14 February, 2016

পবিত্র আশুরা

আরবি নববর্ষের মাস মহররম। তা আরবি শব্দ। যার অর্থ সম্মানিত, বিশেষভাবে গুরুত্বপ্রাপ্ত ইত্যাদি। এ মাসের গুরুত্ব সত্যিই অপরিসীম এর সম্মান অত্যন্ত বেশি। মহররম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আরবি ‘আশারা’ অর্থ দশ। সেই সুবাদে ওই তারিখ আশুরা বলে উল্লেখিত হয়ে আসছে।১০ই মহররম/আশুরা এর তাৎপর্য:০১. আল্লাহপাক এ তারিখে আসমান, জমিন, লওহে কলম সৃষ্টি করেছেন এবং এই ১০ মহররম মহাপ্রলয় বা কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে।০২. আল্লাহতায়ালা আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)-কে ১০ মহররম দুনিয়ায় প্রেরণ করেন।০৩. মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ঈমানের মহা কঠিন পরীক্ষা দিতে নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন ১০ মহররম।০৪. ১০ মহররম খোদাদ্রোহী ফেরাউন বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে নীল দরিয়ার অতল তলে তুবে মরে আর হযরত মুসা (আঃ) বনি ইসরাইলদের নিয়ে পানির ওপর দিয়ে পার হয়ে যান।০৫. হযরত ইউনুছ (আঃ) ৪০ দিন মাছের পেটে অবস্থানের পর ১০ মহররম নাজাত পেয়েছিলেন।০৬. হযরত নূহ (আঃ) ৪০ দিনের মহাপ্লাবনের পর ১০ মহররম নৌকা থেকে বেলাভূমিতে অবতরণ করেন।০৭. হযরত ঈসা (আঃ) ইহুদিদের অত্যাচার, নির্যাতন শূলদণ্ড থেকে মুক্তি লাভের জন্য সশরীরে চতুর্থ আসমানে উপস্থিত হন ১০ মহররম।০৮. হযরত ইয়াকুব (আঃ) তাঁর হারানো ছেলে হজরত ইউসুফ (আঃ)- কে ফিরে পান এবং দৃষ্টিশক্তি আবার ফিরে পান ১০ মহররম।০৯. ধৈর্য, সহনশীলতার মূর্ত প্রতীক হযরত আয়ুব (আঃ) ১৮ বছর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত থেকে আল্লাহপাকের ইচ্ছায় ১০ মহররম আকস্মিকভাবে আরোগ্য লাভ করেন।১০. কাবাঘরের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং ঐতিহাসিক কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা সংগঠিত হয়, যা বিশ্বের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।তবে উপরোক্ত বিষয়গুলো লোকমুখে প্রচলিত থাকলেও কিছু কিছু বিষয় নিয়ে মতপার্থক্যও রয়েছে। যেমন – এদিন হযরত ইউসুফ (আঃ) জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইয়াকুব (আঃ) চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। হযরত ইউনুস (আঃ) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হযরত ইদরীস (আঃ) কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে বলে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই।–(আল আসারুল মারফূআ, আবদুল হাই লাখনুবী ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ ২৫৩-২৫৭।)মহান ত্যাগ ও ঘটনাবহুল আশুরা/মহররমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য।হযরত ইমাম হুসাইন (রা:) এর নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে এক মহাবিপ্লব ঘটেছিল। এই মহাবিপ্লব খোদাদ্রোহী ও মুনাফিক চরিত্রের অধিকারী উমাইয়া শাসকদের স্বরূপ উন্মোচন করেছিল। ইসলামের নামে ধর্মান্ধতা ও সন্ত্রাসবাদ চালু করেছিল ইয়াজিদি শাসক গোষ্ঠী। উমাইয়াদের রাজতান্ত্রিক ইসলামে বসেছিল দরবারি আলেমদের মেলা। লাখ লাখ জাল হাদিস প্রচার করে ইসলাম সম্পর্কে ধুম্রজাল ও বিভ্রান্তি জোরদার করা হয়েছিল সে সময়। ইসলামের প্রকৃত নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা ও ভন্ড প্রকৃতির নেতাদের মাহাত্ম্য প্রচার করা ছিল তাদের স্বভাব। উমাইয়া রাজশক্তির পক্ষ থেকে ইমাম হুসাইন (রা:) ও তাঁর সঙ্গীদেরকে ‘ইসলামী হুকুমাতের’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বলে প্রচার করা হয়েছিল।ঐতিহাসিক বর্ণনায় দেখা গেছে, হযরত ইমাম হুসাইন (রা:)-কে হত্যার জন্য উদ্যত সেনাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল নামাজি। তারা বলছিল: তাড়াতাড়ি হুসাইনের মাথা কাট, নামাজ বা জামায়াতে নামাজ আদায়ের সময় পার হয়ে যাচ্ছে! এরা একবারও হয়তো চিন্তা করেনি যে, রাসূল (সা:) এর আহলে বাইতের একজন মহান সদস্যকে তারা হত্যা করতে এসেছে! আর আহলে বাইত (রা:)এর ওপর দরুদ পেশ করা ছাড়া নামাজ আদায় হয় না।৬১ হিজরির চতুর্থ মহররম কুফায় নিযুক্ত ইয়াজিদের গভর্নর নরপিচাশ ইবনে জিয়াদ ‘শুরাইহ কাজি’ নামক দরবারি আলেমের কাছ থেকে নেয়া ফতোয়ার ভিত্তিতে হযরত ইমাম হুসাইন (রা:)-কে হত্যার জন্য জনগণকে উস্কানি দিয়েছেন। কুফার মসজিদে ওই ফতোয়া শুনিয়ে তিনি একদল মানুষকে ইমামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন। ইবনে জিয়াদের নির্দেশে তৈরি করা ওই ফতোয়ায় বলা হয়েছিল হযরত ইমাম হুসাইন (রা:) তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের খলিফা ইয়াজিদের আনুগত্য করেননি তাই তাকে দমন করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব।কুফার ১৩ হাজার বিভ্রান্ত মুসলমান ইমাম হুসাইন (রা:)এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ওমর সাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এদের মধ্যে শিমার বিন জিল জুশান ছিল ওই ১৩ হাজার সেনার চার জন গ্রুপ-লিডারের অন্যতম।কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পর ইমাম হুসাইন (রা:) যেদিন কারবালায় পৌছেন সে দিনটি ছিল দোসরা মহররম। তিনি সেখানে পৌছেই জানতে পারেন ওই এলাকার নাম কারবালা। তখনই তিনি জানান যে, সেখানে তাঁর ও সঙ্গীদের শাহাদত ঘটবে এবং তাঁদের নারী ও শিশুদের বন্দী করবে ইয়াজিদ বাহিনী। এ দিনেই তিনি কাইস বিন মাসহারকে দূত হিসেবে কুফায় পাঠান। ইমাম তার কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলেন কুফায় তাঁর সমর্থক নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ইয়াজিদের সেনারা কাইসকে পথে গ্রেফতার করে। কাইস ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাকে শহীদ করা হয়।ইবনে জিয়াদ ২ রা মহররম ইমামের কাছে একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে সে জানায়, তাঁকে ও তাঁর সঙ্গীদেরকে ইয়াজিদের প্রতি বায়আত বা আনুগত্যের অঙ্গীকার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এর অন্যথা হলে তাঁদেরকে হত্যা করতে বলেছেন ইয়াজিদ। ইমাম এ চিঠির জবাব না দিয়ে বললেন, ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে।ইমাম হুসাইন (রা:) ৩ রা মহররম কারাবালায় তাবু স্থাপন করেন। আর ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ তার সেনাদের নিয়ে কারবালায় পৌঁছে। আগে নানা জায়গায় ইমামের কাফেলার তাবুগুলো কিছুটা উঁচু বা টিলার মত স্থানে বসানো হয়েছিল। কিন্তু এবার ইমাম (রা:) সমতল বা কিছুটা গর্তময় স্থানে তাবু বসানোর নির্দেশ দেন। সম্ভবত এর কারণ ছিল শিশু ও নারীরা যাতে যুদ্ধের দৃশ্য দেখে ভয় না পান।হোর ইবনে ইয়াজিদ (রা:) নামের একজন সেনা কর্মকর্তা সর্ব প্রথম কারবালায় ইমাম শিবিরের বিপরীতে তাবু গাঁড়েন। তিনিই ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে প্রথম খবর দেন যে ইমাম হুসাইন (রা:) কারবালায় এসেছেন।ইমাম জানতেন কারবালায় কি ঘটতে যাচ্ছে। তিনি ৩ রা মহররমই কারবালার স্থানীয় নেইনাভাবাসীদের কাছ থেকে জমি কিনে নেন। তিনি তাদের এ শর্ত দেন যে ভবিষ্যতে যারা এখানে নবী (সা:) এর পরিবারের সদস্যদের কবর জিয়ারত করতে আসবেন তাদেরকে যেনো আপ্যায়ন করা হয় ও পথ দেখিয়ে দেয়া হয়।ইরানের শাসনভার দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ইবনে জিয়াদ ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ওমর বিন সাদকে পাঠান। সাদ ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু একদল সঙ্গীর নিষেধ সত্ত্বেও সে শেষ পর্যন্ত ইমামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অগ্রসর হয়। ৩ রা মহররম কুফার চার হাজার সেনা নিয়ে ওমর বিন সাদ কারবালায় প্রবেশ করে। সে প্রথমে ইমামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একজন দূতের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে জানতে পারে যে, ইমাম বলেছেন, কুফার জনগণই তাঁকে দাওয়াত করেছে ও প্রতিনিধিও পাঠিয়েছিল তাঁর কাছে যাতে তিনি এই শহরে আসেন। তারা (কুফাবাসী)যদি তাঁর আগমনে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে তাহলে তিনি ফিরে যাবেন বলে জানান। ওমর বিন সাদ এই তথ্য ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠালে ইবনে জিয়াদ ধারণা করে যে ইমাম হোসাইন (রা:) যুদ্ধের ফাঁদে পড়েও মুক্তির আশা করছেন, কিন্তু সে সুযোগ আর নেই। তিনি সাদকে এক চিঠিতে জানান, তোমার চিঠি পেয়ে সব কিছু জেনেছি। হোসাইন (রা:) ও তাঁর সঙ্গীদের বল ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে। যদি তারা তা করে তাহলে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব। সাদ বুঝতে পারে যে জিয়াদের উদ্দেশ্য ভাল নয়। তাই সে জিয়াদের চিঠি ইমাম (রা:) এর কাছে পাঠাননি। কারণ, সে জানত ইমাম হুসাইন (রা:) কখনও ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য করবেন না।এদিকে জিয়াদ বিপুল সংখ্যক সেনা সমাবেশের চিন্তা করতে থাকে। কুফাসহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোক পাঠিয়ে সেনা সংগ্রহের কাজ চলতে থাকে এবং ইমামের প্রতি সহযোগিতার কঠোর পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে ভয়-ভীতি দেখানো হয়। এ সময় আমের বিন আবি সালামাহ নামক ইমাম হুসানই (রা:) এর এক সমর্থক ইবনে জিয়াদের এক সেনা-নিবাস বা সেনা-উদ্যানে জিয়াদকে হত্যার চেষ্টা চালান। কিন্তু সফল হননি। ইনি পরে কারবালায় ইমাম হুসাইন (রা:) এর পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন।৫ ই মহররম ইয়াজিদের গভর্নর ইবনে জিয়াদের নির্দেশে হাছিইন বিন নুমাইর চার হাজার অশ্বারোহী সেনা নিয়ে কারবালায় আসে। এ দিনে জিয়াদ শাবাশ বিন রবি নামের এক ব্যক্তিকে এক হাজার সেনাসহ কারবালায় পাঠায়। এ ছাড়াও সে এক ব্যক্তিকে ৫০০ সেনাসহ কারবালা ময়দানে এ দায়িত্বে নিয়োজিত করে এবং হুকুম দেন যদি কেউ ইমাম হুসাইন (রা:) এর পক্ষে যুদ্ধ করতে কারবালায় প্রবেশ করে তাকে সে হত্যা করবে। কিন্তু এত প্রহরা সত্ত্বেও আমের বিন আবি সালামাহ ৫ ই মহররম ইমাম-শিবিরে যোগ দেন এবং আশুরার দিনে শাহাদত বরণ করেন।মরুভূমির লাল সূযটা দিগন্তের ওপারে মুখ লুকানো। সে হয়তো লজ্জায় দুঃখে পালিয়ে বাঁচল। ইমাম শিবিরের করুণ আহাজারী, হয়তো তারও সহ্য হয়নি। পিপাসায় কাতর প্রাণ উষ্ঠাগত। কচি শিশুদের দুঃখে, পাষাণ হৃদয়ও বিচলিত হয়। কিন্তু নরাধম এজিদ বাহিনীর হৃদয়ে কোন দয়ামায়া নেই। তিনদিন ধরে নবীবংশের প্রিয়জনরা পানিও পাচ্ছে না। দুরাত্মা এজিদ পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। একি নিষ্ঠুরতা! ইমাম বাহিনীর সবাই পরম ধৈর্যের সাথে, তাদের জীবনের শেষ রাতটি ইবাদত বন্দেগীতে কাটালেন। অন্তপুরে নারী শিশুদের করুণ কান্নার ধ্বনি। কারবালার সেই রাত্রীকে আরো ভারী করে তুলেছিল। গভীর নিশীথের মরু হাওয়া যেন অশুভ সংকেত নিয়ে ছুটে গেল কোন অজানার পথে। এরপর আযানের ধ্বনী যেন হৃদয়কে স্পর্শ করলো। এই সুমধুর ধ্বনী করুণ আর্তনাদ হয়ে যেন বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিল তোমরা কে কোথায় আছো দেখে যাও আজ কি ঘটতে চলেছে। বর্ণিত আছে হযরত আলী আকবরের কন্ঠস্বর ছিল মহানবী (সঃ) এর অনুরুপ। তার কন্ঠে আজানের ধ্বনী এমনকি এজিদ বাহিনীর মাঝেও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পিশাচদের মাঝে তার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। আশুরার দিন ভোরে ফজরের নামাজের ইমামতি করলেন ইমাম হোসেন (রা:)। এই নামাজই ছিল কারবালার শহীদদের শেষ নামাজ। আল্লাহর সৈনিকদের এই নামাজ শেষ হবার আগেই এজিদ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। দুরাচার সেনাপতি ওমর সাদ প্রথমে একটি তীর নিক্ষেপ করে যুদ্ধ শুরু করে। তীর বৃষ্টির মধ্যেই ইমাম ও তার সাথীরা নামাজ শেষ করলেন। ইমার তার সাথীদেরকে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিয়ে দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন। ভাই আব্বাসকে দিলেন পতাকা রক্ষার দায়িত্ব। এ সত্যের পতাকাবাহী হযরত আব্বাস ” আব্বাস-ই- আলমদার ” নামে বিখ্যাত।পথভ্রষ্ট দুরাত্মাদেরকে আবারও বুঝাবার চেষ্টা করলেন ইমাম হোসেইন (রা:)। ভুল বুঝার শেষ সুযোগ দিয়ে এজিদ বাহিনীর উদ্দেশ্যে বললেন, হে জনসাধারণ , ক্ষান্ত হও। তোমরা কি জান আমি কে? আমাকে হত্যা করা কি উচিত হবে? আমি কি তোমাদের নবী কন্যা ফাতেমার সন্তান নই? আলী মুর্তাজা কি আমার পিতা নন? তোমরা কি জানোনা মহানবী (সাঃ) বলেছেন আমি ও আমার ভাই বেহেশতে যুবকদের সরদার? আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে তোমরা জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারী, আবু সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনে সা’দ সাঈদী, যায়েদ ইবনে আরকাম, আনাস ইবনে মালিকের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নাও। এরপরও কি তোমরা আমাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকবে না? কিন্তু পাষাণ হৃদয় দুরাচারদের মাঝে কোন ভাবান্তর হলো না। ওমর সাদ, শিমারসহ অন্যান্য পাপিষ্ঠরা যুদ্ধ করার জন্যে সৈন্যদের লেলিয়ে দিল। এই অবস্থায় এজিদ বাহিনীর এক সেনাপতি হুরের মাঝে ভাবান্তর হলো। ইমামের ভাষণ শুনে সে নিজের ভুল বুঝতে পারলো। ইমাম হোসেইনের কাছে এসে সে বলল, হযরত আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি অনেক পাপ করেছি। আমি আপনাকে বাধা দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনাদের এই অবস্থার জন্যে আমি দায়ী। আমি অনুতপ্ত হয়ে আপনার কাছে ফিরে এসেছি, আমার তওবা কি কবুল হবে। ইমাম মৃদু হেসে তাকে আশ্বাস দিলেন , হুর দেরী না করে তলোয়ার চালাতে চালাতে এজিদ বাহিনীর দিকে ছুটে গেল। হোরের সাথে সাথে তার ছেলে, ভাই, এবং ক্রীতদাসও এজিদ বাহিনী ত্যাগ করে ইমাম বাহিনীতে এসে যোগ দিল। এরা সকলে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেল। মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই তীব্র আকার ধারন করলো। এ ছিল অসম যুদ্ধ। মাত্র ৭০/৮০ জন মুসলমানের সাথে হাজার হাজার মোনাফেকের যুদ্ধ। এ ছিল এক অসহায় মুষ্টিমেয় ঈমানদারের প্রতিরোধ যুদ্ধ। একদল ধর্মপ্রাণ আল্লাহর বান্দাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে হিংস্র নেকড়ের দল। ছোট্ট একদল মোমিন কারবালার এই মরু প্রান্তরে যে অসীম সাহসিকতা, বীরত্ব ও ধৈর্য্যরে পরিচয় দিলেন মানব ইতিহাসে তেমনটি আর কখনো দেখা যায় নি এবং ভবিষ্যতেও হয়ত দেখা যাবে না।তিন দিন ধরে পিপাসায় কাতর ইমাম বাহিনী ছিলেন ঈমানের তেজে বলীয়ান। পার্থিব শক্তি সামর্থ তখন ছিল গৌণ ব্যাপার। ধৈর্য আর ঈমানের পরীক্ষাই ছিল মুখ্য। মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতকে রক্ষা করার জন্যে ইমাম হোসেনের সাথীরা সিংহ বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রু সৈন্যের উপর। প্রচন্ড আক্রমনে অসংখ্য এজিদ সৈন্য খতম করে নিজেরা শহীদ হতে লাগলেন। এভাবে একে একে ইমাম বাহিনীর বিখ্যাত বীরেরা শহীদ হয়ে গেলেন। তারা সকলেই ইমাম হোসেন ও তার আহলে বাইতের চারপাশে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে যুদ্ধ করেছেন। ইমামের দিকে ছুটে আসা তীর ও বর্শার আঘাত তারা বুক পেতে নিয়েছেন। ইমামের সামনে তারা একে একে শহীদ হয়ে গেছেন। বাকি রইলেন শুধু আহলে বাইতের সদস্যগণ। মহাকালের এই মহা কোরবানির জন্যে এবার ইমাম হোসেন (রা:) ও তার আহলে বাইত প্রস্তুত হলেন। কারবালার আকাশে প্রচন্ড তেজে জ্বলছে সূর্য। সুহাওয়ার করুণ দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আল্লাহর প্রিয়তমদের প্রতি শয়তানদের আক্রমণে বিস্ময় বিমুঢ় হয়ে আসছে বিশ্ব প্রকৃতি। নবীজীর প্রিয় নাতনী হযরত যয়নব (সাঃ) তার দুই শিশু সন্তান অউন এবং মোহাম্মদকে ডেকে বললেন, এখনও তোমরা বসে আছো? আল্লাহর পথে শহীদ হবার সময়তো এসে গেছে। ১০ বছর ও ৯ বছরের দুই ভাই সমস্বরে বলে উঠলেন, না মা, আমরা শুধু পবিত্র ইমামের হুকুমের অপেক্ষায় আছি। হযরত যয়নব (রা:) এর ভাই ইমাম হোসেন (রা:) এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তার দুই সন্তানকে এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিলেন। ক্ষুদে বীর অউন এবং মোহাম্মদ অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। ইমাম হোসেন (রা:) ও আব্বাস ছুটে গিয়ে তাদের পবিত্র দেহ দুটো এনে হযরত যয়নাবের সামনে রাখলেন। হযরত যয়নাব নিজ সন্তানের নূরানী মুখে চুমু খেতে খেতে বললেন প্রিয় বাছারা আমার। এখন আমি তোমাদের উপর খুশী হয়েছি। তোমরা সত্যের জন্যে যুদ্ধ করে আল্লাহ ও তার নবীকে খুশী করেছ। ছোট্ট এ শিশু দুটোর শাহাদাতের পর আহলে বাইতের অন্যান্য ছেলে সন্তানদের মধ্যে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে গেল। ১৪ বছরের কিশোর কাসিম ইবনে হাসান ইমামের অনুমতি নিয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন। ইমাম হোসেন (রা:) এর ছেলে কাসিম একাকী তলোয়ার চালাতে চালাতে শত্রু বাহিনীর ভেতর ঢুকে পড়লেন। তিনি একাই পাঁচজন শত্রু সেনাকে খতম করে শহীদ হয়ে গেলেন। ইমাম হোসেন (রা:) ভাইপোর মৃতদেহ তুলে আনার আগেই শয়তানের দল তার উপর ঘোড়া চালিয়ে দেয়। কাসিমের শাহাদাতে ইমাম শিবিরে কান্নার রোল পড়ে যায়। ইমাম হোসেন (রা:) সকলকে শান্ত করে যুদ্ধ পরিচালনা করতে লাগলেন। কাসিমের মৃত্যু দেখে মহাবীর আব্বাস আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ইমামকে সালাম করে এজিদের সেনাবাহিনীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ শুরু করলেন। তার ঘোড়া বিদ্যুৎ গতিতে শত্রু ব্যুহ ভেদ করছে। আব্বাসের তলোয়ারের আঘাতে শত্রুসেনারা কচুকাটা হচ্ছে। এই মহাবীরের সামনে সহজে কেউ আসার সাহস পাচ্ছে না। আব্বাস শত্রু সেনাদের মাঝখান দিয়ে পথ করে ফোরাতের তীরে এসে পৌছুলেন । তাকে কেউ আটকে রাখতে পারল না। প্রচন্ড পিপাসা কাতর আব্বাস, পানি খাওয়ার জন্যে নিচু হলেন। কিন্তু সাথে সাথে আঁজলা থেকে পানি ফেলে দিলেন। ইমাম শিবিরের কচি শিশুদের কথা তার মনে পড়ল। দুধের বাচ্চারা এক ফোটা পানির জন্যে কাতরাচ্ছে। তাদের ফেলে তিনি কি করে পানি পান করবেন? একটি থলেতে পানি ভরে ফিরতে লাগলেন আব্বাস। অমনি গোপন জায়গা থেকে অসংখ্য তীর এসে তাকে আঘাত করল। যুদ্ধাহত বীর আব্বাস ফোরাতের তীরেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। মহাবীর আব্বাস শহীদ হওয়ার পর ইমাম হোসেনের ছেলে আলী আকবর ময়দানে এলেন। আলী আকবর ছিলেন দেখতে অনেকটা মহানবী (সঃ)এর মত। তাকে যুদ্ধের ময়দানে দেখে শত্রু সেনারা থমকে গেল। কেউ তাকে আঘাত করার সাহস পেল না। বীর আলী আকবর প্রচন্ড বেগে তলোয়ার চালাতে চালাতে শত্রু সেনাদেরকে চারদিকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। বহু শত্রু সেনা খতম করে আলী আকবর ইমামের কাছে ফিরে এসে বললেন আব্বাজান আমি বড্ড পিপাসার্ত। ইমাম হোসেন পুত্রকে সান্তনা দিয়ে আবার যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দিলেন। আলী আকবর বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে গেলেন। এজিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। হঠাৎ একটি তীর এসে তার কন্ঠে বিদ্ধ হলে তিনি ধরাশায়ী হন। এভাবে ইমাম হোসেনের চোখের সামনেই তার পুত্র, ভ্রাতুস্পুত্র, ও বন্ধু বান্ধবরা একে একে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। এ আত্ম বিসর্জনে কারো মাঝে কোন প্রকার ভয়ভীতি বা দ্বিধা দ্বন্দ ছিল না। সবাই স্বত:স্ফূর্তভাবে ইমাম হোসেনের আহবানে সাড়া দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্যে মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজেদের বিলীন করে দিয়েছেন। ইমাম হোসেন দেখলেন চূড়ান্ত সময় এসে গেছে। পৃথিবীর বুকে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন তিনি। মহানবী (সাঃ) এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্যে যে প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল সেটাই তিনি উপস্থাপন করে বিশ্ব তাগুতী শক্তিকে হতবাক করে দিলেন। ইমাম হোসেন (রা:) ও তার সাথীরা এজিদী ইসলামের মোকাবেলায় মোহাম্মদী ইসলামের ঝান্ডাকে উচিয়ে ধরলেন। বাতিল শক্তির মুখোশ উম্মোচন করে সত্যের মশালকে প্রজ্জ্বলিত করেছেন। সকলকে হারিয়ে আজ এই মুহুর্তে কারবালার মরুপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছেন ইমাম হোসেন। এত বিষাদ, এত বেদনা, এত বিরহের মাঝেও ইমামের মিশনকে কৃতকার্য করার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন তিনি। এখন তো কেবল শেষ পোঁচ দেয়াই বাকি। তিনি নিজে এই মহাকান্ডের সমাপ্তি টানবেন। দুধের শিশু আলী আসগরকে দেখার সাধ জাগল। ইমাম হোসেন তাঁবুতে গিয়ে কচি শিশু আলী আসগরকে দুহাতে বুকে তুলে নিলেন। পিপাসায় কাতর এই শিশুকে দেখে ইমাম আর স্থির থাকতে পারলেন না, শত্রুদের উদ্দেশ্যে বললেন, হে জনসাধারণ! তোমরা আমার সাথে যুদ্ধ করছো আমাকে হত্যা করাই তোমাদের উদ্দেশ্য। এই শিশু তো কোন দোষ করে নি , একে অন্তত: একটু পানি দাও। ইমামের এই আহবানের জবাবে একটি বিষাক্ত তীর এসে ইমামের হাতে বিদ্ধ হলো। তীরের ফলা ইমামের হাত ভেদ করে শিশু আলী আসগরের কন্ঠ এফোঁড় ওফোড় করে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। ইমাম সেই রক্তমাখা হাত আকাশের দিকে তুলে ফরিয়াদ জানালেন হে প্রভু তুমি এর বিচার কর। শিশুপুত্রকে মাটিতে রেখে ইমাম হোসেন চূড়ান্ত ফায়সালার জন্যে প্রস্তুত হলেন। তাবুতে অসুস্থ পুত্র জয়নুল আবেদীনের কাছে ইমামতের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে পরিবারের জন্য সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।ইমাম হোসেন (রা:) যুদ্ধের ময়দানে এসে মুর্খ সেনাদের উদ্দেশ্যে শেষবারের মতে আবারো উপদেশ দিতে চাইলেন। এজিদ বাহিনীকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, হে জনসাধারণ! তোমরা কেন আমাকে হত্যা করতে চাও? আমার কি অপরাধ? শত্রুদের কাছ থেকে কোন উত্তর পেলেন না তিনি। শত্রু পরিবেষ্টিত ইমাম একাকী দাঁড়িয়ে আছেন। তীরের আঘাতে জর্জরিত তার দেহ থেকে রক্ত ঝরছে। তিনি আবার ডাক দিলেন, হাল মিন নাসেরিন ইয়ানসুরুনা? আমাদের সাহায্য করার কেউ আছে কি? কারো কাছ থেকে কোন উত্তর না পাওয়ায় ইমাম আবার বললেন, তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছোনা? তোমাদের মধ্যে একজন মুসলমানও কি নেই? কিন্তু পাষাণ হৃদয়গুলোতে কোন ভাবান্তর হলো না। শত্রুবাহিনী তীর ছুড়ে তার জবাব দিল। শেরে খোদার সন্তান মহাবীর হোসেন স্থির থাকতে পারলেন না। আমার মৃত্যু ব্যতীত যদি মোহাম্মদের ধর্ম টিকে না থাকে তাহলে হে তরবারী আমাকে গ্রহণ কর। একথা বলে প্রচন্ড হুংকারে তিনি শত্রুদের দিকে ছুটে গেলেন। শেরে খোদার পুত্রকে রণমূর্তীতে দেখে এজিদ বাহিনী ভয়ে পিছু হটতে লাগল। ইমাম হোসেন প্রচন্ড বেগে তলোয়ার চালাতে চালাতে শত্রুদের দিক বিদিক ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। তার তলোয়ারের প্রচন্ডতায় কেউ টিকতে পারছে না। শত্রু সেনারা পালিয়ে যাবার পথ পাচ্ছে না। ওমর সাদ, শিমার, সেনান, প্রমুখ দুরাচার পাপিষ্ঠরা সৈন্যদের উসকে দিতে লাগল একযোগে ইমামের উপর আঘাত হানতে। এদিকে তীরের আঘাতে জর্জরিত ইামামের দেহ থেকে প্রচুর রক্ত ক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে তার দেহ নিস্তেজ হয়ে আসছিল। তিনি আর তলোয়ার চালাতে পারছিলেন না। একসময় তিনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। এ সময় পাপিষ্ঠরা চারদিক থেকে তার উপর আক্রমণ চালায়। ইমাম হোসেন তার বুক থেকে তীরের ফলা টেনে বের করে শেষবারের মত বিশ্ব প্রভুর দরবারে ফরিয়াদ জানালেন, হে আল্লাহ! দেখ তোমার হোসেনের প্রতি এরা কেমন আচরণ করল। ওমর সাদের নির্দেশে এজিদের নিষ্ঠুর সৈনিকরা মহানবী (সঃ) এর দৌহিত্রের শির মোবারকও কেটে ফেলে। সেনান বা মতান্তরে শিমার জিলজওশান নামের নরাধম এই নিষ্ঠুরতম কাজটি করেছিল। ইমামের শির যখন কেটে বর্শার আগায় বিদ্ধ করা হয় তখনো ইমামের পবিত্র কন্ঠ দিয়ে উচ্চারিত হলো , আল্লাহু আকবার। এভাবে নিষ্ঠুরতার বিকট উল্লাসের মোকাবেলায় আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত মহাকালের পাতায় চির উজ্জল হয়ে থাকল। ইমাম হোসেন ও তার সাথীরা নতুন করে যেন স্থাপন করলেন লা ইলাহা কালেমার ভিত্তি।তারপরের ঘটনা আরো করুণ ও হৃদয়বিদারক। কারবালার শহীদদের পবিত্র দেহ থেকে শির ছিন্ন করে নেয়া হয় এবং অশ্ববাহিনী ছুটিয়ে পবিত্র দেহগুলো দলিত মথিত করা হয়। এরপর এজিদের বর্বর সেনারা ইমাম পরিবারের মহিলাদের তাবু লুট করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। নবী বংশের অসহায় নারী ও শিশুরা আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে এবং বহু শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায়। ইতিহাসের করুণ ও ভয়াল রাত নেমে এলো। কারবালার আকাশ আজ রাতে রক্তিম আভায় আবৃত। ইতিহাসে এ রাত “শামে গারিবান” নামে পরিচিত। সত্যিই এর চেয়ে করুণ আর হৃদয়বিদারক আর কি হতে পারে? ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম পরিবারের সদস্যরা অভিভাবকহীন অবস্থায় পোড়া তাবুগুলোর মধ্যে বসে শহীদদের স্মরনে কাঁদছিলেন, আহাজারী করছিলেন। রাসুলে খোদা তার জীবনের প্রতিদান হিসেবে চেয়েছিলেন মুসলিম উম্মত যেন তার বংশদল ও আহলে বাইতকে ভালোবাসে। অথচ তার আহলে বাইতের প্রতি মুসলিম নামধারীদের এ কি আচরণ! একদিকে এজিদী সৈনিকদের অট্টহাসি আর শরাব পানের উন্মত্ততা আর অন্যদিকে মস্তকবিহীন শহীদদের পবিত্র লাশ ঘিরে নবী বংশের নারীদের বুকভাঙ্গা বিলাপ। এ রাতে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পাপীও দুফোটা অশ্রু না ফেলে পারে না। পরদিন এজিদের সৈন্যরা পৈশাচিক উল্লাসে আহলে বাইতের নারী ও শিশুদেরকে বেঁধে গলায় দড়ি লাগিয়ে খালি উটের পিঠে তুলে দেয়। ৭২ জন শহীদের মস্তক বর্শার ফলায় বিদ্ধ করা হয়। নবী বংশের সম্মানিতা মহিলাদের পর্দা কেড়ে নেয়া হয়। কথিত আছে অসুস্থ ইমাম জয়নুল আবেদীনকে কাটাওয়ালা লোহার বেড়ি পরিয়ে দিয়ে খালি পায়ে টেনে হিঁচড়ে কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেস্কে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় মহিয়সী নারী যয়নাব এবং ইমাম জয়নুল আবেদীন (রা:) আশুরার এই বিরহের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। কারবালার এই নিষ্ঠুর অত্যাচার অবিচারের কাহিনী জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেন। ইসলামের বিপ্লবী নায়িকা হযরত জয়নাব যদি না থাকতেন তাহলে কারবালার আত্মত্যাগের কাহিনী মানুষের কাছে অজানা থেকে যেত। সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসেন ইসলামী বিপ্লবের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন তার পরবর্তী আরাধ্য কাজ অঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন হযরত জয়নাব। হাল মিন নাসেরিন ইয়ানসুরনা। অর্থাৎ আমাদের সাহায্য করার কেউ আছে কি? ইমাম হোসাইনের এই কালজয়ী আহবানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন হযরত জয়নাব। আজো সেই আহবান মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয় আশুরার বিপ্লব থেকে শিক্ষা নেয়ার এবং ইসলামকে নতুন করে জানার।আশুরার আরও কিছু ইতিহাসইমাম হোসেন (রা:) এর জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল শাহাদত। কারণ, রাসুলে খোদা স্বয়ং বলেছেন, শাহাদাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় পূণ্য। ইমাম হোসেন (রা:) এর মনে পড়ে গেল তার মহান পিতা ও শিক্ষক হযরত আলী (আঃ) এর কথা। ১৯ শে রমজান ভোর বেলায় দুশমন তার মাথায় আঘাত করলে তার কন্ঠ থেকে প্রথম যে কথাটি নিঃসৃত হয়েছিল, সেটি হলো কাবার প্রভুর কসম আমি কামিয়াব হয়েছি। শাহাদতের আগে তার পিতার মর্মভেদী কথাগুলো বার বার ঘুরে ঘুরে তার মনে হচ্ছিল। তিনি বলেছিলেন খোদার কসম, অনাকাঙ্খিত কিছুই ঘটেনি। ইমাম হোসেন (রা:) এর মনে পড়ে গেল তার নানাজীর কথা। তিনি আধ্যাত্মিক জগতে তার উচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ তাকে দিয়েছিলেন। এসব ভাবতে ভাবতে তার ক্লান্ত অবসনড়ব চোখে তন্দ্রা চলে এলো। স্বপ্নে দেখলেন নানাজান রাসুলে খোদাকে, পিতা হযরত আলীকে, স্নেহময়ী মা ফাতেমাকে, আর ভাই ইমাম হাসানকে। তারা বললেন হে হোসেন! তুমি আগামীকালই আমাদের সাথে মিলিত হবে। এর পরপরই তার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। ইমাম হোসেন (আঃ) তার বোন বিবি জয়নাবকে স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। ভাইয়ের নিশ্চিত শাহাদাতের কথা শুনে বোনের মন কি আর মানে? জয়নাব (রা:) চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। ইমাম তাকে সান্তনা দিলেন। ইমাম হোসেন (আঃ) পরদিনের মহা কোরবানির জন্য প্রস্তুত হলেন। এই কোরবানি হবে সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এতে তিল পরিমান খাদ থাকতে পারবে না। কারণ আগামীকাল যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবেন তাদের প্রতিটি রক্ত বিন্দু শত সহস্র রক্ত বিন্দুতে নয় বরং লক্ষ-কোটি রক্ত বিন্দুতে পরিণত হয়ে সমাজদেহে সঞ্চালিত হবে। শহীদের খুন রক্তশূণ্যতায় আক্রান্ত সমাজদেহে নতুন রক্ত প্রবাহ দান করে। তাদের ব্যক্তিত্ব ও স্মৃতি যুগযুগ ধরে মানুষকে মুক্তির প্রেরণা যোগায়। তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও চেতনা দান করে। শহীদরা কেয়ামত পর্যন্ত অমর থাকবেন এবং শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাদেরকে এমন জৌলুসসহ হাজির করবেন যে স্বর্গীয় বাহনে উপবিষ্ট নবী রাসূলরাও তাদেরকে সম্মান দেখানোর জন্য নীচে অবতরণ করবেন। তাই ইমাম তার কাফেলার মধ্যে যাদের নিয়্যতে বিন্দু পরিমান গোলমাল আছে তাদের কাছ থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। তিনি সবাইকে একস্থানে সমবেত করলেন এবং শাহাদাতের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ভাষণ দিলেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, “আমি আমার সঙ্গী সাথীদের চেয়ে কোন সাথীকে অধিক নেককার এবং আমার আহলে বাইতের চেয়ে কোন পরিবারকে অধিক উত্তম মনে করি না। মহান আল্লাহ তোমাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন।” ভয়াবহ আশুরার পূর্বাভাস নিয়ে ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। ধৈর্য্যর মূর্ত প্রতীক ইমাম হোসেন (রা:) সকলকে কাছে ডাকলেন। বললেন, ভায়েরা আমার! জেনে রাখো আজকের এই রাত হবে তোমাদের শেষ রাত। আমার সাথে থাকলে তোমরা কেউ রেহাই পাবে না। আগামীকালই আমাকে ও আমার পরিবার পরিজনকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হবে। এমনকি আমার দুধের বাচ্চাকেও এরা রেহাই দেবে না। ভাইসব, “তোমরা ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারো। আমার হাতে তোমরা যে বায়াত করেছো, তা আমি ফিরিয়ে নিলাম। তোমরা এখন মুক্ত। আমার জন্যে শুধূ শুধু তোমরা কেন প্রাণ দেবে? শত্রুরা শুধু আমাকে চায়, তোমাদেরকে নয়। এখন আন্ধকার রাত। যার ইচ্ছা চলে যাও , কেউ দেখতে পাবে না।“ ইমাম ভাষণ শেষ করে তার ভাই আব্বাসকে প্রদীপ নিভিয়ে দিতে বললেন। যখন অন্ধকার হয়ে এল তখন ইমামের সাথে আসা অনেক লোক সঙ্গোপনে ইমাম বাহিনী ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল। সবাই পার্থিব লাভের আশায় মক্কা থেকে ইমামের সাথে যোগ দিয়েছিল। যখন আলো জালানো হল তখন দেখা গেল মুষ্টিমেয় কিছু লোক মাত্র রয়ে গেছেন। এদের সংখ্যা একশো জনেরও কম। আত্মত্যাগের আদর্শে বলীয়ান বিশুদ্ধ অন্তরের এই মর্দে মোমিনদের দিকে তাকিয়ে ইমামের প্রশান্ত মুখটা উজ্জল দ্বীপ্তিমান হয়ে উঠল। মহাকালের মহাত্যাগের জন্যে এরকম বিশুদ্ধ হৃদয়গুলোই তার প্রয়োজন ছিল। তবুও তিনি তার সাথীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেন গেলে না? এ প্রশ্ন শুনে আহলে বাইতের সদস্যরা বলে উঠলেন, একি বলছেন হযরত! আমরা আপনাকে একা ফেলে কিভাবে চলে যাবো? লোকের কাছে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবো? আমরা কি বলব মহানবী (সঃ) এর সন্তানকে আমরা একা ফেলে চলে এসেছি। তা কখনো হবে না। নিজের জীবন দিয়ে দেব তবুও আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনার সাথে থেকে শহীদ হব। মুসলিম বিন আউসাজা দাঁড়িয়ে বললেন, প্রিয় ইমাম একি বলছেন আপনি। আপনাকে দুশমনদের হাতে ফেলে রেখে পালিয়ে যাবো ? খোদা আপনার পরে যেন আমাদের জীবিত না রাখেন। আমরা যুদ্ধ করবো। গায়ে শক্তি থাকা পর্যন্ত দুশমনের গায়ে তলোয়ার চালাবো, বর্শা চালবো। ওগুলো ভেঙ্গে গেলে পাথর মেরে মেরে যুদ্ধ করবো। সাঈদ বিন আবদুল্লাহ হানাফী বললেন, প্রিয় ইমাম! খোদার কসম আপনাকে রেখে আমরা কোথাও যাবোনা। আপনার জন্যে যদি নিহত হই এবং জীবন্ত দগ্ধ হই এবং তা যদি ৭০ বারও হয় তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনি মরে যাবেন আর আমরা বেচে থাকব এ কি করে হয়! যুহাইর ইবনে কাইন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হে মহানবীর প্রিয় সন্তান, আপনি ও আপনার পরিবারকে রক্ষার জন্যে আমাকে যদি হাজারবারও মেরে ফেলা হয় তাহলেও আমি আপনাকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করব। এভাবে ইমামের বিভিন্ন সঙ্গী সাথী ইমামকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, নিজেদের আন্তরিকতা প্রকাশ করতে লাগলেন। সঙ্গী সাথীদের এরকম দৃঢ়তা দেখে ইমামের চেহারা মোবারক এক অভূতপূর্ব প্রফুল্লায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন। ইমাম হোসেন (রা:)এর ভাষনের পর সবাই ছত্রভংগ হয়ে মশগুল হলেন এবাদতে। কেউ সেজদায়, কেউ নামাজে, কেউ মুনাজাতে। কারবালার প্রান্তর সিক্ত হয়ে উঠল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহীদদের অশ্রুতে। দুনিয়ার সব ফেরেশতা যোগ দিলেন তাদের এই প্রার্থনায়।মহররম মাসের অন্যান্য বিশেষত্ব:পবিত্র ‘মহররম’ মাসের ৩০ দিনে বিশ্বের ইতিহাসে এমনসব ঘটনার অবতারণা ঘটেছে, যার দিকে দৃষ্টিপাত করলে হতবাক না হয়ে পারা যায় না। এই মাসের ১ম তারিখটি বছরের প্রারম্ভ বলে স্বীকৃত। ৯ ও ১০ তারিখে রোজা রাখার কথা হাদীস শরীফে ঘোষিত হয়েছে। ১০ তারিখে আশুরা বা কারবালা বার্ষিকী পালিত হয়। এই তারিখে ইমাম হযরত হুসাইন ইবনে আলী (রাঃ) খলীফা ইয়াজীদ ইবনে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন। ১৬ তারিখে বাইতুল মোকাদ্দাসকে কিবলা মনোনয়ন করা হয়েছিল। এই মাসের ১৭ তারিখ আবরাহার হস্তি বাহিনী মক্কার উপকণ্ঠে ছাউনী গেড়েছিল। বিশেষ করে আশুরার দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিনে হযরত আদম (আ:) দুনিয়ার বুকে পদার্পণ করেছিলেন। হযরত নূহ (আ- এর সময়কার মহাপ্লাবনের শুরু এবং শেষও ছিল আশুরার দিনে। হযরত মুসা (আ:) তাওরাত কিতাব লাভ করেছিলেন এই দিনে এবং অভিশপ্ত ফেরাউনের ধ্বংসও সাধিত হয়েছিল এইদিনে। হযরত ইব্রাহীম (আ:) পাপিষ্ঠ নমরূদের অনলকু- হতে নিষ্কৃতি লাভ করেছিলেন এই দিনে। হযরত ইউসুফ (আ:) অন্ধকার কূপ হতে এইদিনে উদ্ধার লাভ করেছিলেন। হযরত ঈসা (আ:) কে আল্লাহ পাক চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নিয়েছিলন এই দিনে। হযরত আইয়ুব (আ:) এর আরোগ্য লাভের দিনটি ছিল আশুরা। এই দিনে হযরত ইউনূস (আ:) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এই দিনেই হযরত ইদ্রিস (আ:) সশরীরে জান্নাতে প্রবেশ করেছিলেন। আবার এই দিনেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। এতসব ঘটনার চিত্র যে মাস স্বীয় বুকে ধারণ করে আছে এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য যে অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত ‘মহররম’ হচ্ছে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী মাস। এ প্রসঙ্গে ‘মুহির নেছারা’ যা বলেছেন, তা খুবই প্রাণিধানযোগ্য। ‘আবহমানকাল ধরে চলছে মিথ্যার সাথে সত্যের লড়াই। সৃষ্টির ইতিহাসে এ দুইয়ের বৈরিতা চিরন্তন। তা যেমন শক্ত তেমনি শক্তিশালী। এ দ্বন্দ্ব কখনো মুছে যাওয়ার নয়, কিংবা নয় থেমে থাকারও। সত্যের সাথে শত্রুতা ঘোষণা করেই হয় মিথ্যার জন্ম। আর মিথ্যাকে প্রতিহত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে আসে সত্য।’ এভাবেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিজয় মাল্য লাভে ধন্য হয়। মাহে ‘মহররম’ এই শিক্ষাই দিয়ে যায় বারবার।১০ই মহররম/আশুরা এর আমল:নামাজ(১) হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত: রাসুলে পাক (সা:) বলেন যে ব্যাক্তি মহররমের দশম রাত্র জেগে এবাদত করবে, আল্লাহ তাকে উত্তম জীবন দান করবেন।(২) গাউছুল আজম হযরত আব্দুল কাদের জ্বীলানী (রহ:) বলেন যে ব্যাক্তি মহররমের দশম রাত্র জেগে এবাদত করবে, তার মৃত্যু হবে কষ্টহীন এবং আরামের।নামাজের কতিপয় নিয়ম:(১) বুযুর্গনে দ্বীনদের মতে আশুরার রাত্রে ২ রাকাত নামাজ আছে। প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতেহা একবার এবং সুরা এখলাস তিন বার। এভাবে যে দুই রাকাত নামাজ পড়বে আল্লাহতায়ালা তার কবরকে র‍ৌশন (আলোকিত) করে দেবেন।(২) এক নিয়তে চার রাকাত নফল নামাজ যার প্রত্যেক রাকাতে একবার সুরা ফাতেহা এবং পঞ্চাশ বার সুরা এখলাস। এভাবে যে ব্যাক্তি ৪ রাকাত নামাজ পড়বে আল্লাহ তায়ালা তার পঞ্চাশ বছর পূর্বের ও পরের সব গোনাহ মাফ করে দিবেন।(৩) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন এক নিয়তে চার রাকাত নফল নামাজ যার প্রত্যেক রাকাতে একবার সুরা ফাতেহা, তিন বার সুরা এখলাস, এবং এক বার আয়তুল কুরসী।এভাবে নামাজ শেষে ১০০ বার সুরা এখলাস পাঠ। এভাবে নামাজ আদায় করলে গুনাহ মাফ হবে এবং জান্নাতের অসীম নেয়ামত হাসেল হবে।রাহাতুল কুলুব গ্রন্থে একবার সুরা ফাতেহা, ১০ বার সুরা এখলাস এবং ৩ বার আয়াতুল কুরসী পড়ার কথা বলা হয়েছে। (রাহাতুল কুলুব-পৃষ্ঠা ২২৫)(৪) গুনিয়াতুত ত্বালেবিন গ্রন্থে ১০০ রাকাত নফল নামাজের কথা বলা হয়েছে। দুই দুই রাকাত করে। প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতেহা ১ বার এবং সুরা এখলাস ১০ বার। এভাবে ১০০ রাকাত নামাজ আদায় করলে সেই ব্যাক্তির উপরে ৭০টি রহমতের নযর করবেন।যার মধ্যে সর্ব নিম্নটি হলো গোনাহ মাফ।রোযাহয়েছিল।হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর মদিনা শরিফে প্রত্যাবর্তন করে মহররমের দশম তারিখে ভিন্ন ধর্মীয়দের সাওম পালনরত দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমরা কেন এদিন সাওম পালন করছ? উত্তরে ইহুদি সম্প্রদায় বলেছিল, ‘সেদিন ফেরাউনের অন্যায় অবিচার থেকে মূসা (আ.) নিরাপত্তা লাভ করেছিলেন, তাই আমরা কৃতজ্ঞতাবশত সেদিন সাওম আদায় করি। উত্তরে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) জানিয়ে ছিলেন মূসা (আ.)-এর ব্যাপারে আমরা অধিক হকদার। তাই তিনি নিজেও সেদিন রোজা রাখলেন এবং সাহাবীদের (রা.)কেও রোজা রাখতে বললেন। (ইমাম বুখারি, জামি হাদিস নং-১৯০০, মুসলিম সহীহ, হাদিস নং-২৬৫৩) পরবর্তীকালে দ্বিতীয় হিজরি সনে রমজানের সাওম ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজাকে ইচ্ছাধীন করে দেয়া হয়, যা রাখলে অত্যন্ত বেশি ছওয়াব হয়। আবু হোরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন রমজানের রোযার পরে, সবচেয়ে উত্তম রেযা হলো মহররম মাসের (আশুরার) রোযা এবং ফরজ নামাজের পরে সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো রাত্রীকালীন (তাহাজ্জুদ) নামাজ (মুসলিম শরীফ)। এ প্রসঙ্গে উম্মুল মুমিনিন হজরত আইশা সিদ্দীকা (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরাও আশুরার দিনে রোজা রাখত। এদিন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও রোজা রেখেছেন এবং লোকদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু রমজানের রোজা ফরম হওয়ার পর আশুরার রোজা ইচ্ছাধীন করে দিয়েছেন। (ইমাম বুখারি, জামি, ১৮৯৮ তিরমিজী, সুনান ৭৫৩ বাইহাকি, সুনান ৮৪৯৪)।তাছাড়া ইসলাম সম্পুর্ণরূপে অন্যান্য ধর্মের সংশ্রব মুক্ত। তাদের কোনোরূপ অনুকরণ ইসলামে পছন্দনীয় নয়। ইহুদিরা আশুরার দিন ১টি রোজা রাখায় ইসলামে ২টি রাখার পরামর্শ রয়েছে। ৯ তারিখ বা ১১ তারিখকে জড়িত করে তা পালন করা যায়। এ সম্পর্কে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আগামী বছর আমি সুযোগ পেলে (বেঁচে থাকলে) মহররমের দশ তারিখের সঙ্গে নবম তারিখেও রোজা রাখব। (ইমাম মুসলিম, সহিহ ২৬৬২, ইবনে মাজাহ, সুনান ১৭৩৬)।খাদ্যইয়াজিদের নির্মম বাহিনী সামান্য পানি দিয়ে কচি শিশুর তৃষ্ণা নিবারণ করতে দেয়নি বরং বিশ্বের ইতিহাসের সর্বাধিক হৃদয়গ্রাহী ঘটনার অবতারণা করেছিল। তাই এ মাসের আশুরায় উত্তম আহার গ্রহণের ব্যাপারে হাদিস শরিফে তথ্য বিদ্যমান।পরিশেষসত্যের জন্য শাহাদাতবরণের এ অনন্য দৃষ্টান্ত সব আনুষ্ঠানিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে এর অন্তর্গত ত্যাগ-তিতিক্ষার মাহাত্ম্য তুলে ধরার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ১০ মহররমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। পবিত্র আশুরা দিবসে কারবালার শিক্ষা হলো, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামীদের সামনে প্রতিপক্ষের তরফ থেকে কোনো সময় অর্থ, বিত্ত ও সম্মানের লোভনীয় প্রস্তাব এলেও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে আপসহীন মনোভাবের মাধ্যমে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী তাই আমাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়।পবিত্র আশুরা এ মহান শিক্ষা দিয়েছে যে সত্য কখনো অবনত শির হতে জানে না। বস্তুত, কারবালা ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণতন্ত্রের। ইসলামি আদর্শকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন হজরত ইমাম হোসাইন (রাঃ); কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আপস করেননি। জীবনের চেয়ে সত্যের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার জন্য নবী-দৌহিত্রের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগজগতের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বিরল ঘটনা। কারবালার ঘটনায় চিরন্তন সত্যের মহাবিজয় হয়েছিল এবং বাতিলের পরাজয় ঘটেছিল। সুতরাং আশুরার এ মহিমান্বিত দিনে শুধু শোক বা মাতম নয়, প্রতিবাদের সংগ্রামী চেতনা নিয়েহোক চির সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়াই, প্রয়োজনে আত্মত্যাগ। কারবালার কথকতা শুধু শোকের কালো দিবসই নয়, এর মধ্যে সুপ্তরয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য কঠিন শপথ নেওয়ার সুদৃঢ় আকাঙ্ক্ষা। মহররমের ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত শিক্ষা অন্যায়-অবিচার-অসত্য ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সব সময় রুখে দাঁড়ানো। কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই হোক কারবালার মূলমন্ত্র।পবিত্র আশুরা দিবসে কারবালার ত্যাগের শিক্ষা, অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার শিক্ষা আমাদের চিরন্তন আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত। তাই মর্সিয়া ক্রন্দন নয়, কারবালার বাস্তব শিক্ষা, অর্থাৎ সত্যের জন্য আত্মত্যাগের যে অতুলনীয় শিক্ষা, তা সাদরে গ্রহণ করতে হবে।অতিরঞ্জিত বিষয়াদি ইসলাম সমর্থিত নয়। মাতম, কৃত্রিম সমাধি তৈরি, অস্ত্র দিয়ে স্বশরীরে আঘাত এগুলো ইসলাম বহির্ভূত কাজ। এগুলো থেকে মুক্ত থেকে নিজেকে মহররমের শিক্ষা ও আশুরার দীক্ষা নিয়ে গড়ার চেষ্টা করা উচিত। ইসলামের বিধানকে সমুন্নত করা, সর্বাবস্থায় তা পালনের জন্য প্রচেষ্টা চালানো এবং অন্যায়কে মেনে না নেয়ার শিক্ষা আমরা মহররম ও আশুরা থেকে গ্রহণ করতে পারি। আল্লাহতায়ালা আমাদের ত্রুটিসমূহ মার্জনা করুন এবং তাঁর সর্বাধিক প্রিয় হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পূর্ণ ও প্রকৃত উম্মতরূপে কবুল করুন।

No comments:

Post a Comment

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে শিবগঞ্জ উপজেলাবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

 বিসমিল্লাহর রাহমানির রাহিম ঈদ বয়ে আনুক সবার জীনবে সুখ শান্তি ও কল্যাণের বার্তা ঈদের দিনের মতো সুন্দর হোক প্রতিটি দিন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক...