(সংকেত: ভূমিকা; অবস্থান; ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট; পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা পরিচিতি; বান্দরবান জেলা; রাঙ্গামাটি জেলা; খাগড়াছড়ি জেলা; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম; পার্বত্য জেলার পর্যটনস্থানসমূহ; পর্যটনশিল্প ও পার্বত্য চট্টগ্রাম; পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি; উপসংহার।)
ভূমিকা:
রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, রূপের যে তার নাইকো শেষ।’
-সতেন্দ্রনাথ দত্ত
অবস্থান: পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম বিভাগের ৩টি জেলা নিয়ে গঠিত যথা- রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলা। এর পূর্বে মায়ানমার, উত্তরে ভারত এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার বা ৫ হাজার ১৩০ বর্গমাইল।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: পার্বত্য চট্টগ্রামের অপর নাম জম্মু ল্যান্ড। ১৮৬০ সাল পর্যন্ত এটি ‘করপেশ মহল’ নামে পরিচিত ছিল। এরপর ব্রিটিশরা শাসনের সুবিধার্থে বাংলার সাথে একে সংযুক্ত করেন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য জেলাকে ভেঙ্গে ৩টি আলাদা জেলা তৈরি করেন। বর্তমানে এই তিনটি জেলা আধা সায়ত্ত্বশাসনের মর্যাদা ভোগ করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা পরিচিতি:
বান্দরবান জেলা: বান্দরবান জেলার আয়তন ৪ হাজার ৪৭৯ বর্গ কিলোমিটার। ৭টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বান্দরবান জেলার উত্তরে রাঙ্গামাটি, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও মায়ানমার, পূর্বে মায়ানমার, পশ্চিমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা। মাতামুহুরী, শঙ্খ, রানখিয়াং বান্দরবানের প্রধান নদী। বান্দরবানের উল্লেখযোগ্য দর্শণীয় স্থান হলো বোমাংরাজার বাড়ি, বান্দরবান পাহাড়িয়া এলাকা, রিজুক জল প্রপাত, বাকতাই ও পুকুরপাড়া ঝরণা, বিজয়, কেও ক্রাডং ও চিম্বুক পাহাড়। ঢাকা থেকে সড়ক পথে বান্দরবান জেলার দূরত্ব ৩৩৮ কিলোমিটার।
রাঙ্গামাটি জেলা: রাঙ্গামাটি জেলার উত্তরে খাগড়াছড়ি, দক্ষিণে বান্দরবান, পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা। আয়তন ৬ হাজার ১১৬ বর্গকিলোমিটার। ১০টি উপজেলা নিয়ে গঠিত রাঙ্গামাটি জেলা। কর্ণফুলী শঙ্খ, শশালং রাঙ্গামাটি জেলার উল্লেখযোগ্য নদী। রাঙ্গামাটির উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হলো সবুজ পাহাড়, চাকমা রাজার বাড়ি, ঝুলন্ত সেতু, আঁকাবাঁকা পাহাড়ী লেক, কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হার্ডবোর্ড মিল, চন্দ্রঘোনা কাগজ কল, হ্রদ, ঝর্ণা এবং বনাঞ্চল ইত্যাদি। ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটি জেলার দূরত্ব ৩২৮ কিলোমিটার।
খাগড়াছড়ি জেলা: খাগড়াছড়ি জেলাটির উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিণে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও ভারতের ত্রিপুরা। খাগড়াছড়ি জেলার আয়তন ২ হাজার ৬৯৯ বর্গ কি. মি.। ৮টি উপজেলা নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা গঠিত। হালদা, মাইনী, বিংগ্রি, ছিংড়ী খাগড়াছড়ির উল্লেখযোগ্য নদী। খাগড়াছড়ির উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হলো মানিকছড়ির মগরাজার বাসস্থান, রামগড় চাবাগান, বৌদ্ধবিহার, বিডিআরের জন্ম স্মৃতি ভাস্কর্য, সৌন্দর্যের লীলাভূমি আলুটিলা।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম: বাংলাদেশে মোট ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোক রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ যা মোট জনসংখ্যার ১.০৮ ভাগ (প্রায়)। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমাদের সংখ্যা বেশি, সবচেয়ে কম খুমি ও চক নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা। পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা দেশের মোট ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনসংখ্যার শতকরা ৫৩ ভাগ। বৈসাবি অর্থাৎ বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব।
পার্বত্য জেলার পর্যটন স্থানসমূহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা অবারিত সৌন্দর্যের আধার হিসেবে খ্যাত সবার কাছে। রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদ এখানকার প্রধান আকর্ষণ। এই হ্রদের চারদিকে সবুজ ঘেরা পাহাড়, নীলাভ পানি এবং হ্রদের ধারে ছোট ছোট টিলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের কাছে অনাবিল আনন্দ উপভোগের এক মোহনীয় স্থানে রূপান্তরিত করেছে। বান্দরবানে অবস্থিত দেশের সর্বোচ্চ পাহাড় বিজয় যার উচ্চতা ১২৩০ ফুট এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড়ও বান্দরবনে অবস্থিত যা পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম স্থান হিসেবে খ্যাত। এখানে বৌদ্ধ বিহার ও চাকমা রাজার রাজবাড়ি অন্যতম দর্শণীয় স্থান। খাগড়াছড়ির বনভূমি, পাহাড় ও প্রাকৃতিক ঝরণা, বান্দরবানের মেঘতা, শৈলপ্রপাত, নীলগিরি ও নীলাচল পর্যটন স্পট এবং মাতামুহূরী নদী ইত্যাদি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষনীয় সব নান্দনিক দর্শনীয় স্থান।
পর্যটন শিল্প ও পার্বত্য চট্টগ্রাম: প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনাময় দেশ বাংলাদেশ। এদেশে ছড়িয়ে আছে অপরিমেয় সৌন্দর্য। প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক সব সম্পদেই সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার এ বদ্বীপ। প্রতিবছর হাজারো পর্যটক আসেন এদেশে। দেশি-বিদেশি পর্যটকের সারা বছরই আনাগোনা থাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ঘেরা অঞ্চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে ১৯৯১ সালে পর্যটন খাত থেকে আয় হয়েছিল ২৪৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ২০০৮ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬১২ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। বাংলাদেশের জিডিপি’র ২ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। ২০১২ সালে মোট জিডিপি’র ৪.৩ শতাংশ এসেছে এ খাত থেকে। টাকার অংকে এটা প্রায় ৩৯ কোটি আশি হাজার টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন মার্কেটের একটি হিসেবে ধরা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে বসবাসকারী সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের লোক সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিদের সাথে বাংলাদেশে সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং উপজাতিদের পক্ষে শান্তিবাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা।
উপসংহার: পাহাড় পর্বত ঘেরা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির সবুজ বনানীর অপরূপ সৌন্দর্য সকলের মনকে উচাটন করে দেয়। ছোট বড় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ী নদী, ঝরণা আর হ্রদের অপার নান্দনিকতা যেকোনো মানুষকে বারবার হাতছানি দেয়। পাহাড়ি উপজাতিদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রার বর্ণাঢ্যতা মুগ্ধ করে সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটকদের। বাংলাদেশের গর্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়-
পৃথিবীর রূপ খুজিতে যাই না আর।’