প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) এরপর আর কোন নবী রাসূল আসবেন না। যুগে যুগে পথ হারা মানুষের সামনে আদর্শবাদী ও সুন্দর চরিত্রের মানুষ আসবেন। তারা মহানবীর উম্মতের মধ্য থেকেই আসবেন। তারা নতুন কোন ধর্ম বা আদর্শ প্রচার করবেন না। বরং ইসলারেম সত্যকেই নিজেদের জীবন দিয়ে সকলের সামনে সুন্দরভাবে তুলে ধরবেন। তাদের চরিত্র ও স্বভাব হবে মার্জিত, আকর্ষণীয় ও অনুপম। তাদের চরিত্র, স্বভাব ও জীবন যাত্রা দেখে কোটি কোটি মানুষ ফিরে আসবে সত্য ও ন্যায়ের পথে। ইমাম গাজ্জালীও ছিলেন তাদেরই একজন।
সেটা ছিল একাদশ শতাব্দী। এ সময় মানুষ অশিক্ষা, সুশিক্ষা, কুসংস্কার ও নানা পাপ কাজে লিপ্ত হতে শুরু করে। অপর দিকে শিক্ষিত যুব সমাজ পাশ্চাত্যের অমুসলিম দার্শনিকদের ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী হয়ে ইসলামের সত্য পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল্ এসময় সত্য ও সুন্দরের ঝান্ডা নিয়ে আলোর মশাল হাতে করে এগিয়ে এলেন মুজাহিদ ইমাম গাজ্জালী (র)।
ইরানের একটি প্রদেশের নাম খোরাসান। এই খোরাসানে তুস নগরীতে ১০৫৮ খৃষ্টাব্দে ইমাম গাজ্জালী জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম গাজ্জালীর আসল নাম আবু হামেদ মোহাম্মদ গাজ্জালী। কিন্তু সকলের কাছে তিনি ইমাম গাজ্জাীল নামেই পরিচিত। ‘গাজ্জাল’ শব্দের মানে হচ্ছে সুতা কাটা। এটা তার বংশগত উপাধি। সম্ভবত তাঁর পিতা বা তাদের বংশকে গাজ্জালী বলেই ডাকতো।
এমাম গাজ্জালীর পিতা ছিলেন গরীব। এর উপর শৈশবেই তিনি পিতাকে হারান। তাঁর মা অনেক কষ্ট করে তাকে লাল পালন করেন। পিতার ইন্তেকালে তিনি এতিম হয়ে পড়লেও মনের সাহস হারাননি। জ্ঞান লাভের প্রতি ছিল তার খুবই আগ্রহ। জ্ঞান অর্জনের সাধনায় তিনি খাবার দাবার বা ভাল পোষাকের প্রতি কোন খেয়াল করেননি।
সে সময় দু’জন আলেম জ্ঞান সাধক হিসেবে বিখ্যাত হন। িএদের একজন হলেন হযরত আহমদ ইবন আহমদ ইবনে মুহাম্মদ বারকারী এবং অপরজন হচ্ছেন হযরত আবু নসর ইসমাইল। আবু হামেদ এই দুই শিক্ষকের কাছে কোরআন, হাদীস, ফেকাহ ও বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু তিনি এতেও সন্তুষ্ট হলেন না। আরো জ্ঞান অর্জনের জন্য পাগল পারা হয়ে ছুটলেন নিশাপুরের নিযামিয়া মাদ্রাসায়। সেকালে এই নিশাপুর ছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের পীঠস্থান। এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল ছিলেন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুল মালিক (র)। আবু হামেদ তাঁর নিকট ইসলামী দর্শন, আইন ও নানান বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।
আবদুল মালিকের ইন্তেকালের পর আবু হামেদ চলে আসেন বাগদাদে। এখানে ছিল বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিনি িএকটিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি গবেষণা চালাতে থাকেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তার সুনাম আর সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
কিন্তু তিনি যে জ্ঞান অর্জন করেছেন তার মধ্যেই নিজেকে দৃপ্দ তরদে পারলেন না। সর্বদাই তার মনে একটা ব্যকুলতা একটা অতৃপ্তি-তিনি মহান আল্লহপাককে এখনো পাননি। তাকে গভীর ভাবে পাওয়ার জন্য তিনি সুখের চাকরী ছেড়ে দিলেন। কষ্ট আর দুঃখের পথে বের হয়ে পড়লেন। এ পথে যাওয়ার জন্য কেউ তার সামনে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। ধন-সম্পদ ঘর বাড়ী কোন কিছুই তাকে বেধে রাখতে পারেনি। দশটি বছর তিনি আপন ভোলা খোদা প্রেমিক দরবেশের মত ঘুরে বেড়ান নানান দেশে। এ সময় আল্লাহর এবাদত জিকির, আজকার, মোরাকাবা, শিক্ষাদান ও জ্ঞান অর্জনের মধ্যদিয়ে তার সময় কাটাতে থাকেন। জেরুজালেম থেকে মদীনায় যান। প্রিয়নবীর মাজার জিয়ারত করে মক্কায় চলে আসেন। সেখানে হজ্ব পালন করেন। পরে আলেকজান্দ্রিয়ায় যান। বেশ কিছুদিন সেখানে থাকেন। পরে ফিরে আসেন মাতৃভমি ইরানে।
আবু হামেদ সত্যিকার জ্ঞানী ছিলেন। তিনি আল্লাহর পরিচয় ও সৃষ্টি রহস্য খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন আত্মা বা রুহ সৃষ্টি রহস্য আর আল্লাহর অস্তিত্ব বৈজ্ঞানক যুক্তিতর্ক দিয়ে মীমাংসা করা যাবে না। েএরকম চেষ্ট করা নির্বোধের কাজ এবং তা’ অন্যায়। তিনি সকল প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন কোরআন, হাদিস দ্বারা। এছাড়া কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে গবেষণা চালিয়ে তিনি অনেক প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন।
আল্লাহর প্রতি সুগভীর বিশ্বাস ও দ্বীন ইসলামের প্রতি তার আস্থা ছিল পর্বতের মত অটুট। ধর্ম ও দর্শনে আবু হামেদ ছিলেন মহাপন্ডিত। তার পরেও তিনি ছিলেন বিনীয় ও নম্র। তিনি বলেন, আত্মা কখনো ধ্বংস হয় না, বরং দেহ ধ্বংস হয়। মৃত্যুর পরেও আত্মা জীবিত থাকে। কলব বা হৃদপিন্ডের সাথে আত্মার কোন সম্পর্ক নেই। হৃদপিন্ত একটা মাংসপিন্ড ছাড়া আর কিছু নয়। মৃত্যুর পরেও দেহে এর অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু আত্মা মৃতদেহে থাকে না। মৃত্যুর পর আত্মার পূর্ণ উৎকর্ষ ও মুক্তি সম্ভব হয়। আবু হামেদ জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শের সঠিক রূপায়ন ঘটিয়েছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে কোনটি গ্রহনীয় আর কোনটি বর্জনীয় তা’ তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। যা চিরন্তন সত্য ও বাসতব সেখানে তিনি যুক্তিকে প্রাধান্যি দিতেন না। বরং সেক্ষেত্রে তিনি ভক্তি ও অনুভূতির প্রতিই গুরুত্ব দিতেন বেশী।
আবু হামেদ অংকশাস্ত্র ও জ্যোতিবিজ্ঞানে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিন নক্ষত্র সমূহের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে ২টি গ্রন্থ রচনা করেন। িএছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় চার হাজার গ্রন্থ রচনা করেন। তার বেশীর ভাগ গ্রন্থ ইউরোপে ল্যাটিন হিব্রু ও ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তার লেখা গোটা ইউরোপে অসাধারণ প্রবাব বিস্তার করে। তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে (১)এহিয়া উল উলুমুদদীন (২) কিমিয়ায়ে সায়াদাত বা সৌভাগ্যের পরশমনি। (৩) কিতাবুল মানফিদলিন আদদালাল (৪) কিতাবুত তাকাফাতুল ফালাসিফা (৫) মিশকাতুল আনোয়ার (৬) ইয়াক্কুত্তাবলিগ (৭) মনখুল। এসব বই ইউরোপে অনুদিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আবু হামেদের এসব গ্রন্থ ইসলামী জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এর ফলে সে সময় মুলমান যুব সমাজ সঠিক পথের সন্ধান লাভে সক্ষম হয়।
আবু হামেদ সর্বদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতেন। আল্লাহকে পাবার জন্য তিনি ঘরবাড়ি ছেড়েছেন। আল্লাহকে খুশী করার জন্র তিনি সারাটা জীবন দেশ বিদেশে আত্মহারা হয়ে ঘুরেছেন। মৃত্যুই বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার পর্দাকে সরিয়ে দেয়। তিনি তার মৃত্যুর আগমনবার্তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই যেদিন তার পৃথিবী ছাড়ার সময় হল তিনি তা বুঝতে পারলেন। সেটা ছিল ১১১১ খৃঃ। তার কোন অসুখ ছিল না। বরং সুস্থই ছিলেন তিনি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন। িইতোপূর্বে কাফনের কাপড় নিজ হাতে তৈরী করেছিলেন। সে কাপড়টি বের করে বললেন, হে আল্লাহ, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। তুমি তো রহমান ও রাহীম। হে আল্লাহ একমাত্র তোমাকে পাবার জন্য এবং তোমাকে চেনার জন্যই আমি সব আরাম আয়েশ ছেড়ে পথে পথে ঘুরে ফিরেছি বছরের পর বছর পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
এরপর তিনি কাফনের কাপড় পরেন ও ইন্তেকাল করেন। তিনি পৃথিবী ছেড়ে গেলেও চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন সত্য ও সুন্দরের সাধক মানুষের কাছে।
No comments:
Post a Comment