(সংকেত: ভূমিকা; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পটভূমি; মামলার পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য; মামলা- রাষ্ট্রদ্রোহীতা বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য; মামলার অভিযোগ ও দলিলাদি; ট্রাইবুনাল গঠন; গ্রেপ্তার ও বিচার প্রহসন; মামলার আসামি; মামলার শুনানি ও জেরা; গুপ্ত হত্যার ষড়যন্ত্র; প্রবল গণরোষ; ফলাফল; মামলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব; ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক; উপসংহার।)
ভূমিকা: ব্রিটিশ শোষণের (১৭৫৭-১৯৪৭) ১৯০ বছর পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান রাজনৈতিক মুক্তি লাভ করে। আর পূর্ব পাকিস্তান ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে জিম্মি হয়ে পড়ল পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দীশালায়। এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে বাঙালিরা যখনই তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে দাড়িয়েছে তখনই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের উপর চড়াও হয়েছে এবং মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে নানা কৌশল ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এই ষড়যন্ত্রের প্রমাণ।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পটভূমি: ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে, দেশের উভয় অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের সামরিক আইনে প্রেপ্তার করেন। ১৯৬২ সালে ক্ষমতাকে স্থায়ী ও সুদৃঢ় করতে “মৌলিক গণতন্ত্র” নামে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে সকল রাজবন্দীদের মুক্তি প্রদান করেন। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগকে পুনর্গঠিত ও শক্তিশালী করে তোলেন। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব আইয়ুব খানকে বিচলিত করে। ফলে শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হন তার প্রধান শত্রুতে। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যকার পাহাড়সম বৈষম্যগুলোকে জনসম্মুখে প্রচার করে ব্যপক জনমত গড়ে তোলেন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে পাকিস্তানের জাতীয় কনফারেন্সে এই বৈষম্যের উল্লেখপূর্বক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবি সম্বলিত ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ধীরে ধীরে এ দাবি জোরালো হয়ে উঠলে শেখ মুজিবুরকে “বিচ্ছিন্নতাবাদী” আখ্যা দিয়ে তাকে সহ অসংখ্য নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ সালে ৭ জুনের হরতাল সমর্থিত মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা ও আহত করা হয় অনেককে। ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তোফাজ্জাল হোসেন (মানিক মিয়া) কে গ্রেপ্তার তার “নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস” বাজেয়াপ্ত, এবং ইত্তেফাকসহ কিছু পত্রিকা নিষিদ্ধ করে দেয়। তখন সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও কর্মকর্তাগণ সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে বাংলাকে স্বাধীন করতে গোপনে সংগঠিত হয়ে কাজ চালিয়ে যান। কিন্তু সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা ও সংগঠনের দুইজন সদস্যের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে শেষ পর্যায়ে এসে তারা ধরা পড়ে যায়। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আইয়ুব মোনায়েম শাসক বাঙালিদের দমিয়ে দিতে ১৯৬৮ সালের ৬ই জানুয়ারি ও পরে ১৮ই জানুয়ারি একটি মামলা দায়ের করে যা “আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে পরিচিত।
মামলার পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য: ১৯৬৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই আন্দোলনের বটবৃক্ষ শেখ মুজিবরকে হত্যা ও তার সহযোগী নেতাকর্মীদের দীর্ঘদিনের কারাদ- প্রদানের মাধ্যমে পূর্ববাংলার জাতীয়বাদী আন্দোলনকে নির্মূল করাই ছিল এই মামলার মূল লক্ষ্য।
মামলা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য:১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি ২ জন সিএসপি অফিসারসহ ২৮ জন সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে মামলা করা হয়। পরবর্তীতে ১৮ জানুয়ারি ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভিযোগে এনে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে পূর্বের ২৮ জন সহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে “রাষ্ট্রদ্রোহীতা বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য” শিরোনামে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার ফারিয়াদি ছিলেন, পাকিস্তানের এককালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রখ্যাত পাঞ্জাবি আইনজীবী মঞ্জুর কাদের।
মামলার অভিযোগ ও দলিলাদি: সরকার ৪২ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগে বলা হয় যে, ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় ভারতীয়দের সহযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে আসামিরা সামরিক অভ্যুথান ঘটানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ভারতীয়দের থেকে এজন্য অর্থ ও অস্ত্র-সস্ত্র সংগ্রহের অভিযোগ এনে এর একটি তালিকা তৈরি করা হয়। সেখানে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ উপস্থাপিত হয়। ১২ টি চিঠি, ২টি টেলিগ্রাম, “বাংলাদেশ” ও “বেতারবাণী” লেখা ৩টি তারিখবিহীন কাগজ, অর্থলেনদেন সংক্রান্ত দলিল, দশটি প্রবন্ধের একটি তালিকা এবং ২০০ সাক্ষীর নামসহ মোট ৮২টি দলিল উপস্থাপিত হয়।
ট্রাইবুনাল গঠন: ১৯৬৮ সালের ১২ এপ্রিল জারিকৃত ফৌজদারি অধ্যাদেশ অনুযায়ী মামলার বিচার কাজ পরিচালনার জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতি এস.এ রহমানকে চেয়ারম্যান করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এম.আর খান ও পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি মাকসুসুল হাকিমকে নিয়ে এই বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠিত হয়।
গ্রেপ্তার ও বিচারপ্রহসন: ১৯৬৬ সালের ৯ মে থেকে আটক শেখ মুজিব ও গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি মুক্তি ঘোষণা করে ১৯ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় জেলগেটেই “আর্মি, নেভি ও এয়ারর্ফোস অ্যাক্ট” এ পুনরায় গ্রেপ্তার করে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তরিত করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের বিচার পরিচালনার জন্য ১৯৬৮ সালে ২২ এপ্রিল আইন ও বিচার পদ্ধতি সংক্রান্ত একটি ফৌজদারি অধ্যাদেশ জারি করে বলা হয়-
- মামলার বিচার সাধারণ আদালতে নয়, বিশেষ ট্রাইবুনালে সম্পাদিত হবে।
- সুপ্রিম কোর্টের একজন জজ (চেয়ারম্যান) এবং হাইকোর্টের দুইজন জজের (সদস্য) সমন্বয়ে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠিত হবে।
- পুলিশের কাছে প্রদত্ত স্বীকারোক্তি আইনসাবুদ হবে।
- আসামিদের কোনো জামিন দেয়া যাবে না এবং তারা সামরিক হেফাজতে থাকবে।
মামলার আসামি: ১৯৬৮ সালে ১৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে সর্বমোট ৩৫ জনের তালিকা করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম আসামিরা হলেন লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, স্টুয়ার্ড মজিবর রহমান, সার্জেন্ট জহুরুল হক প্রমুখ।
মামলার শুনানি ও জেরা: ১৯ জুন, ১৯৬৮ সনে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে বিপুল সংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও টেলিভিশন প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে মামলার শুনানি হয়। আসামিদের জবাবন্দী ও সওয়াল-জওয়াব শুরু হলে শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত মামলাকে সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা বলে আখ্যা দিয়ে তিনি সহ অন্য সকল আসামিদের নির্দোষ বলে জোরালো দাবী জানান। রাজসাক্ষীদের অনেকেই গোপন তথ্য ফাস করে দিয়ে তাদেরকে জোরপূর্বক সাক্ষ্য দিতে বলা হয়েছে বলে স্বীকার করেন। এভাবেই ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুনানি অব্যাহত থাকে এবং একপর্যায়ে বিচারকার্য স্তিমিত হয়ে পড়ে।
গুপ্ত হত্যার ষড়যন্ত্র: ১৯৬৯ এর শুরুতেই প্রবল গণরোষ দেখা দেয় এমনকি এটি পাকিস্তানের অস্তিত্বের উপর হুমকি হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে ক্যান্টনমেন্টের সিগনাল অফিসার্স মেসেই হত্যার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এক গুপ্ত ঘাতক নিয়োগ করে ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি হত্যার দিন ধার্য করা হয়। এক পাঠান ক্যাপ্টেন শেখ মুজিবকে পূর্বেই সর্তক করে দেওয়ায় তিনি বেঁচে যান। তবে পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়।
প্রবল গণরোষ: ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান, ২৪ জানুয়ারি মতিউর রহমান, ১৫ ফেব্রুয়ারি জহুরুল হক, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা, বিভিন্ন মিছিল-মিটিং ও বিক্ষোভ সমাবেশ গুলি করে অসংখ্য লোককে আহত করায় ছাত্রসংগ্রাম সমাবেশে পরিষদ (সাক) ও গনতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ (ডাক) এর নেতৃত্বে ১৯৬৯ এর ২১ জানুয়ারি ঢাকায় মশাল মিছিল, ২৪ জানুয়ারি দেশব্যপী হরতাল এবং “দৈনিক পাকিস্তান” ও “মর্নিং নিউজ” এর ভবনে আগুন দেয়া হয়। ২৪ জানুয়ারির পর থেকে একদিনও আন্দোলন থেমে থাকেনি। ১ ফেব্রুয়ারি এক বেতার ভাষণে আইয়ুব বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দদের গোল টেবিল বৈঠকের আহ্বান জানালে ছাত্রসমাজ তা প্রত্যাখ্যান করে। ৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঢাকায় আসেন কিন্তু ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করেন।
ফলাফল: প্রবল আন্দোলনের মুখে সরকার ১৯ ফেব্রুয়ারি কারফিউ প্রত্যাহার করে। ২১ ফেব্রুয়ারি এক বেতার ভাষণে তার পদত্যাগের ঘোষণা, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান করেন। ২২ শে ফেব্রুয়ারি সকলে মুক্তিলাভ করলে ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে রেসকোর্স ময়দানে লক্ষাধিক বাঙালির এক বিরল গণসংর্ধনায় “বঙ্গবন্ধু” খেতাব দেয়া হয়।
মামলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফলাফলের মধ্য দিয়েই পূর্ব বাংলার মুক্তি ত্বরান্বিত হয়। উনসত্তর এর গণ-অভ্যুত্থান, সত্তর এর নির্বাচন, একাত্তর এর স্বাধীনতা সংগ্রাম এসব এই মামলারই যুগপৎ ফলাফল।
ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক: এই ঘটনার মধ্যদিয়ে বাঙালির দেশপ্রেম ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সুবিধাবাদী ও বিশ্বাসঘাতকরাও চিহ্নিত হয়ে পড়ে। পরবর্তী সকল আন্দোলনে এটি আত্মবিশ্বাস ও মনোবল যুগিয়েছে। তবে আইয়ুবের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক না হওয়াতে কোনো রাজনৈতিক সমাধান তখন আসেনি এবং ঐ সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নতুন করে ষড়যন্ত্র ও দমননীতি পরিকল্পনার সুযোগ পায়।
উপসংহার: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পাকিস্তান সরকারের একটি ষড়যন্ত্রমূলক অভিপ্রয়াস হলেও একথা অনস্বীকার্য যে, পাকিস্তানের পূর্ব অঞ্চলের সাথে পশ্চিম অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহ সকল ক্ষেত্রে পাহাড়সম বৈষম্যে পূর্ব বাংলার মানুষকে দাবি আদায় ও মুক্তির চেতনার বিষয়ে সচেতন করে তোলে। এদিক থেকে আগরতলা মামলাকে সত্য মামলা বললেও অত্যুক্তি হয় না।