মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা পরিচিতি
নাসির উদ্দিন হোজ্জাকে চেনেন না এমন মানুষ খুব কমই আছেন। কেউ তাঁকে চেনেন মোল্লা নাসির উদ্দিন হিসেবে, কেউ হোজ্জা নাসির উদ্দিন। তিনি একাধারে ছিলেন দার্শনিক, পর্যটক এবং একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। হাস্য কৌতুকেও তিনি ছোট বড় সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পারতেন। তাঁর হাস্য কৌতুকের মধ্যে রয়ে গেছে শিক্ষণীয় অনেক কিছু। আমাদের এই অ্যাপসে তাঁর সম্পর্কে কিছু মজার কৌতুক বন্ধুদের দরবারে পরিবেশন করা হলো।
০০১. মূল্য পরিশোধ
একদা মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা তার নিজের জন্য একটি জোব্বা কিনতে গেলেন একটি দোকানে। তো পছন্দ করার পর দোকানী জোব্বা'টা প্যাক করে দেয়। মোল্লা তখন জোব্বা নিয়ে চলে আসার সময় ভাবলেন জোব্বা না নিয়ে বরং একটি আলখাল্লা নিয়ে যাই। দোকানীকে বললেন, আপনি বরং আমাকে একটি আলখাল্লা দিন। তো দোকানী আলখাল্লা দেয়ার পর মোল্লা নাসিরউদ্দিন তা নিয়ে বের হয়ে আসার সময় দোকানী ডেকে বললেন, হোজ্জা সাহেব আপনিতো আলখাল্লা'র মূল্য পরিশোধ করেননি। তখন মোল্লা উত্তর দিল আমি তো আলখাল্লা'র পরিবর্তে জোব্বা'টা রেখে গেলাম। তখন দোকানী বললেন, আপনিতো জোব্বা'র জন্যও মূল্য পরিশোধ করেননি। প্রতি উত্তরে মোল্লা বললেন, যেটা আমি নেইনি তার জন্য মূল্য পরিশোধ করব কেন।
০০২. রেসিপি তো আমার কাছে
একদিন হোজ্জা বাজার থেকে কলিজা কিনে বাসায় যাচ্ছিলেন। এদিকে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে কলিজার পাই বানানোর রেসিপি দিয়েছিলেন, যাতে বাসায় গিয়ে কলিজার পাই রান্না করতে পারেন। কিন্তু হঠাৎ একটি বাজপাখি উড়ে এসে কলিজা ছিনিয়ে নিয়ে একেবারে নাগালের বাইরে উড়ে চলে গেল।
বোকা কোথাকার! চেঁচিয়ে হোজ্জা বললেন, কলিজা নিয়ে গেছ ঠিক আছে, কিন্তু প্রস্তুত প্রণালী (রেসিপি) তো আমার কাছে!
০০৩. কে অশুভ !
রাজার মেজাজ খারাপ। রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে শিকারে যাওয়ার পথে হোজ্জা সামনে পড়ে গেলেন।
শিকারে যাওয়ার পথে হোজ্জার সামনে পড়ে যাওয়াটা আমার ভাগ্যের জন্য খারাপ, প্রহরীদের রাগত গলায় বললেন রাজা। আমার দিকে ওকে তাকাতে দিও না- চাবুকপেটা করে ওকে পথ থেকে সরিয়ে দাও।
প্রহরীরা তা-ই করল।
শিকার কিন্তু ভালোই হলো।
রাজা হোজ্জাকে ডেকে পাঠালেন।
আমি সত্যি দুঃখিত, হোজ্জা। ভেবেছিলাম তুমি অশুভ। কিন্তু তুমি তা নও।
আপনি ভেবেছিলেন আমি অশুভ! হোজ্জা বললেন। আপনি আমাকে দেখার পর ভালো শিকার করেছেন। আর আমি আপনাকে দেখে চাবুকপেটা খেয়েছি। কে যে কার অশুভ, বুঝলাম না।
০০৪. ওরই বেশি দরকার
নাসির উদ্দিন একবার খোলা কূয়ার পাশে বসে গোছল করছিলেন। পাশে রাখা সাবানদানিতে নতুন সাবান রয়েছে। হোজ্জা ভাবছিলেন, আজ ভাল করে সাবান মেখে গোছল করবেন। এই মনে করে তিনি সাবানটা হাতে নিতে গেলেন কিন্তু তার আগেই একটি কাক এসে সাবানটি নিয়ে উড়ে চলে গেলো। নাসির উদ্দিন হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চিন্তা করলেন। তারপর তাঁর মুখ হাসিতে ভরে উঠলো। এক প্রতিবেশি তা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী ব্যাপার মোল্লা সাহেব, সাবান কাকে নিয়ে যাবার পরও আপনি হাসছেন কেন? নাসির উদ্দিন অম্লান বদনে উত্তর দিলেন- দেখুন, কাকটা আমার চেয়েও কালো কুৎসিত। আমার মনে হয় সাবানটা আমার চেয়ে ওরই বেশি দরকার ।
০০৫. রাজার শিকারে যাওয়া
রাজার মেজাজ খারাপ।রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে শিকারে যাওয়ার পথে হোজ্জা সামনে পড়ে গেলেন।
শিকারে যাওয়ার পথে হোজ্জার সামনে পড়ে যাওয়াটা আমার ভাগ্যের জন্য খারাপ, প্রহরীদের রাগত গলায় বললেন রাজা।আমার দিকে ওকে তাকাতে দিয়ো না-চাবুকপেটা করে ওকে পথ থেকে সরিয়ে দাও।
প্রহরীরা তা-ই করল।
শিকার কিন্তু ভালোই হলো।
রাজা হোজ্জাকে ডেকে পাঠালেন।
আমি সত্যি দুঃখিত, হোজ্জা।ভেবেছিলাম তুমি অশুভ।কিন্তু তুমি তা নও।
আপনি ভেবেছিলেন আমি অশুভ!হোজ্জা বললেন।আপনি আমাকে দেখার পর ভালো শিকার করেছেন।আর আমি আপনাকে দেখে চাবুকপেটা খেয়েছি।কে যে কার অশুভ, বুঝলাম না।
০০৬. প্রশ্নের জবাবের বিনিময়ে পাঁচ পাউন্ড
হোজ্জা একটা স্টল খুলে ওখানে নোটিশ টাঙিয়ে দিলেন।
‘যেকোনো বিষয়ে দুই প্রশ্নের জবাবের বিনিময়ে পাঁচ পাউন্ড।’
একজন পথচারী হন্তদন্ত হয়ে তাঁর কাছে এসে টাকাটা হাতে দিয়ে বলল, ‘দুটো প্রশ্নের জন্য পাঁচ পাউন্ড, একটু বেশি নয় কি?’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন’, হোজ্জা বললেন, ‘এর পরের প্রশ্ন?’
০০৭. বিধবা বিবাহ
হোজ্জা এক বিধবাকে বিয়ে করলেন, বিয়ের পাঁচ দিন পর নতুন বউ একটি ছেলেসন্তান জন্ম দিল। হোজ্জা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বাজারে গিয়ে স্কুলের ব্যাগ, বই থেকে শুরু করে সব কিনতে শুরু করলেন। মানুষজন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এসব কিনছেন কেন?’
জবাবে হোজ্জা বললেন, ‘আমার বাচ্চা যদি নয় মাসের সফর পাঁচ দিনে শেষ করতে পারে, তাহলে তো সে স্কুলে যাওয়ার জন্য যেকোনো সময় প্রস্তুত হতে পারে।’
০০৮. অভিযোগ নাই
বিবির পিড়াপিড়িতে নাসিরুদ্দিন একটা গরু কিনল। কিন্তু গরু ও গাধার জন্য গোয়াল ঘরে পর্যাপ্ত যায়গা না থাকায়, একটা ঘুমালে আরেকটাকে দাড়িয়ে থাকতে হতো।
প্রিয় গাধার এই দুরবস্থা দেখে হোজ্জা একদিন খোদার কাছে প্রার্থনা করছে, "হে আল্লাহ, দয়া করে গরুটাকে মেরে ফেল যাতে আমার গাধাটা একটু আরাম করে ঘুমাইতে পারে" ।
পরদিন সকালে সে গোয়াল ঘরে গিয়ে দেখে যে গাধাটা মরে পরে আছে।
প্রানপ্রিয় গাধার মৃত্যতুতে হতাশ হয়ে হোজ্জা বিরস বদনে আকাশের দিকে তাকায়ে বলল, "কোন অভিযোগ করবনা, খোদা, কিন্তু তুমি এতদিন ধরে সারা দুনিয়ার মালিক হয়েও, কোনটা গরু কোনটা গাধা এইটা চিনলানা!"
০০৯. বিবি তোমার কথাই ঠিক
নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তখন কাজী। বিচার আচার করেন। একদিন বিচারে বসেছেন। ফরিয়াদি আসামির সম্পর্কে তার অভিযোগের বয়ান দিতেছে। হোজ্জা মনযোগ দিয়া তার কথা শুনছেন। বাদীর বলা শেষ হয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললেন, 'তোমার কথাই ঠিক'।
এইবার আসামি বলে উঠল, 'হুজুর, আমার দুইটা কথা ছিল'। হোজ্জা বললেন, 'ঠিকাছে তুমি তোমার বক্তব্য বল'। আসামির বক্তব্যও মনযোগ দিয়া শোনার পর হোজ্জা বললেন, 'তোমার কথাই ঠিক'।
হোজ্জার স্ত্রী পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে তিনি বললেন, 'দুইজনই ঠিক হয় কিভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক অথবা ফরিয়াদির কথা ঠিক'।
হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে সমর্থনসূচক হাসি দিয়ে বললেন, 'বিবি তোমার কথাই ঠিক'।
০১০. কোর্তার ভিতর আমিও ছিলাম
একদিন রাতে হোজ্জার প্রতিবেশি শুনল হোজ্জার সাথে তার স্ত্রীর ঝগড়া চলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ভারী একটা কিছু পড়ার আওয়াজ হলো তারপর সব চুপচাপ।
পরদিন সকালে প্রতিবেশি হোজ্জা কে জিজ্ঞাস করে, 'কাল রাতে আপনার বাসায় ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ পেলাম'।
'আমার বিবি রাগ করে আমার কোর্তা জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়', হোজ্জা জানায়।
'একটা কোর্তা পড়ায় এত শব্দ হয়', প্রতিবেশি অবাক।
'আরে কোর্তার ভিতর তো আমিও ছিলাম', হোজ্জা বিরস মুখে জানায়।
০১১. মহিলা বিচার চায়
একদিন একজন পুরুষ ও একজন মহিলা বিচারক হোজ্জার দরবারে এল।
মহিলাটি ফরিয়াদ জানায়, 'আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, অপরিচিত এই লোকটা হঠাৎ এসে আমাকে চুমু দিয়েছে। আমি বিচার চাই'।
'আমিও মনে করি তোমার বিচার পাওয়া উচিত', হোজ্জা বলে। 'সুতরাং আমি নির্দেশ দিলাম, তুমি লোকটাকে চুমু দাও এবং তোমার প্রতিশোধ নাও'।
০১২. আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?
একদিন নাসিরউদ্দিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল।
তার শালা এসে জিজ্ঞাস করে, ' আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?'
'কেন জিজ্ঞাস করছ', নাসিরুদ্দিন বলে।
'আমি ভাবছিলাম আপনি যদি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতেন'।
'ওকে, তাইলে তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর, আমি ঘুমাচ্ছি', নাসিরউদ্দিন বলে। ' এখন আমাকে একা থাকতে দেও'
০১৩. হোজ্জার চিকিৎসা
হোজ্জা একবার স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য এক হেকিমের কাছ থেকে ওষুধ নিয়েছিলেন।
কয়েক মাস পর হোজ্জা তাঁর হেকিমের কাছে গেলেন ওই ওষুধ আনার জন্য।
“আচ্ছা, গতবার তোমাকে কী ওষুধ দিয়েছিলাম, একেবারেই মনে করতে পারছি না।”
“তাহলে ওই ওষুধ এখন থেকে আপনি নিজেই খাবেন”, হোজ্জা বিনীত গলায় বললেন।
০১৪. হোজ্জার চিঠি
হোজ্জা তাঁর বন্ধুকে চিঠি লিখছিলেন। একজন উৎসুক প্রতিবেশী চুপিচুপি হোজ্জার পেছনে এসে চিঠিতে কী লেখা হচ্ছে, তা পড়তে থাকে।
এদিকে হোজ্জার সামনে ছিল একটা আয়না। ওই আয়নাতেই হোজ্জা লোকটাকে দেখতে পেলেন। তিনি পুরো ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে চিঠি লিখতে লাগলেন: “অনেক কিছুই লেখার ছিল। কিন্তু পারলাম না। ঠিক এই মুহূর্তে একজন অভদ্র ও নির্লজ্জ লোক আমার পেছনে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়ছে—”
লোকটা রেগেমেগে অভিযোগ করল, “হোজ্জা, আপনি এসব কী লিখছেন? আমি কখন আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়েছি?” জবাবে হোজ্জা বললেন, “তুমি যদি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে চিঠি না পড়তে, তাহলে জানলে কী করে চিঠিতে আমি কী লিখেছি?”
০১৫. প্রাণ বাঁচান
হোজ্জার এক প্রতিবেশী শিকারে গিয়ে নেকড়ের কবল থেকে এক ভেড়াকে বাঁচিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে, পালবে বলে। শিকারির যত্নে ভেড়াটি দিন দিন নাদুস-নুদুস হয়ে উঠল। একদিন শিকারির লোভ হলো ভেড়ার মাংস খাওয়ার জন্য। তাই জবাই করতে উদ্যত হতেই ভেড়াটি ভয়ে বিকট শব্দে চিত্কার জুড়ে ছিল। ভেড়ার চিত্কারে হোজ্জার ঘুম গেল ভেঙে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীর বাড়িতে ছুটে গেলেন হোজ্জা।
হোজ্জাকে দেখে শিকারি প্রতিবেশী লজ্জিত গলায় বললেন, “এই ভেড়াটার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলাম একবার।”
“তাহলে ও তোমাকে গালি দিচ্ছে কেন?”
“গালি দিচ্ছে?”
“ভেড়া বলছে, “তুমি একটা নেকড়ে”।”
০১৬. গাড়ি ভাড়া
হোজ্জা একবার উটের গাড়িতে চড়েছেন মাত্র। গাড়িচালক হোজ্জার কাছে ভাড়া চাইল। শুনে হোজ্জা হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলেন। চালক বাধা দিয়ে বলল, “ভাড়া না দিয়ে আপনি যাচ্ছেন কোথায়?”
“আমি হলাম বাদশার খাস বন্ধু। আমার কাছে তুমি ভাড়া চাইছ।”
“ঠিক আছে, আপনিই যে হোজ্জা, তার প্রমাণ কী?”
হোজ্জা বললেন, “তুমি কি আমাকে গাড়িতে উঠতে দেখেছ?”
“নিশ্চয়ই দেখেছি।”
“তুমি কি আমাকে চেন?”
“না, চিনি না।”
“তাহলে কী করে জানলে যে আমি গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছি?”
০১৭. চেহারা দেখা
একদিন বাদশা হোজ্জাকে বললেন, “হোজ্জা, কাল থেকে আমি আর আয়নায় নিজের চেহারা দেখব না। আমার চেহারা যে এত বিচ্ছিরি, তা এত দিনে জানলাম।”
জবাবে হোজ্জা বললেন, “হুজুর, মাফ করবেন, আয়নায় নিজেকে দেখে বলছেন আপনি দেখতে বিচ্ছিরি। কিন্তু এই এত দিন সবাই আয়না ছাড়াই আপনাকে দেখতে বাধ্য হয়েছে।”
০১৮. ব্যবসায় হোজ্জা
হোজ্জা একটা স্টল খুলে ওখানে নোটিশ টাঙিয়ে দিলেন।
“যেকোনো বিষয়ে দুই প্রশ্নের জবাবের বিনিময়ে পাঁচ পাউন্ড।”
একজন পথচারী হন্তদন্ত হয়ে তাঁর কাছে এসে টাকাটা হাতে দিয়ে বলল, “দুটো প্রশ্নের জন্য পাঁচ পাউন্ড, একটু বেশি নয় কি?”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন”, হোজ্জা বললেন, “এর পরের প্রশ্ন?”
০১৯. হোজ্জার চিন্তা
হোজ্জার গ্রামে যমজ ভাই ছিল। একদিন শোনা গেল, ওই যমজ ভাইদের একজন মারা গেছে।
রাস্তায় ওই যমজ তাদের একজনকে দেখে হোজ্জা দৌড়ে গেলেন তার দিকে। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মধ্যে কোন জন মারা গেছে-
তুমি না, তোমার ভাই?”
০২০. হারানো ঘুমকে খোজা
মধ্যরাতে হোজ্জা রাস্তা দিয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছিলেন। গার্ড তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে রাস্তায় কী করছেন, হোজ্জা?”
“আমার ঘুম হারিয়ে গেছে, তাকে খুঁজতে এসেছি।”
০২১. বিধবা বিয়ে
হোজ্জা এক বিধবাকে বিয়ে করলেন, বিয়ের পাঁচ দিন পর নতুন বউ একটি ছেলেসন্তান জন্ম দিল। হোজ্জা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বাজারে গিয়ে স্কুলের ব্যাগ, বই থেকে শুরু করে সব কিনতে শুরু করলেন। মানুষজন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি এসব কিনছেন কেন?”
জবাবে হোজ্জা বললেন, “আমার বাচ্চা যদি নয় মাসের সফর পাঁচ দিনে শেষ করতে পারে, তাহলে তো সে স্কুলে যাওয়ার জন্য যেকোনো সময় প্রস্তুত হতে পারে।”
০২২. হোজ্জার জব্দ
একদিন হোজ্জা গাধার পিঠে লবণ বোঝাই করে বাজারের দিকে রওনা দিলেন। পথে একটা নদী পড়ল। গাধাসহ নদী পার হলেন। কিন্তু নদীর পানিতে লবণ গলে একাকার। পণ্য হারিয়ে হোজ্জা বিরক্ত। গাধা তো মহা খুশি বোঝা থেকে বেঁচে গিয়ে।
এর পরের বারও হোজ্জা ওই পথ দিয়ে গেলেন, তবে এবার তুলা বোঝাই করে। গাধা যখন নদী পার হলো তখন তুলা ভিজে ওজন বেড়ে গেল। গাধা ওজনদার মাল নিয়ে টলমল পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল।
“হাহ্!” হোজ্জা চেঁচিয়ে বললেন, “ভেবেছিলি প্রতিবার পানি দিয়ে গেলে পিঠের ওপরের মালের ওজন কমে যাবে, তাই না?
০২৩. হোজ্জার আধ্যাতিক জ্ঞান
এক সন্ধ্যায় হোজ্জা হঠাৎ দেখতে পেলেন একদল ঘোড়সওয়ার তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি দিব্যদৃষ্টিতে যেন দেখতে পেলেন তাঁকে ধরে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে কিংবা সেনাবাহিনীতে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
হোজ্জা লাফ দিয়ে দেয়াল টপকে গোরস্থানে গিয়ে একটা খালি কবর দেখে শুয়ে পড়লেন। তার আচরণে কৌতূহলী হয়ে ঘোড়সওয়াররা গোরস্থানে ঢুকে পড়ল। দেখল হোজ্জা একটা খালি কবরে শক্ত কাঠ হয়ে শুয়ে আছে।
“কবরের ভেতর কী করছেন আপনি? আমরা কি সাহায্য করতে পারি?”
“প্রশ্ন করেছেন বলেই সব প্রশ্নের সোজাসাপটা জবাব দেওয়া যায় না”, হোজ্জা বললেন।
“পুরো ব্যাপারটা আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করছে। যদি বলি আপনাদের জন্য আমার এখানে আসা আর আমার জন্যই আপনাদের এখানে আসা-তাহলে কি কিছু বুঝবেন?”
০২৪. আশুভ
রাজার মেজাজ খারাপ। রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে শিকারে যাওয়ার পথে হোজ্জা সামনে পড়ে গেলেন।
“শিকারে যাওয়ার পথে হোজ্জার সামনে পড়ে যাওয়াটা আমার ভাগ্যের জন্য খারাপ”, প্রহরীদের রাগত গলায় বললেন রাজা। “আমার দিকে ওকে তাকাতে দিয়ো না-চাবুকপেটা করে ওকে পথ থেকে সরিয়ে দাও।”
প্রহরীরা তা-ই করল।
শিকার কিন্তু ভালোই হলো।
রাজা হোজ্জাকে ডেকে পাঠালেন।
“আমি সত্যি দুঃখিত, হোজ্জা। ভেবেছিলাম তুমি অশুভ। কিন্তু তুমি তা নও।”
“আপনি ভেবেছিলেন আমি অশুভ!” হোজ্জা বললেন।
“আপনি আমাকে দেখার পর ভালো শিকার করেছেন। আর আমি আপনাকে দেখে চাবুকপেটা খেয়েছি। কে যে কার অশুভ, বুঝলাম না।”
০২৫. গাধা
গাধার পিঠে চেপে হোজ্জা প্রায়ই ইরান, গ্রিস চলে যান। প্রতিবারই গাধার পিঠে দুই বোঝা খড় চাপিয়ে নিয়ে যেতেন এবং ফিরে আসতেন পায়ে হেঁটে। প্রতিবার তাঁকে তল্লাশি করা হতো বেআইনি সামগ্রীর খোঁজে। কিছুই পাওয়া যেত না।
“কী নিয়ে যান আপনি, হোজ্জা?”
“আমি একজন চোরাচালানি।”
কয়েক বছর পর হোজ্জার অবস্থা আরও রমরমা। মিসরের উদ্দেশে রওনা দিলেন। সেখানে একদিন এক সী মান্তরক্ষী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।
“বলুন হোজ্জা, কী করে গ্রিস ও ইরানের আইন ফাঁকি দিয়ে গেলেন আর এখানেও বেশ ভালোই আছেন, কী চোরাচালান করতেন যে কখনোই ধরা যেত না?”
“গাধা।”
০২৬. ঘুমের মধ্যে হাটা
একদিন এক গার্ড দেখল হোজ্জা তাঁর শোয়ার ঘরের জানালা খুলে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। তখন ছিল গভীর রাত।
“কী করছেন আপনি হোজ্জা? এভাবে বাইরে আসতে চাইছেন কেন?”
“হিস্স্স্! ওরা বলে আমি নাকি ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটি। সেটা দেখার জন্যই চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
০২৭. ষাঁড় পেটানো
এক তুর্কোমানের ষাঁড় হোজ্জার বাগানের বেড়া ভেঙে ভেতরে ঢুকে তছনছ করে দিয়ে মালিকের কাছে ফিরে গেল। হোজ্জা পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করলেন, তারপর একটা বেত নিয়ে বেরিয়ে এসে ষাঁড়টাকে পেটাতে শুরু করলেন।
“কোন সাহসে আমার ষাঁড়কে আপনি পেটাচ্ছেন!”, তুর্কোমান চেঁচিয়ে বলল।
“কিছু মনে করবেন না আপনি”, হোজ্জা বললেন, “ও পুরো ব্যাপারটা জানে। এটা ওর আর আমার ব্যাপার!”
০২৮. হোজ্জার দৌড়
“আমি যখন মরুভূমিতে গিয়েছিলাম তখন আমার কারণে একটি বেদুইন গোষ্ঠী দৌড়ের ওপর ছিল।” একদিন হোজ্জা বললেন সবাইকে গর্বের সঙ্গে।
“কিন্তু কীভাবে?”
“একেবারে সহজ। হঠাৎ ওদের সামনে দিয়ে যেই দৌড় লাগিয়েছি, অমনি পুরো দলটা আমার পিছু পিছু দৌড় লাগাল, ব্যস।”
০২৯. দিন
হোজ্জাকে একদিন একজন রাস্তায় থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আজকে সপ্তাহের কোন দিন?”
“বলতে পারব না”, জবাবে হোজ্জা বললেন, “আমি এই এলাকায় নতুন। জানি না এখানকার মানুষেরা সপ্তাহের কোন দিনটি মেনে চলে।”
০৩০. হোজ্জার বাঘ তারানো
একদিন হোজ্জা তাঁর বাড়ির চারপাশে শুকনো খাবারের টুকরো ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন।
“কী করছেন হোজ্জা?” একজন জিজ্ঞেস করল।
“বাঘকে দূরে সরিয়ে রাখছি।”
“কিন্তু এ এলাকায় কোনো বাঘ তো নেই।”
“ঠিক বলেছ, খুবই কার্যকর পদ্ধতি, তাই না?”
০৩১. কলিজার রেসেপি
একদিন হোজ্জা বাজার থেকে কলিজা কিনে বাসায় যাচ্ছিলেন। এদিকে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে কলিজার পাই বানানোর প্রণালী দিয়েছিলেন, যাতে বাসায় গিয়ে কলিজার পাই রান্না করতে পারেন। কিন্তু হঠাৎ একটি বাজপাখি উড়ে এসে কলিজা ছিনিয়ে নিয়ে একেবারে নাগালের বাইরে উড়ে চলে গেল।
“বোকা কোথাকার!” চেঁচিয়ে হোজ্জা বললেন, “কলিজা নিয়ে গেছ ঠিক আছে, কিন্তু প্রস্তুত প্রণালী তো আমার কাছে!”
০৩২. স্ত্রীর চিকিৎসা
একদিন হোজ্জার স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসক ডাকতে বলেন। হোজ্জা তাঁর স্ত্রীর অসুস্থতা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি ছুটে গেলেন চিকিৎসক ডেকে আনার জন্য। কিন্তু রাস্তার দিকের জানালার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রী জানালা দিয়ে গলা বের করে চেঁচিয়ে বললেন, “আল্লাহকে ধন্যবাদ! ব্যথাটা চলে গেছে, চিকিৎসকের দরকার নেই।”
হোজ্জা স্ত্রীর কথা শুনলেন এবং চিকিৎসকের বাড়ির দিকে দৌড়ে গেলেন। বললেন, “ডাক্তার, আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ ছিল এবং আপনাকে ডেকে আনার জন্য বলেছিল। কিন্তু আপনাকে ডেকে আনতে বের হওয়ার সময় বলল সে সুস্থ বোধ করছে, আপনাকে ডাকার দরকার নেই। তাই আপনাকে পুরো ব্যাপারটা বলতে এলাম এই জন্য যে তাকে দেখতে আসতে হবে না।”
০৩৩. কোর্তার ভিতর আমি ছিলাম
একরাতে হোজ্জার প্রতিবেশী হোজ্জার বাসা থেকে ভারী কিছু পড়ার শব্দ পেল।
পরদিন সকালে তাদের দেখা হলে প্রতিবেশী হোজ্জাকে জিজ্ঞাস করলেন, “ভাই সাহেব, গতকাল আপনার বাসা থেকে ভারী কিছু পতনের শব্দ শুনলাম, কি হয়েছে?”
“আর বলবেননা, কালকে আমার বিবি রাগ করে আমার কুর্তা উপর থেকে নীচে ফেলে দেয়”।
“কুর্তা ফেলে দিলে এত শব্দ হয়”! প্রতিবেশী অবাক।
“কুর্তার ভিতর তো আমিও ছিলাম”, হোজ্জার ত্বরিত উত্তর।
০৩৪. হোজ্জা যখন কাজী
নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তখন কাজী। বিচার আচার করেন। একদিন বিচারে বসেছেন। ফরিয়াদি আসামির সম্পর্কে তার অভিযোগের বয়ান দিতেছে। হোজ্জা মনযোগ দিয়া তার কথা শুনছেন। বাদীর বলা শেষ হয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললেন, “তোমার কথাই ঠিক”।
এইবার আসামি বলে উঠল, “হুজুর, আমার দুইটা কথা ছিল”। হোজ্জা বললেন, “ঠিক আছে তুমি তোমার বক্তব্য বল”। আসামির বক্তব্যও মনযোগ দিয়া শোনার পর হোজ্জা বললেন, “তোমার কথাই ঠিক”।
হোজ্জার স্ত্রী পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে তিনি বললেন, “দুইজনই ঠিক হয় কিভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক অথবা ফরিয়াদির কথা ঠিক”।
হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে সমর্থনসূচক হাসি দিয়ে বললেন, “বিবি তোমার কথাই ঠিক”।
০৩৫. চিঠি পড়া
একবার এক লোক হোজ্জার কাছে একটা চিঠি নিয়ে এসে পড়ে দেওয়ার অনুরোধ করল। হোজ্জা পড়ার চেষ্টা করে বিফল হয়ে বলল, “লেখাটা দুষ্পাঠ্য তাই পড়া যাইতেছেনা।”
লোকটা খেপে গিয়ে বলল, “একটা সাধারণ চিঠি পড়তে পারো না আবার মাথায় পাগড়ি পরছ”।
হোজ্জা তাড়াতাড়ি নিজের পাগড়ি খুলে লোকটার মাথায় পরিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে এখন তোমার মাথায় পাগড়ি আছে, এইবার তুমি দেখোতো চিঠিটা পড়তে পারো কিনা?”
০৩৬. হোজ্জার বাজীতে জেতা
একবার নাসিরুদ্দিন হোজ্জা অসুস্থ। নিজের গাধাটাকে খাওয়ানোর জন্য বিবিকে বললেন। হোজ্জার বিবি একটু ত্যাদড় টাইপের। সে গাধা কে খাবার দিতে অস্বীকার করল। দুজনের মধ্যে এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া। তারপর একটা সমঝোতা হল, যে আগে কথা বলবে সে গাধাকে খাওয়াবে। হোজ্জা বাজিতে জেতার ব্যপারে ডিটারমাইন্ড ছিল।
সেইদিনই, হোজ্জার বিবি বাইরে গেছে, খালি বাসা দেখে একটা চোর ঘরে ঢুকল। হোজ্জা বাসায় ছিল, কিন্তু বাজিতে হেরে যাওয়ার ভয়ে চোরকে কিছু বলল না। চোর নির্বিঘ্নে ঘরের সব কিছু নিয়ে চলে গেল। হোজ্জার স্ত্রী বাসায় ফিরে এসে যখন দেখল সব কিছু খালি, চিৎকার দিয়ে বলল, “হায় আল্লা! কি হইছে?”
হোজ্জা খুশিতে লাফিয়ে উঠল, “আমি জিতছি বাজিতে, এখন তোমারেই গাধাকে খাওয়ান লাগবে”।
০৩৭. পেটুক
নাসিরুদ্দিন হোজ্জার বাড়িতে তাঁর কিছু বন্ধু এসেছেন। অতিথিদের তরমুজ দিয়ে আপ্যায়ন করলেন হোজ্জা। বন্ধুদের সঙ্গে খেতে বসলেন হোজ্জা নিজেও।
হোজ্জার পাশেই বসেছিলেন তাঁর এক দুষ্টু বন্ধু। তরমুজ খেয়ে খেয়ে বন্ধুটি হোজ্জার সামনে তরমুজের খোসা রাখছিলেন। খাওয়া শেষে দেখা গেল, হোজ্জার সামনে তরমুজের খোসার স্তূপ।
দুষ্টু বন্ধুটি অন্যদের বললেন, “দেখেছেন কাণ্ড? হোজ্জা কেমন পেটুক? তার সামনে তরমুজের খোসার স্তূপ হয়ে গেছে”!
হোজ্জা হেসে বললেন, “আর আমার বন্ধুটির সামনে দেখছি একটা খোসাও নেই! উনি খোসাশুদ্ধ খেয়েছেন! এখন আপনারাই বলুন, কে বেশি পেটুক!”
০৩৮. মুদ্রা গ্রহণ
হাটবারের দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে জড়বুদ্ধির মতো আচরণ করতেন হোজ্জা, ফলে নির্বোধ ভেবে মানুষ তাকে মুদ্রা দান করত। কিন্তু তার সামনে দুটি মুদ্রা তুলে ধরা হলে, সর্বদাই তিনি ছোট মুদ্রাটি গ্রহণ করতেন, যতবারই, যেভাবেই দেয়া হোক না কেন।
একদিন সদাশয় এক ব্যক্তি তাকে বললেন, "নাসিরুদ্দীন, তুমি তো বড় মুদ্রাটা নিতে পার। এতে তোমার দ্রুত বেশ কিছু টাকা-পয়সা জমে যাবে আর মানুষও আগের মতো তোমাকে নিয়ে তামাশা করতে পারবে না।"
"হুমম, আপনি যা বলছেন তা হয়তো ঠিক হতে পারে। কিন্তু আমি ভাবছি, আমি যদি সবসময় বড় মুদ্রাটা গ্রহণ করি, তাহলে মানুষ আমাকে তাদের চেয়েও নির্বোধ ভেবে যে আনন্দটা পায়, সে আনন্দটা আর পাবে না, ফলে দান হয়তো একেবারেই বন্ধ করে দিবে।" হোজ্জা জবাব দেন।
০৩৯. নাসির উদ্দীনের বেদুইনকে দৌঁড়ানো
"আমি যখন মরুভূমিতে ছিলাম," এক স্মৃতিচারণায় বললেন হোজ্জা, "তখন রক্তলোলুপ, নৃশংস একদল বেদুইনকে দৌঁড়িয়েছিলাম।"
"খালি হাতে!" বিস্ময়ে প্রশ্ন করে দর্শক।
"হ্যাঁ, কেবল ছোট একটা লাঠি ছিল আমার হাতে।"
"কিন্তু এ কীভাবে সম্ভব, হোজ্জা!"
"খুবই সহজ। আমি ঝড়ের বেগে দৌঁড়াচ্ছিলাম, আর তারাও আমার পেছন পেছন দৌঁড়াচ্ছিল।"
০৪০. আমি আপনাদের কারণে এবং আপনারা আমার কারণে !
গোধূলি বেলায় নির্জন মরুপথে একাকি হাঁটতে হাঁটতে হোজ্জা দেখলেন ধূলিঝড় উঠিয়ে একদল ঘোড়সওয়ার আসছে তার দিকে। চিন্তার ঝড় খেলতে লাগল তাঁর মনে, কল্পনায় তিনি নিজেকে দেখতে লাগলেন বন্দী, ডাকাতির শিকার কিংবা নিহত অবস্থায়। উৎকণ্ঠায় হৃদপিণ্ড তাঁর গলায় উঠে আসার উপক্রম হলো। দ্রুত এক কবরস্থানের দেয়ালে বেয়ে অন্যপাশে চলে গেলেন তিনি, তারপর খোলা এক কবরে মরার মতো পড়ে রইলেন।
তার এই অদ্ভুত ব্যবহার লক্ষ করল ঘোড়সওয়ারগণ এবং অনুসরণ করে তার কাছে এসে পড়ল। হোজ্জা তখন ভয়ে কাঁপছেন।
"এই কবরে আপনি কী করছেন? আমরা দেখলাম আপনি দৌঁড়ে চলে গেলেন। আমরা কি কোনো সাহায্য করতে পারি আপনার?" কোমল গলায় দলনেতা জানতে চান।
"আপনি একটি প্রশ্ন করেছেন, তার মানে এই নয় যে এর সরল-সোজা কোনো উত্তর আছে।" বিপদ কেটে গেছে বুঝতে পেরে হোজ্জা বলতে লাগলেন। " আসলে ব্যাপারটি নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আর যদি সত্যি সত্যি জানতে চান, তাহলে বলি, আমি এখানে এসেছি আপনাদের কারণে, আর আপনারা এখানে এসেছেন আমার কারণে।"
০৪১. অভিযোগ নাই
বিবির পিড়াপিড়িতে নাসিরুদ্দিন একটা গরু কিনল। কিন্তু গরু ও গাধার জন্য গোয়াল ঘরে পর্যাপ্ত যায়গা না থাকায়, একটা ঘুমালে আরেকটাকে দাড়িয়ে থাকতে হতো।
প্রিয় গাধার এই দুরবস্থা দেখে হোজ্জা একদিন খোদার কাছে প্রার্থনা করছে, "হে আল্লাহ, দয়া করে গরুটাকে মেরে ফেল যাতে আমার গাধাটা একটু আরাম করে ঘুমাইতে পারে" ।
পরদিন সকালে সে গোয়াল ঘরে গিয়ে দেখে যে গাধাটা মরে পরে আছে।
প্রানপ্রিয় গাধার মৃত্যতুতে হতাশ হয়ে হোজ্জা বিরস বদনে আকাশের দিকে তাকায়ে বলল, "কোন অভিযোগ করবনা, খোদা, কিন্তু তুমি এতদিন ধরে সারা দুনিয়ার মালিক হয়েও, কোনটা গরু কোনটা গাধা এইটা চিনলানা!"
০৪২. বিবি তোমার কথাই ঠিক
নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তখন কাজী। বিচার আচার করেন। একদিন বিচারে বসেছেন। ফরিয়াদি আসামির সম্পর্কে তার অভিযোগের বয়ান দিতেছে। হোজ্জা মনযোগ দিয়া তার কথা শুনছেন। বাদীর বলা শেষ হয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললেন, 'তোমার কথাই ঠিক'।
এইবার আসামি বলে উঠল, 'হুজুর, আমার দুইটা কথা ছিল'। হোজ্জা বললেন, 'ঠিকাছে তুমি তোমার বক্তব্য বল'। আসামির বক্তব্যও মনযোগ দিয়া শোনার পর হোজ্জা বললেন, 'তোমার কথাই ঠিক'।
হোজ্জার স্ত্রী পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে তিনি বললেন, 'দুইজনই ঠিক হয় কিভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক অথবা ফরিয়াদির কথা ঠিক'।
হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে সমর্থনসূচক হাসি দিয়ে বললেন, 'বিবি তোমার কথাই ঠিক'।
০৪৩. কোর্তার ভিতর আমিও ছিলাম
একদিন রাতে হোজ্জার প্রতিবেশি শুনল হোজ্জার সাথে তার স্ত্রীর ঝগড়া চলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ভারী একটা কিছু পড়ার আওয়াজ হলো তারপর সব চুপচাপ।
পরদিন সকালে প্রতিবেশি হোজ্জা কে জিজ্ঞাস করে, 'কাল রাতে আপনার বাসায় ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ পেলাম'।
'আমার বিবি রাগ করে আমার কোর্তা জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়', হোজ্জা জানায়।
'একটা কোর্তা পড়ায় এত শব্দ হয়', প্রতিবেশি অবাক।
'আরে কোর্তার ভিতর তো আমিও ছিলাম', হোজ্জা বিরস মুখে জানায়।
০৪৪. মহিলা বিচার চায়
একদিন একজন পুরুষ ও একজন মহিলা বিচারক হোজ্জার দরবারে এল।
মহিলাটি ফরিয়াদ জানায়, 'আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, অপরিচিত এই লোকটা হঠাৎ এসে আমাকে চুমু দিয়েছে। আমি বিচার চাই'।
'আমিও মনে করি তোমার বিচার পাওয়া উচিত', হোজ্জা বলে। 'সুতরাং আমি নির্দেশ দিলাম, তুমি লোকটাকে চুমু দাও এবং তোমার প্রতিশোধ নাও'।
০৪৫. ভাগ্যিস আমি ছিলামনা
এক রাতে হোজ্জা দেখে বাগানে এক লোক দাড়ায় আছে। চোর ভেবে হোজ্জা ধনুক বের করে চোরের দিকে তীর ছুড়ল। পরদিন সকালে গিয়ে দেখে তারই জামা মেলে দেয়া ছিল। যেটাকে হোজ্জা চোর মনে করে তীর ছুড়েছিল এবং সেই তীর জামাতে বিদ্ধ হয়ে আছে।
সাথে সাথে হোজ্জা মোনাজাত করে আল্লার কাছে শুকরিয়া জানায়।
হোজ্জার বিবি অবাক হয়ে বলে, ' তুমি এখন মোনাজাত করছ কেন?'
'ভাগ্যিস জামার ভিতর আমি ছিলামনা', হোজ্জার উত্তর।
০৪৬. আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?
একদিন নাসিরউদ্দিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল।
তার শালা এসে জিজ্ঞাস করে, ' আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?'
'কেন জিজ্ঞাস করছ', নাসিরুদ্দিন বলে।
'আমি ভাবছিলাম আপনি যদি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতেন'।
'ওকে, তাইলে তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর, আমি ঘুমাচ্ছি', নাসিরউদ্দিন বলে। ' এখন আমাকে একা থাকতে দেও'
০৪৭. গায়ের জামা
হোজ্জার বাড়িতে এক বন্ধু এসেছেন বেড়াতে। সন্ধ্যায় প্রতিবেশীদের সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় হোজ্জা নিজের একটি ভাল পোশাক ধার দিলেন। প্রথম বাড়িতে হোজ্জাকে বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় এও জানালেনঃ "এঁর গায়ে যে পোশাকটি দেখছেন, তা আসলে আমার।"
সেখান থেকে বেরিয়ে বন্ধু মহা ক্ষ্যাপা। "কী দরকার ছিল ওটা বলে আমাকে অপমান করার?" হোজ্জা ক্ষমা চাইলেন।
দ্বিতীয় বাড়িতে গিয়ে বললেন, "এঁর গায়ে যে পোশাকটি দেখছেন, তা আসলে এঁরই।" এবার তো বন্ধু আরো ক্ষ্যাপলেন। "পোশাকটি নিয়ে তুমি কিছু না বলাই ভাল"
তৃতীয় বাড়িতে গিয়ে তাই হোজ্জা বললেন, "ইনি আমার ঘনিষ্ট বন্ধু আর এঁর গায়ে যে পোশাকটি দেখছেন, সে সম্পর্কে কিছু না বলাই ভাল!"
০৪৮. আঙুর বিক্রেতা হোজ্জা
হোজ্জা বাজারে বসেছেন আঙুর বিক্রেতা হিসেবে। এক বন্ধুকে দেখে তার কাছেই আঙুর বেচতে চাইলেন। কিন্তু, বন্ধু বললেন যে, তার কাছে টাকা নেই। হোজ্জা উদার মানুষ।
বললেন, "আপনি বন্ধু মানুষ। টাকা পরে দিলেও চলবে। দুটো আঙুর মুখে দিয়ে দেখুন, মধুর মত মিষ্টি।"
বন্ধু অপারগতা জানিয়ে বললেন যে, তিনি রোজাদার। হোজ্জার জিজ্ঞাস্য, রোজার মাস আসতে এখনো দুই মাস বাকি। এখনই রোজা? বন্ধু বিগত বছরের ভাঙা রোজাগুলো পূরণ করার কথা জানালেন।
সাথে সাথে হজ্জা বললেন, " ভাই আমি তোমার কাছে আঙুর বেচব না, যে লোক খোদার বাকি পূরণ করতে দশ মাস লাগায়, সে আমার বাকি টাকা দিতে ক'বছর লাগাবে?"
০৪৯. আমি বাড়ি নেই
বাজারে চায়ের দোকানে বসে বেশ রসিয়ে কথা বলছেন হোজ্জা। একপর্যায়ে তিনি গর্ব করে বলেন, 'জানেন, আমি অনেক অতিথিপরায়ণ।'
কথাটা শুনে দোকানে বসা চতুর লোকটা বললো, 'তা হোজ্জা সাহেব, আজ দুপুরে তো তাহলে আপনার বাড়িতে আমরা খেতেই পারি।'
হোজ্জা রাজি হয়ে তখনই তাদের খাওয়াতে নিজের বাড়ির পথ ধরলেন। বাড়ির সামনে এসে বললেন, 'আমি আগে বাসায় গিয়ে আমার স্ত্রীকে খাবার রেডি করতে বলি। তারপর আপনারা একে একে আসুন।'
হোজ্জার স্ত্রী কথাটা শোনার পর তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, 'এসব পাগলামি ছাড়া তোমার মাথায় আর কিছু কাজ করে না? ঘরে নিজেদের খাবার নেই, তিনি আবার রাজ্যের মেহমান ডেকে এনেছেন! যাও, ওদের ফিরে যেতে বলো।'
'তা আমি পারবো না বাপু। আমি যে অতিথিপরায়ণ, তার তো একটা সুনাম আছে।' _মিনমিন করে বললেন হোজ্জা। তার স্ত্রী বললেন, 'বেশ, তুমি তাহলে উপরের ঘরে গিয়ে বসো, আমি বরং তাদের বলি যে, তুমি বাড়ি নেই।'
এদিকে অনেক সময় কেটে গেলো। অতিথিরা কোনো সাড়া না পেয়ে বাড়ি এসে ঘরের দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো। আর বলতে লাগলো, 'আমাদের ঘরে ঢুকতে দাও হোজ্জা।' হোজ্জার স্ত্রী তখন দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন এবং অতিথিদের বললেন, 'হোজ্জা বাড়ি নেই!'
তারা বললো, 'সেকি! সে তো আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বাড়িতে ঢুকেছে। আর আমরা তো বাড়ির সামনে থেকে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তাকে তো বের হতেও দেখিনি।'
তার স্ত্রী এবার চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু চুপ থাকতে পারলেন না হোজ্জা নিজে। তিনি উপর থেকে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বললেন, 'সামনের দরজা বন্ধ থাকলে কী? আমি কি পেছনের দরজা দিয়ে বের হতে পারি না?'
০৫০. দ্বিতীয় প্রশ্ন বলুন
বাজারে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে হোজ্জা তার গায়ে একটা নোটিশ টাঙিয়ে দিলেন। তাতে লেখা_ 'যে কোনো বিষয়ে দুটি প্রশ্নের জবাবের বিনিময়ে পাঁচ টাকা।'
একজন হাটুরে সবার আগে দৌড়ে হোজ্জার ঘরে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে তার হাতে পাঁচ টাকা দিয়ে বললেন, 'দুটো প্রশ্নের জন্য পাঁচ টাকা, একটু বেশি নয় কী?'
'হ্যাঁ, তা ঠিকই বলেছেন। এবার আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নটি বলুন?'
০৫১. লবণ আর তুলো
<
হোজ্জা নতুন করে লবণের ব্যবসা শুরু করলেন। তো একদিন সে গাধার পিঠে লবণের বস্তা তুলে বাজারের পথ ধরলেন। গাধাসহ পথে নদী পার হলেন। ওমা, পাড়ে ওঠে দেখেন নদীর পানিতে ধুয়ে লবণের বস্তা পুরো ফাঁকা! মহা বিরক্ত হলেন হোজ্জা। অন্যদিকে পিঠের ভার কমে যওয়ায় খুব খুশি তার গাধা।
ক'দিন পরে গাধার পিঠে বস্তাসহ হোজ্জা ফের সেই নদী পার হলেন। তবে এবার বস্তায় লবণ নেননি তিনি, নিলেন তুলা। নদী পার হয়ে গাধার পা টলমল শুরু করে দিলো। হোজ্জা গাধার কানে কানে বললেন, 'কী, ভেবেছিলে এবারও পানি দিয়ে গেলে বস্তার সব ধুয়ে ওজন কমে যাবে, না?'
০৫২. হারিয়ে গেলো ঘুম
<
এমনিতেই ভয়কাতুরে হোজ্জা। তো এক মধ্যরাতে ভয়টয় ভুলে রাস্তা দিয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। গার্ড তাকে দেখে কাছে গেলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, 'এতো রাতে রাস্তায় একাকী কী করছেন হোজ্জা?'
হোজ্জা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, 'আমার ঘুম হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজতে বের হয়েছি ভাই!'
০৫৩. তুমি না তোমার ভাই
দুই যমজ ভাই থাকে হোজ্জার গ্রামে। একদিন কোত্থেকে এসে হোজ্জা শুনলেন, যমজ ভাইদের একজন মারা গেছে। প্রতিবেশী সেই পরিবারটিকে সমবেদনা জানাতে বের হলেন তিনি। একটু এগিয়ে যেতে না যেতেই সেই যমজভাইদের এক ভাইকে দেখে হোজ্জা দৌড়ে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমাদের মধ্যে কোনজন মারা গেছে_ তুমি না তোমার ভাই?'
০৫৪. আপনার ওষুধ আপনিই খান
হোজ্জার স্মৃতিশক্তি কমে যেতে চলেছে; বিষয়টা বুঝতে পেরে তিনি গেলেন হেকিমের কাছে। হেকিম স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ওষুধ দিলেন হোজ্জাকে। কয়েক মাস ঠিকঠাক থাকার পর ফের ওষুধ আনতে গেলেন হেকিমের কাছে। হেকিম তাকে দেখে বললেন, 'গতবার তোমাকে কী ওষুধ দিয়েছিলাম, সেটা একেবারেই মনে করতে পারছি না।'
'মনে করতে না পারলে আপনার ওষুধ আপনি নিজেই খান।' এই বলে হোজ্জা বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলেন।
০৫৫. কুর্তার ভেতর আমিও ছিলাম
এক প্রতিবেশী গভীর রাতে হোজ্জার বাসা থেকে কিছু পড়ার শব্দ শুনলো। পরদিন তাদের দেখা হলে প্রতিবেশী লোকটা হোজ্জাকে বললো, 'ভাই, গত রাতে আপনার বাসা থেকে ভারী কিছু পড়ার শব্দ পেলাম। কি পড়লো বলুন তো?'
হোজ্জা বললেন, 'আর বলবেন না ভাই, আজকাল আমার স্ত্রী শুধু শুধুই রাগ করে। কাল রাতেও সে রাগ করে আমার কুর্তাটা উপর থেকে নিচে ফেলে দেয়।'
প্রতিবেশী লোকটা অবাক হয়ে বললে, 'আরে ভাই, কুর্তা ফেললে কী এতো শব্দ হয়?'
হোজ্জা এদিক-সেদিক চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখে বললেন, 'ভাই, কুর্তার ভেতর আমিও ছিলাম!'
০৫৬. সোনার মহর
নাসিরউদ্দিনের বয়স যখন খুব কম তখন একদিন তার বাবা তাকে ডেকে পাঠালেন।
বাবাঃ ওরে নাসু, এবার থেকে খুব ভোরে উঠিস।
নাসুঃ কেন বাবা?
বাবাঃ অভ্যাসটা ভালো। আমি সেদিন ভোরে উঠে বেড়াতে দিয়ে রাস্তার মধ্যে পড়ে থাকা এক থলে মোহর পেয়েছি।
নাসুঃ সে থলেতো আগের দিন রাত্রেও পড়ে থাকতে পারে, বাবা।
বাবাঃ সেটা কথা নয়। আর তাছাড়া আগের দিন রাতেও ওই পথে আমি হেটেছিলুম। তখন কোন মোহর ছিল না।
নাসুঃ তাহলে ভোরে উঠে লাভ কি বাবা? কারণ যে লোক মোহরের থলি হারিয়েছে সেতো তাহলে তোমার চেয়েও বেশি ভোরে উঠেছিল।
০৫৭. অজ্ঞ
একদিন গ্রামের কিছু লোক মিলে নাসিরউদ্দিন হোজ্জাকে নিয়ে মশকরা করার চিন্তা করল।
তারা নাসিরউদ্দিনের কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বললেন
গ্রামের লোকঃ জনাব আপনি অনেক জ্ঞানী, একদিন আমাদের গ্রামের মসজিদে এসে আমাদের কিছু তত্ত্বকথা শোনান না।
নাসিরউদ্দিন এককথায় রাজি হয়েগেল।
দিন ঠিক করে ঘড়ি ধরে মসজিদে হাজির হয়ে উপস্থিত সকলকে সেলাম জানিয়ে বললেন,
নাসিরউদ্দিনঃ ভাই সকল বলত দেখি আমি কি এখন বলতে যাচ্ছি।
গ্রামের লোকঃ আ্জ্ঞে সে তো আমরা জানি না।
নাসিরউদ্দিনঃ এটাও যদি না যান তাহলে আর আমি কি বলব। যাদের বলব তারা এ অজ্ঞ হলে চলে কি করে?
এই বলে নাসিরউদ্দিন রাগে গজ গজ করতে করতে মসজিদ ছেড়ে সোজ বাড়ির দিকে চলে এল।
০৫৮. গরুর গোস্ত
একদিন গরুর গোস্ত খাওয়ার ইচ্ছা হলো নাসিরউদ্দিন হোজ্জার যেই ভাবা সেই কাজ। বাজারে গিয়ে ১ কেজি গরুর গোস্ত কিনে বাসায় গিয়ে বউকে বললেন ভাল করে কসায়া মাখা মাখা করে রান্না করতে। বলে তিনি বাজারে গেলেন।
বাজার থেকে ফিরে এসে বিবিকে রললেন খাবার দিতে। বিবি খাবার বাড়িয়ে দিল। তরকারী দেখেই নাসিরউদ্দিনের চক্ষু চড়কগাছ।
নাসিরউদ্দিনঃ কিব্যাপার গোস্ত কই?
বিবিঃ বিড়ালে খেয়েছে?
নাসিরউদ্দিনঃ কোন বিড়াল?
ঘরে একটা বিড়াল ছিল তা দেখিয়ে বললঃ এই বিড়াল খেয়েছে!
নাসিরউদ্দিন বিড়ালকে ধরে পাল্লায় চড়িয়ে মাপলেন ওজন ঠিক এ কেজি।
নাসিরউদ্দিনঃ যদি এর ওজন এক কেজি হয় তাহলে গোস্ত কোথায়? আর এটাই যদি সেই গোস্ত হয় তাহলে বিড়াল কোথায়?
০৫৯. সোনার মহর
একদিন কয়েকটি ছোকড়া মিলে ফন্দি করেছে তারা মোল্লাসাহেবের জুতা জোড়া হাত করবে। একটা লম্বা গাছর দিকে দেখিয়ে তারা বললেঃ ওই যে গাছ দেখছেন তাতে চড়ার সাধ্যি কারুর নেই।
মোল্লা নাসিরউদ্দিনঃ আমার আছে।
বলে জুতাসহ গাছে উঠতে শুরু করলেন।
বেগতিক দেখে ছেলেরা চেচিয়ে উঠে বললঃ ও মোল্লাসাহেব, ওই গাছে আপনার জুতা জোড়া কোন কাজে লাগবে শুনি?
মোল্লা নাসিরউদ্দিন গাছের উপর থেকে জবাব দিলেনঃ গাছের মাথায় যে রাস্তা নেই তা কে বলতে পারে।
০৬০. সাবাশ
একবার শীতকালে হোজ্জা একটি হররতখানা তৈরী করে সেখানে বাঙ্গির চাষ করল। বাঙ্গি পাকলে হোজ্জা ভাল পয়সা রোজগারের আশায় কয়েকটি সেরা বাঙ্গি বেছে নিয়ে বাদশাহর কাছে বিক্রি করতে গলে। কিন্তু হায়, কে জানত যে বাদশাহ বাঙ্গিগুলো নিয়ে একটি পয়সাও হোজ্জাকে দেবেন না। তিনি শুধু একজন ভাল প্রজা বলে হোজ্জার ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং পরপর তিনবার ‘সাবাস’ বললেন।
রাজপ্রসাদ থেকে বের হয়ে এলে হোজ্জার খুব খিদে পেল। কিন্তু পকেটে একটি পয়সাও নেই, কি হবে? ভাবতে ভাবতে সে একটি হোটেলে এসে কুড়িটি মাসের চপ খেয়ে ফেলল।
খাওয়া শেষ করে সে তিনবার ‘সাবাস’ বলে হোটেল থেকে বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াল। হোটেলের মালিক তখন চিৎকার করে উঠল, ‘পয়সা কই? তুমি পয়সা দাও নি তো!’
‘কি বলছ? এক্ষুণি তোমাকে পয়সা দিলাম না!’ হোজ্জা আশ্চর্য হয়ে তাকে বলল।
মালিক আর কথা না বলে হোজ্জাকে ধরে নিয়ে বাদশাহর কাছে হাজির হল। বাদশাহ সব ঘটনা শুরে হোজ্জাকে গালি দিতে দিতে বললেন, ‘হোজ্জা, তুমি চপ খেয়ে পয়সা দাওনি কেন?’
উত্তরে হোজ্জা বলল, ‘জাহাঁপনা, আমার কোন দোষ নেই। এই মালিক খুবই লোভী। আমি মাত্র কুড়িটি মাংসের চপ খেয়েছি এবং আপনি আমার বাঙ্গিগুলো কেনার পর আমায় যে তিনবার ‘সাবাস’ দিয়েছিলেন আমি সেগুলিই দিয়েছি। সে আবার পয়সা চাইছে কি করে?
বাদশাহ একথা শুনেই চুপ করে গেলেন।
০৬১. তার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু
একদিন এক জ্ঞানি এসে নাসিরুদ্দিনকে একটা হাঁস উপহার দিলে। নাসিরুদ্দিন ভারী খুশি হয়ে সেটার মাংস রান্না করে জ্ঞানিকে খাওয়ালে।
কয়েকদিন পরে মোল্লাসাহেবের কাছে একজন লোক এসে বললে, ‘আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তাঁর বন্ধু।’
নাসিরুদ্দিন তাকেও মাংস খাওয়াল।
এর পর আরেকদিন আরেকজন এসে বলে, ‘আপনাকে যিনি হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধু।’ নাসিরুদ্দিন তাকেও খাওয়াল।
তারপর এল বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু। মোল্লাসাহেব তাকেও খাওয়াল।
এর কিছুদিন পরে আবার দরজায় টোকা পড়ল। ‘আপনি কে?’ দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলেন নাসিরুদ্দিন।
‘আজ্ঞে মোল্লাসাহেব, যিনি আপনাকে হাঁস দিয়েছিলেন, আমি তার বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু।
‘ভেতরে আসুন,’ বললে নাসিরুদ্দিন, ‘খাবার তৈরিই আছে।’
অতিথি মাংসের ঝোল দিয়ে পোলাও মেখে একগ্রাস খেয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কীসের মাংস মোল্লাসাহেব?’
‘হাঁসের বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর বন্ধুর’, বললে নাসিরুদ্দিন।
০৬২. সব কাজ একবারে সেরে আসুন
নাসিরুদ্দিন এক বাড়িতে চাকরের কাজ করছে। মনিব তাকে একদিন ডেকে বললেন, ‘তুমি অযথা সময় নষ্ট করো কেন হে বাপু? তিনটে ডিম আনতে কেউ তিনবার বাজার যায়? এবার থেকে একবারে সব কাজ সেরে আসবে।’
একদিন মনিবের অসুখ করেছে, তিনি নাসিরুদ্দিনকে ডেকে বললেন, ‘হাকিম ডাকো।’
নাসিরুদ্দিন গেল, কিন্তু ফিরল অনেক দেরিতে, আর সঙ্গে একগুষ্টি লোক নিয়ে।
মনিব বললেন, ‘হাকিম কই?’
‘তিনি আছেন, আর সঙ্গে আরও আছেন,’ বললে নাসিরুদ্দিন।
‘আরও কেন?’
‘আজ্ঞে হাকিম যদি বলেন পুলটিশ দিতে, তার জন্য লোক চাই। জল গরম করতে কয়লা লাগবে, কয়লাওয়ালা চাই। আপনার শ্বাস উঠলে পর কোরান পড়ার লোক চাই, আর আপনি মরলে পরে লাশ বইবার লোক চাই।’
০৬৩. পায়ে জখম
এক চাষা নাসিরুদ্দিনের কাছে এসে বলল, ‘বাড়িতে চিঠি দিতে হবে মোল্লাসাহেব। মেহেরবানি করে আপনি যদি লিখে দেন।’
নাসিরুদ্দিন মাথা নাড়ল। ‘সে হবে না।’
‘কেন মোল্লাসাহেব?’
‘আমার পায়ে জখম।’
‘তাতে কী হল মোল্লাসাহেব?’ চাষা অবাক হয়ে বলল, ‘পায়ের সঙ্গে চিঠির কী?’
নাসিরউদ্দিন বলল, ‘আমার হাতের লেখা কেউ পড়তে পারে না। তাই চিঠির সঙ্গে আমাকেও যেতে হবে সে চিঠি পড়ে দিতে। জখম পায়ে সেটা হবে কী করে শুনি?’
০৬৪. মাছ যেভাবে হোজ্জার জীবন বাঁচিয়েছিলো
নাসিরুদ্দিন একবার ভারতবর্ষে এসে এক সাধুর দেখা পেয়ে ভাবলে, ‘আমার মতো জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তির পক্ষে সাধুর সাক্ষাৎ পাওয়া পরম সৌভাগ্য। এঁর সঙ্গে আলাপ না করলেই নয়।’
তাঁকে জিজ্ঞেস করতে সাধু বললেন তিনি একজন যোগী। ঈশ্বরের সৃষ্ট যত প্রাণী আছে সকলের সেবাই তাঁর ধর্ম।
তখন নাসিরুদ্দিন বলল, ‘ঈশ্বরের সৃষ্টি একটি মৎস্য একবার আমাকে মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করেছিল।’
এ কথা শুনে যোগী আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, ‘আমি এত দীর্ঘকাল প্রাণীর সেবা করেও তাদের এত অন্তরঙ্গ হতে পারিনি। একটি মৎস্য আপনার প্রাণরক্ষা করেছে শুনে, এই দেখুন আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন না তো কে থাকবে?’
নাসিরুদ্দিন যোগীর সঙ্গে থেকে তার কাছ থেকে যোগের নানা কসরত শিখতে শুরু করলেন। শেষে একদিন যোগী বললেন, ‘আর ধৈর্য রাখা সম্ভব নয়। অনুগ্রহ করে যদি সেই মৎস্যের উপাখ্যানটি শোনান।’
‘একান্তই শুনবেন?’
‘হাঁ গুরু!’ বললেন যোগী, ‘শোনার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি।’
‘তবে শুনুন,’ বলল নাসিরুদ্দিন, ‘একবার খাদ্যাভাবে প্রাণ যায় যায় অবস্থায় আমার বঁড়শিতে একটি মাছ ওঠে। আমি সেটা ভেজে খাই।’
০৬৫. বিদ্যান চিঠি লেখক হোজ্জা
নাসিরুদ্দিন লেখাপড়া বেশি জানে না ঠিকই, কিন্তু তার গাঁয়ে এমন লোক আছে যাদের বিদ্যে তার চেয়েও অনেক কম। তাদেরই একজন নাসিরুদ্দিনকে দিয়ে নিজের ভাইকে একটা চিঠি লেখালো। লেখা শেষ হলে পর সে বলল, ‘মোল্লাসাহেব কী লিখলেন একবারটি পড়ে দেন, যদি কিছু বাদটাদ গিয়ে থাকে।’
নাসিরুদ্দিন ‘প্রিয় ভাই আমার’ পর্যন্ত পড়ে ঠেকে গিয়ে বলল, ‘পরের কথাটা ‘বাক্স’ না ‘গরম’ না ‘ছাগল’ সেটা বোঝা যাচ্ছে না।’
‘সে কী মোল্লাসাহেব, আপনার লেখা চিঠি আপনিই পড়তে পারেন না তো অপরে পড়বে কী করে?’
‘সেটা আমি কী জানি?’ বলল নাসিরুদ্দিন। ‘আমায় লিখতে বললে আমি লিখলাম। পড়াটাও কি আমার কাজ নাকি?’
লোকটা কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নেড়ে বলল, ‘তা ঠিকই বললেন বটে। আর এ চিঠি তো আপনাকে লেখা নয়, কাজেই আপনি পড়তে না পারলে আর ক্ষতি কী?’
‘হক কথা’, বললে নাসিরুদ্দিন।
০৬৬. নাসিরুদ্দিন ও ভিখিরি
নাসিরুদ্দিন বাড়ির ছাদে কাজ করছে, এমন সময় এক ভিখিরি রাস্তা থেকে হাঁক দিল, ‘মোল্লাসাহেব, একবারটি নীচে আসবেন?’
নাসিরুদ্দিন ছাদ থেকে রাস্তায় নেমে এল। ভিখিরি বলল, ‘দুটি ভিক্ষে দেবেন মোল্লাসাহেব?’
‘তুমি এই কথাটা বলার জন্য আমায় ছাদ থেকে নামালে?’
ভিখিরি কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘মাফ করবেন মোল্লাসাহেব,গলা ছেড়ে ভিক্ষে চাইতে শরম লাগে।’
‘হুঁ... তা তুমি ছাদে এসো আমার সঙ্গে।’
ভিখিরি তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে ছাদে ওঠার পর নাসিরুদ্দিন বলল, ‘তুমি এসো হে; ভিক্ষেটিক্ষে হবে না।’
০৬.৭ যেভাবে গাঁয়ের লোকদের বোকা বানালো নাসিরুদ্দিন হোজ্জা!
গাঁয়ের লোকে একদিন ঠিক করল নাসিরুদ্দিনকে নিয়ে একটু মশকরা করবে। তারা তার কাছে গিয়ে সেলাম ঠুকে বলল, ‘মোল্লাসাহেব, আপনার এত জ্ঞান, একদিন মসজিদে এসে আমাদের তত্ত্বকথা শোনান না!’ নাসিরুদ্দিন এককথায় রাজি।
দিন ঠিক করে ঘড়ি ধরে মসজিদে হাজির হয়ে নাসিরুদ্দিন উপস্থিত সবাইকে সেলাম জানিয়ে বলল, ‘ভাই সকল, বলো তো দেখি আমি এখন তোমাদের কী বিষয় বলতে যাচ্ছি?’
সবাই বলে উঠল, ‘আজ্ঞে সে তো আমরা জানি না।’
মোল্লা বলল, ‘এটাও যদি না জানো তা হলে আর আমি কী বলব! যাদের বলব তারা এত অজ্ঞ হলে চলে কী করে?’
এই বলে নাসিরুদ্দিন রাগে গজগজ করতে করতে মসজিদ ছেড়ে সোজা বাড়ি চলে এল।
গাঁয়ের লোক নাছোড়বান্দা। তারা আবার তার বাড়িতে গিয়ে হাজির।
‘আজ্ঞে, আসছে শুক্রবার আপনাকে আর একটিবার আসতেই হবে মসজিদে।’
নাসিরুদ্দিন গেল, আর আবার সেই প্রথম দিনের প্রশ্ন দিয়েই শুরু করল। এবার সব লোকে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, জানি।’
‘সবাই জেনে ফেলেছ? তা হলে তো আর আমার কিছু বলার নেই’,এই বলে নাসিরুদ্দিন আবার বাড়ি ফিরে গেল। গাঁয়ের লোক তবুও ছাড়ে না। পরের শুক্রবার নাসিরুদ্দিন আবার মসজিদে হাজির হয়ে তার সেই বাঁধা প্রশ্ন করল। এবার আর মোল্লাকে রেহাই দেবে না গাঁয়ের লোক, তাই অর্ধেক বলল ‘জানি’, অর্ধেক বলল ‘জানি না।’‘বেশ, তা হলে যারা জানো তারা বলো, আর যারা জানো না তারা শোনো’এই বলে নাসিরুদ্দিন আবার ঘরমুখো হল।
০৬৮. তর্কবাগীশ যেভাবে মূর্খ হলেন
তর্কবাগীশ মশাই নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে তর্ক করবেন বলে দিনক্ষণ ঠিক করে তার বাড়িতে এসে দেখেন মোল্লাসাহেব বেরিয়ে গেছেন। মহা বিরক্ত হয়ে তিনি মোল্লার সদর দরজায় খড়ি দিয়ে লিখে গেলেন ‘মূর্খ’।
নাসিরুদ্দিন বাড়ি ফিরে এসে কাণ্ড দেখে এক হাত জিভ কেটে এক দৌড়ে তর্কবাগীশ মশাইয়ের বাড়ি গিয়ে তাঁকে বলল, ‘ঘাট হয়েছে পণ্ডিতমশাই, আমি বেমালুম ভুলে গেসেলুম আপনি আসবেন।
শেষটায় বাড়ি ফিরে দরজায় আপনার নামটা লিখে গেছেন দেখে মনে পড়ল।’
০৬৯. দুঃখীকে সুখের সন্ধান দেবার উপায়
নাসিরুদ্দিন একজন লোককে মুখ ব্যাজার করে রাস্তার ধারে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলে, তার কী হয়েছে। লোকটা বলল, ‘আমার জীবন বিষময় হয়ে গেছে মোল্লাসাহেব। হাতে কিছু পয়সা ছিল, তাই নিয়ে দেশ ঘুরতে বেরিয়েছি, যদি কোনও সুখের সন্ধান পাই।’
লোকটির পাশে তার বোঁচকায় কতগুলো জিনিসপত্র রাখা ছিল। তার কথা শেষ হওয়ামাত্র নাসিরুদ্দিন সেই বোঁচকাটা নিয়ে বেদম বেগে দিল চম্পট। লোকটাও হাঁ হাঁ করে তার পিছু নিয়েছে, কিন্তু নাসিরুদ্দিনকে ধরে কার সাধ্য। দেখতে দেখতে সে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে হাওয়া। এইভাবে লোকটিকে মিনিটখানেক ধোঁকা দিয়ে সে আবার সদর রাস্তায় ফিরে বোঁচকাটাকে রাস্তার মাঝখানে রেখে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। এদিকে সেই লোকটিও কিছুক্ষণ পরে এসে হাজির। তাকে এখন আগের চেয়েও দশগুণ বেশি ব্যাজার দেখাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় তার বোঁচকাটা পড়ে আছে দেখেই সে মহাফুর্তিতে একটা চিৎকার দিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
গাছের আড়াল থেকে নাসিরুদ্দিন বলল, ‘দুঃখীকে সুখের সন্ধান দেবার এও একটা উপায়।’
০৭০. ভোরে উঠলে মোহর পাবার সম্ভাবনা বাড়ে
নাসিরুদ্দিনের যখন বয়স খুব কম তখন একদিন তার বাপ তাকে বললেন, ‘ওরে নসু, এবার থেকে খুব ভোরে উঠিস।’
‘কেন বাবা?’
‘অভ্যেসটা ভাল,’ বললেন নসুর বাপ। ‘আমি সেদিন ভোরে উঠে বেড়াতে গিয়ে রাস্তার মধ্যিখানে পড়ে থাকা এক থলে মোহর পেয়েছি।’
‘সে থলে তো আগের দিন রাত্রেও পড়ে থাকতে পারে, বাবা।’
‘সেটা কথা নয়। আর তা ছাড়া আগের দিন রাত্রেও ওই পথ দিয়ে হাঁটছিলুম আমি; তখন কোনো মোহরের থলে ছিল না।’
‘তা হলে ভোরে উঠে লাভ কী বাবা?’ বললে নাসিরুদ্দিন। ‘যে লোক মোহরের থলি হারিয়েছিল সে নিশ্চয় তোমার চেয়েও বেশি ভোরে উঠেছিল।’
০৭.১ বিড়ালটি কোথায়?
নাসিরুদ্দিন বাজার থেকে মাংস কিনে এনে তার গিন্নিকে দিয়ে বললে, ‘আজ কাবাব খাব; বেশ ভালো করে রাঁধো দেখি।’
গিন্নি রান্নাটান্না করে লোভে পড়ে নিজেই সব মাংস খেয়ে ফেলল। কর্তাকে তো আর সে কথা বলা যায় না, বললে, ‘বিড়াল খেয়ে ফেলেছে।’
‘এক সের মাংস সবটা খেয়ে ফেলল?’
‘সবটা।’
বিড়ালটা কাছেই ছিল, নাসিরুদ্দিন সেটাকে দাঁড়িপাল্লায় চড়িয়ে দেখল ওজন ঠিক এক সের।
‘এটাই যদি সেই বিড়াল হয়’, বললে নাসিরুদ্দিন, ‘তা হলে মাংস কোথায়?আর এটাই যদি সেই মাংস হয়, তা হলে বিড়াল কোথায়?
০৭২. পাঁঠার গোস্ত খেয়ে জামা হারাবেন যেভাবে
নাসিরুদ্দিনের পোষা পাঁঠাটার উপর পড়শিদের ভারী লোভ, কিন্তু নানান ফিকির করেও তারা সেটাকে হাত করতে পারে না। শেষটায় একদিন তারা নাসিরুদ্দিনকে বললে, ‘ও মোল্লাসাহেব, বড় দুঃসংবাদ। কাল নাকি প্রলয় হবে। এই দুনিয়ার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে।’
‘তা হলে পাঁঠাটাকেও ধ্বংস করা হোক’, বললে নাসিরুদ্দিন।
সন্ধেবেলা পড়শিরা দলেবলে এসে দিব্যি ফুর্তিতে পাঁঠার ঝোল খেয়ে গায়ের জামা খুলে নাসিরুদ্দিনের বৈঠকখানায় নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে তারা দেখে তাদের জামা উধাও।
‘প্রলয়ই যদি হবে,’ বললে নাসিরুদ্দিন, ‘তা হলে জামাগুলো আর কোন কাজে লাগবে ভাই? তাই আমি সেগুলোকে আগুনে ধ্বংস করে ফেলেছি।
০৭৩. হারানো চাবি খোঁজার তরিকা!
নাসিরুদ্দিন তার বাড়ির বাইরে বাগানে কী যেন খুঁজছে। তাই দেখে এক পড়শি জিজ্ঞেস করলে, ‘ও মোল্লাসাহেব, কী হারালে গো?’
‘আমার চাবিটা’, বললে নাসিরুদ্দিন।
তাই শুনে লোকটিও বাগানে এসে চাবি খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ খোঁজার পর সে জিজ্ঞেস করলে, ‘ঠিক কোনখানটায় ফেলেছিলে চাবিটা, মনে পড়ছে?’
‘আমার ঘরে।’
‘সে কী! তা হলে এখানে খুঁজছ কেন?’
‘ঘরটা অন্ধকার’, বললে নাসিরুদ্দিন। ‘যেখানে খোঁজার সুবিধে সেইখানেই তো খুঁজব!
০৭৪. সে বুঝি খিড়কি দিয়ে বেরোতে পারে না?
নাসিরুদ্দিনের বন্ধুরা একদিন তাকে বললে, ‘চলো, আজ রাত্রে আমরা তোমার বাড়িতে খাব।’
‘বেশ, এসো আমার সঙ্গে’, বললে নাসিরুদ্দিন।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সে বললে, ‘তোমরা একটু সবুর করো, আমি আগে গিন্নিকে বলে আসি ব্যবস্থা করতে।’
গিন্নি তো ব্যাপার শুনে এই মারে তো সেই মারে। বললেন, ‘চালাকি পেয়েছ? এত লোকের রান্না কি চাট্টিখানি কথা? যাও, বলে এসো ওসব হবে-টবে না।’
নাসিরুদ্দিন মাথায় হাত দিয়ে বললে, ‘দোহাই গিন্নি, ও আমি বলতে পারব না। ওতে আমার ইজ্জত থাকবে না।’
‘তবে তুমি ওপরে গিয়ে ঘরে বসে থাকো। ওরা এলে যা বলার আমি বলব।’
এদিকে নাসিরুদ্দিনের বন্ধুরা প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে শেষটায় তার বাড়ির সামনে এসে হাঁক দিল, ‘ওহে নাসিরুদ্দিন, আমরা এসেছি, দরজা খোলো।’
দরজা ফাঁক হল, আর ভিতর থেকে শোনা গেল গিন্নির গলা।
‘ও ও বেরিয়ে গেছে।’
বন্ধুরা অবাক! ‘কিন্তু আমরা তো ওকে ভিতরে ঢুকতে দেখলাম। আর সেই থেকে তো আমরা দরজার দিকেই চেয়ে আছি। ওকে তো বেরোতে দেখিনি।’
গিন্নি চুপ। বন্ধুরা উত্তরের অপেক্ষা করছে। নাসিরুদ্দিন দোতলার ঘর থেকে সব শুনে আর থাকতে না পেরে বললে, ‘তোমরা তো সদর দরজায় চোখ রেখেছ; সে বুঝি খিড়কি দিয়ে বেরোতে পারে না?’
Developed by
No comments:
Post a Comment