(সংকেত: উপক্রমণিকা; সততা ও সত্যবাদিতা, সততা ও সত্যবাদিতার বৈশিষ্ট্য; আমাদের দেশে সততা ও সত্যবাদিতার অবস্থা; সততা ও সত্যবাদিতার সাধনা; মানবজীবনে সততা ও সত্যবাদিতার আবশ্যকতা; ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সততা ও সত্যবাদিতার গুরুত্ব; অসততা ও অসত্যবাদীতার পরিণাম; সততা ও সত্যবাদিতার উপায়; সততা ও সত্যবাদিতার দৃষ্টান্ত; যবণিকা।)
উপক্রমণিকা:
বিস্মৃতির তলে,
নাহি মরে উপেক্ষায়, অপমানে না হয় অস্থির
আঘাতে না টলে।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সততা ও সত্যবাদিতা: সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকাই হলো সততা আর সত্যের আলোকে পরিচালিত মানব গুণই সত্যবাদিতা। মানব জীবনের সকল সদগুণই সততা ও সত্যবাদিতার অন্তর্ভুক্ত। দৃঢ় চিত্তে, সাহসের সঙ্গে সত্যের পথ অবলম্বন করলে শাশ্বত কল্যাণ লাভ করা যায়।
সততা ও সত্যবাদিতার বৈশিষ্ট্য: কোনো কিছুর হুবহু প্রকাশ করা হলো সত্য অর্থাৎ কোনো কিছু গোপন না করে, মিথ্যা বা কল্পনার আশ্রয় না নিয়ে সম্পূর্ণভাবে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করা হলো সত্য। আর সত্যের পথে পরিচালিত, সত্যকে প্রায়োগিক জীবনে প্রতিফলন ঘটিয়ে জীবনযাপন করা হলো সততা। সৎ পথে থেকে সত্যের পথ অবলম্বন করে সত্য প্রকাশ হলো সত্যবাদিতা। সততা ও সত্যবাদিতা মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ। সৎ ও সত্যবাদী ব্যক্তি কখনো মিথ্যা বলে না, কোনো কিছু গোপন করে না। মানুষের মধ্যে কুৎসা রটায় না। ন্যায় ও নীতির পথ অবলম্বন করে। অন্যায় কাজ করে না এবং অন্যায় কাজের সাথে আপোস করে না।
আমাদের দেশে সততা ও সত্যবাদিতার অবস্থা:আমাদের দেশে সততা ও সত্যবাদিতার অবস্থা খুবই নাজুক। এদেশে দুর্নীতি জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে দুর্নীতির কালো থাবা আঘাত হানেনি। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, গুম-হত্যা, রাহাজানি বর্তমানে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। সৎ পথে উপার্জনের চেয়ে অসৎ পথে উপার্জনের দিকে জাতি বেশি ঝুকে পড়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতা চলছে। সততা সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলেও আমাদের মানবিক মূল্যবোধ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সত্যের পথ ছেড়ে আমরা অন্ধকারের পথে হাঁটছি।
সততা ও সত্যবাদিতার সাধনা: সততা ও সত্যবাদিতার জন্য সাধনার প্রয়োজন। মিথ্যার বেড়াজাল ভেদ করে সত্যকে অবলম্বন করতে কঠোর সাধনা করতে হয়। পৃথিবীতে কোনো সত্য আপনা-আপনি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ করে, অসৎ পথ এড়িয়ে সৎ পথে চলতে সাধনা করতে হয়। সত্যের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। মাওলানা আকরাম খাঁ বলেন- ‘পৃথিবীতে যখন কোনো সত্য আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছে তখনই তাহার বিরুদ্ধাচরণ হইয়াছে, এই বিরুদ্ধাচরণের ধারা ও নীতি মূলতঃ সকল ক্ষেত্রেই অভিন্ন।’
মানবজীবনে সততা ও সত্যবাদিতার আবশ্যকতা:সততা ও সত্যবাদিতা মানুষকে সুন্দর, সঠিক ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। আর যদি এ মহৎ গুণটি না থাকে তবে মানুষ হিংস্র হয়ে উঠে, তার ভিতরে পাপবোধ কাজ করে না। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে এ সব মানুষ অন্যায় কাজ করে সমাজ কলুষিত করে। মানবতা বলতে তাদের মধ্যে কিছুই থাকে না। জীবনে সফলতা লাভ করতে হলে সততা ও সত্যবাদীতার পথ অনুসরণ করতে হয়। ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র বলেন- ‘সত্যকে আশ্রয় করো আর অসত্যের অনুগমন করো না, শান্তি তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে যাবে না।’ সত্য ও সততা থাকলে মানুষের মধ্যে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি থাকবে না। কেউ দুর্নীতি করবে না, ঘুষ নিবে না, অবৈধ উপায়ে উপার্জনের চেষ্টা করবে না। সবাই সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারবে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সততা ও সত্যবাদিতার গুরুত্ব:প্রত্যেক ধর্মেই সত্যের পথ অবলম্বন করতে আর সৎ উপায়ে উপার্জন করতে বলা হয়েছে। যাবতীয় কলুষতা দূর করে নিষ্কলঙ্ক জীবনযাপন করতে প্রত্যেক ধর্মই সততা ও সত্যবাদিতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম ধর্মেও এ গুণটির সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহম্মদ (স.) বলেন- ‘সত্যবাদিতা সুকর্মের পথ দেখায় আর সুকর্ম বেহেস্তের পথ দেখায়।’
অসততা ও অসত্যবাদীতার পরিণাম: সততা ও সত্যবাদিতা ছাড়া মানুষের কোনো গুণই বিকশিত হতে পারে না। সত্য যখন অসত্যের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে তখন মানুষের মানবিক মূল্যবোধ হ্রাস পায়। তখন সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। মানুষ স্বার্থপর ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বলে কোনো বোধ থাকে না। সততা ও সত্যবাদিতা তাদের বিবেককে নাড়া দিতে পারে না। মানুষ যখন সত্যের আলো থেকে দূরে সরে যায়, তখন জাতির জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। জাতি ক্রমে ক্রমে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন-
সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি।’
সততা ও সত্যবাদিতার উপায়: শিশুকাল থেকে শিশুদেরকে সততা ও সত্যবাদিতার শিক্ষা দিতে হবে। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের এ গুণটির আদর্শকে ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করতে হবে। আর আমাদের ব্যক্তি জীবনের প্রাত্যহিক কাজকর্মে এর প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সৎ ও সত্যবাদী জীবনকে আদর্শ জীবনরূপে গ্রহণ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারলেই জীবনের সার্থকতা বাড়ে।
সততা ও সত্যবাদিতার দৃষ্টান্ত: যুগে যুগে মহা মনীষীরা সত্য ও সত্যবাদিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁরা সত্যকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে জীবনকে মহিমান্বিত করেছেন। তাঁরা সমাজে সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সাধনা করেছেন। হযরত মুহম্মদ (স.) সারাজীবন সত্যের পথে ছিলেন এবং সত্য প্রচার করেছেন। সত্যের মাধ্যমে তিনি মানুষের মন জয় করেছিলেন। মনীষীরা তাঁদের কাজ-কর্মে সত্যবাদিতার পরিচয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রহ.) এর সত্যবাদিতার কাহিনী চমকপ্রদ।
যবণিকা: সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। সত্য কখনো চাপা থাকে না। সত্য সকল প্রতিকূলতাকে জয় করে তার স্বরূপে ফিরে আসবে। সততা ও সত্যবাদিতা হবে সকল অন্যায়-অত্যাচার, খারাপ কাজের বিরুদ্ধে হাতিয়ার। সততা ও সত্যবাদিতার আলোকে সমাজকে আলোকিত করতে হবে। সত্যের সাথে কোনো অন্যায়, অসৎ কাজ জয়ী হতে পারেনা। শেকস্পিয়ার বলেছেন- ‘সততার নিকট দুর্নীতি কোনো দিনই জয়ী হতে পারে না।’