28 December, 2018

১৫৩.সমবায় আন্দোলন,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; সমবায় কি; সমবায় সমিতির প্রকারভেদ; সমবায় আন্দোলনের প্রেক্ষাপট; বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস; সমবায় আন্দোলনের মূলনীতিসমূহ; বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমবায় আন্দোলনের গুরুত্ব; খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি সমবায়; বাংলাদেশে সমবায় প্রতিষ্ঠার নিয়মাবলী; সমবায়ের অপব্যবহার; উপসংহার।)
ভূমিকা: আধুনিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অতিপরিচিত এবং পরীক্ষিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নাম হলো সমবায়। ‘দশের লাঠি একের বোঝা’, ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ কিংবা ‘বিন্দু থেকে সিন্ধু’ প্রভৃতি বহুল প্রচলিত প্রবাদ বাক্যগুলোর মূলকথা একটাই আর তা হলো সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের উন্নয়ন। এ সব স্লোগান বা প্রবাদ বাক্যকে পুঁজি করে বিত্তহীন ও স্বল্পবিত্তের মানুষের সংঘবদ্ধ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উত্তরণের স্বপ্নপূরণের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে সমবায় আন্দোলন। সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত নানা প্রতিবন্ধকতার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে সমবায় আন্দোলনকে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায় আন্দোলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সমবায় কি: একই বা অভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সমবেতভাবে কাজ করার নামই হলো সমবায়। নিজেদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একই শ্রেণি ও পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত সমমনা বা একই মানসিকতাসম্পন্ন কিছু সংখ্যক মানুষ যখন একত্রিত হয়ে কোনো সংগঠন বা সংস্থা গঠন করে তখন ঐ সংস্থাকে সমবায় বলে। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ এবং অর্থনৈতিক সংস্থা সমবায়কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ হুভাট ক্যালভাটের মতে ‘সমবায় হলো একটি প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে মানুষ হিসেবে সততা ও সাম্যের ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় একত্রিত হয়।’ International Cooperative Alliance-এর মতে ‘সমবায় হচ্ছে এমন কতগুলো লোকের সংস্থা, যাদের আয় সীমাবদ্ধ এবং এমন একটি প্রতিষ্ঠান যারা গণতান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রিত সংগঠনের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হয়ে কোনো সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় তহবিলে ন্যায়ভাবে অংশ প্রদান করে, আর প্রচেষ্টাজনিত ঝুঁকি ও সুযোগ সুবিধার ন্যায্য অংশগ্রহণ করে।’
সমবায় সমিতির প্রকারভেদ: সমবায় সমিতি বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। নিম্নে তা ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো-
সমবায়
১) সাধারণ শ্রেণি বিভাগ
-উৎপাদন সমবায়
-ভোক্তা সমবায়
২)কার্যভিত্তিক
-কৃষি সমিতি
-ক্রয় সমিতি
-বিক্রয় সমিতি
-সমবায় সমিতি
-গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি
-বহুমুখি সমবায় সমিতি
-বীমা সমবায় সমিতি
৩) দায়ের প্রকৃতি ভিত্তিক
-অসীম দায় সমিতি
-সসীম দায় সমিতি
৪)সাংগঠনিক
-প্রাথমিক সমবায় সমিতি
-জাতিয় সমবায় সমিতি
-কেন্দ্রিয় সমবায় সমিতি
সমবায় আন্দোলনের প্রেক্ষাপট: সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের পর হাজার হাজার শ্রমিক চাকুরিচ্যুত হয়ে কঠিন সমস্যার মুখোমুখী হন। এসময় ইংল্যান্ডের ‘রচডেল’ নামক গ্রামের ২৮ জন তাঁতি ২৮ পাউন্ড পুঁজি নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম সমবায় সমিতি গড়ে তোলে। ১৮৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সমিতি সমবায় আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। ইংল্যান্ডের ‘রচডেল’ গ্রামের এই সমিতিটি পৃথিবীর প্রথম সফল সমবায় হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমবায় সমিতি বিকশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের ইতিহাস: বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের ইতিহাসও বেশ পুরনো। এ দেশে সমবায় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন স্যার পিসি রায়। তিনি খুলনা জেলার পাইকগাছায় রাড়-লী গ্রামের মানুষদের দারিদ্র্য বিমোচন এবং আত্মনির্ভরশীল করার উদ্দেশ্যে এলাকার মানুষদেরকে সমবায়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জেনারেল লর্ড কার্জন ১৯০৪ সালে সমবায় ঋণদান সমিতি আইন জারি করেন। প্রকৃতপক্ষে এই আইনের মাধ্যমেই উপমহাদেশের সমবায় আন্দোলনের অভিযাত্রা শুরু। ১৯৪০ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে 'The Bangle Cooperative Society Act'- নামে একটি আইন পাস হয়। সমবায় ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ১৯৮৪ সালে জারি করা হয় সমবায় অধ্যাদেশ। ১৯৮৭ সালে প্রণীত হয় সমবায় নিয়মাবলী।
সমবায় আন্দোলনের মূলনীতিসমূহ: বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনের মূলনীতি গুলো হলো- একতা, সাম্য, সহযোগিতা, সততা, আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, সেবা। আন্তর্জাতিক সমবায় এর ক্ষেত্রেও কিছু মূলনীতি রয়েছে এগুলো হলো- স্বতঃস্ফূর্ত ও অবাধ সদস্যপদ, সামাজিক অঙ্গীকার, সদস্যের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, সদস্যের আর্থিক অংশগ্রহণ, আন্তঃসমবায় সহযোগিতা, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তথ্য।
বাংলাদেশে সমবায় আন্দোলনকে গতিশীল করার জন্য এদেশের মানুষের সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের আলোকে মূলনীতিসমূহ নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সমবায়ের স্লোগান হলো- ‘একতাই বল’ এবং মূলকথা হলো ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’।
বাংলাদেশের সমবায় আন্দোলনের গুরুত্ব: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নের জন্য জনসম্পৃক্ত সমবায় আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে সমবায় আন্দোলন অনেক পুরনো হলেও তা এদেশের মানুষের দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং আত্মসামাজিক ক্ষেত্রে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো অগ্রগতি আনতে পারেনি। কিন্তু সমবায়ের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করতে পারলে জমির মালিক ও কৃষক উভয়েই লাভবান হবে। এজন্য প্রকৃত সমবায়ীদের নেতৃত্বে সমবায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদন বেশি করলে তা দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাহায্য করবে।
খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি সমবায়: বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। সমবায় সমিতি এমন একটি জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠান যার মধ্যে থাকে গণতন্ত্র, সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা, ব্যাপক উৎপাদন কর্মযজ্ঞ এবং সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির প্রয়াস। আধুনিক কৃষির জন্য যে পুঁজি ঝুঁকি এবং যৌথ মেধার দরকার তার জন্য প্রয়োজন গণমুখী কৃষিভিত্তিক সমবায় ব্যবস্থা। খাদ্য নিরাপত্তা ও মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে হলে কৃষি সমবায়ের কোনো বিকল্প নেই। যথাযথ নীতি এবং সার্বিক সহযোগিতা পেলে কৃষি সমবায় খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।
বাংলাদেশে সমবায় প্রতিষ্ঠার নিয়মাবলী: বাংলাদেশের সমবায়গুলো স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন। সমবায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের সমবায় প্রতিষ্ঠার নিয়মগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো-
- নিবন্ধন বা অনুমোদন ছাড়া কোনো সংগঠন কিংবা সমিতি সংঘের নামে ‘সমবায়’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারবে না। কেউ তা করলে এক বছরের কারাদন্ডে-দন্ডিত হবেন।
- প্রাথমিক সমবায় সমিতি নিবন্ধনের জন্য কমপক্ষে ২০ জন সদস্যের প্রয়োজন।
- প্রত্যেক সমবায় সমিতি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা যার স্থায়ী ধারাবাহিকতা আছে।
- সমবায় আইন অনুযায়ী প্রত্যেক সমবায় সমিতির কমপক্ষে ৭ টি রেজিস্ট্রার হাল নাগাদ সংরক্ষণ করতে হবে।
- সমিতির হিসাব প্রতিবছর অডিট করতে হবে।
- সমবায় আইন, বিধি ও উপবিধি পালন শর্তে সমবায় সমিতির চূড়ান্ত কর্তৃত্ব তার সাধারণ সভার উপর বর্তাবে।
- প্রত্যেক সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আইন বিধি, উপবিধি মোতাবেক গঠিত একটি ব্যবস্থাপনা কমিটির উপর থাকবে।
- সমবায় সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা পরামর্শের প্রয়োজন হলে যেকোনো সমবায় কার্যালয়ে কোনো সমব্যয়ী পরামর্শ করতে পারেন।
- সমবায় আইন ভঙ্গ করলে ৫০০০ টাকা জরিমানা বা ৬ মাসের জেল হতে পারে।
সমবায়ের অপব্যবহার: অনেক সমবায় সমিতি বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তা আত্মসাৎ করেছে। ফলে জনগণের মধ্যে সমবায়গুলোকে নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। এ জন্য সরকার আইন তৈরি করেছে। ২০১২ সালে পাসকৃত আইনে বলা হয়েছে- বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ও পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো সমবায় সমিতি কোনো প্রকার ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারবে না। উক্ত আইন ভঙ্গ করলে তাকে ৭ বছরের কারাদন্ডসহ ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে।
উপসংহার: দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধ এবং খাদ্য নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টিতে অন্যতম এবং উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো সমবায়ী উদ্যোগ। এ জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের জন্য, নিজের জন্য সমবায় প্রতিষ্ঠা। All for each and Each for all এই মর্মবাণী ধারণ করে সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের সকলের একান্ত দায়িত্ব।

25 December, 2018

১৫২.বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; বিজ্ঞান; প্রযুক্তি; উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ; বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী; মানব কল্যাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; কৃষি ক্ষেত্রে; শিল্প ক্ষেত্রে; শিক্ষা ক্ষেত্রে; বিদ্যুৎ উৎপাদন ও দৈনন্দিন জীবনে; যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থায়; চিকিৎসা ক্ষেত্রে; আবহাওয়ার ক্ষেত্রে; নগর সভ্যতার বিকাশে; মহাশূন্যের জ্ঞান আহরণে; বেকার সমস্যা সমাধানে; ক্ষতিকারক দিকসমূহ; উপসংহার।)
ভূমিকা: প্রাচীন সভ্যতা হতে শুরু করে আজকের এই নগর সভ্যতার দিকে তাকালে আমরা এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারি। এই যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। সারাবিশ্বের সর্বত্র আজ বিজ্ঞানের জয় জয়কার। বিজ্ঞান মানুষের জীবনযাত্রাকে করে দিয়েছে সহজ, বেগবান, সভ্যতায় এনে দিয়েছে পরিপূর্ণতা ও বহুমাত্রিকতা। বর্তমানে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি অংশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া আছে। সমাজের যে স্তরে এখনো বিজ্ঞানের ছোঁয়া লাগেনি, সে স্তরে এখনো পর্যন্ত উন্নতি প্রবেশ করতে পারেনি। তাই বলা যায় যে, মানব সভ্যতার উন্নয়নের মূলে রয়েছে বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান: ইংরেজি Science শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ বিজ্ঞান। Science শব্দটি এসেছে Scio শব্দটি থেকে। যার অর্থ ‘জানা বা শিক্ষা লাভ করা’। বিজ্ঞান শব্দের শব্দগত অর্থ হলো ‘বিশেষ জ্ঞান’। আমাদের আশেপাশের জীব ও বস্তুজগৎ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিজ্ঞান সম্মত অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রাপ্ত যে বিশেষ জ্ঞান মানুষের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে চলছে তাকে আমরা বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করতে পারি। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বজগতের অজানা রহস্য সম্পর্কিত সুসংবদ্ধ জ্ঞানই হলো বিজ্ঞান।
প্রযুক্তি: প্রযুক্তি শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Technology শব্দটি গ্রিক শব্দ Techne এবং logia থেকে এসেছে। বিজ্ঞানের জ্ঞানকে বিশেষভাবে ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানে অথবা পূর্ববর্তী সমস্যার উন্নতিসাধনে, সুনির্দিষ্ট কার্যাবলী বিজ্ঞানসম্মতভাবে সম্পন্ন করাই হলো প্রযুক্তি। এক কথায় বিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব এবং সূত্রের প্রায়োগিক দিককেই বলে প্রযুক্তি।
উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ: যেদিন প্রথম আগুনের আবিষ্কার হলো, সেদিন থেকেই যেন মানব সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে। তারপর থেকেই বিভিন্ন আবিষ্কার এর মধ্য দিয়েই মানব সভ্যতার অগ্রগতি ঘটল। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের ফলে। মানুষের কৌতুহলী মন তাকে প্রাকৃতিক নানা বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। তারই ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক আবিষ্কার এবং প্রযুক্তির আবির্ভাব। এসব বিজ্ঞানভিত্তিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তি মানুষ তার প্রয়োজনে ব্যবহার করে আসছে।
বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী: আমরা অনেকেই আমাদের চারিদিকের পরিবেশের বিচিত্র ঘটনা প্রবাহ অহরহ পর্যবেক্ষণ করে থাকি। কিন্তু সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ করেই থেমে থাকেন না। এঁরা প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এ ঘটনাগুলো কেনো এবং কীভাবে ঘটে ইত্যাদি নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত নিবেদিতপ্রাণ, অনুসন্ধিৎসু ও সৃজনশীল এসব ব্যক্তিবর্গকে আমরা বিজ্ঞানী বলি। অনুসন্ধিৎসু গবেষণাধর্মী মনোভাব, বিনয়, সত্যানুন্ধানে আপোষহীন মনোভাব, সহিষ্ণুতা ও সর্বোপরি মানবপ্রেম বিজ্ঞানীদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মানব সেবায় এদের অবদান অনস্বীকার্য।
মানব কল্যাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের মূল লক্ষ্যই হলো মানব কল্যাণ। তাই বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করে চলেছেন। তারই কিছু উল্লেখযোগ্য দিক নিম্নরূপ-
কৃষি ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম। সভ্যতার সূচনালগ্ন হতে মানুষ কৃষির সাথে জড়িত। কিন্তু সেই প্রাচীন কৃষিপদ্ধতির সাথে বর্তমান কৃষিপদ্ধতির ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। কৃষিজ বিভিন্ন যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন, কীটনাশকের ব্যবহার, উন্নতজাতের বীজের ব্যবহার যা অধিক ফলনশীল ইত্যাদির সবকিছুই বিজ্ঞানের ফল। মরুভূমির মতো শুষ্ক বালুময় স্থানেও আজকাল ফসল উৎপাদন করা যায় বিজ্ঞানের কল্যাণে।
শিল্প ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ের শিল্পবিপ্লব মূলত বিজ্ঞানের হাত ধরেই এসেছে। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারও বিজ্ঞানের ফল। আগে শিল্প কারখানাগুলো হস্তচালিত থাকলেও বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির আবিষ্কারের দরুণ শিল্পে উন্নতি সম্ভব হয়েছে। এর ফলে শিল্পে যেমন কম সময় লাগছে, কম শ্রম লাগছে, তেমনি উৎপাদনও বেশি হচ্ছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: মানব সম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা আবশ্যক। শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন উপাদান যেমন, বই, কাগজ, কলম ইত্যাদি সবই শিক্ষার বিকাশে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যা প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের আবিষ্কার। এছাড়া বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে অন্যতম ব্যবহৃত বিষয় হলো কম্পিউটার, ইন্টারনেট। যা পড়াশুনাকে করেছে আরো সহজ ও তথ্যসমৃদ্ধ। পড়াশুনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সকল দেশি-বিদেশি বই ও পরামর্শকে সহজলভ্য করেছে ইন্টারনেট, যা বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক আবিষ্কার।
দৈনন্দিন জীবন ও বিদ্যুৎ: দৈনন্দিন জীবনে সর্বদা ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার। এটি মানুষের জীবনযাত্রাকে করেছে সহজ এবং কাজকে আরামদায়ক ও দ্রুতগতিসম্পন্ন করে দিয়েছে। বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব আবিষ্কার বিদ্যুতের মাধ্যমে আরো অনেক বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে যা আমাদের জীবনের পথচলাকে আরো সহজ করেছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী যেমন- লাইট, ফ্যান ইত্যাদি ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও চলতে পারি না। আর এ সমস্ত কিছুই সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের কল্যাণে।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: আদিম সমাজের মানুষের স্থানান্তরের জন্য পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে চাকাওয়ালা যান এলো এবং এক পর্যায়ে মোটরযান এলো। এগুলো মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ স্থাপনে, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে যানবাহনের উন্নতির পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন বা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে এসেছে টেলিফোন, টেলেক্স, ফ্যাক্স, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে আজকাল মানুষকে আর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে কাজ করতে হয় না। বরং টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে তা নিজ জায়গায় থেকেও কাজ করা যায়। এরকম আরেকটি যোগাযোগের মাধ্যম হলো কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। এটি একটি কৃত্রিম স্যাটেলাইট, যার সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: সর্বাধুনিক পদ্ধতির চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে আজকাল অনেক জটিল ও দূরারোগ্য ব্যধি থেকে মানুষ মুক্তিলাভ করেছে। এমনকি কয়েক বছর আগে যেখানে যক্ষ্মাকে মরণব্যাধি হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো, তার মুক্তি এখন মানুষের হাতের নাগালে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন, চোখ, কিডনি ইত্যাদির প্রতিস্থাপন, মূত্রথলি, পিত্তথলী প্রভৃতি হতে পাথর অপসারণ, ক্যান্সার নামক ভয়ানক ও মরণব্যাধির বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা সম্ভবপর হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমেই। এছাড়া বিভিন্ন ধরণের ওষুধের আবিষ্কারও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরই ফল।
আবহাওয়া ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম একটি অংশ হলো আবহাওয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে, বিজ্ঞানীগণ মহাবিশ্বে কৃত্রিম উপগ্রহ বসাতে সক্ষম হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে আমরা যেমন বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখতে পাই, তেমনি আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাই। বর্তমানে সময় ৭-৮ দিন পূর্বেই আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ফলশ্রুতিতে আমরা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগরোধের চেষ্টা করতে পারি। আবহাওয়া অধিদপ্তর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আবহাওয়ার উপাত্ত সংগ্রহ করে, রাডারের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস ও আগাম সতর্কীকরণের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে।
নগর সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: নগর সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নগর সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছাপ স্পষ্ট। নগর সভ্যতা মানব জীবনে নিয়ে এসেছে অনাবিল স্বাচ্ছন্দ ও জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, উন্নত বাড়িঘর, অর্থাৎ প্রকৌশলগত উন্নয়নসহ সব ধরণের নাগরিক সুবিধা ইত্যাদি নগর সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যা সম্ভবপর হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে।
মহাশূন্যের জ্ঞান আহরণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: প্রকৃতির বিভিন্ন রহস্য উদঘাটন করতে করতে মানুষের কৌতূহলী মন পৃথিবীকে ছাড়িয়ে মহাশূন্যে পদার্পণ করেছে। যে চাঁদকে নিয়ে একদিন আমরা শুধু কল্পনাই করতাম, সেই চাঁদ এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। বিজ্ঞানের উৎকর্ষের কারণেই আমরা এখন মঙ্গলগ্রহে মানব জাতির বসবাস উপযোগী পরিবেশ খুঁজে ফিরছি। এ ছাড়া মানুষ মহাশূন্যে অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ, রোবট ও অন্যান্য আধুনিক ইলেকট্রিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে যার মাধ্যমে মহাশূন্য সম্পর্কে আরো জানা যাবে।
ক্ষতিকারক দিকসমূহ: যদিও বিজ্ঞানের অন্যতম লক্ষ্য হলো মানব জাতির কল্যাণসাধন, তথাপি এর কিছু অপকারিতাও রয়েছে। মানুষের ব্যবহারের ভিত্তিতে এর অপকারিতা ও উপকারিতা নির্ধারিত হয়। বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে যেসব কলকারখানা স্থাপিত হয়ে বেকার সমস্যার সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল, সেসব কারখানায় আবার আধুনিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহারের ফলেই বেকারত্বের হার বেড়ে গেছে। এ ছাড়া বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন আবিষ্কার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। ফলশ্রুতিতে মানব সমাজের অস্তিত্ব হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফল। আজকের এই দিনে বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো কলকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ করেই চলেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন হলেও এসব দেশকে আর পিছনে ফেরানো যাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর দুই মেরুতে বরফ গলতে শুরু করেছে। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ বিভীষিকা আমাদের দেখায় বিজ্ঞানের অপব্যবহারকে। বিজ্ঞানের এই অপব্যবহারকে রোধ করে আমরা বিজ্ঞানের সমস্ত কল্যাণকে আয়ত্ত করতে পারি।
উপসংহার: কালের বিবর্তনে মানব জীবন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞান মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্তেই বিজ্ঞানের অবদান রয়েছে। মানব জীবনে বিজ্ঞানের এই ব্যবহারকে ইতিবাচক দিকেই রাখতে হবে। বিজ্ঞানের আলোয় প্রতিটি মানুষকে আলোকিত করতে হবে। সমস্ত কলুষতা থেকে বিজ্ঞানকে মুক্ত রাখার জন্য সকল ধরণের অপব্যবহার থেকে বিজ্ঞানকে সরিয়ে রাখতে হবে। তবেই মানব সভ্যতার যথার্থ উন্নয়ন সম্ভব।

১৫১.বাংলাদেশের বেকার সমস্যা ও তার সমাধান,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; বেকার সমস্যা কী; বেকারত্বের ধরণ ও প্রকারভেদ; বেকার সমস্যা ও বাংলাদেশ; বেকারত্বের কারণ; বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট; বেকারত্বের নেতিবাচক প্রভাব; বেকারত্ব দূরীকরণের উপায়; উপসংহার।)
ভূমিকা: কোনো দেশের জনশক্তির তুলনায় কর্মসংস্থানের স্বল্পতার ফলে সৃষ্ট সমস্যাই বেকার সমস্যা। বর্তমান বাংলাদেশে এই সমস্যা জটিল ও প্রকট আকার ধারণ করেছে। যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কর্মহীন এই বিশাল উদ্বৃত্ত জনশক্তি না পারছে দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখতে, না পারছে নিজের সুন্দর-সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নির্মাণ করতে। বেকারত্বের অসহ্য যন্ত্রণায় তারা জড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র দেখা দিচ্ছে বিশৃংখলা। ক্রমবর্ধমান এই সমস্যা সমাধানে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো যেকোনো সময় ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়বে।
বেকার সমস্যা কী: বেকারত্ব বলতে মূলত বোঝায় কর্মক্ষম শ্রমশক্তির পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, "Unemployment (or joblessness) occurs when people are without work and actively seeking work." The Bureau of Labour Statistics (BLS) বেকারত্বের সংজ্ঞায় বলেছে- ‘বেকারত্ব হচ্ছে এমন কিছু মানুষের কর্মহীন অবস্থা; যাদের কোনো কর্ম নেই, গত চার সপ্তাহ যাবত সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করছে এবং তারা কাজের জন্য প্রস্তুত।’ বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপে (এলএফএস) বেকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে এমন ব্যক্তিকে যার বয়স ১০ বছর কিংবা তার বেশি; কাজের জন্য প্রস্তুত থেকে সক্রিয়ভাবে কাজের অনুসন্ধান করেও যে কাজের সুযোগ পায়নি বা কাজ করতে পারেনি।
বেকারত্বের ধরণ ও প্রকারভেদ: দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামাজিক অবকাঠামো, বেকারত্বের সংজ্ঞা, কারণ ও বৈশিষ্ট্যের বিচারে বেকারত্ব বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত দুর্বলতার ফলে সৃষ্টি হয় অবকাঠামোগত বেকারত্ব। হঠাৎ কোনো মিল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা স্থানান্তরের ফলে আকস্মিক বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। কারিগরি বা প্রযুক্তিগত অপর্যাপ্ততার দরুণ বেকার সমস্যা তৈরি হয়। তৈরি পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য মৌসুমি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেখা দেয় মৌসুমি বেকারত্ব। আবার কাজের ধরণের সঙ্গে শ্রমশক্তির দক্ষতার অসঙ্গতির ফলে সৃষ্টি হয় এক ধরণের বেকারত্ব। তবে বাংলাদেশে কাঠামোগত বেকারত্বের হারই বেশি।
বেকার সমস্যা ও বাংলাদেশ: বর্তমান বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, কমনওয়েলথসহ একাধিক সংস্থার সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী গত এক দশকে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১.৬ শতাংশ, যেখানে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ২০১৫ সালে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়াবে ৬ কোটিতে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বেকার। এই বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিত বেকারের হারই বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি।
বেকারত্বের কারণ: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে বেকার সমস্যা সৃষ্টির পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানাবিধ কারণ রয়েছে। কিছু কারণ নিচে তুলে ধরা হলো-
ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব: ২০০ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং ২৪ বছর পাকিস্তানি শাসনের সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চরমভাবে অবহেলিত হয়েছে। উপরন্তু তারা শোষণ করে নিয়ে গেছে এদেশের মূল্যবান সম্পদ। ফলে ক্রমেই ভেঙে পড়েছে অর্থনৈতিক অবকাঠামো আর বেড়েছে বেকারত্বের চাপ।
শিল্পবিপ্লবের প্রভাব: শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে অধিক উৎপাদনমুখী যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে। ফলে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা জনশক্তির পরিবর্তে কৃষিযন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। শ্রমিকের প্রয়োজন যন্ত্রে পূরণ করায় সৃষ্টি হচ্ছে বেকার সমস্যা।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর চাপ: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো চরমভাবে ভেঙে পড়ে। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন দেশে শিল্পায়নে গতিহীনতা, সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অদক্ষতার দরুন বিশাল একটি জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে পড়ে। যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বাংলাদেশকে এখনও তাড়িয়ে ফিরছে।
অধিক জনসংখ্যা: বাংলাদেশে বেকার সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জনসংখ্যার সীমাহীন চাপই মূলত এর জন্য প্রধানত দায়ী। যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সেই অনুপাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে না।
শিক্ষা ব্যবস্থায় অসঙ্গতি: বাংলাদেশের শিক্ষার হার কম। তদুপরি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এতে নেই বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ। বছর বছর সনদধারী শিক্ষিত জনশক্তি তৈরি হলেও তৈরি হচ্ছে না যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি।
অপরিকল্পিত উৎপাদন ব্যবস্থা: কৃষকের অসচেতনতা ও অপরিকল্পিত ভূমি ব্যবহার বেকার সমস্যার অন্যতম কারণ। জমির উর্বরতা হ্রাস, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জমি উৎপাদন শক্তিহীন হয়ে যাওয়ায় নষ্ট হয় কাজের সুযোগ।
রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত দুর্বলতা: সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে উদ্যোগহীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি, সীমাহীন দুর্নীতি প্রভৃতি কারণে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। যার ফলে বাড়ছে বেকারত্বের চাপ।
কায়িক শ্রমে অনীহা: কায়িক শ্রমের প্রতি অনীহা বেকার সমস্যার একটি অন্যতম প্রধান কারণ। অভাব অনটন সত্ত্বেও এদেশের মানুষ কায়িক পরিশ্রম করতে আগ্রহী নয়। প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি না পেয়ে বেকার হয়ে বসে থাকে, কিন্তু নিজেই আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ভাগ্যোন্নয়নে উদ্যোগী হয় না।
বেকারত্বের নেতিবাচক প্রভাব: বেকারত্ব একটি অভিশাপ। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সর্বত্র এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বেকারত্বের ভয়াল থাবায় দুর্বল হয়ে পড়ে রাষ্ট্রকাঠামো। বেকারত্বের কারণে কোনো কাজ না পেয়ে মানুষ নানা অবৈধ ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়। সমাজে খুন-গুম, রাহাজানি, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। স্থবির হয়ে যায় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা। দেখা দেয় শাসনতান্ত্রিক বিশৃংখলা। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে প্রভাবশালী দেশগুলো। ফলে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
বেকারত্ব দূরীকরণের উপায়: বাংলাদেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে। যথা-
- যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। অধিক জনসংখ্যাকে দেশের বোঝা নয়, সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
- বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি করতে হবে। নারী শিক্ষার সম্প্রসারণে যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
- ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
- কোনো কাজকেই তুচ্ছ না ভেবে কায়িক পরিশ্রমের মর্যাদা দিতে হবে।
- পরিকল্পিত শিল্পকারখানা গড়ে তুলে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
- আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ শ্রমশক্তি গড়তে তুলতে হবে।
- ভাষাগত দুর্বলতা দেশি-বিদেশি শ্রমবাজারে কর্মসংস্থ্না প্রাপ্তিতে একটি বড় সমস্যা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শ্রমিকদের ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে হবে।
- কর্মক্ষম শ্রমিকদের বিদেশে কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
- শিক্ষিত যুবসমাজকে গ্রামমুখী করতে হবে।
- তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেটে আউটসোর্সিং হতে পারে বেকারত্ব হ্রাসের আরেকটি উপায়।
উপসংহার: বেকারত্বের ভয়াবহ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে সমগ্র জাতিকেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলীয়করণের মনোবৃত্তি পরিহার করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্মে নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বেকারত্ব থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

১৫০.জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট; ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য; উপসংহার।)
ভূমিকা: প্রতিটি দেশ, জাতি কিংবা সমাজের নিকট গৌরব করার মতো কিছু বিষয় থাকে। এসব বিষয় বা ঘটনা সেই জাতি, দেশ কিংবা সমাজকে যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণা যোগায়, শক্তি যোগায়, সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের মানুষের নিকট এরূপ স্মরণীয় একটি ঘটনা হলো ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা। এই দিনে মায়ের ভাষার অধিকার রাখতে গিয়ে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালি জাতির সূর্য সন্তানেরা। তাই বাঙালির জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।
ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। শুধু ধর্মীয় সাদৃশ্যের জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটি পৃথক ভূখন্ড হওয়া সত্ত্বেও একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এ দুই অংশের মধ্যে প্রথম বিরোধ শুরু হয় ভাষার প্রশ্নে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে-এই বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত নেয়। দুই পাকিস্তানের মধ্যে সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সংখ্যালঘুর ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু হয়। এমতাবস্থায় দেশভাগ হওয়ার মাত্র ১৭ দিনের মাথায়, ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় তমুদ্দীন মজলিস। এটি বাংলার প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদে গঠিত প্রথম কোনো সংগঠন। এর উদ্যোক্তা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম।
বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার প্রথম প্রস্তাব করা হয় লাহোরে ১৯৪৭ সালের এক শিক্ষা সম্মেলনে। ১৯৪৮ সালে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে বাংলাকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিরোধীতা এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তব্যে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মনে চরম ক্ষোভের জন্ম দেয়। প্রতিটি ঘটনার পর বাংলার ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ মিছিল এবং ধর্মঘটের ডাক দেয়। ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন পুনরায় একই ঘোষণা দেন যে, ‘উর্দু এবং উর্দু-ই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এর প্রেক্ষাপটে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি।’ এই কমিটির উদ্যোগে ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হরতাল এবং ভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সরকার এই আন্দোলনকে দমন করতে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে, শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালায়। ফলে নিহত হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে। অবশেষে বাধ্য হয়ে সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেয়। ১৯৫৬ সালে এটি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়।
ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য: ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম স্তম্ভ রচিত হয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালে বিশ্বের ইতিহাসে নতুন এক রাষ্ট্রের অভ্যূদয় ঘটে। বাঙালিদের গণচেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে এর মাধ্যমে এবং স্বাধিকার আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অন্যান্য আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে শক্তি যোগায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে একুশের চেতনা যেভাবে কাজ করে তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো-
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ: এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারে ২১ দফার প্রথম দাবী ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে এবং সরকার গঠন করে। এটি ছিল একুশের চেতনায় গড়ে উঠা বাঙালির ঐক্যের প্রথম সার্থক প্রতিফলন।
সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ: ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে দেশটির প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়। এতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা ছিল একুশের আর একটি বিজয়।
রাজনৈতিক ঐক্য গঠন: ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাজনীতি ছিল কেবল এলিট বা উচ্চ শ্রেণির জন্য। সাধারণ মানুষ, বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাত না। ১৯৫২’র ঘটনা এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটায় এবং এলিট ও সাধারণ শ্রেণির মানুষকে রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বার্থ আদায়ে ঐক্যবদ্ধ করে। এটি পরবর্তীকালে জাতীয় ঐক্য গঠন ও সুরক্ষায় ভূমিকা পালন করে।
আত্মসচেতনতা অর্জন: ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে বাঙালি জাতি প্রথম আত্মসচেতনতা অর্জন করে। কেননা যদি বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হত তবে এদেশের সাধারণ শিক্ষিত মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হত। এই আশংকা তাদেরকে উদ্বিগ্ন করে তোলে, যা তাদেরকে সচেতন হতে সহায়তা করে। এই আত্মসচেতনতা পরবর্তীকালে অন্যান্য অন্যায়-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদেরকে প্রতিরোধের শক্তি যোগায়।
শিল্প-সাহিত্যের সমৃদ্ধি: একুশের চেতনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সমৃদ্ধি অর্জন করে। একুশের প্রথম কবিতা মাহবুবুল আলমের ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ প্রকাশিত হলে তা চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত গান, কবিতা, উপন্যাস, নাটক রচিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে, যা বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়: ১৯৫২ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে ভিত্তি রচিত হয়, তা পরবর্তীকালের সকল ঘটনা প্রবাহকে প্রভাবিত করে। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন এবং ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে একুশের চেতনা তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভূমিকা পালন করেছে। একুশের চেতনা ও শিক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে বাঙালিদেরকে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালের ঘটনায়: বাংলাদেশ দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রামের পর স্বাধীন হলেও সমস্যার অন্ত ছিল না। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, রাজনৈতিক হত্যাকা-, সামরিক শাসন, অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা, সামাজিক সমস্যা, অত্যাধিক জনসংখ্যা ইত্যাদি সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বর্তমান অগ্রগতি উৎসাহব্যঞ্জক। এর পেছনে একুশের চেতনা কাজ করে বলে অনেকে মনে করেন। এছাড়াও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ঘটনার সাথে ৫২’র আন্দোলনের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। উভয় আন্দোলনই পরিচালিত হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: একুশে ফেব্রুয়ারি বর্তমানে কেবল বাঙালিদের নয়, এটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (UNESCO) একে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এতে সারাবিশ্ব জানতে পারে বাঙালিদের ত্যাগ, আন্দোলন ও সংগ্রামের কথা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালিদের ভূমিকার কথা। এটি আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে তোলে। বাংলাদেশিদেরকে নতুন করে চিনিয়ে দেয় বিশ্ব দরবারে।
উপসংহার: বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশিদের মধ্যে যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়, তাই পরবর্তীকালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। এই জাতীয়তাবাদী চেতনাই বাঙালি জাতিকে স্বশাসন অর্জনের দিকে পরিচালিত করে। এতে বাঙালির মনে যে বৈপ্লবিক চেতনা ও ঐক্যের উন্মেষ ঘটায়, তা পরবর্তীকালে সকল আন্দোলনে প্রাণশক্তি হিসেবে অনুপ্রেরণা যোগায়। সর্বোপরি একটি স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পেছনে একুশের তাৎপর্য বাঙালি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে।

১৪৯.দারিদ্র্য বিমোচন,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; দারিদ্র্যের ধারণা; বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি; দারিদ্র্যের কারণ; দারিদ্র্র্যের প্রভাব; দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী; সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ; বেসরকারি পদক্ষেপ; বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে করণীয়; উপসংহার।)
ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বে মানুষ যখন মহাকাশ জয়ের নেশায় মত্ত, সেই সময় নানাবিধ সমস্যা মানব সমাজকে অস্থির করে তুলছে। দারিদ্র্য সমস্যা তেমনই একটি সমস্যা। যার নির্মম কষাঘাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন আজ বিপর্যস্ত। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহে এই সমস্যা প্রকট। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এবং দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশ। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতির ধারাকে ব্যহত করছে এই সমস্যা। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী সবচেয়ে আলোচিত বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম।
দারিদ্র্যের ধারণা: দারিদ্র্য একটি আপেক্ষিক বিষয়। একে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দারিদ্র্যের প্রকৃতি ও সূচক বিভিন্ন হয়ে থাকে। আভিধানিক অর্থে ‘দারিদ্র্য’ মানে অভাব, অনটন বা অপর্যাপ্ততা। অর্থাৎ দারিদ্র্য বলতে এমন অবস্থাকে বুঝায় যেখানে মানুষ ন্যূনতম মান বজায় রেখে মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার মতো আবশ্যকীয় ব্যয় নির্বাহ করতে সমর্থ হয় না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে দারিদ্র্যের প্রকৃতিকে দুটি দিক থেকে মাপা হয়। দৈনিক মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণ ও আয় দিয়ে এ দুটি সূচক তৈরি হয়। খাদ্য গ্রহণের সূচকে যারা প্রতিদিন ২১২২ কিলোক্যালরির কম খাবার গ্রহণ করে তারা দারিদ্র্য সীমার নীচে অবস্থান করে। আর যারা ১৮০৫ কিলোক্যালরির কম খাবার পায় তারা চরম দারিদ্র্যের শিকার। অন্যদিকে মাথাপিছু আয়ের হিসাবে বিশ্বব্যাংকের প্রদত্ত দারিদ্র্যের সীমা হলো দৈনিক ২ ডলার। অর্থাৎ যারা দৈনিক ন্যূনতম ২ ডলার আয় করতে পারে না তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। আর যাদের আয় দৈনিক মাথাপিছু ১.২৫ ডলারের কম, তারা চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করে।
বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি: স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা ছিল চরম দারিদ্র্য। এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। এ সময় থেকে সরকারের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকা- আবর্তিত হতে থাকে দারিদ্র্য বিমোচনকে প্রাধান্য দিয়ে। বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (PRSP) দারিদ্র্য বিমোচনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হলেও বাংলাদেশের বর্তমান দারিদ্র্য পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। বিভিন্ন তথ্যমতে দারিদ্র্যের নিম্নসীমায় বসবাসকারী জনসংখ্যার শতকরা হার ক্রমহ্রাসমান হলেও মোট দরিদ্র জনসংখ্যা পরিমাণ কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী জনসংখ্যার শতকরা হার ১৫ ভাগ, যা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ছিল ৩১.৫% ভাগ। বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
দারিদ্র্যের কারণ: দারিদ্র্য একটি ব্যাপক সামাজিক সমস্যা এবং এর পেছনে একক কোনো কারণ দায়ী নয়। বহুবিধ কারণে এদেশে দারিদ্র্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ, অনুন্নত অবকাঠামো, অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা, অনগ্রসর শিল্প, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পদের অসম বণ্টন, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা, বেকারত্ব ও বাণিজ্য ঘাটতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, বাস্তবমুখী নীতি ও পরিকল্পনার অভাব, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নেতৃত্বের অদক্ষতা, সমাজের প্রতিটি স্তরে ব্যাপক আকারে দুর্নীতি ইত্যাদি বাংলাদেশের দারিদ্র্যের প্রধান কারণ।
দারিদ্র্যের প্রভাব: দারিদ্র্য এমন একটি সমস্যা, যার প্রভাব প্রতীয়মান হয় সমাজের প্রতিটি স্তরে। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিকেই দারিদ্র্যের ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা যায়। দারিদ্র্যের কারণে মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। যথাযথ সুযোগ-সুবিধার অভাবে মানব সম্পদে পরিণত হতে পারে না। তাদের জীবনযাত্রার মানও নিম্নমুখী হয়। দারিদ্র্যের কারণে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সামাজিক সমস্যা যেমন-দাম্পত্য কলহ, যৌতুক প্রথা, পতিতাবৃত্তি, আত্মহত্যা, পারিবারিক ভাঙন ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং দুর্নীতির অন্যতম কারণ দারিদ্র্য, যার জন্য দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এটি কেবল একটি সমস্যা নয়, বরং বহুবিধ সমস্যার জন্মদাতাও বটে।
দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী: বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার, বেসরকারি সংস্থা (NGO) এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসমূহ কাজ করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব কর্মসূচীকে প্রধানত সরকারি এবং বেসরকারি এ দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়।
সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ: বাংলাদেশ সরকার দারিদ্র্য বিমোচন এবং মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার এ পর্যন্ত ৬ টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং PRSP-I ও II বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে। সবগুলো পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। সরকার এজন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
শিক্ষা উন্নয়ন: দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়তে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো শিক্ষা। এজন্য সরকার সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য ‘স্কুল ফিডিং’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, শিক্ষার বিনিময়ে টাকা, ছাত্রী উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ ইত্যাদির পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে শক্তিশালী এবং স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়।
কৃষি উন্নয়ন: কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি। এজন্য সরকার কৃষি উন্নয়নে উন্নত বীজ, সার, সেচ এবং কৃষিঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।
শিল্পোন্নয়ন: শিল্পের উন্নয়ন ছাড়া বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না। এটি আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এজন্য সরকার শিল্পের উন্নয়নে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঊচত স্থাপনসহ দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদেরকে শিল্প স্থাপনে সরকার সহায়তা দিয়ে আসছে, যা দারিদ্র্য বিমোচন এবং উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে।
বয়স্কভাতা কর্মসূচী: সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা আয়-উপার্জন করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, তাদেরকে ভাতা দেওয়ার কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।
এসিড দগ্ধ মহিলা ও প্রতিবন্ধী কল্যাণ: এসিড দগ্ধ মহিলা ও অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ কর্মসূচির অধীনে মাসিক ৩০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা ভাতা: বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, যারা সমাজে অবহেলিত, সরকার তাদের ভাতার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
মাতৃত্বকালীন ভাতা: গরিব পরিবারের গর্ভবর্তী মা যেন অপুষ্টিতে না ভোগেন, সেজন্য সরকার ভাতার ব্যবস্থা করেছে। যেটি মা ও শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও টাকা (কাবিখা/কাবিটা) কর্মসূচী: গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার প্রথমে কাবিখা প্রকল্প গ্রহণ করে। পরবর্তীতে এটি কাবিটাতে রূপান্তরিত করা হয়।
গৃহায়ণ তহবিল: গ্রামীণ ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের গৃহনির্মাণে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার এই তহবিল গঠন করেছে।
অন্যান্য:উপরে উল্লিখিত কর্মসূচী ছাড়াও সরকার সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচনের সাথে সম্পর্কযুক্ত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আদর্শ গ্রাম, সমন্বিত মৎস্য কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন, পশু সম্পদ উন্নয়ন, গ্রামীণ মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প, পল্লী বিদ্যুতায়ন প্রকল্প, যুব প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ইত্যাদি।
বেসরকারি পদক্ষেপ: বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এর মধ্যে প্রধান হলো গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, প্রশিকা, আশা, কারিতাস, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, RDRS প্রভৃতি। এ সকল এনজিওর কার্যক্রমের মধ্যে প্রধান হলো ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, কৃষি উন্নয়ন, কুটির শিল্প স্থাপন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, রেশম উন্নয়ন, নলকূপ ও স্যানিট্রেশন, সামাজিক বনায়ন, গৃহায়ন ইত্যাদি।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে করণীয়: দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সুসংগঠিত পরিকল্পিত, পর্যাপ্ত এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। দারিদ্র্য বিমোচনে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জনের জন্য নিচের বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন-
- সম্পদের বৈষম্য হ্রাসে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
- শিল্প ও কৃষিতে উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
- দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করতে হবে।
- দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
- আইনের শাসন, সুবিচার, সুশাসন ও রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে।
- অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে।
- পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধার নিশ্চয়তা থাকতে হবে এবং তা সহজলভ্য করতে হবে।
- সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণ করার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
- সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার: বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের এক সমস্যা হলো দারিদ্র্য। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টাও প্রশংসনীয়। কিন্তু তার পরও এই সমস্যার প্রত্যাশিত সাফল্য আসছে না। যে কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক হাজারো সমস্যা আঁকড়ে ধরে আছে আমাদের এই দেশটাকে। তাই দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব।

১৪৮.আইনের শাসন,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; আইনের শাসন; আইনের শাসনের নীতি ও অভিব্যক্তি; আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা; আইনের শাসন ও বাংলাদেশের সংবিধান; বাংলাদেশে আইনের শাসনের বিভিন্ন দিক; আইনের শাসনে আইন বিভাগের গুরুত্ব;বাংলাদেশে আইনের শাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ; আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমদের করণীয়; উপসংহার।)
ভূমিকা: আধুনিক বিশ্ব হলো গণতান্ত্রিক বিশ্ব। আর গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মূল নির্দেশক হলো আইনের শাসন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকার নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে। দেশ ও সরকার পদ্ধতিভেদে আইন ও সংবিধান ভিন্ন হলেও তা পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রেই বিদ্যমান। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইনের শাসন ছাড়া যেহেতু নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না তাই গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও আইন, সংবিধান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও প্রতিষ্ঠান সবই আছে। তবে বাংলাদেশে আইনের অপপ্রয়োগে মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি মজবুত করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং এজন্য আইনের সুষ্ঠু ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
আইনের শাসন: রাষ্ট্র বা সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতার ক্ষেত্রকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই শাসন বিভাগের ভূমিকাই তুলনামূলকভাবে বেশি। আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে, আর বিচার বিভাগ আইনের ব্যাখ্যা দান, বিভিন্ন মামলায় প্রচলিত আইনের প্রয়োগ ও আইন অমান্যকারীকে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করে। শাসন বিভাগ আইন বিভাগের প্রণীত আইনসমূহকে বিচার বিভাগের সহায়তায় কার্যে পরিণত করে। মূলত এটিই হলো আইনের শাসন। আইনের শাসনে সংবিধানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান সংবিধান মেনে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
আইনের শাসনের নীতি ও অভিব্যক্তি: আইনের শাসন হলো আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ও কর্তৃত্ব। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে সকল বিষয় নির্ধারণের মানদ- হবে আইন এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান হিসেবে বিবেচ্য। প্রত্যেক নাগরিক যেমন তার কৃতকর্মের জন্য আইনের মুখোমুখি হবে তেমনি নিজেদের অধিকার ও দাবি আদায়ে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে। বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে। আইন ব্যবস্থা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার অনুকূলে হতে হবে। সুতরাং আইনের শাসনের একটি প্রয়োগিক ক্ষেত্র আছে এবং এটি একটি সার্বিক প্রক্রিয়া।
আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা: একটি গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান করে আইনের শাসন। আইনের শাসন দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত ও গতিশীল করে; গণতন্ত্র চর্চার পথকে করে অবাধ ও উন্মুক্ত। আইনের শাসনের ফলে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়। আইনের শাসন বিরাজ করলে দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হয়। আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হয়। মানুষের বাক-স্বাধীনতা ও চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। সকল জনগণের সমানভাবে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত হয়। আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা তাই অপরিসীম।
আইনের শাসন ও বাংলাদেশের সংবিধান: বাংলাদেশের সংবিধানে আইনের শাসনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৭ নং ধারায় বলা হয়েছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩২ নং ধারা অনুযায়ী আইনের বাইরে কোনো ব্যক্তিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সুতরাং বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সরকার আইনের বাইরে কোনো নাগরিকের জান, মাল ও সম্মানের হানিকর এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা প্রচলিত আইন মেনে করতে হবে এবং তাকে প্রচলিত নিয়মনীতি ও পদ্ধতি অনুসারে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশে আইনের শাসনের বিভিন্ন দিক: বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিদ্যমান সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা, আদর্শ সংবিধান, নির্বাচিত সরকার ও আইন পরিষদ এবং দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি থাকায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন একেবারে সীমিত। আমাদের আইনি কাঠামো, প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দল সবই যেন আইনের শাসনের প্রতিবন্ধক। এ দেশে আইনের উপর ব্যক্তির প্রাধান্য ও আইনের অসম প্রয়োগনীতি বিদ্যমান। এ দেশে পর্যাপ্ত আইন ও নীতিমালা বিদ্যমান থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। সর্বোপরি বাংলাদেশে আইনের শাসনের নীতিমালা শুধুই সংবিধানে লিপিবদ্ধ বাস্তবে সাধারণ জনগণের বেলায় তা সত্য বলে প্রতীয়মান হয় না।
আইনের শাসনে আইন বিভাগের গুরুত্ব: আইন প্রণয়ন করা হলো আইন সভার প্রধান কাজ। দেশের নাগরিকের সকল ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে আইনসভার মাধ্যমে। আইন সভা কর্তৃক প্রণীত আইন অনুযায়ী শাসনকার্য ও বিচার কার্য পরিচালিত হয়। আইন সভা পুরাতন অনুপযোগী আইনগুলোকে বাতিল বা সংশোধন করে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যুগোপযোগী নতুন আইন প্রবর্তন করে। বংলাদেশের আইন সভা আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে শাসনকার্য পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাংলাদেশে আইনের শাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ:বাংলাদেশে আইনের শাসন একেবারেই নেই একথা বলা যাবে না। তবে যথাযথভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমাদের দেশের আইন প্রণেতারা তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে কেবলই দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নিজ নিজ দলীয় স্বার্থে আইন প্রণয়ন করেন। আমাদের দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশ বাহিনী আইনের অপপ্রয়োগ করে ভালো আইনকেও কলুষিত করে। এছাড়া নিম্ন আদালতের অনেক বিচারক, মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা বা দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির ক্রীড়ানক। নিম্ন আদালতে ঘুষ, দুর্নীতি আর শাসন বিভাগীয় হস্তক্ষেপের কারণে গরিব, অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হয়। বাংলাদেশে আইনের শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তরায় বিচার বিভাগের উপর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। এছাড়াও আইনের শাসনের অন্যতম বাধা হলো প্রশাসনিক দুর্বলতা।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের করণীয়: বাংলাদেশে আইনের শাসনকে যথাযথ রূপ দিতে হলে আমাদের সকলকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। আইন প্রণয়নকালে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। মূলত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদেরকে নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে-
- প্রকৃত অর্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
- বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ন্যায়পাল নিয়োগ দিতে হবে।
- পুলিশ বাহিনীর সংস্কার সাধন করে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- দেশের গণবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, কালো আইন বাতিল করতে হবে।
- ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও ঐকমত্য থাকতে হবে।
- সর্বোপরি আইন প্রণেতাসহ সকলকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
উপসংহার: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সামনে এগুতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এজন্য দেশের জনগণকে আইনি শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা এবং অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকেও জনগণের অধিকার ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে দায়বদ্ধ হতে হবে।

১৪৭.বাংলাদেশের নদ নদী,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থা; বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী; নদী ও কৃষি; নদী ও শিল্প; মৎস্য সম্পদ; নৌ চলাচল ও পরিবহন; জল বিদ্যুৎ উৎপাদন; নদী ও যোগাযোগ ব্যবস্থা; নদী ও বাংলা সাহিত্য; উপসংহার।)
ভূমিকা:
“এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়, এ আমার দেশ
কত আনন্দ বেদনা মিলন-বিরহ সংকটে।”
-আবু জাফর
নদী ও বাংলাদেশ একই সূতোয় গাঁথা দুটি নাম। এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ দেশে সর্বত্র জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নদীগুলো। বাংলাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ, যার সৃষ্টি নদীবাহিত পলি জমাট বেঁধে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী। ছোট বড় অনেক উপনদী এসে এসব নদীতে মিশেছে। এসব নদ-নদী বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বৈচিত্র্য দান করেছে। বলতে গেলে এ নদীই বাংলাদেশের প্রাণ। সে জন্যই নদীর সাথে বাঙালির রয়েছে নাড়ীর টান।
বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থা: বাংলাদেশের নদীগুলোর অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে প্রবাহিত। মোট প্রায় ২৪,১৪০ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে বাংলাদেশের নদীগুলো ৪টি নদী প্রণালী বা নদী ব্যবস্থায় বিভক্ত। যথা:
১। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ২। গঙ্গা-পদ্মা ৩। সুরমা-মেঘনা ও ৪। চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদীসমূহ।
গঠন ও প্রবাহ বৈশিষ্ট্যে বাংলাদেশের নদীগুলো কয়েকটি ভাগে বিভক্ত যথা:- প্রধান নদী, উপনদী, শাখা নদী, স্বাধীন নদী ও নদী মোহনা। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীগুলোর উৎপত্তি ভারত।
বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী: অধিক সংখ্যক নদী থাকার কারণে বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। এজন্য এদেশের মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির উপর নদীর প্রভাব রয়েছে। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র যমুনা, মেঘনা ও কর্ণফুলী বাংলাদেশের প্রধান নদ-নদী। এ নদ-নদীগুলোর উপনদী ও শাখা নদী রয়েছে। নিম্নে প্রধান নদ-নদীর বর্ণনা দেয়া হলো-
পদ্মা: বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নদী পদ্মা। এর দৈর্ঘ্য ৩৬৬ কি.মি.। এটি হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মধ্যদিয়ে গঙ্গানদী পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পদ্মা নদী রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানার দৌলদিয়ায় যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে। এছাড়া চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। কুমার, গড়াই, ভৈরব, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ, মাথাভাঙ্গা, ইছামতি, চিত্রা ইত্যাদি পদ্মার প্রধান শাখা নদী। পদ্মার উপনদীগুলো হলো মহানন্দা, নাগর নদী, পুনর্ভবা, টাঙ্গন এবং কুলিখ।
মেঘনা:ভারতের মনিপুর রাজ্যের নাগা মনিপুর পাহাড়ের পাদদেশে মেঘনা নদীর উৎপত্তি। উৎপত্তি স্থলে এর নাম বরাক। বরাক নদীটি বাংলাদেশের অদূরে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ থানার ভিতর দিয়ে পৃথকভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কালনী হয়ে মেঘনা নাম ধারণ করে। এরপর চাঁদপুরে পদ্মার সাথে মিলিত হয়ে আরও দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মনু, খোয়াই মেঘনার প্রধান শাখা নদী এবং গোমতী, তিতাস, ডাকাতিয়া মেঘনার উপনদী।
ব্রহ্মপুত্র: এ নদ হিমালয় পর্বতের কৈলাস শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রথমে তিব্বতের উপর দিয়ে পূর্ব দিকে ও পরে আসামের ভিতর দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। অতঃপর ব্রহ্মপুত্র কুড়িগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধরলা ও তিস্তা ব্রহ্মপুত্রের প্রধান উপনদী এবং বংশী ও শীতলক্ষ্যা প্রধান শাখা নদী।
যমুনা: যমুনা নদী তিব্বতের কৈলাশ শৃঙ্গের নিকটে মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়েছে। জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের কাছে ব্রহ্মপুত্রের শাখা যমুনা নদী নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে দৌলতদিয়ার কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়ে পদ্মা নাম ধারণ করে দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে। করতোয়া ও আত্রাই যমুনার প্রধান উপনদী। যমুনার শাখা নদী ধলেশ্বরী আর ধলেশ্বরীর শাখা নদী বুড়ি গঙ্গা।
নদী ও কৃষি: কৃষি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের চাষাবাদ ব্যবস্থা অনেকটাই নদীর সেচ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কেননা আমন ধান কাটার পর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বীজতলা তৈরি করে ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে বোরো ধান রোপণ করা হয়। এ সময় বোরো মৌসুমে তেমন বৃষ্টিপাত হয় না বিধায় ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত জোয়ারের সময় নদীর পানি দিয়ে সেচ প্রদান করা হয়। এজন্য কৃষির উন্নয়নে নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নদী ও শিল্প: বাংলাদেশ ধীরে ধীরে শিল্পায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলো বিভিন্নভাবে নদীর পানি ব্যবহার করে। এছাড়া নদী পথে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় বড় শিল্প কারখানা নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছে।
মৎস্য সম্পদ: নদীমাতৃক এ দেশটি স্মরণাতীতকাল থেকে মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধশালী। আর তাইতো বাঙালিকে বলা হত ‘মাছে ভাতে বাঙালি।’ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মৎস্যখাত ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ছিল ৫.৫২ শতাংশ। বাংলাদেশে নদীতে ইলিশ, পাঙাশ, রুই, কাতলা, বোয়াল, পাবদাসহ বিভিন্ন ধরণের মাছ পাওয়া যায়।
নৌ চলাচল ও পরিবহন: নদী পরিবহন সবচেয়ে সস্তা ও সহজ পরিবহন ব্যবস্থা। বাংলাদেশে নদী পরিবহন দীর্ঘদিন ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশে ২টি প্রধান সমুদ্রবন্দর রয়েছে চট্টগ্রাম ও মংলায়। ইওডঞঈ দেশের ৬০০০ কি.মি নৌপথে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে থাকে। নদী পথে পরিবহন ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার প্রভৃতি পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জল বিদ্যুৎ উৎপাদন: বাংলাদেশের একমাত্র জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্ণফুলী নদীতে অবস্থিত যা কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নামে পরিচিত। খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীতে ১৯৬২ সালে স্থাপিত এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ৫টি ইউনিটের মাধ্যমে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। এ কেন্দ্রটি দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে সামান্য হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
নদী ও যোগাযোগ ব্যবস্থা: নদী পথে সুলভে যাতায়াত করা যায়। বাংলাদেশে সারাবছর নৌ চলাচল উপযোগী নৌপথের দৈর্ঘ্য ৫২২১ কিলোমিটার। বর্ষা মৌসুমে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮৪৩৯ কিলোমিটার। বাংলাদেশে বর্তমানে ২২টি নদী বন্দর রয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ প্রধান নদীবন্দর যেটি শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। এছাড়া অসংখ্য নদীর উপর রয়েছে সুদৃশ্য সেতু। যেমন বঙ্গবন্ধু সেতু যা যমুনা নদীর উপর অবস্থিত। এটি বিশ্বের ১১তম বৃহত্তম সেতু। তাছাড়া নির্মিতব্য পদ্মা সেতু তৈরি হলে এটি হবে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সেতু যার দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কি.মি.। এছাড়া খানজাহান আলী সেতু, লালনশাহ সেতু উল্লেখযোগ্য।
নদী ও বাংলা সাহিত্য: নদীকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস, গান, প্রবন্ধ ইত্যাদি। সুদূর ফ্রান্সে বসে মাইকেল মধুসূধন দত্ত লিখেছেন-
সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে
বহু দেশ দেখিয়াছি, বহু নদজলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে
নদীকে কেন্দ্র করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন- ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস। অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন- ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেছেন ‘কর্ণফুলী’। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পদ্মাবোটে বসে লিখেছিলেন ‘সোনার তরী’ নামক বিখ্যাত কবিতাটি। তাছাড়া নদীর কথা আসতেই এই গানটি মনে পড়ে যায়-
ও নদীরে একটা কথা সুধাই শুধু তোমারে. . .
কোথায় তোমার দেশ তোমার নাইকি চলার শেষ।
উপসংহার :
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
সত্যিই বাংলাদেশ এমনি বৈচিত্র্যেভরা। এই দেশে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদী। এসব নদী মাতৃভূমিকে করেছে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা। তাই ইতিহাস ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আজ অনেক নদী মারাত্মক দুষণের শিকার। পানির অভাবে অনেক নদী মৃতপ্রায়। সুতরাং নদী রক্ষায় সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে বিপন্ন হারিয়ে যাওয়া, মৃতপ্রায় নদীগুলোকে উদ্ধার করতে হবে। কেননা নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে, বাঁচবে দেশের মানুষ।

১৪৬.বিশ্ব পরিবেশ দিবস,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; পরিবেশ দিবস; বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রয়াস; বিশ্ব পরিবেশ দিবসের কর্মসূচী; পরিবেশ দিবসের উদ্দেশ্য; পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা; পরিবেশ দিবসের গুরুত্ব; পরিবেশ দিবস ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশে পরিবেশ দিবসের কর্মসূচী; উপসংহার।)
ভূমিকা: মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে মানুষ গড়ে তুলেছে তার পরিবেশ। পরিবেশই প্রাণের ধারক ও বাহক। আর মানুষের উপযোগী এই পরিবেশ ক্রমবিবর্তনের ফলে অর্জিত হয়েছে। কিন্তু আজ এই পরিবেশ বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি। এই সংকট বিশেষ কোনো গোষ্ঠী, দেশ বা জাতির নয়; সমগ্র মানবজাতির। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে পরিবেশ আজ বিপন্ন। আর তাই পরিবেশের নানা দুষণ ও সমস্যা দূর করে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসযোগ্য হিসাবে গড়ে তোলাই আমাদের কাম্য।
পরিবেশ দিবস: মানুষ তার নিজের চেষ্টা সাধনা দ্বারা নানা কিছু জয় করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ফলে আজ মানুষ গভীর সাগরতল থেকে মহাশূন্যে আধিপত্য বিস্তার করছে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে পরিবেশের সাথে। আর এই পরিবেশ নানা কারণে দূষিত হচ্ছে। এই দূষণ আমাদের কঠিন থেকে কঠিনতর অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে সচেতন হচ্ছে বিশ্বের মানুষ। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসাবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ প্রতিবছর বিভিন্ন বিষয়কে সামনে রেখে এর প্রতিপাদ্য ঠিক করে থাকে। দিবসটির ২০১৪ সালের এর প্রতিপাদ্য ছিল- ''Raise your voice, not the sea level'' অর্থাৎ ‘হতে হবে সোচ্চার, সাগরের উচ্চতা বাড়াবো না আর।’
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রয়াস: ঊনিশ শতকের শেষের দিকে পরিবেশ দূষণের মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে পরিবেশ বিজ্ঞানী ও গবেষকরা পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এই সূত্র ধরেই ১৯৯২ সালের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন ব্রাজিলের রাজধানী রিওডি জেনেরোতে বিশ্ব পরিবেশ শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেয় শিল্পোন্নত দেশসহ বিশ্বের ১৭০টি দেশের প্রতিনিধিরা। এই সম্মেলনে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যকার বৈষম্য ভুলে গিয়ে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়। পরিবেশ দূষণে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর তুলনায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর ভূমিকা অনেক বেশি। তাই শিল্পোন্নত দেশগুলো পদক্ষেপ না নিলে পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব না।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের কর্মসূচী: বিশ্ব পরিবেশ দিবস আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত একটি দিবস। সারা বিশ্বের মানুষ এই দিবসটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে থাকে। এতে সমসাময়িক দুর্যোগ, দুষণের ভয়াবহতা নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। এছাড়াও র‌্যালী, আলোচনা সভা, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা, বৃক্ষরোপণ ও বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। চলতি বছরে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পরিবেশ দিবসে বিশেষভাবে আলোচনার জন্য নির্ধারিত হয়েছে। জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশ আলোচনা সাপেক্ষে বছরব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণের কর্মসূচী গ্রহণ করে।
পরিবেশ দিবসের উদ্দেশ্য: পরিবেশকে বাঁচানোই পরিবেশ দিবসের মূল উদ্দেশ্য। মানুষের বসবাস উপযোগী বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে চাই দূষণমুক্ত পরিবেশ। তাই বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। নিম্নে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের উদ্দেশ্যগুলো তুলে ধরা হলো-
- সকল দেশের জাতীয় পরিবেশ নীতির সফল বাস্তবায়ন করা।
- বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা করা।
- বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণে গুরুত্বারোপ করা।
কৃষি কাজে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার কমানো।
- শিল্পবর্জ্য যথাযথভাবে পরিশোধন নিশ্চিতকরণ।
- উপকূলীয় বনায়ন সম্প্রসারিত করা।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
- পরিবেশ সংরক্ষণে ব্যাপকভাবে প্রচার ও সম্প্রসারণ।
- সর্বোপরি পরিবেশ সম্পর্কে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
পরিবেশ দূষণে ভয়াবহতা: আজ পরিবেশ বিভিন্ন কারণে দূষণের ভয়াবহতার শিকার হচ্ছে। পরিবেশের প্রত্যেকটি উপাদানেরই নির্দিষ্ট ধারণ ক্ষমতা আছে। আর যখন দূষণ ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যায় তখনই ভারসাম্য হারায় পরিবেশ। নগরায়ন, শিল্পায়ন, বনভূমি উজাড়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জমিতে সার ও কীটনাশক ব্যবহার, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া প্রভৃতি কারণে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দূষণের ভয়াবহতার কবলে পড়ছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। এই দূষণের কারণে পৃথিবী থেকে আজ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। বাতাসে প্রতিবছর ২০ কোটি টন কার্বন মনোঅক্সাইড সঞ্চিত হচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে বৃষ্টির পানিতে এসিডের পরিমাণ বাড়ছে। পৃথিবীর ৮০ শতাংশ নতুন নতুন রোগের সৃষ্টির কারণ পরিবেশ দূষণ। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন পরিবেশের এই ভয়াবহ দূষণে পৃথিবী পৃষ্ঠের বহু জায়গা বন্যায় প্লাবিত হবে ও তুষারপাতে জমাট বেঁধে যাবে।
পরিবেশ দিবসের গুরুত্ব: শুধু সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা বা আলোচনাই পরিবেশ দিবসের লক্ষ্য নয়। প্রয়োজন দিনটির গুরুত্ব উপলব্ধি করা। বিশ্বের প্রতিটি দেশ দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে এবং দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়ায় ব্রত হয়। মানুষ পরিবেশের ভয়ানক চিত্র সম্পর্কে জানতে পারে। এর ফলে পূর্ব ব্যবস্থা বা পরিকল্পনার মাধ্যমে দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়তে আগ্রহী হয়। বিভিন্ন দেশে সরকার ও জনগণ পরিবেশ রক্ষার কাজে হাত লাগিয়েছে। পরিবেশ দিবস উদযাপনের আহ্বান মূলত বিশ্ববাসীকে দূষণবিরোধী কাজে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান। তাই এই দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
পরিবেশ দিবস ও বাংলাদেশ: পৃথিবীর পরিবেশ সংরক্ষণ ও দুষণমুক্ত রাখতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও প্রতিবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন করে থাকে। বৈষ্ণিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য হলেও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতির সম্মুখীন বাংলাদেশ। তাই বাংলাদেশের জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে পরিবেশ দিবসের গুরুত্ব অনেক।
বাংলাদেশে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের কর্মসূচী: বিশ্ব পরিবেশ দিবসের সাথে একাত্ব হয়ে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে থাকে। বর্তমানে পরিবেশ রক্ষার্থে জনগণের সক্রিয়তার কথা বলা হচ্ছে। দূষণের কুফল ও পরিবেশ রক্ষার সংবাদ নিয়ে জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রচার করছে। তাছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন: বন সংরক্ষণ, বনায়ন, বৃক্ষরোপণ, পরিবেশ পরিচ্ছন্নকরণ ইত্যাদি।
উপসংহার: বর্তমানে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে পৃথিবী ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ মানুষ পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে চায়। তাই বিশ্বকে বসবাসযোগ্য করার লক্ষ্যে দূষণমুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গিকার নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

১৪৫.শিক্ষাঙ্গনে সংকট ও সমাধান,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান অবস্থা; শিক্ষাঙ্গনে সংকট; শিক্ষানীতির অভাব; শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস; ছাত্র রাজনীতি; শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ; সেশনজট; প্রশ্নপত্র ফাঁস; শিক্ষাঙ্গনে সংকট সমাধানের উপায়; উপসংহার।)
ভূমিকা: বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছে অনেক আগেই। এদেশে উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকলেও শিক্ষার অভাবে উন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অস্থিরতা, অরাজকতাসহ অন্যান্য হাজারো সংকটে জর্জরিত আমাদের শিক্ষাঙ্গন। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া একটি দেশের উন্নতি কখনই ঘটনানো সম্ভব নয়। আর তাই সামাগ্রিক সংকট দূর করে সঠিক শিক্ষা দানের মাধ্যমে ছাত্রদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। এতেই বিশ্ব নতুন সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ দেখতে পারবে।
শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান অবস্থা: বর্তমানে দেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেকটা অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ছাত্রদের যেখানে বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকার কথা, সেখানে আজ হায়েনার নির্মম থাবা। খুন, জখম ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে সহিংসতা চরম রূপ ধারণ করেছে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন দাপটের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে অন্যদিকে বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা বোমা, ককটেল নিক্ষেপের পথ বেছে নিয়েছে। হাত পায়ের রগ কেটে দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। বর্তমানে ছাত্র নামধারী একদল শিক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে বা ক্ষমতা দ্বারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করা, ছাত্রাবাসে আসন দখলের জন্য হামলা চালানো প্রভৃতি অনৈতিক কার্যকলাপ করে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন আজ জিম্মি সন্ত্রাসীদের হাতে এবং শিক্ষাঙ্গন যেন পরিণত হচ্ছে সন্ত্রাসাঙ্গনে।
শিক্ষাঙ্গনে সংকট: আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো নানা সমস্যায় জর্জরিত। ফলে সঠিক শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাঙ্গনে সংকটের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে শিক্ষানীতির অভাব, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ, সেশনজট, প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপক সংকটের মুখে পড়বে।
শিক্ষানীতির অভাব: স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সঠিক কোনো শিক্ষানীতির আলোকে পথ চলতে পারেনি। ১৯৯০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস এবং ১৯৯১ সাল থেকে তা চালু হলেও এর সঠিক সুফল পাওয়া যায়নি। তাছাড়া আমরা দেখতে পাই যে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ব্যাপক পাসের হার এবং জিপিএ পাঁচ-এর ছড়াছড়ি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই জিপিএ পাঁচ প্রাপ্ত ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বর তুলতে পারে না। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় বর্তমানে পাসের হার ও জিপিএ পাঁচ এর হার বাড়লেও আমাদের শিক্ষার মান বেড়েছে কী? এই অবস্থার জন্য অনেক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ বা শিক্ষাবিদ আমাদের দুর্বল শিক্ষানীতিকেই দোষারোপ করে থাকেন।
শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস: বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস অন্যতম একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের এমন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে সন্ত্রাস নেই। এই ভাইরাসটি শিক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। রাজনীতি, চাঁদাবাজি আর মাস্তানির ফলে শিক্ষাঙ্গন আজ সন্ত্রাসাঙ্গণে পরিণত হচ্ছে। ছাত্ররা কখনো স্বেচ্ছায় আবার কখনও চাপের মুখে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতার লোভে এক ছাত্র আরেকজনকে হত্যা করছে। ছাত্র রাজনীতি, টেন্ডার বাজি, নৈরাজ্য ইত্যাদি শিক্ষাঙ্গনকে অশান্ত করে তুলেছে। এর ফলে ছাত্রদের মূল্যবান সময়, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সর্বোপরি এটি দেশকে যে ভয়াবহ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষো রাখে না।
ছাত্র রাজনীতি: আজকের বাংলাদেশের যত বড় বড় অর্জন ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সবকিছুই ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকায় অর্জিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতার লোভে ছাত্ররা হাতে অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। সাধারণ ছাত্ররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে রাজনৈতিক দলে ভিড়ছে। এতে একদিকে যেমন শিক্ষাঙ্গন কলুষিত হচ্ছে অন্যদিকে হ্রাস পাচ্ছে শিক্ষার মানও।
শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ: বর্তমানে শিক্ষা অনেকের কাছে একটি বাণিজ্যিক পণ্যের মতো রূপ ধারণ করেছে। সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন সংখ্যা কম থাকার কারণে বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। এখানে বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে কোনো রকমে সময় পার করে হাতে সার্টিফিকেট তুলে দেওয়া হয়। তাছাড়া শিক্ষকরা ক্লাসের বাইরে প্রাইভেট, কোচিং, খন্ডকালীন চাকুরি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ প্রভৃতি কাজে জড়িয়ে পড়ে। যার খারাপ প্রভাব পড়ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়।
সেশনজট: শিক্ষাঙ্গনে একটি বিশাল সমস্যা সেশনজট। আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এমন একশ্রেণির শিক্ষক রয়েছেন যারা শিক্ষাদানকে দায়িত্ব মনে না করে ব্যবসা মনে করেন। তারা সঠিক সময়ে ক্লাস, পরীক্ষা এমনকি ফল দেওয়াতে বিলম্ব করেন। যার দরুন সেশনজটের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলাদলি, সন্ত্রাস প্রভৃতির কারণেও সেশনজটের সৃষ্টি হয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁস: সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে দেশে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। পিইসি পরীক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হচ্ছে। আর এতে করে দেশের প্রকৃত মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এটি খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। এর ফলে দুর্নীতির কালো থাবা আমাদের পবিত্র শিক্ষাকেও দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে। আর এতে করে নিরুৎসাহিত হচ্ছে মেধাবীরা। যার ফলে দেশ অনেক পিছিয়ে পড়ছে।
শিক্ষাঙ্গনে সংকট সমাধানের উপায়: শিক্ষাঙ্গনে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে তা যদি সমাধান না করা হয় তবে শিক্ষা ব্যবস্থায় ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এই সমস্যা সমাধানকল্পে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে-
- সঠিক শিক্ষানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা।
- শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার ব্যবস্থা করা।
- ছাত্রদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধ করা।
- শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা।
- নির্দিষ্ট সময়ে কোর্স শেষ করা, পরীক্ষা নেওয়া ও পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা।
- শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়ানোসহ বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
- দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ও প্রশাসনিক ব্যাপারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দূর করা।
- প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ও জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।
- সর্বোপরি জনসাধারণের সচেতনতা বাড়ানো।
উপসংহার: শিক্ষাই জাতির মেরুদ-। এই স্লোগানকে সামনে রেখে আমাদের উচিত শিক্ষাঙ্গনের সুন্দর শান্ত পরিবেশ বজায় রাখা। শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা। তাই শুধু সরকারের উপর নির্ভর না করে সম্মিলিতভাবে শিক্ষাঙ্গনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা আমাদেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য।

১৪৪.চলচ্চিত্র ও তার ভূমিকা,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; চলচ্চিত্রের ইতিহাস; বাংলাদেশ ও চলচ্চিত্র; চলচ্চিত্রের ভূমিকা; বিনোদন দান একাকীত্ব দূরীকরণ; শিক্ষাদান; সংস্কৃতি আদান-প্রদান; মননশীলতা ও ব্যক্তিত্ব গঠন; ফ্যাশন সচেতন; নৈতিক চরিত্র গঠন; উৎসাহ-উদ্দীপনায়; চলচ্চিত্রের নেতিবাচক দিক; উপসংহার।)
ভূমিকা:
'Of all art cinema is the most Important' 
-লেলিন (১৯১৭)
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ যত উদ্ভাবন-আবিষ্কার করেছে, তার মধ্যে চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ শিখরে। বিগত ষাট বছরে প্রকৌশলগত দিক দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প অভাবনীয় উন্নতি লাভ করেছে এবং প্রতিনিয়তই তা কর্মক্লান্ত মানুষের বিনোদনের ক্ষুধা নিবৃত্ত করছে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আজ ঘরে বসে সারাবিশ্বের শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি বিষয়ে অবগত হওয়া যায়। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর এক দেশের সংবাদ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় অন্য দেশে সরবরাহ ও প্রদর্শন করা যায়। উন্নত রাষ্ট্রে স্কুল-কলেজে সিনেমার সাহায্যে শিক্ষাদানও করা হয়। ফলে জটিল ও দুরূহ বিষয়সমূহ শিক্ষার্থীদের কাছে সরল ও চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে। নিরক্ষর জনসাধারণকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার একটি অন্যতম উপায় হলো চলচ্চিত্র।
চলচ্চিত্রের ইতিহাস: চলচ্চিত্র শব্দটির অর্থ গতিশীল বা চলমান চিত্র। চলচ্চিত্রের ইংরেজি দুইটি প্রতিশব্দ রয়েছে। একটি Film এবং অন্যটি Motion Picture বা Movie। চলচ্চিত্র সৃষ্টির মূল সূত্রের জনক আরবীয় মুসলিম বিজ্ঞানী আবু আলী আল হাসান। বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ১৮৮৫ সালে। ফ্রান্সের লুমিয়ার ও আগস্ট ভ্রাতৃদ্বয় নির্মাণ করেন প্রথম চলচ্চিত্র। ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন। তিনি ১৯০৪ সালে ‘আলী বাবা অ্যান্ড ফরটি থিবস’ নামে নির্বাক ছবি নির্মাণ করেন। ১৯৩১ সালে উপমহাদেশে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রের নাম বিশ্বমঙ্গল। আর উপমাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন অমরেন্দ্রনাথ চৌধুরী চলচ্চিত্রের নাম ‘জামাই ষষ্ঠী’।
বাংলাদেশ ও চলচ্চিত্র: বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জনক আব্দুল জব্বার খান। বাংলাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ৩ আগস্ট, ১৯৫৬ সালে। নির্মিত চলচ্চিত্রের নাম ‘মুখ ও মুখোশ’ এবং এরই পরিচালক ছিলেন আব্দুল জব্বার খান। বাংলাদেশের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান এটি নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্র উন্নয়নে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন তৈরি করা হয় ১৯৫৭ সালে।
চলচ্চিত্রের ভূমিকা: চলচ্চিত্র এমন একটি মাধ্যম যার মাধ্যমে গণমানুষের কাছে খুব সহজেই বার্তা পৌঁছানো যায়। আর এই চলচ্চিত্র যদি কোনো ধর্মীয় বিষয় নিয়ে হয় তবে সেই চলচ্চিত্র হয় অনেক আবেগস্পর্শী। মানব জীবনে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই আজ চলচ্চিত্রের প্রতি ব্যাকুল। আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পে এসেছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। নিম্নে চলচ্চিত্রের ভূমিকা আলোকপাত করা হলো-
বিনোদনদান: চলচ্চিত্রের প্রধান উদ্দেশ্যে হলো মানুষকে বিনোদিত করা। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষ নানামাত্রিক বিনোদন গ্রহণ করে। প্রতিটি চলচ্চিত্রেই হাসি, কান্না, কৌতুক, ইতিহাস, ঐতিহ্য মিশ্রিত থাকে।
একাকীত্ব দূরীকরণ: মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব। কিন্তু আধুনিক ব্যস্ত নগরজীবনে মানুষ একাকীত্ববোধ করে। আর এই একাকীত্ববোধ দূরীকরণে চলচ্চিত্রের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষ শুধু বিনোদনই পায় না এটি তার একাকীত্ববোধও দূর করে দেয়।
শিক্ষাদান: চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন বিষয়ে মানুষ শিক্ষা লাভ করে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্মিত চলচ্চিত্র দেখার ফলে সেসব দেশের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি। বিদেশি ভাষা শিখতে পারে।
সংস্কৃতি আদান-প্রদান: চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বের নানা সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারে মানুষ। এক দেশের মানুষ অন্যদেশের চলচ্চিত্র দেখার মাধ্যমে সে দেশের কৃষ্টি-কালচার, ঐতিহ্য, পোশাকসহ সকল বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে। এর ফলে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটতে পারে।
মননশীলতা ও ব্যক্তিত্ব গঠন: ব্যক্তির মননশীলতা ও ব্যক্তিত্ব গঠনেও চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। চলচ্চিত্র দেখার মাধ্যমে ব্যক্তির চিন্তার জগত, আবেগ, অনুভূতি, সবকিছুর পরিবর্তন ঘটতে পারে। চলচ্চিত্র উন্নত ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠনে সাহায্য করে।
ফ্যাশন সচেতনে: মানুষের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের উপর চলচ্চিত্রের প্রভাব ব্যাপক। প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীর ফ্যাশন অনুকরণ, প্রিয় তারকাদের মতো হেয়ার স্টাইলও করেন এ যুগের তরুণ-তরুণীরা।
নৈতিক চরিত্র গঠন:ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র গঠনেও রয়েছে চলচ্চিত্রের ভূমিকা। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্নভাবে নিজের নৈতিক চরিত্রকে সাজাতে পারে। বর্তমান বিশ্বে মানুষ অনেকটা সময়ই ব্যয় করে এই চলচ্চিত্রের পিছনে। ব্যস্ত নগরজীবনের ক্লান্তি দূর করতে কিংবা সামাজিক উৎসবে অথবা বিনোদনের জন্য বন্ধু-বান্ধব মিলে ছুটে চলে চলচ্চিত্র দেখতে। এর ফলে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া আরো শক্তিশালী হয় এবং নৈতিক ভিত্তিও সুদৃঢ় হয়।
উৎসাহ উদ্দীপনায়: ব্যক্তি জীবনে উৎসাহ ও উদ্দীপনা জোগাতে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র বাঙালিদের সংগ্রামে উৎসাহ জোগায়, নতুনভাবে সংগ্রামে উদ্দীপনা তৈরি করে। এগুলোর মধ্যে জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’, আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটর্স’, বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’, খান আতাউর রহমানের ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ উল্লেখযোগ্য।
চলচ্চিত্রের নেতিবাচক দিক: চলচ্চিত্রের ইতিবাচক ভূমিকা অপরিসীম হলেও এর কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন চলচ্চিত্রের সহিংস দৃশ্য শিশু মনে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। বর্তমানে শিশুরা অতিমাত্রায় চলচ্চিত্র মুখী হয়ে পড়ছে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আসা উন্নত দেশের সংস্কৃতির কারণে দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি আজ হুমকির মুখে। চলচ্চিত্রের এসব নেতিবাচক ভূমিকাকে অনেকে চলচ্চিত্রের আগ্রাসন বলে উল্লেখ করেন। তাছাড়া চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা মানুষের নৈতিক স্খলন ঘটায়। যা তরুণ সমাজকে বিপথগামী করছে। এছাড়া নারীকেও চলচ্চিত্রে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন চলচ্চিত্রের অন্যতম নেতিবাচক দিক।
উপসংহার: আধুনিক বিশ্বের গণমাধ্যমের অন্যতম একটি উপাদন হলো চলচ্চিত্র। মানুষের উপর চলচ্চিত্রের প্রভাব অপরিসীম। এই প্রভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পড়তে পারে। মেলোড্রামা, রোমান্টিক, অ্যাকশন, ওয়েস্টার্ন, কমেডি নানা ধরণের চলচ্চিত্র মানুষকে বিনোদিত করে চলেছে দিনের পর দিন। নানা কারণে মানুষ আজ জাতীয়তা অপেক্ষা আন্তর্জাতিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি দেশ সহজেই পৃথিবীর অন্যদেশের সংস্কৃতির সংবাদ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে পারছে। সুতরাং বলা যায় যে, মানব জীবনে চলচ্চিত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে শিবগঞ্জ উপজেলাবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

 বিসমিল্লাহর রাহমানির রাহিম ঈদ বয়ে আনুক সবার জীনবে সুখ শান্তি ও কল্যাণের বার্তা ঈদের দিনের মতো সুন্দর হোক প্রতিটি দিন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক...