04 January, 2019

সাবলম্বনের মূল্য,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; আত্মশক্তির সাবলম্বন; সাবলম্বনের চাবিকাঠি; সাবলম্বনের বৈশিষ্ট্য ও অনুশীলন; কর্মই মানুষের সৌভাগ্যের কারিগর; মনুষ্যত্ব বিকাশে আত্মশক্তি; সাবলম্বনের পথে বাধা; সাবলম্বন ও স্মরণীয় বরণীয় মানুষ; ছাত্রজীবনে সাবলম্বন; বৃহত্তর ক্ষেত্রে সাবলম্বন; উপসংহার।)
ভূমিকা: মানব জীবন সম্ভাবনাময় এক অনন্ত শক্তির উৎস। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই লুকায়িত আছে দুর্বার এক প্রাণশক্তি। এই মহৎ প্রাণ শক্তির আলোকে মানুষ তার নিজের জীবনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি তারা দেশ ও জাতির কল্যাণে মহান ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মহৎ প্রাণশক্তির উপলব্ধিটাই তার উন্নতির মূলমন্ত্র হিসাবে কাজ করে। অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে আপন মেধা, শ্রম, বুদ্ধি, শক্তি প্রভৃতির সহায়তায় নিজের জীবন গঠনের চেষ্টাই হলো সাবলম্বন। এই বিশ্বপ্রকৃতির চারদিকে দৃষ্টিপাত করলে যে রহস্যটির সন্ধান পাওয়া যায় তাই সাবলম্বন।
আত্মশক্তিরূপে সাবলম্বন: সাবলম্বনের জন্য নিজের আত্মশক্তিই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আপন শক্তির বলেই সে সমাজের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সৃষ্টির সব কিছুই নিজস্ব গতিতে চলছে। কোনো কিছুই অন্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। কর্মের মাধ্যমেই মানুষ তার জীবনকে মনের মতো করে গড়তে পারে। যারা অদম্য ইচ্ছায় বলীয়ান তাদের কাছে কর্ম সৌভাগ্য দেবতার মতো। তারা কখনো অন্যের আশায় বসে থাকে না। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা চলরে।’
সাবলম্বনের চাবিকাঠি: মানবজীবনে সাফল্যের অন্যতম মূলমন্ত্র হলো আত্মনির্ভরশীলতা। এটা ছাড়া জীবনে উন্নতি করা অসম্ভব। পৃথিবীতে যারা সাফল্য অর্জন করেছেন তারা সবাই আত্মনির্ভরশীলতার বলেই করেছেন। যারা নিজের ওপর কোনো আত্মবিশ্বাস রাখতে পারে না তারা হতভাগ্য, তাদের জীবনে সাফল্য অর্জন খুবই দূরূহ ব্যাপার। পৃথিবীতে যারা সাবলম্বী অর্থাৎ আত্মনির্ভরশীল তারা উন্নতির চরম শিখরে আরোহন করতে পারে।
সাবলম্বনের বৈশিষ্ট্য ও অনুশীলন: সাবলম্বন বা আত্মনির্ভরশীলতা একটি মহৎ গুণ। যা অর্জন করতে হলে ব্যক্তি জীবনে অনেক গুণাবলির প্রয়োজন। কথায় বলে, যে শুয়ে থাকে তার ভাগ্যও শুয়ে থাকে। পরিশ্রম ছাড়া সাবলম্বী হওয়ার অন্য কোনো উপায় নেই। আর একই সঙ্গে সংযোগ ঘটবে উদ্যোগ, উদ্যম, আগ্রহ, নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, শিষ্টাচার, সততা প্রভৃতির। আর সাবলম্বী হওয়ার জন্য প্রত্যেক মানুষকে এসব গুণাবলি অনুশীলন করতে হবে। তাই মনে রাখতে হবে- - God help those who help themselves.
কর্মই মানুষের সৌভাগ্যের কারিগর: প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই নিহিত আছে প্রাণশক্তির স্ফুলিঙ্গ। উপযুক্ত পরিবেশের আলোকেই এসব দুর্বার প্রাণশক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটে। কর্মের প্রতি অনুরাগ ও আত্মশক্তির আলোকশিখায় উদ্ভাসিত হয় তার অন্তর্লোক। আর তখনেই মানুষ খুঁজে পায় জীবনের অর্থ। তারপর সে প্রবেশ করে সফলতার জগতে। তখন সে আর অন্যের ওপর নির্ভর করে না। জাগ্রত চেতনার আলোকে দীপ্ত, দুর্জয় আত্মশক্তির মূর্ত প্রতীক হিসেবে সবার কাছে গৃহীত হয়। তার মধ্যে যে কর্মবিমূখতার মোহাবরণ আচ্ছন্ন তা ক্রমে ক্রমে ছিন্ন হয়ে যায়। প্রবাদ আছে- ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি।’ কর্মময় পৃথিবীতে মানুষকে পরিশ্রম করেই সাফল্য অর্জন করতে হবে। আর যে মনুষ কর্মবিমুখ সে ভাগ্যের হাতে জীবনকে সপে দিয়ে বাঁচার ঠিকানা খুঁজে। ফলে তার জীবনে দুঃখের কালো আঁধার আরো বেশি প্রশস্ত হতে থাকে।
মনুষ্যত্ব বিকাশে আত্মশক্তি: আত্মশক্তিই অনন্ত সম্ভাবনায় ভরা ব্যক্তির কর্মমুখর জীবনে নিয়ে আসে সাফল্য। সেদিন থেকেই সে নতুন জগতে প্রবেশ করে। নতুন প্রাণচেতনায় এমনভাবে উদ্বুদ্ধ হয়, যেন তার চোখে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়। জগতের জীর্ণ, কর্মবিমুখ, অলস-স্থবির সবকিছু সে আত্মশক্তির আলোকে জয় করে। সেই আত্মজাগরণের আলোকে তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়- কাজী নজরুল ইসলাম- এর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সেই অমর লাইন-
‘আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সম্মুখে
যাহা পাই যাই চূর্ণি।’
সেই দুর্বার প্রাণশক্তির আলোকে সকল বাধাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তার জীবনের চারদিকে পরিলক্ষিত হয় আত্মপ্রকাশের বাণী। এই আত্মপ্রত্যয়ের মাধ্যমে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে নিজ জীবনকে বিকশিত করে তোলে। অর্থাৎ নিজের কর্ম-কৌশল ও স্বীয় প্রতিভা প্রয়োগ করতে পারলেই মানুষ সত্যিকারের সাবলম্বী হতে পারে।
সাবলম্বনের পথে বাঁধা: মানবসভ্যতার প্রতিটি স্তরেই শ্রমের অবদান বিদ্যমান রয়েছে। এই শ্রমের সঙ্গে সাবলম্বন শক্তির রয়েছে নিবিড় এক সম্পর্ক। একমাত্র শ্রমেই চিত্তশক্তি এবং আত্মার জাগরণকে আরো বেশি জাগ্রত করে। আত্মশক্তির বিকাশের মধ্যেই সাবলম্বনের বিকাশ নিহিত থাকে। কোনো কাজকে আমাদের তুচ্ছ মনে করা উচিত নয়। শ্রমকে অস্বীকার করা মানেই নির্মল আনন্দ থেকে জীবনকে বঞ্চিত করা এবং নিজেকে অন্ধকার জগতে নিয়ে যাওয়া। কেননা, এই কাজের ওপর নির্ভর করে আমাদের জীবনের সাফল্য এবং টিকে থাকার অস্তিত্ব। এই আত্মশক্তির অভাব থাকলে জীবন ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। এজন্য বরং নিজের কাজ নিজে করাটাই শ্রেয়। এই কাজ করার মধ্যে কোনো অমর্যাদা বা অগৌরবের স্থান নেই। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (স.) এ প্রসঙ্গে বলেন- ‘নিজ হাতে কাজ করার মতো পবিত্র জিনিস আর কিছুই নেই।’ তাই শ্রমকে মযাদা দিয়ে সাবলম্বনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ শ্রমের ওপরই নির্ভর করে সভ্যতার বিকাশ। কর্মশক্তির অভাব সাবলম্বনের প্রধান বাধা। কেননা অনভ্যাসে শ্রমশক্তি দিন দিন হ্রাস পেতে থাকে। যার ফলে তারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর এতে সাবলম্বনের গতি পথে বাধার সৃষ্টি করে।
সাবলম্বন ও স্মরণীয় বরণীয় মানুষ: বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি ও মনীষীগণের জীবন সাধনা ও সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো পরিশ্রম। তাঁদের জীবনে সাবলম্বনের শক্তি অপরিমিত দ্যুতির ন্যায় থাকায়, জগতে তারা আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। প্রবল পরাক্রান্ত ক্ষমতার অধিকারী নেপোলিয়ান প্রথম জীবনে সাধারণ সৈনিক ছিলেন। নিজের পরিশ্রম ও কর্মনিষ্ঠার বলে তিনি ফ্রান্সের অধিপতি হয়েছিলেন। জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, নিউটন, দান্তে প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের জীবনে সাবলম্বনের শক্তিই উদ্ভাসিত। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। বুদ্ধ, যীশুখ্রিস্ট ছাড়াও আরো অনেক মহৎপ্রাণ ব্যক্তির জীবনে আত্মশক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। নিজ কর্মময় জীবনের মধ্যেই তারা পৃথিবীতে জীবন দেবতার আসন লাভ করে গেছেন। তাঁদের নাম বিশ্বের ইতিহাসে চিরকালই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ছাত্রজীবনে সাবলম্বন: ছাত্রজীবনই হলো সাবলম্বন শক্তি অর্জনের উপযুক্ত সময়। ছাত্রজীবনে সাফল্য অর্জনের সোপান বলা হয় সাবলম্বনকে। শুধু মাত্র পঠিত বিষয়ই ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা শক্তি বিকশিত করতে পারে না। পঠিত বিষয়ের ওপর মৌলিক চিন্তা শক্তির বিকাশ ঘটায় সাবলম্বন শক্তি। ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে এ গুণ অর্জন করা সম্ভব। শিশু যেমন আপন চেষ্টায় হাঁটতে শেখে, কথা বলার কলাকৌশল রপ্ত করে, তেমনি মানুষকে ছাত্রাবস্থায় সাবলম্বন শক্তির জ্ঞানকে জাগ্রত করতে হবে। কেননা তার মধ্যেই লুকায়িত আছে সুপ্ত প্রাণশক্তি। একমাত্র সাবলম্বনই পারে এই সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করতে। যে বেশি সাবলম্বী তার ভবিষ্যৎ জীবন তত উজ্জ্বলময়।
বৃহত্তর ক্ষেত্রে সাবলম্বন: শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, সমাজজীবন, বৃহত্তর জাতীয় জীবনে সাবলম্বন শক্তির ভূমিকা অপরিসীম। যে জাতি যত বেশি সাবলম্বী সে জাতি তত বেশি উন্নত। জাপান, ব্রিটেন, জার্মান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ আজ এত উন্নত কারণ তারা আত্মনির্ভরশীল বা সাবলম্বী জাতি হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃত। আমাদের সমাজজীবন আজও সাবলম্বী হয়ে ওঠতে পারেনি, আমাদের অর্থনৈতিক শক্তির দিকে তাকালে আমরা এর সকরুণ চিত্র দেখতে পাই। ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও জাতীয় জীবনে সাবলম্বন শক্তির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এর মাধ্যমেই মানুষ তার জীবনকে নিজের মতো করে গঠন করতে পারে।
উপসংহার: সাবলম্বনের মাধ্যমেই মানুষ দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করতে পারে। আত্মশক্তি জাগরণের মাধ্যমে মানুষ লাভ করে বিরাট এক মহিমা। কোনো ভয় বা ভীরুতার কাছে মাথা নত করে না। সে চির উন্নত শিরের ন্যায় কোনো প্রতিবন্ধকতা তাকে রুদ্ধ করতে পারে না। সাবলম্বনশক্তি সাফল্য অর্জনের মূলমন্ত্র ও উন্নতির সোপান।

ইসমাইল হোসেন