01 November, 2018

বাংলা ব্যাকরণ ভাবসম্প্রসারণ ৪১-৬০

হাতে কাজ করায় অগৌরব নেই, অগৌরব হল মিথ্যায়, মূর্খতায়

মানুষের প্রকৃত পরিচয় কর্ম ও সাফল্যের ওপর নির্ভর করে। জীবনে উন্নতির মূল চাবিকাঠি হচ্ছে পরিশ্রম। দৈহিক শ্রম দ্বারা মানুষ তার নিজের ভাগ্যকে নির্মাণ করে। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা কায়িক শ্রমকে ছোট মনে করে, নিজে কাজ করতে অপমানবোধ করে এবং মিথ্যা আর মূর্খতা দ্বারা নিজের গৌরব বৃদ্ধি করতে চায়। কিন্তু মিথ্যা পদে পদে তাদের ধ্বংস ডেকে আনে। 

মূর্খতা তাদের জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। যুগ যুগ ধরে কুলি মজুরের মতো লক্ষ কোটি শ্রমজীবী মানুষের হাতে গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতা। এদেরই অক্লান্ত শ্রম আর ঘামে মোটর, জাহাজ, রেলগাড়ি চলছে, গড়ে উঠেছে আকাশছোঁয়া দালানকোঠা। আমাদের দেশের কৃষকরা আমাদের খাদ্যের যোগান দিতে ঝড়-বৃষ্টি রোদ্র উপেক্ষা করে ফসল ফলায়। এ কাজ তাদের কঠিন সাধনার কাজ। 

এতে তাদের গৌরব কমে না এই কাজের মধ্য দিয়েই তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাধক রূপে পরিগণিত হয়েছে। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে এই শ্রমজীবী মানুষ। আমাদের পোশাক শিল্পকে শ্রম দ্বারাই টিকিয়ে রেখেছে শ্রমিকশ্রেণি। আধুনিক বিশ্বের চালিকা শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কাচাঁমাল কয়লা, যা উত্তোলন করে শ্রমিকরা। পৃথিবীতে যারা মহামানবের অবিধায় অভিসিক্ত হয়েছেন তারা কায়িক পরিশ্রম করেছেন। তাতে তাদের সম্মান কমেনি বরং বেড়েছে। 

অন্যের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা নেওয়ার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। আমেরিকার ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন- “পাঁচটি টাকা কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি টাকা উপার্জনের মধ্যে তৃপ্তি অনেক বেশি।” আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবে রুটির দোকানে কাজ করেছেন। হাতের কারুকার্যে চিত্রশল্পী কাজ হিসেবে পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়েছেন লিওনার্দো-দ্যা-ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো এবং ভ্যানগগের মতো ব্যক্তিবর্গ। মিথ্যা ও মূর্খতা নয় সাধুতা ও সত্যের ভিতর দিয়ে সত্তার মহিমা উদ্ভাসিত হয়। কাজের মাধ্যমে সমাজ স্বনির্ভর হয় এতে মানুষের অফুরন্ত শক্তির প্রকাশ ঘটে। 

শিক্ষা: আমাদের কর্মশক্তি ভরা দুটি সবল হাত রয়েছে যা দ্বারা জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন¦য়ে আমরা পেতে পারি সার্থক জীবনের সন্ধান এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার শক্তি।


স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন

প্রত্যেক মানুষের কাছেই স্বাধীনতা একান্ত কাম্য। কেউ পরাধীন থাকতে চায় না। তবে পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়া অনেক কঠিন। আবার স্বাধীন হওয়ার চেয়ে স্বাধীনতা ধরে রাখা আরো কঠিন। কারণ তখন স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি অনেক সোচ্চার থাকে। তাই স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম আরো বড় হয়ে সামনে আসে। শক্তিশালী শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে বহুকষ্টের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনলেও নানা কারণে তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। 

কারণ স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রথমদিকে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল থাকে। আর তখন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি নানাভাবে এসব দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায়। এসময় তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই নতুন স্বাধীন হওয়া দেশকে প্রথমে সুগঠিত করতে হয়। দেশের প্রতিটি মানুষকে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে অর্থনীতি, শিল্প, কৃষিসহ সকল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়। 

ফ্রান্সের বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ রোঁমা রোঁলা বলেছেন- “কোনো দেশ বা জাতিকে শুধু তার সীমান্ত রক্ষা করলেই চলবে না তার শুভ বুদ্ধিকেও রক্ষা করতে হবে। জাতি তার স্বাধীনতা রক্ষা করবে, পাশাপাশি রক্ষা করবে তার চিন্তা ও আত্মার স্বাধীনতা।” স্বাধীনতা অর্জন করতে যেমন সাহসী পদক্ষেপ নিতে হয় তেমনি রক্ষার জন্যও আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ও সংগ্রামী হতে হবে। স্বাধীনতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সকলকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ হতে হবে। 

স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে হবে এবং স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়ে সমস্ত বিরোধী শক্তির হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য দায়িত্ব সচেতন ও নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমিক হতে হবে। 

শিক্ষা: স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি জাতিকে বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আবার এই অর্জিত স্বাধীনতাকে ধরে রেখে নিজেদের অবস্থান আরো উন্নত করার জন্য দেশের সকলকে আরো বেশি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।



সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি থেকে অর্জিত শিক্ষা-এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষা মূলত পরীক্ষা পাশের শিক্ষা, জীবিকার্জনের শিক্ষা। সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এ শিক্ষা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তাই স্কুল কলেজের শিক্ষাকে প্রকৃত অর্থে সুশিক্ষা বলা যায় না। সুশিক্ষার অর্থ স্বশিক্ষা। 

স্কুল-কলেজের শিক্ষার পাশাপাশি স্বচেষ্টায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্ঞানান্বেষণ সুশিক্ষার পর্যায়ে পড়ে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি হবেন কুসংস্কারমুক্ত, তার চিন্তা হবে সুদূরপ্রসারী, বৈজ্ঞানিক ও মুক্তবুদ্ধির আলোকে উদ্ভাসিত। এমন অনেক ডিগ্রিধারী লোক আছেন যাদের শিক্ষার সঙ্গে বাস্তব জীবনচর্চার কোনো সামঞ্জস্য ঘটেনা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষের বাহ্যিক অবয়ব তৈরি করতে পারলেও তার অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে পারে না। 

মূলত শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য জ্ঞানশক্তি অর্জন করা। শিক্ষা সম্পূর্ণভাবে অর্জন সাপেক্ষ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান আহরণের পথ অনেক সময় সুগম হলেও তাতে পূর্ণতা আসে না। স্বশিক্ষায় অর্জিত জ্ঞান ছাড়া মানুষের অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত হয় না। স্বশিক্ষা মানুষকে সুদৃঢ়প্রসারী জ্ঞানদান করে। 

তখন তিনি বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হয়ে উঠেন, পরিশীলিত রুচিবোধে হয়ে উঠেন উদার ও নম্র স্বভাবের। বস্তুত প্রকৃত শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান মুখ্য নয়। পৃথিবীতে অনেক স্বশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন, যারা প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই মুক্ত চিন্তা ও জ্ঞান দিয়ে মানবতার উপকার করে গেছেন। এ প্রসঙ্গে সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামের কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। স্বচেষ্টায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এঁরা জ্ঞান রাজ্যে বিচরণ করেছেন। তাই বলা যায় যারা প্রকৃত অর্থেই শিক্ষিত আর জ্ঞানী তারা সকলেই স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। 

শিক্ষা: গুরুর শিক্ষা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধ শিক্ষা মানুষকে সুশিক্ষিত করে না। সুশিক্ষা অর্জন হয় আত্মপ্রচেষ্টা, আগ্রহ ও অধ্যয়নের মাধ্যমে।



সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে

প্রতিটি সমাজেই কিছু আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর মানুষ বাস করে। তারা সমাজের প্রতি দায়িত্ব ভুলে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজ এবং সমাজের সদস্যদের প্রতি প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের মধ্য দিয়েই মানুষ সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে এই সমাজ। 

আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সমাজের অবদান রয়েছে তেমনি সমাজের প্রতিও রয়েছে আমাদের দায়িত্ব। সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে হলে ব্যক্তিস্বার্থের চিন্তা পরিহার করে চলতে হয়। স্বার্থবাদী চিন্তা নিয়ে সমাজের উন্নয়ন যেমন সম্ভব না তেমনি ব্যক্তি জীবনেও সাফল্য আসে না। সকলের সহযোগিতায় গড়া সমাজ যেন আনন্দ-কানন। সমাজের অন্য সদস্যরা যাতে ব্যক্তিস্বার্থের সংকীর্ণতার শিকার হয়ে কষ্ট না পায় সেটাই হওয়া উচিত সব মানুষের কামনা।

আর এর জন্য প্রয়োজন স্বীয় স্বার্থ ত্যাগ করা। কারণ অন্যের উপকারে উৎসর্গিত জীবনই প্রকৃত জীবন। পরোপকারী মানুষ অমর এবং সর্বজন পূজনীয় হয়। বিবেক এবং চিন্তার শক্তিই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে। সুতরাং বিবেকবান কোনো মানুষই নিজের স্বার্থের কথা ভেবে সমাজ এবং চারপাশের মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব ভুলে যেতে পারে না। বিবেকবান মানুষমাত্রই পরোপকারী এবং সমাজসেবক হয়ে থাকেন। আর সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে তাহলে সমাজ হয়ে উঠবে সুন্দর। 

শিক্ষা: ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে মানবতার স্বার্থে নিয়োজিত হওয়াই মানবজীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর এর মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।



রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকটে আসে

জীবনের চলার পথে আসে অনেক বাধা-বিপত্তি। সেসব বাধাকে অতিক্রম করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বন্ধুর পথ ডিঙিয়ে সফলতার পানে এগিয়ে যাওয়াই জীবনের লক্ষ্য। অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে সকল বাধা, ভয়কে অতিক্রম করেই করতে হয় সুখের সন্ধান। বিশ্বসংসারে সকল কিছু একটি নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হয়। প্রাকৃতিক এই নিয়মে দিনের শেষে রাত, রাতের শেষে দিন আসে। 

ঠিক তেমনি জীবন চলার পথে দুঃখ-বেদনা আসে। কিন্তু সুখের আগমনে জীবন আবার সজীব হয়ে ওঠে। পৃথিবী বিপরীতমুখী বস্তুর খেলায় প্রতিনিয়ত আবর্তিত। আলো-আঁধার, দিন-রাত, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভালো-মন্দ ইত্যাদি বিপরীতমুখী অনুষঙ্গ একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রকৃতির এই বন্ধন পৃথিবীকে দিয়েছে টিকে থাকার মন্ত্রণা। একটির অর্বতমানে অপরটির অবস্থান স্পষ্ট হয়। পার্থিব জীবনেও এই সাদৃশ্য লক্ষণীয়। সফলতা-ব্যর্থতা, উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ পর্যায়ক্রমে জীবনে আসে। 

আজ যারা সুখে জীবন-যাপন করছেন তাদের সুখ এসেছে নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে। এ জগতে কোনো কিছুই স্থায়ী হয় না। নিরবচ্ছিন্ন সুখ কিংবা নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ সাধারণত পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না। তাদের পালাবদল ঘটে রাত-দিনের মতোই। রাত যদি দুঃখের প্রতীক হয় তাহলে সুখের প্রতীক হলো দিন। রাতের পর যেমন দিন আসে তেমনি দুঃখের পর আসে সুখ। তবে সুখের সন্ধান পেতে হলে দুঃখকে জয় করতে জানতে হয়। দুঃখ জীবনকে, হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। চলার পথে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। 

পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে উদ্যমতার সঙ্গে এসব বাধাকে অতিক্রম করে সুখকে ছিনিয়ে আনতে হয়। দুঃখের অন্ধকার যতই গভীর হোক ধৈর্য, সহিষ্ণুতার মাধ্যমে তা জয় করা সম্ভব। 

শিক্ষা: দুঃখ দেখে, পরাজয়কে দেখে ভয় পেলে চলবে না। মেধা-মননের সমন্বয়ে সাহসী উদ্যোগে জীবন-চলার পথকে মসৃণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে দুঃখের পরেই সুখ আর আনন্দ জীবনকে ছুঁয়ে যাবে।



যতক্ষন শ্বাস, ততক্ষন আঁশ

মানুষের চলার পথ মসৃণ নয়। প্রতিটি পদক্ষেপ নানা বাধা-বিপত্তিতে ভরা। চাওয়ার সাথে পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে আশায় বুক বাঁধে। অসংখ্য তরঙ্গ যেমন সাগরকে বিক্ষুদ্ধ করে, তেমনি দুঃখ-কষ্ট সংসার জীবনে মানুষকে করে তোলে হতাশ বিপর্যস্ত। 

ভেলা ভাসিয়ে মানুষ যেমন উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেয় তেমনি আশার তরীতে ভেসে মানুষ সংসারের সাগরকে অতিক্রম করে। উত্তাল সাগরে মানুষের অবলম্বন হয় ভেলা আর সংসারে মানুষের অবলম্বন হয় আশা বা স্বপ্ন। সমস্যা এবং দুঃখ স্থায়ী নয়। আজকের দিনের সমস্যা এবং দুঃখ একদিন না একদিন শেষ হবে। অন্ধকার কালো রাতের পর নতুন ভোর আসবে। 

দুঃখের দিনের একদিন অবসান ঘটবে, এই আশাতেই মানুষ সকল দুঃখ কষ্টকে অতিক্রম করে। আশা না থাকলে কোনো মানুষ বাচঁতে পারতো না এক মুহুর্তের জন্যেও। যেদিন মানুষ স্বপ্ন দেখা ভুলে যাবে, সেদিনই তার কাছে বেঁচে থাকা মূলহীন হয়ে পড়বে। এই জগতের কোনো কিছুই আর তাকে আকর্ষণ করবে না। আশা বা স্বপ্ন মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। 

সাফল্যের পথে প্রেরণা যোগায় প্রতিটি ক্ষণে। ভবিষ্যতের আশা বা স্বপ্ন প্রেরণা যোগায় বলেই, বর্তমানকে আমরা মেনে নিতে পারি। 

শিক্ষা: আশা বা স্বপ্ন আছে বলেই, নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পৃথিবী আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ভোর আসবে এই বিশ্বাস আছে বলেই, মানুষ অত্যন্ত সহজভাবে জীবনকে গ্রহণ করেছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে একেকটি নতুন স্বপ্নের দিকে।



মোদের গরব মোদের আশা আ-মরি বাংলা ভাষা

প্রত্যেক দেশেরই একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যে ভাষায় সে দেশের মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে। তাই সম্পর্ক সৃষ্টির প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা। জন্মের পর থেকে শিশু তার মায়ের মুখ থেকে আধো আধো করে যা বলতে শিখে তা হলো তার মায়ের ভাষা। বাংলা হলো আমাদের মায়ের ভাষা। আমাদের হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা সবকিছুর প্রকাশ ঘটে বাংলা ভাষার মাধ্যমে। 

বাংলা ভাষার রয়েছে গৌরবোজ্জল ইতিহাস যা অন্য কোন জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মানুষ ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। কিন্তু বাঙালি এক জাতি যারা ভাষার জন্যে আন্দোলন করে জীবন দিয়েছে। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করে এদেশের মানুষকে তা মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু বাংলার ছাত্রসমাজ তথা আপামর জনতা তা মেনে নেয়নি। 

ফলে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে তার প্রতিবাদে মিছিল করতে গিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকেই প্রাণ দিয়েছে ভাষার জন্য। ফলে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। অবশেষে পাকিস্তানের সংবিধানে ১৯৬৫ সালে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। 

পরবর্তীতে ইউনেস্কো বাঙালিদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। অতএব আন্দোলন সংগ্রামের ফলে বাংলা ভাষা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আমাদের জাতীয় চেতনায়। তাই বাংলা ভাষা আমাদের আশা অকাঙ্ক্ষা ও গর্বের বিষয়। 

শিক্ষা: বাংলা ভাষা আজ বিশ্বময় সমাদৃত। এ অর্জন বাংলাদেশের ক্ষুদ্র মানচিত্রকে উজ্জ্বল করেছে। তাই ভাষার চেতনাকে জাগ্রত রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।



মঙ্গল করিবার শক্তিই ধন, বিলাস ধন নহে

মানুষের কঠোর পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে আজকের সভ্যতা। তাই পৃথিবীর সকল ধন সম্পদে প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে। কিন্তু কোটি কোটি অসহায় মানুষকে বঞ্চিত করে কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। তারা আত্মসুখ, ভোগ, চিত্তবিনোদন ও বিলাসিতায় এই সম্পদের অপব্যবহার করে। তাই তাদেরকে প্রকৃত ধনী ও ক্ষমতাবান বলা যায় না। 

প্রকৃত ধনী হতে হলে দেশ, সমাজ ও মানবকল্যাণে সম্পদ ব্যয় করার মহৎ চিন্তা থাকতে হবে। কেননা বিত্তবানের সম্পদের সার্থকতা নির্ভর করে সম্পদের সদ্ব্যবহারের ওপর। মহৎ ব্যক্তিরা সম্পদকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করে। তারা অসহায়কে সাহায্য করতে, আর্ত-পীড়িতদের সেবা করতে, দুঃস্থ মানবতার পাশে দাঁড়াতে সম্পদ ব্যয় করে। ব্যক্তি বিশেষের সুখভোগ ও বিলাসিতায় ব্যবহৃত ধন শুধু অপব্যয় নয়, তা সমাজে অকল্যাণ বয়ে আনে। পবিত্র কোরআনে আছে- ‘অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। 

’সম্পদশালীর অঢেল সম্পদ অর্জিত হয়েছে দরিদ্র-নিপীড়িত জনগণের শ্রমে। যে সমাজে মানুষ নিরন্ন ও নিরাশ্রয় অবস্থায় ধুকে মরে, বিনা চিকিৎসায় রোগযন্ত্রণায় ও ক্ষুধায় ছটফট করে, সেখানে বিলাসবহুল জীবনযাপন অন্যায়। এমন সমাজে মনুষ্যত্ব টিকে থাকতে পারে না। মানবকল্যাণ ও সমাজের অগ্রগতিতে সম্পদের ব্যবহারেই সম্পদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়। 

ধনসম্পদ দুঃখী আর অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে যতো বেশি কাজে লাগে তার সার্থকতা ততো বেশি। প্রকৃত সম্পদশালী তার সঞ্চিত সম্পদ দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজে লাগায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনে। অনেক মানুষ নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে কেবল দরিদ্র, অসহায় ও আর্তপীড়িতদের কথা ভাবেন। মানুষের কল্যাণে তারা জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত থাকেন। তাই অর্থ বিত্ত থাকলেই হবে না, মানুষের কল্যাণে তা ব্যয় করার ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে। মহৎ কাজে ধন সম্পদের ব্যবহার মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে জীবনকে সার্থক করে তোলে। শিক্ষা: সঞ্চিত ধন-সম্পদ আত্মসুখভোগ ও বিলাসিতায় অপব্যয় না করে মানবতার কল্যাণে ব্যয় করা প্রয়োজন। যে ধন মানবকল্যাণে ব্যয়িত হয় না সে ধনের কোনো মূল্য নেই।



বিদ্যার সাধনা শিষ্যকে নিজে অর্জন করতে হয়, গুরু উত্তরসাধক মাত্র

শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জন হলো সাধনার ব্যাপার। তবে এই সাধনার সাধক হতে হবে শিষ্যের নিজেকেই। একজনের সাধনা কখনও অন্য কেউ করে দিতে পারে না। যার সাধনা তাকেই সাধন করতে হয়। অন্যথায় সাধনার ফলাফল কখনই আশানুরূপ হয় না। আমাদের অনেকের মধ্যেই একটি বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তা হলো গুরু বা শিক্ষকের উপর সম্পূর্ণ ভরসা করে বসে থাকা। 

আমাদের এই প্রবণতার কারণেই আমাদের শিক্ষা শতভাগ পরিপূর্ণ হয় না। গুরু কিংবা শিক্ষক নিঃসন্দেহে একজন ছাত্রের নিকট ভরসার পাত্র হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, গুরুই তার শিক্ষাকে অন্তরে গেঁথে দেবেন। অন্তরে গেঁথে দেওয়ার দায়িত্ব গুরুর নয়। গেঁথে নেওয়ার দায়িত্ব শিষ্যের। গুরু বড়জোর পথ দেখিয়ে দিতে পারেন। গুরু শুধুমাত্র শিষ্যকে বলে দিতে পারেন কোন পথ তার জন্য উত্তম, কোন পথে, কিভাবে হেটে গেলে সে তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুর দেখা পেতে পারে। 

কিন্তু এরপরের সব দায়িত্বই শিষ্যের। গুরুর দেখানো পথে, গুরুর নির্দেশিত পন্থায় হেটে যেতে হবে শিষ্যের নিজেকেই। সঠিকভাবে সে পথ পাড়ি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি অর্জন করে আনা শিষ্যেরই দায়িত্ব। আমরা প্রায়ই ছাত্রের খারাপ ফলাফলের জন্যই শিক্ষককেই দোষারোপ করি। কিন্তু খারাপ ফলাফলের জন্য কখনও শিক্ষক দায়ী নয়, বরং ছাত্ররাই দায়ী। কিন্তু শিক্ষকের দেখানো পথে ছাত্র যদি হাঁটতে না পারে সে অযোগ্যতা শুধুমাত্র ছাত্রের।শিষ্য পথভ্রষ্ট হলে সে ত্রুটির ভার শিষ্যকেই বহন করতে হয়। সে ভার গুরুর উপর চাপিয়ে দিলে তা কখনও সুবিচার হয় না। গুরু সর্বদাই শিষ্যের মঙ্গল কামনা করেন এবং কল্যাণের পথই দেখিয়ে থাকেন। কিন্তু সেই কল্যাণ সাধনে যদি শিষ্যের সাধনায় ত্রুটি থাকে, তবে তা একান্তই শিষ্যের অপারগতা। 

শিক্ষা: বিদ্যা অর্জনের জিনিস। আর অর্জন করতে হলে চাই সাধনা। সে সাধনায় গুরু উত্তরসাধক হতে পারেন বটে। তবে তার বেশি কিছু নয়। নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে, এবং নিজের শিক্ষাকে চিরস্থায়ী করতে, যে সাধনার প্রয়োজন তা শিষ্যকেই সঠিকভাবে করতে হয়।



প্রয়োজনে যে মরিতে প্রস্তুত, বাঁচিবার অধিকার তাহারই

মানবজীবন ক্ষণস্থায়ী। এ জন্য মৃত্যু ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকলে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায় না। মৃত্যু ভয়ে সদা ভীত যে ব্যক্তি সে বেঁচে থেকেও মৃত। বাঁচার মতো বাঁচতে হলে মহৎ ত্যাগের মধ্য দিয়ে জীবনকে সার্থক করে তুলতে হবে। 

মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের ত্যাগের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে সমাজ ও সভ্যতা। এই সকল ব্যক্তিরাই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যোগ্য। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু ভয়ে ভীত যে ব্যক্তি তার জীবন অর্থহীন। জীবনকে সার্থক করে তুলতে হলে মৃত্যু ভয় পরিত্যাগ করতে হবে। 

বস্তুত কাজের মধ্যেই জীবনের প্রকৃত মর্যাদা। আর যেকোনো কাজই কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কোনো কোনো কাজে এই ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। যারা প্রকৃত মানুষ তারা কোনো কাজেই ভয় করে না বরং সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যায়। জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে এরাই খনি থেকে মূল্যবান সম্পদ তুলে আনে। এরাই স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দেয়। 

পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে তুলতে এইসব মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষেরাই যুগে যুগে প্রাণ দিয়েছে বন্য প্রাণীর হাতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে। এসব মরণজয়ী সাহসী বীরের হাত ধরেই সমাজ ও জাতীয় জীবনে সফলতা আসে। যারা প্রকৃত বীর তারা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সফলতার পথে এগিয়ে যায়। এ পথে যদি তাদের মৃত্যু আসে তবু তারা হাসিমুখে সেই মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। 

বেঁচে থাকা তাঁদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয় বরং আসন্ন মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করার মধ্যে দিয়ে তারা লাভ করে অমরত্ব। যেমনিভাবে পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে আছেন সক্রেটিস, আইনস্টাইন, নিউটন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রমুখ। এই অমরত্ব লাভের জন্য প্রয়োজন সাহসী মনোভাব, মহৎ কর্ম এবং প্রয়োজনবোধে আত্মত্যাগ। 

শিক্ষা: মৃত্যুর মতো ভয়াবহ সত্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে জীবনের প্রতিটি আনন্দঘন মুহূর্ত মৃত্যুভয়ে নষ্ট করা বোকামী। বরং মৃতুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে জীবনকে যে উপভোগ করতে পারে একমাত্র সে-ই বেঁচে থাকার স্বাদ নিতে সক্ষম।



নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভাল, যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো

মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আর সেই ভুলের সুযোগ নেয় নিন্দুক। মানুষের ছোট বড় দোষ ত্রুটি নিয়ে কুৎসা রটনা করে বেড়ানোই নিন্দুকের কাজ। ফলে আমরা নিন্দুকের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। প্রকৃত পক্ষে নিন্দুক আমাদের ক্ষতির চেয়ে উপকারই বেশি করে। আমাদের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে নিন্দুক আমাদেরকে খাঁটি মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। 

নিন্দুকেরা মানুষের ভুল গুলো নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে। এর দ্বারা মূলত ভুলকারী ব্যক্তিকে সে সচেতন করে তোলে। যা প্রকৃত অর্থেই ইতিবাচক। যে ব্যক্তি বন্ধুর ভুল ধরিয়ে না দিয়ে কেবল প্রশংসা করে চলে, সে কখনই প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। কারণ ঐ বন্ধুর এক তরফা প্রশংসা তার জীবনকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। 

কিন্তু নিন্দুক সারাক্ষণই ওঁৎ পেতে থাকে, মানুষ কখন কি ভুল করে, সেই ভুলের সূত্র ধরে সে নানা কথা বলে বেড়ায়। সকলের কাছে নিন্দা করে বেড়ায়। ফলে নিন্দুকের ভয়ে মানুষ সাবধান থাকে। সকল প্রকার দোষ ত্রুটি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কোনো কাজ করার আগে নিন্দুকের ভয়ে মানুষ অনেক বার চিন্তা করে। নিন্দুক যদি না থাকত, তাহলে মানুষ কোনো ভুল করার আগে চিন্তা করার প্রয়োজনবোধ করতো না। তাই মানুষকে ভুল থেকে দূরে রাখতে এবং অকল্যাণ কর্মতৎপরতা থেকে মুক্তি দিতে নিন্দুকের তুল্য কেউ নেই। 

শিক্ষা: নিন্দুক আমাদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে সংশোধিত হবার সুযোগ করে দেয়। ফলে আমাদের ব্যক্তি জীবন ও সমাজজীবনে ত্রুটি বিচ্যুতির পরিমাণ অনেকাংশেই কমে যায়।


ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর, বাধ বাধ বুক সংসারে সহস্র দুঃখ আসিবে আসুক

জগত সংসারে সুখ-দুঃখ মিলিয়েই মানবজীবন। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই আছে বিপদ-আপদ, বাধা-বিঘ্নে, দুঃখ কষ্ট। এসব প্রতিকূলতাকে জয় করে টিকে থাকতে হলে মানুষকে ধৈর্য ও সহ্যশক্তি প্রদর্শন করতে হয়। দুঃখ আর ব্যর্থতাকে জয় করতে পারলেই জীবনে সুখ ও সাফল্য লাভ সম্ভব। 

দুঃখ দারিদ্র্য, অন্যায়-অত্যাচার, বিপদ আপদ কখনো কখনো মানব জীবনকে থামিয়ে দেয়। মানুষকে এসব প্রতিরোধ করে ধৈর্য নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয়। সাফল্য আর ব্যর্থতায় ভরা কর্মক্ষেত্রে মানুষ যদি ব্যর্থতাকে গ্রহণ করে পরবর্তীকালে সাফল্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তাহলে সে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। 

সহনশীল ও ধৈর্যশীল লোক জীবন সংগ্রামে পরাজয়ের মধ্যেও শক্তি সঞ্চয় করে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। পরাজয়, ব্যর্থতার কাছে সে নতি স্বীকার করে না। তাই ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিজের অধিকার আদায়সহ যেকোনো কঠিন কাজ করা সম্ভব। এ জগত সংসারে দুর্বল আর অসহায়কে সবলের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে জীবনে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। 

কেননা যার সহ্য ক্ষমতা নেই তার জীবন ব্যর্থতা আর হতাশায় পর্যবসিত হয়। কোনো কাজেই সে সাফল্য লাভ করতে পারে না। ধৈর্যের অভাবে তার জীবন নিয়ন্ত্রণহীন ও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তার পারিবারিক জীবনে দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মতো তিক্ততা নেমে আসে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কাজী নজরুল ইসলাম, রবার্ট ব্রুস প্রমুখ মহান ব্যক্তিত্ব জীবনে কখনো পরাজয়ের কাছে নতি স্বীকার করেননি। 

ধৈর্য সহকারে সকল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই সামনে এগিয়ে গেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়মাল্য পরেছেন। তাঁরা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে বেঁচে আছেন ও বেঁচে থাকবেন। কাজেই ধৈর্যসহকারে স্থির মস্তিষ্কে জীবনের সকল কঠিন কাজের সমাধান করতে হবে। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসেও সুন্দর জীবনের স্বপ্নে বুক বাঁধতে হবে। তবেই মানুষ সকল কঠিন কাজে সফল হবে। জগতসংসারে সম্মান ও খ্যাতি নিয়ে বেঁচে থাকবে। 

শিক্ষা: মানবজীবনে টিকে থাকতে ও সাফল্য লাভ করতে কঠিন বাস্তবতা ও বাধাবিপত্তির সাথে লড়াই করে সামনে অগ্রসর হতে হবে। ধৈর্য ও সহনশীলতার অনুশীলনই সাফল্যের চাবিকাঠি।



জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ঠ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব

অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের প্রধান পার্থক্য কেবল চিন্তা ও বুদ্ধিতে। আদিকাল থেকে মানুষ তার চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে নানা প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেকে রক্ষা করে এসেছে। জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে মানুষ বর্তমানে সভ্য জাতিতে পরিণত হয়েছে। নিজ বুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ নানা যন্ত্রপাতি আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। 

এতে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা হয়েছে সহজ। যে মানুষ জ্ঞানচর্চা করে না, সমাজের নানা সংস্কার, সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা এসে তাকে আঁকড়ে ধরে। তার জীবনে কোনো উন্নতিই হয় না। মানুষ হয়েও সে ভারবাহী জীব সাদৃশ্য জীবনযাপন করে। জ্ঞানহীন মানুষের কোনো মূল্য নেই। জ্ঞানচর্চা না করলে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি জাগ্রত হতে পারে না। ফলে সে ঠিক বেঠিক, ন্যায়-অন্যায় অনুধাবন করতে পারে না। এরকম মানুষের দ্বারা যেকোনো অন্যায় কাজ করা স্বাভাবিক। একমাত্র জ্ঞানই মানুষকে প্রকৃত মুক্তি দিতে পারে। 

যে ব্যক্তি জ্ঞানতাপস সে তার বুদ্ধির পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে। তার নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। সে তার বুদ্ধি-বৃত্তির মাধ্যমে নিজের এবং আশপাশের মানুষের উন্নয়ন ঘটাতে পারে। জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব ব্যক্তিজীবনে যেমন প্রয়োজন, তেমনি জাতীয় জীবনেও অত্যাবশ্যকীয়। জ্ঞানচর্চা একটি দেশ ও জাতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সাহায্য করে। সমাজ থেকে অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার মুছে দিয়ে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করে। মুক্তবুদ্ধি চর্চা একটি দেশ ও জাতিকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা দেয়। যে জাতির বুদ্ধির বিকাশ ঘটে না সে জাতি অন্ধকারে পড়ে থাকে। নানা অন্যায়, অবহেলা, কুসংস্কার তাদের ঘিরে ধরে। জ্ঞানহীন জাতির কোনো উন্নয়ন সম্ভব হয় না। 

শিক্ষা: জ্ঞানের আলো মুক্তির পথ দেখায়। তাই অন্যায়-অবিচার, দুঃখ-দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য মানুষের জ্ঞানচর্চা করা উচিত।




জাতীয় অবিচার জাতীয় পতনের নিশ্চিত কারণ

আইনের শাসনের অভাব জাতীয় অবিচারের মূল কারণ। আর জাতীয় অবিচার দেশ ও জাতিকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়। সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে জাতীয় অবিচার উদ্ভব হয়, যা ক্রমেই সকল পেশার মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হয়। 

জাতীয় অবিচারে উৎসাহিত হয়ে বিভিন্ন পেশার মানুষও স্বেচ্ছাচারি হয়ে ওঠে। কেউ কোনো প্রকার অন্যায় করতে ভয় করে না। যে যার জায়গা থেকে কর্তব্যে অবহেলা করে। দুর্নীতিতে জর্জরিত হয় দেশ। জাতীয় অবিচারের ফলে অপরাধী বড় অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। প্রতিটি মানুষ অপরাধের প্রতি উৎসাহিত হয়। 

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কলহ বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষার জগতের উন্নতি মুখ থুবড়ে পড়ে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ইত্যাদি দিন দিন বাড়তে থাকে। মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকে না। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আতঙ্কে। আইনের শাসন না থাকলে জনগণের সকল কার্যক্রমে তার খারাপ প্রভাব পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত ক্ষমতার অপব্যবহার করা শুরু করে। 

ফলে দেশের সব ধরণের উন্নতি স্থবির হয়ে পড়ে। জোর যার মুল্লুক তার এর ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হয়। যার ফলে জাতির জীবনে পতন নেমে আসে। অন্ধকারে ঢাকা পড়ে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ।

শিক্ষা: দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য ব্যক্তি ও সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করা প্রয়োজন। আইন শাসন প্রতিষ্ঠা করা অনিবার্য। তাহলে দেশ ও জাতি নিশ্চিত পতনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।



অতিবাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে অতি ছোট থেকো না, ছাগলে মুড়াবে

অহংকার এবং নম্রতা কোনোটিই অতিমাত্রায় মঙ্গলজনক নয়। এগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখা দেয়। মানুষ রক্ত মাংসের প্রাণী। মানুষের সহজ ধর্ম হলো নিজেকে প্রকাশ করা। তবে প্রতিটি কাজেরই কিছু নিয়ম-কানুন থাকে। এগুলো মানুষকে মেনে চলতে হয়। আর এই নিয়ম-কানুনগুলো না মেনে চললেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। 

অহংকারীর পতন হবে এটাই স্বাভাবিক। অহংকারী ব্যক্তি নিজে ধ্বংস হয় এবং সমাজেরও ক্ষতি মাধন করে। মানবজীবন পুষ্পশয্যা নয়। তাকে সংগ্রাম করেই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। মানুষ তার শ্রম ও মেধার মাধ্যমে কোনো কাজে বিজয়ী হয়। বিজয়ী মানুষের মধ্যে এক ধরণের অহংবোধ কাজ করে। মানুষের মধ্যে পরিমিত অহংকারবোধ থাকবে। 

কখনো কখনো এই অহংবোধ এত তীব্র হয়ে ওঠে যে সমাজের মানুষ তার নিকট থেকে দূরে চলে যায়। ফলে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ির জন্য সে তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। সমাজে আমরা আর এক শ্রেণির লোক দেখতে পাই যারা খুব বেশি নমনীয়তা বা নম্রতা দেখায়। তারা নিজেদের খুব ছোট বা তুচ্ছ মনে করে। এ ধরণের লোক কোনো কাজে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সমাজের নিকট এই শ্রেণির লোকেরাও উপযুক্ত সম্মান পায় না। 

অতিরিক্ত অহংকারী হওয়ার ফল ধ্বংস। আবার নিজেকে মাত্রাতিরিক্ত নম্র বা তুচ্ছ ভাবাটাও অনুচিত। চার্লস ডারউইন বলেছেন- “জীবন যুদ্ধে যোগ্যরাই টিকে থাকে।” তাই আমাদের পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। যে জায়গায় যে সব আচার-ব্যবহার প্রয়োজন সে জায়গায় তাই করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের অতিমাত্রায় অহংকার ও ক্ষমতার দাপটের কারণে ধ্বংস হয়েছে। আবার অনেক জাতি তাদের হীন বা তুচ্ছ মনে করার জন্যে তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছে। প্রকৃতির দিকে তাকালে আমরা সুন্দর উদাহরণ দেখতে পাই। যে গাছগুলো বেশি বড় হয় সেগুলো অল্প ঝড়েই ভেঙে যায়। আবার সে গাছগুলো খুব ছোট সে গুলো বিভিন্ন তৃণভোজী প্রাণী খেয়ে ফেলে। ফলে গাছগুলোর আর বিকাশ ঘটে না। তাই স্থান-কাল ও পাত্র ভেদে আচার-ব্যবহারের ভিন্নতা থাকা প্রয়োজন। 

শিক্ষা: মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে অহংবোধ এবং নমনীয়তা থাকবে। তবে সেগুলো যেন সীমা অতিক্রম করে ধ্বংসের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় এ বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।



অর্থ সম্পদের বিনাশ আছে কিন্তু জ্ঞান সম্পদ কখনো বিনষ্ট হয় না

মানুষ যখন থেকেই সভ্যতা নির্মাণ করার শুরু করেছে তখন থেকে অর্থের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করেছে। বর্তমান সভ্যতার মাপকাঠিতে অর্থ একটি বড় ব্যাপার। অর্থ দিয়েই মূলত আমরা সমাজে মানুষের অবস্থান এবং গ্রহণযোগ্যতা পরিমাপ করে থাকি। বিত্তবান হিসেবে সমাজে পরিচিত হওয়াটাও অনেকের কাছে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু এই বিত্ত-বৈভব, ধন-সম্পদ যেকোনো মুহূর্তে হারিয়ে যেতে পারে। আমীর পরিণত হতে পারে ফকিরে। 

কিন্তু জ্ঞান এমন এক সম্পদ যা কোনদিন বিনষ্ট হয় না। একজন জ্ঞানী চিরদিনের জন্য জ্ঞানী। কিন্তু একজন ধনী চিরদিন ধনী নাও থাকতে পারে। অর্জিত সম্পদ যেকোনো সময় হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। অর্জিত জ্ঞান কখনোই হারানোর ভয় থাকে না। ধনী ব্যক্তি তার সম্পদ দান করে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু জ্ঞানীর বিতরণ করা জ্ঞান অন্যদেরকেও জ্ঞানীর কাতারে সামিল করে অনিঃশেষ থেকে যায়। 

জ্ঞান মানুষকে অমরত্ব দান করে, সম্পদ তা পারে না। সক্রেটিস, প্লেটো, নিউটনরা বহু শতাব্দি আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তাদের জ্ঞান সভ্যতাকে এখনো পথ দেখাচ্ছে। জ্ঞানের শাশ্বত এ সত্য সবারই জানা, সম্পদের বিনাশ আছে কিন্তু জ্ঞান সম্পদের বিনাশ নেই। মানুষের গড়া বহু সভ্যতা বহু ধন সম্পদ সময়ের সাথে সাথে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ যে জ্ঞান পৃথিবীতে রেখে গেছে তা ক্রমশ নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু জ্ঞানের কারণেই মানুষ সকল সৃষ্টির মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। 

শিক্ষা: জ্ঞান আহরণ এবং জ্ঞান বিতরণ সভ্যতাকে গুহার অন্ধকার থেকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। সুতরাং জ্ঞান কখনোই বিনষ্ট হতে পারে না। অর্থ সম্পদ মানুষকে সাময়িক তৃপ্তি দিলেও জ্ঞানের সমকক্ষ হতে পারে না।



অভিজ্ঞতা হল দুঃখ কষ্টের নির্যাস

সুখ-শান্তির পাশাপাশি দুঃখ-কষ্ট মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুঃসময়ে পতিত হলে মানুষ এই পার্থিব জীবনের জটিলতা ও নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। দুঃখের স্পর্শেই মানুষ তার চারপাশে অবস্থিত প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। বিপদের সময়ই ব্যক্তি তার প্রকৃত বন্ধুর সন্ধান পায়। সুতরাং এই কথা অকপটে বলা যায় যে, দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ আপদ মানুষকে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করে। 

এই সময়ই মানুষ জীবনের যথার্থতা উপলব্ধি করার সুযোগ পায়। দুঃখ-কষ্ট মানুষের বিবেককে মহান আদর্শে উজ্জীবিত করে। দুঃখের আগুনে পুড়ে পুড়ে একজন মানুষ খাঁটি বিবেকবান মানুষে পরিণত হয়। দুঃখ-কষ্টের করুণ দহন শেষে যে সোনালি দিনের সন্ধান মিলে তার স্বাদ অনাবিল ও অতুলনীয়। দুঃখ-কষ্টের অভিজ্ঞতা ছাড়া এই পৃথিবীতে কেউ বড় মাপের মানুষ হতে পারে না। এই জগতে যত সাফল্যের ঘটনা রয়েছে তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সীমাহীন দুঃখের মর্মান্তিক ইতিহাস। 

ধৈর্য, দুঃখ-কষ্টের দুঃসহ স্মৃতি, ত্যাগ-তিতিক্ষা এসব ছাড়া কেউ জীবনে সফল হতে পারে না। দুঃখ মানুষকে তার জীবনযাপনে দক্ষ ও অভিজ্ঞ করে তোলে। দুঃখ-কষ্ট জীবনের বাস্তবমুখী দিকগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরে। দুঃখ-কষ্টের সাথে সংগ্রাম করে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার মধ্যে জীবনের প্রকৃত অর্থ নিহিত। দুঃসময়ে জীবনকে থামিয়ে রাখলে চলবে না। জীবনে দুঃখ-কষ্টকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। দুঃখ বেদনা মানুষকে বাস্তববাদী করে। কষ্টবোধে মানুষ আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়, যা মানুষের জীবনে পূর্ণতা নিয়ে আসে। 

আর এই আত্মশক্তিই মানুষকে ক্রমান্বয়ে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করে। দুঃখবোধ একদিকে যেমন কষ্টের অভিজ্ঞতার জন্ম দেয় অন্যদিকে মানুষকে সংগ্রামী মনোভাবে অনুপ্রাণিত করে। 

শিক্ষা: দুঃখ কষ্ট থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা মানুষকে সহনশীল, ধৈর্যশীল, মহান ও সর্বংসহা করে। দুঃখবোধ মানুষকে সত্যাশ্রয়ী ও আত্মসচেতন হতে সহায়তা করে। এর থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা মানুষের অনাগত জীবনের সকল পরিস্থিতি এবং সমস্যা নিয়ন্ত্রণ ও দমনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।



আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে

উপদেশ দেওয়ার মানুষের অভাব হয় না। আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা উপদেশ দিতে খুবই পছন্দ করেন। কিন্তু তাদের নিজেদের জীবনে সে কাজের প্রতিফলন খুব একটা দেখা যায় না। এমন ব্যক্তিরা যখন কাউকে কোনো কিছু শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেন, তখন সেটা খুব কমই গ্রহণযোগ্য হয়। ভালো কাজ করতে বলা খুবই সহজ, কিন্তু ভালো কাজ করে দেখানোটা খুবই কঠিন। 

মানবজাতির ধর্মই হলো অন্ধকার ও নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ। এইসব খারাপ কাজে মানুষ সহজাত প্রবৃত্তিগত কারণেই আকৃষ্ট হয়। এসব থেকে দূরে থেকে জীবনে সুন্দর ও সত্যের বিকাশ ঘটানোই প্রতিটি মানুষের করণীয়। কিন্তু এসব মিথ্যা ও অন্ধকারের হাতছানিকে উপেক্ষা করে জীবনে সততার পথ অবলম্বন করা ভীষণ কঠিন। আর এই কঠিন কাজটি নিজেরা সম্পাদন করার পরই কেবল অন্যদেরকে শিক্ষা দেওয়া উচিত। তবেই সেই শিক্ষা অর্থবহ হয়ে উঠবে। একজন নীতিবান মানুষ তার সারাজীবনে ন্যায়, নীতি ও অনুশীলন করলেই কেবল অন্যরা তার নিকট থেকে উপদেশ গ্রহন করবে। 

মহানবী (স.) এর নিকট একদা এক মা এসে তার ছেলেকে মিষ্টি খেতে নিষেধ করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি সেই মাকে এক সপ্তাহ পরে আসতে বলেন। সেই এক সপ্তাহে তিনি আগে মিষ্টি খাওয়া পরিহার করেন, তারপর সেই ছোট ছেলেটিকে মিষ্টি খেতে নিষেধ করেন। এই উদাহরণ আরো স্পষ্ট করে যে, নিজে না করে, অন্যকে কিছু করতে বলাটাই অন্যায়। শুধু ইসলাম ধর্মেই নয়, অন্যান্য সকল ধর্মেই একই কথা বলা হয়েছে। গুণীজনদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও আমরা তাদের চরিত্রে এই গুণেরই চর্চা দেখতে পাই। সুতরাং উপদেশ দেয়ার আগে আমাদের অবশ্যই চিন্তা করতে হবে আমরা নিজেরা কাজটি করতে কতটুকু সক্ষম। 

শিক্ষা: যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে উপদেশ প্রদানের পূর্বশর্ত হলো নিজে সেই কাজের যথার্থ অনুশীলন করা। নিজে সে কাজ করে দেখাতে না পারলে উপদেশ অর্থহীন হয়ে পড়ে। নিজে করে অপরকে শিক্ষা দিলেই, কেবলমাত্র সেই শিক্ষা গ্রহণযোগ্য হয়।


Post By Md.Ripon Mia

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন