07 February, 2019

শীত ও একটি ভালোবাসার গল্প

জীবনে এতখানি surprised  হব কখনও ভাবি নি............।

আমি ক্লারার সামনে দাড়িয়ে আছি.........! এই আট বছরে অনেকটাই অপরিবর্তিত আছে ও। মুখের সেই উজ্জ্বলতা......পরিপাটী সোনালি চুল......নীলাভ মায়াভরা দুটো চোখ......আর প্রচণ্ড ঠান্ডায় লাল হয়ে থাকা খাড়া নাক......

একগাল হেসে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, “কেমন আছ?”

কিছু বলতে পারি নি। হাসিটা কৃত্তিম ছিল কিনা বুঝি নি তবে ওর স্বাভাবিকতা আমাকে হতবম্ব করে দেয়। এতোগুলো বছর পর ওকে এইখানে দেখে ধাতস্ত হতে কিছুটা সময় নেই। ও বুঝে । তাই একটু পড়ে আবার জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছ রুদ্র?”

-“এইতো আছি। আর তুমি?”     কিছুটা স্বাভাবিক হই।

-আমিও আছি।

প্রায় ১৩ বছর আগের কথাগুলো মনে পড়ে যায়। মিনেসোটায় গিয়েছিলাম গ্র্যাজুয়েশন করতে। ক্লাসমেট হিসেবে পেয়েছিলাম ক্লারা মিশেল কে।

আমাদের প্রথম কথা হয় লাইব্রেরীতে। একই বইয়ে হাত পড়ে যায় আমাদের......।

আমাকে বলে জানো “একই বইয়ে হাত পরলে কি করতে হয়?” আমি বলি, “না”। “একসাথে নোট করতে হয়” -ও ঠোট চাপা হাসি হেসে বলে। এরপর থেকে আমরা একসাথে নোট করতে বসি কিন্তু ও কিছুই করে না। আমিই সব করি আর ও একটু পরপর ফিসফিস করে কথা বলে যেত। আমার যে খুব একটা খারাপ লাগত তা না......বরং পাশে একজন শ্বেত সুন্দরীর উপস্থিতি আমাকে রোমাঞ্চিত করত। ওর বকবকানির গণ্ডি লাইব্রেরী পেরিয়ে চলে যায় মাঠে। আমরা ক্লাস শেষে বা off hour এ মাঠে বসে গল্প করতাম। ওর ঠাশ ঠাশ করে বলা ইংরেজির কিছু কিছু যখন না বুঝে হাবার মত ওর দিকে চেয়ে থাকতাম কিংবা যখন বিদঘুটে টাইপের দু একটা বাংলা শব্দ বলতাম তখন ও হেসে কুটিকুটি হয়ে যেত......।

সে হাসি যে সে হাসি না.........যেকোনো ছেলেকে ভেতর থেকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় সেই হাসি। আমাদের বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে।

 holiday গুলোতে আমরা প্রায়ই চলে যেতাম মিনেসোটার ভিতরে কোনো গ্রামে, মাঝে মাঝে চলে যেতাম প্রধান শহরে.........।

সারা দিন ঘুরে সন্ধ্যার দিকে ফিরতাম ডরমিটরিতে।



প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় যখন বের হওয়াও মুশকিল ছিল তখনও নিজের চেয়ে বেশী ওজনের কাপড় পড়ে বের হতাম, শুধু ওর জন্য.........। কারণ ও বরফ খুব ভালবাসে। বাচ্চাদের মতো বরফ নিয়ে খেলত ও। আমি ঠাণ্ডা লাগিয়ে রুমে ফিরতাম আর ও সন্ধ্যায় ফ্লাস্ক ভর্তি গরম সুপ নিয়ে চলে আসত ডরমের নিচে.........।   ওর প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম অনেক আগেই, কিন্তু নিজের conservative family background’ র কথা চিন্তা করে মনটাকে আটকে রেখেছিলাম। কিন্তু মন নিয়ন্ত্রনে মনুষ্য জাতি বড়ই কাচা......তাই শেষ রক্ষা হয় নি।

এরকমই এক বরফ পড়া দিনে যখন ওর জন্য বের হই...........ঠান্ডায় জবুথবু আমার দিকে ও একদৃস্টিতে তাকিয়ে থাকে...... কিছুক্ষণপর আমাকে হতবম্ব করে দিয়ে বলে, “রুদ্র, তুমি বোঝ না যে তুমি আমাকে ভালবাস?” আমি কিছু বলি না............চুপ থাকি।

“তাহলে কিছু বলোনা কেন?”-বলেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরে......।

কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে, “I love you” আমিও এতদিনের জমে থাকা সকল অনুভুতিগুলোকে একত্র করে কাঙ্গালের মত বলে উঠি, “আমিও তোমাকে ভালবাসি।’’



 আমদের প্রথম চুম্বন হয়...।



 এরপরের দিনগুলো সম্ভবত আমাদের জীবনের সেরা দিন ছিল।



 Graduation এর শেষ দিকে হঠাৎ বাংলাদেশে থেকে খবর পাই যে বাবাকে hospitalize করা হয়েছে। দেশে যাই। বাবা আমাকে oxygen mask এর ভেতর থেকেই জিজ্ঞেস করে, “বাবা, ওখানে আবার কোন বিদেশীনির প্রেমে পড়িস নি তো?”  আমি মিথ্যা হাসি হাসি...। কারন বুঝতে পেরেছিলাম যে তখন ক্লারার কথা বললে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে। বাবা তার শেষ বেলায় তার একমাত্র পুত্রের বউ দেখে যেতে চান......।

আমার মাথায় যেন বাজ পড়ে......।

কথায় আছে না, life is stranger than fiction. তাই টের পেলাম। “উঠ ছেড়া তোর বিয়ে” এর মতো আমারও এক রাতেই বিয়ে হয়ে গেল। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে সব কিছু ঘটে যায়।



এরপর ফাইনালের পরীক্ষার জন্য USA ফিরি তবে ক্লারাকে কিছু জানাইনি।



আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়। আমি ক্লারাকে বলে ফেলি সব। ক্ষমা চাই ওর কাছে। খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন যে ও খুব শান্ত ছিল তখন। শুধু একভাবে তাকিয়ে শুনছিল আমার কথাগুলো। যেন এরকম কিছু শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল ও। একটা বারও প্রতিবাদ করে নি। অভিমান করে নি। জানি না কেন করেনি, হয়ত প্রচন্ড অভিমানী বলে কিংবা ঘটনার আকস্মিকতায় প্রচন্ড shocked  হয়ে। ভেবেছিলাম আমাকে চিট ভাববে; খুব কাদবে কিন্তু কাদে নি।

এর পর ক্লারা ওর মা’র কাছে বোস্টনে চলে যায়।



বাংলাদেশে ইউরোপিয়ান এক কোম্পানীতে খুব বড় পোস্টে চাকরি করছি এখন। অফিস থেকে জানাল যে International Telecommunication Seminar এর জন্য আমাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ডেনমার্কে যেতে হবে । বউ-বাচ্চা নিয়ে কখনও কোথাও যেতে পারি না তাই ওদের নিয়েই ডেনমার্ক চলে আসি...। Conference শেষ তাই দেশের সবার জন্য কিছু গিফট আর চকলেট কিনতে একটা সুপার শপে ঢুকি আর তখনি দেখা ক্লারার সাথে।



ক্লারার কথায় তন্দ্রা ভাঙ্গে আমার......।

-ডেনমার্কে কি করছ?

-একটা সেমিনারে এসেছিলাম।

-আর তুমি এখানে যে?

-এখন এখানেই আছি.........ভালো Job offer পেয়েছিলাম তাই চলে এসেছি।

-USA ছেড়েছো কবে?

-প্রায় ৫ বছর......

হঠাৎ কি যেন হল, জিজ্ঞেস করে বসলাম, “বিয়ে করেছ?”

-নাহ..................তোমার গিফটেই এত ভালবাসা আছে যে আর কাওকে ভালবাসতে পারিনি.....।

বলেই গেমবয় খেলায় বুদ এক ছয়/সাত বছর বয়সী ছেলেকে কাছে টেনে নিল......

হতবাক হয়ে দেখতে লাগলাম গেম খেলায় ব্যস্ত ছেলেটাকে.....................ওর মুখে আমার মুখাবয়ব খুজতে থাকলাম যেন.........পেলাম তার চেয়েও বেশীকিছু...।

এ যে আমারই কার্বন কপি......!!  গায়ের রঙ  ক্লারার মত হলেও...... চোখ,নাক সবই তো আমার মতো ! তবে মা’র মত ওর চেহারায় একটা আভিজাত্য রয়েছে.....।



আট বছর আগে যখন বাংলাদেশে ফিরে আসব তার সাত দিন আগে ক্লারার সাথে আমার শেষ দেখা হয়। ও সেদিন আমাকে বলেছিল, “চলে যাবার আগে আমাকে একটা উপহার দেবে...............?”

আমি সেদিন ওকে না করতে পারি নি। ঐদিনও যদি ক্লারা একবারের জন্যও আমাকে সবকিছু ছেড়েছুড়ে  ওর কাছে থেকে যেতে বলতো তাহলে হয়ত তাই করতাম।



-ওকে ছুয়ে দেখবেনা একটু......?

ক্লারার কথায় আবার আমার চিন্তায় ছেদ পড়ল।

-আমি ছেলেটার মাথায় হাত বুলাই কিন্তু একটু বিরক্ত হয় বলে মনে হয়.........আমি হাত সরিয়ে নেই।

ক্লারা একটু নিচু হয়ে ওকে বলে, “baby, remember……… I told u about an angel…….it’s him…….!!”

এবার ও একটু মাথা তুলে আমার দিকে তাকায়.........আর ক্লারার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “he’s not an angel……..He looks like a man……” বলেই আবার গেমসে মনোযোগ দেয়। কথাটা শুনে আমার হাসি পায়।

 ক্লারাও হাল ছেড়ে দেয়।

“কি নাম রেখেছ?’’  জিজ্ঞেস করি।

-আমরা যেটা ঠিক করেছিলাম।

-রাইয়ান...??

-হ্যা......তবে এখানে সবাই ওকে রায়ান বলেই ডাকে।



 এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা........আমি বলি, “যখন যোগাযোগ করতে চেয়েছি তখন response কর নি কেন?”

-তুমি অযথা কষ্ট পাবে বলে.........



-জিজ্ঞেস করলে না আমার জীবন কেমন চলছে? -ওকে বললাম।

-সুন্দরী স্ত্রী আর দুটো সন্তান নিয়ে ভালই তো আছো......

অবাক হয়ে বললাম, এত খবর রাখ??

নির্জীব হাসি হাসল। “তবে এখন আর খবর রাখি না........ইচ্ছে করে না।”

খুব ঠান্ডা স্বরের একটা উত্তর পেলাম।



ভাবলাম আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না...............।। আজ রাতেই বাংলাদেশের flight...... রাত বাড়ছে, হোটেলে ওরা একা, ফিরতে হবে........।

যাবার আগে জীবনের প্রথম নারীটাকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু সেই অধিকারের অস্তিত্ব কতটুকুই বা অবশিষ্ট আছে সেই ব্যাপারে আমি সন্দিহান।

 কিছুই কেনা হল না। বের হওয়ার আগে শুধু বললাম, “কিছু বলবে?”

-না......।

শুভ কামনা.........ভাল থেকো......।

গলার কাছে কিছু কথা এসে আটকে যায়......।

তাই কিছু আর বলতে পারিনা । ছেলেটার মাথায় আর একবার হাত বুলিয়ে বেরিয়ে যাই। খুব দুর্বল মানুষ আমি তাই একবারও পেছন ফিরে তাকাতে সাহস পাই না........।

বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা......জোর কদমে হেটে যাচ্ছি............ ক্লারার অভিমানী ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ঠান্ডাটা যেন আরো বেশী লাগছে............ হিম শীতল মনটা কেমন যেন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। সহ্য করতে পারছি না । কিন্তু ক্লারা !! এত শক্তি কোথা থেকে পায় মেয়েটা.........!!

No comments:

Post a Comment

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে শিবগঞ্জ উপজেলাবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

 বিসমিল্লাহর রাহমানির রাহিম ঈদ বয়ে আনুক সবার জীনবে সুখ শান্তি ও কল্যাণের বার্তা ঈদের দিনের মতো সুন্দর হোক প্রতিটি দিন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক...