আমার দাদু শিকারি ছিলেন না, কিন্তু যেহেতু তিনি শিবালিকের জঙ্গল অন্য অনেকের থেকে বেশি ভাল চিনতেন, তাই তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছিল এক বিশেষ দলের সাথে যেতে – এই দলে দিল্লির অনেক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন – যাতে তিনি জঙ্গল এর আনাচকানাচ সম্বন্ধে আর বাঘ দেখা গেলে বিটাররা কি করবে, বলে দিতে পারেন।
ক্যাম্পটি ছিল অসাধারন -সাতটা বিশাল বড় তাঁবু [প্রত্যেক শিকারির জন্য একটা], একটা খাবার তাঁবু আর অনেকগুলি কাজের লোকেদের তাঁবু। রাতের খাওয়া খুব ভাল হত, আর দাদু পরে স্বীকার করেছিলেন যে ওইরকম গরম জলের পাত্র, হাত ধোয়ার বাটি আর চর্ব্ব-চোষ্য খাওয়া, জঙ্গলের ভেতর তাঁবুর মধ্যে খুব একটা দেখা যায়না! কিন্তু ভাইসরয়ের আমলে এইরকমই সব ব্যাপার-স্যাপার ছিল…সঙ্গে ছিল পনেরোটা হাতি, তার মধ্যে চারটে হাওদাওয়ালা, শিকারিদের বসার জন্য, আর বাকিগুলি ছিল শিকারে অংশ নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত।
শিকারিরা বাঘ তো দেখতেই পেলনা, অন্য কিছুও মারল না, যদিও তারা অনেক হরিণ, ময়ূর আর বুনো শুয়োর দেখেছিল। তারা প্রায় বাঘ দেখার আশা ছেড়েই দিয়েছিল, আর শেয়ালগুলির দিকে তাক করতে বসেছিল, এমন সময় দাদু, অন্যদের থেকে একটু দূরে জঙ্গলের পথে ঘুরতে ঘুরতে, দেখতে পেলেন প্রায় আঠেরো ইঞ্চি লম্বা একটা বাঘের ছানা , একটা বটগাছের ঘন ঝুরির মধ্যে লুকিয়ে আছে। দাদু ছানাটাকে কোলে তুলে নিলেন, আর শিকার-যাত্রা শেষ হওয়ার পর সাথে করে বাড়ি নিয়ে এলেন। সেইবার ওই দলের মধ্যে দাদুই একমাত্র কোন একটা শিকার নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।
প্রথমদিকে বাঘের ছানা টিমোথিকে, যার নামকরন করেছিলেন আমার দিদিমা, খালি দুধ খাওয়ানো হত, যেটা ফিডিং বোতলে করে ওকে খাওয়াত আমাদের রাঁধুনি মাহমুদ। কিন্তু দুধ ওর পেটের পক্ষে খুব ভারি হয়ে গেল, তাই তখন ওকে কাঁচা খাসির মাংস আর কড লিভার তেল খাওয়ানো হত, আর পরের দিকে দেওয়া হত আরো লোভনীয় ঘুঘু আর খরগোশের মাংস।
টিমোথির দুইজন সঙ্গী জুটল – টোটো নামের বাঁদর-যে কিনা মাঝে মাঝেই সাহস ভরে ওর লেজ ধরে টানতো আর টিমোথি রেগে গেলেই পর্দার ওপর চড়ে বসতো। অন্যজন ছিল একটা মংগ্রেল কুকুরছানা, যাকে দাদু রাস্তায় পেয়েছিলেন।
প্রথমদিকে টিমোথি কুকুরছানাটাকে খুব ভয় পেতো, আর ও কাছাকাছি এলেই এক লাফ দিয়ে পেছিয়ে যেত। নিজের বড় বড় সামনের পা দুটো দিয়ে কুকুরছানাটাকে ভয় দেখাতো, তারপর নিজেই ভয় পেয়ে যতদূর সম্ভব সরে যেত। শেষের দিকে অবশ্য কুকুরছানাটা ওর পিঠের ওপর চড়ে আরাম করত!
ওর সঙ্গে যারা খেলতে আসত, তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াটা ছিল টিমোথির প্রিয় খেলা, আর তাই, যখন আমি দাদুর সাথে থাকতে এলাম, আমি হয়ে পড়লাম ওর প্রিয়পাত্র। ঝকঝকে দুইচোখ ভরা দুষ্টুমি নিয়ে, শরীরটাকে গুঁড়ি মেরে, ও ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতো, তারপর আমার পায়ের ওপর হটাত ঝাঁপিয়ে পড়তো, আর পিঠের ওপর গড়াগড়ি দিয়ে ফূর্তিতে পা ছুঁড়তো, আর ভান করতো যেন আমার গোড়ালি কামড়ে দেবে।
এই সময়ে ওর চেহারা প্রায় একটা বড় রিট্রিভার কুকুরের মত হয়ে গিয়েছিল, আর আমি যখন ওকে নিয়ে হাঁটতে বেরোতাম, রাস্তার লোকজন আর কাছে ঘেঁষতো না। ও যখন চেন টেনে এগিয়ে যেতো, আমার বেশ অসুবিধাই হতো ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। বাড়িতে ওর সব থেকে পছন্দের জায়গা ছিল বসার ঘরটা, সেখানে ও আরাম করে লম্বা সোফাটার ওপর গা এলিয়ে রাজকীয় ভঙ্গীতে শুয়ে থাকতো, আর ওকে কেউ সরাতে এলেই তার দিকে তাকিয়ে ফোঁসফোঁস করতো।
টিমোথি খুব পরিচ্ছন্ন ছিলো, বেড়ালের মত পা দিয়ে ঘষে ঘষে নিজের মুখ পরিষ্কার করতো। রাতে ও রাঁধুনির ঘরে ঘুমোতো, আর সকালে ছাড়া পেলে খুবই খুশি হত।
“এর মাঝে কোন একদিন” দিদিমা দৈববানীর মত ঘোষণা করতেন, “আমরা দেখবো টিমোথি মাহমুদের খাটে উঠে বসে আছে, আর ওই রাঁধুনিটার জুতো আর জামা ছাড়া আর কিছু দেখতে পাওয়া যাবে না।”
অবশ্যই সেরকম কিছু হয়নি, কিন্তু টিমোথি যখন প্রায় মাস ছয়েকের, তখন ওর মধ্যে একটা পরিবর্তন এলো। ওর ধীরে ধীরে মেজাজ পাল্টাতে লাগলো। আমার সাথে বেড়াতে বেরিয়ে ও চেষ্টা করতো আমাকে এড়িয়ে গিয়ে কোন বেড়াল বা কারোর পোষা পিকিনিজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। মাঝে মাঝে রাতে আমরা মুরগির ঘর থেকে ভয়ার্ত চিতকার শুনতাম, আর পরের দিন সকালে দেখা যেত সারা বারান্দা জুড়ে পড়ে আছে পাখির পালক। টিমোথিকে আরো বেশি করে বেঁধে রাখা হতো। অবশেষে যখন ও বাড়ির মধ্যে মাহমুদের ওপর হিংস্রভাবে যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগলো, তখন দাদু ঠিক করলেন এইবার ওকে কোনো চিড়িয়াখানায় পাঠানোর সময় হয়েছে ।
সবথেকে কাছাকাছি চিড়িয়াখানা ছিল লখনউতে, দুশো মাইল দূরে। নিজের আর টিমোথির জন্য একটা প্রথম শ্রেণীর কামরা বুক করে – ওদের সাথে আর কেউ এক কামরায় যেতোও না – দাদু টিমোথিকে লখনউ নিয়ে গেলেন , যেখানে চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ এতো স্বাস্থ্যবান এবং ভদ্র একটা বাঘ পেয়ে খুবই খুশি হলেন।
এর প্রায় ছয় মাস পরে, যখন আমার দাদু আর দিদিমা লখনউ গেলেন আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে, তখন দাদু একদিন সময় করে চিড়িয়াখানা গেলেন টিমোথিকে দেখতে। আমি তখন ওনার সঙ্গে ছিলাম না, কিন্তু গল্পটা শুনেছিলাম দাদু দেহরা তে ফিরে আসার পর।
চিড়িয়াখানায় পৌঁছে দাদু সোজা চলে গেলেন টিমোথিকে যেই খাঁচায় রাখা হয়েছিল, তার সামনে। খাঁচার ভেতরে এক কোনায় বসে আছে,আরো বড় হয়ে গেছে, সেই বাঘ, গায়ে তার ডোরা ডোরা দাগ।
“কিরে টিমোথি!” বলে দাদু সোজা গিয়ে চড়লেন রেলিং এর ওপর, আর খাঁচার গরাদের ভিতর দিয়ে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন।
বাঘটা খাঁচার গরাদের কাছে এগিয়ে এলো, আর দাদুকে তার মাথায় দুই হাত রাখতে দিলো। দাদু ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন, কানে সুড়সুড়ি দিলেন, আর যখনই ও গরগর করল, চটাস করে ওর মুখে মারলেন, ঠিক যেমন ভাবে আগে ওকে শান্ত করতেন।
ও দাদুর হাত চাটলো আর যখন পাশের খাঁচার থেকে একটা চিতা ওর দিকে তাকিয়ে গর্জন করলো, তখন এক লাফে ছিটকে দূরে সরে গেলো। দাদু চিতাটাকে “শুহ-হ-হ” করে তাড়িয়ে দিলেন, অমনি বাঘটা ফেরত এসে ওঁর হাত চাটতে শুরু করলো; কিন্তু মাঝে মাঝেই চিতাবাঘটা খাঁচার এদিকে ছুটে এলেই, বাঘবাবাজি আবার কোনায় দৌড় লাগাচ্ছিলো।
এই পুনর্মিলন দেখার জন্য বেশ কিছু লোক জমে গেলো আর একজন কীপার ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দাদুকে জিজ্ঞাসা করলো উনি কি করছেন।
“আমি টিমোথির সাথে কথা বলছি,” দাদু বল্লেন।”ছয়মাস আগে আমি যখন ওকে চিড়িয়াখানায় দিয়ে গেলাম তুমি তখন ছিলে না?”
“আমি এখানে খুব বেশিদিন আসিনি,” অবাক গলায় বললো কীপারটি।”আপনি কথা বলুন। আমি তো ওকে কোনদিন ছুঁতেই পারিনি, ওর সবসময় মেজাজ গরম থাকে।”
“তোমরা ওকে অন্য কোথাও রাখছোনা কেনো?” দাদু বললেন।” ওই চিতাটা ওকে ভয় দেখায়। আমি গিয়ে সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট এর সাথে কথা বলছি।”
দাদু সুপার কে খুঁজতে গেলেন, গিয়ে শুনলেন তিনি সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেছেন; কি আর করা, তাই দাদু চিড়িয়াখানার এদিক ওদিক খানিক্ষণ ঘুরে বেড়ালেন, তারপর টিমোথির খাঁচার কাছে ফিরে এলেন ওকে বিদায় জানাতে। তখন সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে।
প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে টিমোথির গায়ে হাত বোলানো আর চাঁটি মারার পর তিনি লক্ষ করলেন অন্য একজন কীপার তাঁর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। দাদু চিনতে পারলেন এই লোকটি টিমোথিকে নিয়ে আসার সময়ে চিড়িয়াখানায় ছিল।
“তুমি আমাকে চিনেছ,” দাদু বললেন।”তুমিই নাহয় কেনো টিমোথিকে এই পাজি চিতাটার থেকে দূরে অন্য কোন খাঁচায় রাখো না?”
“কিন্তু -স্যর – “কীপারটি থেমে থেমে বললো,” এটা আপনার বাঘ নয়।”
“আমি জানি, আমি জানি,” দাদু একটু অভিমানভরে বললেন। “আমি জানি ও এখন আর আমার নয়। কিন্তু তুমি আমার দুই -একটা কথা শুনতেই পারো।”
“আপনার বাঘটাকে আমার খুব ভালো করে মনে আছে”, বললো কীপার। “ও দুইমাস আগে মারা গেছে।”
“মারা গেছে!!” দাদু চমকে উঠলেন।
“হ্যাঁ, স্যর, নিউমোনিয়া হয়েছিল। এই বাঘটাকে মোটে গতমাসে পাহাড় থেকে ধরা হয়েছে, আর এটা খুবই ভয়ানক।”
দাদু ভেবে পেলেন না কি বলবেন। বাঘটা তখনও তাঁর হাত চাটছে, ক্রমশঃ আরো আয়েশ করে। দাদু অনেক্ষণ ধরে, যেন প্রায় এক যুগ ধরে নিজের হাতটাকে টেনে বাইরে নিয়ে এলেন।
বাঘটার মুখের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে গিয়ে দাদু কোনমতে বল্লেন,”গুডনাইট টিমোথি,” তারপর কীপারটির দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে, তাড়াতাড়ি চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন।
No comments:
Post a Comment