনের উপরে যা তোমারা করেছ তার সাথে। আর এ হ’ল এক মহান সাফল্য’।[তওবাহ ৯/১১১]

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে শিবগঞ্জ উপজেলাবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

 বিসমিল্লাহর রাহমানির রাহিম ঈদ বয়ে আনুক সবার জীনবে সুখ শান্তি ও কল্যাণের বার্তা ঈদের দিনের মতো সুন্দর হোক প্রতিটি দিন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক...