"সে অনেকদিন আগের কথা"- বলছিলেন দাদু, এক কুয়াশামোড়ানো শীতের সন্ধ্যায়, জমজমাট এক গল্পের আসরে। "তখন চলছে ব্রিটিশ আমল। ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে বাস করছে বহু ব্রিটিশ পরিবার। বন-জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তারা।
এখান থেকেই বের হয়ে এসেছে অনেক জগতখ্যাত শিকারি।" "জিম করবেট?"- ফট করে বলে বসল দিপু। দাদু বললেন, "গুড। আর কারো নাম জানো?" আমরা মাথা চুলকাই। "জিম করবেট সহ আরো অনেক বাঘা বাঘা শিকারি ছিলেন। এদেশীয় একজন কিংবদন্তিতুল্য শিকারী ছিলেন। তাদের নাম জানবে- তোমাদের হোমওয়ার্ক।" এই দিপুর প্রতি মহাবিরক্ত হই আমরা। গল্পের আসর শেষেই গুগল চালাতে হবে ভেবে মেজাজ গরম হয়।
"হ্যাঁ, যা বলছিলাম।" দাদু ফিরে আসেন গল্পে। " খুব নামকরা না হলেও মাঝারি মানের এক ব্রিটিশ শিকা্রীকে নিয়ে আজকের কাহিনী।"
দাদু ধুমায়িত চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিলেন। তারপর শুরু করলেন-
" ভদ্রলোকের নাম চার্লস দা সিলভা। রেলওয়েতে কাজ করতেন, থাকতেন পাহাড়ি বনঘেরা এক গ্রামে। একদিন রাত করে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। আকাশে কৃষ্ণার দ্বাদশী চাঁদ। মৃদু আলোতে এক অপার্থিব রূপ ধারণ করেছে বনানী। অপরূপ শোভা উপভোগ করতে করতে পথ চলছিলেন, হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন পিছনের 'টক টক টক টক' শব্দে। চকিতে ঘুরে দাঁড়ালেন আর দেখতে পেলেন-
বেঁটে মত একজন লোক এগিয়ে আসছে। ভালোমত খেয়াল করে ভয়ানক আঁতকে উঠলেন তিনি।
লোকাটার সর্বাঙ্গ অস্বাভাবিক সাদা।তার চোখ বলে কিছু আছে বলে মনে হল না। চাঁদের আলোয় মুখের কাছটা এক অশুভ গহ্বরের মত দেখাচ্ছিল। পাটকাঠির মত সরু দুই পা চালিয়ে সে এগিয়ে আসছিল।
সিলভা সাহেবের ভুত-প্রেতে বিশ্বাস ছিল না কোনকালে। কিন্তু এই রাতে অজানা আগন্তকের হঠাৎ আগমনে ক্ষণিকের জন্য যেন ভেঙে গিয়েছিল তার অবিশ্বাসের বাঁধ।
সহসাই বাস্তব বিচার-বুদ্ধি ফিরে পেলেন তিনি। অনুধাবন করলেন, এ কোন ভুত-প্রেত নয়, এক অন্ধ, খোঁড়া এবং মৃত্যুপথযাত্রী এক কুষ্ঠ রোগী।
লোকটা সাহায্য চাইছিল। বেশ খানিকটা বিচলিত বোধ করলেন সিলভা। কুষ্ঠকে তিনি যমের মতই ভয় পান।
এমন সময় পাশের ঝোপে ডেকে উঠল ফেউ। ফেউ হল বাঘের সঙ্গী, শিয়াল। এ ডাকের অর্থ একটাই, আশেপাশেই বাঘ আছে - অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায়।
কুষ্ঠরোগী লোকটি এবার ব্যাকুলভাবে সাহায্য চাইতে লাগল। ভয়ানক দোটানায় পড়ে গেলেন সিলভা।
তার হাতে রাইফেল আছে বটে, কিন্তু এই লোকটাকে বাঁচাতে গিয়ে এই আলো- আঁধারিতে বাঘের মুখোমুখি হওয়া তার জন্য মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। সিলভা ঠিক বুঝতে পারলেন, খুব কাছের কোন ঝোপের আড়ালে সন্তর্পণে তাদের দিকে নজর রাখছে বাঘটা।
কুষ্ঠরোগীকে সাহায্য করতে সায় দিল না মন। ভাবলেন, 'এ লোক এমনিতে মৃত্যুর কাছাকাছি, এর নেই কোন পরিবার-পরিজন। একে বাঁচানোর জন্যে নিজেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়াটা বুদ্ধির কাজ না।' পরিবারের লোকজনের কথা মনে পড়তেই তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন।
লোকটার ধারেকাছে ঘেঁষলেন না তিনি। বরং আত্নরক্ষার জন্য সুবিধাজনক এক জায়গায় গিয়ে ঘামতে লাগলেন।
মুহূর্তগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল। হঠাৎ ভীষণ গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঘ।
শোনা গেল কুষ্ঠরোগীর শেষ অসহায় আর্তনাদ।
এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন সিলভা।
বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে বললেন, 'বাঘের মুখোমুখি হয়েছিলাম।' ঘূণাক্ষরেও টানলেন না অসহায় কুষ্ঠরোগীর কথা। সে রাতে ঘুম হল না তার।
তার পরের রাতেও না।
এরপর থেকে অনিদ্রায় ভুগতে শুরু করলেন তিনি।
কিছুদিন পর গ্রামবাসী তার কাছে অভিযোগ জানালো, গ্রামে নাকি এক মানুষখেকো 'সাদা' বাঘের উদয় হয়েছে। তারা অনুরোধ করল, সিলভা সাহেব যেন বাঘটা মারার জন্য ব্যাবস্থা নেন।
সিলভা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন, 'সাদা বাঘ? এ অঞ্চলে তো কোন সাদা বাঘ থাকার কথা নয়!'
তার চাকর বলল, 'শুনবেন না হুজুর, লোকেদের কথা! ওরা বলছে, বাঘটার নাকি কুষ্ঠ হয়েছে।
No comments:
Post a Comment