14 May, 2018

রাতের বিভীষিকা



আজ কাজে আসতে কামালের একটু দেরী হয়ে যায় । এখন বাজে সকাল প্রায় ৯ টা৪৫ মিনিট । হাজিরা খাতায় সই করতে করতে কামাল একবার আশে পাশে চোখ বুলায়তারপর ঝট করে হাজিরের ঘরে লিখে ফেলে ৯টা ৩০ মিনটি । তার পর পাশের টেবিলেবসা এক বুড়োকে লক্ষ্য করে বলে- বুঝলেন কলিম চাচা বউডার শরীর বেশি ভালা না ।আট মাস চলতাছে । অনেক চিন্তায় আছি । বাসায় কেউ নাই যে দেখভাল করবো । কিযে করি ? একটু থেমে আবার বলে -আমারই সব করতে হয় । তার উপর টাকা পয়সারসমস্যায় আছি ।
-একটা কামের লোক রাখতে পারো না মিঞা ? পাশের টেবিলেবসে থাকা ৬০ বছর বয়সের বৃদ্ব কলিম মিয়া কথাটা বলে কিছুটা থামে , তারপরআবার বলে – জানো তো পরপর তিনদিন লেট হইলে এক দিনের বেতন পানিতে যাইবো ।তোমার এ মাসে ওলরেডি ৭ দিন লেট । মানে ২ দিনের বেতন নাই । ব্যাপারটা মাথায়রাইখো ।
কামাল কিছু বলে না মাথা নাড়ায় । সে ব্যাপারটা জানে ।
সরওয়াদিহাসপাতালের এ্যম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসাবে গত মাস দু’য়েক আগে যোগ দিয়েছেকামাল । ওর কাজ হলো সারাদিন এ্যম্বুলেস চালান । যেদিন কাজের চাপ থাকে সেদিনএতো বেশি থাকে যে খাওয়া দাওয়ার সময় থাকে না । আর যেদিন কাজের চাপ কমথাকে সেদিন দেখা যায় দু’একটা ট্রিপ মারার পরই বসে বসে ঝিমোতে হয় । তবেকাজের মধ্যেই থাকতে বেশি ভাল লাগে কামালের । তার উপর কখন ও সখন ও দু’পয়সাউপরি পাওয়া যায় । শুরুতে রুগি ,লাশ পরিবহন করতে একটু খারাপই লাগত ।কিন্তু এখন তা সয়ে গেছে । ও চিন্তা করে দেখেছে যাত্রী পরিবহন করার চেয়েরুগি আর লাশ পরিবহন করাই নিরাপদ। হাউকাউ চেচামেচি কম করে । সই করেএ্যম্বুলেন্সের চাবির জন্য দোতালায় উঠতেই শান্তি দিদির সঙ্গে দেখা হয়েযায় । তিনি প্রায় দৈড়ে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছিলেন । শান্তি দিদিহাসপাতালের সিনিয়র নার্স । কামালকে বেশ স্নেহ্ করে । ঠিক কামালের মতোদেখতে নাকি তার এক ভাই ছিল ।
- কি দিদি কি খবর ?
- ২১ নম্বররুগির অবস্হা বেশি ভাল না রে । স্যারদের খবর দিতে গেছিলাম । তোর বউ কেমনআছে ? কোন চিন্তা করবি না আমরা আছি । শান্তি দিদি দাঁড়ায় না ।
কামালকিছু বলার সুযোগ না পেয়ে হেসে অফিস রুমে ঢুকে যায় । সেখান থেকে চাবিনিয়ে সোজা বাহার ভাইয়ের চায়ের দোকানে । চাবি নেয়ার মানে কামাল গাড়ি সহরেডি । কল আসলেই চলে যাবে । বাহার ভাই এর দোকানে কামাল এলাহি ভাইকে দেখতেপায় । আরো কয়েকজনকে নিয়ে বসে চা খাচ্ছে আর হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে ।এলাহি ভাই এই হাসপাতালের ড্রাইভার ইউনিয়নের নেতা । তার হুকুম ছাড়াহাসপাতালের একটা গাড়িও চলে না । তার কথাই আইন । কামাল কাছে গিয়ে সালামদিয়ে বলে ভাই কেমন আছেন ?
সালামের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে এলাহিমিয়া বলে – কি ব্যাপার কামাল আজকাল থাকো কৈই ? ইউনিয়িন অফিসে আসো টাস না ।শুধু কি রুগিগো সেবা করলে চলবো ? নিজের ভবিষ্যতের দিকে ও তো তাকাইতে হইবো, না কি ? সর্মথনের আশায় এলাহি মিয়া পাশে বসে থাকা অন্য সবার দিকে তাকায় ।সবাই মাথা নেড়ে তাকে সর্মথন দেয় ।
- লিডার কামাল মিয়ার তো বাচ্চা হইবো । পাশে বসে লম্বা মতো তেল চোরা জহির বলে ।
-আবেকামালের বাচ্চা হইবো নাকি ? ক’ওর বউ এর বাচ্চা হইবো । আরেকজন কথাটা বলারসাথে সাথে সবাই হো হো করে হেসে উঠে । কামাল কিচ্ছু বলে না । মুখে হাসি হাসিএকটা ভাব করে রাখে । যেন খুব মজা পাচ্ছে ।
-বস । চাটা খাও । তয় ভাইবাচ্চা হওনের পর কিন্তু ইউনিয়নের জন্য সময় দিবা । আমি তো শালায় তোমগোলাইগা খাটতে খাটতে শেষ । আর যে কোন দরকারে আমার ফোন দিবা । তোমগো লাইগাআমার জান কোরবান । বলে এলাহি মিয়া দল বল নিয়া চলে যায় ।
কামালবুঝতে পারে আজকের দিনটা ওর বসে বসেই কাটবে । চায়ের দোকানে দীর্ঘ সময় বসেথাকার পর ও কোন কল আসেনা । কামাল উঠে ওর এ্যম্বলেন্সের কাছে চলে আসে । ১৭নম্বর এ্যম্বুলেন্স । দরাজা খুলে ও এ্যম্বুলেন্সে উঠে রেডিও চালিয় কতোক্ষনখবর শুনে ।
এমন সময় সোলেমান এসে একটা ঠিকানা দিয়ে যায় । গুলশানযেতে হবে । রুগী নিয়ে আসতে হবে । কামাল বের হয়ে যায় । যাবার সময় একটাকলা আর বন রুটি নিয়ে নেয় বাহার এর দোকান থেকে দুপুরের খাবার হিসাবে খাবেবলে । খাতায় লিখে রাখতে বলে ও টান দিয়ে গাড়ী নিয়ে বেড় হয়ে যায় ।হাসপাতালের গাড়ি চালালে আরেকটা সুবিধা হলো রাস্তায় সাজেন্টের সঙ্গেঝামেলায় পরতে হয় না । কথায় আছে এ্যম্বুলেন্সের সাইরেন শুনলে প্রধানমন্ত্রীর গাড়ীও নাকি সাইড দেয় । কথাটা অনেকটা সত্য ।
দেশের অবস্থাখুব একটা ভাল না । রাস্তা ঘাটে প্রচুর জ্যাম । তাড়াতাড়ি গুলশান থেকেফিরতে পারলেই দ্বায়িত্ব শেষ করে বাসায় ফেরা যায় । মায়া বাসায় একলা ।দুবার এর মধ্যে ওর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে । মায়া বলেছে ও ভাল আছে । কোনসমস্যা নাই । তাই ও এখন অনেকটা নিশ্চিন্তে আছে । গুলশান থেকে ফিরতে ফিরতেরাত হয়ে যায় । দোতালায় চাবি জমা দেবার জন্য আসতেই কামাল খবর পায় শান্তিদিদি ওকে কয়েকবার খুঁজেছে । অফিস রুমে খবর দিয়ে রেখেছে যেন ও আসলেই যেন ৭নম্বর ওয়ার্ডে চলে আসে ।
৭ নম্বর ওয়ার্ডটা খুব বড় । ঢুকতেই হাতেরডান পাশে নার্সদের বসার জায়গা । শান্তি দিদি সেখানেই বসে আছেন । ওকে দেখেবলেন- কামাল এদিকে আয় । তোর সঙ্গে কথা আছে ।
-দিদি বাসায় যেতে হবে । তাড়াতাড়ি কও কি কইবা । কামাল একটা খালি চেয়ার টেনে বসে পরে ।
-তোর বউ কেমন আছে ?
-আছে কোনরকম । দিদি রাইত হইছে । কাজের কথা কও । বউডা একলা ঘরে । কামাল তাড়া দেয় ।
-আরেবছ না ছেমরা । কাজ ছাড়া কি তোরে ডাকছি ? কামাল মাথা নাড়ে দিদি ঠিক বলেছকাজ ছাড়া ডাকেনি । শুন ২১ নম্বর বেডের রুগীডা মারা গেছে । লাশ মর্গে আছে ।তোরে একটু দিয়া আইতে হইবো ।
-কি কও ? এ্যই রাইতের বেলা ? জাকিরের তো নাইট ,ও’রে কও ? কামাল চলে যাবার জন্য দাঁড়িয়ে যায় ।
-আরেশুন ; শুন; তোর তো টাকা দরকার । মালদার পাটি ; পাথের খরচ বাদ দিয়াও মনেহয় হাজার পাঁচেক দিবো । জাকির গেছে সাভারে আসলে কমু । ও মনে হয় রাজিহইয়া যাইবো । সামনে তোর পোলা পাইন হইবো হাতে টাকা পয়সা দরকার তাই আমিতোরে কইলাম । এখন যাওয়া না যাওয়া তোর মর্জি ।
পাঁচ হাজার ! কামালএকটু দ্বিধায় পরে যায় । আসলেই তো ওর হাতে তেমন টাকা পয়সা নাই । প্রতিমাসে মাটির ব্যাংটাতে এতোদিন যা জমিয়েছে সব মিলিয়ে হয়তো হাজার পাঁচেকইহবে । এ সময় পাঁচ হাজার টাকা হলে বাচ্চা হওনের সময় অনেক নিশ্চিত হওয়াযায় ।
-কিন্তু দিদি মায়া তো বাসায় একলা । দেরী করলে ভয় পাইতে পারে ।
-আরে ছেমরা কয় কি ? ভয় পাইবো কেন ? লাগলে আমি যাওনের সময় একবার দেইখা যামু । শান্তি দিদি খাতায় কিছু লিখতে লিখতে বলে ।
- কৈই যাইতে হইবো ? মাথা চুলকাতে চুলকাতে কামাল জিজ্ঞাসা করে ।
-কুমিল্লা । শান্তি দিদি লেখা বন্ধ না করেই বলে ।
-ও মা কও কি দিদি ? কুমিল্লা ! কামাল আতকে উঠে । তাইলে তো ফিরতে ফিরতে ভোর হইয়া যাইবো ।
-আরে না । ভোর হইবো না । এ্যই ধর তিনটা চারইটা বাজতে পারে ।
-হেইডা তো ভোরই । কাইল আবার ডিইটি আছে না ? কখন ঘুমামু কখন কামে আমু ।
-কাইল ১২ দিকে আবি ।সুপার স্যাররে আমি কইয়া রাখুম । কোন অসুবিধা হইবো না । শান্তি দিদি ফাইলটা আলমারিতে রাখতে রাখতে বলে ।
-একটা কথা কও তো দিদি তোমার এতো গর্জ কেন ? ভালাই পাইছো মনে হয় ।
-আরে ছেমরা মর । আমার আবার গর্জ কি ? তুই যখন মরবি তখন তোর লাইগাও আমি মাইষের হাতে পায়ে ধরমু ।
-আহা দিদি রাগ করো কেন ?
-শুন। দিদি কামালের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে । যে মরছে সে অনেক বড়লোক আছিল । বড়লোকগো যেমন খাসলত ভালা হয় না । এই ব্যাডারও তাই আছিল । শেষবয়সে তিনডা বিয়া করছে । কচি কচি মাইয়া গুলি এই এক সপ্তাহ বুইড়াডার লাগিযা করলো । এখন মরার পরও লাশ নিয়া বইয়া আছে । তুই যাইয়া পৌছে দিয়ে আয় ।তোর কাম শেষ । শান্তি দিদি ওর হাতে একটা সাদা খাম দেয় ।
-কি এইডা ? কামাল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ।
-কি আবার টাকা আর ঠিকানা যেহানে যাবি । যা গাড়িতে গিয়া ব।
-কিন্তু দিদি এতোটা পথ এই রাইতের বেলায় লাশ নিয়া একলা যাইতে পারুম না ।
-আরেছেমড়া একলা যাবি কেন । বুইড়ার তিন বউ যাইবো তোর লগে । দেখিস আবার না তুইবুইড়া হইয়া যাছ ।নিজের রসিকতায় নিজেই শান্তি দিদি হেসে উঠে ।
-কি যে কওনা দিদি ? আমি তাইলে গাড়িতে যাই ।
-যা । আর শুন বউরে নিয়া চিন্তা করবি না । আমি তোর দিদি আছি । যা ভাগ ।
কামালবের হয়ে যায় । হঠাৎ করে টাকাটা পেয়ে মেজাজ ভাল হয়ে গেছে । যেতে যেতেমায়ার সঙ্গে ফোনে কথা বলে । মায়াকে জানায় – ওকে এখন কুমিল্লা যেতে হচ্ছে, ফিরতে রাত হবে । মায়া যেন কোন চিন্তা না করে । যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ওফিরে আসবে ।
কামাল নীচে নেমে দেখে লাশ ওর গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে । মনির মিয়া গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে ।
এতোভারী কারো শরীর হয় ? চাইর জন মিল্লাও তুলতে যে কষ্ঠটা হইলো । কামালেরদিকে তাকিয়ে হাত ঢোলতে ঢোলতে কথা গুলো এক নি:শ্বাসে বলে মনির মিঞা ।
-অনেকভারী নাকি ? পাল্টা জিজ্ঞাসা করে কামাল তাকায় এ্যম্বুলেন্সের ভেতরে । বামপাশের বেডের উপর লাশটা রেখে সাদা একটা চাদর দিয়ে লাশটা ঢেকে দেওয়াহয়েছে । মিনির মিঞা বাম দিকের দরজা বন্ধ করে দেয় । কালো বোরকা পরা লম্বামতোন দু’জন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির পাশে । একবার কামালের দিকে তাকিয়েদু’জন নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে । কামালের কান পর্যন্ত সেকথার আওয়াজ পৌছায় না । কাগজ নিয়ে আরেক জন বোরকা পড়া মহিলা কামাল এরকাছে এসে বলে – আপনিই কি যাবেনভাই ?
-কামাল উপরে নীচে হা সূর্চক মাথা নাড়ে ।
-তা হলে চুলুন রওনা হই । মহিলা মিনির মিয়ার হাতে কয়েকটা একশ টাকার নোট দিয়ে অন্য দুজন মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে – কৈই তোমরা আস ।
সবাই উঠে বসতেই কামাল এ্যম্বুলেন্স ছেড়ে দেয় । ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় রাত ১২ টা বাজে ।
রাস্তায়খুব একটা গাড়ি নেই । সোডিয়াম বাতির আলোয় পথ ঘাট কেমন ভৌতিক মনে হচ্ছে ।কামাল এমনিতে ভুত প্রেত বিশ্বাস করে না । তবু এ নির্জন রাতে কেন যেন ওরশরীরে কাটা দিয়ে যায় । গাড়ির গতি ঘন্টায় ৬০ রাখে কামাল । মনে মনে ঠিককরে কোন অবস্থাতেই গাড়ির গতি ৬০কি.মি: এর উপড় নেবে না । কামালের শশুরইছিল ওর ওস্তাদ । সে শিখিয়েছে রাতের বেলা রাস্তা ঘাট যতোই ফাঁকা হোক না কেনএকটা নিদিষ্ট গতিতে গাড়ী চালালে কোন এক্সিডেন্ট হয় না । কামাল কথাটাবিশ্বাস করে । তাই আগে বাগে মনে মনে গাড়ির গতি ঠিক করে নেয় ঘন্টায় ৬০কিলোমিটার ।সংসদ ভবন এর সামনে আসতেই বৃষ্টি শুরু হলো । কামাল মনে মনে বলে-বৃষ্টি হবার আর সময় পেল না । কামাল গাড়ীর গতি আরো কমিয়ে আনে । আসাদ গেটেআড়ং এর সামনে আসতেই সিগনাল পরে গেল । কামাল একবার ভাবলো টান দিয়ে চলেযাবে কিনা ? কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো; না । অস্থির হবার কিছু নাই ।
ওগাড়ী থামিয়ে গ্রীন বাতির জন্য অপেক্ষা করে । রাস্তা প্রায় ফাঁকা । কোনজন মানব নেই । ডানে বামে তাকালে ওর কেমন একটা গা ছমছম করে উঠে । দুর !যতোসব ফালতু চিন্তা ভাবনা । এক কিলোও আসতে পারলাম না আর ভুতের চিন্তা পেয়েবসেছে । নিজেক নিজেই সান্তনা দেয় কামাল । হঠাৎ বাম পাশের জানলা দিয়েএকটা মুখ উকি দিতে চমকে উঠে চিৎকার করে কামাল কে ? কে ?
জানালায়দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে আছে এক বুড়া । মাথায় এলোমেলে সাদা চুল । দু’হাতদিয়ে জানালার কাঁচ চেপে আছে । দাঁত গুলোও কেমন ফাঁক ফাঁক । লোকটা বলে উঠে-দে ; দে; টাকা দে । ভাত খামু টাকা দে ।
মেজাজ খারাপ হয়ে যায়কামালের । মনে হয় নাইমা দুইটা চড় মারে । হারমজাদা ভিক্ষা চাওনের আর কোনসময় পায় না । মর যাইয়া । ও শার্ট ফাঁক করে বুকে থুতু দেয় ।
মনেমনে গজগজ করলেও বুক পকেট হাতরে পাঁচ টাকার একটা নোট বেড় করে লোকটার দিকেবাড়িয়ে ধরে । লোকটা টাকা না নিয়ে বলে -ভাগ । ভাগ । তাড়াতাড়ি ভাগ ।
কথারআগা মাথা বুঝতে পারে না ও । কামালের মনে করে হয়তো পাগল- টাগল হইবো । ঠিকএই সময় ওর পেছনের ছোট জানলায় টোকা দেবার শব্দ হয় । কামাল ওর ঠিক পিঠলাগোয়া যে জানালাটা সেটা একটু ফাঁক করে ও ০পেছনে না তাকিয়েই বলে- জ্বিবলেন ?
-কি হয়েছে ? পেছন থেকে তিন জনের একজন জিজ্ঞাসা করে ।
-না কিছুনা ।
সিগনালছেড়ে দেওয়ায় কামাল গাড়ী টানদেয় । কামাল বাম পাশের মিররে তাকিয়েবুড়োটাকে আর দেখতে পায় না । মনে মনে ভাবে আরে গেলো কোথায় ? ও একটু সামনেঝুকে ফুটপাতটা দেখতে চেষ্টা করে ;কিন্তু বুড়োকে আর দেখতে না পেয়ে বেশঅবাক হয় ও ; তারপর ফার্মগেটের দিকে টার্ন্ নেয় ।
পেছন থেকে ফিস ফিসকরে কথা বলার শব্দ কানে আসে কামালের । এই নিরবতায় তাতে ও কিছুটা সাহসপায় কামাল । মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি শো শো করে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ।রাতে রাস্তায় বেশির ভাগ ট্রাকই চলে । দানবের মতো ট্রাকগুলি ঘোত ঘোত শব্দকরে চলে যায় । সায়দাবাদ ; যাত্রাবাড়ি হয়ে কামাল গাড়ি চালাতে থাকে শনিরআখড়া দিয়ে কুমিল্লার দিকে । এ রাস্তাটা ওর বেশ পরিচিত । একটানা বৃষ্টিহচ্ছে । মনে হয়ে আজ সারা রাতই হবে । মাঝে মাঝে বিকট শব্দে বিদ্যুতচমকাচ্ছে । শীত; শীত একটা ভাব চলে এসেছে । কামাল পানির বোতল খুলে পানি খায়। আশে পাশের দোকান পাট সব বন্ধ । আজ মনে হচ্ছে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কম। পেছন থেকে আবারও টুক টুক করে শব্দ হয় ।
- জ্বি বলেন ? কামাল মাথাটা একটু পেছনে নিয়ে বলে ।
-আমরা একটু নামবো ? এক জন বলে । কামাল অবাক হয় ।
-এখানে ?
-জ্বি । আপনি কি একটু থামেন ।
-মনে হয় দাউদকান্দি এসে পরেছি । সেখানে থামলে হতো না ?
-না। সামনের বড় গাছটার কাছে থামুন । পেছন থেকে অন্য একটি কন্ঠ বলে উঠে ।কথাটা আদেশেয মতো শুনার ওর কাছে । কামাল এ্যম্বুলেন্সটা রাস্তার পাশে একটাবড় গাছের গা ঘেষে দাঁড় করিয়ে দেয় । পেছনের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ওজানালাটা দিয়ে পেছনে তাকায় । আধো আলোয় যা দেখতে পায় তাতে কামাল এর মাথাঘুরে উঠে । সিটের উপর মৃত ব্যক্তি বসে আছে । শুধু বসেই নেই ; হাত নেড়েনেড়ে কি যেনো বলছে । ও প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে যায় । কামাল পেছন থেকেচোখ সরিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেষ্টা করে । সামনে তাকালে দু’ছায়াদেখতে পায় ও । কোন শরীর নেই । শুধু বোঝা যাচ্ছে দেহের অস্তিত্ব । বাতাসেভেসে ভেসে ছায়া দু’কামালের দিকেই আসছে । ভয়ে ওর জান বের হয়ে যাবার জোগার। মনে হচ্ছে মরে যাবে । নিজেকে সিটের সঙ্গে চেপে রাখে ও। মনে হচ্ছে নিজেকেসিটের ভেতর ডুকিয়ে ফেলতে পারলে ভয় কিছুটা কমে যেতো । মনে মনে আল্লাহ্ ; আল্লাহ্ করতে থাকে । ছায়া দু’টো ওর পাশ দিয়ে পেছনে চলে যায় । পেছন থেকেহঠাৎ হাসির শব্দ ভেসে আসে । কামাল সাহস সঞ্চয় করে আবার পেছনে তাকায় ।
লাশটাগাড়ি থেকে নেমে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে । শরীরে জড়ানো মুদ্দারের কাপড়এলোমেলো ঝুলে আছে । লোকটার হাতে সাদা কাপরের একটা পুটলির মতো কিছু । দু’জনমহিলা দাঁড়িয়ে আছে লোকটার ঠিক সামনে । একজন পুটুলিটি একটু ফাঁক করেতেইকামাল একটি শিশুর মাথা দেখতে পায় ।
লোকটা পুটুলিটা গাড়ির ভেতরেছুরে মারে । প্রায় সাথে সাথে হুরমুর করে সবাই গাড়িতে উঠে পরে গাড়িতে।কামালের শরীর শক্ত হয়ে গেছে । একবার ভাবলো গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দেবে কিনা। কিন্তু কোথায় যাবে ? তার চেয়ে ভাল কিছু না দেখার ভান করে থাকলে হয়তোজানে বেচে যাওয়া যাবে । ও মনে মনে প্রার্থনা করে আল্লাহ্ বাঁচাও । পেছনথেকে টোকা দেবার শব্দ আসতেই কামাল চমকে উঠে – গাড়ি চালান । ভারী এটা কন্ঠবলে । কামাল চাবিতে হাত দিতেই গাড়ি স্টাট হয়ে যায় । কামালের মাথা কাজকরছে না । গাড়ি রাস্তায় উঠার সময় সাইড মিররে দেখতে পায় ছায়া দু’টোএখনও দাঁড়িয়ে আছে । হাতে ধরে আছে সাদা মতো দু’টো পুটুলি । এখন আর বৃষ্টিপড়ছে না ; তবে মাঝে মাঝে বিদ্যূত চমকাচ্ছে । মেইন রাস্তা ধরে গাড়িচালাচ্ছে কামাল । ও চালাচ্ছে না বলে গাড়ি নিজে নিজে চলছে বললেই ভাল শুনায়। কেননা এই মুর্হুতে গাড়ির উপর ওর কোন কন্ট্রোল নেই । ও শুধু চুপচাপ বসেআছে । গাড়ি নিজে নিজে চলছে । পেছন থেকে চুক চুক শব্দ ভেসে আসছে । কামালনিজেকে সামলে সাহস সঞ্চয় করে আবার পেছনে তাকায় । দেখতে পায় দু’জন করেদুপাশে বসে সবাই সামনের দিকে ঝুকে বাচ্চাটা
খাচ্ছে। দু’জনের হাতেবাচ্চাটার ছেড়া পা ; অন্য দু,জনের হাতে বাচ্চাটার ছেড়া দুটো হাত ।বাচ্চার মাথাটা নীচে পড়ে আছে । চোখ দুটো খোলা । কামাল এ সমগ্র শরীরগুলিয়ে উঠে । বমি পেয়ে যায় । কি করবে বুঝতে পারে না । সারা শরীর কাঁপছে ।মনে হচ্ছে ও মরে যাবে । সামনে ডান পাশে একটা বাড়ী দেখা যাচ্ছে ।বারান্দায় আলো জ্বলছে । কামাল সমস্ত শক্তি দিয়ে ব্রেক চেপে ধরে ।এ্যম্বুলেন্সটি একটা প্রচন্ড ঝাকি খেয়ে থেমে যায় । পেছনে বসে থাকা সবাইধাক্কা খেয়ে কামাল এর দিকে চলে আসে । পেছন থেকে হালকা একটা কাশির শব্দশোনা যায় । পুরুষ কন্ঠে কেউ একজন বলে – কি হলো ; কি হলো ? আগে বলেছিলামতোরা ধৈর্য্য ধর । আমার কথা শুনলি না । এখন হলো তো । ড্রাইবার হারামজাদা সবদেখেছে । ধর হারামজাদাটারে । তারপর আবারও কাশির শব্দ । ছিড়ে টুকরা টুকরাকরে ফেল । কামালের পেছনের জানালা দিয়ে একটা হাত বেড় হয়ে আসে কামালেরদিকে -থামলি কেন চালা চালা । হাতটা থেকে তখনও টপ টপ করে রক্ত পড়ছে । কামালসামনের দিকে সড়ে এসে পেছনে তাকালে দেখতে পায় শেয়ালের মতো একটা মুখ ।চোখ দুটো জ্বলছে । জিহ্বাটা বের হয়ে আছে । কামাল জ্ঞান হারিয়ে সিটের উপরলুটিয়ে পরে ।
পরিশেষ : পরের দিনে ভোরে মসজিদে ফজরের নামাজ শেষেফেরার সময় মুসুল্লিরা কামাল কে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে। জ্ঞান ফিরে আসার পর কামাল আর কিছু মনে করতে পারে না । আর ওরএ্যম্বুলেন্সটি থেমে ছিলে রাস্তার পাশের একটি বাড়ীর সামনে ।এ্যম্বুলেন্সটির পেছনে একটি সাদা কাপড়ের মোড়ান অবস্থায় পাওয়া যায় একটিবাচ্চা ছেলের দেহের অবশিষ্ট অংশ ।

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন