নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে । কেন এতোদিন বুঝতে পারলোনা ? কেন এতোদিন
বোকার মত একটা মরীচিকার পেছনে ছুটল ? নাহ , আসলেই একটা গাধা সে । সাতপাচ
ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে বের হল কাব্য । প্রমিতির সাথে break-up হয়েছে গত
পরশুদিন । তাই কাল সারাদিন বাসা থেকে বের হয়নি । এখনো জ্বরটা ছাড়েনি
ঠিকমত । তবু বের হয়েছে সে । না , আর ভুল করে বসে থাকা যায়না । এই চারটা
মাস অনেক কষ্ট দিয়েছে সাফা কে ।
আর নয় । এখন যদি সাফার কাছে নিজের দোষ না
স্বীকার করা হয় , তবে সেটা খুবই বড় অপরাধ এবং নিঃসন্দেহে ভুল হবে । আর
ভুল করতে চায়না কাব্য । অনেক হয়েছে । আজ আর একটা বিহিত করতেই হবে । ভেবেই
বাসা থেকে বের হয়েছে কাব্য । মা দেখে বলেছেন না যেতে । কিন্তু এখন সে কথা
শোনার সময় নেই । এক মুহুর্তেরও অনেক দাম এখন । কোনমতে ফ্রেশ হয়েই সাফার
দেয়া শার্টটা পরে বের হল কাব্য ।
রাস্তায় কোন রিকশা পাওয়া গেলোনা । গরম ও পরেছে আজকে । ভাবতে ভাবতে মেইন
রোডে চলে আসল কাব্য । দূরে দেখা গেল এক রিকশাওয়ালা নিজের রিকশায় বসে চোখ
বুজে পড়ে আছে ।
-মামা , যাবা নাকি ?
-(চোখ খুলে বিরক্তির স্বরে)না মামা , মুড নাই ।
-মামা , নিয়ে যাওনা । না গেলে অনেক ঝামেলা হইয়া যাইব । চল মামা…………চল
সোবাহান মিয়ার মনটা আজকে এম্নিতেই একটু বেশিমাত্রার খারাপ । সকালে উঠেই
আম্মার কান্নাকাটি দেখেছে সে । সেই একটাই প্রলাপ তার-“আমার পোলাডা , কি
দোষ করছিল হ্যায় ? পোলাডার বিয়া না দেইখা মরতেও পারমুনা । ওরে আল্লাহ ,
তুমি এমন করলা ? ” ধুর , এক কথা শুনতে কত ভালো লাগে ? তাই কিছু না খেয়েই
বের হয়ে আসল সোবাহান । গ্যারেজে গিয়ে দেখে মহাজন জোরে হাক ছাড়ছেন
“সোবাহানডা গেল কই ? বিয়াশাদি কি আমরা করিনাই ? আমার বিয়ার লাইগা ২৫ খান
মাইয়া দেহাইসিল আমার মায় । আমি কি কামাই দিসিলাম ? নাহ । আর এই পোলাডা……”
আস্তে করে মহাজনের সামনে গিয়ে রিকশাটা নিয়ে বেরিয়ে পরল সোবাহান । কিছু
বলার নেই তার । মনে অশান্তি লেগে আছে । মহাজনকে দোষ দিয়ে লাভ কি ? সে তো
বলবেই । রিকশাটা নিয়েই সোজা বাবলা গাছটার নিচে আসল সোবাহান । এই গাছটা
তার অনেক প্রিয় । দুপুরে হয়রান হয়ে গেলে সে এখানে এসে বিশ্রাম নেয় । আজকে
সকাল সকালই চলে আসল । রিকশা চালানোর মুড নেই এখন । একপাশে সাইড করে রেখে
নিজেই আধশোয়া হয়ে থাকল । চোখ বুজে পড়ে থাকলে ভাল লাগে তার । মনে হয় এই
দুনিয়াতে আর কেউ নাই । শুধু সোবাহান আর তার লক্ষী হবু বউ আমেনা । কিন্তু
আজ আমেনাকে ভাবতে গিয়ে ঘেন্না চলে আসছে । মনে খালি একটাই প্রশ্ন আসতে
থাকল “ আমেনা , তুমি এইডা করতে দিলা কেমনে ? তোমার বাপরে ঠেকাইতে পারলানা
? কেমনে করলা এইডা তুমি ? ”
বেশিক্ষন ভাবতে পারলোনা সোবাহান । তার আগেই একটা ছেলে এসে অনুরোধ করতে
থাকল । সোবাহান ভালো মানুষ । মানুষের উপর কথা বলতে কষ্ট হয় তার । তবু বলল
“না মামা , মুড নাই”।
তাও ছেলেটা আবার মিনতি করল । নাহ , সোবাহানের ভাল
লাগছেনা আর । ছেলেটাকে জোরে একটা না বলতে গিয়েও থেমে গেল । কি যেন আছে
তার আকুতিতে । কিছু না বলেই নেমে পড়ল সোবাহান । ছেলেটা অনেক খুশি হয়ছে
বলে মনে হল , কিন্তু সেটা তার শুকনো মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই । কথা না
বাড়িয়ে রিকশা টানা শুরু করল সোবাহান ।
এত tension এর মধ্যেও শার্টটা পড়তে ভোলেনি কাব্য । ভুলবে কি করে ? সাফা
তো আর কোন সাধারন মেয়ে নয় , সেই বাচ্চাকাল থেকে বন্ধু তারা । আসলে বন্ধু
বললে সাফাকে ছোট করা হবে । সাফাই ছিল তার সব । যে কোন কাজ তারা একসাথে
করত । নতুন মুভি বের হলে দুজনের সেটা একসাথে দেখা চাই । কোন কন্সার্টে
গেলে পাশাপাশি টিকেট দুটো তাদের হওয়া চাই । ঈদে একজন কাল ড্রেস কিনলে
আরেকজনেরও কাল ড্রেস চাই । কিন্তু হঠাৎ করে কি হয়ে গেল সাত মাস আগে
স্কুলে নতুন মেয়েটা আসাতে । মেয়েটার নাম প্রমিতি । ক্লাস নাইনের
top-ranked সুন্দরীদের তালিকায় সাফার সাথে তারও নাম উঠল । কিছুদিনের
মধ্যেই সে সাফার অনেক ভাল বন্ধু হয়ে গেল । আর কাব্য ? কিভাবে যেন
প্রমিতির প্রেমে পাগল । কোথাও গেলে এখন তিনজন একসাথে যায় । এভাবেই
প্রমিতির সাথে কাব্যর ভাল সম্পর্ক হতে থাকে । ব্যাপারটা সাফা বুঝত ,
কিন্তু কিছু বলত না । আর কাব্য , গাধার মত সাফার সামনেই প্রমিতির যত রকম
প্রশংসা করতে ব্যস্ত । আস্তে আস্তে সাফা চুপ হয়ে যেতে থাকল । কাব্য সেটা
খেয়াল করলেও তেমন একটা মাথায় নিতোনা । তার মাথায় তখন প্রমিতি আর প্রিমিতি
। রাত জেগে প্রমিতির সাথে কথা বলা , টিফিনের সময় প্রমিতির সাথে বসা ,
স্কুল শেষে প্রমিতিকে নিয়ে বের হওয়া , এসব চলতে থাকল । সাফা এসব দেখতে
দেখতে এক্সময় চুপ হয়ে গেল । সে শুধু একা একা থাকে আর নিরবে চোখের পানি
ফেলে । কিভাবে বোঝাবে সে কাব্যকে চায় ? অসহায় সাফা তাই কাব্যর সাথে মেশা
বন্ধ করে দেয় । শুধু ক্লাসে যায় আর বাসায় ফেরে । কাব্য সাফাকে কোথাও
যাবার আগে ডাকে , কিন্তু সাফা কোনভাবে কেটে পড়ে । ব্যাপারটা ক্লাসে সবাই
খেয়াল করল । কারন কাব্য-সাফা জুটি তাদের কাছে ছিল একটা আদর্শ । কিন্তু সে
বন্ধনে ভাঙ্গন দেখে অনেকেই সহ্য করতে পারলোনা । একদিন কয়েকজন বন্ধু মিলে
কাব্যকে ডেকে বলল সব । কথাগুলো শুনে কাব্য যে ব্যবহার করল সেটা কেউ আশা
করেনি । তখনি সবার বোঝা হয়ে গিয়েছে , কাব্য আর আগের মত নেই । তিন মাসে
কাব্য পালটে গেছে ।
এদিকে কাব্য এসব শুনে হুট করেই প্রমিতির সাথে রিলেশন শুরু করল । তার
উদ্দেশ্য বন্ধুদের দেখিয়ে দেয়া – সে ভাল আছে । কথাটা সাফার কানে গেল ।
সাফা আগে থেকেই খারাপ কিছুর জন্য তৈরি ছিল । তবু খবরটা বড়সড় একটা ধাক্কা
দিল মেয়েটাকে । বাসায় গিয়ে অনেক্ষন কাদল সাফা । কিন্তু তবু সে কাব্যকে
ভুলতে পারছেনা । কাব্যকে ভুলতেই হবে । নইলে সাফার বেচে থাকা কষ্টকর হয়ে
যাবে । এই ভেবে সে স্কুলে আসা বন্ধ করে দ্দিল । আর এদিকে কাব্য প্রমিতিকে
নিয়ে ব্যস্ত । ব্যস্ততা খুব বেশিদিন যায়নি , তার আগেই কাব্য টের পাওয়া
শুরু করল সাফা আর প্রমিতির মাঝে ব্যবধান । প্রমিতি আর আগের মত নেই , সে
এখন কাব্যর সবকথায় খুত ধরে , খবরদারি ফলাতে চায় । সাফার মত নয় সে , বরং
কিছুটা উল্টোই । এভাবে চার মাস কেটে গেছে । হঠাৎ গত পরশুদিন কি একটা বিষয়
নিয়ে কাব্যর সাথে প্রমিতির সাথে ঝগড়া হচ্ছিল । এক পর্যায়ে প্রমিতি বলে
ওঠে “ এত যখন সমস্যা তোমার , তাহলে আমার সাথে রিলেশন করেছ কেন ? যাও ,
সাফার কাছে যাও ! ” কথাটা কাব্যর খুব লেগেছিল ,কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল
প্রমিতি ঠিকই বলেছে । আসলেই ভুল ছিল এতদিন । কথাটা ভেবে কাব্য সোজা
প্রমিতিকে বলে এসেছে “ আমাকে ভুলে যাও।” তারপর সোজা বাসায় । টানা একদিন
বাসা থেকে বের হয়নি কাব্য । এর মাঝে প্রমিতি একবারের জন্যেও ফোন দেয়নি ।
বন্ধুর কাছ থেকে জানা গেল প্রমিতি সবাইকে বলেছে কাব্যর সাথে যা ছিল সব
ছিল মিথ্যা । শুনে কিছুটা খুশিই হল কাব্য । রাতে সাফার কথা ভেবে
দীর্ঘশ্বাস ফেলল । নাহ , অনেক ভুল করেছে সে । আর নয় । এই ভেবেই সকাল সকাল
সাফার বাসা দিকে রওনা দিয়েছে কাব্য ।
সোবাহান মিয়া রিকশা চালাচ্ছে আর ভাবছে । আমেনা তার এলাকার মতিন চাচার
মেয়ে । আমেনাকে তার অনেক ভাল লাগে । আমেনাও সোবাহানকে পছন্দ করে ।
শুক্রবার হলেই তারা হলে সিনেমা দেখতে যায় । সবকিছুই ভালমত যাচ্ছিল ।
সোবাহানের মা ছেলেকে বিয়ে দেবার জন্য ভাবছিলেন । তখন সে আমেনার কথা খুলে
বলে । সোবাহানে মাও আমেনাকে আগে থেকেই পছন্দ করেন । তাই ছেলের মুখের কথা
শুনে তিনি আমেনার বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠান । কিন্তু আমেনার বাবা প্রথমে
সায় দিলেও পরে বেকে বসেন । তার একটাই কথা “ পোলার ভিটা আছে বুঝলাম ,
কিন্তু শুধু ভিটা থাকলেই কি চলব ? জমিরেরও তো বাপের ভিটা আছে , তাইলে
তফাৎ কি হইল ? সোবাহানের কি জমিরের মতন দুইডা রিশকা আছে ? অর নিজের তো
এহন একখান রিশকাও নাই । আমার মাইয়ারে আমি ক্যান দিমু ?” কথাটা ভাবে আর
ক্ষনে ক্ষনে দু;খ পায় সোবাহান “ হায়রে দুনিয়া , ভালোবাসার দাম কি উইডা
গেছে আসমানে?” প্রতিদিন সকালে মায়ের এক প্যাচাল ভালো লাগেনা তার । কিছু
একটা বিহিত করতেই হবে । আমেনাকে ছাড়া বাচবেনা সে । ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুম
হয়না সোবাহানের । আবার সকালে মায়ের কান্নাকাটি শুনে সোবাহান সিদ্ধান্ত
নিয়ে ফেলে আমেনাকে তার চাই ই চাই । হয় আমেনা তার হবে , না হয় মরবে সে ।
রিকশা চালাতে চালাতে মাথায় একটা বুদ্ধি আসে । আচ্ছা , আমেনাকে নিয়ে
পালিয়ে গেলে কেমন হয় ? মা তো রাজি আছেনই , আমেনা রাজি থাকলেই হল । কাল
সকালেই গার্মেন্টস-এ যাবার কথা বলে আমেনা আর মাকে নিয়ে দেশের বাড়ি চলে
যাবে সোবাহান । আর আসবেনা ঢাকায় । আমেনাকে পেলে তার আর কিছু চাওয়ার নেই ।
কথাটা ভাবে আর মনে মনে হাসে সে । সকাল থেকে এই প্রথম হাসল সোবাহান ।
রিকশাও এখন সিগনালে আটকা পড়ে আছে । কাব্য হঠাৎ খেয়াল করে সে রিকশাওয়ালাকে
বলেইনি কোথায় যাবে । আর রিকশাওালাটাও কেমন ? সেও জিজ্ঞেস করেনি । যাক ,
তবু ঠিক রাস্তায়ই আছে । আচ্ছা , সিগনালটা পার হোক । তারপর বলা যাবে ।
কাব্যর খুব তাড়া । সাফা কি বাসায় আছে নাকি নেই ? ও থাকবে তো ? কাব্যকে
দেখে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকবেনা তো ? হুমম………তারমানে বাসায় গিয়েই আগে সরি
বলতে হবে । শুধু খালি হাতে বললে তো হবেনা । ফুল লাগবে , ফুল । ওই তো
রাস্তার ওপাড়ে ফুলের দোকান ।
ট্রাফিক পুলিশ সিগনাল ছেড়ে দেয় । সবার আগে সোবাহান রিকশা ছোটায় ।
কাব্যর মাথায় এখন শুধু সাফাকে পাওয়ার ইচ্ছা ।
সোবাহানের মাথায় এখন শুধু আমেনাকে পাওয়ার ইছা ।
দুজনের কেউই তাই খেয়াল করেনি বাম পাশ থেকে ওদের দিকে ছুটে আসা সিগনাল
অমান্য করা ট্রাকটিকে………………………
(মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলা করা বোধহয় লেখকের কাজ । আমি এখনও সে পর্যায়ের
খেলোয়াড় হইনি । তবু এখানে বড় একটা সাহসের কাজ করে ফেললাম । শেষ লাইনটার
আগ পর্যন্ত সব কিছু ভালই ছিল । কিন্তু লাইনটা না লিখে পারলাম না । আমি
দু;খিত । গতকাল সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি তারেক মাসুদসহ আরো কয়েকজনকে
। তাদের সবারই সপ্ন ছিল , আশা ছিল , কারো হয়ত ছোট্ট একটা সংসার ছিল ,
সদ্য হাটতে শেখা শিশু ছিল । কিন্তু নিয়তি তাদের ছাড়েনি । এখানের নিয়তির
দোষ দেবার আগে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে । সবার মত আমার মনেও একটাই প্রশ্ন
“ আর কতদিন আমরা নিজের পায়ে কুড়াল মারব ? ” গল্পটি তাদেরকে উৎসর্গ করছি ,
যাদের মুখগুলো আমাদের অসতর্কতার ফলে হারিয়ে গেছে । তাদের কাছে আমরা ঋণী
আজীবন । তারেক মাসুদ , আমাদের ক্ষমা করুন । )
বোকার মত একটা মরীচিকার পেছনে ছুটল ? নাহ , আসলেই একটা গাধা সে । সাতপাচ
ভাবতে ভাবতে বাসা থেকে বের হল কাব্য । প্রমিতির সাথে break-up হয়েছে গত
পরশুদিন । তাই কাল সারাদিন বাসা থেকে বের হয়নি । এখনো জ্বরটা ছাড়েনি
ঠিকমত । তবু বের হয়েছে সে । না , আর ভুল করে বসে থাকা যায়না । এই চারটা
মাস অনেক কষ্ট দিয়েছে সাফা কে ।
আর নয় । এখন যদি সাফার কাছে নিজের দোষ না
স্বীকার করা হয় , তবে সেটা খুবই বড় অপরাধ এবং নিঃসন্দেহে ভুল হবে । আর
ভুল করতে চায়না কাব্য । অনেক হয়েছে । আজ আর একটা বিহিত করতেই হবে । ভেবেই
বাসা থেকে বের হয়েছে কাব্য । মা দেখে বলেছেন না যেতে । কিন্তু এখন সে কথা
শোনার সময় নেই । এক মুহুর্তেরও অনেক দাম এখন । কোনমতে ফ্রেশ হয়েই সাফার
দেয়া শার্টটা পরে বের হল কাব্য ।
রাস্তায় কোন রিকশা পাওয়া গেলোনা । গরম ও পরেছে আজকে । ভাবতে ভাবতে মেইন
রোডে চলে আসল কাব্য । দূরে দেখা গেল এক রিকশাওয়ালা নিজের রিকশায় বসে চোখ
বুজে পড়ে আছে ।
-মামা , যাবা নাকি ?
-(চোখ খুলে বিরক্তির স্বরে)না মামা , মুড নাই ।
-মামা , নিয়ে যাওনা । না গেলে অনেক ঝামেলা হইয়া যাইব । চল মামা…………চল
সোবাহান মিয়ার মনটা আজকে এম্নিতেই একটু বেশিমাত্রার খারাপ । সকালে উঠেই
আম্মার কান্নাকাটি দেখেছে সে । সেই একটাই প্রলাপ তার-“আমার পোলাডা , কি
দোষ করছিল হ্যায় ? পোলাডার বিয়া না দেইখা মরতেও পারমুনা । ওরে আল্লাহ ,
তুমি এমন করলা ? ” ধুর , এক কথা শুনতে কত ভালো লাগে ? তাই কিছু না খেয়েই
বের হয়ে আসল সোবাহান । গ্যারেজে গিয়ে দেখে মহাজন জোরে হাক ছাড়ছেন
“সোবাহানডা গেল কই ? বিয়াশাদি কি আমরা করিনাই ? আমার বিয়ার লাইগা ২৫ খান
মাইয়া দেহাইসিল আমার মায় । আমি কি কামাই দিসিলাম ? নাহ । আর এই পোলাডা……”
আস্তে করে মহাজনের সামনে গিয়ে রিকশাটা নিয়ে বেরিয়ে পরল সোবাহান । কিছু
বলার নেই তার । মনে অশান্তি লেগে আছে । মহাজনকে দোষ দিয়ে লাভ কি ? সে তো
বলবেই । রিকশাটা নিয়েই সোজা বাবলা গাছটার নিচে আসল সোবাহান । এই গাছটা
তার অনেক প্রিয় । দুপুরে হয়রান হয়ে গেলে সে এখানে এসে বিশ্রাম নেয় । আজকে
সকাল সকালই চলে আসল । রিকশা চালানোর মুড নেই এখন । একপাশে সাইড করে রেখে
নিজেই আধশোয়া হয়ে থাকল । চোখ বুজে পড়ে থাকলে ভাল লাগে তার । মনে হয় এই
দুনিয়াতে আর কেউ নাই । শুধু সোবাহান আর তার লক্ষী হবু বউ আমেনা । কিন্তু
আজ আমেনাকে ভাবতে গিয়ে ঘেন্না চলে আসছে । মনে খালি একটাই প্রশ্ন আসতে
থাকল “ আমেনা , তুমি এইডা করতে দিলা কেমনে ? তোমার বাপরে ঠেকাইতে পারলানা
? কেমনে করলা এইডা তুমি ? ”
বেশিক্ষন ভাবতে পারলোনা সোবাহান । তার আগেই একটা ছেলে এসে অনুরোধ করতে
থাকল । সোবাহান ভালো মানুষ । মানুষের উপর কথা বলতে কষ্ট হয় তার । তবু বলল
“না মামা , মুড নাই”।
তাও ছেলেটা আবার মিনতি করল । নাহ , সোবাহানের ভাল
লাগছেনা আর । ছেলেটাকে জোরে একটা না বলতে গিয়েও থেমে গেল । কি যেন আছে
তার আকুতিতে । কিছু না বলেই নেমে পড়ল সোবাহান । ছেলেটা অনেক খুশি হয়ছে
বলে মনে হল , কিন্তু সেটা তার শুকনো মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই । কথা না
বাড়িয়ে রিকশা টানা শুরু করল সোবাহান ।
এত tension এর মধ্যেও শার্টটা পড়তে ভোলেনি কাব্য । ভুলবে কি করে ? সাফা
তো আর কোন সাধারন মেয়ে নয় , সেই বাচ্চাকাল থেকে বন্ধু তারা । আসলে বন্ধু
বললে সাফাকে ছোট করা হবে । সাফাই ছিল তার সব । যে কোন কাজ তারা একসাথে
করত । নতুন মুভি বের হলে দুজনের সেটা একসাথে দেখা চাই । কোন কন্সার্টে
গেলে পাশাপাশি টিকেট দুটো তাদের হওয়া চাই । ঈদে একজন কাল ড্রেস কিনলে
আরেকজনেরও কাল ড্রেস চাই । কিন্তু হঠাৎ করে কি হয়ে গেল সাত মাস আগে
স্কুলে নতুন মেয়েটা আসাতে । মেয়েটার নাম প্রমিতি । ক্লাস নাইনের
top-ranked সুন্দরীদের তালিকায় সাফার সাথে তারও নাম উঠল । কিছুদিনের
মধ্যেই সে সাফার অনেক ভাল বন্ধু হয়ে গেল । আর কাব্য ? কিভাবে যেন
প্রমিতির প্রেমে পাগল । কোথাও গেলে এখন তিনজন একসাথে যায় । এভাবেই
প্রমিতির সাথে কাব্যর ভাল সম্পর্ক হতে থাকে । ব্যাপারটা সাফা বুঝত ,
কিন্তু কিছু বলত না । আর কাব্য , গাধার মত সাফার সামনেই প্রমিতির যত রকম
প্রশংসা করতে ব্যস্ত । আস্তে আস্তে সাফা চুপ হয়ে যেতে থাকল । কাব্য সেটা
খেয়াল করলেও তেমন একটা মাথায় নিতোনা । তার মাথায় তখন প্রমিতি আর প্রিমিতি
। রাত জেগে প্রমিতির সাথে কথা বলা , টিফিনের সময় প্রমিতির সাথে বসা ,
স্কুল শেষে প্রমিতিকে নিয়ে বের হওয়া , এসব চলতে থাকল । সাফা এসব দেখতে
দেখতে এক্সময় চুপ হয়ে গেল । সে শুধু একা একা থাকে আর নিরবে চোখের পানি
ফেলে । কিভাবে বোঝাবে সে কাব্যকে চায় ? অসহায় সাফা তাই কাব্যর সাথে মেশা
বন্ধ করে দেয় । শুধু ক্লাসে যায় আর বাসায় ফেরে । কাব্য সাফাকে কোথাও
যাবার আগে ডাকে , কিন্তু সাফা কোনভাবে কেটে পড়ে । ব্যাপারটা ক্লাসে সবাই
খেয়াল করল । কারন কাব্য-সাফা জুটি তাদের কাছে ছিল একটা আদর্শ । কিন্তু সে
বন্ধনে ভাঙ্গন দেখে অনেকেই সহ্য করতে পারলোনা । একদিন কয়েকজন বন্ধু মিলে
কাব্যকে ডেকে বলল সব । কথাগুলো শুনে কাব্য যে ব্যবহার করল সেটা কেউ আশা
করেনি । তখনি সবার বোঝা হয়ে গিয়েছে , কাব্য আর আগের মত নেই । তিন মাসে
কাব্য পালটে গেছে ।
এদিকে কাব্য এসব শুনে হুট করেই প্রমিতির সাথে রিলেশন শুরু করল । তার
উদ্দেশ্য বন্ধুদের দেখিয়ে দেয়া – সে ভাল আছে । কথাটা সাফার কানে গেল ।
সাফা আগে থেকেই খারাপ কিছুর জন্য তৈরি ছিল । তবু খবরটা বড়সড় একটা ধাক্কা
দিল মেয়েটাকে । বাসায় গিয়ে অনেক্ষন কাদল সাফা । কিন্তু তবু সে কাব্যকে
ভুলতে পারছেনা । কাব্যকে ভুলতেই হবে । নইলে সাফার বেচে থাকা কষ্টকর হয়ে
যাবে । এই ভেবে সে স্কুলে আসা বন্ধ করে দ্দিল । আর এদিকে কাব্য প্রমিতিকে
নিয়ে ব্যস্ত । ব্যস্ততা খুব বেশিদিন যায়নি , তার আগেই কাব্য টের পাওয়া
শুরু করল সাফা আর প্রমিতির মাঝে ব্যবধান । প্রমিতি আর আগের মত নেই , সে
এখন কাব্যর সবকথায় খুত ধরে , খবরদারি ফলাতে চায় । সাফার মত নয় সে , বরং
কিছুটা উল্টোই । এভাবে চার মাস কেটে গেছে । হঠাৎ গত পরশুদিন কি একটা বিষয়
নিয়ে কাব্যর সাথে প্রমিতির সাথে ঝগড়া হচ্ছিল । এক পর্যায়ে প্রমিতি বলে
ওঠে “ এত যখন সমস্যা তোমার , তাহলে আমার সাথে রিলেশন করেছ কেন ? যাও ,
সাফার কাছে যাও ! ” কথাটা কাব্যর খুব লেগেছিল ,কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল
প্রমিতি ঠিকই বলেছে । আসলেই ভুল ছিল এতদিন । কথাটা ভেবে কাব্য সোজা
প্রমিতিকে বলে এসেছে “ আমাকে ভুলে যাও।” তারপর সোজা বাসায় । টানা একদিন
বাসা থেকে বের হয়নি কাব্য । এর মাঝে প্রমিতি একবারের জন্যেও ফোন দেয়নি ।
বন্ধুর কাছ থেকে জানা গেল প্রমিতি সবাইকে বলেছে কাব্যর সাথে যা ছিল সব
ছিল মিথ্যা । শুনে কিছুটা খুশিই হল কাব্য । রাতে সাফার কথা ভেবে
দীর্ঘশ্বাস ফেলল । নাহ , অনেক ভুল করেছে সে । আর নয় । এই ভেবেই সকাল সকাল
সাফার বাসা দিকে রওনা দিয়েছে কাব্য ।
সোবাহান মিয়া রিকশা চালাচ্ছে আর ভাবছে । আমেনা তার এলাকার মতিন চাচার
মেয়ে । আমেনাকে তার অনেক ভাল লাগে । আমেনাও সোবাহানকে পছন্দ করে ।
শুক্রবার হলেই তারা হলে সিনেমা দেখতে যায় । সবকিছুই ভালমত যাচ্ছিল ।
সোবাহানের মা ছেলেকে বিয়ে দেবার জন্য ভাবছিলেন । তখন সে আমেনার কথা খুলে
বলে । সোবাহানে মাও আমেনাকে আগে থেকেই পছন্দ করেন । তাই ছেলের মুখের কথা
শুনে তিনি আমেনার বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠান । কিন্তু আমেনার বাবা প্রথমে
সায় দিলেও পরে বেকে বসেন । তার একটাই কথা “ পোলার ভিটা আছে বুঝলাম ,
কিন্তু শুধু ভিটা থাকলেই কি চলব ? জমিরেরও তো বাপের ভিটা আছে , তাইলে
তফাৎ কি হইল ? সোবাহানের কি জমিরের মতন দুইডা রিশকা আছে ? অর নিজের তো
এহন একখান রিশকাও নাই । আমার মাইয়ারে আমি ক্যান দিমু ?” কথাটা ভাবে আর
ক্ষনে ক্ষনে দু;খ পায় সোবাহান “ হায়রে দুনিয়া , ভালোবাসার দাম কি উইডা
গেছে আসমানে?” প্রতিদিন সকালে মায়ের এক প্যাচাল ভালো লাগেনা তার । কিছু
একটা বিহিত করতেই হবে । আমেনাকে ছাড়া বাচবেনা সে । ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুম
হয়না সোবাহানের । আবার সকালে মায়ের কান্নাকাটি শুনে সোবাহান সিদ্ধান্ত
নিয়ে ফেলে আমেনাকে তার চাই ই চাই । হয় আমেনা তার হবে , না হয় মরবে সে ।
রিকশা চালাতে চালাতে মাথায় একটা বুদ্ধি আসে । আচ্ছা , আমেনাকে নিয়ে
পালিয়ে গেলে কেমন হয় ? মা তো রাজি আছেনই , আমেনা রাজি থাকলেই হল । কাল
সকালেই গার্মেন্টস-এ যাবার কথা বলে আমেনা আর মাকে নিয়ে দেশের বাড়ি চলে
যাবে সোবাহান । আর আসবেনা ঢাকায় । আমেনাকে পেলে তার আর কিছু চাওয়ার নেই ।
কথাটা ভাবে আর মনে মনে হাসে সে । সকাল থেকে এই প্রথম হাসল সোবাহান ।
রিকশাও এখন সিগনালে আটকা পড়ে আছে । কাব্য হঠাৎ খেয়াল করে সে রিকশাওয়ালাকে
বলেইনি কোথায় যাবে । আর রিকশাওালাটাও কেমন ? সেও জিজ্ঞেস করেনি । যাক ,
তবু ঠিক রাস্তায়ই আছে । আচ্ছা , সিগনালটা পার হোক । তারপর বলা যাবে ।
কাব্যর খুব তাড়া । সাফা কি বাসায় আছে নাকি নেই ? ও থাকবে তো ? কাব্যকে
দেখে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকবেনা তো ? হুমম………তারমানে বাসায় গিয়েই আগে সরি
বলতে হবে । শুধু খালি হাতে বললে তো হবেনা । ফুল লাগবে , ফুল । ওই তো
রাস্তার ওপাড়ে ফুলের দোকান ।
ট্রাফিক পুলিশ সিগনাল ছেড়ে দেয় । সবার আগে সোবাহান রিকশা ছোটায় ।
কাব্যর মাথায় এখন শুধু সাফাকে পাওয়ার ইচ্ছা ।
সোবাহানের মাথায় এখন শুধু আমেনাকে পাওয়ার ইছা ।
দুজনের কেউই তাই খেয়াল করেনি বাম পাশ থেকে ওদের দিকে ছুটে আসা সিগনাল
অমান্য করা ট্রাকটিকে………………………
(মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলা করা বোধহয় লেখকের কাজ । আমি এখনও সে পর্যায়ের
খেলোয়াড় হইনি । তবু এখানে বড় একটা সাহসের কাজ করে ফেললাম । শেষ লাইনটার
আগ পর্যন্ত সব কিছু ভালই ছিল । কিন্তু লাইনটা না লিখে পারলাম না । আমি
দু;খিত । গতকাল সড়ক দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি তারেক মাসুদসহ আরো কয়েকজনকে
। তাদের সবারই সপ্ন ছিল , আশা ছিল , কারো হয়ত ছোট্ট একটা সংসার ছিল ,
সদ্য হাটতে শেখা শিশু ছিল । কিন্তু নিয়তি তাদের ছাড়েনি । এখানের নিয়তির
দোষ দেবার আগে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে । সবার মত আমার মনেও একটাই প্রশ্ন
“ আর কতদিন আমরা নিজের পায়ে কুড়াল মারব ? ” গল্পটি তাদেরকে উৎসর্গ করছি ,
যাদের মুখগুলো আমাদের অসতর্কতার ফলে হারিয়ে গেছে । তাদের কাছে আমরা ঋণী
আজীবন । তারেক মাসুদ , আমাদের ক্ষমা করুন । )
No comments:
Post a Comment