01 November, 2018

বাংলা ব্যাকরণ ভাবসম্প্রসারন ২১-৪০

জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে

সৃষ্টিকর্তা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। সবুজ শ্যামলে সুন্দর করে সাজিয়েছেন পৃথিবী। তবে তার সেরা সৃষ্টি হলাম আমরা মানুষ জাতি। তিনি আমাদেরকে জীবন দিয়েছেন। আমাদের জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী আর তা আটকে আছে সুনির্দিষ্ট বাঁধাধরা কিছু নিয়মে। এই জীবনের আয়ু অসীম নয়, অনন্তকালের নয়; এর শেষ আছে। আমাদের জীবন অবিনশ্বর নয় বরং তা নশ্বর। জীবনের শুরু হয় জন্ম দিয়ে আর এর পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মাধ্যমে। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু নিশ্চিত। 

পৃথিবীতে এমন কোনো সৃষ্টি নেই, যার জন্ম হয়েছে কিন্তু মৃত্যু হবে না। মৃত্যুকে থামানো যায় না বলেই মানুষ কখনো অমর হতে পারে না। মানুষের পঁচনশীল শরীর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে মিশে যায় পৃথিবীর মাটিতে। মানুষ হয়তো অন্যের স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু স্বশরীরে কেউ কোনোদিন অমর হতে পারে না। মানুষ মৃত্যুকে না চাইলেও মৃত্যুই মানুষকে কেঁড়ে নিয়ে যায় এই সুন্দর বসুধা থেকে। মৃত্যু কাউকে কখনো অমর হতে দেয় না। মৃত্যু প্রত্যেক জীবের জন্য অবধারিত সত্য। 

সৃষ্টিকর্তা নির্দিষ্ট সময় বেধে দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কখনোই এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি, ঘটে না আর ঘটবেও না। মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় কিন্তু অমর থেকে যায় কেবল তার সৃষ্টিকর্ম। 

শিক্ষা: মানুষ মরণশীল, প্রতিনিয়ত সে মৃত্যুর দিকে ধাবমান। মৃত্যু এড়িয়ে অমর হওয়া তাই অসম্ভব।


জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো

মানুষ “আশরাফুল মাখলুখাত” অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বিবেচিত। মানুষ তার এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে জন্মের শ্রেষ্ঠত্বের মধ্য দিয়ে নয়, কর্মের শ্রেষ্ঠত্বের দ্বারা। জন্মের ব্যাপারে মানুষের নিজের কোনো হাত নেই। উঁচু বা নিচু, ধনী বা দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হওয়াটা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। তবুও মানুষকে বংশ বা ধর্মের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। যা ন্যায়সঙ্গত নয়। 

কারণ সমাজের নিচুতলায় জন্মগ্রহণ করেও অনেকে কর্মের মাধ্যমে অনেক বড় হতে পারেন। মানব সমাজের ইতিহাসে তার বহু প্রমাণ আছে। আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, ফ্রান্সের নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, ভারতের এ.পি.জে আবুল কালাম আজাদ, প্রমুখ ব্যক্তি অতি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েছেন। পদ্মফুলের সৌন্দর্যই বড়। পঙ্কে জন্মেছে বলে তাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। 

নিচুকুলে জন্মগ্রহণ করলেই যে নিচু হতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। তার কৃতকর্মই তাকে উঁচু নিচুর পরিচয় করিয়ে দেয়। তাই মানুষ যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক, যে কাজই করুক, সে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছে কি না সেটাই বিবেচ্য বিষয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বংশগৌরবই মানুষের যথার্থ পরিচয় নয়। তাই জন্ম কোথায় হলো এ বিষয়টা একেবারে অযৌক্তিক ও অবান্তর। বরং মানুষের মহৎ কর্মই তার আসল পরিচয় বহন করে। 

শিক্ষা: মানুষের জন্ম পরিচয়ের চেয়ে তার কর্মই সর্বাপেক্ষা তাৎপর্য বহন করে। তাই মানুষকে তার কর্মগুণের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা উচিত।



চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান

মানব জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট গুণাবলির মধ্যে চরিত্র অন্যতম। এটি মানব জীবনের ভূষণ হিসেবে কাজ করে। কথায় আছে, ‘সম্পদ হারালে কোনো ক্ষতি হয় না, স্বাস্থ্য হারালে কিছুটা ক্ষতি হয় কিন্তু চরিত্র হারালে সব কিছুই খোয়া যায়।’ তাই বিখ্যাত ইংরেজ লেখক স্যামুয়্যাল স্মাইলস তাঁর "Character" নিবন্ধে বলেছেন- "The crown and glory of life is character." মনীষী বাকী বলেছেন- ‘অর্থের প্রয়োজন নেই, পদমর্যাদার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আছে শুধু চরিত্রের, যা মানুষের জীবনের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়।’ বস্তুত চরিত্র শ্রেষ্ঠ সম্পদ। নামমাত্র নৈতিকতা বা ন্যায়নিষ্ঠাই চরিত্র নয়। 

চরিত্রের মধ্যে সমন্বয় ঘটবে মানুষের যাবতীয় গুণাবলি ও আদর্শের। সততা, সত্যনিষ্ঠা, প্রেম, পরোপকারিতা, দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা এবং কর্তব্যপরায়ণতা হলো চরিত্রের মৌলিক উপাদান। এসব সদগুণ তাকে চরিত্র শক্তিতে বলীয়ান করে তোলে। স্পর্শ-মণির ছোঁয়ায় লোহা যেমন সোনায় পরিণত হয়, তেমনি সচ্চরিত্র মানুষের পশুবৃত্তি ঘুচিয়ে দেয়। সে হয়ে ওঠে বিবেকের কাছে কলুষমুক্ত, পরোপকারী, নির্লোভ, ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের সেবক। কিন্তু চরিত্র শক্তিতে বলীয়ান না হলে মানুষ সহজেই অপকর্মে লিপ্ত হয় নৈতিক অধঃপতন ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হলেও সে জাতির জীবন হয়ে ওঠে কলঙ্কিত। 

চরিত্রহীন লোককে সবাই ঘৃণা করে, সমাজের কারো কাছে এদের দাম নেই। এরা সমাজের কোনো উপকারে আসে না, বরং ক্ষতি করে। এ জন্য সবাই তাদের এড়িয়ে চলে। চরিত্র দোষেই তাদের স্থান হয় পশুস্তরে। পক্ষান্তরে চরিত্রবান লোক কেবল জীবনে মহত্ত্বই অর্জন করেন না, মৃত্যুর পরও তারা স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকেন। সচ্চরিত্র বলে তারা সমাজ ও জাতীয় জীবনের অগ্রগতি ও উন্নতির পথে আলোকবর্তিকার মতো কাজ করেন। পৃথিবীর সকল ধর্মগুরু ও মনীষীগণ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বস্তুত সচ্চরিত্রের কারণেই মানুষ হয় মহৎ, গৌরবান্বিত মর্যাদার অধিকারী। তা না হলে তার স্থান হয় নিম্নস্তরে। স্বাস্থ্য, অর্থ, বিদ্যা মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ করে তুলতে পারে না। 

পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে তাকে সচ্চরিত্রবান হতে হয়। এজন্য প্রতিটি মানুষের সচ্চরিত্র ভালো মানস গঠনের সহায়ক আর ভালো মানস ভালো সমাজ ও জাতি গঠনের সহায়ক। চরিত্রহীন জনগোষ্ঠী জাতির উন্নতির অন্তরায়। 

শিক্ষা: মানব জীবনে চরিত্র অমূল্য সম্পদ। কোনো মূল্যেও এর পরিমাপ করা যায় না। চরিত্রের কারণেই মানুষ পশুত্ব থেকে মুক্তি পায়, অর্জন করে সত্যিকারের গৌরব ও মর্যাদা।




ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে

আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি। আজকের দিনে যারা শিশু তারাই হবে আগামী দিনের জাতির পথ প্রদর্শক। তারা বড় হয়ে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখবে। তাদের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে। 

প্রতিটি শিশুর মধ্যে লুকিয়ে আছে সুপ্ত প্রতিভা। তাকে খুঁজে বের করে কাজে লাগাতে হবে। পৃথিবীর মহামানব ও মনীষীদের জীবন লক্ষ করলে দেখা যায় যে, তারা শিশুকাল থেকেই নানা বিষয়ে আগ্রহী ও প্রতিভাবান ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ (সঃ), কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আইনস্টাইন, নিউটন ও আব্রাহাম লিংকন প্রমুখের মধ্যে সম্ভাবনার বীজ শিশুকাল হতেই দেখা দিয়েছিল। 

শিশুরা উপযুক্ত পরিবেশ পেলে বিশ্বকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারে। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন- ‘শিশুরাই জাতির পিতা’। কাজেই শিশুরা যদি উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন করতে পারে তাহলেই দেশের মঙ্গল, জাতির উন্নতি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক শিশু অবহেলা-অনাদরে, অশিক্ষা-কুশিক্ষা এবং অপুষ্টিসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। আবার অনেক শিশু বেঁচে থাকার তাগিদে শিশু শ্রমে জড়িত হচ্ছে। 

শিশুরা নানাভাবে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ এই শিশুরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দিবে। কেবল শিশুর স্বার্থেই নয় জাতির কল্যাণ ও দেশের উন্নতির জন্যই শিশু বিকাশের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত জরুরী। 

শিক্ষা: আজকের শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ পিতার দায়িত্ব পালন করবে। তাই শিশুদের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা উচিত। শিশুদের সঠিক পরিচর্যাই ভবিষ্যতে উন্নত জাতি গঠনের প্রধান শর্ত।



চকচক করলেই সোনা হয় না

পৃথিবীতে খাঁটি বস্তুর চেয়ে নকল বস্তুর পরিমাণই বেশি। আসল বস্তুর প্রাপ্য মর্যাদা হরণের জন্য নকল বস্তু সর্বদা সচেষ্ট। নকল তার দোষ-ত্রুটি সৌন্দর্যের আবরণে লুকিয়ে নিজেকে আসল রূপে পৃথিবীর কাছে প্রকাশ করতে ব্যস্ত। কিন্তু শুধু বাইরের আবরণ দিয়েই বেশিদিন সবাইকে আকৃষ্ট করে রাখা যায় না। এক সময় মিথ্যা আবরণের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে নকল বস্তুর বৈশিষ্ট্য। তখন তার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে আসল বস্তুর কাছে। সোনা অতি মূল্যবান একটি ধাতু। 

এর বর্ণ উজ্জ্বল। কিন্তু একমাত্র এই উজ্জ্বলতাই সোনাকে মূল্যবান করে তোলেনি। সোনা প্রকৃতপক্ষে মূল্যবান এর অভ্যন্তরীণ গুণের কারণে। এমন অনেক ধাতু আছে যেগুলো ঘষা-মাজা করলে বা রং করলে সোনার বর্ণ ধারণ করে। কিন্তু তাই বলে এসব ধাতু সোনা হতে পারে না। কারণ ঘষা-মাজার ফলে এগুলো কেবল সোনার বাহ্যিক বর্ণটিই ধারণ করতে পারে, তার অভ্যন্তরীণ গুণগুলো আয়ত্ত করতে পারে না। তাই বাহিরের চাকচিক্যই কেবল কোনো বস্তুকে পূর্ণাঙ্গভাবে চেনার মাপকাঠি হতে পারে না। আমাদের সমাজেও এমন অনেক মানুষ আছে যাদের ভেতরটা প্রকৃত অর্থে ফাঁপা। 

কিন্তু বাহিরে তারা একটি পরিপূর্ণ ভালো মানুষের মুখোশ এঁটে থাকে। তারা কখনো মহৎ নয়, মহৎ হওয়ার অভিনয় করে মাত্র। তাদের বাহিরের ভালোমানুষী দেখে অনেকেই প্রভাবিত হয়। আকর্ষণীয় চেহারা ও মিষ্টি কথায় আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই তাদের সম্মানের আসনে বসায়। কিন্তু এসব তথাকথিত ভালো মানুষদের সত্যিকার রূপ যখন প্রকাশ পায় তখন তাদের বীভৎসতায় সকলে বিমূঢ় হয়ে যায়। তাই বাহ্যিক সৌন্দর্য নয় ভেতরের গুণাবলির মাধ্যমেই মানুষকে বিচার করা উচিত। 

শিক্ষা: দেখতে কুৎসিত অনেক মানুষের মন পবিত্র হতে পারে। আবার সুন্দর চেহারা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী অনেক মানুষও হতে পারে চরম ভয়ংকর। তাই একটি মানুষের ভেতরকে পরিপূর্ণভাবে না জেনে তার সম্পর্কে কোনো ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়।



করিতে পারি না কাজ সদা ভয় সদা লাজ। সংশয়ে সংকল্প সদা টলে পাছে লোকে কিছু বলে

মানুষ জন্ম থেকেই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে। প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ঠের অধিকারী। ভয় ও লজ্জা তেমনি মানুষের দুটি স্বভাবজাত বিষয়। ভয় এবং লজ্জা নেই এমন কোনো মানুষ বিশ্ব সংসারে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বলে ভয় এবং লজ্জার জন্য নিজের কর্মস্পৃহাকে অবহেলা করা ঠিক নয়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন কর্মময় জীবন-যাপন করার জন্য। 

মানুষ নিজের কর্মের দ্বারাই জগতে কীর্তিমান হয়। কর্মহীন মানুষ সমাজের অলস এবং অথর্ব হিসেবে পরিচিত। কাজকে যারা ভয় পায় তারা কখনোই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। জগতের কোনো কাজই ছোট নয়। কাজকে যারা ছোট করে দেখে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। সভ্যতা বিনির্মাণে কর্মঠ মানুষের অবদান অনেক। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সীমাহীন ধৈর্যের বিনিময়ে সভ্যতার শুভ সূচনা হয়েছিল। 

আজ সেই সভ্যতা আলোকিত হয়েছে মানুষের কর্মমুখরতার কারণে। কোনো গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে যেমন লক্ষ্য স্থির করতে হয়, তেমনি কোনো কাজ বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প। লক্ষ্য স্থির না করে যেমন কিছু করা যায় না তেমনি, সংকল্প না থাকলে সফল হওয়া যায় না। মানুষের কাজের জন্য যেমন প্রশংসা জোটে তেমনি সমালোচনাও হয়। তাই বলে সমালোচনার ভয়ে কাজ থেকে বিরত হওয়া কিংবা সংকল্প থেকে দূরে সরে আসা ঠিক নয়। 

বুদ্ধিমান এবং সাহসী মানুষ সর্বদাই ভয় এবং সমালোচনাকে তুচ্ছ করে স্বীয় কাজে কীর্তিমান হয়। জগতের যত বড় বড় অভিযান সফলতার মুখ দেখেছে তার পিছনে ছিল দৃঢ় সংকল্প এবং সাহসী পরিকল্পনা। কর্মে সফল হওয়ার জন্য যেমন জড়তা ঝেড়ে ফেলতে হবে তেমনি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। 

শিক্ষা: ভয় কে জয় না করতে পারলে কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয় না। দৃঢ় সংকল্প না থাকলে মানুষের সমালোচনার ঝড় সামাল দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রই কর্মঠ এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।



তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন

সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলে। এজন্য সে মানবতার কল্যাণে কাজ করে, পাশাপাশি যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। সমাজে মানুষ তার কর্মের কারণে দুই ভাগে বিভক্ত। উত্তম এবং অধম। উত্তম সর্বদাই মানব কল্যাণে নিয়োজিত। যাবতীয় ভালো এবং জনহিতকর কাজ সে সম্পাদন করে থাকে। অপরদিকে অধম কখনোই মানবকল্যাণে নিয়োজিত হয় না। মানবধর্ম ভুলে সে আপন কাজে ব্যস্ত হয়। সমাজ-সংসার তাদের কাছ থেকে কিছুই পায় না। কোনো সমাজেই সে অনুকরণীয় হতে পারে না। 

সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের রয়েছে বিবেকবোধ, চিন্তার ক্ষমতা এবং ভাল-মন্দ নির্ণয়ের ক্ষমতা। যে তার স্বাভাবিক জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে ভাল-মন্দের বিচার না করে খারাপ কাজে লিপ্ত হয় সে সমাজে অধম হিসেবে বিবেচিত হয়। উত্তম স্বভাবের মানুষ সমাজের অন্য মানুষদের উত্তম হওয়ার প্রেরণা যোগায়। দুনিয়ার সর্বত্রই উত্তম মানুষগণ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার সাথে স্মরণীয়। অন্যদিকে অধম কোনো সমাজেই সমাদৃত নয়। 

একজন মানুষ তার জ্ঞান, বুদ্ধি, চিন্তাশীল মনের প্রখরতা দিয়ে সমাজে নিজের অবস্থান সৃষ্টি করে। অধম সব সময়ই অকল্যাণকর কাজে রত। উত্তম এবং অধমের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় তাদের কাজ, চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। আর সেজন্যই উত্তম সর্বদা অধমের চেয়ে আলাদা। সে কখনোই অন্যের সাথে নিজের তুলনা করে না। উত্তম তাই অধম থেকে নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে এবং সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। মূলত ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকলে মানুষ শত অধমের সঙ্গে থেকেও ভালো মানুষ তথা উত্তম হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

শিক্ষা: উত্তম স্বভাবের মানুষই সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। তাই উত্তম হওয়ার সাধনাই হওয়া উচিত মানবজীবনের প্রকৃত সাধনা, প্রধান লক্ষ্য।


দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ

পৃথিবীর ছোট বড় যেকোনো কাজে সম্মিলিত অংশগ্রহণের মধ্যেই সর্বোত্তম সফলতা নিহিত। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাঝে আছে বিপুল উৎসাহ, বিজয়ের দুর্দমনীয় নেশা আর অফুরন্ত উদ্দীপনা। ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে সফলতার সম্ভাবনাই থাকে বেশি। অন্তত পরাজিত হওয়ার আগে পরাজয়ের নেতিবাচক মানসিকতা স্থান পায় না মিলিত শক্তিতে। সবাই মিলেমিশে কাজ করতে গিয়ে পরস্পরের মাঝে তৈরি হয় একতা, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এক সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সৃষ্ট সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তৈরি করেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের মতো ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী সংগঠন। 

ঐক্যবদ্ধ মানুষের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় অস্ত্রের ক্ষমতা। একক ব্যক্তিসত্তা একতাবদ্ধ হয়ে পৃথিবীর যেকোনো পরাক্রমশালী শক্তিকে হারিয়ে দিতে পারে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত বিশাল পাক হানাদার বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন ঐক্যমন্ত্রে দীক্ষিত আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। আর সমবেতভাবে কাজ করার মাঝে হার-জিত মুখ্য বিষয় নয়। সমবেত কাজ জয় পরাজয়কে ছাপিয়ে মহত্তম হয়ে ওঠে সম্মিলনের সৌন্দর্যে। তাছাড়া সমবেত কাজে বিজয়ের আনন্দ যেমন সকলের, তেমনি ব্যর্থতার দায়ভার ও গ্লানিও সকলের। একক কাজের ক্ষেত্রে পরাজয়ের গ্লানিও একাকী নিজেকে বহন করতে হয়। সম্মিলিত কাজ ব্যর্থতার গ্লানিও সমভাবে সবার ওপরে বর্তায় বলে গ্লানিবোধ তীব্র হয় না। 

শিক্ষা: সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে কাজের সফলতা ব্যর্থতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। মিলেমিশে কাজ করে ব্যর্থ হলেও লজ্জা কিংবা অগৌরব নেই।




ধনের মানুষ, মানুষ নয় মনের মানুষই মানুষ

মানুষ জন্ম থেকেই দুটি পরিধির মধ্যে বাস করে। একটি আত্মপরিধি অন্যটি বিশ্বপরিধি। একদিকে থাকে আত্মসুখ ও ঐশ্বর্য আকাক্সক্ষা অন্যদিকে থাকে ত্যাগ ও মানবকল্যাণের চিন্তা। আত্মপরিধি সম্পন্ন মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। কারণ প্রকৃত মানুষ যারা তারা অপরের হিতকামনা করেন। সহানুভূতি, পরার্থপরতা ও সমষ্টিগত কল্যাণবোধ ছাড়া মনুষ্যত্ব থাকে না। এ গুণগুলো মানুষকে সুন্দর মনের অধিকারী করে তোলে। 

পরোপকারী ও ত্যাগী মনের মানুষই প্রকৃত মানুষ। জনসাধারণের কাছে সংকীর্ণ মনসম্পন্ন প্রবল অর্থশালী লোকের কোনো মূল্য নেই। তারা আপাত সম্মান পেলেও হৃদয়ের শ্রদ্ধাবোধ পায় না কখনই। মৃত্যুর সাথে সাথে তার নামও বিলীন হয়ে যায় পৃথিবী থেকে। 

মৃত্যুর পর মানুষ আর তাকে স্মরণ করে না কখনই। একমাত্র পরোপকারী মনের অধিকারী বিত্তবান মানুষ সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কথায় বলে ‘বিত্তের চেয়ে চিত্ত বড়।’সুন্দর মনের মানুষ সম্পদহীন হলেও অপরের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পায়। মানুষ তাকে মৃত্যুর পরেও অনন্তকাল মনে রাখে। মৃত্যুর পরও সে মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় হয় সিক্ত। 

শিক্ষা: ধন-ঐশ্বর্য নয়, মানবকল্যাণকামী সহানুভূতিশীল মনই মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করতে পারে। এ ধরণের মানুষই প্রকৃত মানুষ।



নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়

সম্প্রসারিত ভাব ঃ মানব সভ্যতার বিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার হলো আগুন। প্রাচীনকালে মানুষ ও পশুর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। মানুষ পশুর মতো কাঁচা মাংস খেত। আগুনের আবিষ্কার সবকিছু বদলে দিয়েছিল। আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষ খাবার সিদ্ধ করে খেতে শেখে। আগুনে পুড়িয়ে বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করতে শেখে, বন্য প্রাণীকে ভয় দেখাতে আগুন ব্যবহার করতে শেখে। 

সর্বোপরি আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের জীবনযাত্রাই পুরো পাল্টে গিয়েছিল। সভ্যতার প্রতিটি আবিষ্কারেই আশীর্বাদের পাশাপাশি কিছু অভিশাপ থাকে। আগুন এমন একটি পদার্থ যার সাধারণ ধর্ম হলো দহন। ভুল করে আগুনে হাত দিলেও আগুন পোড়াতে ভুল করবে না। আগুনের কাছে মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট সবই সমান। আমাদের সমাজ জীবনেও আগুনের মতো কিছু ধ্বংসাত্মক জিনিস রয়েছে। 

সমাজে যখন কোনো অপরাধ দানা বাঁধে তখন তা গোটা সমাজকেই গ্রাস করে। সমাজে ভাল-মন্দ উভয় শ্রেণির মানুষই থাকে। তথাপি অন্যায়ের জোরই বেশি। আগুন ও অপরাধ এ দুটো বিষয়ের মধ্যে একটি মিল রয়েছে। উভয়ই ছোট থেকে বড় হতে থাকে এবং ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আগুনের যেমন দহন ছাড়া কোনো ধর্ম নেই, তেমনি অপরাধেরও ধ্বংস ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আগুন রূপে অপরাধকে বিঘ্নত হতে দেখি। আগুনের মতোই অপরাধ ভালো-মন্দ সব কিছুকেই গ্রাস করে। কারো প্রতি তার পক্ষপাত নেই। 

শিক্ষা: আগুন ও অপরাধ অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন যেমন ভাল-মন্দ সবকিছু পোড়ায়, তেমনি অন্যায় পাপকে গ্রহণ করে ভালোকে ধ্বংস করে দেয়। সুতরাং ব্যক্তি ও সমাজজীবনে অপরাধ যত দ্রুত সম্ভব প্রতিরোধ করতে হবে।



পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে

পথ ও পথিক, এ দুটি আলাদা বস্তু হলেও পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পথিক তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় নতুন পথ সৃষ্টি করে। মানুষ ঠিক একইভাবে তার চেষ্টা ও সাধনা দিয়ে জীবনে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানুষের সৃষ্টিশীলতার মূলে নিহিত রয়েছে বিরামহীন অধ্যবসায় ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং ধৈর্য। তীব্র ইচ্ছা শক্তি আর প্রচেষ্টা দিয়ে মানুষ অসাধ্যকে জয় করতে পারে। 

সৃজনশীল মানুষ তার চলার পথ নিজেই তৈরি করে নেয়। অন্যের পথে সে হাঁটে না। একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা জীবনে অগ্রসর হতে চায়। প্রতি পদক্ষেপেই তারা একটা নতুন উপায়ের সন্ধান করে। আর জীবনে নানা ব্যর্থতা অতিক্রম করে একদিন সে ঠিকই তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথটি তৈরি করে নেয়। অন্যের প্রদর্শিত পথে অগ্রসর হওয়ার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, নেই কোনো গৌরব। 

আর এ পথে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অনেক সময়ই অর্জিত হয় না। তাই কৌতূহলী পথিক অবিরাম নতুন পথের সন্ধান করে। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন সঠিক পথ। এরকম অনেক পথই এ পৃথিবীতে তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু প্রতিটি পথই যে মানুষকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে দিবে এমনটি নয়। কারণ প্রতিটি মানুষই একে অপরের থেকে পৃথক এবং তাদের মেধা ও চিন্তাশক্তিও পৃথক। 

তাই গতানুগতিক পথে গন্তব্যে পৌঁছাতে চাইলে অনেককেই মাঝ পথে থেমে যেতে হয়। এমন দৃষ্টান্তের শেষ নেই। কারো অভিভাবক হয়তো আশা করে যে তাদের সন্তান ডাক্তার হবে। কিন্তু সন্তানটি হয়তো তার মেধা এবং সৃজনশীলতাকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে লাগাতে চায়। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক যদি সন্তানের ওপর তাদের ইচ্ছাটাকে চাপিয়ে দেয় তবে দেখা যাবে যে সে মাঝপথেই থমকে গেছে। অন্যদিকে সে যদি নিজের মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে নিজ পথের সন্ধান করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে তবে সে প্রকৃত অর্থেই সফল। এরকম প্রতিটি মানুষেরই সফলতার পথ আলাদা। তাই প্রকৃত পথিক প্রতিনিয়ত নতুন পথের সন্ধান করে। 

শিক্ষা: অন্যের প্রদর্শিত পথ নয়, নিজের সৃষ্ট পথেই প্রতিটি মানুষ সফলতা অর্জন করে। তাই প্রতিটি মানুষেরই উচিত নতুন পথের সন্ধান করা এবং সে পথ ধরে এগিয়ে চলা।



বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে

প্রত্যেক প্রাণীই একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে জন্ম গ্রহণ করে। সেই পরিবেশেই সে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। আপন পরিবেশের সাথে তার এক ধরণের সম্পর্ক গড়ে উঠে সেখানেই তাকে সবচেয়ে ভালো মানায়। প্রতিটি প্রাণীই আপন পরিবেশ ছাড়া চলতে পারে না। বন্য প্রাণীর জন্য সুন্দর স্থান হলো বনভূমি। বন্য প্রাণীরা মানুষের সাথে বসবাস করতে পারবে না। নিজস্ব পরিবেশই তাদের সুখ দিতে পারে। বনের পাখিদের বৈশিষ্ট্য হলো আকাশে উড়ে বেড়ানো। সেই পাখিকে দামী খাঁচায় ভরে রাখলেও সে আনন্দ পাবে না। 

আবার শিশুদের জন্য মায়ের কোলই হলো উপযুক্ত স্থান। মায়ের কোল ছাড়া অন্য কারো কোলে রাখলে সে তৃপ্তি পায় না। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্মে শিশুকে মায়ের কোলেই স্থান দিয়েছেন। কৃষকদের জন্য উপযুক্ত স্থান গ্রাম। জমিতে ফসল ফলানোই তাদের কাজ। শহর তাদের কাছে খাপছাড়া মনে হবে। জলের পরিবেশেই মাছের বৃদ্ধি, জল থেকে ডাঙ্গায় তুললে মাছ মরে যায়। এভাবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীই নিজস্ব বাসস্থান ব্যতীত স্বাধীনভাবে চলতে পারে না। 

পৃথিবীকে সুন্দরভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রতিটি প্রাণীর আপন আপন পরিবেশের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান এবং প্রতিটি প্রাণী পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। 

শিক্ষা: উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে অনেক সুন্দর জিনিসও অসুন্দর হয়ে যায়। তাই প্রতিটি প্রাণীকে তার নিজ নিজ পরিবেশে বিকাশের সুযোগ দেওয়া উচিত।



পুণ্য পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে মানুষ হতে দাও তোমার সন্তানে

মানুষের জীবনে চলার পথ মসৃণ নয় বরং তা কাঁটায় ভরা। প্রতিটি পদে পদে রয়েছে কষ্ট-দুঃখ, বাধা-বিপত্তি, সংঘর্ষ, সংঘাত। প্রতিটি পদক্ষেপ সংগ্রামের। মানুষের জীবনে বেদনা আছে, কষ্ট আছে, অপমান আছে, ব্যর্থতা আছে, পরাজয় আছে। 

এসব জীবনের অঙ্গ এবং বৈশিষ্ট্য। এই সকল বিরোধী শক্তির সাথে অত্যন্ত সহনশীলতা এবং নিষ্ঠার সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হতে হয়। বাঁধাকে জয় করার মধ্যেই রয়েছে জীবনের তাৎপর্য। মানবজীবনের সার্থকতা লুকিয়ে থাকে বাধা জয়ের মধ্যে। 

দুঃখ, কষ্ট, শোক, আঘাত মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলে। আগুনে পুড়ে সোনা যেমন খাঁটি হয়, তেমনি দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ জীবনের সকল বাধাকে জয় করার শক্তি অর্জন করে। মানুষের জীবন মানেই সংগ্রামের ইতিহাস। 

পৃথিবীতে যুগে যুগে যোগ্যতম প্রাণীগুলো টিকে থাকতে পেরেছে কিন্তু দুর্বল প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে সংগ্রামের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে। কেউ যদি জীবনে সফল একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তবে তাকে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, অপমান, পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মনীষীদের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায়, তারা কষ্ট, দুঃখ, সংগ্রাম, সংঘাতের মধ্য দিয়ে পথ চলেছেন। অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। 

কিন্তু তারা তাদের অটুট মনোবল এবং সাহসের মাধ্যমে সকল বাধাকে অতিক্রম করেছেন। সফলতার খাতায় নিজেদের নামকে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নামকে অঙ্কিত করেছেন এবং হয়েছেন অনুকরণীয় চরিত্র। 

শিক্ষা: জীবনে চলার পথে কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করেই মানুষ, প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে। মানুষের জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানোর জন্যে দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, আঘাত, সংগ্রাম, উত্থান-পতন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।



মানুষকে ভুল করিতে না দিলে মানুষকে শিক্ষা লাভ করিতে দেওয়া হয় না

শিক্ষা মানবজীবনকে সামনে এগিয়ে নেয়, এনে দেয় পরিপূর্ণতা। শিক্ষা লাভের জন্য মানুষ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সব কাজই নির্ভুল হয় না। কারণ মানুষের অভিজ্ঞতা লাভের পথে ভুল ভ্রান্তি হওয়াটা স্বাভাবিক। নির্ভুলভাবে কাজ করতে হবে এই শর্ত কাজের বেলায় আরোপ করা ঠিক নয়। কারণ ভুল করাই মানুষের স্বভাব। তাই কারো পক্ষেই কাজের নির্ভুলতার অঙ্গীকার করা সম্ভব নয়। নেপোলিয়ান বলেন- “যদিও আমি ইউরোপের একজন বিশিষ্ট সৈনিক তবু আমি দিনে দশটি ভুল করি। 

” কাজের ভুল ভ্রান্তি থেকেও মানুষ নতুন করে শিক্ষা লাভ করে। কেননা পৃথিবীর যত বড় বড় আবিষ্কার সবই সম্ভব হয়েছে ভুল থেকে অর্জন করা নতুন শিক্ষা লাভের ফল হিসেবে। বার বার ভুল করেও তারা থেমে যাননি বরং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেছেন। ফলস্বরূপ পেয়েছেন সত্যের দেখা আর সফলতা। শেখ সাদী বলেন- “যার জীবনে যত ভুল তার জীবনে তত মঙ্গল। অন্ধকারের অলিগলি পার হয়েই তো আমরা আলোর সন্ধান পাই।” তাই কাজে কোনো ভুল হলে তা অপরাধ হিসেবে নেওয়া ঠিক নয়। 

শিক্ষা লাভের জন্য কেউ ভুল করলে তাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। তাকে ভুল সংশোধনের জন্য সুযোগ দিতে হবে। এ ভুল অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে সংশোধন করলেই সে সফলতা অর্জন করতে পারবে। ভুল সংশোধন না করে ভুলকে অন্যায়ের দৃষ্টিতে বিচার করলে শিক্ষা লাভের পথযাত্রা থেমে যাবে। তাই ভুলকে বিবেচনায় রেখেই শিক্ষা লাভ করতে হবে। তবেই শিক্ষা অর্থবহ হয়ে উঠবে। 

শিক্ষা: ভুল থেকেই সাহসের জন্ম হয়। কেননা ভুল সংশোধন করার সর্বাত্মক চেষ্টার মাধ্যমেই শিক্ষা লাভের পথ সুগম হয়।



যত মত, তত পথ

একই স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষ। কিন্তু সেই মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। একই সময়ে জন্ম নেয়া দু’টি জমজ শিশুর মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বিদ্যমান। পার্থক্য দেখা যায়, তাদের পছন্দ-অপছন্দের, মতামতের। ধর্ম, পরিবেশ, সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি মানুষে মানুষে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এক ধর্মের অনুসারীদের রীতিনীতি, জীবনাচার ইত্যাদি অন্য ধর্মের অনুসারীদের চেয়ে ভিন্ন হয়। কারণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আবার উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যেও দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতামতের সুবিশাল পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। 

উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে জন্ম নেয়া একটি শিশু যেভাবে গড়ে উঠে, নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে জন্ম নেয়া শিশু সেভাবে গড়ে উঠে না। উচ্চবিত্ত শ্রেণিতে শিশুটি যেমন সুযোগ-সুবিধা পায়, নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে জন্ম নেয়া শিশুটি তেমন সুযোগ-সুবিধা পায় না। তাই তাদের জীবনধারার মধ্যে বিস্তর অমিল দেখা যায়। সব মানুষ যখন তাদের নিজ নিজ বিশ্বাস এবং জীবনধারা সুষ্ঠুভাবে মেনে চলে তখন সমাজে শান্তির সুবাতাস বয়ে চলে। সমাজে তখন কোনো অশান্তি দেখা যায় না। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটলেই সমাজে নেমে আসে অশান্তি। এক ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সাথে অন্য ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি, যা সমাজের সুন্দর পরিবেশকে এক মুহূর্তেই নষ্ট করে দেয়। 

একজনের নিজস্ব মতামত যখন অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, তখনই সমাজে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। ফলে নষ্ট হয় সম্প্রীতির বন্ধন। মানুষের নিজের মতকে অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়ার হীন মনোবৃত্তি তাকে করে তোলে অহংকারী এবং উগ্র। পৃথিবীতে সমস্যা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সমস্যার সমাধান। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যতো ভিন্নই হোক না কেন প্রত্যেকেই নিজস্ব পথ অবলম্বন করে লক্ষ্যে পৌছায়। তাই বলা যায় পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে সমাধানের পথও ভিন্নতর হয়। 

শিক্ষা: পৃথিবীতে প্রতিটি সমস্যার রয়েছে সমাধান। দৃষ্টিভঙ্গি যতো ভিন্ন হবে তার প্রয়োগ পদ্ধতিও ততো ভিন্নতর হবে। তাই সমাজের শান্তি এবং সম্প্রীতি রক্ষার জন্য সকলের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া, সমাজের প্রতিটি মানুষের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।



যে অন্যায় আদেশ পালন করে সেও অন্যায় করে

মানবজাতিকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। অপরের কল্যাণসাধন করাই জীবনের মূল সার্থকতা। কিন্তু মানব সমাজের অনেকেই পরস্পরের ক্ষতি করতে চায়। সমাজে তারা বিশৃংখলা সৃষ্টির মাধ্যমে বিভেদ তৈরি করে। মানুষের কল্যাণার্থে রচিত আইন তারা ভঙ্গ করে এবং আরেকজনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। সমাজে এসব কাজ যারা করে তারা নিঃসন্দেহে অন্যায়কারী ও অপরাধী। কিন্তু অনেকেই আবার এদেরকে নানাভাবে সহায়তা করার মাধ্যমে নিজের অজান্তেই অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ে। 

শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণির লোকদেরকে অনেক সময় তাদের অন্যায় কাজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সমাজের প্রভাবশালীরা অধিনস্তদেরকে নানা ধরণের অন্যায় কাজের আদেশ দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে সেই আদেশ পালন করার মাধ্যমে অনেক ভালো মানুষও প্রকৃতপক্ষে অন্যায়কারীদের তালিকায় বন্দি হয়ে যায়। কেননা অন্যায় কাজের আদেশের প্রতিবাদ না করে তা সহ্য করাও একটা অন্যায়। এটি পালন করা আরো বড় অন্যায়। 

অন্যায় আদেশ পালন করার মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে অপরাধীদের সাহস যোগান দেয়। কাউকে অন্যায় কাজে সাহায্য করলে সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন আরো বৃদ্ধি পায়। অন্যায়কারী তার অপরাধের জন্য যেরূপ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তেমনি অন্যায় আদেশ পালনকারীও সেরূপ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। 

কারণ তার একটি অন্যায় আদেশ পালনের ফলে সমাজের বৃহৎ স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। অপরদিকে সমাজের বিচারে সে অপরাধী, যে অন্যায় কাজের আদেশ দেয় তার ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধ হয় এবং সমাজে অশান্তি ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। তাই দুর্বলচিত্তে কারো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া ও তার অন্যায় আদেশ পালন করা সমাজের চোখে একটি গর্হিত অপরাধ। 

শিক্ষা: সহযোগিতা ও আন্তরিকতা উদার মানসিকতার পরিচায়ক হলেও কাউকে অন্যায় কাজে সহযোগিতা করা যাবে না। একটি অন্যায় আদেশ পালন করার দরুন সারাজীবন সমাজে একজন অন্যায়কারী হিসেবে বিবেচিত হতে হবে।



লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু

পার্থিব জগতে কোনো কিছু অর্জনের জন্য মানুষের মধ্যে যে, দুর্দমনীয় বাসনার সৃষ্টি হয় তার নামই লোভ। লোভ মানব জীবনের সবচেয়ে ক্ষতিকর এক রিপু। মানুষ লোভের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাহ্যিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। তখন ভাল-মন্দের বিচার-বিবেচনা জ্ঞান থাকে না। মানুষের মতো মনুষ্যত্ববোধ অন্য পশু পাখির মধ্যে নেই। লোভ মানুষের সেই মনুষ্যত্বকে বিনষ্ট করে দেয়। আর মনুষ্যত্বহীন মানুষের পশুর মতো বিচার, বুদ্ধি, বিবেক লোপ পায়। 

লোভ এমনই এক তাড়না যা মানুষকে পশুতে রূপান্তরিত করে। লোভের কারণে মানুষ পাপ পুণ্যের কথা পর্যন্ত ভুলে যায়। তাই সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। ধীরে ধীরে সে ধ্বংসের পথে, পাপের পথে এগিয়ে যায়। লোভী ব্যক্তি যে শুধু নিজের ক্ষতি করে তাই নয়। সে নিজের সাথে সাথে সমাজেরও ক্ষতি করে। অপরদিকে লোভহীন মানুষ পাপ থেকে দূরে থাকে। স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবনযাপন করে। লোভী মানুষের পক্ষে কখনই এমন নির্মল সুন্দর জীবন পাওয়া সম্ভব হয় না। 

লোভের তাড়নায় মানুষ গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়। এসকল নীতি বিবর্জিত কাজ পাপ কাজ বলে বিবেচিত হয়। এর ফলে সৃষ্টিকর্তা মানুষের প্রতি চরম অসন্তুষ্ট হন। আর এই নীতি বিবর্জিত পাপ কাজের কারনে মানুষের মানবিকতার আত্মিক মৃত্যু ঘটে। 

শিক্ষা: লোভ মানুষের স্বাভাবিক ও নির্মল জীবন-যাপনের পথে বড় অন্তরায়। লোভে পড়ে মানুষ সর্বনাশের দিকে এগিয়ে যায় এবং ধ্বংস ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার জীবনের অবসান ঘটে। এককথায় লোভই মানুষের সকল অপরাধের উৎস।


যতক্ষন শ্বাস, ততক্ষন আঁশ

মানুষের চলার পথ মসৃণ নয়। প্রতিটি পদক্ষেপ নানা বাধা-বিপত্তিতে ভরা। চাওয়ার সাথে পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করতে হয়। তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে আশায় বুক বাঁধে। অসংখ্য তরঙ্গ যেমন সাগরকে বিক্ষুদ্ধ করে, তেমনি দুঃখ-কষ্ট সংসার জীবনে মানুষকে করে তোলে হতাশ বিপর্যস্ত। 

ভেলা ভাসিয়ে মানুষ যেমন উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দেয় তেমনি আশার তরীতে ভেসে মানুষ সংসারের সাগরকে অতিক্রম করে। উত্তাল সাগরে মানুষের অবলম্বন হয় ভেলা আর সংসারে মানুষের অবলম্বন হয় আশা বা স্বপ্ন। সমস্যা এবং দুঃখ স্থায়ী নয়। আজকের দিনের সমস্যা এবং দুঃখ একদিন না একদিন শেষ হবে। 

অন্ধকার কালো রাতের পর নতুন ভোর আসবে। দুঃখের দিনের একদিন অবসান ঘটবে, এই আশাতেই মানুষ সকল দুঃখ কষ্টকে অতিক্রম করে। আশা না থাকলে কোনো মানুষ বাচঁতে পারতো না এক মুহুর্তের জন্যেও। যেদিন মানুষ স্বপ্ন দেখা ভুলে যাবে, সেদিনই তার কাছে বেঁচে থাকা মূলহীন হয়ে পড়বে। এই জগতের কোনো কিছুই আর তাকে আকর্ষণ করবে না। আশা বা স্বপ্ন মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সাফল্যের পথে প্রেরণা যোগায় প্রতিটি ক্ষণে। ভবিষ্যতের আশা বা স্বপ্ন প্রেরণা যোগায় বলেই, বর্তমানকে আমরা মেনে নিতে পারি। 

শিক্ষা: আশা বা স্বপ্ন আছে বলেই, নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পৃথিবী আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ভোর আসবে এই বিশ্বাস আছে বলেই, মানুষ অত্যন্ত সহজভাবে জীবনকে গ্রহণ করেছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে একেকটি নতুন স্বপ্নের দিকে।



যে সহে, সে রহে

জীবনে চলার পথ নিছক সরল-সোজা নয়। নানারকম বাধা-বিপত্তি, দুঃখ-শোক, হতাশা, গ্লানি, ভয়, দারিদ্র্য প্রভৃতি বিরুদ্ধ শক্তি এসে বারবার মানুষের পথ আগলে দাঁড়ায়। এসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে মানুষকে এ পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। আর পদে পদে এসব প্রতিবন্ধকতার সাথে লড়তে মানুষের মধ্যে সবার আগে যে মহৎ গুণটির থাকা প্রয়োজন সেটি হলো সহনশীলতা। পৃথিবীর ইতিহাসে যারা চির স্মরণীয় হয়ে আছে তাদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাদের জীবনের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল সহিষ্ণুতা তথা সহনশীলতা। 

যুগে যুগে মহামানবেরা তাদের অসীম ধৈর্য শক্তির গুণে সাধারণ মানুষদের কল্যাণের পথে টেনে এনেছেন। এ পথে চলতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্নরকম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই তারা অসহিষ্ণুতার পরিচয় দেননি। মুহাম্মদ (স.) কিংবা যিশু খ্রীষ্টের জীবন সহনশীলতার অসামান্য নিদর্শন। কেবল মহামানবদের জীবন নয় বরং সাধারণ মানুষের জীবনেও পদে পদে আছে নৈরাশ্যের বেদনা, পরাজয়ের গ্লানি, ব্যর্থতার ক্লান্তি, বিপদের আশঙ্কা। এসবের বিরুদ্ধে প্রতি মুহুর্তে সংগ্রাম করে মানুষকে এ বিশ্ব সংসারে তার অবস্থান তৈরি করে নিতে হয়। 

আর এই সংগ্রামের মূল পাথেয় বা শক্তি হচ্ছে ধৈর্য তথা সহনশীলতা। সহনশীল ব্যক্তি পরাজয়, ব্যর্থতা, হতাশা, ক্লান্তি, ভয় প্রভৃতির কাছে কখনোই মাথা নত করে না। উপরন্তু এসবের বিরুদ্ধে ধৈর্য সহকারে সংগ্রাম করে সফলতার পথে এগিয়ে যায়। কেননা সে জানে অধৈর্য হলে এই প্রতিকূল শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। একমাত্র সহনশীলতার গুণেই মানুষ কঠিন বাস্তবতার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাফল্যের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। সহনশীলতা বা ধৈর্যের গুণেই স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস বারবার যুদ্ধে পরাজিত হয়েও মাকড়সার জাল বোনা দেখে যুদ্ধ জয়ের স্বপ্ন দেখেন এমনকি যুদ্ধে জয়লাভও করেন। তাই ব্যর্থতাকে ভয় পেলে চলবে না বরং সহিষ্ণুতাকে ধারণ করে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে। 

শিক্ষা: জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই সহনশীলতা একান্ত প্রয়োজনীয়। জীবনের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ধৈর্য সহকারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলে বড় ধরণের বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। অন্যদিকে ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সাফল্য অনিবার্য।



মিত্রত্ব সর্বত্রই সুলভ, মিত্রত্ব রক্ষা করাই কঠিন

সামাজিক জীব হিসেবেই একজন মানুষ আর একজন মানুষের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। এ সম্পর্ক বন্ধুত্বের, আত্মীয়তার, রক্তের, পারস্পরিক নির্ভরশীলতার। পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল মানুষের মধ্যে থাকে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সহমর্তিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও আস্থা। এগুলোর সমন্বয়ে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে বন্ধুত্বের ভূমিকা অনেক। একজন সত্যিকারের বন্ধু পারে কারো জীবন বদলে দিতে এবং সুন্দও ও সমৃদ্ধ করতে। কিন্তু পৃথিবীতে এই সত্যিকারের বন্ধু পাওয়া সহজ কথা নয়। 

আমাদের চারপাশে যে শত শত বন্ধুরা ঘোরাফেরা করে তাদের বেশিরভাগই প্রয়োজনের তাড়নায়, স্বার্থ সিদ্ধি কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বন্ধুত্ব করে। উদ্দেশ্যপ্রবণ মানুষেরা কখনো ব্যক্তির অধিকারে থাকা অর্থের জন্য, কখনো খ্যাতির জন্য, শক্তির জন্য আবার কখনো বা ক্ষমতার জন্য বন্ধুত্ব করে। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে তারা ব্যক্তির সেই অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি, ক্ষমতা ও শক্তিকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। 

বন্ধুর সুসময়ে সে সারাক্ষণ বন্ধুর পাশে থাকে। চাটুকারিতায় বন্ধুকে মুগ্ধ করে তার কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে। একই সাথে তারা বন্ধুর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়, পরশ্রীকাতর হয়ে পড়ে। বন্ধুর বিনাশ চায়। নিজের স্বার্থসিদ্ধি হওয়া মাত্রই তারা বন্ধুত্বে ফাটল ধরায়, অস্বীকার করে। তাই এত দিনের বন্ধুটি যখন কোনো বিপদে পড়ে বা কোনো সাহায্য প্রয়োজন হয় তখন উদ্দেশ্যপ্রবণ বন্ধুকে আর কোথাও পাওয়া যায় না। অন্যদিকে প্রকৃত বন্ধুরা কখনোই বন্ধুর বিপদে তাকে এড়িয়ে চলে না, কিংবা সুসময়ে তার থেকে কোনো সুবিধাও নেয় না। বরং সকল পরিস্থিতিতে তারা বন্ধুর পাশে থাকে। কোনো রকম স্বার্থ ছাড়াই, কেবলমাত্র নিখাঁদ বন্ধুত্বের টানে তারা সবার আগে বন্ধুর বিপদে ঝাপিয়ে পড়ে। 

কিন্তু এমন বন্ধুদের সংখ্যা নিতান্তই কম। তাছাড়া হাজারো স্বার্থপরের ভিড়ে আমরা প্রকৃত বন্ধুকে চিনতে পারি না। ভুল মানুষের প্ররোচনায় তাদেরকেই সত্যিকারের বন্ধু ভেবে আস্থা রাখি। বিনিময়ে তারা প্রয়োজন মিটিয়ে বন্ধুত্ব বিনষ্ট করে। ফলে বন্ধুত্ব রক্ষা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। 

শিক্ষা: স্বার্থপর বন্ধুদের হিংসা, লোভ ও পরশ্রীকাতরতা বন্ধুত্ব নষ্ট করে। শুধুমাত্র নিঃস্বার্থ প্রকৃত বন্ধুরাই বন্ধুত্বের মর্যাদা দেয় এবং তা রক্ষা করে। তাই আমাদেরকে প্রকৃত বন্ধু বাছাই করতে শিখতে হবে।


হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে কাজ করে যাও গোপনে গোপনে

মহাকাল অনাদি, অনন্ত ও নিরবিচ্ছিন্ন। মহাকালের এই অনন্ত ব্যাপ্তির মধ্যে রয়েছে ত্রিমাত্রিক কালবিন্দু-অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। ক্ষুদ্রায়ু মানুষের পক্ষে মহাকালের অখ- প্রবাহকে উপলদ্ধি করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই মানুষ সময়কে উপলদ্ধি করে অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের সীমারেখায়। মানুষের জীবনচর্চায় বর্তমান হলো অস্তিত্বময় এক কালপর্ব, ভবিষ্যৎ হলো কল্পনা বিস্তারের এক অনাগত স্বপ্ন। আর অতীত হলো ধূসর স্মৃতির রাজ্য। জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধারাবাহিক অংশ যা একদিন বর্তমান ছিল, মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে লাভ করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের সৌধ। 

আসলে অতীত নেপথ্যে থেকে নীরবে নিঃশব্দে বর্তমানকে প্রণোদিত করে। বর্তমানে যে সাফল্য, যে সঞ্চয়, যে অর্জন তা অতীতের অভিজ্ঞতা ও কর্মজ্ঞান থেকেই প্রাপ্ত। অতীত বিরাট মহীরুহের ন্যায় কর্ম, জ্ঞান ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে চলেছে মানুষের ওপর, একটি জাতীর উপর। বর্তমানের জীবন, সংস্কার, সংস্কৃতি অতীতের জীবনের বীজ থেকে উৎপন্ন। অতীতের বীজাঙ্কুর থেকেই জন্ম নেয় বর্তমানের বিশাল মহীরূহ। অতীতের শ্রম, সাধনা, কর্ম বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য বয়ে আনে সমৃদ্ধি ও সাফল্য। 

অতীতের ব্যর্থতা বর্তমানকে সতর্কভাবে গড়ে তোলার শিক্ষা দেয়। অতীতের শিক্ষা মানুষকে সঠিক ও সতর্কভাবে পথ চলার নির্দেশ দেয়। জীবনে চলার পথে মানুষ যখন হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ায়, বিচলিত সঙ্কটে মানুষ তখন মূল্যায়ন করে অতীতকে। আজকের বর্তমান আগামী দিনে অতীত হয়ে মানুষকে অভিজ্ঞতার আলোকে পথনির্দেশ করবে, তাই আজকের বর্তমানকে সুন্দর ও অভিজ্ঞতাময় করে তোলা অত্যন্ত জরুরী। 

শিক্ষা: অতীত মানবজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য কালপর্ব। অতীত নেপথ্যে থেকে পরিচালনা করে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে। তাই অতীতকে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে সাফল্যম-িত করে তুলতে হবে।



Post By Md.Ripon Mia

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন