04 January, 2019

মুজিবনগর সরকার,বাংলা রচনা

(সংকেত: ভূমিকা; মুজিবনগর সরকার; মুজিবনগর সরকার গঠনের পটভূমি; আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন; মুজিবনগর সরকারের কাঠামো; মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ; স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ; মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম; উপদেষ্টা পরিষদ; স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা; বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা; উপসংহার।)
ভূমিকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হলো- মুজিবনগর সরকার। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন এবং ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেপথ্যে নীতিনির্ধারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় গঠনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীন কর্ম পরিকল্পনা ও বৈদেশিক সমর্থন আদায়ে এই সরকারের অবদান অনস্বীকার্য। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ সরকারের সকল নীতি নির্ধারণী ব্যক্তিদের জোর তৎপরতার মধ্য দিয়েই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
মুজিবনগর সরকার: মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অর্থাৎ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার, মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুজিবনগর সরকারের অবদান অপরিসীম। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এই সরকারের প্রধান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে এই সরকারের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর সরকার। প্রতিষ্ঠাকালীন মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগরে স্থাপিত হলেও পরবর্তীকালে এর সদর দপ্তর কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে স্থানান্তরিত করা হয়।
মুজিবনগর সরকার গঠনের পটভূমি: ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট সংগটিত হওয়ার সময় যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে তার আগ মুহূর্তে ২৫ মার্চ দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। এরপর ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূলত এই দিন হতেই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিচয় ফুটে উঠে। এদিকে ২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যার সময় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা তাজউদ্দিন আহমদ নিজ বাসভবন ছেড়ে পালিয়ে যান এবং সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেন। এরই মধ্যে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। তার সাথে ছিলেন ব্যারিস্টর আমীর-উল-ইসলাম। তারা ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের পূর্বে এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দিন আহমেদকে জিজ্ঞাসা করলেন যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোনো সরকার গঠিত হয়েছে কিনা। সেজন্য বৈঠকে তাজউদ্দিন ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন সরকারের প্রেসিডেন্ট আর আমি অর্থাৎ (তাজউদ্দিন) প্রধানমন্ত্রী। এভাবেই বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার গঠন: ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠক শেষে তিনি বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের M.N.A এবং M.P.A দের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। উক্ত অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী করে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভাষণ প্রদান করেন তাজউদ্দিন আহমদ।
মুজিবনগর সরকারের কাঠামো: ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় মুজিবনগর সরকার। এই সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। শপথ গ্রহণের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সরকার। মুজিবনগর সরকারে কাঠামো বা মন্ত্রিসভা নিম্নে দেওয়া হলো।
রাষ্ট্রপতিঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুর রহমান
উপ-রাষ্ট্রপতিঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম
প্রধানমন্ত্রীঃ তাজউদ্দিন আহমদ
অর্থমন্ত্রীঃ ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রীঃ এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান
পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীঃ খন্দকার মোশতাক আহমদ
প্রধান সেনাপতিঃ কর্ণেল (অব.) এম.এ.জি ওসমানী
চিফ অব স্টাফঃ কর্ণেল (অব.) আবদুর রব
ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এবং বিমান বাহিনী প্রধানঃগ্রুপ ক্যাপেন এ.কে. খন্দকার
[উৎস: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: তৃতীয় খন্ড, পৃ-১৬-১৭]
মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ: মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল সংক্ষিপ্ত। দেশি-বিদেশি ১২৭ জন সাংবাদিক, কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি বর্গের উপস্থিতির মাধ্যমে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। শপথবাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এই ঘোষণাপত্রটি আগেও ১০ এপ্রিল প্রচার করা হয় এবং এর কার্যকারিতা ঘোষণা করা হয় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই ঐ অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তার ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিশ্বের দেশসমূহের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা পরিষদ: মুজিবনগর সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষ্য ছিল দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা। এজন্য ন্যাপের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিংহ ও কংগ্রেসের শ্রী মনোরঞ্জন ধরের সমন¦য়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। যারা মুজিবনগর সরকারকে যুদ্ধকালীন সময়ে দেশ পরিচালনায় সহযোগিতা করতো।
স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুজিবনগর সরকার নীতি নির্ধারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এই সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সকল ক্ষেত্রেই বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা এবং বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায়ের জন্য তৎপরতা চালায়। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় গঠন করে দেশের নিগৃহীত-নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং যুদ্ধকালীন সময়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। এই সরকারের উপ-রাষ্টপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করে বাংলাদেশের সাহায্যের আবেদন জানালে তিনি সম্মত হন।
বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা: যুদ্ধকালীন সময়ে বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিশেষ দূত হিসেবে পাঠানো হয় বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সমর্থন ও জনমত আদায়ের জন্য। এছাড়া বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, সুইডেন ও অন্যান্য কতিপয় প্রভাবশালী দেশের সমর্থন লাভের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। তৎকালীন সময়ে কলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহোমসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মিশন স্থাপন করা ছিল এই সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এই সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এপ্রিল মাস থেকে পাকিস্তান দূতাবাসের অনেক বাঙালি পক্ষত্যাগ করে। মে মাসের প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান সরকারের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে যান। তার তৎপরতার ফলে বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে। এছাড়া ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মুজিবনগর সরকারের ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য পাঠানো হয়। এই অধিবেশনে উপস্থিত ৪৭টি দেশের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ঘটনা শুনে সহানুভূতি প্রদর্শন করেন। এভাবে মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিল।
উপসংহার: মুজিবনগর সরকার শুধুমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষাই নয় বরং বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনসমর্থন আদায়ের জন্য জোর তৎপরতা চালায়। মুজিবনগর সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণেই বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আর্বিভূত হয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাথে এই সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য। তাই আমাদের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মুজিবনগর সরকারের নাম।

ইসমাইল হোসেন