লিচুগাছে প্রচুর ফুল আসার পরও নানা কারণে ফুলের দুই ভাগ ঝরে যায়। ফুল আসা, ফুল টিকে থাকা এবং ফুলের স্বাস্থ্য বহুলাংশে সার ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে। সার ব্যবস্থাপনাঃ গাছের গোড়ায় ফেব্রুয়ারিতে একবার, মে মাসে আরেকবার এবং আগষ্ট মাসে আরেক বার সার দিলে লিচুর ফুল ও ফল ধারণক্ষমতা বাড়ে। হরমোন প্রয়োগঃ হরমোন প্রয়োগের ফলে ফুলঝরা বন্ধ হয়। সেচ দিলে ফল হয় স্বাস্থ্যবান। স্বাদ হয় কাঙিক্ষত। লিচুর ভালো ফলন পাওয়ার কৌশলগুলো নিচে দেওয়া হল: সার ব্যবস্থাপনাঃ গাছের গোড়ায় কোদাল দিয়ে কুপিয়ে সার ছিটিয়ে দিতে হবে। সার ছিটানোর পরে সেচ দিলে সারের কার্যকারিতা বাড়ে। গাছের বয়স যত বেশি সারের পরিমান তত বেশি হয় দুপুরে গাছের ছায়া যতটুকু স্থান দখল করে নেয় ঠিক ততটুকু জায়গা কোদাল দিয়ে কুপিয়ে গাছের বয়স সাত থেকে দশ বছর হলে গাছ প্রতি পয়তাল্লিশ কেজি গোবর, সাড়ে সাত শ’ গ্রাম ইউরিয়া, এমপি পাচঁ শ’ গ্রাম, টিএসপি সাত শ’ গ্রাম ছিটিয়ে দিতে হবে।গাছের বয়স দশ বছরের ওপর হলে পচা গোবর ষাট কেজি, এক কেজি পাচঁ শ’ গ্রাম করে ইউরিয়া এবং টিএসপি এবং এক কেজি এমপি সার দিতে হয়। পাতার রঙ তামার মতো হলে একশ’ লিটার পানির সঙ্গে এক কেজি জিস্ক সালফেট (জিপসাম) ও পাচঁশ’ গ্রাম চুন মিশিয়ে গাছে ফুল আসার সময় স্প্রে করে দিতে হবে। ফলঝরা রোধে হরমোনঃ ফল ঝরা রোধ করতে নিয়মিত সেচ ও সঠিক মাত্রায় সার দেওয়ার পরও হরমোনের অভাবে এলেও তা ঝরে যেতে পারে। ফুলঝরা বন্ধ করতে প্লানোফিক্স নামের হরমোনেটির এক মিলি পাচঁ লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে দুই থেকে তিনবার।রোগঃ কখনো কখনো পাউডারি মিলডিউ রোগের কারণে ফুলের গোছায় সাদা সাদা পাউডারের মতো ছত্রাকের আবরণ পড়ে। এতে ফুল ও ফল ঝরে পড়ে। অ্যানথ্রকনোজ রোগে মাঝেমধ্যে ফুল ও ফল বাদামি বর্ণের হয়ে ঝরে পড়ে। অ্যানথ্রকনোজ দমনে ডায়থেন এম ৪৫ এবং পাউডারি মিলডিউ রোগ দমনের জন্য থিওভিট ওষুধের দুই গ্রাম আলাদা করে দশ লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে দশ দিন পরপর দুই থেকে তিনবার স্প্রে করে দিতে হবে। পোকাঃ খুব ছোট ও সাদা সাদা লিচুর মাইট বা মাকড় লিচুর ক্ষতি করে। এই মাকড়গুলো পাতার নিচের সবুজ অংশ খেয়ে বাদামি রঙের ভেলভেট তৈরি করে। আক্রান্ত গাছের পাতায় মেটাসিসটক্স দুই গ্রাম দশ লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করলেই মাইটকে দমন করা যায়।
লিচুর ফলন ও মান বৃদ্ধিতে করণীয়
জ্যৈষ্ঠের অন্যতম রসালো ফল লিচু। ছোট বড় সবার প্রিয় অন্যতম ফল এই লিচুর মৌসুম অল্প সময়ব্যাপী। তবে এর পরিচর্যা এবং যত্নের সময়সীমা বেশ বড়। আকর্ষণীয় বঙ আকার আর রোগমুক্ত লিচু ফল পেতে এর প্রতি যত্নবান হওয়ার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে। লিচুর এই পরিচর্যা এবং যত্নকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিতে পারি। এগুলোকে মূলত সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা এবং রোগ-বালাই দমন ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষিতে আলোচনা করা যেতে পারে।
লিচুর বিভিন্ন উন্নত জাত রয়েছে। এর মধ্যে বারি উদ্ভাবিত চারটি জাত বারি-১, বারি-২, বারি-৩ ও বারি-৪। এছাড়াও রয়েছে চায়না-৩, মোজাফফরপুরী, বেদানা, ঈশ্বরদী ইত্যাদি জাতের লিচু। লিচুর চারা মূলত মধ্য মে-মধ্য জুলাই পর্যন্ত রোপণের সময়। এর চারা ১০ী৮ মিটার দূরত্বে রোপণ করা হয়। এই হিসেবে লিচুতে একরপ্রতি ৪০টি চারা প্রয়োজন হয়। পিট আকারে গর্ত করার জন্য ১ মিx১ মি. আকারে গর্ত করে নিতে হয়।
সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতিলিচুর জন্য গর্ত প্রতি ১৮-২০ কেজি কম্পোস্ট/ গোবর সার এবং সেই সঙ্গে খৈল ২-২.৫ কেজি ইউরিয়া, ২-২.৫ কেজি ৪৫০-৫৫০ গ্রাম টিএসপি, ২০০-৩০০ গ্রাম এমওপি ও জিপসাম এবং ৪০-৬০ গ্রাম জিংক সালফেট প্রয়োগ করে ১৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হয়। এরপর প্রতি বছর ১০ বছর পর্যন্ত প্রতি গাছে গোবর ৬ কেজি, ইউরিয়া ৩০০ গ্রাম, টিএসপি ২৫০ গ্রাম, এমওপি ১৫০ গ্রাম ও জিপসাম ১৫০ গ্রাম করে দিতে হবে। ১০ বছর পর পঁচা গোবর ৫০ কেজি, খৈল ২ কেজি, ইউরিয়া ২ কেজি, টিএসপি ১ কেজি, এমওপি ৫০০ গ্রাম ও জিপসাম ৫০০ গ্রাম করে দিতে হবে। লিচু গাছ অর্থাৎ যে কোন ফল গাছেই সার প্রয়োগের সময় হলো ফল সংগ্রহের পরপরই প্রথমবার এবং ৪-৫ মাস পর আরেকবার। লিচুতে মে-জুন মাসে ফল সংগ্রহের পরপরই একবার এবং বর্ষার শেষে আশ্বিনের শুরুতে দ্বিতীয়বার সার প্রয়োগ করতে হয়। সার গাছের গোড়া থেকে ছায়ার দূরত্বে গর্ত করে প্রয়োগ করতে হয়।
সেচ ব্যবস্থাপনা
লিচু বাগানে ফারো বেসিন বা মুক্ত প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করা যায়। গাছের গোড়া থেকে দুপুর রোদে চারদিকে যে ছায়া পড়ে বা বাইরের দিকে গাছের ডালের যে বিস্তার সে বরাবর একটি আইল দিতে হয়। এরপর গাছের গোড়া থেকে আইল পর্যন্ত অংশটিকে দুভাগে ভাগ করে মাঝ বরাবর আরেকটি আইল দিয়ে মধ্যবর্তী স্থানে বেসিনের মতো করে সেচ দেয়া হয়। দু-সারি গাছের মাঝ বরাবর নালা তৈরি করে প্রতি গাছের বেসিনে সেচ দেয়া যেতে পারে। এছাড়া সমতল জমিতে সম্পূর্ণ বাগানে মুক্ত প্লাবন পদ্ধতিতে সেচ দেয়া যেতে পারে। শীতকালে ১০-১২ দিন এবং গ্রীষ্মকালে ৭-১০ দিন পরপর মাঝারি সেচ দেয়া যেতে পারে। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগের আক্রমণ ও এর প্রতিকার
এনথ্রাকনোজ : লিচুর কচি পাতার প্রথমে ধূসর কালো ফোটা ফোটা ফুসকুড়ির মতো দাগ দেখা যায়। দাগগুলো এক হয়ে বড় হয় এবং কালো হয়ে পোড়া পোড়া মনে হয়। আক্রান্ত স্থান কুঁকড়িয়ে যায়। ফুল ফল ধরা অবস্থায় আক্রমণ হলে ফুল ও কচি ফল ঝরে যায়। এই লক্ষণ হলো এনথ্রাকনোজের কারণে যা ছত্রাকজনিত একটি রোগ। এক্ষেত্রে আক্রান্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। প্রপিকোনাজল জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়।
পাউডারি মিলভিউ
লিচুর মুকুলে সাদা বা ধূসর রঙের পাউডারের আবরণ দেখা যায়। মুকুল নষ্ট হয়ে ঝড়ে পড়ে। পাতাও হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে।এক্ষেত্রেও মুকুল আসার পর তবে ফুল ফোটার আগে প্রোপিকোনাজল জাতীয় ছত্রাকনাশক ০.৫ মিলি হারে বা সালফার প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
কীটপতঙ্গের আক্রমণ ব্যবস্থাপনা
লিচুর মাজরা পোকা
পরিপক্ব অবস্থার বোঁটার দিকে খয়েরি রঙের গুঁড়া গুঁড়া দেখা যায়, পাকা লিচুর বীজ ছিদ্র অবস্থায় পাওয়া যায়। খোশা ছড়ালে শাঁষ কিছুটা নষ্ট বা পচা দেখা যায় এবং ফলের ওপর কোন কোন জায়গায় ছিদ্র দেখা যায়। গাছের ডালে গুঁড়ি গুঁড়ি মালার মতো দেখা যায়। হাত দিলে ডালের ওপর থেকে সেটি সরে আসে এবং নিচে ডালের মধ্যে ছিদ্র দেখা যায়। এটি মাজরা পোকার আক্রমণের লক্ষণ।
লিচুর ফল গুটি হওয়ার পর বা ফুল ফোটার ২০-২২ দিন পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার করে ডায়াজিনন/ভেলটামেথ্রিন, সাইপারমেথ্রিন প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
লিচুর মাকড়
নিচের পাতা মেরুন/বাদামি রঙের হয়ে কোন কোন অংশ কোকড়ানো হয়। পরবর্তীতে পাতা দুর্বল হয়ে মরে যায় এবং ডালে ফুল, ফল ও পাতা হয় না। আক্রান্ত ফুলে ফল হয় না।
আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পলিথিনে মুড়িয়ে কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লি. পানিতে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার অথবা মাকড়নাশক স্প্রে করে দিতে হয়।
অন্যান্য পরিচর্যা
লিচু গাছের ফলের ক্ষেত্রে কিছু অন্যান্য সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। এসবের কিছু বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হলো
০ আবহাওয়া অত্যন্ত গরম বা খরার পর ঘন বৃষ্টি হয়েছে এর ফলে লিচু ফেটে যাচ্ছে এবং ফোসকা পড়ছে।
– বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ফুল ও ফলের গোড়ার খুব দ্রুত নির্মোচন স্তর তৈরি হয় এবং এগুলো ঝরে পড়ে। এছাড়াও দিনে ও রাতের বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা কম বেশি হলে লিচু ফেটে যায়। মাটির রস বেশি হলে বা হঠাৎ বেশি বৃষ্টি হলে লিচু ফেটে যায়। এছাড়াও ফলের ভেতরের রসের অবস্থা ও বাইরের শুকনো অবস্থার মধ্যে সাম্যতা না থাকলে ফল ফেটে যায় এবং ত্বকে ফোসকা পড়ে।
এজন্য ফল ধারণের সময় থেকে মাটির রস যেন কমে না যায় সেদিকে লক্ষ রেখে হালকা সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। দিনের বেলা কোন সেচ দেয়া ঠিক নয়। রাতে যখন বাতাস কিছুটা ঠা-া হয় তখন স্প্রে আকারে পানি ছিটালে কিছুটা ভালো ফল পাওয়া যায়।
০ লিচুর গুটি বাঁধার পর ফল ঝরে যাওয়া
– বিভিন্ন কারণে এ সমস্যাটি দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হলো-
০ বাতাসের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ও আর্দ্রতা কমে যাওয়া। এজন্য রাতের বেলা স্প্রে করে পানি দেয়া যেতে পারে।
০ মাটিতে পানি বা রসের অভাব হলে।
০ ফল ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি ফল ধরলে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক।
০ সুষম সার প্রয়োগ না করলে বা পুষ্টি অভাবে।
০ এনথ্রাকনোজ রোগের সংক্রামণে।
০ মাকড়ের আক্রমণ হলে।
লিচু রসালো একটি আকর্ষণীয় ফল। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে এর ফলন পাওয়া যায়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে একবার ভালো ফল পাওয়ার পর পরের বার ফলন কম আসতে দেখা যায় বা কিছু সমস্যা দেখা যায়। এক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সমস্যা দূর করা যায়। প্রতি বছরই যেন কাক্সিক্ষত মাত্রায় লিচুর ভালো ফলন পাওয়া যায় সেজন্য কিছু করণীয়-
গাছ থেকে ফল পাড়ার পর পরই বা ফল পাড়ার সময় সাধারণত লিচুসহ চিকন ডাল ভাঙা হয়। এতে গাছ ছাঁটাইয়ের কাজ হয়। তবে এরপরও যদি কোথাও ঘন ডাল থেকে যায় সেগুলোও হালকা করে ছাঁটাই করতে হয়।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, কখনই আঙুলের চেয়ে মোটা ডাল ছাঁটাই করা যাবে না। ছাঁটাইয়ের কাজ ফল সংগ্রহের পর মে-জুন মাসের মধ্যেই শেষ করতে হবে। বছরে দুবার নির্ধারিত পরিমাণ সার গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হয়। বাগান বা লিচু গাছের গোড়ায় শুকনো মৌসুমে মাটির রস যেন স্বাভাাবিক থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্থা করতে হয়।
No comments:
Post a Comment