ডাকাত নাকি?

সুকুমার রায়
হারুবাবু সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরছেন। স্টেশন থেকে বাড়ি প্রায় আধ মাইল দূর, বেলাও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হারুবাবু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলছেন। তাঁর এক হাতে ব্যাগ, আর এক হাতে ছাতা।
চলতে চলতে হঠাৎ তাঁর মনে হল, কে যেন তাঁর পিছন পিছন আসছে। তিনি আড়চোখে তাকিয়ে দেখেন, সত্যি সত্যি কে যেন ঠিক তাঁরই মতন হন্‌হনিয়ে তাঁর পিছন পিছন আসছে। হারিবাবুর মনে কেমন যেন ভয় হল— চোর ডাকাত নয়তো! ওরে বাবা! সামনের ঐ মাঠটা পার হবার সময় একলা পেয়ে যদি হঠাৎ ঘাড়ের উপর দু’চার ঘা লাঠি কষিয়ে দেয় তাহলেই ত গেছি! হারুবাবুর রোগা রোগা হাত পা দু’টো কাঁপতে কাঁপতে ছুটতে লাগল। কিন্তু লোকটাও যে সঙ্গে সঙ্গে ছোটে!
তখন হারুবাবু ভাবলেন, সোজা মাঠের উপর দিয়ে গিয়ে কাজ নেই। বড় রাস্তা দিয়ে বদ্যিপাড়া ঘুরেই যাওয়া যাক, না হয় একটু হাঁটাই হল। তিনি ফস্‌ ক’রে ডানদিকের একটা গলির ভিতর ঢুকেই বক্সীদের বেড়া টপকিয়ে একদৌড়ে বড় রাস্তায় গিয়ে পড়লেন। ওমা! সে লোকটাও কি দুষ্টু, সেও দেখাদেখি ঠিক তেমনি ক’রে বেপথ দিয়ে বড় রাস্তায় এসে হাজির!
হারুবাবু ছাতাটাকে বেশ শক্ত ক’রে আঁকড়ে ধরলেন— ভাবলেন, যা থাকে কপালে, কাছে আসলেই দু’চার ঘা কষিয়ে দেব। হারুবাবুর মনে পড়ল, ছেলেবেলায় তিনি জিমনাস্টিক করতেন— দু’তিনবার তিনি হাতের ‘মাসল’ ফুলিয়ে দেখলেন এখনও শক্ত হয় কিনা।
আর একটু সামনেই কালিবাড়ি। হারুবাবু তার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ রাস্তা ছেড়ে ঝোপজঙ্গল ভেঙে প্রাণপণ ছুটতে লাগলেন। পিছনে পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পারলেন যে, লোকটাও সঙ্গে সঙ্গেই ছুটছে! এ কিন্তু ডাকাত না হয়ে যেতেই পারে না! হারুবাবুর হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল, কপালে বড় বড় ঘামের ফোঁটা দেখা দিল। এমন সময় হঠাৎ শোনা গেল, সামনে ঘাটের পাশে বসে কারা যেন গল্প করছে।
শুনবামাত্র হারুবাবুর মনে সাহস হল। তিনি ধাঁ ক’রে ছাতা বাগিয়ে সিংহবিক্রমে ফিরে বললেন, “তবে রে! আমি টের পাইনি বুঝি? ভালো চাস ত—” কিন্তু লোকটির চেহারা দেখে হঠাৎ তাঁর বক্তৃতার তেজ কমে গেল। অত্যন্ত নিরীহ রোগা ভালোমানুষ গোছের লোকটি— ডাকাতের মতো একেবারেই নয়!
হারুবাবু তখন একটু নরম মতো ধমক দিয়ে বললেন— “খামখা আমার পেছন পেছন ঘুরছ কেন হে?” লোকটি অত্যন্ত ভয় পেয়ে আর থতমত খেয়ে বলল, “স্টেশনের বাবুটি যে বললেন, আপনি বলরামবাবুর পাশের বাড়িতেই থাকেন, আপনার সঙ্গে গেলেই ঠিকমতো পৌঁছব।— তা আপনি কি বরাবর এইরকম ক’রে বেঁকেচুরে চলেন নাকি?” হারুবাবু ঠিক এক মিনিট হাঁ ক’রে তাকিয়ে থেকেও বলবার মতো কোনো জবাব খুঁজে পেলেন না। কাজেই ঘাড় হেঁট ক’রে আবার সোজা পথে বাড়ি ফিরে চললেন।