(সংকেত: ভূমিকা; স্বনির্ভরতা কি; স্বনির্ভরতার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ; স্বনির্ভরতার পথে অন্তরায়সমূহ; স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে করণীয়; সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ; উপসংহার।)
ভূমিকা:
সোনা নয় তত খাঁটি।
বল যত খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি আমার বাংলাদেশের মাটি
ও ভাই আমার জন্মভূমির মাটি।
-আব্দুল লতিফ
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশ বাংলাদেশ। সত্যিই বাংলাদেশ এক অপার সম্ভাবনার দেশ। এদেশের মাটিতে সবখানেই সোনা ফলে। সেকালের চিরায়ত বুলি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে-গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু। এ নিয়েই সুখী ছিল এদেশের বাঙালি পরিবার। কিন্তু সেই সমৃদ্ধকাল পৌনে দুশ বছরের ইংরেজ শাসন ও চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের কারণে বিপন্ন হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সকল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। অতীতের সকল গ্লানি মুছে বাংলাদেশ আজ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। স্বনির্ভর দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে।
স্বনির্ভরতা কি: ইংরেজি Self Dependent শব্দের বাংলা পরিভাষা হলো স্বনির্ভরতা। স্বনির্ভরতা বলতে অন্য কারও সাহায্যের উপর নির্ভর না করাকে বুঝায়। অর্থনৈতিকভাবে বলতে গেলে- নিজ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে পরনির্ভরশীলতা হ্রাস করাই স্বনির্ভরতা।
স্বনির্ভরতার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ: ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হয় এদেশ। স্বাধীনতা যুদ্ধে সারাদেশ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে নব্বই দশকে গণতন্ত্রের যাত্রার সাথে সাথেই স্বনির্ভরতা অর্জনের পথচলা শুরু হয়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, একদিকে দেশে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ কিছুটা কমেছে, অন্যদিকে ঋণ পরিশোধের মাত্রা বেড়েছে। ১৯৯০ সালে বৈদেশিক ঋণ সাহায্যের পরিমাণ ছিল ১৮১ কোটি মার্কিন ডলার এবং পরিশোধিত হয়েছে ৩০ দশমিক ২ কোটি মার্কিন ডলার। আর ২০০৯ সালে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৭২ দশমিক ৭ এবং পরিশোধ হয়েছে ৮২ দশমিক ৩ মার্কিন ডলার।
কৃষি উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে খাদ্য শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৭৭ দশমিক ৮৭ লক্ষ মেট্রিক টন। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৩৭৫.০৮ লক্ষ মেট্রিক টন। এর ফলে খাদ্যশস্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে চলেছে। দেশে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। বর্তমানে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রিজার্ভ রয়েছে যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বর্তমানে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১১৯০ মার্কিন ডলার। যা ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ছিল ৫৩৩ মার্কিন ডলার। কমেছে বেকারত্ব, দারিদ্রের হার, শিশু মৃত্যুহার, মাতৃমৃত্যুহার। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৩২১ কিলোওয়াট। ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে এরই মধ্যে অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন করে চলেছে সরকার। তথ্য প্রযুক্তি খাতে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। বর্তমানে দেশে ৯ কোটির অধিক মোবাইল ফোন গ্রাহক রয়েছে। সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশ অতীতের সকল বাধা বিপর্যয় উপেক্ষা করে স্বনির্ভরতার পথে এগিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার পথে অন্তরায়/বাধাসমূহ:এককালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অতীত গৌরব আজ ধূসর স্মৃতি মাত্র। ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫শ বর্গকিলোমিটারের এ দেশের স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রধান অন্তরায়সমূহ হলো-
জনসংখ্যা সমস্যা: স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায় হলো জনসংখ্যা সমস্যা। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ মতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৫ কোটি ৩৬ লাখ এবং প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ১০১৫ জন গড়ে বাস করে। তবে বেসরকারি হিসাব মতে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটিরও অধিক যা ২০২৫ সালের মধ্যে ১৮ কোটি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য শস্য আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের সমস্যা সৃষ্টিসহ নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করছে। যা স্বনির্ভরতা অর্জনে প্রধান অন্তরায়।
দারিদ্র্য: বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ লোক এখনো চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। আর এ দারিদ্রতা বাংলাদেশের স্বনির্ভরতার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দারিদ্র্য সীমা ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
বেকারত্ব: বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারত্ব সমস্যা এখনো প্রকট। দেশে শতকরা ২৩ ভাগ লোক এখনো বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছে আর এটিই স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে অন্যতম বাধা।
রাজনৈতিক অস্থিরতা: বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস পায়। হানাহানি, জ্বালাও পোড়াও রাজনীতি, ধর্মঘটে কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন কমে যায়। ফলে স্বনির্ভরতার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়।
দুর্নীতি: যেকোনো দেশের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হলো দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতি বাংলাদেশের সর্বস্তরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঘুষ, অনিয়মে ছেঁয়ে গেছে বাংলাদেশের সকল স্তর। যা স্বনির্ভরতার পথে বাধা হিসেবে কাজ করছে।
জ্বালানি সংকট: উন্নয়ন প্রধান শর্ত হলো নিরবিচ্ছিন্ন জ্বালানি শক্তি তথা বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু বাংলাদেশ জ্বালানি তথা বিদ্যুৎ খাতে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে সময়মত সেচ সুবিধা, শিল্প উৎপাদন চরমমাত্রায় ব্যাহত হচ্ছে, যা স্বনির্ভরতার পথে প্রধান বাধা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ: বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগ প্রবণ দেশ হিসেবে স্বীকৃত। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, সাইক্লোন ইত্যাদি লেগেই আছে। জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত এদেশে উপকূলীয় অঞ্চলে লোনা পানির প্রকোপ বেড়েছে অধিক পরিমাণে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে করণীয়: বাংলাদেশ স্বনির্ভর করতে হলে যেসব পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন তা নিম্নরূপ-
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যা এবং ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। অধিক জনসংখ্যা একটি প্রধান সমস্যা। সুতরাং জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে স্বনির্ভরতা আনতে হবে।
দারিদ্র্য দূরীকরণ: বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হলো দারিদ্র্য সমস্যা। দারিদ্রতার নাগপাশ থেকে আমাদের মুক্তি অর্জন করতে হবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসন: অপার সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু ঘনঘন হরতাল ও সহিংসতা এদেশে লেগেই রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দেশের উন্নয়ন ব্যবস্থা একদমই ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে। সুতরাং স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে অবশ্যই রাজনৈতিক অস্তিরতা দূর করতে হবে।
ব্যক্তিখাতের উন্নয়ন: আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি বিকাশমান ধারা। গত ৪৩ বছরে আমাদের দেশে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, কৃষক সমাজ, যুবক ও মহিলা এবং বৃহত্তর অর্থে দরিদ্র জনগোষ্ঠী একটি বিরাট বিপ্লবের ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে। ব্যক্তিখাতের এ বিকাশ ও অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা:দিনবদলের সনদ ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে এক যোগে কাজ করতে হবে। এজন্য আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখা: দেশের অর্থনীতির প্রাণ বলা হয় প্রবাসী শ্রমিকদের প্রেরিত রেমিট্যান্সকে। বাংলাদেশ রেমিট্যান্স অর্জনে বিশ্বে ৭ম স্থান অধিকার করেছে। সুতরাং স্বনির্ভর ও মজবুত বাংলাদেশ গড়তে প্রবাসী শ্রমিকদের নানা সমস্যা সমাধান করে রেমিট্যান্সের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
সামাজিক অগ্রগতি ধরে রাখা: দেশকে স্বনির্ভর করতে হলে শিক্ষার হার, গড় আয়ু বাড়াতে হবে। এই সূচকই বলে দেবে আমাদের অবস্থান কোথায়। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। শিশু-মৃত্যু, মাতৃ-মৃত্যুর হ্রাস পেয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। এখন দরকার এই ধারা অব্যাহত রাখা।
পোশাক শিল্পের উন্নয়ন: বাংলাদেশে প্রধান রপ্তানি আয়ের উৎস পোশাক রপ্তানি। দেশে ৫ হাজারের অধিক পোশাক কারখানা রয়েছে যেখানে ৪০ লক্ষের বেশি শ্রমিক কাজ করছে। আর দেশকে স্বনির্ভর করতে হলে এই পোশাক শিল্পের সকল অস্থিরতা দূর করে উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে হবে।
গ্রিন ব্যাংকিং ও সেবা বৃদ্ধি: বর্তমানে দেশে ইতোমধ্যে সবুজ বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। গ্রিন ব্যাংকিং এর সেবা খাতের বিকাশ ঘটিয়ে দেশকে স্বনির্ভরতার পথে নিয়ে যেতে হবে।
সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ: বাংলাদেশের স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে সরকার অত্যন্ত তৎপর। দেশের প্রত্যেক জেলায় স্বতন্ত্রভাবে স্বনির্ভরতার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। জেলা বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। বস্তুত এ সব প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশকে স্বনির্ভর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
উপসংহার:
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’
-দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা এমন দেশটি আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর তাই স্বনির্ভরতা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। জাতির জীবনের দারিদ্র্য দূর করে, বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতার অবসান ঘটিয়ে সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে পারলেই স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। ব্যক্তিজীবনের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা সম্ভবপর হলে তা জাতীয় জীবনেও প্রভাব ফেলবে। আর তাই স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সকলের এক যোগে আন্তরিকভাবে কাজ করে যেতে হবে।