আবলুস কাঠের বিশাল রাজকীয় জানালাটা হাট করে খোলা। সবে সন্ধ্যা হয়েছে। দক্ষিণা বাতাসে উড়ছে ফিনফিনে পর্দা গুলো। সেই সাথে উড়ছে জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকা ফাতাহ রাজ্যের রাজকুমারী মেহেরের রেশমী চুল। অদ্ভুত বিষন্নতায় ছেয়ে আছে তার মুখটা। শূন্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে দূর দিগন্তে।সূর্য ডুবে যাওয়ায় পশ্চিম দিগন্তে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে । আম্মির কথা খুব মনে পড়ছে তার্। আকাশের এই রং দেখতে খুব ভালোবাসতেন আম্মি।
বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে পারলো না রাজকুমারী । আগামীকাল তার একমাত্র সখী আসবে রাজপ্রাসাদে। তাকে নিয়ে কি কি করবে ; কোথায় বেড়াতে যাবে সেসব পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
মেহেরের ব্যাঙ্গমাটা পাখা নাচাচ্ছে। সেও খুব খুশি! রাজকুমারীর সখীর সাথে তার ব্যাঙ্গামীও যে আসবে!
রাজকুমারী মেহেরের পুরো নাম মেহরিবান। আম্মি চেয়েছিলেন মেয়ে যেন দয়ালু হয়। তাই এই নাম। সবাই রাজকুমারীকে মেহের ডাকলেও আব্বি সবসময়ই তাকে মেহরিবান ই ডাকেন। মা মরা মেয়েটার জন্য মহারাজার ভাবনার অন্ত নেই। তাঁর অসম্ভব লক্ষী মেয়েটার জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। কারন তার মেয়েটা কানে শুনতে পায়না। কথাও বলতে পারেনা। তার বিশাল প্রাচুর্য দিয়ে খুব সহজেই তিনি ভালো কোন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন; কিন্তু তা তিনি করতে চান না। তিনি চান; এমন কেউ আসুক , যে তার মেয়েকে গভীর ভাবে ভালোবেসে গ্রহণ করবে।
দুই
রাতে উত্তেজনায় ভালো ঘুম হলোনা মেহেরের। কতদিন পর সখী আসছে! মেহেরের সখী নাজিফাও রাজকন্যে। তবে মেহেরদের প্রতিবেশী কোন রাজ্যের রাজকন্যে নয়। বহুদূরের আরাকান রাজ্যের রাজার মেয়ে সে। আশেপাশের রাজ্যের রাজকন্যেরা মেহেরকে এড়িয়ে চলে। সত্যি বলতে রাজকুমারেরাও তাই। হয়তো সে বোবা আর কালা বলেই। নাজিফার সাথে পরিচয় হবার আগে মেহের সারাক্ষণ মন খারাপ করে প্রাসাদেই সময় কাটাতো। যতদিন আম্মি বেঁচে ছিলেন; আম্মিই ছিলেন মেহেরের বন্ধু; খেলার সাথী এবং ওর বানানো পুতুল গুলোর একমাত্র দর্শক। ওহ! বলতে ভুলে গেছি; মেহের খুব ভালো পুতুল বানাতে পারতো। আম্মি মারা যাওয়ার পর মেহের পুতুল বানানো ছেড়ে দিল। ব্যাঙ্গামার পিঠে চড়ে বাগানময় ঘুরে বেড়ানো বন্ধ হয়ে গেল। মাস্টারজির কাছে পড়া শেখার সময়টুকু বাদে সারাদিনের পুরোটা সময় সে তাদের বিরাটাকায় ছাদে বসে থাকত।
সেসময় ই একদিন ছাদের এককোণে , ছায়ায় বসে দূর দিগন্তের পানে উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিল। হটাৎ করেই সে মোহাবিষ্ট হয়ে গেল। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে দেখতে পেল , কোন এক দূর রাজ্যের নিরপরাধ রাজা ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছে। মেহেরের মনে হলো , রাজ্যটা সে চেনে।
ব্যাঙ্গমার পিঠে ঘুরে বেড়ানোর সময় ব্যাঙ্গমা একদিন তাকে এক রাজ্যের বাগানে নিয়ে গেছিল। সেই রাজ্যে ব্যাঙ্গমার ব্যাঙ্গমী থাকত। তার সাথেই দেখা করতে গেছিল ব্যাঙ্গমা। ওই রাজ্যে নাকি একজন রাজকন্যে আছে। ব্যাঙ্গমী ওই রাজকন্যের কাছেই থাকত। ব্যাঙ্গমী মেহের কে রাজকন্যের সাথে কথা বলিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মেহের লোকের চোখে করুণা দেখতে পছন্দ করে না। তাই সে ব্যাঙ্গমার পিঠে চড়ে প্রাসাদে ফিরে এসেছিল।
তার মনে হচ্ছিল , সেই রাজ্যের রাজাই বিপদে পড়তে যাচ্ছেন। সে চট জলদি ছাদ থেকে নেমে পুরো ঘটনাটা কাগজে লিখে মহারাজার কাছে দিল। রাজা ফাতাহ প্রথমে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকালেও মেহেরের চোখের আকুতি দেখে কিছু সৈন্য সামন্ত নিয়ে রাজকুমারীর নির্দেশনানুসারে সেই রাজ্যে গিয়ে পৌঁছুল। গিয়ে দেখল , সত্যি সত্যিই অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে শত্রুরা রাজ্যটিকে ঘিরে ফেলেছে। ফাতাহ রাজা একপাশ থেকে শত্রুর ব্যূহ ভেদ করে এগুতে থাকলো। আর ব্যাঙ্গমাকে মেহের আগেই খবর দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল ব্যাঙ্গমীর কাছে। ব্যাঙ্গমী তার মনিব কে বলতে না বলতেই শত্রুর আক্রমনের শিকার হয়েছিল রাজ্যটি। রাজা ফাতাহ যুদ্ধ শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই আরাকান রাজা তাঁর সেনাবাহিনী কে প্রস্তুত করে ফেলেছিল। তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুরা পিছু হটতে বাধ্য হল। আর সেই সাথে দুই রাজ্যের মধ্যে মৈত্রীবন্ধনের সৃষ্টি হলো। ওদিকে ব্যাঙ্গমা -ব্যাঙ্গমীর কাছে সব ঘটনা জানতে পেয়ে আরাকান রাজ্যের রাজকন্যে নাজিফা মেহেরের সাথে আজীবন বন্ধুত্বের ইচ্ছে পোষন করলো।
সেই থেকে রাজকন্যে নাজিফা আর মেহের জনম জনমের সখী।
তিন
ব্যাঙ্গমীর পিঠে চড়ে রাজকন্যে নাজিফা সকাল সকাল ই চলে এলো। নাজিফাকে পেয়ে মেহেরের আনন্দ আর ধরে না! ব্যাঙ্গমা -ব্যাঙ্গমীর পিঠে চড়ে বাগানময় ঘুরে বেড়াল দুজনে। ছাদে আর প্রাসাদের গলি ঘুপচিতে ছোটাছুটি করল। ওদের উত্তেজনা দেখে রাজা হাসেন। বহুদিন পর মেয়েটাকে এত হাসিখুশি দেখছেন তিনি।
ছোটাছুটি করে ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে বসে হাঁফাতে থাকল নাজিফা আর মেহের্। কিছুটা সুস্থির হয়ে নাজিফা মেহেরের বানানো পুতুল গুলো এক এক করে ছুঁয়ে দেখছে মুগ্ধ হয়ে। “আমাকে একটা পুতুল বানিয়ে দিবি? ” হঠাৎ করেই বলল নাজিফা “এমন একটা পুতুল যেটা দেখলে সবাই তাকিয়েই থাকবে। ” মেহের তখন ব্যাঙ্গমার সাথে ঈশারায় কথা বলছে। আর কেউ কিছু বুঝুক আর না বুঝুক , ব্যাঙ্গমা মেহেরের সব কথা বোঝে। নাজিফার কথা শুনে মুখ তুলে তাকালো ও। ছোট্ট একটা হাসি ফুটলে ওর ঠোঁটে। মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ল সে।
ব্যাঙ্গমা -ব্যাঙ্গমীও খুশিতে মাথা নাড়ালো। অবশেষে রাজা ফাতাহ এর চিন্তার অবসান ঘটতে যাচ্ছে!
মেহের ঠিক করল কাঠ , পাথর , ঝিনুক বা তুলো দিয়ে নয়; নাজিফাকে সে খাবার দিয়ে পুতুল বানিয়ে দিবে।
ঘিয়ে চুপচুপে সোনালী রঙ্গের পোলাও দিয়ে মানবদেহ বানালো মেহের্। রকমারি খাবার আর ফলফলাদি দিয়ে পোশাক বানালো। মুকুট আর জুতোও বানালো ও। ধীরে ধীরে পুতুল টি সুদর্শন রাজকুমারের আকৃতি পাচ্ছে। ছোট খাট একটা ছুরি বানিয়ে রাজকুমারের কোমরে গুজে দিল মেহের্। মনে মনে ভাবছে , যদি তার প্রাণ দেওয়ার ক্ষমতা থাকতো , তাহলে সে অবশ্যই এই পুতুল টিকে জীবন্ত করে দিতো। সেই সাথে আরো একটি ক্ষমতা দিতো রাজকুমার কে।
নাজিফা রাজকুমারের পুতুল টি দেখে খুব খুশি হলো।
রাতে ওরা পুতুলটিকে শোবার ঘরে নিয়ে গেল। ঘুমানোর আগে মেহের রাজকুমারের চকচকে কালো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল সে। দক্ষিণা বাতাসে তখনো জানালায় লাগানো ফিনফিনে পর্দা উড়ছে। চাঁদের আলো এসে পড়ছে রাজকুমারের পুতুলটির উপর্।
গভীর রাতে হাঁটার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মেহেরের্। চাঁদের রূপালী আলোয় সে দেখতে পেল কেউ হাঁটাহাঁটি করছে তার কামরায়। ভয় পেয়ে উঠে বসল সে। ওদিকে নাজিফার ও ঘুম ভেঙে গেছে। প্রদীপ জ্বালিয়ে ওরা দেখতে পেল সোনালি চামড়ার অত্যন্ত রূপবান একজন রাজকুমার কামরায় মাঝখানে দাড়িয়ে আছে। “আমার রাজকুমার প্রাণ পেয়েছে! আমার রাজকুমার প্রাণ পেয়েছে !!” বলে নাজিফা রাজকুমারের দিকে এগোয়। রাজকুমার তখন ধীর পায়ে হেঁটে মেহেরের সামনে এসে দাড়ায়। সে তো মেহেরের কাছেই যাবে! মেহের ই তো তাকে নিজ হাতে বানিয়েছে! মেহেরের প্রার্থনায় ই তো সে জীবন পেয়েছে। রাজকুমার মেহেরের হাত দুটি নিজের হাতে তুলে নেয়। মেহের তখনো অবাক চোখে চেয়ে আছে রাজকুমারের দিকে।
মেহের মুখ তুলে আরেকবার রাজকুমারের চোখের দিকে তাকায়। আবারো মোহাচ্ছন্ন হয় ও। ঘোর লাগা চোখে সে দেখতে পায় , ফুলবাগানে বসে আছে রাজকুমার আর মেহের। রাজকুমারকে গান গেয়ে শোনাচ্ছে ও।
সৃষ্টিকর্তা তাহলে তার মনের বাসনা পূর্ণ করেছেন! সত্যি সত্যিই রাজকুমার কে সেই ক্ষমতা টা দেওয়া হয়েছে!
No comments:
Post a Comment