31 October, 2018

বাংলা ব্যাকরণ সারাংশ ৯১-১২০

পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক কথা নয়।

পাস করা আর শিক্ষিত হওয়া এক কথা নয়। আমাদের দেশে প্রচুর পাস করা লোক থাকলেও জ্ঞানী লোকের খুবই অভাব। স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদের প্রকৃত জ্ঞানার্জন করতে হবে। শুধু পরীক্ষা পাসের হাস্যকর মোহে আমরা যেন আর মোহিত না হই।
সারাংশ: জ্ঞানার্জন করা আর পরীক্ষায় পাস করে ডিগ্রি অর্জন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বিষয়। জাতি হিসেবে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত জ্ঞানী হওয়া, ডিগ্রি অর্জন করা নয়।

পুরুষগণ আমাদিগকে সুশিক্ষা হইতে পশ্চাৎপদ রাখিয়াছেন

পুরুষগণ আমাদিগকে সুশিক্ষা হইতে পশ্চাৎপদ রাখিয়াছেন বলিয়া আমরা অকর্মণ্য হইয়া গিয়াছি। ভারতে ভিক্ষুক ও ধনবানÑএই দুই দল লোক অলস এবং ভদ্রমহিলার দল কর্তব্য অপেক্ষা অল্প কাজ করে। আমাদের আরাম-প্রিয়তা খুব বাড়িয়াছে। আমাদের হস্ত, মন, পদ, চক্ষু ইত্যাদির সদ্ব্যবহার হয় না। দশজন রমণীরতœ একত্র হইলে ইহার উহার-বিশেষত আপন আপন অর্ধাঙ্গের নিন্দা কিংবা প্রশংসা করিয়া বাকপটুতা দেখায়। আবশ্যক হইলে কোন্দালও চলে।
সারাংশ: পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ হলো সুশিক্ষার অভাব। এই সুশিক্ষার অভাবে নারীরা অলস, অকর্মণ্য হয়ে পড়েছে এবং বাজে আলাপে সময় ব্যয় করছে। গোটা জাতির উন্নতির জন্যই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ অবশ্যম্ভাবী।

পৃথিবীতে যাহার দিকে তাকাও, দেখিবে সে নিজের অবস্থায় অসন্তুষ্ট।

পৃথিবীতে যাহার দিকে তাকাও, দেখিবে সে নিজের অবস্থায় অসন্তুষ্ট। দরিদ্র কিসে ধনী হবে সে চিন্তায় উদ্বিগ্ন, ধনী চোর-ডাকাতের ভয়ে ত্রস্ত। রাজা শত্রুর ভয়ে ভীত। এক কথায় পৃথিবীতে এমন কেহ নেই, যে পূর্ণ সুখে সুখী। অথচ কৌতুকের বিষয় এই, পৃথিবী ছেড়ে যেতেও কেহ প্রস্তুত নয়। মৃত্যুর নাম শুনলেই দেখি মানুষের মুখ শুকিয়ে যায়। মানুষ যতই দরিদ্র হোক, সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাকে অনাহারে কাল কাটাতে হোক, পৃথিবীর কোনো আরাম যদি তার ভাগ্যে না থাকে তবু সে মৃত্যুকে চায় না। সে যদি কঠিন পীড়ায় পীড়িত হয়, শয্যা হতে উঠিবার শক্তিও না থাকে তবু সে মৃত্যুর প্রার্থী হবে না। কে না জানে যে, শত বছরের পরমায়ু থাকলেও তাকে একদিন না একদিন মরতে হবে।
সারাংশ: নিজ অবস্থানে প্রকৃত অর্থে সুখী এমন মানুষ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু জীবনে অতৃপ্তি থাকা সত্যেও মানুষ মৃত্যুকে বরণ করতে চায় না। দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক, দারিদ্রের মতো অসহনীয় অবস্থায়ও সে অমরত্বের প্রত্যাশা করে।

পৃথিবীতে যখন কোনো সত্য আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছে,

পৃথিবীতে যখন কোনো সত্য আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে চাহিয়াছে, তখনই তাহার বিরুদ্ধাচরণ হইয়াছে। এই বিরুদ্ধাচরণের ধারা ও নীতি মূলত সকল ক্ষেত্রেই অভিন্ন। প্রথম প্রথম যখন সেই সত্য আত্মপ্রকাশ করিতে চায়, তখন বিপক্ষীয়গণ তাহাকে উপেক্ষা করিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিতে চায়। ঠাট্টা-তামাসা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তখন তাহাদের প্রধান অবলম্বন হইয়া থাকে। সত্যের সেবক যখন এই প্রাথমিক বিঘ্নকে অতিক্রম করিয়া অগ্রসর হইতে থাকেন, তখন ঐ উপেক্ষা ক্রোধে পরিণত হয় এবং বিপক্ষীয়েরা নীচ গালাগালি ইত্যাদি দ্বারা সেই ক্রোধের অভিব্যক্তি করিতে থাকে। গালাগালি দিয়াও যখন কোনো ফল হয় না, তখন তাহারা সত্যকে প্রতিহত করিবার জন্যে দল পাকাইতে এবং অপেক্ষাকৃত নির্বোধ এবং গোঁড়া লোকদিগকে ধর্মের নামে উত্তেজিত করিতে থাকে। ইহাও যখন নিষ্ফল হইয়া যায়, তখন নানা প্রকার শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করা এবং সাধ্যে কুলাইলে অবশেষে শাণিত খড়গ ও বিষাক্ত কৃপাণ দ্বারা সত্যের মু-পাত করিবার জন্যে চেষ্টা করা হয়।
সারাংশ: আমাদের তরুণ সমাজের দৃষ্টি আজ জ্ঞানার্জনের দিকে নয়, পরীক্ষা পাশের দিকে। জ্ঞানস্পৃহার সঙ্গে সম্পর্কহীন শিক্ষা কোনো জাতির জন্যই মঙ্গল বয়ে আনে না। তাই আমাদের তরুণ সমাজকে পরীক্ষা পাশের মোহ ত্যাগ করে প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে জাতিকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

প্রকৃত জ্ঞানের স্পৃহা না থাকলে শিক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

প্রকৃত জ্ঞানের স্পৃহা না থাকলে শিক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তখন পরীক্ষায় পাসটাই বড় হয় এবং পাঠ্যপুস্তকের পৃষ্ঠায় জ্ঞান সীমাবৃদ্ধ থাকে। এই কারণেই পরীক্ষায় পাস করা লোকের অভাব নেই আমাদের দেশে, কিন্তু অভাব আছে জ্ঞানীর। যেখানেই পরীক্ষা-পাসের মোহ তরুণ ছাত্রছাত্রীদের উৎকণ্ঠিত রাখে, সেখানেই জ্ঞান নির্বাসিত জীবনযাপন করে। একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে জগতের বুকে অক্ষয় আসন লাভ করতে হলে জ্ঞানের প্রতি তরুণসমাজকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। সহজ লাভ আপাতত সুখের হলেও জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচিত হবে না।
সারাংশ: পৃথিবীতে কোনো নতুন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত কঠিন একটি ব্যাপার। কেননা এর পদে পদে আছে বহু বাধা বিপত্তি। যারা সত্যের বিরোধী তারা নানা উপায়ে সত্য প্রতিষ্ঠার পথকে রুদ্ধ করে দিতে চায়।

প্রাচীনযুগে জ্ঞানার্জন আজিকার মতো এত সস্তা ছিল না।

প্রাচীনযুগে জ্ঞানার্জন আজিকার মতো এত সস্তা ছিল না। জ্ঞান ছিল সাধনার সামগ্রী। সে সাধনায় ছাত্রমাত্রকেই শ্রম স্বীকার করিয়া উহা সঞ্চয় করিতে হইত। শুক্তির মতো সে জ্ঞান ধীরে ধীরে জমাট বাঁধিয়া মুক্তাতে পরিণত হইত। মুক্তার কদর মানুষ করিত, জ্ঞানীর কদরও তাহারা করিত। ফলে প্রবাদবাক্য রচিত হইয়াছিল-বিদ্বান সর্বত্র পুজ্যতে’। যুগের হাওয়ায় সে জ্ঞান তপস্যার পাদপীঠ হইতে বাজারে আসিয়া আস্তানা গড়িয়াছে। লোকে পয়সার বদৌলতে তাহা আহরণ করিয়া কৃতবিদ্যা হইতেছে। কিন্তু ইহার ফলে বিদ্যার অধঃপ্রভা বিলুপ্ত হইয়াছে, যাহা কিছু দৃষ্ট হইতেছে তাহা বাহ্যিক চাকচিক্য মাত্র।
সারাংশ: প্রাচীনকালে জ্ঞানার্জন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল বলেই জ্ঞান এবং জ্ঞানী উভয়েরই সম্মান ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিদ্যা অনেকাংশে হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক। আর এর ফলে বিদ্যা তার প্রকৃত সত্য হারিয়ে বাহ্যিক আড়¤¦রে পরিণত হয়েছে।

ফুল ফুটেছে, এটাই ফুলের চরম কথা।

ফুল ফুটেছে, এটাই ফুলের চরম কথা। যার ভালো লাগল সে-ই জিতল, ফুলের জিত তার আপন আবির্ভাবেই। সুন্দরের অন্তরে আছে একটি রহস্যময় আয়ান্তর অথীত সত্য, আমাদের অন্তরের সঙ্গে তার অনির্বচনীয় সম্বন্ধ তার সম্পর্কে আমাদের আত্মচেতনা হয় মধুর গভীর ও উজ্জ্বল। আমাদের ভেতরে মানুষ বেড়ে ওঠে, রেঙে উঠে, রসিয়ে ওঠে। আমাদের সত্তা যেন তার সঙ্গে বসে মিলে যায় একেই বলে অনুরাগ।
সারাংশ: ফুল সার্থকতা লাভ করে বিকশিত হৃদয়ের সুবাস দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে। মানুষের হৃদয়ও ঠিক তার অনুরূপ। সুন্দরকে ধারণ করে মানব হৃদয় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠে।

বড়লোকের নন্দগোপালটির মতো দিবারাত্রি চোখে চোখে

বড়লোকের নন্দগোপালটির মতো দিবারাত্রি চোখে চোখে এবং কোলে কোলে রাখিলে যে সে বেশটি থাকবে, তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই, কিন্তু একেবারে তেলোপোকাটির মতো বাঁচাইয়া রাখার চেয়ে এক আধবার কোল হইতে নামাইয়া আরও পাঁচ জন মানুষের মতো দু-এক পা হাঁটিতে দিলেই প্রায়শ্চিত্ত করার মতো পাপ হয় না।
সারাংশ: বাঁচার মতো বাঁচতে হলে কোনো কুসংস্কারকে হৃদয়ে স্থান দেওয়া যাবে না। স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে প্রত্যেককে কর্মে প্রবৃত্ত হতে হবে।

বর্তমান সভ্যতায় দেখি এক জায়গায় একদল মানুষ

বর্তমান সভ্যতায় দেখি এক জায়গায় একদল মানুষ অন্ন উৎপাদনের চেষ্টায় নিজের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছে। আর এক জায়গায় আর একদল স্বতন্ত্রভাবে সেই অন্নে প্রাণ ধারণ করে। চাঁদের যেমন একপিঠে অন্ধকার, অন্যপিঠে ধনের সন্ধান, ধনের অভিমান, ভোগ-বিলাস সাধনের প্রয়াসে মানুষ উন্মত্ত। অন্নের উৎপাদন হয় পল্লীতে, আর অর্থের সংগ্রহ চলে নগরে। অর্থ-উপার্জনের সুযোগ ও উপকরণ যেখানে কেন্দ্রীভূত, স্বভাবত সেখানেই আরাম, আরোগ্য, অমোদ ও শিক্ষার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক লোককে ঐশ্বর্যের আশ্রয় দান করে। পল্লীতে সেই ভোগের সৃষ্টি যা কিছু পৌঁছায় তার যৎকিঞ্চিৎ।
সারাংশ: বর্তমানে গ্রাম এবং শহরের অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। উৎপাদনের কেন্দ্র গ্রাম হলেও তার সকল সুবিধা ভোগ করছে শহরবাসী। তাই গ্রামের মানুষ একদিকে অনাহারে দিন কাটায় আর অন্যদিকে শহরের মুষ্টিমেয় মানুষ ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে।

বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের দিকে একটু ভালো করে দেখলে

বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের দিকে একটু ভালো করে দেখলে সর্বাগ্রে চোখ পড়ে তার দুটি রূপ। এক রূপে সে ধুলিমলিন পৃথিবীর উর্ধ্বে উঠে স্বর্গের সন্ধান করে, তার চরণ কখনও ধরার মাটি স্পর্শ করে না-এইখানে সে স্বপ্নবিহারী। আরেক রূপে সে এই মাটির পৃথিবীকে অপার মমতায় আঁকড়ে ধরে থাকে। এইখানে সে মাটির দুলাল।
সারাংশ: বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের দুটি রূপ লক্ষণীয়। এক রুপে সে কল্পলোকের সৌন্দর্য সন্ধানী। আর অন্য রুপে সে এই মাটির পৃথিবীর -মমতার বন্ধনে আবদ্ধ।

বার্ধক্য তাহাই যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে।

বার্ধক্য তাহাই যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে। বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা মায়াচ্ছন্ন নবমানবের অভিনব জয়যাত্রার শুধু বোঝা নয়, বিঘ;শতাব্দীর নবযাত্রীর চলার ছন্দে ছন্দ মিলাইয়া যাহারা কুচকাওয়াজ করিতে জানে না, পারে না; যাহারা জীব হইয়াও জড়; যাহারা অটল সংস্কারের পাষাণস্তুপ আঁকড়িয়া পড়িয়া আছে। বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা নব-অরুণোদয় দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে দ্বাররুদ্ধ করিয়া পড়িয়া থাকে।
সারাংশ: বয়স কম বা বেশি যা-ই হোক না কেন যারা রক্ষণশীল তারাই বৃদ্ধ। সমাজের প্রগতিকে তারা গ্রহণ করতে চায় না। সমাজের কল্যাণকে যে এরা শুধু ভয় পায় তা-ই নয়, সমাজের কল্যাণের পথে তারা নিজেরাও এক বিরাট বাধা।

বাল্যকাল হইতেই আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই।

বাল্যকাল হইতেই আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা নিতান্ত আবশ্যক, তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনো মতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু মনের বিকাশ লাভ হয় না। হাওয়া খাইলে পেট ভরে না। আহারাদি রীতিমতো হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়া দরকার। তেমনি একটা শিক্ষা পুস্তককে রীতিমতো হজম করিতে অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তকের সাহায্য আবশ্যক। আনন্দের সহিত পড়িতে পড়িতে পড়িবার শক্তি অলক্ষিতে বৃদ্ধি পাইতে থাকে। গ্রহণশক্তি, চিন্তা বেশ সহজ স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধি পায়।
সারাংশ: শিক্ষার সাথে আনন্দের সংস্পর্শ না থাকলে সে শিক্ষা হৃদয়কে বিকশিত করতে পারে না। তাই হৃদয়ের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য পাঠ্য-পুস্তকের পাশাপাশি চিন্তাশক্তি বৃদ্ধিকারী ও আনন্দদায়ক পুস্তক পাঠ করা অত্যাবশ্যক।

বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষায় সামান্যতা বা উচ্চতা নির্ধারিত হওয়া উচিত।

বিষয় অনুসারেই রচনার ভাষায় সামান্যতা বা উচ্চতা নির্ধারিত হওয়া উচিত। রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন সরলতা এবং স্পষ্টতা। যে রচনা সকলেই বুঝিতে পারে এবং পড়িবামাত্র যাহার অর্থ বুঝা যায়, অর্থগৌরব থাকলে তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট রচনা। তাহার পর ভাষার সৌন্দর্য। সরলতা এবং স্পষ্টতার সহিত সৌন্দর্য মিশাইতে হইবে। অনেক রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য সৌন্দর্য, সে স্থলে সৌন্দর্যের অনুরোধে শব্দের একটু অসাধারণতা সহ্য করিতে হয়। প্রথমে দেখিবে তুমি যাহা বলিতে চাও, কোন ভাষায় তাহা সর্বাপেক্ষা পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত হয়। যদি সরল প্রচলিত কথাবার্তার ভাষায় তাহা সর্বাপেক্ষা সুস্পষ্ট ও সুন্দর হয় তবে কেন উচ্চ ভাষার আশ্রয় লইবে? যদি সে পক্ষে টেকচাঁদী বা হুতোমী ভাষায় সকলের অপেক্ষা কার্য-সুসিদ্ধ হয়, তবে তাহাই ব্যবহার করিবে। যদি তদপেক্ষা বিদ্যাসাগর বা ভুদেববাবু প্রদর্শিত সংস্কৃতবহুল ভাষায় ভাবের অধিক স্পষ্টতা ও সৌন্দর্য হয়, তবে সামান্য ভাষা ছাড়িয়া সেই ভাষার আশ্রয় লইবে। যতি তাহাতেও কার্যসিদ্ধ না হয়, আরও ওপরে উঠিবে, প্রয়োজন হইলে তাহাতেও আপত্তি নাই, নি®প্রয়োজনেই আপত্তি।
সারাংশ: স্পষ্টতা, সরলতা এবং অর্থময়তা রচনার অন্যতম প্রধান গুণ। এগুলোর পরই গুরুত্ব দিতে হয় ভাষার সৌন্দর্যের ওপর। যে ভাষায় মনের ভাব সহজে ব্যক্ত হয় সে ভাষাই রচনায় ব্যবহার করা উচিত। ভাষার আড়ষ্ঠর নয়, বিষয় উপযোগী ভাষাই রচনাকে সার্থক করে তোলে।

বিদ্যা মঙ্গলের নিদান সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।

বিদ্যা মঙ্গলের নিদান সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু অল্প বিদ্যা মারাত্মক। সংসারে প্রত্যেক ব্যক্তিরই আপনার যথার্থ মূল্য বুঝিয়া চলা উচিত। যে ব্যক্তি যে বিষয়ে বিশেষরূপে দক্ষ নহে, তাহার পক্ষে সেই কার্যে হস্তক্ষেপ অবিধেয়। যে ব্যক্তি অর্ধশিক্ষিত, সুশিক্ষিতের ভান করা তাহার অনুচিত। কেননা ইহাতে সে যে কেবল আপনার ক্ষতি করে তাহা নহে; তাহার এইরূপ আচরণের দ্বারা সমাজেরও বিষম অনিষ্ট সাধিত হয়। হাতুড়িয়া বৈদ্যগণ প্রকৃত চিকিৎসক নহে, চিকিৎসাশাস্ত্রে তাহাদের অতি অল্প জ্ঞানই থাকে। কিন্তু তাহা তাহারা নিজেরাও বুঝে না বা বুঝিলেও অপরের নিকট স্বীকার করে না। সুতরাং তাহারা কোনো সুচিকিৎসকের ভান করিয়া যদি সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসার ভার গ্রহণ করে তবে ঐ রোগীর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাহারা সমাজের অজ্ঞ লোকদিগকে প্রতারিত করিয়া উহাদের ভীষণ ক্ষতিসাধন করে। তাহাদের এই কার্যের জন্যে চিকিৎসাবিদ্যা দায়ী নহে, দায়ী তাহাদের চিকিৎসাবিদ্যার অল্প জ্ঞান।
সারাংশ: বিদ্যা মুল্যবান এবং মঙ্গলজনক হলেও অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী। অল্প বিদ্যা নিয়ে কোনো কাজে হাত দেওয়া উচিত নয়। কেননা, এতে বড় ধরনের ক্ষতি সাধিত হতে পারে।

বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়।

বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়। তাই বারবার সেদিকে তাকানো প্রয়োজন, মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলাতেই বৃক্ষের কাজের সমাপ্তি নয়। তাকে ফুল ফোটাতে হয়, ফল ধরাতে হয়। নইলে তার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই বৃক্ষকে সার্থকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা, সজীবতা ও সার্থকতার এমন জীবন্ত দৃষ্টান্ত আর নেই।
সারাংশ: মানব অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত থাকে না। জগৎ, জীবন ও জাতির কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়েই মানুষের জীবন সার্থক হয়ে ওঠে।


বিদ্যা মানুষের মূল্যবান সম্পদ, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।

বিদ্যা মানুষের মূল্যবান সম্পদ, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু চরিত্র তদপেক্ষাও মূল্যবান। অতএব, কেবল বিদ্বান বলিয়াই কোনো লোক সমাদর লাভের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না। চরিত্রহীন ব্যক্তি যদি নানা বিদ্যায় আপনার জ্ঞানভান্ডার পূর্ণ করিয়াও থাকে, তথাপি তাহার সঙ্গ পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। প্রবাদ আছে যে, কোনো কোনো বিষধর সর্পের মস্তকে মণি থাকে। মণি মহামূল্যবান পদার্থ বটে, কিন্তু তাই বলিয়া যেমন মণিলাভের নিমিত্ত বিষধর সর্পের সাহচর্য লাভ করা বুদ্ধিমানের কার্য নহে, সেইরূপ বিদ্যা আদরণীয় হইলেও বিদ্যালাভের নিমিত্ত বিদ্বান দুর্জনের নিকট গমন বিধেয় নহে।
সারাংশ: বিদ্যা মূল্যবান সম্পদ হলেও চরিত্রের মূল্য তার থেকে বেশি। চরিত্রহীন ব্যক্তি বিদ্বান হলেও তার সঙ্গ পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ তার সংস্পর্শে সাধু ব্যক্তির চরিত্রও নষ্ট হতে পারে।


ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই হলো জ্ঞানীর কাজ।

ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই হলো জ্ঞানীর কাজ। পিঁপড়ে-মৌমাছি পর্যন্ত যখন ভবিষ্যতের জন্যে ব্যতিব্যস্ত, তখন মানুষের কথা বলাই বাহুল্য। ফকির-সন্ন্যাসী যে ঘরবাড়ি ছেড়ে, আহার-নিন্দ্রা ভুলে, পাহাড়-জঙ্গলে চোখ বুজে বসে থাকে, সেটা যদি নিতান্ত পঞ্জিকার কৃপায় না হয়, তবে বলতে হবে ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে কোনো লাভ নেই। সমস্ত জীব-জন্তুর দুটো চোখ সামনে থাকবার মানে হলো ভবিষ্যতের দিকে যেন নজর থাকে। অতীতের ভাবনা ভেবে লাভ নেই। পন্ডিতেরা তো বলে গেছেন, ‘গতস্য শোচনা নাস্তি।’ আর বর্তমান সে তো নেই বললেও হয়। এটা যেটা বর্তমান সেই-এই কথা বলতে বলতে অতীত হয়ে গেল। কাজেই নদীর তরঙ্গ গণনা আর বর্তমানের চিন্তা করা সমানই অনর্থক। ভবিষ্যতের মানব কেমন হবে সেটা একবার ভেবে দেখা উচিত।
সারাংশ: ভবিষ্যতের ভাবনাই জীবনে সুফল বয়ে আনে, অতীত অথবা বর্তমানের ভাবনা নয়। আর এই ভবিষ্যতকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলার জন্য প্রয়োজন নিখুঁত কর্মপরিকল্পনা।

মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল, কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে,

মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল, কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমন্ত শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সে নীরব মহাশব্দের সহিত এই পুস্তকাগারের তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর অগ্নি কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কালো চামড়ার কারাগারে বেড়া দগ্ধ করিয়া একবার বাহির হইয়া আসে। কালের শঙ্খরন্ধ্রে এই নীরব সহস্র বৎসর যদি এককালে ফুৎকার দিয়া উঠে তবে সে বন্ধনমুক্ত উচ্ছ্বসিত শব্দের স্রোতে দেশ-বিদেশে ভাসিয়া যাইত। হিমালয়ের মাথার ওপরে কঠিন তুষারের মধ্যে যেমন শত শত বন্যা বাঁধা পড়িয়া আছে, তেমনি এই পুস্তকাগারের মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখা হইয়াছে।
সারাংশ: গ্রন্থাগার হলো জ্ঞানের এক নীরব মহাসমুদ্র। হাজার বছরের জ্ঞান ও মানবহৃদয়ের আবেগ, উচ্ছ্বাস বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়ে গ্রন্থাগারে রক্ষিত হয়।

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণী।

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ প্রাণী। জগতের অন্যান্য প্রাণীর সহিত মানুষের পার্থক্যের কারণ- মানুষ বিবেক ও বুদ্ধির অধিকারী। এই বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান নাই বলিয়া আর সকল প্রাণী মানুষ অপেক্ষা নিকৃষ্ট। জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ সাধন করিয়া মানুষ জগতের বুকে অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করিয়াছে, জগতের কল্যাণ সাধন করিতেছে; পশুবল ও অর্থবল মানুষকে বড় বা মহৎ করিতে পারে না। মানুষ হয় জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের বিকাশে। জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের প্রকৃত বিকাশে জাতির জীবন উন্নত হয়। প্রকৃত মানুষই জাতীয় জীবনের প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন আনয়নে সক্ষম।
সারাংশ: বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক করে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। জ্ঞান ও মনুষ্যত্ববোধের মাধ্যমে মানুষ সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে জগতের কল্যাণসাধন করছে। জাতীয় উন্নতির জন্যও এই জ্ঞান ও মনুষ্যত্ববোধই প্রয়োজন, অর্থবল বা পেশীশক্তি নয়।

মানুষের জীবনে ভাষার স্থান যে কত বড় তা আমরা খুব কমই ভেবে থাকি।

মানুষের জীবনে ভাষার স্থান যে কত বড় তা আমরা খুব কমই ভেবে থাকি। আমরা যেমন খাই-দাই, ওঠা-বসা করি ও হেঁটে বেড়াই, তেমনি সমাজজীবন চালু রাখবার জন্যে কথা বলি, নানা বিষয়ে নানাভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিকতা বজায় রাখতে হলে তার প্রধান উপায় কথা বলা, মুখ খোলা, আওয়াজ করা। একে অন্যের সঙ্গে সম্বন্ধ যেমনই হোক না কেন শত্রুতার কী ভালোবাসার, চেনা কী অচেনার, বন্ধুত্বের কিংবা মৌখিক আলাপ-পরিচয়ের, মানুষের সঙ্গে মানুষের যে কোনো সম্বন্ধ স্থাপন করতে গেলেই মানুষমাত্রকেই মুখ খুলতে হয়, কতকগুলো আওয়াজ করতে হয়। সে আওয়াজ বা ধ্বনিগুলোর একমাত্র শর্ত হচ্ছে যে, সেগুলো অর্থবোধক হওয়া চাই।
সারাংশ: মানবজীবনে ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অপরের সাথে সম্পর্ক গড়া এবং তা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন ভাষার। ভাষা বলতে কেবল মুখনির্গত কতগুলো আওয়াজ বা ধ্বনিকে বোঝায় না, ভাষা বলতে বোঝায় অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনির সমষ্টি।

মানুষের এক বড় সৃষ্টি তার সাহিত্য।

মানুষের এক বড় সৃষ্টি তার সাহিত্য। তার বৈচিত্র্যময় জীবনের অন্তধারা দিয়ে মানুষ সাহিত্যের নানা শাখাকে রসে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। যুগ যুগ ধরে মানুষের মনোরাজ্যের লীলা খেলার কল্পলোকের বিচিত্র সূর ধ্বনিত হয়েছে। সাহিত্য সৃষ্টির গোড়া মানুষের চিন্তারাজ্যের এই যাত্রা রুদ্ধ হতে পারে না। যেখানে যে মানুষের মধ্যে এই চিন্তার স্রোতে রুদ্ধ হয়ে এসেছে, সেখানে তার জীবনও স্থবির হয়ে এসেছে। গতিহীন যে সাহিত্যের সম্মুখে অগ্রসর হতে পারে না তার অকালমৃত্যু অনিবার্য।
সারাংশ: সাহিত্য মানুষের এক অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি। যুগ যুগ ধরে সাহিত্য মানুষের মনকে অবলম্বন করে হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ। মনের স্বাভাবিক গতি যদি রুদ্ধ হয় তবে সেই মনের মৃত্যু ঘটে। আর রূদ্ধ হওয়া মনে সাহিত্য তার খোরাক খুঁজে পায় না।

মানুষের সুন্দর মুখ দেখে আনন্দিত হয়ো না।

মানুষের সুন্দর মুখ দেখে আনন্দিত হয়ো না। স্বভাবে সে সুন্দর নয়, দেখতে সুন্দর হলেও তার স্বভাব, তার স্পর্শ, তার রীতিনীতিকে মানুষ ঘৃণা করে। দুঃস্বভাবের মানুষ মানুষের হৃদয়ে জ্বালা ও বেদনা দেয়। তার সুন্দর মুখে মানুষ তৃপ্তি পায় না। অবোধ লোকেরা মানুষের রূপ দেখে মুগ্ধ হয় এবং তার ফল ভোগ করে। যার স্বভাব মন্দ, সে নিজেও দুষ্ক্রিয়াশীল, মিথ্যাবাদী, দুর্মতিকে ঘৃণা করে। মানুষ নিজে স্বভাবে সুন্দর না হলেও সে স্বভাবের সৌন্দর্যকে ভালোবাসে। স্বভাব গঠনে কঠিন পরিশ্রম ও সাধনা চাই, নইলে শয়তানকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
সারাংশ: বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, স্বভাবের সৌন্দর্যই মানুষকে বিচারের মাপকাঠি। খারাপ স্বভাবের মানুষও বাহ্যিক সৌন্দর্যের অধিকারী হতে পারে। আর যারা খারাপ স্বভাবের তারাও সুন্দর স্বভাবের মানুষকে পছন্দ করে। তাই কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে সুন্দর স্বভাবের অধিকারী হতে হবে।

মানুষের একটা বড় পরিচয় সে ভাবতে পরে।

মানুষের একটা বড় পরিচয় সে ভাবতে পরে। করতে পারে যে কোন বিষয়ে চিন্তা। সে চিন্তা ও ভাব মানুষকে সাহায্য করে মানুষ হতে। পশুপাখিকে পশুপাখি হতে ভাবতে হয় না পারেও না ওরা ভাবতে বা চিন্তা করতে। সে বালাই ওদের নেই- যেটুকু পারে তার পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ বাঁচা ও প্রজননের মধ্যে তা সীমিত। সভ্য-অসভ্যের পার্থক্যও এ ধরনের। যারা যত বেশি চিন্তাশীল সভ্যতার পথে তারাই তত বেশি অগ্রসর। আর চিন্তার ক্ষেত্রে যারা পেছনে পড়ে আছে, সভ্যতারও পেছনের সারিতেই তাদের স্থান। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জাতি, দেশ সবের বেলায় এ সত্যের তারতম্য নেই। মোট কথা সভ্যতার প্রথম সোপানই হল চিন্তা-চিন্তার অভ্যাস তথা বুদ্ধির চর্চা।
সারাংশ: মানব জাতি প্রাণিকুলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কেবল চিন্তাশক্তির কারণে। যুগ যুগান্তরে সভ্যতার উদ্ভাবন ও বিবর্তন তাদের চিন্তারই ফসল। মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও গবেষণা জাতিকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে নিয়ে যায়। আর এর বিপরীতে রয়েছে কেবল দৈন্যদশা।

মানুষের মূল্য কোথায়? চরিত্রে, মনুষ্যত্বে, জ্ঞানে ও কর্মে।

মানুষের মূল্য কোথায়? চরিত্রে, মনুষ্যত্বে, জ্ঞানে ও কর্মে। বস্তুত চরিত্র বলেই মানুষের জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা বুঝতে হবে। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করার আর কিছু নেই। মানুষের শ্রদ্ধা যদি মানুষের প্রাপ্য হয়, মানুষ যদি মানুষকে শ্রদ্ধা করে, সে শুধু চরিত্রের জন্যে, অন্য কোনো কারণে মানুষের মাথা মানুষের সামনে এত নত করার দরকার নেই। জগতে যে সকল মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদের গৌরবের মূলে এই চরিত্রশক্তি। তুমি চরিত্রবান লোক, একথার অর্থ এই নয় যে, তুমি লম্পট নও। তুমি সত্যবাদী, বিনয়ী এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করো, তুমি পরদুঃখকাতর ন্যায়বান এবং মানুষের ন্যায় স্বাধীনতাপ্রিয়, চরিত্রবান মানে এই।
সারাংশ: চরিত্র মানবজীবনের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। চরিত্র বলেই মানুষ গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়, লাভ করে অপরের শ্রদ্ধা। আর চরিত্রবান বলতে মূলত সত্যবাদী, বিনয়ী, জ্ঞানবান, পরদুঃখকাতর, ন্যায়বান, স্বাধীনতাপ্রিয় ব্যক্তিকে বোঝায়।

মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। জীবসত্তা সেই ঘরের নিচের তলা আর মানবসত্তা বা মনুষ্যত্ব ওপরের তলা। জীবসত্তার ঘর থেকে মানবসত্তার ঘরে উঠবার মই হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাই আমাদের মানবসত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে। অবশ্য জীবসত্তার ঘরেও সে কাজ করে; ক্ষুৎপিপাসার ব্যাপারটি মানবিক করে তোলা তার অন্যতম কাজ। কিন্তু তার আসল কাজ হচ্ছে মানুষকে মনুষ্যত্বলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অন্য কথায় শিক্ষার যেমন প্রয়োজনের দিক আছে, তেমনি অপ্রয়োজনের দিকও আছে; আর অপ্রয়োজনের দিকই তার শ্রেষ্ঠ দিক। সে শেখায় কী করে জীবনকে উপভোগ করতে হয়, কী করে মনের মালিক হয়ে অনুভূতি ও কল্পনার রস আস্বাদন করা যায়।
সারাংশ: মনুষ্যত্ববোধের কারণে মানুষ পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা। মানুষের জীবসত্তা থেকে মানবসত্তা তথা মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় হলো শিক্ষা। শিক্ষাই মানুষকে মনুষ্যত্ববোধের সন্ধান দেয়, জীবনকে উপভোগ করতে শেখায় এবং হৃদয়কে আলোকিত করে।

মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সার্থকতা সৈনিক-জীবনে।

মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সার্থকতা সৈনিক-জীবনে। সৈনিক যে-পথ দিয়া হাঁটেন, সে পথের ধূলাগুলিও পবিত্র। সৈনিক সামান্য নহেন। পাপকে দমন করিবার জন্যে যে মানুষ অসি গ্রহণ করেন, তিনি অসামান্য। জীবনকে তুচ্ছ জানিয়া যিনি কামান-গোলার সম্মুখে বুক পাতিয়া দাঁড়ান, তিনি কত বড় তাহা কি ভাবিয়া দেখিয়াছ? সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দান করিবার সাহস যাঁহার আছে তিনি কি শ্রেষ্ঠ মানুষ নন? খোদার সহিত প্রেম করিবার অধিকার সৈনিক ছাড়া আর কাহার আছে? যে মানুষ জীবনের মায়ায় অসত্যকে নমস্কার করে, সে মানুষ নহে।
সারাংশ: নিজ জীবনকে তুচ্ছ করে সৈনিকরা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, অপরের কল্যানের জন্য অস্ত্র ধারণ করে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাই সৈনিক জীবন সার্থক জীবনের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে যারা নিজের সুখের জন্য অন্যায়কে বরণ করে তারা প্রকৃত মানুষ নয়।

মাতৃস্নেহের তুলনা নাই।

মাতৃস্নেহের তুলনা নাই। কিন্তু অতিস্নেহ অনেক সময় অমঙ্গল আনয়ন করে। যে স্নেহের উত্তাপে সন্তানের পরিপুষ্টি, তাহারই আধিক্যে সে অসহায় হইয়া পড়ে। মাতৃস্নেহের মমতার প্রাবল্যে মানুষ আপনাকে হারাইয়া আসল শক্তির মর্যাদা বুঝিতে পারে না। নিয়ত মাতৃস্নেহের অন্তরালে অবস্থান করিয়া আত্মশক্তির সন্ধান সে পায় না - দুর্বল অসহায় পক্ষীশাবকের মতো চিরদিন স্নেহাতিশয্যে আপনাকে সে একান্ত নির্ভরশীল মনে করে। ক্রমে জননীর পরম সম্পদ সন্তান অলস, ভীরু, দুর্বল ও পরনির্ভরশীল হইয়া মনুষ্যত্ব বিকাশের পথ হইতে দূরে সরিয়া যায়। অন্ধ মাতৃস্নেহ সে কথা বুঝে না অলসকে সে প্রাণপাত করিয়া সেবা করে ভীরুতার দুর্দশা কল্পনা করিয়া বিপদের আক্রমণ হইতে ভীরুকে রক্ষা করিতে ব্যস্ত হয়।
সারাংশ: মাতৃস্নেহে অতুলনীয় হলেও অন্ধস্নেহে এবং অত্যধিক স্নেহে সন্তানের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। মাতৃস্নেহে আধিক্যে সন্তানের অন্তরের শক্তির স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হয়। ফলে সে দুর্বল এবং পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া এ জগতে কোন জাতি বড় হইয়াছে?

মাতৃভাষার উন্নতি ছাড়া এ জগতে কোন জাতি বড় হইয়াছে? সারা দেশটিকে মূর্খ রাখিয়া দুই-চারজন লন্ডনে উচ্চজ্ঞানের সাথে পরিচিত হইতে পারিলে কি লাভ হইল ? তেমাার জ্ঞান, তোমার চিন্তা, যতদিন না তোমাকে প্রত্যেক দেশবাসীর আত্মাকে যাইয়া আঘাত করিতেছে, ততদিন তোমার উচ্চ জীবনের কোনো সার্থকতা নাই। তোমার জ্ঞান-ভান্ডারর মূল্য এক পয়সা নয়। জাতিকে উচ্চ রকমের জ্ঞান দান করো- তার চিত্ত মহৎ ও সুখী হইয়া উঠিবে। উহা কি দুই-একটা বিদেশী ভাষার স্কুল-কলেজে সম্ভব? সাহিত্যের ভিতর দিয়া জাতির হৃদয়ে আগুন জ্বালাইয়া দাও। সে জীবনের সার্থকতা অনুভব করিতে সমর্থ হইক।
সারাংশ: মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। একটি দেশের গুটিকয়েক লোক বিদেশি ভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করলেই গোটা জাতির উন্নতি হয় না। জাতির উন্নতির জন্য মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চা, যার মধ্যদিয়ে সমগ্র জাতি জ্ঞানবান হয়ে ওঠবে।

মিথ্যাকে মিথ্যা বলিলে, অত্যাচারীকে অত্যাচারী বলিলে যদি নির্যাতন ভোগ করিতে হয়,

মিথ্যাকে মিথ্যা বলিলে, অত্যাচারীকে অত্যাচারী বলিলে যদি নির্যাতন ভোগ করিতে হয়, তাহাতে তোমার আসল নির্যাতন ঐ অন্তরের যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে না। প্রাণের আত্মপ্রসাদ যখন বিপুল হইয়া ওঠে তখন নির্যাতনের আগুন ঐ আনন্দের এক ফুঁতে নিভিয়া যায়। ইব্রাহীম যখন বিদ্রোহী হইয়া নমরুদ্রের অত্যাচারকে অত্যাচার এবং তাহার মিথ্যাকে মিথ্যা বলিয়া প্রচার করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, নমরুদ তাহাকে ধরিয়া এক বিরাট অগ্নি জাহান্নামে নিক্ষেপ করিল। কিন্তু ইব্রাহীমের সত্যের জোর ছিল বলিয়া তাহার আত্মপ্রসাদের ঐ বিপুল আনন্দের এক ফূঁতে সমস্ত জাহান্নাম ফুল হইয়া হাসিয়া উঠিল। তাঁহার মনে যদি এতটুকু ফাঁকি থাকিত তবে তখনই নমরুদের আগুন তাহাকে ভস্মীভূত করিয়া দিত।
সারাংশ: অসত্য আর অত্যাচার রুখে দাঁড়াতে গিয়ে নির্যাতিত মানুষ প্রকৃতপক্ষে আত্মিক শক্তির দুয়ারে উপনীত হয়। প্রতিবাদ করার প্রবল আত্মসুখের জোয়ারে নমরুদের আগুন ইব্রাহিমের কাছে ফুলের বাগানে পরিণত হয়েছে। কপটতা কখনোই অগ্নিকুন্ড বসে স্বর্গীয় সুখ লাভ করে না।

মুখে অনেকেই টাকা তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলিয়া থাকেন।

মুখে অনেকেই টাকা তুচ্ছ, অর্থ অনর্থের মূল বলিয়া থাকেন। কিন্তু জগৎ এমন ভয়ানক স্থান যে টাকা না থাকিলে তাহার স্থান কোথাও নাই। সমাজে নাই, স্বজাতির নিকট নাই, ভ্রাতা-ভগিনীর নিকটে নাই, স্ত্রীর নিকটে নাই। স্ত্রীর ন্যায় ভালোবাসে এমন বলতে জগতে আর কে আছে? টাকা না থাকিলে অমন অকৃত্রিম ভালোবাসারও আশা নাই। কাহারও নিকট সম্মান নাই। টাকা না থাকিলে রাজায় চিনে না, সাধারণে মান্য করে না, বিপদে জ্ঞান থাকে না। জন্মমাত্র টাকা, জীবনে টাকা, জীবনান্তে টাকা, জগতে টাকারই খেলা।
সারাংশ: অর্থকে অনর্থের মূল বলা হলেও মূলত এটি অত্যন্ত মূল্যবান। অর্থ বিত্তহীন মানুষকে তার পরিবার থেকে শুরু করে সর্বত্রই অসম্মানের চোখে দেখা হয়। মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাই অর্থই প্রধান অবলম্বন।

Posted By Md.Ripon Mia

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন