এক রাজা আর এক মন্ত্রী। একদিন রাজা মন্ত্রীকে বলিলেন,-“মন্ত্রী! রাজ্যের লোক সুখে আছে, কি, দুঃখে আছে, জানিলাম না!”
মন্ত্রী বলিলেন,-“মহারাজ! ভয়ে বলি, কি, নির্ভয়ে বলি?”
রাজা বলিলেন,-“নির্ভয়ে বল।”
তখন মন্ত্রী বলিলেন,-“মহারাজ, আগে-আগে রাজারা মৃগয়া করিতে যাইতেন,-দিনের বেলায় মৃগয়া করিতেন, রাত্রি হইলে ছদ্মবেশ ধরিয়া প্রজার সুখ-দুঃখ দেখিতেন। সে দিনও নাই সে কালও নাই, প্রজার নানা অবস্থা।”
শুনিয়া রাজা বলিলেন,-“এই কথা? কালই আমি মৃগয়ায় যাইব।”
রাজা মৃগয়া করিতে যাইবেন, রাজ্যে হুলুস্থুল পড়িল। হাতী সাজিল, ঘোড়া সাজিল, সিপাই সাজিল, মন্ত্রী সাজিল; পঞ্চকটক নিয়া, রাজা মৃগয়ায় গেলেন।
রাজার তো নামে মৃগয়া। দিনের বেলায় মৃগয়া করেন,-হাতীটা মারেন, বাঘটা মারেন; রাত হইলে রাজা ছদ্মবেশ ধরিয়া প্রজার সুখ-দুঃখ দেখেন।
একদিন রাজা গৃহস্থের বাড়ির পাশ দিয়া যান; শুনিতে পাইলেন, ঘরে মধ্যে গৃহস্থের তিন মেয়েতে কথাবার্ত বলিতেছে।
রাজা কান পাতিয়া রহিলেন।
বড় বোন বলিতেছে,-“দ্যাখ্ লো আমার যদি রাজবাড়ির ঘেসেড়ার সঙ্গে বিয়ে হয়, তো আমি মনের সুখে কলাই-ভাজা খাই!”
তার ছোট বোন বলিল,-“আমার যদি রাজবাড়ির সূপ্কারের রাঁধুনের সঙ্গে বিয়ে হয়, তো আমি সকলের আগে রাজভোগ খাই!”
সকলের ছোট বোন যে, সে আর কিছু কয় না; দুই বোন ধরিয়া বসিল-“কেন লো ছোট্টি। তুই যে কিছু বলিস্ না?”
ছোট্টি ছোট্ট করিয়া বলিল,-“নাঃ?”
দুই বোনে কি ছাড়ে? শেষে অনেকণ ভাবিয়া টানিয়া ছোট বোন বলিল,-“আমার যদি রাজার সঙ্গে বিয়ে হইত, তো আমি রাণী হইতাম!”
সে কথা শুনিয়া দুই বোনে “হি” “হি!” করিয়া উঠিল,-“ও মা, মা, পুঁটির যে সাধ!!”
শুনিয়া রাজা চলিয়া গেলেন!
পরদিন রাজা দোলা-চৌদোলা দিয়া পাইক পাঠাইয়া দিলেন, পাইক গিয়া গৃহস্থের তিন মেয়েকে নিয়া আসিল।
তিন বোন তো কাঁপিয়া কুঁপিয়া অস্থির। রাজা অভয় দিয়া বলিলেন,-“কাল রাত্রে কে কি বলিয়াছিলে বল তো?”
কেহ কিচ্ছু কয় না!
শেষে রাজা বলিলেন,-“সত্য কথা যদি না বল তো, বড়ই সাজা হইবে।”
তখন বড় বোন বলিল,-“আমি যে, এই বলিয়াছিলাম।” মেজো বোন বলিল,-“আমি যে, এই বলিয়াছিলাম।” ছোট বোন্ তবু কিছু বলে না।
তখন রাজা বলিলেন,-“দেখ, আমি সব শুনিয়াছি। আচ্ছা তোমরা যে যা’ হইতে চাহিয়াছ, তাহাই করিব।
তাহার পরদিনই রাজা তিন বোনের বড় বোনকে ঘেসেড়ার সঙ্গে বিবাহ দিলেন, মেজোটিকে সূপ্কারের সঙ্গে বিবাহ দিলেন, আর ছোটটিকে রাণী করিলেন।
তিন বোনের বড় বোন ঘেসেড়ার বাড়ি গিয়া মনের সাধে কলাইভাজা খায়; মেজো বোন রাজার পাকশালে সকলের আগে আগে রাজভোগ খায়, আর ছোট বোন রাণী হইয়া সুখে রাজসংসার করেন।
কয়েক বছর যায়; রাণীর সন্তান হইবে। রাজা, রাণীর জন্য ‘হীরার ঝালর সোনার পাত, শ্বেতপাথরের নিগম ছাদ’ দিয়া আঁতুড়ঘর বানাইয়া দিলেন। রাণী বলিলেন,-“কতদিন বোনদিগে দেখি না, ‘মায়ের পেটের রক্তের বোন, আপন বল্তে তিনটি বোন্’-সেই বোন্দিগে আনাইয়া দিলে যে, তারাই আঁতুড়ঘরে যাইত।”
রাজা আর কি করিয়া ‘না’ কনের? বলিলেন,-“আচ্ছা।” রাজপুরী হইতে ঘেসেড়ার বাড়ি কানাতের পথ পড়িল, রাজপুরী হইতে রাঁধনের বাড়ি বাদ্য-ভান্ড বসিল; হাসিয়া নাচিয়া দুই বোনে রাণী-বোনের আঁতুড়ঘর আগ্লাইতে আসিল।
“ও মা!”-আসিয়া দুজনে দেখে, রাণী-বোনের যে ঐশ্বর্য!-
হীরামোতি হেলে না, মাটিতে পা ফেলে না,
সকল পুরী গম্গমা; সকল রাজ্য রম্রমা।
সেই রাজপুরীতে রাণী-বোন্ ইন্দ্রের ইন্দ্রাণী!!-দেখিয়া, দুই বোনে হিংসায় জ্বলিয়া জ্বলিয়া মরে।
রাণী কি অত জানেন? দিনদুপুরে, দুই বোন্ এঘর-ওঘর সাতঘর আঁদি সাঁদি ঘোরে। রাণী জিজ্ঞাসা করেন,-“কেন লো দিদি, কি চাস? দিদিরা বলে-“না, না; এই,-আঁতুড়ঘরে কত কি লাগে, তাই জিনিসপাতি খুঁজি।” শেষে, বেলাবেলি দুই বোন রাণীর আঁতুড়ঘরে গেল।
তিন প্রহর রাত্রে, আঁতুড়ঘরে, রাণীর ছেলে হইল।-ছেলে যেন চাঁদের পুতুল! দুই বোনে তাড়াতাড়ি হাতিয়া পাতিয়া কাঁচা মাটির ভাঁড় আনিয়া ভাঁড়ে তুলিয়া, মুখে নুন, তুলা দিয়া, সোনার চাঁদ ছেলে নদীর জলে ভাসাইয়া দিল!
রাজা খবর করিলেন, “কি হইয়াছে?”
“ছাই! ছেলে না ছেলে,-কুকুরের ছানা!’
দুইজনে আনিয়া এক কুকুরের ছানা দেখাইল। রাজা চুপ করিয়া রহিলেন। তার পরের বছর রাণীর আবার ছেলে হইবে। আবার দুই বোনে আঁতুড়ঘরে গেল। রাণীর এক ছেলে হইল। হিংসুকে’ দুই বোন আবার তেম্নি করিয়া মাটির ভাঁড়ে করিয়া, নুন তুলা দিয়া, ছেলে ভাসাইয়া দিল।
রাজা খবর নিলেন,-‘এবার কি ছেলে হইয়াছে?’
“ছাই! ছেলে না ছেলে-বিড়ালের ছানা!” দুই বোনে আনিয়া এক বিড়ালের ছানা দেখাইল!
রাজা কিছুই বুঝিতে পারিলেন না!
তার পরের বছর রাণীর এক মেয়ে হইল। টুকটুকে মেয়ে, টুলটুলে’ মুখ, হাত পা যেন ফুল-তুক্তুক্! হিংসুকে দুই বোনে সে মেয়েকেও নদীর জলে ভাসাইয়া দিল।
রাজা আবার খবর করিলেন,-“এবার কি?”
“ছাই! কি না কি,-এক কাঠের পুতুল।” দুই বোনে রাজাকে আনিয়া এক কাঠের পুতুল দেখাইল! রাজা দুঃখে মাথা হেঁট করিয়া চলিয়া গেলেন।
রাজ্যের লোক বলিতে লাগিল,-“ও মা! এ আবার কি! অদিনে কুক্ষণে রাজা না-জানা না-শোনা কি আনিয়া বিয়ে করিলেন,-একনয় দুই নয়, তিন তিন বার ছেলে হইল-কুকুর-ছানা, বিড়াল-ছানা আর কাঠের পুতুল! এ অলক্ষণে, রাণী কখ্খনো মনিষ্যি নয় গো, মনিষ্যি নয়-নিশ্চয় পেত্নী কি ডাকিনী।”
রাজাও ভাবিলেন,-“তাই তো! রাজপুরীতে কি অলক্ষ্মী আনিলাম-যাক, এ রাণী আর ঘরে নিব না।”
হিংসুকে দুই বোনে মনের সুখে হাসিয়া গলিয়া, পানের পিক ফেলিয়া, আপনার আপনার বাড়ি গেল। রাজ্যের লোকেরা ডাকিনী রাণীকে উল্টাগাধায় উঠাইয়া, মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া, রাজ্যের বাহির করিয়া দিয়া আসিল।
এক ব্রাহ্মণ নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিয়াছেন,-স্নান-টান সারিয়া ব্রাহ্মণ জলে দাঁড়াইয়া জপ-আহ্নিক করেন,-দেখিলেন এক মাটির ভাঁড় ভাসিয়া আসে। না,-ভাঁড়ের মধ্যে সদ্য ছেলের কান্না শোনা যায়। আঁকুপাঁকু করিয়া ব্রাহ্মণ ভাঁড় ধরিয়া দেখেন,-এক দেবশিশু!
ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি করিয়া মুখের নুন তুলা ধোয়াইয়া শিশুপুত্র নিয়া ঘরে গেলেন। তার পরের বছর আর এক মাটির ভাঁড় ভাসিয়া ভাসিয়া সেই ব্রাহ্মণের ঘাটে আসিল। ব্রাহ্মণ দেখিলেন,-আর এক দেবপুত্র! ব্রাহ্মণ সে-ও দেবপুত্র নিয়া ঘরে তুলিলেন।
তিন বছরের বছর আবার এক মাটির ভাঁড় ব্রাহ্মণের ঘাটে গেল। ব্রাহ্মণ ভাঁড় ধরিয়া দেখেন,-এবার-দেবকন্যা! ব্রাহ্মণের বেটা নাই, পুত্র নাই, তার মধ্যে দুই দেবপুত্র, আবার দেবকন্যা!-ব্রাহ্মণ আনন্দে কন্যা নিয়া ঘরে গেলেন।
হিংসুক মাসীরা ভাসাইয়া দিয়াছিল, ভাসানে’ রাজপুত্র রাজকন্যা গিয়া ব্রাহ্মণের ঘর আলো করিল। রাজার রাজপুরীতে আর বাতিটুকুও জ্বলে না।
ছেলেমেয়ে নিয়া ব্রাহ্মণ পরম সুখে থাকেন। ব্রাহ্মণের চাটি-মাটির দুঃখ নাই, গোলা-গঞ্জের অভাই নাই। ক্ষেতের ধান, গাছে ফল, কলস কলস গঙ্গাজল, ডোল-ভরা মুগ,কাজললতা গাইয়ের দুধ,-ব্রাহ্মণের টাকা পেটরায় ধরে না।
তা’ হইলে কি হয়? এত দিনে বুঝি পরমেশ্বর ফিরিয়া চাহিলেন,-ব্রাহ্মণের ঘরে সোনার চাঁদের ভরা-বাজার। খাওয়া নাই, নাওয়া নাই, ব্রাহ্মণ দিন রাত ছেলেমেয়ে নিয়া থাকেন। ছেলে দুইটির নাম রাখিলেন,-অরুন, বরুণ আর মেয়ের নাম রাখিলেন-কিরণমালা।
দিন যায়, রাত যায়-অরুন-বরুণ কিরণমালা চাঁদের মতন বাড়ে, ফুলে মতন ফোটে। অরুণ-বরুণ-কিরণের হাসি শুনিলে বনের পাখি আসিয়া গান ধরে, কান্না শুনিলে বনের হরিণ ছুটিয়া আসে। হেলিয়া-দুলিয়া খেলে-তিন-ভাই-বোনের নাচে ব্রাণের আঙ্গিনায় চাঁদের হাট ভাঙ্গিয়া পড়িল।
দেখিতে দেখিতে তিন ভাই-বোন্ বড় হইল। কিরণমালা বাড়িতে কুটাটুকু পড়িতে দেয় না, কাজললতা গাইয়ের গায়ে মাঠিটি বসিতে দেয় না। অরুণ-বরুণ দুই ভাইয়ে পড়ে; শোনে; ফল পাকিলে ফল পাড়ে; বনের হরিণ দৌড়ে’ ধরে। তার পর তিন ভাই-বোনে মিলিয়া ডালায় ডালায় ফুল তুলিয়া ঘরবাড়ি সাজাইয়া আচ্ছন্ন করিয়া দেয়।
ব্রাহ্মণের আর কি? কিরণমালা মায়ে ডালিভরা ফুল আসে, দীপ চন্দন দেয়। ধূপ জ্বালাইয়া ঘন্টা নাড়িয়া ব্রাণ “বম্-বম্” করিয়া পূজা করেন!
এমনি করিয়া দিন যায়। অরুণ-বরুণ ব্রাহ্মণের সকল বিদ্যা পড়িলেন; কিরণমালা ব্রাহ্মণের ঘরসংসার হাতে নিলেন।
তখন একদিন তিন ছেলে-মেয়ে ডাকিয়া, তিনজনের মাথায় হাত রাখিয়া ব্রাহ্মণ বলিলেন-“অরুণ, বরুণ, মা কিরণ, সব তোদের রহিল, আমার আর কেনো দুঃখ নাই,-তোমাদিগে রাখিয়া এখন আমি আর এক রাজ্যে যাই; সব দেখিয়া শুনিয়া খাইও।” তিন ভাই বোনে কাঁদিতে লাগিলেন, ব্রাহ্মণ স্বর্গে চলিয়া গেলেন।
মনের দুঃখে মনের দুঃখে দিন যায়,-রাজার রাজপুরী অন্ধকার। রাজা বলিলেন,-“না! আমার রাজত্ব পাপে ঘিরিয়াছে। চল, আবার মৃগয়ায় যাইব।” আবার রাজপুরীতে মৃগয়ায় ডঙ্কা বাজিল।
রাজা মৃগয়ায় গিয়াছেন আর সেই দিন আকাশের দেবতা ভাঙ্গিয়া পড়িল। ঝড়ে, তুফানে, বৃষ্টি বাদলে-সঙ্গী সাথী ছাড়াইয়া, পথ পাথার হারাইয়া ঘুরঘুট্রি অন্ধকার, ঝম্ঝম্ বৃষ্টি-বৃক্ষের কোটরে রাজা রাত্রি কাটাইলেন।
পরদিন রাজা হাঁটেন, হাটেন, পথের শেষ নাই। রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ, দিক্ দিশা খাঁ খাঁ; জল মনুষ্য কোথায়, জল জলাশয় কোথায়,-হাঁপিয়া জাপিয়া তৃষ্ণায় আকুল রাজা দেখেন, দূরে এক বাড়ি। রাজা সেই বাড়ির দিকে চলিলেন।
অরুণ বরুণ কিরণমালা তিন ভাই-বোন্ দেখে,-কি-এক যে মানুষ, তাঁর হাতে পায়ে গায়ে মাথায় চিক্চিক্! দেখিয়া, অরুণ বরুণ অবাক হইল; কিরণ গিয়া দাদার কাছে দাঁড়াইল।
রাজা ডাকিয়া বলিলেন,-“কে আছ, একটুকু জল দিয়া বাঁচাও।”
ছুটিয়া গিয়া, ভাই-বোনে জল আনিল। জল খাইয়া, অবাক রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন,-“দেবপুত্র দেবকন্যা-বিজন দেশে তোমার কে?”
অরুণ বলিল,-“আমরা ব্রাহ্মণের ছেলেমেয়ে!”
রাজার বুক ধুকু ধুকু, রাজার মন উসু খুসু-‘ব্রাহ্মণের ঘরে এমন ছেলেমেয়ে হয়!’- কিন্তু রাজা কিছু বলিতে পারিলেন না, চাহিয়া চাহিয়া, দেখিয়া দেখিয়া, শেষে চক্ষের জল পড়ে-পড়ে। রাজা বলিলেন,-“আমি জল খাইলাম না, দুধ খাইলাম! দেখ বাছারা, আমি এই দেশের দুঃখী রাজা। কখনও তোমাদের কোন কিছুর জন্য যদি কাজ পড়ে, আমাকে জানাইও, আমি তা’ করিব।” বলিয়া, রাজা নিশ্বাস ছাড়িয়া উঠিলেন।
তখন কিরণ বলিল, -” দাদা! রাজার কি থাকে?”
অরুণ বরুণ বলিল ,- “হাতী থাকে, ঘোড়া থাকে,-অট্রালিকা থাকে।”
কিরণ বলিল, “হাতী ঘোড়া কোথায় পাই; অট্রালিকা বানাও।”
অরুণ বরুণ বলিল, “আচ্ছা”।
“আচ্ছা”-দিন কোথায় দিয়া যায়, রাত্রি কোথায় দিয়া যায়, কোন রাজ্য থেকে কি আনে, মাথার ঘাম মাটিতে পড়ে, ুধা নাই, তৃষ্ণা নাই, বারো মাস ছত্রিশ দিন চাঁদ সূর্য ঘুরে’ আসে, অরুণ বরুণ যে অট্রালিকা বানায়। অরুণ বরুণ কাজ করে, কিরণমালা বোন্ ভরা ঘাটের ধরা জল হাঁড়িতে হাঁড়িতে ভরিয়া আনিয়া দেয়। বারো মাসে ছত্রিশ দিনে, সেই অট্রালিকা তৈয়ার হইল।
সে অট্রালিকা দেখিয়া ময়দানব উপোস্ করে, বিশ্বকর্মা ঘর ছাড়ে-অরুণ বরুণ কিরণের অট্রালিকা সূর্যের আসল ছোঁয়, চাঁদের আসন কাড়ে! শ্বেতপাথর ধব্ ধব্, শ্বেতমাণিক রব্ রব্; দুয়ারে দুয়ারে রূপার কবাট, চূড়ায় চূড়ায় সোনার কলসি! অট্রালিকার চারদিকে ফুলে গাছ, ফলের গাছ-পী-পাখালিতে আঁটে না। মধুর গন্ধে অট্রালিকা র্ভুর্ভু, পাখির ডাকে অট্রালিকা মধুরপুর! অরুণ বরুণ কিরণের বাড়ি দেবে দৈত্য চাহিয়া দেখে!
একদিন এক সন্ন্যাসী নদীর ওপার দিয়া যান! যাইতে যাইতে সন্ন্যাসী বলেন,-
“বিজন দেশের বিজন বনে কে-গো বোন্ ভাই?-
কে ‘গড়েছ এমন পুরী, তুলনা তার নাই।”-
পুরী হইতে অরুণ বলিলেন,-
“নিত্য নূতন চাঁদের আলো আপ্নি এসে পড়ে,
অরুণ বরুণ কিরণমালা ভাই-বোন্টির ঘরে!”
সন্ন্যাসী বলিলেন,-
“অরুণ বরুণ কিরণমালার রাঙা রাজপুরী’
দেখতে সুখ শুনতে সুখ ফুট্ত আরো ছীরি’।
এমন পুরী আরো কত হত মনোলোভা,
কি যেন চাই, কি যেন নাই, তাইতো না হয় শোভা।
এমন পুরী,-রূপার গাছে ফল্বে সোনার ফল।
ঝর্-ঝরিয়ে পড়বে ঝরে মুক্তা-ঝরার জল।
হীরার গাছে সোনার পাখির শুনব মধুস্বর-
মাণিক-দানা ছড়িয়ে রবে পথের কাঁকর।
তবে এমন পুরী হবে তিন ভুবনের সার,-
সোনার পাখির এক-এক ডাকে সুখের পাথার।”
শুনিয়া, অরুণ-বরুণ-কিরণ ডাকিয়া বলিলেন,-
“কোথায় এমন রূপার গাছ,
কোথায় এমন পাখি,
কোথায় সে মুক্তা-ঝরা,
বল্লে এনে রাখি।”
সন্ন্যাসী বলিলেন,-
“উত্তর পূর্ব, পূবের উত্তর
মায়া-পাহাড় আছে,
নিত্য ফলে, সোনার ফল
সত্যি হীরার গাছে
ঝর্-ঝরিয়ে, মুক্তা-ঝরা
শীতল বয়ে যায়,
সোনার পাখি, বসে আছে
বৃক্ষের শাখায়!
মায়ার পাহাড়, মায়ার ঢাকা।
মায়ায় মারে তীর-
এ সব যে, আনতে পারে
সে বড় বীর!”
বলিতে বলিতে সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন।
অরুণ বরুণ বলিলেন,-“বোন, আমরা এ সব আনিব।”
অরুণ বলিলেন,-“ভাই বরুণ, বোন কিরণ, তোরা থাক্ আমি মায়া পাহাড়ে গিয়া সব নিয়া আসি।” বলিয়া অরুণ, বরুণ কিরণের কাছে এক তরোয়াল দিলেন,-“যদি দেখ যে তরোয়ালে মরিচা ধরিয়াছে, তো জানিও আর বাঁচিয়া নাই।” তরোয়াল রাখিয়া অরুণ চলিয়া গেলেন।
দিন যায়, মাস যায়, বরুণ কিরণ রোজ তরোয়াল খুলিয়া খুলিয়া দেখেন। একদিন, তরোয়াল খুলিয়া বরুণের মুখ শুকাইল; ডাক দিয়া বলিলেন,-‘বোন্? দাদা আর এ সংসারে নাই! এই তীর ধনুক রাখ, আমি চলিলাম। যদি তীরের আগা খসে, ধনুর ছিলা ছিঁড়ে, তো জানিও আমিও নাই।”
কিরণমালা অরুণের তরোয়ালে মরিচা দেখিয়া কাঁদিয়া অস্থির। বরুণের তীর ধনুক তুলিয়া নিয়া বলিল,-“হে ঈশ্বর। বরুণদাদা যেন অরুণদাদাকে নিয়া আসে।”
যাইতে যাইতে বরুণ মায়া পাহাড়ের দেশে গেলেন। অমনি চারিদিকে বাজনা বাজে, অপ্সরী নাচে,-পিছন হইতে ডাকের উপর ডাক-
“রাজপুত্র! ফিরে’ চাও! ফিরে চাও! কথা শোন!”
বরুণ ফিরিয়া চাহিতেই পাথর হইয়া গেলেন-“হায় দাদাও আমার পাথর হইয়াছেন।”
আর হইয়াছেন;-কে আসিয়া উদ্ধার করিবে? অরুণ বরুণ জন্মে মত পাথর হইয়া রহিলেন।
ভোরে উঠিয়া কিরণমালা দেখিলেন তীরের ফলা খসিয়া গিয়াছে। ধনুর ছিলা ছিঁড়িয়া গিয়াছে-অরুণদাদা গিয়াছে, বরুণদাদাও গেল। কিরণমালা কাঁদিল না, কাটিল না, চরে জল মুছিল না; উঠিয়া কাজললতাকে খড় খৈল দিল, গাছ-গাছালির গোড়ায় জল দিয়া, রাজপুত্রের পোশাক পরিয়া, মাথে মুকুট হাতে তরোয়াল,-কাজললতার বাছুরকে, হরিণের ছানাতে চুমু খাইয়া, চরে পলক ফেলিয়া কিরণমালা মায়া পাহাড়ের উদ্দেশে বাহির হইল।
যায়,-যায়,-কিরণমালা আগুণের মত উঠে, বাতাসের আগে ছাটে; কে দেখে, কে না-দেখে! দিন রাত্রি, পাহাড় জঙ্গল, রোদ বান সকল লুটালুটি গেল; ঝড় থম্কাইয়া বিদ্যুৎ চম্কাইয়া তের রাত্রি তেত্রিশ দিনে কিরণমালা পাহাড়ে গিয়া উঠিলেন।
অমনি চারিদিক দিয়া দৈত্য, দানব, বাঘ, ভালুক, সাপ, হাতী, সিংহ, মোষ, ভূত-পেত্নীতে আসিয়া কিরণমালাকে ঘিরিয়া ধরিল।
এ ডাকে,-“রাজপুত্র, তোকে গিলি!”
এ ডাকে,-“রাজপুত্র, তোকে খাই!”
“হাম্….হুম্!….হাঁই!
“হম্….হম্!….হঃ!”
“হুম্….হাম্!….!”
“ঘঁ:!……..”
পিঠের উপর বাজনা বাজে,-
“তা কাটা ধা কাটা
ভ্যাং ভ্যাং চ্যাং-
রাজপুত্রের কেটে নে
ঠ্যাং!’
করতাল ঝন্ ঝন্-
খরতাল খন্ খন্-
ঢাক ঢোল-মৃদঙ্গ্ কাড়া-
ঝক্ ঝক্ তরোয়াল, তর্ তর্ খাঁড়া-
অপ্সরা নাচে,-“রাজপুত্র, রাজপুত্র এখনো শোন্!”
মায়ার তীর,-ধনুকে ধনুকে ঢানে গুণ;-
উপরে বৃষ্টি বজ্রের ধারা, মেঘের গর্জন ল কাড়া,-শব্দে, রবে আকাশ ফাটিয়া পড়ে, পাহাড় পর্বত উল্টে, পৃথিবী চৌচির যায়!-সাত পৃথিবী থর থর কম্পমান,-বাজ, বজ্র-শিল,-চমক……….।
নাঃ! কিছুতেই কিছু না!- সব বৃথায়, সব মিছায়!- কিরণমালা তো রাজপুত্র ন’ন, কিরণমালা কোনদিকে ফিরিয়া চাহিল না, পায়ের নিচে কত পাথর টলে গেল, কত পাথর গলে গেল-চরে পাতা নামাইয়া তরোয়াল শক্ত করিয়া ধরিয়া, সোঁ সোঁ করিয়া কিরণমালা সর্সর্ একেবারে সোনার ফল হীরার গাছের গোড়ায় গিয়া পৌঁছিল।
আর অমনি হীরার গাছে সোনের পাখি বলিয়া উঠিল,-“আসিয়াছ? আসিয়াছ? ভালই হইয়াছে। এই র্ঝণার জল নাও, এই ফুল নাও, আমাকে নাও, ওই যে তীর আছে নাও, ওই যে ধনুক আছে নাও, দেরি করিও না; সব নিয়া, ওই যে ডঙ্কা আছে, ডঙ্কায় ঘা দাও।”
পাখির এক-এক কথা বলে, কিরণমালা এক-এক জিনিস নেয়। নিয়া গিয়া, কিরণমালা ডঙ্কায় ঘা দিল।”
সব চুপ্চাপ্! মায়া পাহাড় নিঝুম। খালি কোকিলের ডাক, দোয়েলের শীস্, ময়ূরের নাচ!
তখন পাখি বলিল,-
“কিরণমালা, শীতল র্ঝণার জল ছিটাও!”
কিরণমালা সোনার ঝারি ঢালিয়া জল ছিটাইলেন, ত চারিদিকে পাহাড় মড়মড় করিয়া উঠিল, সকল পাথর টক্ টক্ করিয়া উঠিল,-যেখানে জলের ছিটা-ফোঁটা পড়ে, যত যুগের যত রাজপুত্র আসিয়া পাথর হইয়াছিলেন, চরে পলকে গা-মোড়া দিয়া উঠিয়া বসেন।
দেখিতে-দেখিতে সকল পাথর ল ল রাজপুত্র হইয়া গেল। রাজপুত্রেরা জোড় হাত করিয়া কিরণমালাকে প্রণাম করিল,-
“সাত যুগের ধন্য বীর!”
অরুণ বরুণ চোখের জলে গলিয়া বলিলেন,-“মায়ের পেটের ধন্য বোন্।”
“অরুণ বরুণ কিরণমালা
তিনটি ভুবন করলি আলা!”
পুরীতে আসিয়া অরুণ বরুণ কিরণমালা কাজললতাকে ঘাস-জল দিলেন, কাজললতাকে বাছুর খুলিয়া দিলেন, হরিণছানা নাওয়াইয়া দিলেন, আঙ্গিনা পরিস্কার করিলেন, গাছের গোড়ায় গোড়ায় জল দিলেন, জঞ্জাল নিলেন,-দিয়া নিয়া, বাগানে রূপার গাছের বীর হীরার গাছের ডাল পুঁতিলেন, মুক্তা র্ঝণা-জলের ঝারীর মুখ খুলিলেন, মুক্তার ফল ছড়াইয়া দিলেন; সোনার পাখিকে বলিলেন,-“পাখি! এখন গাছে বস।”
তর্ তর্ করিয়া হীরার গাছ বড় হইল, ফর্ ফর্ করিয়া রূপার গাছ পাত মেলিল, রূপার হালে হীরার শাখে টুক্টুকেটুক্ সোনার ফল থোবায় দুলিতে লাগিল; হীরা ডালে সোনার পাখি বসিয়া হাজার সুরে গান ধরিল। চারিদিকে মুক্তার ফল থরে থরে চম্-চম্ তারি মধ্যে শীতল র্ঝণায় মুক্তার জল ঝর্ ঝর্ করিয়া ঝরিতে লাগিল।
পাখি বলিল,-“আহা!”
অরুণ বরুণ কিরণ তিন ভাই-বোন গলাগলি করিলেন।
বনের পাখি পারে না, বনের হরিণ পারে না, তা মানুষে কি থাকিতে পারে? ছুটিয়া আসিয়া দেখে-“আঃ! যে পুরী-পুরী। ইন্দ্রপুরী পৃথিবীতে নামিয়া আসিয়াছে।”
খবর রাজার কাছে গেল। শুনিয়া রাজা বলিলেন,-“তাই না কি! সে ব্রাহ্মণের ছেলেরা এমন সব করিল।”
সে রাতে সোনার পাখি বলিল,-“অরুণ বরুণ কিরণমালা! রাজাকে নিমন্ত্রণ কর।”
তিন ভাই-বোন্ বলিলেন,-“সে কি! রাজাকে নিমন্ত্রণ করিয়া কি খাওয়াইব?”
পাখি বলিল,-“সে আমি বলিব!”
অরুণ বরুণ ভোরে গিয়া রাজাকে নিমন্ত্রণ করিয়া আসিলেন।
সোনার পাখি বলিল,-“কিরণ! রাজা মহাশয় যেখানে খাইতে বসিবেন, সেই ঘরে আমাকে টাঙ্গাইয়া দিও।”
কিরণ বলিল,-“আচ্ছা।”
ঠাট কটক নিয়া, জাঁকজম করিয়া, রাজা নিয়ন্ত্রণ খাইতে আসিয়া দেখেন,-কি!!-রাজা আসিয়া দেখেন…আর চম্কেন; দেখেন…আর ‘থ’ খান। পুরীর কানাচে কোণে যা’, রাজভান্ডার ভরিয়াও তা নাই। “এসব এরা কোথায় পাইল?-এরা কি মানুষ!-হায়!!” একবার রাজা আনন্দে হাসেন, আবার রাজা দুঃখে ভাসেন-আহা, ইহারাই যদি তাঁহার ছেলেমেয় হইত!
রাজা বাগান দেখিলেন, ঝর্ণা দেখিলেন; দেখিয়া-শুনিয়া সুখে-দুঃখে, রাজার চোখ ফাটিয়া জল আসে, চোখে হাত দিয়া বলিলেন,-“আর তো পারি না। ঘরে চল।”
ঘরে এদিকে মণি, ওদিকে মুক্তা, এখানে পান্না, ওখানে হীরা। রাজা অবাক্।
তারপর রাজা খাবার ঘরে।-রকমে রকমে খাবার জিনিস থালে থালে, রেকাবে রেকাবে, বাটিতে বাটিতে, ভাড়ে-ভাড়ে রাজার কাছে আসিল! সুবাসে সুগন্ধে ঘর ভরিয়া গেল।
আশ্চর্য বিস্ময়ে রাজা আস্তে আস্তে আসিয়া আসন নিলেন। আস্তে আস্তে অবাক্ রাজা, থালে হাত দিয়াই-
-রাজা হাত তুলিয়া বসিলেন!-
“এ কি!-সব যে মোহরের!”
“তাহাতে কি?”
রাজা। “এ কি খাওয়া যায়?”
“কেন যাইবে না? পায়েস, পিঠা, ক্ষীর, সর, মিঠাই, মোন্ডা, রস, লাড়ু-খাওয়া যাইবে না?”
রাজা বলিলেন,-কে এ কথা বলে? অরুণ কিরণ! তোমরাও কি আমার সঙ্গে তামাসা করিতেছ? মোহরের পায়েস, মোতির পিঠা, মুক্তার মিঠাই, মণির মোন্ডা, এসব মানুষে কেমন করিয়া খাইবে? এ কি খাওয়া যায়?”
মাথার উপর হইতে কে বলিল,-“মানুষের কি কুকুর ছানা হয়?
“-অ্যাঁ-”
“রাজা মহাশয়,-মানুষে কি বিড়াল ছানা হয়?
“-অ্যাঁ!” রাজা চমকিয়া উঠিলেন! দেখিলেন, সোনার পাখিতে বলিতেছে,-
“মহারাজ, এ সব যদি মানুষে খাইতে না পারে, তো, মানুষের পেটে কাঠের পুতুল কেমন করিয়া হয়?”
রাজা বলিলেন,-“তা’ই তো, তা’ই তো-আমি কি করিয়াছি!!” রাজা আসন ছড়িয়া উঠিলেন।
সোনার পাখি বলিল,-
“মহারাজ, এখন বুঝিলেন? ইহারাই আপনার ছেলেমেয়ে। দুষ্টু মাসিরা মিথ্যা করিয়া আপনাকে কুকুর-ছানা, বিড়াল-ছানা, কাঠের পুতুল দেখাইয়াছিল।”
রাজা থর্থর্ কাঁপিয়া, চোখের জলে ভাসিয়া, অরুণ-বরুণ-কিরণকে বুকে নিলেন।
“হায়! দুঃখিনী রাণী যদি আজ থাকিত!”
সোনার পাখি চুপি চুপি বলিল,-“অরুণ বরুণ কিরণ! নদীর ও-পারে যে কুঁড়ে, সেই কুঁড়েতে তোমাদের মা থাকেন, বড় দুঃখে মর-মর হইয়া তোমাদের মায়ের দিন যায়; গিয়া তাঁহাকে নিয়া আইস।”
তিন ভাই-বোন্ অবাক্ হইয়া চোখের জলে গলিয়া মাকে নিয়া আসিল। দুঃখিনী মা ভাবিল,-“আহা স্বর্গে আসিয়া বাছাদের পাইলাম!
সোনার পাখি গান করিল,-
“অরুণ বরুণ কিরণ,
তিন ভুবনের তিন ধন।
এমন রতন হারিয়ে ছিল
মিছাই জীবন।
অরুণ বরুণ কিরণমালা
আজ ঘুচালি সকল জ্বালা।”
তাহার পর আর কি? আনন্দের হাট বসিল। রাজা রাজত্ব তুলিয়া আনিয়া, অরুণ বরুণ কিরণের পুরীতে রাজপাট বসাইয়া দিলেন। সকল প্রজা সাত রাত্রি ধরিয়া মণি-মুক্তা হীরা-পান্না নিয়া হুড়াহুড়ি খেলিল।
তাহার পর আর এক দিন, রাজ্যের কতকগুলো জল্লাদ হৈ হৈ করিয়া গিয়া ঘেসেড়ার বাড়ি, সূপকারের বাড়ি জ্বালাইয়া দিয়া, রাণীর পোড়ারমুখী দুই বোন্কে হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলিয়া চলিয়া আসিল।
তাহার পর রাজা, রাণী, অরুণ বরুণ কিরণমালা, নাতি-নাত্কুড় লইয়া কোটি-কোটিশ্বর হইয়া যুগ যুগ রাজত্ব করিতে লাগিলেন।
No comments:
Post a Comment