(সংকেত: ভূমিকা; অলিম্পিক গেমসের ইতিহাস; গেমসের ছন্দপতন; অলিম্পিকের রকমফের; প্রতীক; খেলাধুলা; অলিম্পিকের পদক; উপসংহার।)
ভূমিকা: প্রাচীন গ্রীসে দেবতাদের বাসভূমি বলে গণ্য অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে দেবতাদের সম্মানার্থে যে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হতো তাকে অলিম্পিক গেমস বলা হয়। মনে করা হয় প্রধানত গ্রীসের এলিসের অলিম্পিক ভিলেজে অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে দেবতা জিউসের উদ্দেশ্যে ৪ বছর পর পর অলিম্পিক গেমস আয়োজিত হতো। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজকের আধুনিক অলিম্পিক, মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে অলিম্পিকে এসেছে নানা পরিবর্তন। কে প্রচলন করেছিল অলিম্পিক গেমস তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও অধিকাংশের মত হলো গ্রীক বীর হারকিউলিস বা হেরাক্লিস প্রচলন করেন এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসরের।
অলিম্পিক গেমসের ইতিহাস: প্রাচীন অলিম্পিকের উৎপত্তি নিয়ে যে জনশ্রুতিগুলো রয়েছে তা খানিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ। বেশকিছু মিথও প্রচলিত আছে এ নিয়ে। এগুলোর মাঝে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মিথ অনুসারে গ্রিক রাজা হেরাক্লেস এবং তার বাবা জিউস এই গেমসের আদি পুরুষ। প্রাচীন গ্রিসে অলিম্পাস পাহাড়কে পবিত্র মনে করা হতো। ভাবা হতো এ পাহাড়ে দেবতারা বাস করেন। তাই দেবতাদের সম্মানে পাহাড়ের পাদদেশে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। হেরাক্লেসই প্রথম এ গেমসকে অলিম্পিক নামকরণ করেন এবং তিনি জিউসের সম্মানে অলিম্পিক স্টেডিয়ামও নির্মাণ করেছিলেন। খানিকটা মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রাচীন অলিম্পিকের শুরুর সময়কাল নিয়ে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মত হলো ৭৭৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। ঐ সময়ের গ্রিসের নগর রাষ্ট্র এবং রাজ্যগুলো এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। প্রতিযোগিতা চলাকালে অংশগ্রহণকারী রাজ্যগুলো পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকত। মূলত দৌড়, মুষ্টিযুদ্ধ, কুস্তি এ ধরণের খেলাগুলো সে সময়ের অলিম্পিকে প্রাধান্য পেত। ১২শ বছর গেমস চলার পর রোমান রাজা থিওডোমিয়াম-১৩৯৩ সালে গেমসের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। পৌত্তলিকতার উপর ভিত্তি করে গেমসের উদ্ভাবন এবং এটি মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা তৈরিতে সহায়তা করে না এই অজুহাতে গেমস বিলুপ্ত করা হয়। ৫শ বছর পরে ফ্রান্সের অধিপতি ব্যারন পিয়েরে কুবার্তে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) গঠনের মাধ্যমে ১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিকের শুভ সূচনা করেন। যে গ্রিসে অলিম্পিকের যবনিকা ঘটেছিল সেই গ্রিসেই অলিম্পিকের পুনর্জাগরণ হয়। আইওসির অধীনে প্রথম অলিম্পিকের আয়োজক হবার গর্ব নিজের করে নিল গ্রিসের এথেন্স নগরী। প্রথম আসরে অংশ নেয় ১৪টি দেশের মোট ২৪১ জন অ্যাথলেট। প্রতিযোগিতায় মোট ইভেন্টের সংখ্যা ছিল ৪৩টি।
গেমসের ছন্দপতন: শুরু হওয়ার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চার বছর পরপর অলিম্পিক তার সূচি অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। তবে চলার পথে ছন্দ পতনের ঘটনা ঘটেছে দুইবার। এ পৃথিবী আধুনিক কালে এসে যে দুটি মহাবিপর্যয় পাড়ি দিয়েছে তা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি অলিম্পিক গেমসও। দু’টি বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবলীলায় সভ্যতা যখন থমকে দাঁড়িয়ে পথ খুঁজে ফিরেছে অলিম্পিক গেমসও থমকে গিয়েছিল তখন। ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি এর ষষ্ঠ আসর। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে দাঁড়িয়ে ১৯৪০ ও ১৯৪৪ এ যথাক্রমে ১২ ও ১৩তম আসরের আয়োজন সম্ভব হয়নি। ধ্বংসযজ্ঞ পেরিয়ে পৃথিবী যখন গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে তখন অলিম্পিক গেমসও খুঁজে পেয়েছে নিজস্ব ছন্দ।
অলিম্পিকের রকমফের: অলিম্পিক বললে সাধারণভাবে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিককেই বোঝায়। প্রচার প্রচারণার আলোটাও বেশি থাকে এ অলিম্পিককে ঘিরেই। শুরুতে কেবল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকই প্রচলিত ছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে আরও কিছু অলিম্পিক এর প্রচলন ঘটানো হয়েছে। ১৯২৪ সালে এসে প্রথম শীতকালীন অলিম্পক এর আয়োজন করা হয়। এর কারণ অলিম্পক কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল তুষার বা বরফের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ইভেন্টকে অলিম্পিকে সংযোজন করতে। যা গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে সম্ভব ছিল না। এ কারণে ১৯২১ সালে লুজানে কমিটির কংগ্রেসে অলিম্পিকের শীতকালীন ভার্সন চালুর সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬০ সালে মার্কিন নাগরিক ইউনাইস কেনেডি শ্রাইভার এর প্রচেষ্টায় স্পেশাল অলিম্পিকের যাত্রা শুরু হয়। স্পেশাল অলিম্পিকে অংশ নিয়ে থাকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা। অলিম্পিকে সর্বশেষ সংযোজন হলো যুব অলিম্পিক। ২০০১ সারে আইওসির ১১৯তম কংগ্রেসে যুব অলিম্পিক আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১০ সালে সিঙ্গাপুরে প্রথম গ্রীষ্মকালীন যুব অলিম্পিক এর আয়োজন করা হয়। যুব অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারীদের বয়স ১৪ বছর থেকে ১৮ বছরের মধ্যে হয়।
প্রতীক: অলিম্পিক প্রতীকে ব্যবহৃত হয় ভিন্ন ভিন্ন রঙের পরস্পর সংযুক্ত পাঁচটি বৃত্ত। সাদা জমিনের ওপর নীল, হলুদ, কালো, সবুজ ও লাল রঙের বৃত্ত দিয়ে তৈরি হয়েছে অলিম্পিক পতাকা। পতাকার পরিকল্পনাকারীও ছিলেন ব্যারন পিয়েরে কুবার্তো। পাঁচ রঙের বৃত্তগুলো যথাক্রমে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, ওশেনিয়া ও আমেরিকা মহাদেশকে বোঝায়। রঙগুলো বেছে নেয়ার কারণ হলো প্রতিটি জাতির পতাকাতেই এ রংগুলোর অন্তত একটির উপস্থিতি আছে। অলিম্পিক পতাকা ১৯১৪ সালে গৃহীত হলেও গেমসে প্রথম উত্তোলন করা হয় ১৯২০ সালে এন্টওয়ার্প (বেলজিয়াম) অলিম্পিকে। অলিম্পিকের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো মশাল। গেমসের কয়েক মাস পূর্বে মশাল প্রজ্বলন প্রাচীন গ্রিক রীতিকে মনে করিয়ে দেয়। বিভিন্ন শহর ঘুরে আসার পর উদ্বোধনী দিনে এটির মাধ্যমে স্টেডিয়ামের বৃহৎ মশাল জ্বালানো হয়। ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে প্রথম এর প্রচলন করা হয় যদিও ১৯২৮ সাল থেকেই মশালকে অলিম্পিকের প্রতীক হিসেবে ধরা হত। ১৯৬৮ সালে এসে অলিম্পিকে প্রথম মাসকট এর দেখা মেলে। মাসকট সাধারণত স্বাগতিক দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
খেলাধুলা: বর্তমানে প্রচলিত আছে অলিম্পিক গেমসে এমন খেলার সংখ্যা ৩৫। এ খেলাগুলোই ৩০টি বিভাগে প্রায় ৪০০টির মত ইভেন্টে বিভক্ত। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে খেলার সংখ্যা ২৬টি; শীতকালীন অলিম্পিকে যার সংখ্যা ১৫। অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, ফেন্সিং এবং জিমন্যাস্টিক এর চারটি খেলা গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের কোনো আসর থেকে বাদ পড়েনি। অপরদিকে স্কিইং, স্কেটিং, আইস হকি, নর্ডিক কম্বাইন্ড, স্কি জাম্পিং এবং স্পিড স্কেটিং এ খেলাগুলো শীতকালীন অলিম্পিকের প্রতিটি আসরেই থাকে।
অলিম্পিকের পদক: প্রাপ্তির আনন্দ আর না পাবার বেদনা সবই যখন এই পদককে ঘিরে, তখন পদক তো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই থাকবে। প্রতিটি ইভেন্টের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী অ্যাথলেট বা দল যথাক্রমে স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে। তিনটি পদক দেয়ার এ ফরম্যাট চালু হয় ১৯০৪ সাল থেকে। ১৯৪৮ সাল থেকে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানধারীদের সনদ দেয়ার ব্যবস্থা চালু হয় যেটা ভিক্টরি ডিপ্লোমা হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৪ সালে এসে সপ্তম ও অষ্টম স্থানও ভিক্টরি ডিপ্লোমার অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০৪ সালে অলিম্পিক যেবার তার আঁতুড় ঘর এথেন্সে ফিরে যায় সেবার পদকের সাথে গ্রিসের জাতীয় প্রতীক জলপাই পাতার মালাও দেয়া হয়। প্রাচীনকালে অলিম্পিকের বিজয়ের প্রতীক ধরা হত জলপাইয়ের মালাকে। একজন আইওসি সদস্য বিজয়ীদের পদক পরিয়ে দেবার পর বিজয়ীদের নিজ নিজ দেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই সঙ্গে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত দেশের জাতীয় সঙ্গীতও বাজানো হয়।
উপসংহার: প্রাচীন গ্রীসের গুরুত্বপূর্ণ প্রথার অন্যতম হলো অলিম্পিক। প্রাচীন অলিম্পিক গেমসে যতটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল ততটা ধর্মীয় উৎসবও ছিল। গ্রিক দেবতা জিউসের সম্মানার্থে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত এবং খেলার মাঝে একদিন জিউসের কাছে ১০০টি ষাঁড় বলি দেওয়া হত। এরপর সভ্যতার পথ পরিক্রমায় অলিম্পিক গেমস এখন পৃথিবীর প্রধান জমকালো খেলার আসরের মধ্যে একটি।