04 January, 2019

স্কাউট আন্দোলন,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; স্কাউট আন্দোলন কী; স্কাউট আন্দোলনের ইতিহাস; স্কাউটদের আবশ্যকীয় গুণাবলি; স্কাউট আন্দোলনের প্রসার; বাংলাদেশে স্কাউটিংয়ের অগ্রগতি; স্কাউট আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য; স্কাউট আন্দোলনের উদ্দেশ্য; বিভিন্ন স্তর; উপসংহার।)
ভূমিকা: স্কাউট একটি আন্তর্জাতিক, বিশ্ব ভ্রাতৃত্বমূলক অরাজনৈতিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও স্বেচ্ছাধর্মী সেবামূলক সংগঠন। সাধারণত ছয় থেকে পচিঁশ বছর বয়সি শিশু-কিশোর ও যুব সমাজের চরিত্র গঠন এবং যোগ্যতা অর্জনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই এখন স্কাউট আন্দোলন চলছে। এই কার্যক্রমটি বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
স্কাউট আন্দোলন কী: দেশের প্রতিটি শিশু-কিশোর ও যুব সমাজকে শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক উন্নতি সাধনের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা জন্য যে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাকে স্কাউট আন্দোলন বলা হয়। এর মাধ্যমে একজন শিশু তার স্বাভাবিক মেধার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়। স্কাউট আন্দোলনের শিক্ষার মাধ্যমে যেকোনো শিশু-কিশোর ও যুবক দেশ ও দশের কল্যাণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠে। এই আন্দোলন সমগ্র বিশ্বে ভ্রাতৃত্বের আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করে। স্কাউট আন্দোলন শিশু-কিশোর ও যুবকদের সত্য ও ন্যায়ের অনুযায়ী উদ্যম, সুশৃঙ্খল ও সাহসী করে তুলে।
স্কাউট আন্দোলনের ইতিহাস: ব্যাডেন পাওয়েলকে স্কাউট আন্দোলনের উদ্যোক্তা বলা হয়। তিনি একজন সেনাপতি ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বুয়র যুদ্ধে ম্যাফেকিং অবরোধের সময় যখন সৈনিকদের গোলা বর্ষণের মধ্যে যেতে হতো তখন ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের দলে দলে বিভক্ত করে দুর্গে দুর্গে সংবাদ আদান-প্রদানের কাজে লাগানো হত। এইসব ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করত। যুদ্ধের শেষে তাদের বীরত্বের পদক দেওয়া হত। এসব দৃশ্য দেখে ব্যাডেন পাওয়েলের মাথায় বুদ্ধি এসে গেল ছেলেমেয়েদের যেহেতু যুদ্ধের সময় বিভিন্ন কাজে লাগানো যায় সেহেতু তাদের সংঘবদ্ধ করতে পারলে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করানো যাবে। এই উপলক্ষে ১৯০৮ সালে তিনি বয় স্কাউট বা ব্রতী বালক সমিতি গঠন করলেন। আর স্কাউট আন্দোলন এখান থেকেই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
স্কাউটদের আবশ্যকীয় গুণাবলী: প্রতিটি স্কাউটকে কিছু আবশ্যকীয় গুনাবলি অর্জনের চেষ্টা করতে হয়। সেগুলো হলো- ১. সর্বক্ষেত্রে বিশ্বস্ত থাকতে হবে ২. দলপতি ও পিতা মাতার প্রতি অনুগত থাকার গুণাবলী অর্জন করতে হবে ৩. প্রতিটি দলে পারষ্পরিক সাহায্য সহযোগিতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব গড়ে তুলতে হবে ৪. স্কাউটদের উদ্যমী, সাহসী, মিতব্যয়ী, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং মহান স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়।
স্কাউট আন্দোলনের প্রসার: স্কাউট আন্দোলনের জনপ্রিয়তা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমেরিকার এরূপ একটি দল বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। স্কাউট আন্দোলনের ফলে শিশু-কিশোরদের সেবামূলক মনোভাব গড়ে উঠেছে। স্কাউট আন্দোলন কেবল শহরেই নয় বর্তমানে গ্রাম পর্যায়েও ছড়িয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে স্কাউটিংয়ের অগ্রগতি: ভারতবর্ষে বয় স্কাউট আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯১৬ সালে। পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে অবিভক্ত বাংলাদেশে অ্যানিবেসান্টের সহায়তায় ডাক্তার মল্লিক বাঙালি বয় স্কাউট দল গঠন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বতন্ত্র পরিবেশে স্কাউট আন্দোলন বেশ প্রসারিত হয়। বর্তমান সময়ে এই আন্দোলনকে আরো জোরদার করা হয়েছে। বর্তমানে এ দেশে স্কাউটের সংখ্যা দশ লাখেরও বেশি। আমাদের দেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন স্কাউট কার্যক্রম চালু আছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে স্কাউট সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ দেশের স্কাউটরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমাবেশে অংশগ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশের স্কাউট কার্যক্রম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেছে।
স্কাউট আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য: স্কাউট একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। সারাবিশ্বে যুবসমাজের মাধ্যমে এর কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়। এর কর্মসূচিতে বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। বিশ্বের স্কাউটরা পরষ্পর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। দেশ, জাতি, বর্ণ ও ভাষায় স্কাউটদের মধ্যে কোনো পার্থক্য বিবেচনা করা হয় না। তাদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, আইন, শপথ, মূলমন্ত্র, আচার ব্যবহার সব কিছুর মধ্যে একটা ঐক্য বিরাজ করে। প্রতিটি স্কাউটকে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় এবং নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হয়। তবে তারা অপরের ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধা বজায় রাখে। স্কাউটদের মাঝে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ থাকে না। সেবামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করাই এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পরোপকারের মহান ব্রত নিয়ে এটি কাজ করে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাই তাদের অন্যতম কাজ। স্কাউট আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৭টি আইন এবং নির্দিষ্ট শপথ বাক্য আছে। তাদের শপথবাক্য অনেকটা এরূপ- “আমি আমার আত্মর্মযাদার উপর বিশ্বাস করে শপথ করছি যে, স্রষ্টা ও দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে, প্রতিদিন কারো না কারো উপকার করতে এবং স্কাউট আইন মেনে চলতে যথাযথ চেষ্টা করব।”
স্কাউট আন্দোলনের উদ্দেশ্য: স্কাউট আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো বালকদের জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করা। শিশু-কিশোর ও যুবকদেরকে আনুগত্য ও আত্ম-নির্ভরশীলতার শিক্ষা দিয়ে যোগ্য করে তোলা। তারা পরোপকারের অনুশীলন করবে এবং দেশ ও জনগণের কল্যাণে এগিয়ে আসবে। দেশের প্রতিটি যুবকের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন স্কাউট আন্দোলনের উদ্দেশ্য। বালকেরা যাতে আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী সকলের বন্ধু বিনয়ী, অনুগত, জীবের প্রতি দয়াশীল, প্রফুল্ল, মিতব্যয়ী চিন্তা-ভাবনা, কথা ও কাজের মিল রেখে গড়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে স্কাউট আন্দোলন পরিচালিত হয়। বিভিন্ন উপদলের মাধ্যমে এদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। স্কাউটদের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি ব্যপক থেকে ব্যপকতর হয়েছে। এখন স্কাউট দল প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিভিন্ন ধরণের বিপদে মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করছে।
বিভিন্ন স্তর: সংখ্যার উপর ভিত্তি করে স্কাউটদের নানা দলে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি দলে পাঁচ থেকে ছয়টি প্যাট্রল থাকে এবং প্রতিটি প্যাট্রলে ৮ জন করে স্কাউট থাকে। স্কাউট মাস্টার স্কাউটদের নিয়ন্ত্রণ করে। আবার বয়সের বিবেচনায় স্কাউটদের ৩ স্তরে বিভক্ত করা যায়-
১. কাব স্কাউট: ছয় থেকে এগার বছর বয়সী বালদের কাব স্কাউট বলা হয়।
২. বয়েজ স্কাউট: বার থেকে ষোল বছর বয়সী বালকদের বলা হয় বয়েজ স্কাউট।
৩. রোভার স্কাউট: সতের থেকে পচিঁশ বছর পর্যন্ত বয়সী বালকদের রোভার স্কাউট বলা হয়।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে মিল রেখে স্কাউট আন্দোলনকে নিম্ন লিখিত স্তরে ভাগ করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা কাব স্কাউটের পর্যায়ে পড়ে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা বয়েজ স্কাউট এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রোভার স্কাউট এর পর্যায়ে পড়ে।
উপসংহার: স্যার ব্যাডেন পাওয়েল কোনো সামরিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে স্কাউট দল গঠন করেনি। তার উদ্দেশ্য ছিল কোমলমতী ছেলেমেয়েদের সমাজসেবামূলক কাজে ব্যস্ত রাখা। তার মাধ্যমেই স্কাউটের সেবামূলক কর্মকান্ড পৃথিবীব্যাপী প্রসার এবং প্রশংসা অর্জন করে। স্কাউট আন্দোলন গ্রাম অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ুক, উপকৃত হোক মানবতা এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

ইসমাইল হোসেন