06 February, 2019

আম চাষ পদ্ধতি


যেভাবে করবেন আমবাগান

বাড়ছে আমের চাষ। মানসম্পন্ন আম ফলাতে তাই দরকার আধুনিক উত্পাদন কৌশল। আম চাষিদের জানা দরকার কীভাবে জমি নির্বাচন, রোপণ দূরত্ব, গর্ত তৈরি ও সার প্রয়োগ, রোপণ প্রণালী, রোপণের সময়, জাত নির্বাচন, চারা নির্বাচন, চারা রোপণ ও চারার পরিচর্যা করতে হয়। মাটি ও আবহাওয়ার কারণে দেশের সব জেলাতে সব জাতের আম হয় না। আমের জন্য মাটির অম্লতা দরকার ৫.৫-৭.০। অনেক সময় দেখা যায় পাহাড়ি ও বরিশাল বিভাগের অনেক জেলাতে ফজলী, ল্যাংড়া, খিরসাপাত ও আশ্বিনা জাতগুলো ভাল হয়। সুতরাং কাঙ্ক্ষিত জাতটি নির্বাচিত জায়গায় হবে কিনা তা বিবেচনায় রাখতে হবে। গভীর, সুনিষ্কাশিত, উর্বর দো-আঁশ মাটি আম চাষের জন্য ভাল। বর্ষায় পানি দাঁড়ায় না এমন উঁচু বা মাঝারী উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। কয়েকবার চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল এবং আগাছামুক্ত করতে হবে। রোপণ দূরত্ব নির্ভর করে আমের জাতের উপর। দ্রুত বর্ধনশীল আমের জাত বা বড় আকৃতির গাছ হলে সাধারণত ১২ মিটার বা প্রায় ৪০ ফুট দূরত্বে লাগাতে হবে। এই দূরত্বে গাছ লাগালে এক বিঘা জমিতে প্রায় ৯টি গাছ লাগানো যাবে। মধ্যম আকৃতির গাছ হলে ১০ মিটার বা ৩৫ ফুট দূরত্বে লাগানো যাবে এবং দূরত্ব অনুসরণ করলে এক বিঘা জমিতে ১৩টি গাছ লাগানো যাবে। খাটো আকৃতির জাত যেমন- বারি আম-৩ (আম্রপলি) হলে ৬-৮ মিটার দূরত্বে লাগানো যাবে এবং এ দূরত্ব অনুসরণ করলে এক বিঘা জমিতে প্রায় ২০-২৭টি গাছ লাগানো যাবে। জাতভেদে আম গাছের রোপণ দূরত্ব ৬×৬ মিটার; ১০×১০ মিটার এবং ১২×১২ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্গাকার, আয়তাকার, ত্রিভুজাকার বা ষড়ভুজাকার যে প্রণালীতে চারা রোপণ করা হোক না কেন, গাছ লাগানোর স্থানটি চিহ্নিত করে বর্ষা শুরুর আগেই সেখানে গর্ত করতে হবে। সাধারণত মে-জুন মাসে ৭৫-১০০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতায় গর্ত করতে হবে। গর্ত করার সময় গর্তের উপরের অর্ধেক অংশের মাটি একপাশে এবং নিচের অংশের মাটি অন্যপাশে রাখতে হবে। গর্ত থেকে মাটি উঠানোর পর ১০ দিন পর্যন্ত গর্তটিকে রোদে শুকাতে হবে। এরপর প্রতি গর্তে ১০ কেজি গোবর সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ৫০ গাম জিংক সালফেট এবং ১০ গ্রাম বোরিক এসিড উপরের অংশের মাটির সাথে মিশিয়ে মাটি ওলোট-পালোট করে গর্ত ভরাট করতে হবে। গর্ত ভরাটের সময় উপরের অর্ধেক অংশের মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট না হলে প্রয়োজনে পাশ থেকে উপরের মাটি গর্তে দিতে হবে। তবে গর্তের নিচের অংশের মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করা যাবে না। সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত চারা রোপণ করলে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায়। রোপণের জন্য ৪-৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ২-৩টি ডাল বিশিষ্ট চারা নির্বাচন করতে হবে। ২-৩ বছর বয়সী ফাটল/ভিনিয়ার কলমের চারা বাগানে লাগানোর জন্য ভাল। গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর পুনরায় গর্তের মাটি ভালভাবে উলোট-পালোট করে গর্তের মাঝখানে চারাটি সোজাভাবে লাগিয়ে তারপর চারদিকে মাটি দিয়ে গাছের গোড়া সমান্য চেপে দিতে হবে। চারা রোপণের সময় চারার গোড়ার বলটি যেন ভেঙে না যায় এবং চারা গোড়াটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাটির নিচে ঢুকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোপণের পর চারাটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। বিকেল বেলায় চারা/কলম রোপণ করা ভাল। রোপণের পর বৃষ্টি না থাকলে কয়েকদিন সেচ দিতে হবে। গাছে নতুন পাতা বের হলে পাতাকাটা উইভিল পোকা আক্রমণ করতে পারে। কচি পাতার নিচের পিঠে মধ্যশিরার উভয়পাশে স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ে। পরে স্ত্রী পোকা ডিমপাড়া পাতাটির বোঁটার কাছাকাছি কেঁটে দেয়। শেষে গাছটি পাতাশূন্য হয়ে যায়। কর্তিত কচি পাতা মাটি থেকে সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছে কচি পাতা বের হওয়ার ৬ দিন এবং ১২ দিন পর প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম সেভিন অথবা যেকোনো কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় সেপ্র করলে পোকার আক্রমণ হয় না। বাজারজাত করার জন্য কোন জাতের আমের চাহিদা বেশি, গুণগতমান ভাল এবং বাজারমূল্য বেশি তা জানা দরকার। আমাদের দেশে বেশ কিছু উত্কৃষ্ট মানের আমের জাত (ল্যাংড়া, খিরসাপাত, হিমসাগর, ফজলী, গোপাল ভোগ ও বোম্বাই) রয়েছে। যেগুলো রঙিন না হলেও স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা বেশি। কিন্তু এ জাতগুলো বিদেশে রফতানি করে তেমন মুনাফা পাওয়া যাবে না। কারণ বিদেশের বাজারে রঙিন ও হালকা মিষ্টি আমের চাহিদা বেশি। এর জন্য বারি আম-২ এবং বারি আম-৭ জাত দু’টি উপযুক্ত। তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতি বছর ফল দিতে সক্ষম এমন কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো হলো বারি আম-১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮। এ জাতের চারা দিয়ে বাগান করলে ভাল ফলনের পাশাপাশি লাভবান হওয়া যায়। এগ্রোবাংলা ডটকম

আম বাগানের আগাম পরিচর্যা

বাংলাদেশে যে ৭০টি ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় তার মধ্যে আম অন্যতম। মোট ফল চাষের ৪০ ভাগ জমিতে আম চাষ হলেও দিনদিন এর পরিধি আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে ফলনের তারতম্য দেখা যায়। যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীতে আমের ফলন অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি। উত্পাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে একটু যত্নবান হলে ফলন কয়েকগুণ বাড়ানো যায়। আর তাই যত্ন নিতে হবে আম সংগ্রহের পর থেকেই। রোগাক্রান্ত ও মরা ডালপালা একটু ভাল অংশসহ কেটে ফেলতে হবে মৌসুমের পর। ডালপালা এমনভাবে ছাটাই করতে হবে যেন গাছের ভেতর পর্যন্ত সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে। গাছের ভেতরমুখি ডালে সাধারণত ফুলফল হয় না, তাই এ ধরনের ডাল কেটে ফেলতে হবে। বর্ষাকালে কাটা অংশগুলো থেকে নতুন কুশি গজাবে এবং পরের বছরে ওই নতুন কুশিগুলোতে ফুল আসবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে- ডগার বয়স ৫ থেকে ৬ মাস না হলে ওই ডগায় সাধারণত ফুল আসে না। আগামী বছরে একটি গাছে কী পরিমাণ ফলন আসতে পারে তা আগস্ট মাসেই ধারনা পাওয়া যায়। এ সময়ের মধ্যে গাছে যত বেশি নতুন ডগা গজাবে ততই ভাল। আমবাগানে সার প্রয়োগের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি গাছে বছরে কি পরিমাণ সার দিতে হবে তা নির্ভর করে মাটির গুণাগুণের উপর। গাছ বাড়ার সাথে সাথে সারের চাহিদাও বাড়তে থাকে। বছর অনুযায়ী সারের পরিমাণ দেয়া হল- গোবর সার দিতে হবে রোপণের ১ বছর পর ২০, রোপণের ২ বছর পর ২৫, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ১২৫ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ইউরিয়া রোপণের ১ বছর পর ২৫০, রোপণের ২ বছর পর ৩৭৫, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১২৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ২৭৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। টিএসপি রোপণের ১ বছর পর ১০০, রোপণের ২ বছর পর ২০০, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১০০ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ২১৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। এমপি রোপণের ১ বছর পর ১০০, রোপণের ২ বছর পর ২০০, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১০০ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ২১০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। জিপসাম রোপণের ১ বছর পর ১০০, রোপণের ২ বছর পর ১৭৫, প্রতিবছর বাড়াতে হবে ৭৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ১৬০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। জিংক সালফেট রোপণের ১ বছর পর ১০, রোপণের ২ বছর পর ১৫, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ১১০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। বোরিক এসিড রোপণের ১ বছর পর ৫, রোপণের ২ বছর পর ৭, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ২ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। সব সার দু’কিস্তিতে প্রয়োগ করা ভাল। প্রথম অর্ধেক বর্ষার আগে এবং বাকিটা আশ্বিন মাসে অর্থাত্ বর্ষার পরে। যদি কোনো আমচাষি প্রথম কিস্তির সার প্রয়োগ না করেন তবে দ্বিতীয় কিস্তির সময় চাহিদার পুরো সারটাই প্রয়োগ করতে হবে। অনেক আমচাষি বাগানের ফজলি ও আশ্বিনা আম সংগ্রহ করার পর সার প্রয়োগ করেন যা মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। ফলন্ত গাছে গুঁড়ি থেকে ২-৩ মিটার দূরত্বে ৩০ সে.মি. প্রশস্ত ও ১৫-২০ সে.মি. গভীর করে চক্রাকার নালা কেটে তার ভেতর রাসায়নিক ও জৈব সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। অথবা দুপুরবেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় সার ছিটিয়ে কোঁদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সাধারণত আমগাছে ফল আসার পর গাছগুলো দুর্বল হয়ে যায়। ফলে গাছের প্রয়োজন হয় খাদ্যের। সার দেয়ার পর বর্ষা শুরু হলে গাছ তার প্রয়োজনীয় খাদ্য মাটি থেকে নিতে পারে। আমবাগানে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। তবে মাটিতে রস থাকলে সেচের দরকার হবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, আমগাছে পরিবর্তিত বেসিন পদ্ধতিতে অর্থাত্ গাছের গোড়ার চারদিকে এক মিটার জায়গা সামান্য উঁচু রেখে দুপুরবেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় একটি থালার মত করে বেসিন তৈরি করে সেচ দিলে পানির পরিমাণ কম লাগে এবং বেশির ভাগ পানি গাছ গ্রহণ করতে পারে। বেসিন পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হল গাছের গোড়া পরিষ্কার থাকে ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। সেচ দেয়ার পর জায়গাটি কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিলে মাটিতে একমাস পর্যন্ত রস থাকবে। তবে আমগাছে ফুল আসার একমাস আগে সেচ না দেয়াই ভাল। এ সময় সেচ দিলে গাছে নতুন পাতা বের হবে এতে মুকুলের সংখ্যা কমে গিয়ে ফলন কমে আসবে। আমবাগানে জৈব পদার্থের ঘাটতি থাকলে ধৈঞ্চার চাষ করতে হবে। এতে বাগানে জৈব পদার্থসহ অন্যান্য সার যোগ হলে মাটির উত্পাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আমগাছে ২/৩ ধরনের পরগাছা দেখা যায়। ছোট গাছের চেয়ে বড় গাছে পরগাছার আক্রমণ বেশি হয়। পরগাছার বীজ আমগাছের ডালে অঙ্কুরিত হয়ে বাড়তে থাকে এবং ডাল থেকে প্রয়োজনীয় পানি, খাদ্যরস, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি শোষণ করে বেঁচে থাকে। পরগাছার কোনো শেকড় থাকে না। শেকড়ের মত এক ধরনের হস্টোরিয়া তৈরি করে। ডাল থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। বর্ষাকালে পরগাছার বীজ বেশি বিস্তার লাভ করে। আক্রান্ত ডাল পরগাছার গোড়াসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটা স্থানে রোগের আক্রমণ যাতে না হয় তার জন্য বোর্দো পেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। পরগাছায় ফুল ফল আসার আগেই এ কাজটি করতে হবে। আমগাছে শতভাগ মুকুল আসা ভাল না। এতে ফলন ব্যাহত হয়। তাই শতভাগ মুকুলায়িত আমগাছের চারদিক থেকে ৫০% মুকুল ফোটার আগেই ভেঙে দিতে হবে। এতে ভাঙা অংশে নতুন কুশি গজাবে এবং পরবর্তী বছরে ওই সব ডগায় ফুল আসবে, আম আসবে। উপরোক্ত বিষয়সমূহে নজর দিলে অবশ্যই প্রতিবছর আমের ভাল ফলন পাওয়া যাবে। আম চাষি লাভবান হবেন। লেখক: কৃষিবিদ মো. শরফ উদ্দিন, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, ঈশ্বরদী, পাবনা এগ্রোবাংলা ডটকম

বাড়ির আঙিনায়ও আমের চাষ করা যায়

জ্যৈষ্ঠ মাস হচ্ছে বাংলাদেশের মধুমাস। আর এই মধুমাসের মধুফল হল আম। এই আমকে ঘিরে হয়েছে বাঙালির অনেক ঐতিহ্য এবং নানা ধরনের খাবার। ইদানীং কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী এই ঐতিহ্যকে নষ্ট করে ফেলছে। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন-কার্বামাইড ইথাইল, ইথিলিন এবং বিভিন্ন প্রকার হরমোন দিয়ে অপরিপকস্ফ ফলকে পাকিয়ে বাজারজাত করছে, যা মানুষের দেহের জন্য অনেক ক্ষতিকর। এতে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, ক্ষুদা মন্দা, বন্ধ্যত্ব ইত্যাদি মারাত্মক রোগ হতে পারে। এছাড়াও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দিন দিন জমি কমে যাওয়ায় ফল গাছের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। বাঙালিদের এই ঐতিহ্যবাহী ফলকে টিকিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএ রহিম নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তারই অংশ হিসেবে এরই মধ্যে ফলগাছ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ও বাণিজ্যিকভাবে চাষোপযোগী বিভিন্ন উন্নত জাতের উচ্চ ফলনশীল বামন প্রকৃতির আমের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়াও বছরে দুই থেকে তিনবার ফলনশীল, পলিঅ্যামব্রায়োনিক, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়াবেটিক আমসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আমের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এফটিআইপি বাউ আম-১ (শ্রাবণী) : শ্রাবণী একটি নিয়মিত ফলধারণকারী নাবী জাতের আম। ফলের আকার মাঝারি ও কিঞ্চিত্ লম্বা। পাকা ফলের ত্বকের রং গাঢ় হলুদ, শাঁসের রং কমলাভ লাল, সুস্বাদু, রসালো ও মিষ্টি। খোসা সামান্য মোটা ও আঁটি পাতলা। এটি একটি মাঝারি বামন জাতের গাছ। বাংলাদেশের সবগুলো এগ্রো ইকোলজিক্যাল জোনে উত্পাদনযোগ্য। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে ফুল আসে এবং জুলাই মাসের শেষের দিকে ফল পাকতে শুরু করে। সুনিষ্কাশিত উর্বর দোআঁশ মাটি উত্তম। ফুল আসা থেকে ফল পরিপকস্ফ হতে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস সময় লাগে। প্রতি বছর বর্ষার আগে ও পরে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের জন্য নিয়মিত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে। হেক্সাগোনাল রোপণ পদ্ধতি উত্তম। ৫-৭ মিটার – ৫-৭ মিটার রোপণ দূরত্বে প্রতি হেক্টর ৩০০-৩৫০টি চারা রোপণ করা যায়। রোপণকাল থেকে ফল পেতে প্রায় এক বছর সয়ম লাগে। ফলে মাঝে মাঝে হালকা অ্যানথ্রাকনোজ রোগ দেখা যায়। এফটিআইপি বাউ আম-২ (সিন্দুরী) :এটি নিয়মিত ফলধারণকারী ও বামন প্রকৃতির জাত। ফল আকারে ছোট ও গোলাকৃতি। গাছে থোকায় থোকায় আম ধরে। কাঁচা আম সবুজাভ সিঁদুরে রংয়ের হয়ে থাকে। পাকলে সিঁদুরে হলুদ রংয়ের হয়ে থাকে। রসালো এবং টক-মিষ্টি। শাঁসে কোনো আঁশ নেই। আমের আঁটি পাতলা কাগজের মতো। তাই এ জাতকে বীজবিহীন আম বলে। বাংলাদেশের সবগুলো এগ্রো ইকোলজিক্যাল জোনে উত্পাদনযোগ্য। উর্বর দোআঁশ মাটি এ ফল চাষের জন্য উত্তম। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সব মাটিতে এ ফল চাষ করা যায়। ৫-৭ মিটার – ৫-৭ মিটার রোপণ দূরত্বে প্রতি হেক্টর ৩০০-৩৫০টি চারা রোপণ করা যায়। রোপণের পর প্রথম বছর থেকে ফল পাওয়া যায়, তবে গাছের মজবুত কাঠামো তৈরির জন্য প্রথম বছর মুকুল আসার পর মুকুল ভেঙ্গে দিতে হবে। এই আমে ভিটামিন সি বেশি পরিমাণে থাকে।এফটিআইপি বাউ আম-৩ (ডায়াবেটিক) : জুন মাসের শেষের দিকে এই জাতের পাকা ফল পাওয়া যায় । ফুল আসা থেকে শুরু করে পরিপকস্ফ হতে ৫-৭ মাস সময় লাগে । ফলের আকার মাঝারি ও লম্বাটে প্রকৃতির । ফলের গড় ওজন ৫৫ গ্রাম । পাকা ফলের রং হলুদাভ । ফলে রসের পরিমাণ কম কিন্তু আঁশের পরিমাণ বেশি। ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত রোগীরা এ ফল খেতে পারে। এটি নিয়মিত ফলধারণকারী ও বামন প্রকৃতির জাত। গাছে প্রতি বছরই প্রধানত ২ বার ফুল ও ফল ধরে। প্রথমবার জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং দ্বিতীয় বার মে-জুন মাসে ফুল আসে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে উত্পন্ন ফুল হতেই মুখ্য উত্পাদন পাওয়া যায় । সুনিষ্কাশিত উর্বর দোআঁশ মাটি এ আম চাষের জন্য উত্তম । দীর্ঘ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না, তবে খরা মৌসুমে সেচ প্রদান করতে হবে । ৫-৭ মিটর দূরে দূরে প্রতি হেক্টরে ৩০০-৩৫০টি চারা রোপণ করা যায় । রোপণকাল থেকে ফল পেতে প্রায় একবছর সময় লাগে । এফটিআইপি বাউ আম-৪: এটি নিয়মিত ফল ধারণকারী জনপ্রিয় একটি জাত। জুন মাসের দিকে এই জাতের ফল পাকা শুরু হয় আর ফুল আসা থেকে ফল পরিপক্ক হতে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস সময় লাগে। পাকা ফলের ত্বকের রঙ হালকা সবুজ। শাঁসের রঙ কমলা, সুগন্ধযুক্ত, রসালো এবং বেশ মিষ্টি। শাঁসে কোনো আঁশ নেই। খোসা পাতলা এবং আঁটি খুবই ছোট (ফলের ৯.৭৬%)। এ জাতের আম সারা বছর লাগানো যায়। বোঁটা শক্ত হওয়ায় ঝড়ো হাওয়াতে ঝরে পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। ৭-৮ মিটার দূরে দূরে প্রতি হেক্টরে ২০০-২২০টি চারা রোপণ করা যায়।এফটিআইপি বাউ আম-৬ (পলিএ্যাম্বব্রায়নী): গাছ বামন আকৃতির এবং নাবী জাত। পাঁচ বছরের একটি গাছ হতে গড়ে ১০০-৩০০টি ফল পাওয়া যায়। একটি বীজ হতে গড়ে ৫-৮টি চারা পাওয়া যায়, এর মধ্যে একটি চারা জাইগোটিক বাকিগুলো নিউসেলাস। প্রতি বছরই ফল পাওয়া যায়। অর্ধেক ড্রামে বাড়ির ছাদেও চাষ করা যায়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফুল আসে এবং জুলাই-আগস্ট মাসে ফল পরিপক্ক হয়। জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি উত্তম। পাঁচ বছরের একটি গাছ হতে ৩০-৪০ কেজি ফলন পাওয়া যায় এবং বছর প্রতি ২০-৩০ কেজি করে বাড়তে থাকে। পূর্ণবয়স্ক গাছে ২৫-৩০ টন/হেক্টরে ফল পাওয়া যায়। এই আমগাছ বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন এবং পলিএ্যাম্বব্রায়নী হওয়ায় নার্সারিতে চারা উৎপাদন করার জন্য উত্তম। এফটিআইপি বাউ আম-৯ (সৌখিন চৌফলা): জাতটি নিয়মিত ফলধারণকারী। এটি একটি বামন জাতের গাছ। বছরে ৩-৪ বার ফল দেয়। এটি সৌখিন ফল চাষিদের জন্য, যা ছাদে বা টবে চাষ করা যায়। বাণিজ্যিকভাবেও লাগানো যায়। পলিব্যাগে চারা থাকলে সারা বছর গাছ লাগানো যায়। সুনিষ্কাশিত উর্বর দোআঁশ মাটি উত্তম। ফুল আসা থেকে ফল পরিপক্ক হতে প্রায় পাঁচ মাস সময় লাগে। প্রতি হেক্টরে ৭০০-৮০০টি চারা রোপণ করা যায়। রোপণকাল থেকে ফল পেতে ছয় মাস সময় লাগে।এফটিআইপি বাউ আম-১০ (সৌখিন-২): এটি একটি মাঝারি বামন জাত। সারা বছর জাতটি লাগানো যায়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ফুল আসে এবং মে-জুন মাসে ফল পরিপক্ক হয়। আবার জুলাই-আগস্ট মাসে ফল আসে এবং নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ফল পাকে। রোপণকাল থেকে ফল পেতে এক বছর সময় লাগে। তেমন কোনো রোগবালাই দেখা যায় না। প্রথম বছর ১০-১৫টি এবং দ্বিতীয় বছরে ৩০-৫০টি পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। এই জাতের গাছ বাণিজ্যিকভাবে লাগানো ঠিক হবে না। তবে বাড়ির আঙিনায় ও ছাদে লাগানোর জন্য উত্তম। উল্লেখ্য, বাউ আমের চারা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্ম প্লাজম সেন্টারসহ দেশের বিভিন্ন নার্সারিতে পাওয়া যায়।

থাই আম চাষের পদ্ধতি

থাইল্যান্ডে চাষ করা আমের জাত এ দেশে থাই আম নামে পরিচিত। তবে কোনো থাই আমের জন্ম থাইল্যান্ডে নয়। আমের আদি নিবাস এই ভারতীয় উপমহাদেশেই। থাইল্যান্ড আমের কিছু আদি জাত নিয়ে গবেষণা করে উন্নত অনেক জাত উদ্ভাবন করেছে। সেসব জাতের মধ্যে বেশ কিছু জাত তারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করছে। কিছু কিছু জাত অন্য দেশের মাটিতেও চাষ করা হচ্ছে। সম্প্রতি থাইল্যান্ড থেকে বেশ কিছু জাতের আম এ দেশে এসেছে। জাতগুলো হলো চুকানন, মিয়াচাও, মোহাচনক, নাম ডক মাই, নাম ডক মাই মান, নাম ডক মাই ৪, উমরন, থাই কাঁচামিঠা প্রভৃতি। এসব জাতের মধ্যে এ দেশে নাম ডক মাই জাতটি পাকা আম হিসেবে এবং থাই কাঁচামিঠা জাতটি কাঁচা আম হিসেবে খাওয়ার জন্য অনেকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। নাম ডক মাই জাতটি এ দেশে বিভিন্ন নার্সারিতে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিতি পেলেও জাতটি আসলে একই। বৃক্ষমেলাসহ বিভিন্ন নার্সারিতে এখন নাম ডক মাই জাতের আমের চারা পাওয়া যাচ্ছে।নাম ডক মাই জাতের বৈশিষ্ট্য : এ জাতের আম কাঁচা ও পাকা দুই অবস্খাতেই খাওয়া যায়। গাছ মাঝারি আকৃতির, ঘন পত্রপল্লববিশিষ্ট, গাছের গড়ন খাড়া। নতুন পাতা হালকা সবুজ রঙের, বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাঢ় সবুজ হয়ে যায়। ছয় বছরের একটা গাছ ছয় মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। কলমের চারা লাগানোর পরের বছর থেকেই গাছে মুকুল আসে ও ফল ধরে। চারার গাছে ফল ধরতে চার থেকে পাঁচ বছর লেগে যায়। এ জাতের ফল লম্বাটে, একটু বাঁকানো, অগ্রভাগ ক্রমেই সরু ও ভোঁতা। কাঁচা আমের রঙ সবুজ, কিন্তু পাকার পর খোসা পুরোপুরি হলুদ হয়ে যায়। একটি আমের গড় ওজন ৩০০ গ্রাম, সাধারণত ২৫০ থেকে ৪০০ গ্রামের মধ্যে আমের ওজন হয়ে থাকে। এ জাতের আম প্রায় ১৩ সেন্টিমিটার লম্বা ও ছয় সেন্টিমিটার চওড়া। পাকার পর শাঁসের রঙ হয় হলুদ ও নরম। শাঁস খুবই মিষ্টি ও আঁশবিহীন। তবে খোসার কাছে শাঁস নরম হতে হতে আঁটির কাছের শাঁস অনেক সময় বেশি নরম হয়ে জেলি বা কাদার মতো হয়ে যায়। আমের ওজনের চার ভাগের তিন ভাগই শাঁস, এক ভাগ খোসা ও আঁটি। খোসা বেশ পাতলা। পাকার পর আম থেকে মৃদু মিষ্টি ঘ্রাণ বের হয়। এ জাতের আমের বীজ বহুভ্রূণী বা পলিঅ্যামব্রায়নি প্রকৃতির। সচরাচর একটা আমের আঁটি থেকে একটা চারাই হয়। কিন্তু এ জাতের আমের একটি আঁটি থেকে অনেকগুলো চারা হয়। প্রায় সব জাতের আমেরই আঁটি থেকে গজানো চারায় মাতৃগুণ হুবহু এক না থাকলেও নাম ডক মাই জাতের আঁটি থেকে গজানো চারায় মাতৃগুণ একই থাকে এবং সে চারার গাছে ধরা আমগুলোর বৈশিষ্ট্যও হয় একই। চাষাবাদ : বাড়ির আঙিনায়, ছাদে ড্রামে, পুকুরপাড়ে, বাণিজ্যিক বাগানে নাম ডক মাই জাতের আমগাছ লাগানো যায়। বসতবাড়িতে শখ করে দু-একটা গাছ লাগানো যেতে পারে। তবে কেউ যদি দু-এক হেক্টর জমিতেও এ জাতের বাণিজ্যিক বাগান গড়তে চান তো সে ক্ষেত্রে আম্রপালি আমের চেয়ে লাভ কম হবে না। এ জাতের আমের গাছ লাগানোর জন্য চাই উঁচু জমি, যেখানে বন্যা বা বৃষ্টির পানি আটকে থাকে না। বেলে, বেলে দোআঁশ ও উপকূলের লোনা মাটি ছাড়া যেকোনো মাটিতে নাম ডক মাই জাতের আম চাষ করা যেতে পারে। চাষ করা যায় লাল মাটি ও পাহাড়েও। তবে দো-আঁশ ও এঁটেল দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো। এরূপ মাটিতে জৈবসার ব্যবহার করে চাষ করলে গাছের বাড়বাড়তি ও ফলন ভালো হয়। কলমের গাছ লাগালে অতি ঘন পদ্ধতিতে দূরত্ব কম দিয়ে চারা লাগানো যায়। পরে পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্ত সেসব গাছ থেকে ফল পাওয়ার পর দুই গাছের মাঝখান থেকে একটা গাছ গোড়া থেকে কেটে ফেলা যায়। এতে প্রথম তিন থেকে চার বছরে একই পরিমাণ জমি থেকে প্রায় দ্বিগুণ লাভ হতে পারে। কাটার পর বাকি গাছগুলো স্খায়ীভাবে রেখে ভালো করে যত্ন নিলে সেসব গাছ পূর্ণ হয়ে ওঠে। সাধারণত এ জাতের চারা বা কলম লাগানোর জন্য চার থেকে ছয় মিটার দূরত্ব দেয়া হয়। এ দূরত্বের হিসাবে হেক্টরপ্রতি ১৮৫ থেকে ২৭৮টি চারা লাগানো যায়। অতি ঘন পদ্ধতিতে তিন মিটার দূরত্ব দিয়ে সব দিকে সারি করে গাছ লাগানো যেতে পারে। তা না হলে প্রথমেই ছয় মিটার দূরে দূরে চারা বা কলম লাগিয়ে মাঝখানের জায়গা ফাঁকা না রেখে গাছ যথেষ্ট বড় না হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন শাকসবজি, মুগ ও মাষকলাই ডাল, তিল, আদা প্রভৃতি লাগানো যায়। লাগানোর সাত থেকে ১০ দিন আগে গর্ত খুঁড়ে গর্তের মাটিতে গর্তপ্রতি ১০ থেকে ১৫ কেজি গোবর সার মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। কলম বা চারা সুরক্ষার ব্যবস্খাও করতে হবে। বর্ষাকাল চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। তবে পলিব্যাগ বা টবের কলম খুব শীত ছাড়া বছরের যেকোনো সময় লাগানো যায়। সে ক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্খা করতে হবে। গর্তের ঠিক মাঝখানে চারাটি সোজা করে লাগিয়ে চারার গোড়ায় পানি দিতে হবে। চারা বাড়তে শুরু করলে গাছের গোড়ার চার পাশে চারটি ট্যাবলেট সার পুঁতে দিলে সারা বছর আর কোনো সার দেয়ার দরকার পড়ে না। তবে দ্বিতীয় বছর থেকে পরিমাণমতো ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিঙ্ক ও জিপসাম সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে বোরন সারও দিতে হবে। না হলে আমের গুটি ফেটে যেতে পারে। এ জাতের আমগাছের সুন্দর গড়ন, বাড়বাড়তি, রোগ-পোকার আক্রমণ কমানো ও ভালো ফলনের জন্য ছাঁটাই খুব দরকার। বিশেষ করে রোপণের পর প্রথম কয়েক বছর ছাঁটাই কাজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এতে মূল কাণ্ড বা গুঁড়ি মজবুত হওয়া ছাড়াও গাছের মাথা বেশি ঝাঁকড়া হয়, বেশি ফুল-ফল ধরে। গাছে ফল ধরা শুরু হলে নিচে ঝুলে পড়া ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। খুব ঘনভাবে এঁটে থাকা ডালও ছেঁটে পাতলা করে দিতে হবে। গাছকে ছেঁটে তিন থেকে পাঁচ মিটার উচ্চতার মধ্যে রাখতে পারলে স্প্রে করা ও ফল তুলতে সুবিধে হয়। এ জাতের গাছে নিয়মিতভাবে প্রতি বছরই ফল ধরে, তবে সব বছর সমান ধরে না। চারা বা কলম তৈরি : সরাসরি বীজ বা আঁটি থেকে চারা তৈরি করা যায়। পূর্ণভাবে পাকা ফল গাছ থেকে পেড়ে আরো দু-চার দিন ঘরে রেখে নরম করতে হবে। এরপর আম থেকে আঁটি সংগ্রহ করে প্রথম বীজতলার মাটিতে বসাতে হবে। বীজতলায় ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে আঁটিগুলো সারি করে বসানোর পর আঁটির ওপরে আলগা ঝুরা মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। আঁটি বের করার পরপরই বীজতলার মাটিতে ফেলতে পারলে ভালো, না হলে অল্প কিছু দিনের জন্য ছায়ায় শুকিয়ে চটের বস্তায় ভরে রেখে দেয়া যায়। একটা আঁটি থেকে যে কয়টি চারা গজাবে সে চারাগুলোকে শেকড়সহ সাবধানে কেটে আলাদা করে দ্বিতীয় বীজতলায়, টবে বা বড় পলিব্যাগে গোবর মিশানো মাটিতে বসাতে হবে। এক বছর বয়স হলে সেসব চারা বাগানে লাগানোর উপযুক্ত হবে। জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত চারা তৈরির উপযুক্ত সময়। তবে কলম করতে চাইলে মাঝারি আকারের গাছ হয় এমন কোনো দেশী জাতের আমের আঁটি থেকে প্রথমে চারা তৈরি করে নিতে হবে। চারার মাথা কেটে ফাটল তৈরি করে ক্লেফট গ্রাফটিং পদ্ধতিতে নাম ডক মাই গাছের ডগা তেরছা করে কেটে ফাটলে ঢুকিয়ে ফিতে দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। ক’দিনের মধ্যে জোড়া লেগে যায়। জুড়ে দেয়া ডগা থেকে নতুন পাতা ছাড়া শুরু হলেই বুঝতে হবে জোড়া লেগে গেছে। নতুন চারা উৎপাদনের জন্য এ পদ্ধতিই ভালো। কেননা এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত কলমের গাছে রোপণের এক থেকে দুই বছর পর থেকেই ফল ধরতে শুরু করে। বালাইব্যবস্খাপনা : এ জাতের গাছে পাউডারি মিলডিউ বা সাদা গুঁড়া রোগ বেশি হয়। ছত্রাকজনিত এ রোগটি মুকুল ও মুকুলের ডাঁটিতে আক্রমণ করে সাদা পাউডারে ঢেকে ফেলে। এতে ফুল ও ছোট ফল পচে নষ্ট হয়, সব ঝরে পড়ে। মুকুল আসার পর থেকে ফল কলাইদানার মতো হওয়া পর্যন্ত এ রোগটি সাধারণত আক্রমণ করে। কুয়াশা হলে রোগটা বাড়ে। রোগের আক্রমণে দানা বেঁধে ওঠা গুটিও ঝরে যায়। তাই মুকুল আসার পরপরই ফুল ফোটার আগেই যেকোনো অনুমোদিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। এ ছাড়া কাঁচা অবস্খায় আমের মুখ ছিদ্র করে একধরনের পোকা ভেতরে ঢুকে শাঁস ও কচি আঁটি খেয়ে নষ্ট করে দেয়। পাকার সময় আক্রমণ করে ফলের মাছি। ওরাও ফল ছিদ্র করে শাঁস খেয়ে পাকা আম নষ্ট করে। তাই এসব পোকার আক্রমণ থেকে ফল রক্ষার জন্য অনুমোদিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
আম চাষ ব্যবস্থাপনা
পুষ্টিমূল্য: পাকা আম ক্যারোটিনে ভরপুর। এছাড়া প্রচুর পরিমানে খনিজ পদার্থ থাকে।
ভেষজগুণ: আমের শুকনো মুকুল পাতলা পায়খানা, প্রস্রাবের জ্বালা উপশমে ব্যবহার করা যায়। আম লিভার ও যকৃতের জন্য উপকারি।
ব্যবহার: চাটনি, আচার, জুস ও ক্যান্ডি।
উপযুক্ত জমি মাটি: উর্বর দোআঁশ উঁচু ও মাঝারি জমি আম চাষের জন্য উপযোগি।
জাতপরিচিতি:
বারি আম-১ (মহানন্দা): প্রতি বছর নিয়মিত ফল দেয়। বাংলাদেশের সবখানেই এ জাতটির চাষ করা যায়। পাকা ফলের রং আকর্ষণীয় হলদে। ফলের ওজন গড়ে প্রায় ২০০ গ্রাম।
বারি আম-২: প্রতি বছর ফল ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন জাত। ফলের ওজন গড়ে ২৫০ গ্রাম। ফলের খোসা মধ্যম পুরু ও মসৃন। বাংলাদেশের সবখানেই এ জাতটির চাষ করা যায়।
বারি আম-৩ (আম্রপালি): প্রতি বছর নিয়মিত ফল দেয়। ফলের শাঁস গাঢ় কমলা রঙের। আঁশহীন, মধ্যম রসালো, শাঁস ফলের শতকরা ৭০ ভাগ। গাছের আকৃতি মাঝারি। প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ১৫৫-১৭০ টি।
বারি আম-৪ (হাইব্রিড আম): এটি একটি উচ্চ ফলনশীল, মিষ্টি স্বাদের নাব জাত। ফজলী আম শেষ হওয়ার পর এবং আশ্বিনা আমের সাথে এ জাতের আম পাকে। এ জাতের আম কাঁচা অবস্থাতেও খেতে মিষ্টি।
চারাতৈরি: ক্লেফট গ্রাফটিং পদ্ধতিতে চারা তৈরি করা যায়।
চারারোপণ: ষড়ভূজি পদ্ধতিতে আম চারা রোপণ করলে ১৫ ভাগ চারা বেশি রোপণ করা যায়। জৈষ্ঠ্য থেকে আষাঢ় (মধ্য মে থেকে মধ্য জুলাই) এবং ভাদ্র-আশ্বিন মাস (মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর) চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। প্রতি গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৮ থেকে ১০ মিটার রাখতে হয়।
সার ব্যবস্থাপনা: প্রতি গর্তে সারের পরিমাণ গোবর ২২ কেজি, ইউরিয়া ১৫০ গ্রাম, টিএসপি সার ৫৫০ গ্রাম, এমওপি সার ৩০০ গ্রাম, জিপসাম সার ৩০০ গ্রাম, জিংক সালফেট সার ৬০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর চারার গোড়ার মাটির বলসহ গর্তের মাঝখানে রোপণ করতে হবে।
একটি পূর্ণ বয়স্ক ফলন্ত আম গাছে বছরে ৫০ কেজি জৈব সার, ২ কেজি ইউরিয়া, ১ কেজি টিএসপি, ৫০০ গ্রাম এমওপি, ৫০০ গ্রাম জিপসাম ও ২৫ গ্রাম জিংক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে। উল্লেখিত সার ২ কিসি-তে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথমবার জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাসে এবং দ্বিতীয়বার আশ্বিন মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ  আগাছাব্যবস্থাপনা: ফলন্ত গাছে মুকুল বের হওয়ার ৩-৪ মাস আগ থেকে সেচ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তবে মুকুল ফোটার পর ও ফল মটর দানা হলে একবার বেসিন পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া দরকার। গাছের গোড়া ও গাছের ডালপালা সব সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কলমের গাছের বয়স ৪ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মুকুল ভেঙে দিতে হবে।
রোগব্যবস্থাপনা
আমেরএ্যানথ্রাকনোজরোগদমন:
ভূমিকা: এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমনের কারণে এ রোগ হয়।
ক্ষতিরনমুনা: গাছের পাতা, কান্ড, মুকুল ও পরে ধুসর বাদামি রঙের দাগ পড়ে। এ রোগে আক্রান- মুকুল ঝরে যায়, আমের গায়ে কালচে দাগ পড়ে এবং আম পচে যায়।
প্রতিকার: আমের মৌসুম শেষে গাছের মরা ডালপালা কেটে পুড়ে ফেলতে হয়। কাটা অংশে বোঁর্দো মিশ্রণ লাগাতে হয়। গাছে মুকুল আসার পর কিন’ ফুল ফোটার আগে ডাইথেন এম-৪৫ বা টিল্ট-২৫০ ইসি প্রয়োগ করা দরকার।
পোকাদমনব্যবস্থাপনা
আমেরভোমরাপোকাদমন:
ভূমিকা: আমের ভোমরা পোকার আক্রমনে ফলনে মারাত্নক ক্ষতি হয়ে থাকে।
ক্ষতিরনমুনা: ভোমরা পোকার কীড়া আমের গায়ে ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে শাঁস খায়। সাধারণত কচি আমে ছিদ্র করে এরা ভিতরে ঢুকে এবং ফল বড় হওয়ার সাথে সাথে ছিদ্রটি বন্ধ করে দেয় এ জন্য এ জন্য বাইরে থেকে আমটি ভাল মনে হলেও ভিতরে কীড়া পাওয়া যায়।
প্রতিকার: আম গাছের মরা ও অতিরিক্ত পাতা শাখা এবং পরগাছা কেটে ফেলতে হবে। গাছে ফল আসার ১-২ সপ্তাহ পর অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা দরকার।
ফসলতোলা: আমের বোটা যখন হলুদাভ রঙ ধারণ করে তখন আম সংগ্রহ শুরু করতে হয়। গাছ ঝাকি না দিয়ে জালিযুক্ত বাঁশের কৌটার সাহায্যে আম সংগ্রহ করা ভালো।
নিচু জায়গায় আম বাগান তৈরির কলাকৌশল
বাংলাদেশে আম একটি অর্থকরী ফসল। বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার, স্বাদ-গন্ধ ও পুষ্টিমানে এটি একটি আদর্শ ফল। তাই আমকে ফলের রাজা বলা হয়। আম বাগান স্থাবর সম্পত্তির মতো। কারণ বাগান থেকে বছরের পর বছর আয় আসতে থাকে। বাংলাদেশে ৭০ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৪ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয় (বিবিএস, ২০০৯)। লক্ষ করা গেছে, অনেক আম বাগান নিচু জমিতে হওয়ায় বর্ষাকালে বৃষ্টির পানির ফলে জলাবদ্ধতায় এবং কখনো কখনো বন্যার পানির জন্য আমগাছ মারা যায়। গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময় বর্ষাকালে। তাই নিচু জায়গায় বর্গাকারপদ্ধতিতে আম বাগান তৈরিতে নিম্নলিখিত কলাকৌশল গ্রহণ করা দরকার। ক. ইনসিটু গ্রাফটিংযখন স্বস্থানে আঁটি থেকে চারা গজানোর পর সেই চারায় কলম বাধা হয়। এ ৰেত্রে তৈরি কলমের গাছ প্রতিস্থাপন বা পুনরায় রোপণের দরকার হয় না। অর্থাৎ জোড়া লাগানোর পরে কলমের চারাটি স্বস্থানেই স্থানীয়ভাবে বেড়ে উঠে এবং ফুল-ফল দিতে থাকে।যেসব জায়গা নিচু অর্থাৎ বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি জমে থাকে অথবা কখনো কখনো বন্যার পানি উঠে, সেসব জায়গায় প্রথমেই জমির নকশা অনুযায়ী কেবলমাত্র আঁটি লাগানোর পয়েন্ট এর চতুর্দিকে (১.৫-২.০ হাত পর্যন্ত) মাটি দ্বারা ঢিবি তৈরি এবং ঢিবি পরিমাণ মতো অর্থাৎ দাঁড়ানো পানি থেকে উঁচু করে গাছের জন্য স্থায়ী জায়গা তৈরি করতে হবে। তারপর প্রথম বছর আঁটি স্থায়ী জায়গাগুলোতে লাগাতে হবে। চারা গজালে পছন্দ মতো বড় (৪-৫ ফুট উঁচু) করে সেই চারায় আমের ভালো জাতের সায়ন নিয়ে ভিনিয়ার গ্রাফটিং করতে হবে। এ পদ্ধতিতে বাগান তৈরিতে সময় বেশি লাগে।
প্রযুক্তির সুবিধাজনক দিক ১. এতে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। ২. তৈরি কলমের গাছ স্থানান্তর করে অন্যত্র লাগানোর দরকার হয় না। বলে এর সফলতা অনেক বেশি। ৩. অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। বেশি টাকা দিয়ে কলমের চারা না কিনে অল্প টাকায় আঁটিকিনে তার থেকে রুট স্টক তৈরি করে এবং পরে সেখানে ভিনিয়ার গ্রাফটিং করে বাগান করা সম্ভব। ৪. কলমের জোড় উঁচুতে (পছন্দ মতো ৪-৫ ফুট উপরে) থাকায় জলাবদ্ধতায় রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় না। ৫. উঁচুতে কলম করা হয় বিধায় গরু-ছাগলের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাঁশের তৈরি খাঁচার প্রয়োজন হয় না।
প্রযুক্তির জরুরি দিকগুলো ১. আঁটি সংগ্রহ করতে হয়। ২. আঁটি থেকে কাঙ্ক্ষিত রুটস্টক তৈরি করতে হয়। ৩. কাঙ্ক্ষিত সায়ন সংগ্রহ করতে হয়। ৪. কলম বাঁধায় দক্ষ ও এরকম লোক খুঁজে বের করতে হয়।
খ. মডিফাইড ইনসিটু গ্রাফটিং
এক্ষেত্রে স্বস্থানে প্রথমে আঁটি ব্যবহার না করে তার পরিবর্তে অন্য জায়গায় অর্থাৎ কোনো ফার্ম বা নার্সারি থেকে গুটি গাছ (সাধারণত ৪-৫ ফুট উঁচু যাতে কমপক্ষে ২/৩টি শাখা-প্রশাখা থাকে) এনে লাগিয়ে পরে সেই চারায় পছন্দের সায়ন দ্বারা ভিনিয়ার কলম বাঁধা এবং অন্যান্য কাজকর্ম সব ইনসিটু গ্রাফটিং এর মতোই।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেক জায়গায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম গাছ লাগিয়ে বাগান তৈরি করা হয়েছে। আজকাল বাজারে সঠিক জাতের চারা পাওয়া খুবই কঠিন। এক জাতের চারা নিয়ে লাগানোর পরে অন্য জাতের গাছ হয়ে যায়। এভাবে জনগণঅহরহ প্রতারিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় মডিফাইড ইনসিটু গ্রাফটিং প্রযুক্তিতে আম বাগান তৈরি খুবই ফলপ্রসূ হবে।
প্রযুক্তির সুবিধাজনক দিক ১. এতে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকে না বললেই চলে। ২. তৈরি কলমের গাছ স্থানান্তর করে অন্যত্র লাগানোর দরকার হয় না। ৩. বেশি টাকা দিয়ে কলমের চারা না কিনে অল্প টাকায় পছন্দের সায়ন ও আঁটির গাছ (রুটস্টক) কিনে পরে সেখানে ভিনিয়ার গ্রাফটিং করে বাগান করা সম্ভব। ৪. কলমের জোড় উঁচুতে (পছন্দ মতো ৪-৫ ফুট উপরে) থাকায় জলাবদ্ধতায় রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রানৱ হয় না। ৫. উঁচুতে কলম করা হয় বিধায় গরু-ছাগলের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাঁশের তৈরি খাঁচার প্রয়োজন হয় না। ৬. বড় গুটি গাছে কলম করা হয় বিধায় অল্প সময়ে কম খরচে বাগান তৈরি হয় এবং গাছগুলো দেখতে একই রকম হয়।
প্রযুক্তিরজরুরি দিকগুলো ১. পছন্দের গুটি গাছ অর্থাৎ রুটস্টক সংগ্রহ করতে হয়। ২. কাঙ্ক্ষিত সায়ন সংগ্রহ করতে হয়। ৩. কলম বাঁধায় দক্ষ লোকের প্রয়োজন হয়।
গ. মাটি ঢিবিতে কলমের চারা রোপণ (মাটিকচারো)
যখন বাজার, নার্সারি কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পছন্দের কলমের চারা ক্রয় করে এনে স্বস্থানে বা নির্ধারিত জায়গায় নকশা অনুযায়ী সরাসরি লাগানো হয়। এক্ষেত্রেও একই রকম মাটির ঢিবি তৈরি করা হয়। তবে চারাটি বড় (৪-৫ ফুট উঁচু) এবং কলমের জোড়ের স্থানটি বেশ উপরে হলে ভালো হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহীর নিচু জায়গায়গুলোতে এ প্রযুক্তিতে বহু আম বাগান গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে আম ধানের জমিতে অনেক আম বাগান গড়ে উঠেছে। দেখা গেছে, অনেক জায়গায় মাটির ঢিবি তৈরির নিয়ম মানা হয়নি। অর্থাৎ গাছের গোড়ায় অল্প মাটি দেয়া হয়েছে। ফলে গাছের রুট সিস্টেম ততটা উন্নত না হওয়ায় গাছের বৃদ্ধিও ভালো হয়নি। গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য অর্থাৎ একটি ভালো বাগান তৈরির জন্য নিয়ম মেনে মাটির ঢিবি তৈরি করা উচিত। ২০০২ সনে জেলা কারাগার চাঁপাইনবাবগঞ্জ কর্তৃপক্ষ অফিসিয়াল চিঠির মাধ্যমে কারাগারের অভ্যন্তরে নিচু জায়গায় বাগান তৈরির পরামর্শ চাইলে মডিফাইড ইনসিটু গ্রাফটিং অথবা মাটিকচারো যেকোনো একটি পদ্ধতিতে বাগান তৈরির পরামর্শ দেয়া হয়। এতে বেশ সুফল পাওয়া গেছে।
প্রযুক্তি সুবিধাজনক দিক ১. কম সময়ে বাগান তৈরি করা যায়। ২. কাঙ্ক্ষিত সায়ন এবং রম্নট স্টক সংগ্রহ করতে হয় না। ৩. কলম বাঁধায় দৰ লোকের প্রয়োজন হয় না।
প্রযুক্তির অসুবিধা ১. প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকে। ২. খরচ বেশি পড়ে। ৩. চারা ছোট হলে করমের জোড় নিচে থাকে। ফলে জলাবদ্ধতায় রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রানৱ হয়।
এতোক্ষণ নিচু জায়গায় আম বাগান তৈরির কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হলো। আম বাগান তৈরি সম্পর্কে আরো জানার থাকলে লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। এখন আমগাছের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে ‘অন-ইয়ার’ ও ‘অফ-ইয়ার’ সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
আমগাছের অন-ইয়ার অফ-ইয়ারসমস্যা ও প্রতিকার আমগাছের বহু সমস্যার মধ্যে একটি বড় সমস্যা হলো প্রতি বছর ফুল ও ফল না আসা। দেখা গেছে, একেবারেই ফুল হয় না বা হলেও কোনো কোনো বছর খুব কম হয়। যখন অনেক গাছে এক বছর খুব ফুল হয় আর পরের বছর একেবারেই হয় না বা খুব সামান্য হয় এবং তৃতীয় বছর আবার খুব বেশি ফুল আর চতুর্থ বছর কিছুই না বা কম অর্থাৎ এরা একটু ছন্দের মতো চলে। এই রকম হলে বলা হয় ‘অলটারনেট বা বায়িনিয়াল বেয়ারিং’। আবার যেসব গাছে হয়তো এক বছর খুব বেশি ফুল হলো, তারপর দু-তিন বছর হলো না বা কম হলো, কিংবা পরপর দু’তিন বছর বেশ ফুল হলো তারপর এক বছর বা কয়েক বছর বন্ধ থাকে অর্থাৎ এরা একটু এলোপাতাড়ি ধরনের। এদের বলা হয় ‘ইরেগুলার বেয়ারার’। এই দুটি সমস্যা অনেক আমগাছে দেখা যায়। যে বছর খুব বেশি ফুল হয়, সেই বছরটিকে উদ্যান বিজ্ঞানে বলা হয় ‘অন ইয়ার’, আর বিনা ফলন বা কম ফলনের বছরকে বলা হয় ‘অফ-ইয়ার’।
সম্ভাব্য কারণ
ক.জাতের বৈশিষ্ট্য- আমের যে জাতগুলো কেবল শাখার অগ্রভাগে ফুল ধারণ করে জাতগুলোর পর্যায় ক্রমিক অর্থাৎ এক বছর অন্তর ফল উৎপাদন হয়। এই সমস্যা সব জাতের আমের মধ্যে দেখা যায় না কিন্তু কিছু ভালো আমের জাতের মধ্যে যেমন ল্যাংড়া, খিরসাপাত, গোপালভোগ ইত্যাদিতে সমস্যাটি ভালোভাবে দেখা যায়। আর কিছু কিছু আমের জাত আছে যাদের ‘অফ ইয়ারে’ ফুল ও ফল হয়, তবে অপেৰাকৃত কম যেমন- ফজলি। আবার যে জাতগুলো শাখার অগ্রভাবে প্রথম বছর ও পরের বছর শাখার কৰে পুষ্পমুকুল উৎপন্ন করতে পারে সে জাতগুলো নিয়মিতভাবে কম/বেশি ফল উৎপাদন করতে পারে, যেমন- বারি আম-১, বারি আম-২, বারি আম-৩, বারি আম-৪ ইত্যাদি।
খ.গাছের বয়স- যেসব জাতের মধ্যে সমস্যাটি দেখা যায় যেমন- ল্যাংড়া। কিন্তু যখন ওই ল্যাংড়া গাছের বয়স কম তখন সমস্যাটি থাকে না অর্থাৎ প্রথম দিকে প্রতি বারেই ফুল হয় কিন্তু সাধারণত ১৫-২০ বছর বয়সের পর তারা এই গুণটি হারিয়ে ফেলে।
গ.গাছের ডালের বয়স : মুকুল ধরার জন্য ডালের বয়স কমপৰে ৪-৫ মাস হওয়া দরকার।তবে যেসব ডালের বয়স ৮-১০ মাসের হয় সেসব ডালে বেশি মুকুল ধরে।
ঘ.পাতাওয়ালা মুকুল : আমের মুকুল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডালের ডগায় আসে এবং ওপর দিকে আস্তে আস্তে সুচালো হয়ে যায়, যা দেখতে পিরামিডের মতো। উপ-শাখাগুলো ফুলে ভরা থাকে, তাতে পাতা থাকে না। কিন্তু কিছু কিছু জাতের গাছ আছে,যাদের মুকুলে শুধু ফুলই থাকে না, সেই সঙ্গে পাতাও থাকে। বারি আম-৩, বারি আম-৪ ইত্যাদিতে বেশি পাতাওয়ালা মুকুল দেখা যায়। ফজলি গাছেও কিছুসংখ্যক পাতাওয়ালা মুকুল হয়, তাই এই জাতগুলো প্রায় প্রতি বছর মোটামুটি ফল আসে। অন্যান্য জাতেও মাঝে মধ্যে কিছু কিছু পাতাওয়ালা মুকুল দেখা যায়। পাতাওয়ালা প্যানিকলকে মিঙড প্যানিকল বলে।
ঙ. ডালে শর্করা ও নাইট্রোজেনের অনুপাত : আমের একটি ডালে মুকুল আসতে হলে, ফুল আসার আগে ডালটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করা ও নাইট্রোজেন দুই-ই থাকতে হবে আর শুধু তাই নয়,শর্করার ভাগ নাইট্রোজেনের ভাগের চেয়ে যথেষ্ট বেশি থাকতে হবে তবেই মুকুল আসবে। আর যদি দুটির ভাগ সমান হয় বা বিশেষ করে ডালটির নাইট্রোজেনের মাত্রা শর্করার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে ঐ ডালটির ডগায়, বসন্তকালে মুকুল আসার বদলে পাতা এসে যাবে।
চ. উদ্ভিদ হরমোনের বৈষম্য (Phyohomone):আম গাছের এই সমস্যাটির জন্য উদ্ভিদ হরমোন ‘অঙিন’,‘জিম্বেরেলিন’ ও বিশেষ করে ‘গ্রোথ ইনহিবিটর’ জাতীয় হরমোনগুলো দায়ী বলে মনে করা হয়।
প্রতিকার: ক.বাণিজ্যিক জাত : যেমন- গোপালভোগ, ল্যাংড়া, খিরসাপাত, আশ্বিনা ইত্যাদির অলটারনেট বেয়ারিং হ্যাবিট আছে এবং বারি আম-১, বারি আম-২, বারি আম-৩, বারি আম-৪ ইত্যাদি রেগুলার বেয়ারর জাত। তাই বাগানে শুধু ‘অলটারনেট বেয়ারার’ জাতের গাছ না লাগিয়ে, অন্তত কিছুসংখ্যক ‘রেগুলার বেয়ারার’ জাতও লাগানো উচিত। এতে প্রতি বছরই বাগান থেকে কিছু না কিছু ফলন পাওয়া যাবে।
খ.বাগানের গাছগুলোকে অধিক উৎপাদনক্ষম করার জন্য অবশ্যই আম বাগান বছরে ৩ বার বর্ষার আগে, বর্ষার পরে ও শীতকালে লাঙল, পাওয়ার টিলার অথবা কোদাল দ্বারা কুপিয়ে ভালোভাবে গভীর চাষাবাদ করতে হবে। ফলে বাগানের আগাছা মারা যাবে এবং মাটির সাথে মিশে জৈবসারে পরিণত হবে। মাটির ভেতরকার পোকামাকড়ও মরে জৈব পদার্থ হিসেবে মাটিতে যোগ হবে। তাছাড়া মাটির আর্দ্রতা ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং পুষ্টি উপাদানগুলো গাছের গ্রহণের উপযোগী হবে। গ. গাছের বৃদ্ধি ও বেশি ফলনের জন্য সঠিক সময়ে, সঠিক পরিমাণে ও সঠিক পদ্ধতিতে সার ও সেচ দেয়া আবশ্যক। বিভিন্ন বয়সের আম গাছে সার প্রয়োগের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি ছক-১ এ দেখানো হলো।
বছরে দু’বার সার প্রয়োগ করতে হবে। বর্ষার শুরুতে একবার এবং বর্ষার শেষে আর একবার। একবারেও সব সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে ভাগ করে প্রয়োগ করলে বেশিলাভবান হওয়া যায়। মাটিতে প্রয়োজনীয় পানি/রসের অভাব হলে সার প্রয়োগের পর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ফিডার রম্নটগুলো গাছের গোড়া থেকে দূরে থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে গাছের বয়স অনুযায়ী এ দূরত্ব (মাঝামাঝি থেকে বড় গাছ) ১.৫-৩.০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে ছোট চারা গাছের ক্ষেত্রে ১৫-৩০ সেমি. হতে পারে। কাজেই যেখানে ফিডার রুটটগুলো থাকে সেখানেই সার দিতে হবে। দুভাবে সার দেয়া যায়। নালা পদ্ধতিতে গাছের গোড়া থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী ২-৩.০ মিটার দূরে ৩০ সেমি. প্রশস্ত ও ১৫-২০ সেমি. গভীর করে চক্রাকারে নালা তৈরি করে তাতে সার দিতে হবে। পরে মাটি দ্বারা ঢেকে দিতে হবে। অথবা দুপুর বেলা যে জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে সেই জায়গায় সার ছিটিয়ে কোদাল দ্বারা কুপিয়ে ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। কোদাল দ্বারা কুপানোর সময় সোজা না কুপিয়ে পার্শ্বভাবে কোপাতে হবে যাতে করে গাছের শিকড় না কাটে।
ঘ. বাগানে নিয়মিতভাবে সেচ দিতে হবে। জমিতে কখনই যেন রসের টান না পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, ফলন্ত আম গাছে দুইবার বেসিন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া প্রয়োজন। প্রথমবার প্যানিকল যখন ৬-৮ ইঞ্চি (১৫-২০ সেমি.) লম্বা হয় এবং দ্বিতীয়বার যখন ফল মটর দানার মতো হয়। এতে ফল এর আকার, মান ও ফলন ভালো হয়। প্রচণ্ড খরা দেখা দিলে এবং ফল ঝরার পরিমাণ বেশি হলে তখনও সেচ দিতে হবে। গাছে ফুল আসার কমপক্ষে ২-৩ মাস আগে সেচ দেয়া বন্ধ করতে হবে। কারণ এ সময় বাড ডিফারেনশিয়েশন হয়। ফলে গাছ অল্প পানির অভাব পছন্দ করে। কিন্তু যদি সেচ দেয়া হয় অথবা বৃষ্টি হয়ে যায় তাহলে গাছের ফুলের পরিবর্তে নতুন পাতা গজাবে বেশি করে কারণ বিটপে (Shoot) বিদ্যমান কার্বন ও নাইট্রোজেনের অনুপাত বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে গেলে নতুন পাতা গজাবে।
ঙ. সাধারণত আম গাছের ডাল ছাঁটাই প্রয়োজন হয় না। কারণ আমের মুকুল আসে ৪-৫ মাস বয়সের বিটপ এর মাথায়। তবে ছোট এবং বয়স্ক গাছের মৃত, শুকনা রোগাক্রান্ত শাখা ও কেবলমাত্র বয়স্ক গাছের পরজীবী উদ্ভিদ দ্বারা আক্রান্ত শাখা আম পাড়ার পর পরই ছাঁটাই করা দরকার। তাছাড়া গাছের ভেতরের অনেক সুস্থ ডাল থাকে যেগুলোতে ফুল ধরে না সেগুলো ছাঁটাই করা দরকার। ছাঁটাই এমনভাবে করতে হবে যেন গাছের ভেতরে প্রচুর পরিমাণে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে। কাটা ডালের মাথায় বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে যাতে করে রোগের আক্রমণ হতে না পারে। পেস্ট তৈরি জন্য তুঁত ২৫০ গ্রাম ও চুন ২৫০ গ্রাম নিয়ে এমনভাবে এক লিটার পানিতে মিশাতে হবে যাতে করে পেস্ট তৈরি হয়। এ পেস্ট তৈরির ১২ ঘণ্টার মধ্যে ব্রাশের মাধ্যমে ডালের কাটা অংশে প্রয়োগ করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে,ডাল ছাঁটাই এর আগে গাছ নিয়মিত এবং যথেষ্ট পরিমাণে গুণসম্পন্ন ফল দেয়। এতে প্রতি বছর ফল না আসার সমস্যা কিছুটা কমানো যায়।
চ. যে বছর গাছে প্রচুর ফুল আসে, সে বছর যদি গাছের অধের্ক ফুল ভেঙে দেয়া হয়,তাহলে গাছের সেই অংশ নতুন শাখা উৎপন্ন করবে। আগামী বছর সেই অংশে ফুল ও ফল উৎপন্ন করবে। এভাবে আম গাছ থেকে নিয়মিত ফলন পাওয়া যেতে পারে।
গাছের বয়স অনুযায়ী সারের পরিমাণ
সারের নামগাছেরবয়স(বছর)
২-৫৬-৯১০-২০২০ এর ঊর্ধ্বে
জৈবসার (কেজি)২০-৩০৩০-৪০৪০-৫০৪০-৫০
ইউরিয়া (গ্রাম)২৫০৫০০১০০০২০০০
টিএসপি (গ্রাম)২০০২৫০৫০০১০০০
এমপি (গ্রাম)১২৫২৫০৫০০১০০০
জিপসাম (গ্রাম)১০০২৫০৫০০৫০০
জিঙ্কসালফেট (গ্রাম)২৫২৫২৫২৫

আম সংক্রান্ত পোস্টসমূহ

পচন রোধে আম শোধন

No comments:

Post a Comment

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে শিবগঞ্জ উপজেলাবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

 বিসমিল্লাহর রাহমানির রাহিম ঈদ বয়ে আনুক সবার জীনবে সুখ শান্তি ও কল্যাণের বার্তা ঈদের দিনের মতো সুন্দর হোক প্রতিটি দিন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক...