20 May, 2018

রাজা ও রানী


রাজা নাম হলেও আসলে ও ভিখারীর ছেলে।ভিখারী আরজু ভিক্ষা করে দিন আনে দিন খায়। ভিখারীর ছেলের নাম রাজা শুনে আশপাশের লোকেরা হাসে। আরজু বলে,নাম রাখতে কোনো বাধা নাই।আমি আমার ছেলের নাম রাজা রাখি আর ফকির রাখি–কার কি বলো? কথাটা তিন সত্য। ভগবান এমন অনেক কিছু দিয়েছেন–যাতে রাজা ফকিরের সমান হক বলা যায়।মাথার ওপরের আকাশ,দিন ভর বয়ে যাওয়া বাতাস,রাতের চন্দ্র,সূর্য্য, গ্রহ, তারা–এ সবই তো সবার জন্যে!ধনীর শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ যেমনটি হয় দরিদ্রেরও তাই! তবে কেন এ নিয়ে এত মাথা ব্যথা? আরজু ভিখারী বটে কিন্তু ইচ্ছে মত তার ছেলের নাম রাখার অধিকার তো তার আছে!

নীমা,রাজার মা,বলে ছিলো,ভিখারীর ঘরে আবার রাজা! আরজু বৌকে বুঝিয়ে ছিলো,দেখ,নামে কি যায় আসে। আমাদের ছেলের নাম রাজা হলে ক্ষতি কি বল?মনের মত না হলেও নীমা,আরজুর বৌ,চুপ করে গিয়েছিল।

সেই রাজা,তিন বছরের ছোট্ট ছেলে।ঘরে বসে খেলা করে।খেলনা!নানা আকার প্রকারের টুকরো পাথর,ভাঙা বাক্স,শুকনো গাছের ডাল,আর বাপের কুড়িয়ে আনা একটা পুতুল,যার এক হাত নেই,এক পা নেই।এসব নিয়ে রাজা খেলে চলে আনন্দে।

কখনো পুতুল তুলে নিয়ে দেখে,ওর এক হাত নেই। তার নিজের হাত দুটো নাড়ে,আর পুতুলের হাতের বেমানান অবস্থা আন্দাজ করে!তেমনি পুতুলের এক পা আর ওর দু পা! এমনি ভাবনা ক্ষণেকের জন্যে এসেই আবার মিলিয়ে যায়।পর মুহূর্তেই সে পাথরের টুকরোগুলি নিয়ে খেলতে থাকে। কখনো সেগুলি ফেলছে,কখনো কুড়িয়ে নিয়ে আসছে। ফেলা আবার নিয়ে আসার মধ্যে কি সুন্দর খেলে যাচ্ছে রাজা!খেলার অভাব বোধ তার কোথায়!আনন্দে হাসছে,আনন্দে হাত তালি দিচ্ছে,পাথরে ঠোকা খেয়ে কাঁদছে…আবার খেলছে।

মা নীমার কোনো চিন্তা নেই।সে মাটির চুল্লিতে শুকনো ডালপালা গুঁজে দিয়ে ভাত ফুটা। ভাতের সঙ্গে দু টুকরো আলুও কখনো সখনো জুটে যায়। রাজা খেয়ে নেয়।গপাগপ খেয়ে নেয়।মা কোনো দিন আধ সিদ্ধ আলু ভাতের সঙ্গে টিপে দেয়,অমৃতের মত রাজা তা খেয়ে নেয়। কোনো ব্যাপরে তার নতুন কোনো আব্দার নেই।

তিন বছরের রাজা কি নিজে নিজে খেতে পারে? হ্যাঁ,প্রায় দেড় বছর বয়স থেকেই রাজা নিজে নিজে খেতে শিখেছে। এ সব ভগবানের দান–গরীব ভিখারীর ঘরে এটা খাবো না,সেটা খবো না বললে চলে!না কি খাইয়ে না দিলে খাবো না বলে অভিমান করা সাজে! সারাদিন বসে থাকে আরজু ও নীমা। মন্দিরের দেওয়াল ঘেঁষে বসে থাকে।তাদের সামনে বিছানো থাকে নোংরা চাদরের টুকরো।দয়ালু লোকেরা মন্দির দর্শনে আসেন।আর আরজু ও নীমার মত হাত জোড় করে বসে থাকা ভিখারীদের সামনে দিয়ে যান পয়সা।দিন ভর আরজু,নীমা এমনি ভাবে বসে থাক।নীমাকে মাঝে মাঝে ঘরে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসতে হয়।

দিনের শেষে ওরা পাততাড়ি গুটোয়.দুজনের ভিক্ষার পয়সার হিসাব হয। নব্বই টাকা–ওরে বাবা অনেক!ওদের গড়ে দিনে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা রোজগার হয়। কোনো দিন বিড়ালের ভাগ্যে যদি সিকা ছেড়ে তবে একশ টাকার উপরেও জুটে যায়।সে দিন তো ওদের মহা আনন্দ! এক বছর আগেও নীমা রাজাকে কোলে নিয়ে চাদর পেতে বসে থাকত.এখন আর তা হয় না,রাজাকে সামলে রাখা যায় না। ঘরের গন্ডির বাইরে সে পা না বাড়ালে কি হবে,বাইরে এলে সমস্ত খোলা জাগাটাই তার আপন মনে হয়। ছুটে যেতে চায় এখানে ওখানে। মহা কষ্টে ওকে সামলাতে হয়।

নীমা দেখল,রাজা দিব্যি থেকে যায় ঝুপড়ি ঘরে। বাঁশের কঞ্চিতে বাঁধা দরজা,বাঁশ খুঁটিতে কোনো মত ঠেকিয়ে রাখা ঝুপড়ি ঘর। বেশী দাপাদাপিতে ভেঙে পড়তে পারে।কিন্তু সে ভাঙ্গার চেষ্টা রাজা করেনি। ওই তিন বছরের রাজাও জানে তাকে ওই গন্ডিতে থাকতে হবে। নইলে সমূহ বিপদ। সূক্ষ্ম বিচারের অনুভূতি ঐটুকু ভিখারীর ছেলের মধ্যেও ঢুকে গেছে। ওই বোধ টুকু ভগবান যদি ওদের না দেন তবে ওরা বাঁচবে কি করে! রানীদের ঘর রাজাদের ঝুপড়ি ঘরের সামনে। মাঝখান দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা চলে গেছে। রানী একটি মেয়ের নাম। ধনী ঘরের মেয়ে রানী। চার তলা বিরাট বাড়ি ওদের।

চার বছর বয়েস রানীর।স্কুলে যায়। ডি.পী.সী.স্কুলে। রোজ সকালে স্কুলের গাড়ি আসে ওকে নিতে। বিকেলে ওই গাড়ি ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে যায়। পড়া লেখার চাপ বিশেষ নেই।হোম ওয়ার্ক–সে এক ঘন্টা বসেই শেষ করে নেয়।তারপর খেলা–কত রকম খেলনায় তার ঘর ভরা!কি নেই তাতে?চাবি দাও,মানুষ নাচে,গান করে। ট্রেন ছুটে চলে,পাখী উড়ে যায়। প্রকান্ড বড় বড় নানা রকম ডল। এ ছাড়া আছে রান্না বাটি খেলার সমস্ত সরঞ্জাম। যখন যে খেলা পছন্দ তাই নিয়ে খেলো!এত খেলনাও মাঝেমাঝে তার মন কাড়তে পারে না। নতুনত্বের খোঁজে সে বাবা মার কাছে বায়না ধরে–আরও চাই,আরও পুতুল,অন্য অন্য রকমের!

তিন তলায় রানীর পড়ার ঘর,শোয়ার ঘরও সেটাই.বাবা মার সঙ্গেই শোয় ও।

একদিন সে ওই তিনতলা থেকে আবিষ্কার করল একটা বাচ্চা ছেলেকে।ওদের বাড়ির নীচে,রাস্তার ওপারের ঝুপড়ি ঘরে বসে আছে ছেলেটা। ওই ঘরগুলি কেমন ভাঙাচোরা। দরজা,জানালা,দেওয়াল–কোনো কিছুরই ঠিক নেই!বোরা,প্লাস্টিক কাগজ,বাঁশ কঞ্চির ঘেরায় তৈরী। ঘরে ছেলেটা খেলা করছে -একা একা–ঘরের দরজা আধ খোলা।ছাদের রেলিং ধরে রানী উঁকি মেরে দেখছিল। সেই ছেলে পাথরের টুকরো ,গাছের ডালের টুকরো,ভাঙা পুতুল,বাক্স নিয়ে চুপ চাপ খেলা করছে।রানীর কাছে এ যেন এক আবিষ্কার।খেলা ধুলার ফাঁক,পড়া লেখার অবসরে ওই ছেলেটাকে দেখতে ও ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।ওর খেলা,ওর নাচানাচি,লাফালাফি সব কিছু দেখে রানী খুব আনন্দ পায়।

একদিন রানী দেখল রাজা খেলে বেড়াচ্ছে.ওদের ভাঙা ঘরের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে যে রোদের আলো গিয়ে পড়েছে।তাই দিয়ে ও খেলছে।কখনো ও ধরতে যাচ্ছে রোদের টুকরো,কখনো সে দেখে তার নিজের গায়েই লেগে আছে ওই টুকরো রোদ।ঝিকির মিকির রোদের খেলনা দেখতে দেখতে রাজা হাততালি দিয়ে উঠছে।খেলার এ দৃশ্য দেখে রানী নিজের অজান্তে হাততালি দিয়ে উঠলো।রাজার কান পর্যন্ত পৌঁছালো সে তালির শব্দ।হাততালির শব্দ মিলিয়ে রাজা ওদের আধ খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে রানীকে দেখতে পেল। দেখল তার মতই ছোট একজন–যে হাততালি দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।খুব আনন্দ হলো ওর।আনন্দে সেও রানীর দিকে তাকিয়ে আবার হাততালি দিয়ে উঠল।

দূরত্ব যাই থাক,রাজা রানী এখন বন্ধু। এ ওকে দেখে হাসে,হাততালি দেয়।

দূর থেকেই রানী তার খেলনা দেখায়। নতুন খেলনা দেখে চুপ করে রাজ কিছু সময় দেখে নেয়। তারপরেই সে তার চকমকি পাথর রানীর দিকে তুলে ধরে।

রানী অবাক হয়। রাজার হাতে চকচক করছে যে খেলনা–তেমনটা তো সে কখনো দেখে নি!

রানীকে স্কুল যাবার জন্যে নীচে নেমে আসতে হয়। বাবা মা কেউ না কেউ তাকে বাসে চড়িয়ে দেন। এই সময়টুকুর ফাঁকে সে রাজাদের ঘরের দিকে তাকিয়ে নেয়। যদি রাজার দেখা পায়,যদি তার দূর থেকে দেখা চকমকি খেলনার রহস্যের খোঁজ পাওয়া যায়!

মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায় রাজার সঙ্গে।আবার কোনো দিন বুঝতে পারে রানী–ওই ঝাটিমাটির দরজার,দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে দুটো চোখ যেন জুলজুল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে!

–বাস এসে গেছে রানী!

কখনো বাবা বা মার কথায় সম্বিত ফিরে পায় রানী। তাড়াতাড়ি গিয়ে বাসে ওঠে।

রাজা ওই মেয়েটাকে ভালো ভাবে চেনে,ছোট্ট রাজার জীবনের দূর থেকে দেখা রানী সে!অনেক সময় সে দেখতে থাকে রানী গাড়িতে উঠে চলে যায়,গাড়িতে আবার সে ঘরে ফিরে আসে।

একদিন রানী তার মা,অনিমাকে ডেকে দেখায়,মা,দেখ,দেখ না!

–কি,কি দেখব?মা বলে ওঠেন।

–ওই ঘরে না একটা ছেলে থাকে।আমার বড় ডলের মত ও!রানী বলে যায়.

মা দেখবার চেষ্টা করেন ছেলেটাকে। বলেন,কে,কোথায় ছেলে?

–ওই দেখ,ভাঙ্গা মত ঘরটার ফাঁক দিয়ে দেখ,রানী উত্সাহ নিয়ে বলে ওঠে।

–ও গুলো বস্তি বাড়ি,গরীব ভিখারীদের ঘর,বলেন রানীর মা।

–কিন্তু ও তো ভিখারী না মা,ও ঘরেই বসে থাকে। খেলা করে । আমায় ওর খেলনা দেখায়।ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আমায় হাত দেখায়।বলে চলে রানী।

–ওর মা,বাবা,ভিখারী,কালী মন্দিরের সামনে ভিক্ষার জন্যে সারা দিন বসে থাকে,মা বলে যেতে থাকেন।

রানী ভিখারী ধনীর পার্থক্য বোঝে না।ও বলে,না,মা,ও ভিখারী না,সুন্দর দেখতে,আমায় খেলতে ডাকে।এক দিন যাবো ওর ঘরে?

–না,না,ওরা খুব নোংরা থাকে,ওদের ঘরে গন্ধ,ওখনে গেলে ভালো লাগবে না তোর। রানীর মা বোঝাতে থাকেন মেয়েকে।

তবু রানী মানতে চায় না,বলে কই আমি তো পাই না!আমি তো গন্ধ পাই আমাদের বাড়ির পাশের নর্দমার!

কথা বলতে বলতে রানী হঠাৎ দেখতে পায় রাজা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে সে রানীকে ইশারায় ডেকে যাচ্ছে।রানীও হাত নাড়ে,মাকে বলে ওঠে,ওই দেখ,ওই দেখ মা,ও আমায় ডাকছে!

রানীর মা,অনিমা দেখলেন ঝুপড়ির দরজার ফাঁক দয়ে ছোট্ট একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। রানীকে হাত নেড়ে ডেকে চলেছে ও। ছেলেটা দেখতে ভালো।ছোট্ট বাচ্চা।বাচ্চা ছেলে কার না ভালো লাগে!

রানী,মা বাবার একমাত্র সন্তান। ওঁদের ইচ্ছে ছিলো রানীর একটা ভাই হোক।কিন্তু সে ইচ্ছা আর পুরন হয় নি।

সে দিন তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেল। স্কুলবাস রানীকে ঘরে পৌঁছে দিল। স্কুলের আগে ছুটি হবার কথা কারো জানা ছিলো না,তাই রানীকে নীচে থেকে নিয়ে যেতে কেউ এলো না। একটু সময় সে চুপ চাপ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। এমনি সময় তার মনে পড়ল বন্ধুর কথা। ও তাকালো সামনের বস্তির দিকে। ওই যে বস্তির ঘরগুলি।এরই একটাতে থাকে তার বন্ধু। রানী এগিয়ে গেল।খুঁজতে লাগলো সেই ঘরটা যাতে থাকে তার বন্ধু.এখনো সে বন্ধুর নাম জানে না!

রানী চিনতে পারলো,ওই তো ঐটাই রাজাদের ঘর।এগিয়ে গেল ও।বাঁশ কঞ্চির তৈরী দরজা,বাইরে থেকে ঘরে কেউ আছে বলে মনে হলো না।কাছে গিয়ে দরজার ফাঁকা দিয়ে উঁকি মারলো রানী।শুরুতে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ল না।কিছু সময় পরেই ও দেখতে পেল,ঘুমোচ্ছে,তার বন্ধু ঘুমোচ্ছে! ঘরে আর কেউ নেই!

বন্ধুকে ডেকে উঠলো সে,এই,এই,এই…না,কোনো সাড়া নেই। এবার দরজায় ধাক্কা লাগলো রানী,একবার, দুবার,তিনবার,না ঘুম ভাঙ্গে না!দরজায় চড়ে চীত্কার করে ডাকবে কি না ভাবলো,দরজার ওপর অনেকটা ফাঁকা। ও ভাবলো দরজায় চড়ে ওই ফাঁকা জাগা দিয়ে ওকে ডাকলে কেমন হয়!দরজায় দুপা উঠতে গিয়েই ঘটে গেল বিপদ।লড়বড়ে দরজা নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেলো রানী. একেবারে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়ল।আচমকা ভয় পেয়ে গেল ও।পড়ে গিয়েই জোরে চীত্কার করে কেঁদে উঠলো।ওদিকে রাজার ঘুম ভেঙে গেল,সেও ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে দু তিন বার কান্নার সুর টেনে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো!উভয়ের মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটল।

রানী বলল,তোর নাম কি?

রাজা আধো কথা বলতে শিখেছে।খানিক তুতলে সে বলে উঠলো,নাজা!

–আমার নাম রানী.তুই আমায় চিনিস?রানী প্রশ্ন করল।

কথা বলল না রাজা,এক ধরণের চিনতে পারার হাসি হাসল।

–জানিস আমি ওই বাড়িতে থাকি,বলে আঙ্গুল দিয়ে রাস্তার ও পারের বড় বাড়িটা দেখিয়ে দিল রানী।

রাজা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলো,তারপর ওপরে যেখানে রানী দাঁড়িয়ে থাকে রাজা তার আঙ্গুল দিয়ে সে জায়গাটা দেখালো।আর হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,উখানে,উখানে … তুই কি খেলিস দেখাত আমাকে?চল আমরা খেলব.রাজাকে রানী বলে। রাজা পরম উত্সাহে ঘরের এক কোন থেকে সব টেনেটুনে বের করে আনে। খেলার সমস্ত সরঞ্জাম তাতে রাখা।

রানীর খুব ভালো লাগলো।রাজার ছোট,বড়,সাদা,লাল,কালো,নানা রঙের পাথরগুলি,সত্যি দেখতে বেশ সুন্দর–এমন জিনিস তো তার কাছে নেই! রাজাদের ঘর খুব নোংরা,ভাঙা,রানীর একদম ভালো লাগলো না.কিন্তু রাজা?সে তো ভালো,সুন্দর হাসে,সুন্দর আধ-আধ কথা বলে!দূর থেকে ইশারায় তাকে ডাকে।যেন কত দিনের বন্ধু ওরা!

এদিকে সময় কেটে গেছে অনেক।এতক্ষণ নিয়ম মত স্কুল বাসের এসে যাবার কথা। রানীর মা বাসের অপেক্ষায় ঘরবার করছেন।ব্যালকনি থেকে বারবার বাস এলো কিনা দেখছেন।কে জানে,এত দেরী হচ্ছে কেনো বাস আসার! অগত্যা স্কুলে ফোন করা হল। জানা গেলো বেলা একটায় আজ ছুটি হয়ে গেছে।শুনে ভয় পেয়ে গেলেন রানীর মা।

ঘরের চাকর দীনু। ওকে পাঠানো হলো নীচে।রাস্তার আশপাশ,অলি গলিতে খুঁজে দেখতে। রানীকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।রানীর বাবাকে ফোন করা হলো।খবর শুনে রানীর বাবা আঁতকে উঠলেন…আমি এক্ষুনি আসছি,বলে ফোন রাখলেন তিনি. তখন সন্ধ্যে হয় হয়।রানীর মা কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেলেন।রানীর বাবা স্কুলে খোঁজ নিতে গেলেন। এমনি সময় রানীর বাড়ির কথা মনে পড়ল। ধীরে ধীরে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। মা কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।সামনে মেয়েকে দেখে,কোথায় ছিলি,বলে জাপটে ধরলেন।

–আমি না বন্ধুর বাড়ি গিয়ে ছিলাম,রানী বলে ওঠে।

এবার ধমকে ওঠেন মা,না বলে কেন গিয়ে ছিলে?জানো না আমরা তোমার জন্যে কত চিন্তা করছি!

–কোথায় গিয়েছি!এই তো পাশে,সহজ ভাবে রানী বলে ওঠে।

–চুপ!আমরা চিন্তা করি তুমি জানো না বুঝি?মা আবার ধমকান।

–ঠিক আছে,না বলে আর যাব না,কেমন?রানী পাকা বুড়ির মত বলে চলে,আমার বন্ধু ওখানে থাকে তাই একটু গিয়ে ছিলাম।

মা আর থাকতে পারলেন না,মেয়েকে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকলেন।

সে দিন ছুটির দিন ছিলো,রবিবার।তখন রাত দশটা হবে। রাজাদের বস্তিঘরগুলিতে কিভাবে যেন আগুন লেগে গেলো। আটদশ ঘর একের পর এক দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো.চারি দিকে চীত্কার চেঁচামেচি– আগুন,আগুন,করে সবাই ছুটোছুটি করতে লাগলো।বস্তির লোকেদের কান্নার রোল পড়ে গেলো।

হইহট্টগোল,কান্না চেঁচামেচিতে রানীর ঘুম ভেঙে গেলো। ধড়ফড় করে সে উঠে বসলো। দেখল মা,বাবা,কেউ তার পাশে নেই। ও ভয় পেয়ে চীত্কার করল।ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো।মা,বাবাকে দেখলো ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন।নীচে জ্বলে যাচ্ছে রাজাদের ঘরগুলি মা,বাবার কাছে তাড়াতাড়ি ছুটে গেলো রানী। সে চীত্কার করে কেঁদে উঠলো,আমার বন্ধু,আমার বন্ধু কই!

নীচে তখন বস্তির সব ঘর আগুনে ভস্মিভূত হোয়ে গেছে রানী প্রচন্ড চীত্কার করে কেঁদে বলে উঠলো,আমার বন্ধু কই!আমার বন্ধু কই?সিঁড়ি দিয়ে তড়তড় করে নীচে নেমে যেতে লাগলো। বাবা,মা’র শত বাধা ওকে যেন বাধ মানাতে পারছে না। রানী চীত্কার করে একই কথা বলে চলেছে,আমার বন্ধু,আমার বন্ধু কই!

জোর করে বাবা,মা তাকে আটকে রাখলেন । তাঁদের মনও ভালো নেই।রানীর বন্ধু,রাজার চিন্তা ওদের মনকেও বিষন্ন করে তুলেছে। রাত শেষে ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গলো সবার। রাতের দুঃস্বপ্নের ঘোর রানীর তখনও কাটে নি। মুখ চোখ তার শুকিয়ে গেছে. বেলা দশটার পরে দীনু খবর নিয়ে এলো,ঝুপড়ি ঘরের ছেলেটার মা,বাবা,কাল রাতে পুড়ে মারা গেছে। ছেলেটা কি ভাবে যেন বেঁচে গেছে! রানী জোরে কেঁদে উঠলো,রাজা,আমার রাজা কোথায় আছে বলো? দীনু বলে,হ্যাঁ,রাজা নাম ছেলেটার,ও বেঁচে আছে।

রানীর মা,বাবা খুব দুঃখ পেলেন। মেয়ের দুঃখে ওঁরা বেশ চিন্তিত হলেন। সত্যি বন্ধুকে তাদের মেয়ে খুব ভালোবাসে।রানীর বাবা কিছু সময় ভেবে বলে উঠলেন,দিনু একটা কাজ করতে পারবে?

–কি?বলুন না বাবু!বিনত দীনু বলে ওঠে।

–একবার রাজা ছেলেটাকে এনে আমাদের দেখাতে পারবে? বাবা ধীর স্বরে বলে উঠলেন।

–বলেন যদি,দেখতে পারি,আনতে পারি কি না!দীনু বলে।

ঠিক দুপুর বেলা,দীনু রানীর বন্ধু রাজাকে কোলে নিয়ে হাজির হল।তখন কাঁদছিল রাজা,মুখ চোখ কেমন লাল লাল তার।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছিল। রানীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো,দৌড়ে সে রাজার কাছে এসে দাঁড়ালো। সুন্দর ছেলে রাজা।শরীরে কোথাও ভিখারীর ছেলে বলে লেখা নেই।রানীকে দেখা মাত্র কান্নার মধ্যেই সে কেমন হেসে উঠলো!

রানীর মা,বাবার দু জনের মনে একই কথা মনে হচ্ছিল,ভিখারীর অনাথ ছেলেটা বেশ সুন্দর।তাদের তো কোনো পুত্র সন্তান নেই।এই অনাথ ছেলেটিকে যদি ছেলে বলে মেনে নেওয়া যায়!ছেলের মত স্নেহ ভালোবাসা দেওয়া যায়!কেমন হয় তা হলে?

এমনি সময় দীনু দুঃখে কাতর হয়ে বলে ওঠে,ওর আর কেউ নেই গো,ও একা হয়ে গেলো,বেচারা!

রানীর বাবা যেন আর থাকতে পারলেন না,সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,আমরা আছি দীনু,আজ থেকে ও আমাদের এখানে থাকবে।

রানীর মা অবাধ খুশিতে কেঁদে ফেললেন। রানীর বাবাকে বলে উঠলেন,আমার মনের কথাটা তুমি বলে দিলে গো!

রানী তো খুব খুশি,উচ্ছল আনন্দে সে ডেকে উঠলো,বন্ধু!

রাজা তাকালো রানীর দিকে,তারপর তুতলিয়ে বলে উঠলো,ব ন ধু উ…!

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন