(সংকেত: ভূমিকা; আকাশ সংস্কৃতি কি; আকাশ সংস্কৃতির উদ্ভব; আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ; আকাশ সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক; আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক দিক; বাংলাদেশ ও আকাশ সংস্কৃতি; বিশ্ব ও আকাশ সংস্কৃতি; আমাদের করণীয়; উপসংহার।)
ভূমিকা: সংস্কৃতি একটি জাতি ও রাষ্ট্রের দর্পণস্বরূপ। প্রতিটি জাতি ও সমাজেরই আলাদা সংস্কৃতি থাকে। এই সংস্কৃতির মাধ্যমেই একটি জাতি ও রাষ্ট্র বিশ্বের দরবারে তাদের গৌরব ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে পারে। কিন্তু আধুনিককালে বিশ্বায়নের কারণে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপকতায় পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির আদান-প্রদানও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে এসে বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইসের সুবাদে আকাশ সংস্কৃতি নামে অনুন্নত দেশের সংস্কৃতিকে গ্রাস করছে উন্নত দেশগুলোর সংস্কৃতি। ফলশ্রুতিতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তাদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা হারাচ্ছে।
আকাশ সংস্কৃতি কি: মানুষের জীবনাচরণই তার সংস্কৃতি। ডিজিটাল ডিভাইস, স্যাটেলাইট তথা ডিশ এন্টেনার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানই হলো আকাশ সংস্কৃতি। স্যাটেলাইট ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আকাশ সংস্কৃতির বিস্তারে আমাদের তরুণ ও যুব সমাজের মাঝে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি যেমন অনীহা বাড়ছে তেমনি বিদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের সর্বনাশা প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। এভাবে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
আকাশ সংস্কৃতির উদ্ভব: কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়। এর মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান গ্রাহক যন্ত্রের মাধ্যমে সরাসরি উপভোগ করতে পাচ্ছি। আর এভাবেই উদ্ভব ঘটেছে আকাশ সংস্কৃতির। আমরা টেলিভিশন ও রেডিওতে আবহাওয়াসহ বিভিন্ন খবর দেখি ও শুনি এগুলো মূলত সম্ভব হয়েছে স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে যেটিকে আমরা আকাশ সংস্কৃতি বলি। আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমেই একটি দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে অন্য দেশ সম্যক ধারণা পাচ্ছে।
আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ: স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের দেশের মানুষ আজ দেশি বিদেশি নানামুখী চ্যানেল ও ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে। আগে যেখানে বাংলাদেশে বিটিভি-ই ছিল একমাত্র ইলেকট্রনিক বিনোদনের মাধ্যম সেখানে স্যাটেলাইটের সুবাদে এখন বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মোট ৪১টি টিভি চ্যানেল চালু রয়েছে। যার মধ্যে ৩টি সরকারি ও বাকীগুলো বেসরকারি । এর মধ্যে এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই, আরটিভি, এনটিভি, বৈশাখী, বাংলাভিশন, যমুনা টিভি, মাছরাঙা, দেশ টিভি, সময়, ইনডিপেন্ডেন্ট ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।২০০৪ সালে অশ্লীলতার বিবেচনায় সরকার এটিভি, টিভি-৬, চ্যানেল-ভিসহ বেশ কটি চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও এমটিভি, সনিটিভি, জিটিভি, এইচবিও, স্টার মুভি, ইটিসি, বিফোরইউসহ আরও অনেক মিউজিক ও মুভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান শহর থেকে শুরু গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত ঘরে ঘরে প্রচারিত হচ্ছে। তাছাড়া বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা ইত্যাদি চ্যানেলগুলোতে আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে। পাশাপাশি ডিসকভারি, এনিমেল প্লানেট, অ্যাডভেঞ্চারার্সসহ বেশ কিছু চ্যানেল আছে যেগুলো পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টিকে দর্শকের সামনে তুলে ধরছে। এভাবে প্রতিনিয়ত আকাশ সংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে।
আকাশ সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক: বর্তমান আধুনিক বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই প্রতিটি দেশ একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বর্তমান বিশ্বে তথ্য ব্যবস্থার যে অবাধ প্রবাহ তার সাথে নিজেদেরকে সংযুক্ত রাখতে হলে ইন্টারনেট ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। স্যাটেলাইট আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্ব একটি Global Village এ পরিণত হয়েছে। এই Global Village-এর সদস্য হয়ে এ থেকে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা হাসিলের জন্য আমাদেরকে তথ্য প্রযুক্তিতে আরো বেশি অগ্রগামী হতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংবাদ জানতে হলে বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থাগুলোর সাথে যোগাযোগ না থাকলে আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়বো। এছাড়া ইন্টারনেট প্রচলনের মাধ্যমে আমরা যে মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছি এর মাধ্যমে আমাদের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটেছে। এটি আমাদেরকে বিভিন্ন সংকীর্ণ ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চিন্তা করার সুযোগ করে দিচ্ছে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে অবাধ প্রবেশের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে সহজভাবে বিচরণ করতে পারছি। যেটি আমাদের জাতিগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক দিক: বাংলাদেশে আকাশ সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক অপেক্ষা নেতিবাচক দিকই বেশি। আকাশ সংস্কৃতির করাল গ্রাসে আজ আমাদের সমাজ কাঠামো ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গঠন প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের পরিবারের বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমা সমাজের বিবাহবন্ধনহীন অনৈতিক জীবনব্যবস্থা আমাদের দেশের জনগণকে প্রভাবিত করছে। ফলশ্রুতিতে চরম সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। আমরা সমাজে লক্ষ করছি বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির স্রোতে আমাদের তরুণ ও যুব সমাজ বিপথগামী ও রুচিহীন হয়ে পড়ছে।আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক আগ্রাসনের ফলে আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ ও খাদ্যাভাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তাছাড়া এটি আমাদের জীবনবোধ, নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে ব্যাপক আঘাত হানছে। ফলশ্রুতিতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার ফলে সমাজে অন্যায়-অবিচার যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও আকাশ সংস্কৃতি: বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেলগুলো অবাধে তাদের অনুষ্ঠানাদি সম্প্রচার করে যাচ্ছে। ফলে ইউরোপীয় চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানের কারণে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারের ফলে আমাদের ধর্মনিষ্ঠা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ পরাস্থ হচ্ছে। অপরদিকে ভারতীয় চ্যানেলগুলোও বিভিন্ন প্রকার অনুষ্ঠান ও সিরিয়াল প্রচারের মাধ্যমে আমাদের দেশের নারী সমাজকে পারিবারিক কোন্দলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হচ্ছে পারিবারিক বিরোধ। এভাবে আমাদের পরিবার ও সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।
বিশ্ব ও আকাশ সংস্কৃতি: আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপরদিকে উন্নত দেশগুলো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক ধ্যান-ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর দুর্বল সংস্কৃতি পাশ্চাত্যের তথাকথিত উন্নত সংস্কৃতির আগ্রাসনে ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের মত অনুন্নত দেশগুলোর নিজস্ব সংস্কৃতি বিলুপ্ত হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো তাদের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে অনুন্নত দেশগুলোকে শাসন করছে।
আমাদের করণীয়: বর্তমানে গোটা পৃথিবী একটি বিশ্ব গ্রামে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এই পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে এই বিশ্ব গ্রামের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সেজন্য এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও স্বার্থকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করতে হবে। বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন হতে নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে হলে আমাদেরকে বিদেশি সংস্কৃতির ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করতে হবে এবং নেতিবাচক দিকগুলো বর্জন করতে হবে। সে জন্য বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরও বেশি দক্ষতা অর্জন করতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতির লালন আর বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হলে দেশীয় সংস্কৃতিকে আরও যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। বর্তমানে চালু আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর সম্প্রচারে আরও বৈচিত্র্য আনয়নের পাশাপাশি নতুন নতুন স্যাটেলাইট চ্যানেল চালুর পদক্ষেপ নিতে হবে।
উপসংহার: আকাশ সংস্কৃতির করালগ্রাসে বর্তমানে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নাজেহাল। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের ফলে অনুন্নত দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেজন্য আমাদেরকে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর পাশাপাশি যে সকল স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি প্রচার করছে সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে অথবা ঐ সকল চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে।