20 May, 2018

মজার কিন্তু শিক্ষণীয় গল্প


১।
একটি বাচ্চা ছেলের হাতে নরম কিন্তু বিষাক্ত শুঁয়ো-ওয়ালা বিছুটি পাতা লেগে যায়। বাচ্চাটি তার মা’র কাছে ছুটে গিয়ে বলে, “এত ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, আমি কিন্তু ওটা আলতো করে ছুঁয়েছিলাম।” “সেটাই তো ব্যাপার,” মা তাকে বোঝায় তখন, “তার ফলেই তো রোঁয়াগুলো তোমার হাতে ঘষে ঘষে গেল আর সেগুলো থেকে হুল ফুটে গিয়ে এখন জ্বলে যাচ্ছে। আবার যদি কখনো বিছুটি পাতা ধরো, সাহস করে, ঠিক মত, শক্ত করে, না ঘষে ধরবে, ঐ রোঁয়াগুলো-ই তখন চুপটি করে নরম সিল্কের মত শুয়ে থাকবে, কোন ঝামেলা করবে না।”

(টীকাঃ ইংরেজীতে গাছটির নাম বলা হয়েছে Nettle, আন্তর্জালে অনেক খোঁজাখুঁজি করে বাংলা অনুবাদ-এ বিছুটি পাতার থেকে কাছাকাছি কিছু পাই নি। বিছুটি পাতা এইভাবে শক্ত করে ধরলে জ্বালা-চুলকানির কবলে পড়ার থেকে রেহাই পাওয়া যায় কি না আমার জানা নেই। )

প্রাচীন বচনঃ যা-ই করো, আলগা, আলগা নয়, পুরো শক্তি লাগিয়ে করো।

২।
এক ইঁদুর, এমনই কপাল খারাপ তার, এক ব্যাঙ-এর সাথে জিগরী দোস্তি পাতিয়ে বসল। ব্যাঙটা একদিন, মাথায় নষ্টামি বুদ্ধি চাপলে যা হয়, ইঁদুরটার এক পায়ের সাথে নিজের এক পা আচ্ছা করে বেঁধে ফেলল।

তারপর টানতে টানতে তাকে নিয়ে চলল সে নিজে যেই পুকুরে থাকত সেখানে। পুকুর-পাড়ে পৌঁছে, হঠাৎ সে ঝপাং করে দিল লাফ, ইঁদুর-সুদ্ধ সোজা জলে গিয়ে পড়ল। জলে পড়ে সেই ব্যাঙের সে কি মাতামাতি! সাঁতরাচ্ছে, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে ডাকাডাকি করছে, যেন এক বিরাট কাজ করে ফেলেছে সে। ইঁদুরটা কি কষ্ট যে পেল! খানিকক্ষনের মধ্যেই জলে ডুবে, দম আটকে মারা গেল বেচারা।

তার শরীরটা জলে ভাসতে থাকল। তখনো ব্যাঙের পা-এর সাথে তার পা বাঁধা। উড়তে উড়তে এক বাজপাখীর নজরে পড়ল সেই জলে-ভাসা ইঁদুর। ছোঁ মেরে নেমে এসে ইঁদুরটা নিয়ে সে উঠে গেল ঐ-ই-ই উঁচুতে। ইঁদুরের পায়ে পা বাঁধা থাকায় সেই ব্যাঙ-ও তখন বাজ-এর থাবায় বন্দী।

এর পর ইঁদুরের সাথে সাথে ব্যাঙটা-ও চলে গেল বাজ-এর পেটে।

প্রাচীন বচনঃ যেমন কাজ তার তেমন ফল।

৩।
এক কুকুর আর তার সাথী এক মোরগ। দু’জনে মিলে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে রাত হয়ে গেল। তখন তারা আশ্রয়ের জন্য ঘন বনের মধ্যে চলে এল। মোরগ চড়ে বসল এক গাছের অনেক উঁচু একটা ডালে আর কুকুর সেই গাছের নীচে তার বিছানা পেতে নিল। ভোর হলে, যেমন সে রোজ করে, মোরগ ডেকে উঠল কোঁকড়-কো করে। সেই আওয়াজ শুনে এক শিয়ালের মনে হল সকালের নাস্তাটা আজ মোরগের মাংসে সেরে ফেললে খাসা হয়। শিয়াল তখন ঐ ডালটার নীচে চলে এল আর নানাভাবে মোরগের মিষ্টি গলার আওয়াজের সুখ্যাতি করে তার সাথে দোস্তি পাতাতে চাইল।
“আপনি রাজী থাকলে,” বলল সে মোরগকে, “আজকের দিনটা আপনার সাথে কাটাতে পারলে আমার খুব ভাল লাগবে।”
মোরগ বলল, “মশায়, এক কাজ করেন, একটু এগিয়ে এই গাছের গোড়ায় চলে যান। আমার মালপত্র যে টানে সে ঐখানে ঘুমিয়ে আছে। তারে ডেকে তোলেন, সে আপনাকে এখানে আসার জন্য দরজা খুলে দিবে।”
শিয়ালকে ঐদিকে আসতে দেখেই কুকুর একেবারে লাফ দিয়ে উঠল আর শিয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল।

প্রাচীন বচনঃ অন্যদের যারা ফাঁদে ফেলতে চায়, প্রায়ই তারা নিজেরাই নিজেদের ফাঁদে পড়ে যায়।

আমি বলিঃ চেনা শয়তান যখন ভাল কথা বলে মন ভোলায়, জেনে রেখো সে তোমায় ডোবানোর ফন্দী আঁটছে।

৪।
এক হরিণ-এর একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দেখতে না পাওয়া বিপদ-এর হাত থেকে বাঁচতে সে সমুদ্রের ধারের মাঠে ঘাস খেয়ে বেড়াত। তার ভাল চোখটা সে ফিরিয়ে রাখত ডাঙ্গার দিকে যাতে কোন শিকারী বা শিকার ধরা কুকুর এলে দূর থেকেই তাকে দেখতে পেয়ে যায়। সমুদ্রের দিক থেকে সে কোন বিপদের ভয় করত না। তাই তার নষ্ট চোখটা সে ঐ দিকে রেখে রেখে চরে বেড়াত। একদিন সমুদ্রে সেই এলাকা দিয়ে নৌকা বেয়ে যাচ্ছিল কিছু লোক। তারা হরিণটাকে দেখতে পেয়ে অনায়াসে তাক করে তাকে মেরে ফেলল।
মরার সময় হরিণটা বলে গেল, “কি দুর্ভাগা আমি! ডাঙ্গার দিক থেকে যাতে বিপদে না পড়ি তার জন্য কত ব্যবস্থা নিলাম, এমনকি এই সাগরের ধারে চলে এলাম, ভেবেছিলাম বেঁচে গেলাম, উল্টে আরো সহজে মারা পড়লাম।”

প্রাচীন বচনঃ যে দিক থেকে সবচেয়ে কম সন্দেহ করা যায়, অনেক সময় সেদিক থেকেই বিপদ ঘনিয়ে আসে।

আমি বলিঃ অন্ধ বিশ্বাস পতন ঘটায়। যুক্তি দিয়ে সবসময় সবদিকে নজরদারী জারী রাখতে লাগে।

৫।
ঘুরতে ঘুরতে এক নেকড়ে একটা দলছুট ভেড়াকে একলা পেয়ে গেল। নেকড়ের ইচ্ছে হল বেশ মহত্ব দেখায়। ভেড়াটার উপর কোন হামলা না চালিয়ে বরং কিছু যুক্তি-তক্ক দিয়ে সেটাকে বুঝিয়ে দেওয়া যাক যে ভেড়াটাকে খাওয়ার ব্যাপারটা নেকড়ের হক-এর মধ্যেই পড়ে। সে ভেড়াটাকে বলল
“এই যে মশায়, গেল সনে আপনি আমাকে বিস্তর অপমান করেছিলেন।”
ভেড়াটা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল “কিন্তু, আমার তো গত বছর জন্মই হয়নি!”
নেকড়েটা তখন বলে, “হতে পারে। কিন্তু, আমার মাঠের ঘাস খাও তুমি”
“না হুজুর,” ভেড়া উত্তর দ্যায়, “ঘাস খেতে কেমন তাই আমি জানি না এখনো।”
নেকড়ে ছাড়ে না, “তুই আমার কুয়ো থেকে জল খাস। ”
“না, না,” আর্তনাদ করে ওঠে ভেড়াটা, “আমি এখনো এক ফোঁটা জল ও মুখে দিইনি। আমি ত এখনো শুধু মা’র দুধ খাই! ”
“হুম! আমার সব অভিযোগ-এর তুই ভালই জবাব দিয়ে দিয়েছিস। কিন্তু, তা বললে তো আর আমার পেট চলবে না।” এই বলতে বলতেই ভেড়াটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শয়তান নেকড়ে তাকে টুকরো টুকরো করে খেয়ে ফেলল।

নীতিশিক্ষাঃ অত্যাচারী সবসময়ই অত্যাচার করার জন্য কিছু না কিছু কারণ খুঁজে বার করে ফেলে।

আমি আরো বলিঃ যারা কোন কথা শুনবে না ঠিক করেই রেখেছে, তাদের সাথে যুক্তি-তর্কে গিয়ে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই।

৬।
এক অন্ধ মানুষের একটা বিশেষ গুণ ছিল। জন্তু-জানোয়ারের গায়ে হাত বুলিয়ে সে বলে দিত পারত কোন প্রাণী সেটা। একদিন একজন একটা নেকড়ের ছানা এনে তার হাতে দিল। অনুরোধ করল যদি সে প্রাণীটার গায়ে হাত বুলিয়ে বলে দিতে পারে ঠিক কোন জানোয়ার বাচ্চা সেটা। লোকটি প্রাণীটির গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে পরীক্ষা করল। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে না পেরে বলল সে, “বুঝতে পারছি না ঠিক কোন জন্তুর বাচ্চা এটা – শিয়ালের না নেকড়ের। কিন্তু এই ব্যাপারটায় আমার কোন সন্দেহ নেই যে, এটাকে ভেড়ার পালের মধ্যে ছেড়ে দিলে ভেড়াগুলোর বিপদ হয়ে যাবে। ”
প্রাচীন বচনঃ শয়তানীর লক্ষণ ছোট থাকতেই নজরে পড়ে।
আমি বলিঃ এখনো পুরো মুর্ত্তি ধরেনি তাই চিন্তার কিছু নেই, এই ভাবনায় বুঁদ হয়ে নেতৃত্ব যখন শয়তানকে তুচ্ছ বলে হিসাব করে , নেতৃত্বের উপর নির্ভর করা মানুষগুলির জন্য তখন সর্বনাশ ঘনিয়ে আসে।

৭।
হযরত সুলতান নিজামুদ্দিন (রঃ) এর যামানায় দিল্লিতে এক হিন্দু সাধু বস করতেন।তিনি এমন এক অনুশীলন করেছিলেন যে রোগীর উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করলে তার রোগ দূর হয়ে যেতো।একবার হযরত নিজামুদ্দীন (রঃ) এর অসুখ হলো।তিনি মাঝে মাঝে বেহুশ হয়ে পড়তেন।হুম হওয়ার পর খাদেম গন একবার আরজ করলেন যে যদি অনুমতি দান করেন তবে অমুক সাধুর কাছে হযরত খাদেমের খাট কাধে করে নিয়ে যাবো।
সে দৃষ্টির মাধ্যমে রোগ দূর করতে পারে।হযরত বললেন সাবধান!এরুপ করিও না।তাহলে লোকদের আকিদা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।কিন্তু পিরের প্রতি মুরিদের মহব্বত হয়ে থাকে একশ পর্যায়ের।হযরত যখন আবার বেহুশ হয়ে পড়লেন তখন মুরিদগন এত পেরেশান হয়ে পড়লেন যে হযরতের খাট উড়িয়ে সাধুর বাড়িতে হাজির করলেন এবং ভবলেন এটা হযরতের ইচ্ছার বিরিদ্ধে হওয়ায় মাফ চেয়ে এর মীমাংসা করে নেওয়া যাবে।সাধু দেখলেন এত বড় ব্যক্তিত্ব তার বাড়িতে এসে উঠেছেন।তিনি তাৎক্ষানাৎ সব কাজ ফেলে রেখে ছুটে গেলেন হযরতের খাটের কাছে এবং দৃষ্টি দিতেই এমন ভাবে রোগ সব দূর হয়ে গেল যে হযরত একে বারে উঠে বসলেন।মনে হল যেন কোন রোগ ছিল না।তিনি দেখলেন যে এটা সাধুর বাড়ি।বুঝতে পারলেন যে এরা সামান্য কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তাই কেহ কে কিছু বললেন না।বরং তিনি সেই সাধুকে জিজ্ঞাসা করলেন,তোমার মধ্যে এই শক্তির কিসের প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছে; কোন আমলের দ্বারা এই যোগ্যতা অর্জন বল দেখি।
সাধু আরজ করলেন,আমার মধ্যে শুধু একটি জিনিস আছে, যা আমার গুরু আমকে শিক্ষা দিয়েছে।আর সেটা হল এই যে তিনি বলেছিলেন,সব সময় নফের বিরিদ্ধে চলিও;অর্থাৎ তোমার মন যে যে কাজ টি করতে চাই সেই কাজ টি করিও না আর যে কাজটি করতে চায় না সেই কাজ টি করিও।এই একটি মাত্র অভ্যাসের দ্বারা আমার নফের মধ্যে এমন একটি অভ্যাসের সৃষ্টি হয়েছে যার দ্বারা আমি তাছারুফ করে রোগ দূর করে দিই।এই কথা শুনে হযরত জিজ্ঞাসা করলেন,আচ্ছা বল দেখি তোমার মুসলমান হতে মন চায়? সাধু আরজ করলেন না চাই না।তাহলে তোমার গুরুর শিক্ষার উপর আমল হয় কৈ।সাধু চিন্তায় পড়ে গেল।এদিকে হযরতের উপকারের বদলে উপকারের চিন্তার দুয়া করতে লাগলেন,হে আল্লা সে আমার উপকার করেছে,আমিও তার উপকার করতে চাই সে আমার শরীরের রোগ দূর করেছে আমি তার রুহানি রোগ কুফুরি দূর করতে চাই।তুমি সাহায্য কর।সাধু আর ঠিক থাকতে পারলেন না,একটি ঘূর্ণি ঝড় খুলে গেল তার অন্তরে।সে তাৎক্ষাণাৎ বলে উঠলোঃ
সুতরাং উপকারের বদলে উপকার বাস্তবায়িত হলো।সাধু মুসলমান হয়ে ঈমানের সৌভাগ্য লাভ করলেন।

৮।
এই গল্পটা একজন জ্ঞানী শিক্ষককে নিয়ে। তাঁর ছাত্র ছির এক বাদশা’র ছেলে। শিক্ষকের কর্তব্য ছাত্রকে শিক্ষা দেওয়া। এই শিক্ষক ছিলেন খুবই আদর্শবাদী। যা সত্য বলে জানতেন তাই করতেন। ধনী-গরিব, ছোট-বড় বলে তিনি কিছু মানতেন না। সকল ছাত্রের প্রতি তাঁর সমান নজর ছিল। বাদশাহ’র ছেলেকে তিনি আলাদা চোখে দেখতেন না। বাদশাহ’র ছেলেটা ছিল খুব দুষ্টু। পড়াশোনায় তার একটুও মনোযোগ ছিল না। কাউকে সে পরোয়াও করত না। শিক্ষেক তাই বাদশাহ’র ছেলেকে মাঝে মধ্যেই শাসন করতেন। এমনটি তাকে বেত্রাঘাত করতেও দ্বিধা করতেন না। একদিন ছেলেটি সহপাঠীদের সঙ্গে অণ্যায় আচরণ করল। শিক্ষক জানতে পেরে ডেকে পাঠালেন ছেলেটিকে।

তারপর বেদম পেটালেন। ছেলেটি রাগে অভিমানে দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরল। বাদশাহ জিজ্ঞেস করলেন– কোমার কান্নার কারন কি? ছেলেটি সবিস্তারে শিক্ষকের ওপর সব দোষ চাপাল। বাদশাহ খুব অখুশি হলেন। ডেকে পাঠালেন শিক্ষককে। –আপনি আমার পুত্রকে এত মারধর করে। কিন্তু কেন? আদর্শবান শিক্ষক বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। বাদশাহ’র সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভীক উচ্চারণে বললেন- আমাকে মাফ করবেন। আপনার পুত্র আগামীদিন আমাদের বাদশাহ হবে। তার দ্বায়িত্ব অনেক। আমি তাকে সৎ ও সুন্দর শিক্ষা দিয়ে বড় করে তুলতে চাই। ভবিষ্যতে সে যেন একজন সুশাসক হয়। তাই চেষ্টার কোন ত্রুটি করি না। আমার যদি ভুল হয়ে থাকে তবে আমাকে শাস্তি দিন। শিক্ষকের কথা শুনে বাদশাহ খুব খুশি হলেন। প্রচুর বকশিস দিয়ে তিনি বিদায় দিলেন শিক্ষককে। বললেন- একজন ভালো শিক্ষকই পারে একটি জাতিকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে। আপনার মতো শিক্ষক আমাদের আরো প্রয়োজন।

৯।
এক বাড়ির মালিক ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা পেতে ইঁদুরের ফাঁদ পাতল। ইঁদুরটা সেই ফাঁদ দেখে কর্তার পালা মুরগির কাছে গিয়ে বলল ফাঁদটা ছিঁড়ে ফেলতে তাকে যেন সাহায্য করে। কিন্তু মুরগি বলল যেহেতু ফাঁদের কারণে তার নিজের কোন সমস্যা হচ্ছে না তাই সে সাহায্য করতে ইচ্ছুক নয়। ইঁদুরটা মালিকের পালা ছাগল আর গরুর কাছে সাহায্য চেয়েও একই উত্তর পেল। যেহেতু ফাঁদের কারণে ছাগল বা গরুর কোন বিপদ হবে না তাই তারা ইঁদুরের অনুরোধকে অগ্রাহ্য করল।
এদিকে রাতের বেলা ইঁদুরের বদলে ফাদে আটকা পড়ল এক বিষধর সাপ। মালিক ইদুর ধরা পড়েছে ভেবে কাছে আসতেই সাপ কামড় দিল। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকা হল। ডাক্তার বিষ নামাতে পারলেন বটে, কিন্তু বললেন সুস্থ্ হয়ে উঠতে মালিকের স্যুপ খাওয়া প্রয়োজন। তাই স্যুপ রান্না করতে মালিক প্রথমেই তাঁর মুরগিটাকে জবাই করলেন।
এদিকে মালিককে দেখতে বাড়িতে অনেক মেহমান আসলেন। তাদের আপ্যায়ন করতে ছাগলটা জবাই করতে হল। কিছুদিন পর মালিকের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না দেখে ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার কথা উল্লেখ করলেন। তার জন্য অনেক টাকার দরকার ছিল বলে মালিক তাঁর গরুটাকে কসাইখানায় বিক্রি করলেন।
কয়েকদিন পর দেখা গেল শুধু ইঁদুরটাই বেঁচে আছে; মুরগি-গরু-ছাগল কেউ নেই। ইদুর ভাবল, সেদিন যদি ওরা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে সাহায্য করত, আজ ওরাও বেঁচে যেত।

১০।
একদা এক মহিলা ছিল। সে একদিন তার ছেলেদের নিয়ে বাপের বাড়িতে যাচ্ছিল। তার পাপের বাড়ী
যাবার পথে গভির জঙ্গল পড়ে। আর সেই জঙ্গলে থাকে বাঘ, ভালুক, সিংহ, কত রকমের প্রানী। তারা চলছে আর চলছে। চলতে চলতে দুপুর গড়িয়ে গেল। এমন সময় একটা বাঘ হেলতে দুলতে তাদের দিকে এগিয়ে এলো।
মহিলা ভাবল এ বাঘের হাত থেকে তাদের আর রেহাই নেই। মানুষের গন্ধ পেয়েছে বাঘ, তাইতো রক্তের লোভে এগিয়ে আসছে।

মহিলা মনে মনে সাহস সঞ্চয় করল। নাঃ বাঘের গায়ের জোর থাকতে পারে, কিন্তু আমি বুদ্ধি দিয়ে লড়াই করে একবার শেষ চেষ্টা করবো। কারন বাঘের থেকে পালিয়ে বাঁচা যাবে না।
মহিলা মনে মনে স্থির করলো বুদ্ধি প্রয়োগ কিভাবে করবে। হঠাৎ মহিলা ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বাঘটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগল – কাঁদিস না রে তোরা কাঁদিস না। ঐ তো একটা বাঘ এসে গেছে। ওটাকে আজকে খা। মনে হচ্ছে এ বনে আরও বাঘ আছে। কাল আবার মেরে আনবো। বাঘের মাংস খাবার বায়না করছিলি ক’দিন ধরে। এবার বাঘের মাংস খেতে পাবি।
এসব কথা শুনে বাঘটার তো পিলে চমকে গেল। মানুষ যে বাঘের মাংস খায় তা সে জানতো না। ভয় পেয়ে বাঘ পিছন ফিরে দিলো ছুট।
মহিলা তার ছেলেমেয়েদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বসে পড়ল – যাক, এ যাত্রা তো সকলে বাঁচল!
ওদিকে বাঘটাকে ছুটতে দেখে এক শিয়াল অবাক হয়ে জিঞ্জেস করল – কি হয়েছে বাঘ মামা, অত ছুটছ কেন? কি হয়েছে?
বাঘ বলে – কি আর হয়েছে ভাগ্নে – প্রানের দায়ে ছুটছি।
শিয়াল আরো অবাক হয়ে বলে – কি হয়েছে মামা, একটু খুলে বলো। তোমার কিসের ভয়?
বাঘ হাঁপ ছেড়ে একটু দম নিয়ে বলল – এক ডাইনি এসেছে বনে। সে বাঘ মেরে খায়! সঙ্গে আবার দু-দুটো বাচ্চা।
শিয়াল হো হো করে হেসে উঠল। বলল – তোমার মাথা খারাপ হয়েছে মামা। একটা মেয়ে মানুষকে তোমার এতো ভয়। চল দেখছি আমি।
বাঘ জানে শিয়াল ধূর্ত। বলল – বুঝেছি আমাকে তার সামনে ছেড়ে দিয়ে কেটে পড়বে। খুব মজা হবে না ? পরে ফিরে গিয়ে নিজেও বাঘের মাংস একটু ভাগ পাবে, তাই না? আমি তোমাকে বিলক্ষন চিনি।
শিয়াল বলল – এতই যদি তোমার সন্দেহ হয়, তবে এক কাজ কর – আমাকে তোমার গলার সঙ্গে বেঁধে নাও। তাহলে তো আর পালাতে পারবো না।
বাঘ রাজি হয়ে গেল। মানুষগুলোকে সেই খাবে । মানুষ খেতে দারুন লাগে। মহিলা ছেলে দু’টিকে নিয়ে একটি গাছের তলায় বসে বসে ভাবছিল কি করা যায়। সে আর এগোতে সাহস পাচ্ছিল না। হটাৎ দেখে বাঘ ফিরে আসছে গলায় একটা শিয়াল বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে। মহিলা একটু ঘাবড়ে গেলো বটে কিন্তু তক্ষনাৎ বুদ্ধি এসে গেলো মাথায়। চিৎকার করে বলে উঠল – ও রে পাজী শেয়াল, আয় তুই আয়, মজা দেখাচ্ছি তোর! ছেলেমেয়েরা আমার বাঘের মাংস না হলে ভাত খেতে চায় না – কান্নাকাটি করছে, সেদিকে তোর খেয়াল নেই? রোজ তিনটে করে বাঘ এনে দেবার কথা ছিলো, মাত্র একটা বাঘ নিয়ে এতক্ষনে আসা হচ্ছে!
বাঘ বুঝলো শেয়াল চালাকি করে তাকে সেখানে নিয়ে এসেছে, সে আবার পেছল ফিরে প্রানপনে ছুটতে লাগল। শেয়াল যত মরে গেলাম, মরে গেলাম বলে চীৎকার করতে থাকে বাঘ তত জোরে ছুটতে থাকে।
মহিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
নীতিকথা = গায়ের জোরের চেয়ে সুক্ষ্মবুদ্ধির বেশি প্রয়োজন।

১১।
এক পালোয়ান মল্ল যুদ্ধে খুব পারদর্শিতা অর্জন করেছিলো। মল্ল বিদ্যায় সে তিনশত ষাটটি কৌশল আয়ত্ব করেছিলো। নিত্য নতুন কায়দায় সে কুস্তি লড়তো। কাজেই সে সময়ে কোন কুস্তিগীর তার সাথে মল্ল যুদ্ধে জয় লাভ করতে পারতো না। তার বহু শিষ্য ছিলো। তার মাঝে একজন রুপে- গুনে অস্তাদের প্রিয় পাত্র ছিলো। দূরদর্শী ওস্তাদ তাকে তিনশত উনষাট টি কৌশল শেখান, একটা বিশেষ কৌশল শেখালেন না থাকে। সেই যুবক অল্পদিনে শক্তি সামর্থ্য কলা কৌশলে এমন খ্যাতি অর্জন করতে লাগলো যে, সেই সময়ের কোন পাহলোয়ান তার সাথে মোকাবেলা করার সাহস পেতনা। যুগের শ্রেষ্ট কুস্তিগীর উপাধী পাওয়ায় তার মনে অহংকার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। এমন কি একদিন, বাদশাহর সামনে গল্প দিয়ে বসলো যে, আমার উস্তাদ যার কাছে আমি কুস্তি শিখেছি, শিক্ষা গুরু হিসাবে তিনি আমার চাইতে বড় ও সম্মানের পাত্র হতে পারেন বটে, কিন্তু শক্তি ও কলা কৌশলে আমি তার চাইতে কম না। বাদশার কাছে কথাটি যুক্তিহীন মনে হল। তখনি তিনি প্রতিযোগিতার আদেশ দিলেন। প্রতিযোগিতার জন্য একটি বিরাট মাঠ নির্বাচন করা হল। ওস্তাদ ও ছাত্রের প্রতিযোগিতা দেখার জন্য দেশের বিশিষ্ট ব্যাক্তি বর্গ ও সেখানে হাজির হল এবং প্রতিযোগিতা শুরু হল। উস্তাদ জানতেন, যুবক শিষ্যের শারীরিক শক্তি তার চাইতে বেশি। তাই তিনি তার শিষ্যকে নতুন কৌশলে আক্রমন শুরু করলেন। সেই নিয়ম ছাত্রকে না জানিয়ে গোপন রেখেছিলেন। কাজেই সে নিরুপায় হয়ে পড়লো। উস্তাদ থাকে দুই হাত দিয়ে মাথায় উটিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো। উস্তাদ বিজয়ের মুকুট মাথায় পড়ে নিলেন। বাদশাহ উস্তাদ কে মুল্যবান পুরস্কার দিলেন। এর পর ছাত্রের অহংকারের জন্য তিরস্কার করে বললেন, তুমি একটা নির্বোধ ও বেয়াদব। তাই নিজের উস্তাদের সাথে সমকক্ষতার দাবি করতে লজ্জা বোধ করেনি। তাই বোকার মত লড়াই করলে এবং পরাজিত হলে। ছাত্র বিনীত ভাবে বলল হে বাদশাহ, উস্তাদ গায়ের জুরে আমার সাথে পারতেন না। কিন্তু কি করব কুস্তি বিদ্যার সকল কৌশল আমায় শেখানো হয়নি। তিনি কিছু কোশল গোপন রেখেছিলেন। আমার অজানা সেই কৌশল দিয়ে জয়লাভ করলেন। উত্তরে উস্তাদ বললেন হ্যা বাবা এই দিনের জন্য তা যত্ন করে রেখেছিলাম। নইলে আজ তুমি আমার সুনাম বরবাদ করে দিতে।

নীতি কথা : বন্ধুকে ভালবেসে এতো শক্তি শালী কর না যেন সে যদি কখনো শত্রতা করে বসে তবে তুমি পরাজিত হও। (শেখ সাদি)

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন