31 October, 2018

বাংলা ব্যাকরণ সারাংশ ৬১-৯০

ছাত্রজীবন আমাদের ভবিষ্যৎ-জীবনের বীজ বপনের সময়।

ছাত্রজীবন আমাদের ভবিষ্যৎ-জীবনের বীজ বপনের সময়। এ সময় যে যেমন বীজ বপন করবে, ভবিষ্যৎ-জীবনে সে সেরূপ ফল ভোগ করবে। এ সময় যদি আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে জ্ঞানের অনুশীলন করে যাই তবে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় হবে। আর যদি হেলায় সময় কাটিয়ে দেই, তাহলে জীবনের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। যে শিক্ষা জীবন ও জীবিকার পথে কল্যাণকর, যে শিক্ষা মানুষকে উন্নত চরিত্রের অধিকারী করে, তাই সর্বোৎকৃষ্ট শিক্ষা। ছাত্রদের জীবন গঠনে শিক্ষকসমাজ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের সুষ্ঠু পরিচালনার মধ্যে দিয়েই ছাত্রদের জীবন গঠিত হয় এবং উন্মুক্ত হয় মহত্তর সম্ভাবনার পথ।
সারাংশ: আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা ছাত্রজীবনের ওপরই নির্ভর করে। জীবন, জীবিকা এবং উন্নত চরিত্র গঠনের পক্ষে সহায়ক এমন শিক্ষাই ছাত্রদেরকে প্রদান করা উচিত। আর এ পথে শিক্ষার্থীদের পরিচালনা করে তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষকসমাজের।

জাতি শুধু বাইরের ঐশ্বর্য-সম্ভার, দালান-কোঠার সংখ্যাবৃদ্ধি

জাতি শুধু বাইরের ঐশ্বর্য-সম্ভার, দালান-কোঠার সংখ্যাবৃদ্ধি কিংবা সামরিক শক্তির অপরাজেয়তায় বড় হয় না, বড় হয় অন্তরের শক্তিতে, নৈতিক চেতনায় আর জীবনপন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতায়। জীবনের মূল্যবোধ ছাড়া জাতীয় সত্তার ভিত কখনও শক্ত আর দৃঢ়মূল হতে পারে না। মূল্যবোধ জীবনাশ্রয়ী হয়ে জাতির সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়লেই তবে জাতি অর্জন করে মহত্ত্ব আর মহৎ কর্মের যোগ্যতা।
সারাংশ: বাহ্যিক ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতার বলে কোনো জাতি বড় হয়ে ওঠে না। অন্তরের শক্তি, নৈতিকতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা এবং মূল্যবোধ অর্জনই একটি জাতিকে বড় করে তোলে। আর এভাবেই সে জাতি অর্জন করে মহত্ত্ব এবং মহৎ কর্মের যোগ্যতা।

জাতিকে শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ, ধন-সম্পদশালী,

জাতিকে শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ, ধন-সম্পদশালী, উন্নত ও সুখী করতে হলে শিক্ষা ও জ্ঞান বর্ষার বারিধারার মতো সর্বসাধারণের মধ্যে সমভাবে বিতরণ করতে হবে। দেশে সরল ও সহজ ভাষার নানা প্রকারের পুস্তক প্রচারের দ্বারা এ কার্য সিদ্ধ হয়। শক্তিশালী দৃষ্টিসম্পন্ন মহাপুরুষদের লেখনীর প্রভাবে একটি জাতির মানসিক ও পার্থিব অবস্থার পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত অল্পসময়ে সংশোধিত হয়ে থাকে। দেশের প্রত্যেক মানুষ তার ভুল ও কুসংস্কার, অন্ধতা ও জড়তা, হীনতা ও সংকীর্ণতা পরিহার করে একটি বিনয় মহিমোজ্জ্বল উচ্চ জীবনের ধারণা করতে শেখে। মনুষ্যত্ব ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করাই সে ধর্ম মনে করে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হয় এবং গভীর দৃষ্টি লাভ করে। তারপর বিরাট জাতির বিরাট বিরাট দেহে শক্তি জেগে ওঠে।
সারাংশ: কোনো জাতিকে সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে সর্বসাধারণকে শিক্ষা ও জ্ঞানের সমান সুযোগ দিতে হবে। সরল ভাষায় লিখিত বই প্রচারের মাধ্যমে এ কাজ সহজেই করা সম্ভব। এসকল বইয়ে থাকে মহাপুরুষদের শক্তিশালী দৃষ্টির স্পর্শ যা একটি জাতিকে তার সকল ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা পরিহার করে মানসিকভাবে সমুন্নত হতে সাহায্য করে।

জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুখের জন্য এ জগতে

জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুখের জন্য এ জগতে যিনি কথা বলিয়া থাকেন তাহাই সাহিত্য।বাতাসের উপর কথা ও চিন্তা স্থায়ী হইতে পারে না মানব জাতি তাই অক্ষর আবিষ্কার করিয়াছে। মানুষের মূল্যবান কথা, উৎকৃষ্ট চিন্তাগুলি কোন যুগে পাথরে, কোন যুগে গাছের পাতায় এবং বর্তমানে কাগজে লিখিয়া রাখা হইয়া থাকে। যে নিতান্তই হতভাগা সেই সাহিত্যকে অনাদর করিয়া থাকে। সাহিত্যে মানুষের সকল আখাঙ্ক্ষার মীমাংসা হয়। তোমার আত্মা হইতে যেমন তুমি বিচ্ছিন্ন হইতে পার না, সাহিত্যকেও তেমনি তুমি অস্বীকার করিতে পার না উহাতে তোমার মৃত্যু, তোমার দুঃখ ও অসম্মান হয়।
সারাংশ: মানব কল্যাণে ও সুখের নিমিত্তে সুবিন্যস্ত কথামালার স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য লেখকগণ অক্ষর আবিষ্কার করেন। কালের পরিক্রমায় মানুষের মূল্যবান বাণী, উৎকৃষ্ট চিন্তা ও গবেষণা বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রস্তরখ খন্ডে, গাছের পাতায়, পশুর চামড়ায়, কাগজে, লিপিবদ্ধ হচ্ছে। সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত সকল কথামালা জাতিসত্ত্বার আখাঙ্ক্ষারই প্রতিচ্ছবি। যার অপ্রয়োজনীয়তা অনুভব মূর্খতার শামিল।

জীবনের একটি প্রধান লক্ষণ হাসি ও আনন্দ।

জীবনের একটি প্রধান লক্ষণ হাসি ও আনন্দ। যার প্রত্যেক কাজে আনন্দ-স্ফুর্তি তার চেয়ে সুখী আর কেউ নয়। জীবনে যে পুরোপুরি আনন্দ ভোগ করতে জানে, আমি তাকে বরণ করি। স্থূল দৈনন্দিন কাজের ভেতর সে এমন একটা কিছুর সন্ধান পেয়েছে যা তার নিজের জীবনকে সুন্দর শোভন করেছে এবং পারিপার্শ্বিক দশ জনের জীবনকে উপভোগ্য করে তুলেছে। এই যে এমন একটা জীবনের সন্ধান যার ফলে সংসারকে মরুভূমি বোধ না হয়ে ফুলবাগান বলে মনে হয়, সে সন্ধান সকলের মেলে না। যার মেলে সে পরম ভাগ্যবান। এরূপ লোকের সংখ্যা যেখানে বেশি সেখান থেকে কলুষ বর্বরতা আপনি দূরে পালায়। সেখানে প্রেম, পবিত্রতা সর্বদা বিরাজ করে।
সারাংশ: হাসি-আনন্দ মানবজীবনের এমন একটি সম্পদ যার মাধ্যমে জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। এই হাসি ও আনন্দকে যে তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে খুঁজে পেয়েছে তার মাধ্যমে কেবল তার নিজের জীবনই সুন্দর হয়নি চারপাশের মানুষের জীবনও হয়ে উঠেছে উপভোগ্য। এই সুখী মানুষের স্পর্শেই সমাজের কালিমা দূর হয়, সমাজ হয়ে ওঠে পবিত্র ও প্রেমময়।

জীবন বৃক্ষের শাখায় যে ফুল ফোটে তাই মনুষ্যত্ব।

জীবন বৃক্ষের শাখায় যে ফুল ফোটে তাই মনুষ্যত্ব। বৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালতে হবে এই ফুলের দিকে লক্ষ রেখে। শুধু শুধু মাটির রস টেনে গাছটা মোটা হয়ে উঠবে, এই ভেবে কোনো মালী গাছের গোড়ায় জল ঢালে না। সমাজব্যবস্থাকেও ঠিক করতে হবে মানুষকে খাইয়ে-দাইয়ে মোটা করে তুলবার জন্য নয়, মানুষের অন্তরে মূল্যবোধ তথা সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দ সম্বন্ধে চেতনা জাগিয়ে তুলবার উদ্দেশ্যে। যখন এই চেতনা মানুষের চিত্তে জাগে তখন এক আধ্যাত্মিক সুষমায় তার জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং তারই প্রতিফলনে সমস্ত জগৎ আলোময় হয়ে দেখা দেয়। ফলে মানুষ ইতর জীবনের গুরুভার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে লঘুপক্ষ প্রজাপতির মতো হালকা মনে করে।
সারাংশ: মানব জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য হলো মনুষ্যত্ববোধ অর্জন। সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দ প্রভৃতির সমন্বয়ে যে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে তার জাগরণই সমাজব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই মূল্যবোধ যার মধ্যে জাগ্রত হয় তার জীবন অপরিসীম সৌন্দর্যে ভরে ওঠে। তার হৃদয়ের আলোয় সমস্ত পৃথিবী আলোকিত হয়।

জীবনে সুখ-দুঃখের স্মৃতিতে মুখ লুকাইয়া একবারও কাঁদে নাই,

জীবনে সুখ-দুঃখের স্মৃতিতে মুখ লুকাইয়া একবারও কাঁদে নাই, সংসারে এরূপ লোক দেখা যায় না। সকল মনুষ্যেরই হৃদয়-তন্ত্রীতে এক একটি সুর কেমন লাগিয়া থাকে; সেই সুরে যেদিন আঘাত পড়ে, সেই দিন সহসা যেন তাহার জীবনে কী পরিবর্তন সাধিত হয়, তাহার হৃদয়ে মর্মে কী যেন ত্বড়িৎ স্রোত ছুটিয়া বেড়ায়, আপনাকে কোথাও যেন ধরিতে পাইয়া সে একবার পশ্চাতে ফিরিয়া দেখে, তাহার নয়ন বাহিয়া অশ্রুজল ঝরিতে থাকে। কিন্তু কোনখানে কবে কী আঘাত লাগিয়া তাহার হৃদয় চঞ্চল হইয়া ওঠে, সে কি তাহা বুঝিতে পারে/ সে আপনার মনে কাঁদিয়া যায়- না কাঁদিয়া থাকিতে পারে না।
সারাংশ: মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে প্রতিনিয়ত বিচিত্র অনুভূতি খেলা করে। কোনো অনুভূতি কোনো কারণে যদি আন্দোলিত হয় তবে আনন্দে বা বেদনায় তার অশ্রুসিক্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

জ্ঞান যে বাহুতে বল দেয়, জ্ঞানের তাই শ্রেষ্ঠ ফল নয়;

জ্ঞান যে বাহুতে বল দেয়, জ্ঞানের তাই শ্রেষ্ঠ ফল নয়; জ্ঞানের চরম ফল যে তা চোখে আলো দেয়। জনসাধারণের চোখে জ্ঞানের আলো আনতে হবে, যাতে মানুষের সভ্যতার অমূল্য সৃষ্টি, তার জ্ঞান বিজ্ঞান, তার কাল্যকলা, তার মূল্য জানতে পারে। জনসাধারণ যে বঞ্চিত, সে কেবল অন্ন থেকে বঞ্চিত বলে নয়, তার পরম দুর্ভাগ্য যে সভ্যতার এইসব অমৃত থেকে সে বঞ্চিত। জনসাধারণকে যে শেখাবে একমাত্র অন্নই তার লক্ষ্য, মনে সে তার হিতৈষী হলেও কাজে তার স্থান জনসাধারণের বঞ্চকের দলে। পৃথিবীর যেসব দেশে আজ জনসংঘ মাথা তুলেছে, জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার প্রচারেই তা সম্ভব হয়েছে। তার কারণ কেবল এই নয় যে, শিক্ষার গুণে পৃথিবীর হালচাল বুঝতে পেরে জনসাধারণ জীবনযুদ্ধে জয়ের কৌশল আয়ত্ব করেছে। এর একটি প্রধান কারণ সংখ্যার অনুপাতে জনসাধারণের সমাজে শক্তি লাভের যা গুরুতর বাধা অর্থাৎ সভ্যতা লোপের আশঙ্কা, শিক্ষিত জনসাধারণের বিরুদ্ধে সে বাধার ভিত্তি ক্রমশই দুর্বল হয়ে আসে।
সারাংশ: শক্তির উৎস আলো, তেমনি জ্ঞানীরা আলোকিত এবং শক্তিশালী। শক্তি ও সামর্থের বিচারে জ্ঞানের অবস্থান সবার উপরে। সভ্যতার বীজ বুনন থেকে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় চরম উৎকর্ষতায় অবস্থান জ্ঞানাচর্চারই ফলাফল। জ্ঞানের আলোর অভাবে সভ্য সমাজেও আধুনিক বিজ্ঞানের বিশ্বয়কর উদ্ভাবনের সূফল থেকে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা কম নয়। যে জাতি যত বেশী জ্ঞানী সে জাতি তত বেশী উন্নত।

টাকা পয়সার অপব্যবহার করে যে লোক তাকে অমিতব্যয়ী লক্ষ্মীছাড়া বলে।

টাকা পয়সার অপব্যবহার করে যে লোক তাকে অমিতব্যয়ী লক্ষ্মীছাড়া বলে। সময়ের অপব্যবহার যে করে সেও অমিতব্যয়ী। সময়ের সদ্ব্যবহার করো। সময়ের আরেক নাম সম্পদ। লেখাপড়া শিখে চাকুরী করা ছাড়া কি জীবনের আর কোনো ব্যবহার নাই? কামারের লোহার কাজ, চটি তৈরি, পুস্তক বাধাই, কলাই ও কলকারখানার কাজ, কাপড় তৈরি, কাঠের কাজ, খেলনা তৈরি, লণ্ঠন ও ছড়ি তৈরি প্রভৃতি বহু শিল্প তুমি শিখতে পার। আলস্য করে শুধু খেয়ে-পরে, শুধু পৃথিবীর কলহ-দ্বন্দ্ব নিয়ে তুমি তোমার জীবনকে নিরর্থক করে দিও না।
সারাংশ: অর্থ এবং সময় এ দুটোই মানুষের জীবনে অত্যন্ত মূল্যবান। অর্থ অপচয়কারীর মতো সময় অপচয়কারীও অমিতব্যয়ী। তাই অলসতায় বৃথা সময় নষ্ট না করে লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কাজ শিখে সময়কে কাজে লাগানো উচিত।

তবে কি সাহিত্যের উদ্দেশ্যে লোককে শিক্ষা দেওয়া?

তবে কি সাহিত্যের উদ্দেশ্যে লোককে শিক্ষা দেওয়া? অবশ্য নয়। কেননা কবির মতিগতি শিক্ষকের মতিগতির সম্পূর্ণ বিপরীত। স্কুল না বন্ধ হলে যে খেলার সময় আসে না, এ তো সকলেরই জানা কথা। কিন্তু সাহিত্য-রচনা যে আত্মার লীলা, একথা শিক্ষকেরা স্বীকার করতে প্রস্তুত নন। সুতরাং শিক্ষা ও সাহিত্যের ধর্মকর্ম যে এক নয়, এ সত্যটি একটু স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়া আবশ্যক। প্রথমত, শিক্ষা হচ্ছে সেই বস্তু যা লোকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হয়, অপরপক্ষে কাব্যরস লোকে শুধু স্বেচ্ছায়-সানন্দে পান করে; কেননা শাস্ত্রমতে সে রস অমৃত।
সারাংশ: সাহিত্য শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত নয়। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে মানবমন খেলা করে এবং মানবাত্মা এর মাধ্যমে আনন্দ লাভ করে। অন্যদিকে শিক্ষার সাথে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনের সম্পর্কটি অত্যন্ত নিবিড়। তাই শিক্ষা মানুষ বাধ্য হয়ে গ্রহণ করলেও সাহিত্য সে স্বেচ্ছায় পাঠ করে।

তুমি জীবনকে সার্থক-সুন্দর করিতে চাও?

তুমি জীবনকে সার্থক-সুন্দর করিতে চাও? ভালো কথা। কিন্তু সেজন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করিতে হইবে। সব তুচ্ছ করিয়া যদি তুমি লক্ষ্যের দিকে ক্রমাগত অগ্রসর হইতে পার, তবে তোমার জীবন সুন্দর হইবে। আরও আছে। তোমার ভিতর এক ‘আমি’ আছে যে বড় দুরন্ত। তাহার স্বভাব পশুর মতো বর্বর ও উচ্ছৃঙ্খল। সে কেবল ভোগবিলাস চায়। সে বড় লোভী। এই ‘আমি’-কে জয় করিতে হইবে। তবেই তোমার জীবন সার্থক ও সুন্দর হইয়া উঠিবে।
সারাংশ: কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা যায়। জীবনে সার্থকতা অর্জনের জন্য মানুষকে যেমন পরিশ্রমমী হতে হয় তেমনি তাকে হতে হয় সংযমী, ধৈর্য্যশীল এবং একাগ্রচিত্ত।

তুমি যদি অতুল ঐশ্বর্যের অধিপতি হও,

তুমি যদি অতুল ঐশ্বর্যের অধিপতি হও, সিংহাসনে বসিয়া অনেকের ওপর প্রভুত্ব করো, লোকে তোমাকে মহারাজ চক্রবর্তী বড় মানুষ বলিয়া মহাসম্ভ্রমে সম্বোধন করিবে। কিন্তু তুমি যদি আসল মানুষ না হও, তবে মানুষ তোমায় কখনোই মানুষ বলিবে না। ধনে কি মানুষ বড় হয়? ধনের বড় মানুষ কখনোই মনের বড় মানুষ নহে, ধনের মানুষ মানুষ নয়, মনের মানুষই মানুষ। আমি ধন দেখিয়া তোমাকে সমাদর করিব না, জন দেখিয়া তোমাকে আদর করিব না, সিংহাসন দেখিয়া তোমায় সম্মান করিব না, বাহুল্যের জন্যে তোমার সম্মান করিব না- কেবল মন দেখিয়া তোমার পূজা করিব।
সারাংশ: অর্থ সম্পদ এবং ক্ষমতা মানুষের প্রকৃত মর্যাদা নির্ধারণ করতে পারে না। মানবিক গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। মহৎ এবং হৃদয়বান হয়ে ওঠার মাধ্যমেই মানুষ অপরের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা লাভ করে। ধন এবং ক্ষমতার বলে এ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা লাভ করা যায় না।

তুমি বসন্তের কোকিল, বেশ লোক।

তুমি বসন্তের কোকিল, বেশ লোক। যখন ফুল ফোটে, দক্ষিণা বাতাস বহে, এ সংসার সুখের স্পর্শে শিহরিয়া উঠে, তখন তুমি আসিয়া রসিকতা আড়ম্ভ কর; আবার যখন দারুণ শীতে জীবলোকে থরথরি কম্প লাগে, তখন কোথায় থাক বাপু! যখন শ্রাবণের ধারায় আমার চালা-ঘরে নদী বহে, যখন বৃষ্টির চোটে কাক, চিল ভিজিয়া গোময় হয়, তখন তোমার মাজা মাজা কালো দুলালী ধরনের শরীরখানি কোথায় থাকে? তুমি বসন্তের কোকিল, শীত বর্ষার কেহ নও।
সারাংশ: সুযোগসন্ধানী লোকদের স্বভাব বসন্তের কোকিলের মতোই। মানুষের সুসময়ে দিন-রাত পাশে থাকলেও দুঃসময়ে তারা সামান্যতম সহানুভূতির হাতও বাড়িয়ে দেয় না।

দীপশিখা যেমন সমগ্র প্রদীপটির বাণী প্রকাশ করে,

দীপশিখা যেমন সমগ্র প্রদীপটির বাণী প্রকাশ করে, তেমন করিয়া কবি জনসাধারণের অস্পষ্ট অনুভূতিকে নিজের হৃদয়ের গভীর রসানুভূতি দ্বারা ভাষায় প্রকাশ করেন। এই প্রকাশ করিবার আশ্চর্য ক্ষমতা অনন্যসাধারণ। অনুভব অল্পবিস্তর সকলেই করিতে পারে। কিন্তু সেই অনুভূতিকে হৃদয়ের জড়তা ভাঙ্গিয়া তুলিবার সোনার কাঠিটি পায় কয়জনে? রাত্রির অন্ধকারে অরণ্য যে কথাটি বলিবার জন্যে আকুলি-বিকুলি করিয়া মরে, পূর্ব গগনে সোনার রেখা ফুটিতে সেই কথাটি শত শত বিহঙ্গের কণ্ঠে স্বতঃউচ্ছ্বসিত হইয়া ওঠে। কবিরা সেই ভোরের পাখি। তাহারা যে কথাটি বলেন, তাহা খাপছাড়া একটা নিতান্ত অদ্ভুত জিনিস নহে। তাহাদের বাণীটি সমগ্র জনসাধারণের মধ্যে মগ্নচৈতন্য অবস্থায় আছে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করিতে পারি না যে, কোনো মহাকবির জন্যে তোমার দেশ পূর্ব হইতেই ধীরে ধীরে প্রস্তুত হইয়া থাকে।
সারাংশ: অনুভব করার ক্ষমতা সকলের থাকলেও সেই অনুভূতিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেবল একজন কবিই প্রকাশ করতে পারেন। তিনি জনসাধারণের অনুভূতিকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে বাণীরূপ দেন। এমন একজন মহান কবির জন্য গোটা জাতি আগে থেকেই অপেক্ষা করে এবং ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে।

দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য।

দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য। সর্পের মস্তকে মণি আছে বলিয়া সে কি ভয়ংকর নহে? নৈতিক শিক্ষা যেমন অতি প্রয়োজনীয়, তেমনি অতি কঠিন। সুনীতি কাহাকে বলে এবং দুর্নীতি কাহাকে বলে, তাহা নির্ণয় করা প্রায় সহজ, কিন্তু তাহা হইলেও নৈতিক শিক্ষালাভ সুনীতি কি দুর্নীতি তাহা জানিলেই সম্পন্ন হয় না। কার্যত যাহা সুনীতি, তাহা আচরণ করা ও যাহা দুর্নীতি তাহা পরিহার করাই নৈতিক শিক্ষার লক্ষণ। কারণ এইরূপ কাজ করিতে পারা বহু যত ও অভ্যাসের ফল। ফলত নৈতিক শিক্ষা কেবল জ্ঞানলাভের জন্যে অতি প্রয়োজনীয়। যদিও দুর্জন বিদ্যালংকৃত হইতে পারে, তবু দুর্জনের জ্ঞানলাভ প্রায়ই ঘটে না। তাহার কারণ এই যে, জ্ঞানলাভের নিমিত্তে যে সকল যত, অভ্যাস আবশ্যক, তদুপযোগী মনের শান্তভাব দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের থাকে না। তাহারা তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন হইতে পারে, কিন্তু ধীর বুদ্ধির হইতে পারে না।
সারাংশ: নৈতিক শিক্ষা লাভের মাধ্যমে সুনীতি এবং দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে হবে এবং জীবনে চলার পথে সুনীতিকে বরণ করে দুর্নীতিকে পরিহার করতে হবে। দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি যত জ্ঞানী হোক না কেন তার সঙ্গ অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত।

দেখো আমি চোর বটে, কিন্তু আমি কী সাধ করিয়া চোর হইয়াছি?

দেখো আমি চোর বটে, কিন্তু আমি কী সাধ করিয়া চোর হইয়াছি? খাইতে পাইলে কে চোর হয়? দেখো, যাহারা বড় বড় সাধু, চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাহারা অনেকে চোর অপেক্ষাও অধার্মিক। তাহাদের চুরি করিবার প্রয়োজনাতীত ধন থাকিলেও চোরের প্রতি মুখ তুলিয়া চাহে না; ইহাতেই চোরে চুরি করে। অধর্ম চোরের নহেÑ চোর যে চুরি করে, সে অধর্ম কৃপণ ধনীর। চোর দোষী বটে, কিন্তু কৃপণ ধনী তদপেক্ষা শতগুণে বেশি দোষী। চোরের দ- হয়, চুরির মূল যে কৃপণ তার হয় না কেন?
সারাংশ: কৃপণ ধনীর লোভের কারণেই দারিদ্র্যের সৃষ্টি হয়। তখন মানুষ নিতান্ত বাধ্য হয়েই চৌর্যবৃত্তির মতো অপকর্মে লিপ্ত হয়। এই চৌর্যবৃত্তির জন্য মূলত কৃপণ ধনীরাই দায়ী। তাই চোরের পাশাপাশি তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত।

দুঃখ মানুষকে আত্মসচেতন ও সংগ্রামী করে।

দুঃখ মানুষকে আত্মসচেতন ও সংগ্রামী করে। সংগ্রামী জীবনই মানুষকে ক্রমান্বয়ে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে পরিচালিত করে। দুঃখ মানুষের সকল জড়তা ও দৈন্য দূর করে তাকে কর্মতৎপর করে। দুঃখের ভেতর দিয়ে মানুষ জীবন সাধনায় সিদ্ধি লাভ এবং বৃহৎকে উপলব্ধি করে। দুঃখের আগুনে পুড়ে মানুষের জীবন সকল প্রকার ক্লেদ ও গ্লানি থেকে মুক্ত হয়। পরশ-পাথর নিকৃষ্ট ধাতুকে স্বর্ণে পরিণত করে। দুঃখও তেমনি মাটির মানুষকে খাঁটি করে, সত্যাশ্রয়ী, আত্মসচেতন ও কর্মঠ করে। দুঃখের স্পর্শে মানুষের ভেতরকার আত্মসত্তা ও শক্তি জাগ্রত হয়।
সারাংশ: অগ্নিদহনে লোহা যেমন খাটি হয়, তেমনি দু:খের দহনে মানুষ আত্মপ্রত্যয়ী হয়। সুখ এবং দুঃখ একে অপরের পরিপূরক। দুঃখের কারণেই সুখের স্মৃতিগুলো এত মধুময়। দুঃখ-কষ্ট মানুষের জীবনকে উপলব্ধি করতে শেখায়। দুঃখের জন্য আফসোস নয় বরং দুঃখ থেকে সুখ লাভের শিক্ষাই সাধনায় সিদ্ধি লাভের একমাত্র মূলমন্ত্র।

দুঃখই মানুষকে বৃহৎ করে, আপন বৃহত্ত্ব সম্বন্ধে জাগ্রত

দুঃখই মানুষকে বৃহৎ করে, আপন বৃহত্ত্ব সম্বন্ধে জাগ্রত ও সচেতন করে তোলে। যাতে আমাদের খর্বতা, আমাদের স্বল্পতা, তা অনেক সময় আমাদের আরামের হতে পারে; কিন্তু তা আনন্দের নহে।যা আমরা বীর্যের দ্বারা না পাই, অশ্রুর দ্বারা না পাই, তা আমরা সম্পূর্ণ পাই না যাকে দুঃখের মধ্য দিয়ে কঠিনভাবে লাভ করি, হৃদয় তাকেই নিবিড়ভাবে, সমগ্রভাবে প্রাপ্ত হয়। মনুষ্যত্ব আমাদের পরম দুঃখের ধন। তা বীর্যের দ্বারাই লভ্য। প্রত্যেহ পদে পদে বাধা অতিক্রম করে যদি তাকে পেতে না হতো, তবে তাকে পেয়েও পেতাম না। যদি তা দুর্লভ না হতো, তবে আমাদের হৃদয় তাকে সর্বতোভাবে গ্রহণ করত না; কিন্তু তা দুঃখের দ্বারা দুর্লভ। কিন্তু দুর্লভ মনুষ্যত্ব অর্জন করার চেষ্টায় আত্মা আপনার সমস্ত শক্তি অনুভব করতে থাকে। সে অনুভূতিতেই তার প্রকৃত আনন্দ।
সারাংশ: দুঃখের মাধ্যমেই মানুষ মনুষ্যত্ববোধ অর্জন করে। এটি মানুষের চেতনাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে, জীবনবোধকে প্রখর করে। গভীর দুঃখের মধ্য দিয়ে মহৎ যা কিছু অর্জিত হয় তার মধ্যে এক বিশাল আনন্দ থাকে।

ধনে কি মানুষ বড় হয়? ধনের বড় মানুষ কখনোই মনের বড় মানুষ নহে;

ধনে কি মানুষ বড় হয়? ধনের বড় মানুষ কখনোই মনের বড় মানুষ নহে; ধনের মানুষ মানুষ নহে, মনের মানুষই মানুষ। আমি ধন লইয়া তোমাকে সমাদর করিব না, জন দেখিয়া তোমাদের আদর করিব না, সিংহাসন দেখিয়া তোমায় সম্মান করিব না, বাহুবলের জন্যে তোমার সম্ভ্রম করিব না; কেবল মন দেখিয়া তোমার পূজা করিব। তুমি যদি স্বয়ং অমানুষ হও, অথচ দ-ধর হইয়া আমাকে দ-করণে উদ্যত হও, তথাপি আমি দ-ভয়ে কদাচ দ-বৎ করিব না। কিন্তু তুমি যদি পবিত্র চিত্তে সাধুভাবে ভিক্ষার ঝুলি ধারণ করিয়া আগমন কর, তবে তোমার দর্শনমাত্রই তৎক্ষণাৎ আমি ধূলিধুসরিত হইয়া পদতলে প্রণত হইব। অতএব যদি মানুষ হইবার অভিলাষ থাকে, তবে মনকে বিমল করো ও সরল হও।
সারাংশ: ধন, জন, শক্তি এবং ক্ষমতা মানুষের প্রকৃত পরিচয়ের নির্ণায়ক নয়। যে ব্যক্তি উদার এবং মহৎ সে-ই প্রকৃত মানুষ। মানুষ তার মনের পবিত্রতা এবং সরলতার মাধ্যমেই সকলের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠে।

ধনীর যথার্থ পরীক্ষা দানে, যাহার প্রাণ আছে,

ধনীর যথার্থ পরীক্ষা দানে, যাহার প্রাণ আছে, তাহার যথার্থ পরীক্ষা প্রাণ দিবার শক্তিতে, যাহার প্রাণ নাই বলিলেই হয় সেই মরিতে কৃপণতা করে। যে মরিতে জানে, সুখের অধিকার তাহারই। যে জয় করে, ভোগ করা তাহারই সাজে, যে লোক জীবনের সঙ্গে সুখ ও বিলাস দুটিকেই আঁকড়িয়ে থাকে সুখ সে-ই ঘৃণিত ক্রীতদাসের নিকট তাহার নিজের সমস্ত ভান্ডার খুলিয়া দেয় না। তাহাকে উচ্ছিষ্টমাত্র দিয়া দ্বারে ফেলিয়া রাখে। আর আহ্বান শুনিবামাত্র যাহারা তুড়ি মারিয়া চলিয়া যায়, সুখ তাহারাই জানে। যাহারা সবলে ত্যাগ করিতে জানে তাহারাই প্রবল বেগে ভোগ করিতে পারে। যাহারা মরিতে জানে না, তাহারা ভোগ-বিলাসের দীনতা, ঘৃণ্যতা, গাড়ি জুড়ি এবং তকমা চাপ রাতের দ্বারা ঢাকা পড়ে না। ত্যাগের বিলাস বিরল কঠোরতার মধ্যে আছে। যদি স্বেচ্ছায় তাহা বরণ করি তবে নিজেকে লজ্জা হইতে বাঁচাইতে পারিব।
সারাংশ: ভোগ-বিলাসের মধ্য দিয়ে জীবন সার্থক, সুন্দর হয়ে ওঠে না। দানশীল, ত্যাগী এবং মহৎকর্মে আত্মোৎসর্গীকৃত ব্যক্তিরাই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা খুঁজে পায়।

নিজের সুখ-দুঃখ, নিজের উন্নতি নিয়ে আমাদের চিত্ত সর্বদা ডুবে আছে।

নিজের সুখ-দুঃখ, নিজের উন্নতি নিয়ে আমাদের চিত্ত সর্বদা ডুবে আছে। যাদের মধ্যে বাস করি, যারা সর্বদা আমাদের আশেপাশে ঘোরে, যারা আমাদের প্রতিবেশী, যারা জীবন-সংগ্রামে অনেক আঘাত সয়েছে, তাদের প্রতি কি কোনো কর্তব্য নেই? এই জগতে নিজের কথা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। পরের কথা ভাববার মতো তোমার প্রাণ হওয়া চাই। পরের জন্যে সর্বস্ব তুমি দান করো, এ আমি বলছি নে। আমি চাই তোমার প্রাণ নিজের মধ্যে যেন ডুবে না থাকে। এমন করে আত্মাকে বিনষ্ট করে ফেললে তোমার মনষ্যুত্বের প্রতি খুবই অবিচার করা হবে।
সারাংশ: কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকাই মানুষের একমাত্র কাজ নয়। আমাদের আশেপাশের প্রতিটি মানুষের প্রতিই আমাদের কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য রযেছে। নিজের পাশাপাশি অপরের কথা ভেবে এই দায়িত্ব কর্তব্যসমূহ যথাযথভাবে পালন করলেই মনুষ্যত্বের মর্যাদা রক্ষিত হয়।

নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কী থাকিত ?

নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কী থাকিত ? একটা ভালো কাজে হাত দিলাম, তাহার নিন্দা কেহ করে না, সে ভালো কাজের দাম কী ? একটা ভালো কিছু লিখিলাম তাহার নিন্দুক কেহ নাই, ভালো গ্রন্থের পক্ষে এমন মর্মান্তিক অনাদর কী হইতে পারে? জীবনকে ধর্মচর্চায় উৎসর্গ করিলাম, যদি কোনো মন্দ লোক তাহার মধ্যে গূঢ় মন্দ অভিপ্রায় না দেখিল তবে সাধুতা যে নিতান্তই সহজ হইয়া পড়িল। মহত্ত্বকে পদে পদে নিন্দার কাঁটা জড়াইয়া চলিতে হয়। ইহাতে যে হার মানে, বীরের সদগতি সে লাভ করে না। পৃথিবীতে নিন্দা দোষীকে সংশোধন করিবার জন্য আছে তাহা নহে, মহত্ত্বকে গৌরব দেওয়াও একটা মস্ত কাজ।
সারাংশ: কোনো মহৎ কাজের দোষ ধরা এবং তার অসৎ উদ্দেশ্য খুঁজে বের করাই নিন্দুকের কাজ। নিন্দুক মহৎ কাজ বা মহত্ত্বের মূল্যায়নে সংশোধকের ভূমিকা পালন করে। তাই নিন্দুকের কাছে হার মানা চলবে না। তাকে গ্রহণ করেই মানুষকে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হতে হবে।

নিরবিচ্ছিন্ন এক বিদ্যা আলোচনা দ্বারা যদিও সেই বিদ্যায়

নিরবিচ্ছিন্ন এক বিদ্যা আলোচনা দ্বারা যদিও সেই বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ হইতে পারে, কিন্তু মনের সাধারণ শক্তির দ্বারা বৃদ্ধি না হয়ে বরং হ্রাস হইয়া যায় এবং এইরূপে পন্ডেতমূর্খ বলিয়া যে একশ্রেণীর বিচিত্র লোক আছে, তাহার সৃষ্টি হয়। বিদ্যা শিক্ষা করিয়াও যদি মানসিক শিক্ষার অভাবে লোকে এইরূপ পরিহাসভাজন হইতে পারে, তবে সেই অত্যাবশ্যক মানসিক শিক্ষা কী এবং কীরূপে তাহা লাভ করা যায়-উৎসুক হইয়া সকলেই এ প্রশ্ন করিবেন। মানসিক শিক্ষা কেবল বিষয় বিশেষের জ্ঞানলাভ নয়, সকল বিষয়েই জ্ঞানলাভের শক্তিবর্ধন ইহার মূল লক্ষণ। সেই শক্তিবর্ধনের উপায়, নানা বিষয়ের যথাসম্ভব শিক্ষা এবং সকল বিষয়ই যথাসম্ভব আয়ত্ত করিবার অভ্যাস। সকল বিষয় সকলের সম্যকরূপ আয়ত্ত হইতে পারে না, কিন্তু সকল বিষয়েরই সহজ কথা কিয়ৎ পরিমাণ আয়ত্ত করিবার শক্তি সকল প্রকৃতির ব্যক্তিরই থাকা উচিত এবং একটু যত করিলেই সেই শক্তি পাওয়া যায়। প্রকৃত মানসিক শিক্ষা না হইলে জ্ঞানলাভ হয় না।
সারাংশ: নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে আদ্যোপান্ত শিক্ষালাভ করলেই মানুষের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। সম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য এর সাথে সাথে মানসিক শিক্ষা গ্রহণএবং বহুমুখী বিচিত্র বিষয়ে জ্ঞানলাভ করাটাও জরুরি।

নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার গান গেয়ে সোনায়।

নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার গান গেয়ে সোনায়। অনুভূতির কান দিয়ে সে গান শুনতে হবে। তাহলে বুঝতে পারা যাবে জীবনের মানে বৃদ্ধি, ধর্মের মানেও তাই। প্রকৃতির যে ধর্ম, মানুষের সে ধর্ম; পার্থক্য কেবল তরুলতা ও জীবজন্তুর বৃদ্ধির ওপর তাদের নিজেদের কোন হাত নেই, মানুষের বৃদ্ধির ওপরে তার নিজের হাত রয়েছে। আর এখানেই মানুষের মর্যাদা। মানুষের বৃদ্ধি কেবল দৈহিক নয়, আত্মিকও। মানুষকে আত্মা সৃষ্টি করে নিতে হয়, তা তৈরি পাওয়া যায় না। সুখ-দুঃখ-বেদনা উপলব্ধির ফলে অন্তরের যে পরিপক্বতা, তাই তো আত্মা।
সারাংশ: বৃক্ষ মানবজীবনের প্রতিরূপক। জীবন ও ধর্ম, প্রকৃতি ও মানুষ উভয়ের মূলকথা হলো বৃদ্ধি। মানুষ বৃক্ষ ও অন্যান্য প্রাণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, কারণ তার বৃদ্ধির ভার তার উপরই ন্যস্ত। তবে এ বৃদ্ধি ততটা শারীরিক নয়, যতটা আত্মিক। আর এই আত্মাও তাকে তৈরি করে নিতে হয়।

নিষ্ঠুর ও কঠিন মুখ শয়তানের।

নিষ্ঠুর ও কঠিন মুখ শয়তানের। কখনও নিষ্ঠুর বাক্যে প্রেম ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠা হয় না। কঠিন ব্যবহারে ও রূঢ়তায় মানবাত্মার অধঃপতন হয়। সাফল্য কিছু হইলেও যে আত্মা দরিদ্র হইতে থাকে, সুযোগ পাইলেই সে আপন পশু-স্বভাবের পরিচয় দেয়। যে পরিবারের কর্তা ছোটদের সাথে অতিশয় কদর্য ব্যবহার করে, সে পরিবারের প্রত্যেকের স্বভাব অতিশয় মন্দ হইতে থাকে।
সারাংশ: নিষ্ঠুরতা এবং কঠোরতার মাধ্যমে প্রেম ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এর জন্যে প্রয়োজন স্নেহ-মায়া-মমতা ও ভালোবাসা। পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, পরিবারের যিনি প্রধান তার নিষ্ঠুরতা এবং দুর্ব্যবহার ধীর ধীরে পরিবারের সবাইকে প্রভাবিত করে।

পথ-পার্শ্বের ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড়-পড় হইয়াছে,

পথ-পার্শ্বের ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড়-পড় হইয়াছে, তাহাকে বাঙিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম, ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে, তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদেরই মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙিয়া নতুন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে এক তরুণেরই। খোদার দেওয়া এই পৃথিবীর নিয়ামত হইতে যে নিজেকে বঞ্চিত রাখিল, সে যত মোনাজাতই করুক, খোদা তাহা কবুল করিবেন না। খোদা হাত দিয়াছেন বেহেশত ও বেহেশতি চিজ অর্জন করিয়া লইবার জন্যে, ভিখারির মতো হাত তুলিয়া ভিক্ষা করিবার জন্য নয়।
সারাংশ: দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নড়বড়ে অতীত আদর্শকে ভেঙে ফেলতে হবে। তরুণরাই কেবল এ দুঃসাহস নিয়ে কাজ করতে পারে। অন্যের দয়া প্রার্থনা নয় কর্মের মধ্য দিয়েই এ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

পরীক্ষায় পাস করিবার এই হাস্যোদ্দীপক উন্মত্ততা

পরীক্ষায় পাস করিবার এই হাস্যোদ্দীপক উন্মত্ততা পৃথিবীর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না। পাস করিয়া সরস্বতীর নিকট চিরবিদায় গ্রহণ, শিক্ষিতের এইরূপ জঘন্য প্রকৃতিও আর কোন দেশে নাই। আমরা এদেশে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করিয়া জ্ঞানী ও গুণী হইয়াছি বলিয়া অহঙ্কারে স্ফীত হই, অপরাপর দেশে সেই সময়েই প্রকৃত জ্ঞান চর্চা আরম্ভ হয়। কারণ সেই সকল দেশের লোকের জ্ঞানের প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ আছে।
সারাংশ: আমাদের দেশে পরীক্ষায় পাস করাকে শিক্ষার শেষ ধাপ মনে করা হলেও অন্যান্য দেশে তা জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের দ্বার। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ থেকেই মানুষ আরো বেশি জ্ঞান পিপাসু হয়ে উঠে।

পরের উপর সম্পূর্ণ ভার দিয়া নিশ্চিত থাকা এ সংসারে চলে না।

পরের উপর সম্পূর্ণ ভার দিয়া নিশ্চিত থাকা এ সংসারে চলে না। নিজের দেখিবার ক্ষমতা না থাকিলে অজ্ঞাতসারে সংসারের উপর যে ক্ষতি আসিয়া পড়িবে তাহা অনিবার্য। ছেলে স্কুলে গেল ও নিয়মিত সময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইল, ইহাতে খুব আহ্লাদিত হইবার যথেষ্ট কারণ নাই। তাহার পড়াশোনার কি উন্নতি হইতেছে, তাহা নিজেরা না পারিলেও কোন শিক্ষিত আত্মীয় কিংবা বন্ধুর দ্বারা সময় সময় পরীক্ষা করিয়া দেখা উচিত। অনেক স্কুলে যখন মাতাপিতা বহু কষ্টে নিজেদের নিতান্ত প্রয়োজনীয় ব্যয় সংকুচিত করিয়াও ছেলেদের পড়াশোনার খরচ চালাইয়া থাকেন, তখন কষ্টার্জিত সামান্য আয়ের বৃহৎ অংশ একেবারে নিষ্ফল হইয়া কেন পড়িবে, এটা কি দেখিবার বিষয় নহে? এইরূপে ব্যয় করিয়াই কোন কোন ছেলের উন্নতির আশা বাল্যকালেই বিনষ্ট কহইতেছে। মাতাপিতার এই বিষয়ে কিছুতেই উদাসীন থাকা উচিত নয়।
সারাংশ: নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব অন্যকে দিয়ে সম্পাদন করলে তার ফল ক্ষতি ছাড়া আর কিছু আশা করা যায় না। সন্তানের শিক্ষার ভার ও শুধু শিক্ষকের হাতে ছেড়ে দিলে অনেক সময় সে শিক্ষা নিষ্ফল হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে পিতামাতার উদাসীনতা তাই দায়িত্বহীনতার সামিল।

পাখি যেমন তার বাপ-মায়ের কাছে পাখা মেলে উড়তে শেখে,

পাখি যেমন তার বাপ-মায়ের কাছে পাখা মেলে উড়তে শেখে, তেমনি বিদ্যালয়ে এসে মানুষকেও শিখতে হবে তার অন্তরের পাখা মেলাতে। এর জন্য দরকার মনের মধ্যে মহৎ আকাঙক্ষা পোষণ করা। কেবল শরীর রক্ষার জন্য বেশি সাধনার দকার হয় না, কিন্তু সত্যিকার মানুষ হতে হলে অন্তরে বড় আকাক্সক্ষা জাগিয়ে রাখতে হবে। এই শিক্ষাই মানুষের আসল শিক্ষা।
সারাংশ: বিদ্যালয়ে এসে মানুষ শিখতে পারে কীভাবে তার অন্তরকে প্রসারিত করতে হয়। তবে এর জন্য প্রয়োজন মহৎ আকাক্সক্ষা। আর প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো এই মহৎ আকাক্সক্ষাকে জাগ্রত করে মানুষকে সত্যিকার মানুষে রূপান্তরিত করা।

পাপীকে সাধু করা বড় সহজ কথা নয়।

পাপীকে সাধু করা বড় সহজ কথা নয়। ইহাতে অনেক যত, অনেক সতর্কতা ও মানবপ্রকৃতির অনেক জ্ঞান থাকা চাই। এমনকী কিছু কালের নিমিত্ত আপনার স্বার্থ পর্যন্ত বিস্মৃত হইতে হয়। এ সংসারে প্রেমই হৃদয়রাজ্যের অদ্বিতীয় ঈশ্বর। কী শিশু, কী প্রবীণ, কী বৃদ্ধ, কী ধনী, কি নির্ধন, কী পাপী, কী সাধু সকলেই এক বাক্যে ভালোবাসার দাস। অন্যের অন্তঃকরণে প্রভুত্ব করিতে হইলে প্রথম ভালোবাসার দ্বারাই তাহার পথ প্রস্তুত করিতে হয়। এইরূপ পরোক্ষ শিক্ষাদানেরও উদ্দেশ্যে ভালোবাসার দ্বারা কার্যকরী হয়। বস্তুত সহৃদয়তা ছাড়া যে পরের উপকার করা যায় না এবং সর্বময় স্নেহের অভাবে যে সর্বপ্রকার সদগুণও থাকা না থাকা সমান, তাহাতে আর সন্দেহ কী।
সারাংশ: পাপীকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে হলে নিত্য স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তাকে ভালোবাসতে হবে। কেননা, প্রতিটি মানুষই ভালোবাসার প্রত্যাশী। আর ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষ খুব সহজেই অন্যের হৃদয় জয় করতে হবে। তাই পরোপকারী হওয়ার প্রধান কথা হলো সুহৃদয়বান হওয়া।

Posted By Md.Ripon Mia

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন