০০১. সাধু বাবা
দিল্লীর এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বেনারসে যাকে তীর্থ যাত্রায়। সংসারে তার আপন বলতে কেই ছিল না। কাজেই যাবার সময় সে একটা সমস্যায় পড়ল। তার সঞ্চিত কিছু টাকা ছিল। সঙ্গে নিতে চাইল না সেগুলো। পথে ডাকাতরা না আবার সব লুটে নেয়। কিন্তু রাখবেই বা কার কাছে? বিশ্বস্ত কারো কাছে রেখে না গেলে বৃদ্ধ বয়সে শেষ সম্বল টুকু খোয়াতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে পড়ল গ্রামের শেষ প্রান্তের বটতলার সাধুর কথা। ওই সাধু বাবাই একমাত্র লোক যার কাছে টাকাগুলো রেখে তীর্থে যাওয়া যেতে পারে।
প্রয়োজনীয় অর্থ নিজের কাছে রেখে অবশিষ্ট অর্থ একটি থলিতে ভরে বৃদ্ধ ব্রাম্মণ গিয়ে হাজির হলো সেই সাধুর কাছে। কিন্তু সব শুনে সাধু বাবা রেগে বলল, ‘ তোমার সাহস তো কম নয়, হে। তুমি কি জানো না আমরা- সাধুরা দুনিয়ার সব ত্যাগ করেছি? যেখানে আমার নিজেরই কোন টাকা-পয়সা নেই, সেখানে আমি তোমার টাকা পাহারা দেব?’
ব্রাহ্মণ সাধুর হাতে পায়ে ধরে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল। বলল, ‘আপনি পূণ্যবান লোক। আপনি দয়া করে এ টাকা কয়টা না রাখলে আমার আর তীর্থে যাওয়া হবে না, বাবা।’
ব্রাহ্মণের অনুরোধে সাধু কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি দেখব, তবে ওসব স্পর্শ করতে পারবো না। তুমি বরং এক কাজ করো। ওই যে নিম গাছটি দেখা যাচ্ছে, ওখানে গর্ত করে টাকার থলে টা পুঁতে রাখো। তাহলেই চলবে।’
ব্রাহ্মণ খুশি হয়ে তাই করল। তারপর সাধুকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে তীর্থে যাত্রা করল।
কয়েক মাস পর তীর্থ থেকে ফিরে সে গেল সাধুর কাছে। টাকাগুলো চাইল। সাধু বলল, ‘তুমি তো ওই নিম গাছের নিচে টাকার থলিটা পুঁতে রেখে গিয়েছিলে। এখন খুঁড়ে বের করে নাও।’
ব্রাহ্মণ মাটি খুঁড়ল বটে কিন্তু কোন থলি পেল না। তারই ভুল হয়েছে ভেবে নিম গাছের চারপাশটাই খুঁড়ল। কিন্তু না, কোথাও নেই। টাকার থলির কোন চিহ্নই নেই। বেচারা বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ভারী ব্যথিত হয়ে সাধুকে একথা বলতেই সাধু ভীষণ রেগে উঠল, ‘তুমি কি বলতে চাও যে আমি তোমার টাকা চুরি করেছি?’
ব্রাহ্মণ বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘না, আমি তা বলছি না, বাবা। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি নিম গাছের আশেপাশে কাউকে মাটি খুঁড়তে দেখেছেন? এমন তো হতে পারে আপনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, তখন কেউ হয়তো মাটি খুঁড়ে টাকার থলিটা নিয়ে গেছে।’
কিন্তু সাধু বাবা ব্রাহ্মণের কোন কথাই কানে তুলল না। উল্টো ধমক-ধামক দিয়ে তাড়িয়ে দিল তাকে।
বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ মনের দুঃখে বাড়ি ফিরে ভাবতে লাগল এখন সে কি করবে? সাধু বাবা এমন করল! কিভাবে সে টাকা উদ্ধার করবে? হঠাৎ করে বীরবলের কথা মনে পড়ল তার। দেরি না করে সে গেল বীরবলের কাছে।
সব শুনে বীরবল বললেন, ‘’চিন্তা কোরো না, ব্রাহ্মণ ঠাকুর। ওই সাধু ব্যাটার কাছে থেকে তোমার টাকা ঠিকই উদ্ধার করে দেব। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।
এক ভৃত্যকে ডেকে ব্রাহ্মণের গ্রামের অবস্থান জানিয়ে বীরবল বললেন, ‘গ্রামের শেষ মাথায় বাটগাছের নিচে এক সাধু বাবা আছে। তুমি সোজা গিয়ে বলবে যে তোমার ভাই ব্যবসার কাছে দেশের বাইরে যাবে। সে সঞ্চিত টাকা নিরাপদে রাখার কোন স্থান খুঁজে পাচ্ছে না। তো সাধু বাবা কি তা কিছুদিনের জন্য রাখতে পারবে? ঠিক এই সময় বাহ্মণ যাবে সেখানে, তার টাকার থলির সন্ধানে। সাধু নির্ঘাত নিজেকে বিশ্বস্ত প্রমাণ করার জন্য তোমার সামনেই ব্রাহ্মণের টাকা ফেরত দেবে। ব্রাহ্মণ তার টাকার থলি নিয়ে চলে আসার পর তুমি অবিলম্বে তোমার ভাইসহ টাকা নিয়ে আসছ- এই বলে সাধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসবে। আর হ্যাঁ সাধুকে বলো- তোমার ভাই অনেক সোনার মহর রাখতে চায়।’
যেমন বলা তেমন কাজ। বীরবলের ভৃত্য সাধুকে মোহর রাখার কথা বলতেই প্রথমে সাধু রেগে গেল। কিন্তু সে অনেক বলে কয়ে সাধু কে রাজি করাল। যখন তাদের কথাবার্তা চলছিল, তখন বাহ্মণ গিয়ে হাজির হল সেখানে। সাধু বাবা তাকে খুব খাতির করে বলল, ‘আসলে তুমি গতকাল ভুল জায়গায় মাটি খুঁড়েছ। তুমি চলে যাবার পর আমার তা মনে পড়েছে। তাই আমি বের করে রেখেছি। এই নাও,’ বলে সে ব্রাহ্মণ কে তার টাকার থলিটা ফিরিয়ে দিল। ব্রাহ্মণ ফিরে গেল এবং বীরবলকে ধন্যবাদ জানাল।
ওদিকে বীরবলের ভৃত্য এই দৃশ্য দেখে সাধু বাবার প্রচুর প্রশংসা করল। তক্ষুণি সে ত্র ভাইকেসহ সোনার মোহর নিয়ে আসার কথা বলে বিদায় নিল। কিন্তু সাধু বাবা আর কখনোই ওই ভৃত্যকে দেখল না। সোনার মোহর গচ্ছিত রাখার ভাগ্যও তার হল না।
০০২. মুখ দর্শন
মানিকচাঁদ নামে এক বণিক বাস করত দিল্লীতে। সকালে ঘুম থেকে উঠে যে প্রথমে এই বণিকের মুখ দর্শন করত, তার নাকি সারাদিন আর অন্ন জুটত না। কথাটা সম্রাটের কানে এল।
সম্রাট ভাবলেন, আজব কথা তো। বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখবেন বলে ঠিক করলেন। তাই একদিন ধরে এনে প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হলো মানিকচাঁদকে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সম্রাট প্রথমেই মানিকচাঁদকে দেখলেন। তারপর তাকে মুক্ত করার আদেশ দিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলেন, দেখা যাক আজ কি হয়।
যথারীতি প্রাতঃকৃত্য শেষে সম্রাট খেতে যাবেন। এমন সময় বাঁদী এসে খবর দিল বেগমের ভয়ানক মাথা ধরেছে। সম্রাটকে এখুনি যেতে হবে। ছুটলেন সম্রাট। হাকিম তলব করা হলো। দাওয়াই দেয়া হলো। খানিক সেবার পর বেগম সুস্থ হয়ে উঠলেন।
ওদিকে সম্রাটের সকালের নাশতা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে। ফলে আবার তা গরম করার ব্যবস্থা করতে হলো। কিন্তু খাওয়ার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবার অনেক পরেও না খাওয়ার জন্য সম্রাটের পেটে ব্যাথা শুরু হলো। ব্যাথা তো ব্যাথা, সম্রাটের অবস্থা একেবারে কাহিল। আবার হাকিম সাহেব এলেন। সম্রাটকে পরীক্ষা করে বললেন, ‘আজ আর কিছু না খাওয়াই সম্রাটের জন্যে ভাল হবে।’
ব্যাথায় অস্থির সম্রাট বললেন, ‘সে কি হাকিম, সকালেও তো কিছু খাইনি।’
হাকিম বললেন, ‘তবুও আজ না খাওয়াই ভাল। কিন্তু সকালে খাননি কেন? তাহলে তো দাওয়াতই দিতে হয়।’ বলে সম্রাটকে দাওয়াই খাইয়ে দিলেন হাকিম। খানিক পরে কমে গেল ব্যাথা। ব্যাথা কমতেই সম্রাটের মনে পড়ল মানিকচাঁদের কথা। মেজাজ তাঁর গরম হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে ওই নচ্ছার বণিকের মুখ দেখেছিলেন বলেই সকালে তো খেতে পারেননি, উপরন্ত সারাদিনের খাওয়া বরবাদ হতে চলছে। এমন অলুক্ষণের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তৎক্ষণাৎ তিনি মানিকচাঁদকে ধরে এনে ফাঁসিতে লটকে দেবার নির্দেশ দিলেন।
নির্দেশ মত পেয়াদা গিয়ে হাজির মানিকচাঁদের বাড়িতে। সম্রাটের নির্দেশ জানাতেই রীতিমত ভড়কে গেল সে। আর জানল-সকালে উঠে প্রথমেই তার মুখ দেখার কারণেই সম্রাট কিছু খেতে পারেননি। তাই তার এ শাস্তি। মানিকের শত কাকুতি মিনতি সত্ত্বেও পেয়াদা তাকে ধরে নিয়ে চলল। পথে বীরবল এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। মানিক বীরবলের পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমাকে বাঁচান। আমার বউ ছেলেমেয়ের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
বীরবল বণিককে অভয় দিলেন, প্রহরীদের কাছ থেকে তাকে একটু আড়ালে নিয়ে, কিছু কথা বলে আবার প্রহরীদের কাছে ছেড়ে দিলেন। পেয়াদারা বণিককে ধরে সোজা ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে এল। জল্লাদ এসে উপস্থিত হলো। ফাঁসির পূর্বে মূহুর্তে মানিক চাঁদকে জিজ্ঞেস করা হলো যে মৃত্যুর আগে তার কোন বিশেষ ইচ্ছা আছে কি না। কোন ইচ্ছা পূরণ করা হবে।
মানিক বলল, ‘মহামান্য সম্রাট ভারতেশ্বর আকবর কে একবার দেখতে চাই। এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।’
পেয়েদা-আমত্যরা রাজি হলো না। জানাল সম্রাটের মেজাজ বিগড়ে আছে। একথা বললে তিনি হয়তো আরো রেগে যাবেন। কিন্তু মানিক চাঁদের ওই একই কথা। শেষে খবর দেয়া হল সম্রাটকে। এলেন তিনি। মানিককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার? মৃত্যুর আগে আমার দেখার ইচ্ছা কেন?’
মানিক করজোড়ে বলল, ‘মহামান্য সম্রাট বাহাদুর, এটা কি সত্যি যে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই আমার মুখ দর্শনের কারণে সারাদিন কিছু খেতে পারেননি? আর তাই আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে নির্দেশ দিয়েছেন?’
সম্রাট বললেন, ‘শুধু কি আমি-যারাই সকালে প্রথমে তোমার মুখ দর্শন করে তারাই সারাদিন উপোস করে মরে। তোমার মত এরকম অলক্ষুণে, অপয়া লোককে আমরা রাজ্যে বাঁচিয়ে রাখতে পারি না।’
মানিক চাঁদ বলল, ‘আজ্ঞে জাঁহাপনা, আমি আজ প্রথমেই আপনার মুখ দর্শন করেছি। আর সেজন্যেই মরতে বসেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার মুখ দেখে যদি ফাঁসিতে ঝুলে মরতে হয়, সেটা কেমন হচ্ছে?’
একথা শুনে সম্রাট একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘তোমার কথাটা একদিক থেকে ভুল নয়। ঠিক আছে যাও, তোমার মৃত্যুদন্ড রদ করে দিলাম। কিন্তু তোমার ঘটে এই বুদ্ধি এল কি করে?’
মানিক বলল, ‘আজ্ঞে জাঁহাপনা, বীরবল মহাশয়ের বুদ্ধি পেয়েছিলাম’
মুচকি হেসে চলে গেলেন সম্রাট।
০০৩. আকবর বনাম ইন্দ্র
রাজদরবারে একদিন কথা প্রসঙ্গে সম্রাট আকবর সকলকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আচ্ছা বলো তো, আমি এবং দেবরাজ ইন্দ্র- এ দু’জনের মধ্যে বড় কে?’
সকলে অবাক হয়ে গেল। এ কেমনতর প্রশ্নরে বাবা! যদি দেবরাজ ইন্দ্রকে বড় বলা হয়, তাহলে সম্রাট যাবে চটে। আবার যদি সম্রাটকে বড় বলা হয়, তাহলে সম্রাটকে অতিরিক্ত তোষামোদ করা হয়। তদুপরি সম্রাট যদি প্রমাণ দাবী করে বসেন, তাহলে তো আরো বিপদ। দরবারীরা চুপ করে বসে রইলেন। কেবল বীরবল হাসতে হাসতে বললেন, ‘এটা আবার কোন প্রশ্ন হল নাকি, মহামান্য সম্রাট। দেবরাজ ইন্দ্রকে চোখে নি দেখেই লোকে তাকে বড় বলে। আসলে মহামান্য সম্রাট , দিল্লীশ্বর, ভারতের অধিপতি আকবর যে ইন্দ্রের চেয়েও বড়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’
সম্রাট বললেন, ‘তাই নাকি? প্রমাণ করতে পারবে?’
‘অতি সহজে জাঁহাপনা,’ বললেন বীরবল। ‘ভগবান সম্রাট আকবর আর দেবরাজ ইন্দ্রকে সৃষ্টি করে দাঁড়িপাল্লার দু’ধারে বসালেন, কে বড় কে ছোট বের করার জন্যে। আপনি ইন্দ্র তুলনায় অনেক বড় ও ভারী বলে আপনার দিকটা ঝুলে এসে পড়ল পৃথিবীতে। তাই তো আপনি পৃথিবীশ্বর সম্রাট হয়ে গেলেন।’
দরবারের সবাই বীরবলের এই উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। কিন্তু কৌশলে তিনি যে ইন্দ্রকে বড় রাখলেন, তা কেবল সম্রাটই বুঝলেন। তবে তিনি কিছু না বলে মুচকি হাসলেন।
০০৪. মহাজনের ছবি
দিল্লীতে এক সুদখোর মহাজন বাস করত। যেমন পাজী, তেমন ধূর্ত। একবার নিজের একটা ছবি আঁকিয়ে ঘরে বাঁধিয়ে রাখার শখ হলো তার।
ওই সময় এক প্রখ্যাত চিত্রকর ছিলেন দিল্লীতে। খুবই চমৎকার ছবি আঁকতেন তিনি। প্রচুর নামডাক ছিল।
প্রখ্যাত চিত্রকরের একদিন ডাক পড়ল মহাজনের বাড়ি। চিত্রকর উপস্থিত হলে মহাজন বললেন, ‘তুমি তো খুব দক্ষ চিত্রকর। তা আমার একটা নিখুঁত ছবি এঁকে দিতে হবে। হুবহু আমার প্রতিকৃতি হওয়া চাই। তাহলে তোমার পারিশ্রমিকের চারগুন পাবে।’
চিত্রকর বললেন, ‘হবে মহাজন। আপনি তা দেখেই সন্তুষ্ট হবেন।’
মহাজন বলল, ‘তা তোমার পারিশ্রমিক কত?’
চিত্রকর বললেন, ‘একহাজার সোনার মোহর।’
এ কথায় মহাজন মনে মনে রেগে গেল। ভাবতে লাগল তাহলে এই ব্যাটা আমার চেয়ে অনেক বেশি টাকা কামায়। আমার চেয়ে অনেক টাকা থাকবে সামান্য এক চিত্রকরের? ওকে একটা শিক্ষা না দিলেই নয়। ছবি নরকে যাক, আগে ব্যাটাকে একটা শিক্ষা দিয়ে নিই। এই ভেবে মনে মনে এক দুষ্ট বুদ্ধি আঁটল সে। কিন্তু মুখে বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি ছবি এঁকে নিয়ে এসো। তোমার উপযুক্ত সন্মানী দেব। মনে রাখবে, খুঁতহীন হুবহু প্রতিকৃতি হওয়া চাই।’
চিত্রকর সানন্দে ফিরে গেলেন। অন্যসব কাজ বন্ধ রেখে তিনদিন তিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে মহাজনের একটি চমৎকার প্রতিকৃতি আঁকলেন। তা নিয়ে হাজির হলেন মহাজনের বাড়িতে।
ছবি দেখে মহাজন বলল, ‘এটা তো নিখুঁত ছবি হয়নি। আমার ডান চোখের ওপর দিক যে জন্মদাগ সেটা কোথায়?’
চিত্রকর এতে একটু দমে গিয়ে লক্ষ করলেন জন্মদাগ মহাজনের চোখের ওপর আছে বটে, কিন্তু খুব ভালমত পর্যবেক্ষণ না করলে তা চোখেই পড়ে না। যাহোক, তিনি আরেকটি ছবি এঁকে দেয়ার কথা বলে বিদায় নিলেন।
ক’দিন পর আরেকটি প্রতিকৃতি নিয়ে হাজির হলেন চিত্রকর। তুচ্ছ একটি খুঁত বের করে মহাজন এটিও বাতিল করে দিল।
এভাবে অন্তত ৪/৫ বার চিত্রকর প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে গেল। প্রতিটি ছবিতে মহাজন একটা না একটা খুঁত বের করবেই। মহাজন মনে মনে মহাখুশি এই ভেবে যে, সে সমানো ক্ষতি করে চলেছে চিত্রকরের।
চিত্রকর চিন্তা করলেন এর একটা বিহিত না করলেই নয়। কিন্তু বুদ্ধি কে দিবে? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল বীরবলের কথা। অমনে ছুটলেন বীরবলের খোঁজে।
বীরবল তখন সবেমাত্র বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন। চিত্রকর তাঁকে সব খুলে বললেন। বীরবল বললেন, ‘আচ্ছা ওই পাজী সুদখোর মহাজনকে আচ্ছামত জব্দ করতে হয়।’ তারপর তিনি চিত্রকরকে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিলেন। চিত্রকর হাসিমুখে বাড়ি ফিরে গেলেন।
পরদিন চিত্রকর একটা মোড়কসহ মহাজনের বাড়িতে হাজির। মহাজন বলল, ‘কী, এবারো আগের মত খুঁতওয়ালা ছবি এনেছ?’
চিত্রকর বললেন, ‘না। এবার হুবহু আপনার ছবি। বিন্দুমাত্র খুঁত নেই।’ বলেই সে মোড়কটি খুলে ধরল মহাজনের সামনে।
মহাজন তো হতবাক। ছবিটি কোথায়! স্বচ্ছ একটি আয়না। সে বলে উঠল, ‘এ তো আয়না, ছবি কোথায়?’
চিত্রকর বললেন, ‘আয়নার ভেতর আপনার হুবহু প্রতিকৃতি রয়েছে। আপনি যা চেয়েছিলেন ঠিক তাই। আয়নার ভেতর যে আপনারই ছবি, তাতেও সন্দেহ হচ্ছে নাকি?’
পাজী মহাজন বাধ্য হয়ে চিত্রকরকে মোহর দিল আর গজরাতে লাগল।
০০৫. বর্মের পোশাক
একদিন একলোক সম্রাটের জন্য চমৎকার একটি বর্মের পোশাক (যুদ্ধের সময় গায়ে দেয়া হয়) নিয়ে এল। সম্রাট তা দেখে বললেন, ‘দেখতে তো বেশ সুন্দর, কিন্তু আসলেই শক্ত তো?’
লোকটি বলল, ‘মহামান্য সম্রাট, একবার পরীক্ষা করে দেখলেই হয়।’
সম্রাট তৎক্ষণাৎ ভৃত্যকে ডেকে বর্মের পোশাকটি একটি মূর্তির গায়ে পরাতে নির্দেশ দিলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার তলোয়ার দিয়ে প্রচন্ড আঘাত হানো। তাহলেই বোঝা যাবে কেমন শক্তিশালী বর্ম এটা।’
যেমন নির্দেশ, তেমন কাজ। ভৃত্যটির কয়েকবার তলোয়ার দিয়ে সর্বশক্তিতে প্রচন্ড আঘাত করল। এতে বর্মসহ মূর্তিটি ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে সম্রাট প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললেন, ‘যদি আমি এই বর্ম পরে যুদ্ধে যেতাম, তাহলে তো আমিও এভাবে মারে যেতাম।’
লোকটি ভীষণ লজ্জিত ও ভীত হয়ে পড়ল। গ্রামে প্রতিবেশীদেরকে বর্মটি দেখিয়ে বাহবা পেয়েছিলেন। তারা এখন অপেক্ষা করে আছে- সে সম্রাটের কাছে থেকে কি পুরষ্কার নিয়ে আসে।
‘এখন আমি কি করব?’ ভাবতে ভাবতে সে আকবরের কাছে করজোড়ে আবেদন করল, ‘জাঁহাপনা আমাকে আরেকটি বর্ম বানিয়ে আনতে দিন। সেটি নিশ্চয়ই এরচেয়ে বেশি শক্ত হবে।’
বীরবল পুরো ঘটনা দেখে বুঝলেন- এই লোকটি বহু কষ্ট করে বর্মটি বানিয়ে এনেছিল, কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশায়। অথচ এখন তাকে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। লোকটি যাবার পথে তিনি তাকে ডেকে হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘এই টাকা দিয়ে নতুন বর্মের পোশাক বানিয়ে নিও। আর সেটি সম্রাটকে দেখানোর আগে আমার কাছে এসো।’
লোকটি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিল।
কিছুদিন পর নতুন বর্মের পোশাক নিয়ে লোকটি বীরবলের কাছে হাজির হলো। বীরবল তাকে কিছু বুদ্ধি বাতলে দিলেন।
সম্রাট আগের মতই ভৃত্যকে ডেকে বর্মটা পরীক্ষা করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু লোকটি বলল, ‘জাঁহাপনা, বর্মটি আমাকে পরিধান করিয়ে পরীক্ষা করুন।’
‘তাহলে তো তুমি মারাত্নক জখম হবে,’ বললেন সম্রাট।
‘কোন ব্যাপার নয়,’ লোকটির নির্ভীক উত্তর।
সম্রাট আর কথা না বাড়িয়ে রাজি হয়ে গেলেন। লোকটি বর্মপোশাক পরে নিল। ভৃত্য যেই না তলোয়ার দিয়ে আঘাত হানতে গেছে, অমনি লোকটি নিজের তলোয়ার টেনে বের করে আঘাত প্রতিহত করল। সম্রাট হতবাক হয়ে বললেন, ‘এর মানে কি? তুমি কি যুদ্ধ করতে এসেছ?’
‘মহামান্য সম্রাট,’ বর্ম প্রস্তুতকারক বলল। ‘যুদ্ধে কেউ আপনাকে আঘাত করতে এলে আপনিও নিশ্চয়ই পাল্টা আঘাত করবেন এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল মার খাবেন না। ফলে এই বর্ম সহজে ভেঙ্গে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং এ দিয়ে আপনি অনেকদিন যুদ্ধ করতে পারবেন।’
ইতোমধ্যে বীরবলও সেখানে এসে পড়েছেন। তিনি বললেন, ‘জাঁহাপনা লোকটি যুক্তিসঙ্গত কথাই বলেছে।’
সম্রাট আকবর বর্ম প্রস্তুতকারকের ওপর খুশি হয়ে তাকে প্রচুর উপহার দিলেন।
০০৬. বাগানের গাছ ও বনের গাছ
বীরবলকে নিয়ে একদিন সম্রাট ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। একটি গ্রাম অতিক্রম করার সময় সম্রাট লক্ষ্য করলেন যে গ্রামের মানুষগুলো ভীষণ কর্মঠ। বিশেষত মহিলারা খুব পরিশ্রমী। তারা কলসি কাঁখে পুকুরে যাচ্ছে পানি আনতে। কাঠ কেটে কেটে বয়ে আনছে তারা। কৃষকেরা জমিতে নিরলস ভাবে কাজ করছে। এসব দৃশ্য দেখে সম্রাট বললেন, ‘এদের দেখো, বীরবল। কি পরিশ্রমটাই না করছে এরা। অথচ কত অল্প টাকা আয় করে। কত কম খেয়ে থাকে। কি কঠিন জীবন এদের। নিজেদের কাজ নিজেরাই করে এরা।’
বীরবল চুপচাপ শুনে গেলেন। কিছু বললেন না।
প্রাসাদে ফিরেই সম্রাট হুকুম জারি করলেন, ‘প্রাসাদের প্রত্যেকরই যার যার কাজ, তার তার করতে হবে। গ্রামের আধাপেট খাওয়া মহিলারা যদি কঠোর পরিশ্রম করতে পারে, তাহলে তিনবেলা বিপুল খানা খাওয়া, স্বাস্থ্যবতী বেগম আর বাহশাদজাহীরা কেন পারবে না? পারতেই হবে। এখন থেকে চুল বাঁধা থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজে নিজেদের করতে হবে। কোন দাসী-বাঁদী ডাকা চলবে না।’
স্রমাটের নির্দেশে বেগম ও বাদশাহজাদীরা চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলেন। যাঁরা সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে অভ্যস্ত, কিভাবে তাঁরা এত কাজ করবেন? কিন্তু সম্রাটের নির্দেশ উপেক্ষা করলে তো শাস্তি হবে। শেষতক বীরবলকে ডেকে পাঠালেন এক বাদশাহজাদী।
এলেন বীরবল। বাদশাহজাদী তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করলেন। তাঁদের করুণ অবস্থা দেখে বীরবল প্রতিজ্ঞা করলেন, যত শিঘ্রি সম্ভব তিনি একটা বিহিত করবেন।
সম্রাটের বাগানের ফুলগাছে পানি দিত এক মালী। বীরবল তাকে ডেকে বললেন, ‘আজ থেকে তুমি আর গাছে পানি দিবে না।’
মালী ভীত হয়ে বলল, ‘সম্রাট তো তাহলে আমাকে শাস্তি দেবেন।’
বীরবল বললেন, ‘তোমার কিছুই হবে না। আমি যা বলব তুমি কেবল তাই করবে।’ সেদিন থেকে বাগানে পানি দেয়া বন্ধ হয়ে গেল।
ক’দিন পর সম্রাট ও বীরবল বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। সম্রাট দেখলেন যে ফুলগাছের চারাগুলো পানি না পেয়ে শুকিয়ে গেছে। ক্রুদ্ধ হয়ে মালীকে তলব করলেন তিনি।
বীরবল বললেন, ‘অত ভাববেন না হুজুর, সব ঠিক হয়ে যাবে। বনের ফুল, গাছপালা দেখেননি? কেউ তো পানি দেয় না, পরিচর্যা করে না। তবু কেমন তরতর করে বেড়ে ওঠে।’
সম্রাট রেগে বললেন, ‘কি যা তা বলছ! বাগানের এই সুন্দর ফুল গাছের সাথে কি বুনো জংলী ফুল গাছের তুলনা হয়?’
‘কেন হবে না, মহামান্য সম্রাট?’ বীরবল অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি গ্রামের খেটে খাওয়া ওই মহিলাদের সঙ্গে বাদশাহজাদীদের তুলনা করে তাদেরকে সব কাজ নিজ হাতে করার নির্দেশ দিয়েছেন।’
সম্রাট মূল সমস্যাটা বুঝতে পারলেন। এবং বললেন, ‘হুম। তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে। আজ থেকে বেগম ও বাহশাহজাদীরা আবার তাহের দাসী-বাঁদীদের নিয়ে কাজ করবে। আমার আদেশ প্রত্যাহার করে নিলাম।’
০০৭. সীমাহীন রাজ্য!
একবার সম্রাট আকবর কোন কারণে তাঁর তিন মন্ত্রীর উপরে ভায়ানক ক্ষেপে গেলেন। আদেশ করলেন, ‘তোমরা অবিলম্বে আমার রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। যদি আর কোনদিন তোমাদের দেখি, তাহলে সাথে সাথে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে।’ মন্ত্রীত্রয় অনেক কাকুতি মিনতি করল শাস্তি মওফুকের জন্য। কিন্তু সম্রাট অনড়।
ভীষণ বিপদে পড়ল তিন মন্ত্রী। পরিবারের পরিজন রেখে কোথায় যাবে? তাদের দুরবস্থা দেখে বীরবল বললেন, ‘আপতত আপনাদের কোন উপায় নেই। তবে আপনারা আমার কথা শুনলে শেষতক রেহাই পেতে পারেন।’
তারা সানন্দে রাজি হয়ে গেল। বীরবল তাদেরকে কিছুদিনের জন্য দিল্লীর আশেপাশে লুকিয়ে থাকতে বললেন। আর কয়েকমাস পর তাঁর সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন।
প্রায় বছর খানেক পর একরাতে মন্ত্রী তিনজন লুকিয়ে বীরবল কাছে এল। বীরবল কিছু বুদ্ধি শিখিয়ে তাদের বিদায় করলেন।
পরেরদিন সম্রাট আর বীরবল বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। এমন সময় সম্রাট দেখলেন একটি গাছের ডালে তিনজন লোক হাত শূন্যে মেলে বসে আছে। এগিয়ে গিয়ে দেখলেন এরা আর কেউ নয়, নির্বাসিত সেই তিন মন্ত্রী। তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের নিচে নেমে আসার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, ‘তোমাদের এত বড় সাহস, আমার আদেশ অমান্য করেছ! এই মুহুর্তে তোমাদের প্রাণ দন্ড দেয়া হবে।’
মন্ত্রী তিনজন হাঁটু গেড়ে সম্রাটের সমানে বসে পড়ে বলল, ‘ জাঁহাপনা, আমরা আপনার আদেশ অমান্য করিনি। আপনি নির্দেশ দেবার পর পরই আমরা বেরিয়ে পড়ি। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম সব দিকেই গিয়েছি আমরা। অনেক শহর বন্দর পার হয়েছি। তবু আপনার রাজ্যসীমা অতিক্রম করতে পারিনি। আমাদের মনে হয়েছে যে মহামান্য সম্রাটের রাজ্য বিশাল, সীমাহীন। তাই ঠিক করেছি আকাশে উড়াল দেব। গাছে উঠে শূন্যে হাত বাড়িয়ে আমরা সে চেষ্টা করছিলাম।’
সম্রাটের বুঝতে বেগ পেতে হল না যে এটা আসলে বীরবলের বুদ্ধি। তিনি মন্ত্রী তিনজনকে ক্ষমা করে দিলেন। আর বীরবলকে করলেন পুরস্কৃত।
০০৮. সম্রাটের যোগী তোতা!
একদিন এক কৃষক এল রাজদরবার। সঙ্গে এনেছে একটি তোতা পাখি। সম্রাটকে কুর্নিম করে সে বলল, ‘মহামান্য সম্রাট, এই তোতাটি খুব সুন্দর করে কথা বলতে ও গান গাইতে পারে। আমি হুজুরের জন্য এটি উপহার হিসাবে এনেছি।’
খুশি হয়ে তাকে প্রচুর উপহার দিলেন সম্রাট।তোতাটিকে প্রাসাদের অন্দরে নিয়ে গেলেন। সম্রাটের নির্দেশে খাঁচায় রাখা হলে পাখিটিকে। দু’জন ভৃত্য নিযুক্ত হলো তোতা পাখির তত্ত্বাবধানে। সম্রাট হুকুম জারি করলেন, ‘তোতার খুব যত্ন করবে। এইটাই তোমাদের একমাত্র কাজ। যে আমার কাছে তোতার মৃত্যু সংবাদ আনবে, তারই মৃত্যুদন্ড হবে।’
ভৃত্যদ্বয়ের অবস্থা হয়ে উঠলো শোচনীয়। তারা তোতাকে খুবই যত্নের সঙ্গে খাওয়ায়, নাওয়ায়। মাঝে মধ্যে সম্রাটকে দেখিয়ে আনে। কিন্তু সব সময় একটা দুশ্চিন্তা কাজ করে তাদের মাথায়। যদি তোতাটা মারা যায়? তাহলে তো সর্বনাশ। ভেবে ভেবে তাদের নাওয়া, খাওয়া, ঘুম হারাম হয়ে গেল।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভৃত্যরা দেখে তোতাটি সত্যিই মারা গেছে। অনেক নড়াচড়া করল তারা। কিন্তু তোতা স্থির। ডানা ঝাপটায় না। মহা বিপদ! কি করা যায় ভাবতে ভাবতে একজনের মনে পড়ল বীরবলের কথা। তারা ছুটে গেল বীরবলের কাছে। বীরবল সব শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে, যা করার আমি করব। কোন ভয় নেই তোমাদের।’
কিছুক্ষণ পর দরবারে এসে হাজির হলেন বীরবল। সম্রাটকে বললেন, ‘জাঁহাপনা জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।’
‘কি দুঃসংবাদ, বীরবল?’
‘মানে, আপনার প্রিয় তোতা পাখিটা দানাপানি খাচ্ছে না। এমনি কি ডানা পর্যন্ত ঝাপটাচ্ছে না। চুপ করে চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে ধ্যান করছে।’
‘বলো কি!’ আহত হয়ে বললেন সম্রাট।
‘হ্যাঁ, জাঁহাপনা,’ বীরবল বললেন, ‘সম্ভবত ভগবানের কৃপায় যে যোগী হয়ে গেছে।’
সম্রাট দুঃখিত মনে বললেন, ‘কি আর করা। ওকে ছেড়ে দাও। বনে গিয়েই ধ্যান করুক।’
কিন্তু যেই মাত্র খাঁচা থেকে তোতাটিকে বের করে আনা হলো, সম্রাট বুঝে ফেললেন যে আসলে বীরবল তাকে ঠিক কথা বলেনি। তিনি ভীষণ রেগে বললেন, ‘বীরবল, তুমি এত বড় মিথ্যা বললে? এমন তামাশা করতে পারলে? যোগী-টোগী কিছু না, তোতা তো মরে গেছে।’
‘আপনি কিন্তু প্রথম তোতার মৃত্যুর খবরটা নিজেকে জানালেন, সম্রাট,’ বীরবল বললেন।
‘কি বলতে চাও তুমি?’ সম্রাট স্তম্ভিত।
‘আপনি বলেছিলেন যে, আপনার কাছে যে তোতার মৃত্যুর সংবাদ আনবে, তারই মৃত্যুদন্ড হবে। আপনার ভৃত্যরা এই ভয়ে আপনাকে তোতার মৃত্যুর খবরটা দিতে পারছিল না। তারা আমার কাছে সাহয্য চায়। আমাকে বাধ্য হয়েই চালাকির আশ্রয় নিতে হয়।’
বিচক্ষণ সম্রাট বীরবলের এই বুদ্ধিমত্তার খুশি হলেন এবং বললেন, ‘সত্যিই তোমার এই কাজে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তুমি এটা করলে দু’জন নিরপরাধ লোকের প্রাণ যেত। আমি নির্বোধের মত একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দু’জন মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছ তুমি।’
০০৯. পেটুক সম্রাট
প্রাসাদের বারান্দার বসে সম্রাট আকবর ও তাঁর বেগম আম খাচ্ছিলেন। খোসা আর আঁটি বেগমের পাশে জমা হচ্ছিল। এমন সময় সেখানে এলেন বীরবল। সম্রাটের খাসমহলে তাঁর অবাধ যাতায়াতের অনুমতি ছিল।
বীরবলকে দেখেই সম্রাট বললেন, ‘দেখো বীরবল, বেগম কি পেটুক! ওর পাশে কতগুলো আমের খোসা ও আঁটি, দেখেছ?’ বলেই তিনি খুব হাসতে লাগলেন।
এদিকে বেগম তো চটে লাল। বীরবল তা লক্ষ্য করে বললেন, ‘আসলে বিষয়ে হচ্ছে কি মহামান্য সম্রাট, সতীসাব্ধী স্ত্রীরা চিরদিনই স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে থাকেন। কাজেই বেগম সাহেবার কোন দোষ নেই।’
‘তার মানে তুমি আমাকেই পেটুক বলতে চাইছ? কিন্তু অবস্থা দেখেও কি কিছু বুঝতে পারছ না? ওর পাশে খোসা ও আঁটি জমেছে কতগুলো, কিন্তু আমার পাশে একটিও নেই,’ বললেন সম্রাট।
‘সেই জন্যেই তো বলছি সম্রাট,’ বীরবল বলতে লাগলেন। ‘বেগম সাহেবা কেবল আমের রসসহ শাঁস খেয়েছেন। আপনি তো খোসা আর আঁটিও বাদ দেননি। যথার্থ পেটুকের মত সব চেটেপুটে খেয়েছেন।’
বেগম এবার আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, ‘ঠিক ধরেছ বীরবল। আমি সরিয়ে রেখেছি বলেই তো ওগুলো আর খেতে পারেনি।’
সম্রাট একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। বেগম আর বীরবল সম্রাটের অবস্থা দেখে হেসে উঠলেন এক সঙ্গে।
০১০. কৃতজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞ
একদিন সম্রাট আকবর বীরবলকে আদেশ করলেন, ‘চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এমন দু’টি প্রাণী হাজির করতে, যাদের একটি হবে স্বভাব-কৃতজ্ঞ আর অন্যটি হবে জাত-অকৃতজ্ঞ।’
বীরবলের তো চক্ষুস্থির। এমন খেয়ালীপনার অর্থ কি? তাকে চুপ থাকতে দেখে সম্রাট ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘ব্যর্থ হলে মৃত্যু অনিবার্য।’
বীরবল নতমুখে নিজের ঘরের দিকে রওনা হলেন। দরবারের অনেকে তো মহা খুশি। বীরবল এবার ব্যর্থ হবে। তাদের পথের কাঁটা দূর হচ্ছে তাহলে। নির্ঘাত মরতে বসেছে বীরবল।
এদিকে বীরবলকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখে মেয়ে রঙ্গীলা জিজ্ঞেস করল, ‘কি হয়েছে?’
সবকিছু খুলে বলতেই সে বাবাকে কোন দুশ্চিন্তা না করতে বলল।
পরেরদিন যথাসময়ে বীরবল দরবারে হাজির হলেন। সঙ্গে মেয়ের পরামর্শমত তাঁদের পোষা কুকুর ও মেয়ে-জামাই যষ্ঠী। বীরবলকে দেখে সবাই রীতিমত অবাক।
সম্রাট গম্ভীর সুরে বললেন, ‘কী বীরবল,এনেছ না কৃতজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞকে?’
সম্রাটকে কুর্নিশ করে বীরবল সঙ্গের কুকুর আর জামাইকে দেখিয়ে দিল। সম্রাট রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছ? তোমার স্পর্ধা তো কম নয়।’
বীরবল নির্ভীকচিত্তে বললেন, ‘আজ্ঞে জাঁহাপনা, আপনি সব শুনলেই বুঝতে পারবেন। এই যে কুকুরটি দেখছেন, এ হচ্ছে স্বভাব-কৃতজ্ঞ। এ রকম কৃতজ্ঞ প্রাণী আর দ্বিতীয়টি এই দুনিয়ায় নেই। মনিবের সুখ-দুঃখে বিপদ আপদের সাথী। কোন অবস্থাতেই মনিব কে ছেড়ে যায় না। আর এই লোকটি হচ্ছে আমার মেয়ে জামাই। এরা হচ্ছে জাত-অকৃতজ্ঞ। যত খাতির যত্ন করুন, উপহার দিন, কোনদিনই এদের খাঁই মিটবে না; এরা অকৃতজ্ঞ থেকেই যাবে।’
সম্রাট খুব খুশি হলেন। পাশাপাশি হুকুম জারি করলেন যে তাঁর রাজত্বে কোন অকৃতজ্ঞ প্রাণীর স্থান হবে না। তাই তৎক্ষণাৎ জামাই ষষ্ঠীর গর্দান নেয়ার আদেশ করলেন।
বীরবল সহসা বলে উঠলেন, ‘মহামাণ্য সম্রাট, আপনার নির্দেশ সকল অকৃতজ্ঞের জন্যই প্র্রযোজ্য বটে। কিন্তু, জাঁহাপনাসহ এখানে আমরা সবাই তো কারও না কারও জামাই। তাহলে কি...’
বীরবলের কথা শেষ হবার আগেই গোটা দরবার হাসিতে ফেটে পড়ল। সম্রাটও হাসতে লাগলেন। বীরবলের বুদ্ধিমত্তা ও কৌতুকরসের জন্য সম্রাট তাকে প্রচুর উপহার দিলেন।
০১১. মহেশ হলেন বীরবল
একবার গরমের সময় সম্রাট আকবর তাঁর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে শিকারে গেছেন। কিন্তু বিধিবাম। ঘোড়ায় চড়ে বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করেও কোন শিকার মিলল নি। তার উপরে প্রচন্ড গরম। ভীষণ পিপাসার্ত হয়ে পড়লেন তাঁরা। এদিকে ধারে কাছে কোন জলাশয় নেই। শেষমেষ সম্রাট ঠিক করলেন যে নিকটবর্তী কোন গ্রামে গিয়ে পানির ব্যবস্থা করা হবে।
গ্রামের উদ্দেশে যাবার পথেই তাঁরা একটি ছোট ছেলেকে দেখতে পেলেন। কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে পথ চলছে সে। সম্রাট ঘোড়া থামিয়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন যে ধারের কাছে কোথায় পানি পাওয়া যাবে কি না। সম্রাট ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের যে ভয়ানক তেষ্টা পেয়েছে, ছেলেটি তাঁদের মুখ দেখেই বুজতে পারল। কালবিলম্ব না করে সে তাঁদের পানির সন্ধান দিতে রাজি হল। সম্রাট আকবর ছেলেটিকে নিজের ঘোড়ায় তুলে নিলেন এবং তাঁর কথামত ঘোড়া ছোটালেন।
যাওয়ার পথে সম্রাট ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কি?’ ছেলেটি সম্রাটের প্রশ্নের উত্তর নি দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করল, ‘আগে আপনার নামটা শুনি?’ তারপরে আমারটা বলব।
সম্রাট বিস্মিত হলেন,ছেলেটির এহেন কথা শুনে। খানিকটা রাগতস্বরেই বললেন, ‘তুমি জানো, আমি কে?’
ছেলেটি হেসে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আপনি জানেন, আমি কে?’
সম্রাট রেগে গেলেও তা যথাসম্ভব চেপে উত্তর দিলেন, ‘না’।
‘আমারও ওই একই উত্তর,’ জবাব দিলো সে।
পুঁচকে এক ছেলের একরকম উত্তর শুনে সত্যি সত্যি হতবাক হয়ে গেলেন সম্রাট। তবে মনে মনে ছেলেটির বুদ্ধির ও সাহসের তারিফ করলেন।
ইতোমধ্যে তাঁরা কাঙ্ক্ষিত জলাশয়ের কাছে চলে এসেছেন। কথা না বাড়িয়ে সম্রাট ও তাঁর সঙ্গীরা পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করলেন। তারপর ধন্যবাদ জানালেন ছেলেটিকে। সম্রাট আকবর খুশি হয়ে তাঁর হাতের আংটি খুলে তাকে উপহার দিয়ে বললেন, ‘এই আংটিই প্রমাণ করবে, আমি আসলে কে।’ আংটিতে সম্রাটের চিহ্ন দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। সম্রাট বললেন, ‘এবার তোমার নাম বলো।’
‘মহেশ,’ জবাব দিল ছেলেটি।
‘বড় হয়ে যদি তুমি দিল্লীর রাজদরবারে আসো, তবে সেখানেই আমাকে পাবে।’এই বলে সম্রাট সঙ্গীসাথীসহ ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন।
এরপর বেশ কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে। মহেশের বয়স ষোলো-সতেরো হয়েছে। একদিন তার কাকা তাকে ডেকে বলল, ‘বাবা মহেশ, তুমি এখন নিজের ভাগ্য নিজে গড়ে নাও। বাবা নেই তোমার। দূর দেশে গিয়ে নিজের বুদ্ধির জোরে কিছু একটা করো।’
কাকার কথা মনে ধরল মহেশের। কিন্তু যাবে কোথায়? হঠাৎ মনে পড়ল সম্রাট আকবরের কথা। সে তৎক্ষণাৎ দিল্লী যাত্রার বন্দোবস্ত করতে লেগে গেল। যাবার সময় সম্রাটের দেয়া আংটিটা মাকে দিয়ে বলল, ‘আমার কথা মনে হলে এটা দেখো আর আর্শীবাদ কোরো।
দিল্লীতে পৌঁছে সোজা সে আগ্রায় সম্রাটের প্রাসাদে গিয়ে হাজির হলো। কিন্তু দ্বাররক্ষী কি তাকে দরবারে ঢুকতে দেয়? পুরস্কার লোভ দেখিয়ে মহেশ বহুকষ্টে দরবারে প্রবেশ করল। দরবারে বিচিত্র সৌন্দর্য তার চোখ ধাঁধিয়ে দিল। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখে পড়ল সিংহাসনে উপবিষ্ট বহুদিন আগে দেখা সেই সম্রাট আকবরকে। তিনি তখন দারবারীদের কাছে প্রশ্ন করছেন- ‘কার সন্তান পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ?’
দরবারীরা বিভিন্ন উত্তর দিতে লাগলেন। কেউ বললেন, রাজার সন্তান; কেউ বললেন, জ্ঞানীর সন্তান ইত্যাদি। মহেশ সাহস করে বলল, ‘আজ্ঞে জাঁহাপনা, গাভীর সন্তান পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।’
দরবারের সবাই তো হতবম্ভ হয়ে গেলেন। এই গেঁয়ো ভূত বলে কি! পাগল না ছাগল? সম্রাট খানিক কৌতুক অনুভব করলেন মহেশের উত্তরে। বললেন, ‘তোমার এহেন উত্তরের হেতু কি?’
‘আজ্ঞে মহামান্য সম্রাট,’ মহেশ সবিনয়ে বলতে লাগল, ‘গাভীর সন্তান যদি ছেলে হয়, তাহলে সে হয় ষাঁড়, যে কিনা লাঙ্গল টানে। সে লাঙ্গল না টানলে আমরা চাষাবাদ করতে পারতাম না, খেতেও পারতাম না। আর সন্তান যদি মেয়ে হয়, তাহলে সেও হয় গাভী। তার পুষ্টিকর দুধ যে আমাদের জন্য কত উপকারী তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব দিক বিবেচনা করলে গাভীর সন্তানই সর্বশ্রষ্ঠ হতে বাধ্য।’
দরবারীরা এমন যুক্তি শুনে বোকা বনে গেলেন। চমৎকৃত হয়ে গেলেন সম্রাটও।পুরষ্কৃত করতে চাইলেন মহেশকে। এবার সম্রাটের আরো অবাক হওয়ার পালা। কি পুরষ্কার চায় জিজ্ঞাসা করতেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে মহেশ বলল, ‘পঞ্চাশ ঘা চাবুক।’
দরবারীরা পাগল ঠাউরেলেন মহেশকে। কিন্তু মহেশ অনড়। শেষতক সম্রাটের আদেশে তাঁর পিঠে চাবুকের ঘা দেয়া হতে লাগল। পঁচিশ ঘা দেবার পরপরই মহেশ চিৎকার করে থামতে বলল। কি ব্যাপার? দ্বাররক্ষীকে ডাকার আবেদন জানালো সে। আবেদন মঞ্জুর হল। দ্বাররক্ষী এলে মহেশ করজোড়ে সম্রাটকে বলল, ‘জাঁহাপনা, এই দ্বাররক্ষী আমাকে কিছুতেই ঢুকতে দিচ্ছিল না। শেষতক তার কাছে এই প্রতিজ্ঞা করে ঢুকতে হলো যে, আপনার কাছে আমি যা পুরষ্কার পাব, তার অর্ধেকটা তাকে দেব। এখন চাবুকের বাকি পঁচিশ ঘা এই লোকের প্রাপ্য।’
সমগ্র দরবারে হৈ চৈ পড়ে গেল। সকলে বিস্মিত হয়ে গেছে। সম্রাট নবাগত মহেশের বুদ্ধি ও সাহস দেখে ভীষণ খুশি হলেন। তিনি তার পরিচয় পেয়ে আরও আনন্দিত হয়ে বললেন. ‘আমার কাছে এসেছ বলে খুবই খুশি হয়েছি। তুমি এই রাজপ্রসাদেই থাকবে এখন থেকে। আজ থেকে তোমাকে “বীরবল” বলে ডাকব, যার অর্থ জ্ঞানী। তোমার মত বুদ্ধিমান, রসিক ও সাহসী লোক আমার দরবারের কদর বাড়াবে, সন্দেহ নেই’।
সেই থেকে বীরবলের যাত্রা শুরু হলো। সম্রাট আকবরসহ অনেক চমকপ্রদ ঘটনার জন্যে আজও বীরবল বিখ্যাত’।
Developed by
No comments:
Post a Comment