(সংকেত: ভূমিকা; চেতনা কী; যার জন্য মুক্তিযুদ্ধ; কামনায় স্বর্গরূপী মাতৃভূমি; মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট; ভাষা আন্দোলন-চেতনার প্রথম সোপান; মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী চেতনা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধ; সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিসর; বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; চেতনার পরিস্ফুটন; উপসংহার।)
ভূমিকা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো একটা বীজ। বঙ্গজননী সে বীজ বুনে দিয়েছে প্রত্যেকটি দামাল ছেলের পাগল বুকে। এই পাগলদের বুকেই সেই বীজের অঙ্কুরোদগম থেকে বেড়ে ওঠা। এটি তাদের শিখিয়েছে কেমন করে আলো ছড়াতে হয় আর সে আলোর পথে হাত ধরে চলতে হয়। কেমন করে এই বীজ বপণকারী বঙ্গজননীর প্রতি বাড়িয়ে দেয়া কালো হাত গুঁড়িয়ে ফেলতে হয়। এই হলো চেতনা। এ চেতনা মন্ত্র শেখায়, মন্ত্রে দীক্ষা দেয়। সে মন্ত্র বিষমন্ত্র, সে মন্ত্র বারুদ ছাড়াই আগুন জ্বালায় মুক্তিপাগলদের বুকে, চোখে। এ চেতনা সকলকে একই ধ্যানের মৃণাল ধরে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে।
চেতনা কী: যে অনুভূতি, যে শক্তি মনে থাকলে দেশকে মুক্ত করার জন্য বুক তোলপাড় করে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরাতে কুন্ঠা জাগেনা, হাসিমুখে জীবনদানেও প্রাণ কাঁপে না, সে অনুভূতি, সে শক্তিই চেতনা। এই চেতনার সুর বেসুর তালে বাজে না। একই সুরের মুর্ছনায় চেতনার সুর মুর্ছিত হয়। একই হুংকারের ঝংকারে আকাশ কাঁপিয়ে প্রতিপক্ষের ঔদ্ধত্যকে গুঁড়িয়ে দেয় নিমিষেই। কর্ণকুহরে একই স্বপ্নের সুললিত সংগীত শুনতে শুনতে, অগ্নিঝরা চোখে প্রতিশোধ স্পৃহার স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে জন্ম নেয় এ চেতনা। আবালবৃদ্ধবণিতা যখন একই পতাকার ছায়ায় জড়ো হয়ে শপথ নেয় সে পতাকার সম্মান রক্ষার জন্য তখন তাই হয় চেতনা। এই চেতনার রঙে রঙিন হয়ে বাঙালি মায়ের মুক্তিপাগল ছেলেগুলো মুক্তিযুদ্ধে জয় করেছিল বিজয়-শিরোপা।
যার জন্য মুক্তিযুদ্ধ: অফুরন্ত শ্যামলিমার চাদরে ঘেরা এক অনিন্দ্যসুন্দর ভূমিখন্ডে বাস করি আমরা। দিনে সবুজের ঢেউ-দোলানো নৃত্য, রাতে আলো-আধারির লুকোচুরি মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয় আমাদের। ঘুঘু-ডাকা ক্লান্ত দুপুরে যখন ঘর্মাক্ত কৃষক ফসলের মাঠে তাকায়, তখন ক্লান্তি আর ক্লান্তি থাকে না। দোয়েলের চিরচেনা সুর মনে করিয়ে দেয়, এ তোমার প্রিয় দেশ। বড় মমতার সে দেশ। একদিন একদল বুনো শকুন ভুলের বশবর্তী হয়ে এই মমতার আঁচল ধরে টান দিয়েছিল খুবলে ছেঁড়ার কামনায়। কিন্তু এই মমতার আঁচল জড়িয়ে ঘুমিয়েছে যে বাঙালি, তারা বড় বেশি লোভী। সে লোভ মমতার সেই আঁচল জড়িয়ে চিরদিন ঘুমিয়ে থাকার। সেজন্যই তারা ঐ শকুনের ছোবল থেকে এই দেশকে মুক্ত করার জন্য হয়েছিল মরিয়া। দেশমাতৃকার জন্য এই চেতনাই মুক্তির নেপথ্য শক্তি।
কামনায় স্বর্গরূপী মাতৃভূমি: যখন মাতৃভূমির বুকে থাকি তখন মনে হয় মায়ের বুকে আছি। পৃথিবীর সকল কষ্টপীড়ার সামনে ঢাল সে বুক। বড় প্রশস্ত, সবুজ আর কাদা-মাটি-জলে মাখামাখি সে বুক। তৃষ্ণায় সে শীতল পরশ বুলিয়ে দেয়। তৃপ্তির মাঝে আরও বেশি তৃপ্তি এনে দেয় , সুখের মাঝে আরও বেশি সুখ। মর্ত্যরে মাঝে স্বর্গরূপী এই দেশের রূপরস-মধুর লোভে সেই প্রাচীনকাল থেকেই লালায়িত ছিল পর্তুগীজ, মারাঠা, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, তুর্কী, মোঘল, ইংরেজ প্রভৃতি জাতি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট: ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের উপর থেকে ইংরেজদের কালো ছায়া চলে গেলেও বাংলার ভাগ্যাকাশ মেঘমুক্ত হয়নি। সে আকাশে ছায়া পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানি নামে আর একদল কসাইয়ের। ওরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ, যৌক্তিক-অযৌক্তিক উপায়ে শাসনের মোড়কে পেঁচিয়ে শোষণ করে গেছে বছরের পর বছর ধরে। ২৪ বছরের শোষণ-বঞ্চনার জাল ছিড়ে বাঙালি জাতি বেরিয়ে আসতে চায় ১৯৭১ সালে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তান। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে বাঙালি স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়।
ভাষা আন্দোলন- চেতনার প্রথম সোপান: ১৯৪৭ সালের অযৌক্তিক দ্বি-জাতিতত্ত্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দেয়, যা পূর্ব পশ্চিম-দুই খন্ডে বিভক্ত ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে সব দিক থেকে স্বেচ্ছাচারিতা আর বঞ্চনার শিকার হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ। এই বঞ্চনার প্রথম চিত্র তারা এঁকে দেয় মাতৃভাষার বুকে। তারা বাংলাকে প্রতিস্থাপিত করতে চায় উর্দু ভাষার মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে রফিক, শফিউর, বরকত, সালাম, জব্বার প্রমুখ নামে একঝাঁক প্রাণবন্ত তরুণের প্রাণের তেজে ঝলসে যায় তাদের সে চাওয়া। বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী চেতনা: ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের অভাবনীয় বিজয়, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবী, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা-সব মিলিয়ে অসাধারণ এক চেতনার সৃষ্টি করে। সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সত্ত্বেও পশ্চিমারা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানার আশ্রয় নিলে সে চেতনা উষ্ণতায় ভরে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধ: সকল বঞ্চনায় বঞ্চিত হতে হতে ১৯৭১ এ এসে বাঙালি পুরোপুরি রুখে দাঁড়ায়। তাদের শাশ্বত অবদমিত মনোবলকে ভেঙে দিতে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ নিকষ কালো রাতে পশ্চিমা নরপিশাচগুলো হামলে পড়ে ঘুমে বিভোর নিষ্পাপ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। শুরু হয় বাঙালির ঝড়ো হাওয়া আর পশ্চিমাদের উড়ে যাওয়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। এই ঘোষণা সারা দেশকে নামিয়ে আনে রণক্ষেত্রে। পরিপূর্ণ বিজয় পাবার আগ পর্যন্ত বাঙালি শক্ত হাতে ধরে রেখেছে স্টেনগান, বুকে ধরে রেখেছে চেতনা, আর অগ্নিঝরা চোখে বিছিয়ে রেখেছে স্বাধীন বাংলার রঙিন ক্যানভাস। সে ক্যানভাসে প্রকৃতি আর রক্তের আঁচড়ে লাল-সবুজ পতাকা আঁকতে আঁকতে একদিন ভোর হলো। পরাধীন বাঙালি দেখল স্বাধীনতার সূর্যোদয়। তিরিশ লাখ শহিদ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত দিয়ে কেনা সে সূর্যোদয়।
সাহিত্য সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে, চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রচিত কবিতা ও গান যোদ্ধাদের মনের শক্তি অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চেতনায় লাগিয়ে দিয়েছে নতুন রং, উদ্দীপনার মাঝে দিয়েছে নতুন গতি। রক্তের মাঝে জাগিয়েছে আলোর নাচন। তেমনি বর্তমানের সাহিত্য সংস্কৃতির একটা বড় অংশ জুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিসর: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এমন এক চেতনা, জীবনের সবগুলো ক্ষেত্র জুড়ে যার ব্যাপ্তি। ব্যক্তি-স্বাধীনতা, নারীমুক্তি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সাম্য, অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সবক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হলে দেশের উন্নয়নের ধারা আর পিছিয়ে পড়বে না। একাত্তরের বিজয়ের মতোই জীবনের প্রতিক্ষেত্রে বাজবে বিজয়ের ঘন্টাধ্বনি।
বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ বাঙালি আত্মোৎসর্গ করেছে। এক অনন্যসাধারণ স্বপ্ন বুকে নিয়ে। সে স্বপ্ন সুখী, সমৃদ্ধ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু অনুতাপের বিষয় হলো যে, শহিদদের সে স্বপ্ন আজ স্বপ্নভঙ্গের পথে। যে চেতনাবোধের আলো চোখে জ্বালিয়ে তারা পথ চলেছিল, আমরা সে আলোর পথ থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছি। সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্য, অর্থনৈতিক-সামাজিক বৈষম্য, রাজনৈতিক নৈরাজ্য, বেকারত্ব, আর অশিক্ষা-কুশিক্ষার চটেপাঘাতে ধ্বসে পড়ছে সার্বিক উন্নয়নের দেয়াল। এই পরিস্থিতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত তীরে অবস্থান করে।
চেতনার পরিস্ফূটন: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপেক্ষা আমাদের জাতীয় জীবনের মসৃন পথচলাকে ব্যাহত করে, রুদ্ধ করে দেয় সকল উন্নয়নের দুয়ার। তাই জীবনাকাশের সাদা-কালো মেঘের ভাঁজে ভাঁজে মেলে দিতে হবে সে চেতনার ডানা। দেশের প্রতিটি কাজে অতি যত্নে ছড়িয়ে দিতে হবে দেশপ্রেমের রং। তাহলেই সে চেতনা আবার ফুটবে, বিকশিত হবে নিবিড় পরিচর্যায়।
উপসংহার: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অপার মহিমামন্ডিত এক চেতনা। এই চেতনাকে প্রতিটি নাগরিকের বুকে পরম মমতায় লালন করা উচিত। বিশাল সম্ভাবনার এক অপরূপ লীলাভূমি বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ কালিমামুক্ত করে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া দিতে এই চেতনার বিকল্প নেই।