20 May, 2018

বন্ধুত্বের পরখ


অনেক অনেক বছর আগের কথা। এক গ্রামে বাস করতো দুই বন্ধু। একজন ওলেলে, অন্যজন ওমোটেই। মুখোমুখি বাড়ি দু’জনের। তাদের বন্ধুত্বের কথা জানতো গ্রামের সবাই। আর তাদের প্রতিবেশী ছিলো এক বুড়ো। বুড়ো হলে কী হবে_ অনেক বিষয়ে বেশ জ্ঞান ছিলো তার। একবার ওলেলে আর ওমোটেইয়ের বন্ধুত্ব পরখ করে দেখতে চাইলেন তিনি।

দুই বাড়ির মাঝে পায়ে হাঁটা পথ। এক সকালে ওই পথ দিয়ে হাঁটছিলেন বুড়ো। মাথায় একটা নতুন টুপি। টুপিটার একপাশ লাল, অন্যপাশ সবুজ।

প্রথমেই দেখা হলো ওমোটেইয়ের সঙ্গে। নিজেদের জমিতে লতানো গাছের পরিচর্যা করছিলো সে।

বুড়ো বললেন, ‘শুভ সকাল, ওমোটেই।’

ওমোটেই বললো, ‘শুভ সকাল। খুব সুন্দর লালটুপি পরেছেন দেখছি।’

বুড়ো বললেন, ‘ধন্যবাদ। টুপিটা সুন্দর হয়েছে জেনে খুশি হলাম।’

ওমোটেই বললো, ‘সত্যিই খুব সুন্দর টুপিটা।’

টুপিটা ধরে একটু ঠিকঠাক করে আবার হাঁটতে শুরু করলেন বুড়ো। কিছুক্ষণ পর দেখা হয়ে গেলো ওলেলের সঙ্গে। ওলেলে তখন জমির আগাছা পরিষ্কার করছিলো।

জ্ঞানী মানুষ হাঁক দিলেন, ‘শুভ সকাল, ওলেলে।’

ওলেলে ঘুরে তাকালো জ্ঞানী মানুষের দিকে। নতুন টুপিটা তারও চোখ এড়ায়নি। বললো, ‘ওহ্! কী সুন্দর সবুজ রঙের টুপি পরেছেন। নতুন নাকি?’

মুচকি হেসে বুড়ো বললেন, ‘এই আর কি। এমন একটা সুন্দর টুপির শখ অনেকদিন থেকেই ছিলো। সে যাই হোক। তারপর বলো, কেমন আছো তুমি?’

ওলেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে গেলেন বুড়ো।

একসময় সূর্যটা চলে এলো একেবারে মাথার ওপর। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। কাজ বন্ধ করে ওলেলেই চললো প্রিয় বন্ধু ওমোটেইয়ের কাছে। প্রতিদিন দু’জন একসঙ্গে দুপুরের খাবার খায়। খেতে খেতেই ওমোটেই জানতে চাইলো, ‘আমাদের প্রতিবেশী বুড়োর নতুন লাল টুপিটা দেখেছো? খুব সুন্দর, তাই না?’

অবাক হয়ে ওলেলে বললো, ‘লাল! সবুজ টুপিটাকে তুমি লাল বলছো? টুপিটা তোমার কাছে হয়তো লাল মনে হয়েছে। আসলে সূর্যের ঝকমকে আলো তোমার চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে।’

ওমোটেই বললো, ‘মানে! তুমি কী বলতে চাইছো?’

বন্ধুর বোকামোতে একটা ব্যঙ্গ হাসি দিলো ওলেলে। বললো, ‘আমাদের প্রতিবেশী বুড়োর মাথায় লাল টুপি দেখিনি বন্ধু। সবুজ টুপি দেখেছি।’

ওমোটেই বললো, ‘সবুজ টুপি! ওহ্, বন্ধু আমার, উল্টাপাল্টা কী বলছো বুঝতে পারছি না! ওটা সবুজ টুপি ছিলো না। লালই ছিলো। আমি ভালোমতো দেখেছি।’

গলা চড়িয়ে ওলেলে বললো, ‘উঁহু। আমিই ঠিক বলছি। ওটা সবুজ ছিলো।’

বন্ধুর চড়া গলা শুনে বিরক্ত হলো ওমোটেই। গলা চড়ালো সে-ও, ‘আমিই ঠিক দেখেছি। টুপিটা লালই ছিলো’

এবার রেগে গেলো ওলেলেও। চেঁচিয়ে বললো, ‘টুপিটা সবুজই ছিলো।’

তারপর টুপির রঙ নিয়ে শুরু হলো দু’জনের মধ্যে চিৎকার আর চেঁচামেচি। খানিকপর ঝগড়া। আরও খানিকপর বিষয়টা আর ঝগড়াতেই আটকে রইলো না, হাতাহাতিতে গিয়ে ঠেকলো। ওদের হাতাহাতি আর চিৎকার শুনে জড়ো হতে লাগলো অন্য প্রতিবেশীরা। একটু পর ওদের প্রতিবেশী সেই বুড়ো ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন দু’জনের সামনে। জানতে চাইলেন, ‘এসব কী হচ্ছে? দুই বন্ধু মারামারি করছো? আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা খুব ভালো বন্ধু। তোমাদের বন্ধুত্বের নমুনা এই? ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’

মাঝপথে বাধা পেয়ে থেমে গেলো ওলেলে আর ওমোটেই। চোখ বড় বড় করে তাকালো বুড়োর দিকে। ঠিক তখনই টুপিটার সবুজ দিকটা ওমোটেইয়ের আর লাল দিকটা ওলেলের চোখে পড়লো।

সঙ্গে সঙ্গে ওলেলে বললো, ‘বন্ধু ওমোটেই, আমি আসলেই দুঃখিত। তুমি ঠিক কথাই বলেছিলে তখন। আমাদের প্রতিবেশীর টুপিটা সত্যিই লাল।’

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো ওমোটেই, ‘না, না, তুমি ভুল বলোনি। না জেনে ভুল কথা আমিই বলেছি। সূর্যের চিকচিকে আলোয় আমার চোখে সত্যিই তখন ধাঁধা লেগেছিলো। সে জন্যই আমাদের প্রতিবেশীর সবুজ টুপিটাকে লাল দেখেছিলাম।’

ওলেলে বললো, ‘উঁহু। তুমিই ঠিক বলেছিলে। টুপিটা আসলেই লাল।’

ওমোটেই বললো, ‘না। তুমিই ঠিক বলেছিলে, সত্যি সত্যি টুপিটা সবুজ।’

তারপর আবার শুরু হলো দু’জনের চেঁচামেচি, হৈচৈ, ঝগড়া। দু’জনের ঝগড়া দেখে না হেসে পারলেন না বুড়ো। হাসতে হাসতেই মাথা থেকে টুপিটা খুলে দেখালেন, ‘দেখো এটা। টুপির ব্যাপারে কারোরই ভুল ছিলো না। কিন্তু বন্ধুত্বের ব্যাপারে তোমরা কেউই ঠিক নও। আসলে এখনও তোমরা কেউ কারও সেরা বন্ধু হতে পারোনি। টুপির রঙ নিয়ে দু’জনই হৈচৈ করেছো, চেঁচামেচি করেছো, রাগারাগি করেছো, এমনকি মারামারিও করেছো। তোমরা কেউ ঠাণ্ডা মাথায় যাচাই করে দেখোনি, কার কথাটা ঠিক। নিজের দেখাটাকেই সঠিক হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছো। টুপি, টুপির রঙ এসব কিছুই তোমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। গুরুত্বপূর্ণ ছিলো নিজের কথা।’

ওলেলে বললো, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আসলে যাচাই ছাড়া কেউই বুঝতে পারে না, কার বন্ধুত্ব কতোখানি। টুপিটা লাল নাকি সবুজ, সেটা এখন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়_ ওমোটেইয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কতোখানি_ সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।’

সঙ্গে সঙ্গে ওমোটেইও সমর্থন জানালো বন্ধু ওলেলের কথায়, ‘আমার কাছেও।’

এরপর থেকে তাদের বন্ধুত্ব হয়েছে আরও গভীর।

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন