(সংকেত: ভূমিকা; সুনামির পরিচয়; ভূমিকম্প ও সুনামি; সুনামি সৃষ্টির কারণ; সুনামির ইতিহাস; সুনামির চরিত্র/বৈশিষ্ট্য; সুনামি ২০০৪; সুনামিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ; সুনামির পূর্বাভাস; সুনামি প্রতিরোধে করণীয়; উপসংহার।)
ভূমিকাঃ সুনামি প্রাকৃতিক দুর্যোগের এক নতুন মাত্রার নাম। নিশ্চুপ, নীরব বিভীষিকাময় এই সুনামি। আসে ঝঞ্ঝার বেগে, পলকেই লন্ড-ভন্ড করে দেয় জনপদ, সভ্যতা, নাগরিক জীবন। অপ্রতিরোধ্য ও নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সারা পৃথিবীতেই এখন বহুল আলোচিত বিষয় সুনামি। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সকাল ৭টায় দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আঘাত হানে গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এশিয়া ও আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চলের ১২টি দেশ। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও ভারতের পূর্ব উপকূলীয় বিশাল এলাকা। আমাদের কাছে সুনামি অতিসাম্প্রতিক বিষয় হলেও এর ইতিহাস নতুন নয়। বহু শতাব্দী আগেও সুনামির বিস্তার ছিল বলে প্রাচীন ভূ-তাত্ত্বিক ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে।
সুনামির পরিচয়ঃ সুনামি একটি জাপানি শব্দ। ইংরেজিতে যার উচ্চারণ Soo-nam-ee. Tsunami এর আভিধানিক অর্থ-পোতাশ্রয়ের ঢেউ বা খুব লম্বা কম্পমান সমুদ্রের ঢেউ। সমুদ্র বিজ্ঞানের পরিভাষায় সুনামি হলো ভূমিকম্পজনিত সামদ্রিক ঢেউ। সমুদ্রের নিচে সৃষ্ট প্রবল ভূমিকম্পের ফলে যে উত্তাল ঢেউ সৃষ্টি হয় সেই ঢেউকেই সুনামি বলে। উৎপত্তিস্থলে ঢেউয়ের উচ্চতা কম হলেও উপকূলের দিকে অগ্রসর হতে হতে এর উচ্চতা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। একটি ঢেউ থেকে আরেকটি ঢেউ স্বাভাবিক তরঙ্গের চেয়ে কয়েকগুন বেশি হয়ে থাকে। সুনামির ভয়াবহতা নির্ভর করে সাগরের গভীরতার উপর। গভীরতা ভেদে সুনামির গতিবেগ ৫০০ মাইল পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ভূমিকম্প ও সুনামিঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভূমিকম্প থেকে সৃষ্টি হয় সুনামির। কাজেই ভূমিকম্প সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান সুনামির আগাম বার্তা দিয়ে রক্ষা করতে পারে হাজারো জীবন। ভূমিকম্প হলো ভূ-অভ্যন্তরে সংগঠিত আকস্মিক কম্পন। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, পৃথিবীতে বছরে প্রায় ১০ লক্ষ ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। আর এর বেশিরভাগই সংগঠিত হয় সমুদ্রতলে। সমুদ্রতলে সংগঠিত বড় মাত্রার ভূমিকম্প ভূত্বকে বড় ধরণের পরিবর্তন আনে। উপকূলে সৃষ্টি হয় বড় ধরণের জলোচ্ছ্বাস। ভূ-তত্ত্ববিদগণ এ জলোচ্ছ্বাসের নাম দিয়েছেন সুনামি।
সুনামি সৃষ্টির কারণঃ সুনামি সৃষ্টির প্রধান কারণ ধরা হয়েছে সমুদ্রের তলদেশে সংগঠিত বড় মাত্রার ভূমিকম্পকে। এই ভূমিকম্পের ফলে টেকটনিক প্লেট বা সমুদ্রের বিশাল ভূ-স্তরে ফাটল দেখা দেয়। এছাড়া সাগরতলের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির অকম্মাৎ অগ্নুৎপাত কিংবা গভীর সমুদ্রে আছড়ে পড়া গ্রহাণূ বা বড় ধরণের উল্কা সুনামি সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ভূ-স্তরের একটি তল নিচে ও আরেকটি তল উপরে উঠে যায়। এটি সুনামি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। টেকটনিক প্লেটের এ আকস্মিক উঠানামা সমুদ্রের জলরাশিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে এবং সুনামি ঘটায়।
সুনামির ইতিহাসঃ আমাদের কাছে নতুন হলেও সুনামি নতুন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৬১০০ কিংবা তারও আগে বর্তমান উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে সুনামি বারবার আঘাত হেনেছে। ১৬০০ থেকে ১৬৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রীক দ্বীপ “সেন্টারিনিতে” অগ্নুৎপাতের ফলে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। ১৭৫৫ সালে পর্তুগালে ভূমিকম্পের পর সৃষ্ট সুনামিতে ব্যাপক প্রাণহানি হয়। ১৮৮৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার “কারকাতোয়া দ্বীপে বিশাল আকারের একাধিক সামুদ্রিক ঢেউ ৪০ মিটার উঁচু হয়ে আঘাত হানে। ১৯৪৬ সালে ভূমিকম্পের সাথে সাথে যে সুনামি আমেরিকার আলাস্কা, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, ক্যালেফোর্নিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর পশ্চিম উপকূলে আঘাত হেনেছে তাতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সুনামি আঘাত হানা অঞ্চল সমূহের মধ্যে রয়েছে ১৫২৪ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রের দভল, ১৭৬২ সালে মায়ানমারের আরাকান, ১৮৪৭ সালে মিকোবার দ্বীপ ও ১৯৪৫ সালে বেলুচিস্তানের মাকয়ান উপকূল। সভ্যতার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ও প্রলয়ংকারী সুনামি ধরা হয় হয়রত নুহ (আঃ) এর সময়কার মহাপ্লাবনকে। ধারণা করা হয় এসময় পৃথিবীর বেশিরভাগ অঞ্চল বিশাল জলরাশি গ্রাস করে নিয়েছিল।
সুনামির চরিত্রঃ আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের মতে, গভীর সমুদ্রে কোনো ঢেউয়ের উচ্চতা যদি হয় এক মিটার তাহলে তা উপকূলে ২০/৩০ মিটার উচ্চতা ধারণ করতে পারে। সেই ঢেউ কয়েক হাজার টন শক্তি ধারণ করে স্থলভাগে আঘাত হানে। প্রচন্ড ক্ষমতাধর পানির প্রচীরের একটি অংশ তীরে আঘাত না করে সমুদ্রে ফিরে যায়। অনেক সময় সেই জলরাশি ঘণ্টায় ৫০০ মাইল গতিতে পুনরায় উপকূলে আঘাত হানতে সক্ষম। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরে যে সুনামি এশিয়ায় আঘাত হেনেছিল তার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫০০ কিলোমিটার। সুনামির ঢেউয়ে যে শক্তি থাকে তা সাধারণ ঢেউয়ের চেয়ে অনেক বেশি। সুনামির শক্তি এতটাই প্রচন্ড যে, ২০ মেট্রিক টন ওজনের পাথর খন্ড-কে এই ঢেউ ১৮০ মিটার পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। উপকূলে আছড়ে পড়া সুনামি মুহূর্তেই একটি শহরকে শ্মশানে পরিণত করতে পারে।
সুনামি ২০০৪: প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে সুনামির মাধ্যমে। সুনামির ক্ষয়ক্ষতি ছাড়িয়ে গেছে অন্যসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে। ২৬ ডিসেম্বর ২০০৪, বরিবার ভোর ৭টার দিকে যে ভূমিকম্প অনুভূত হয় তা গত ১০৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ। এই সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলো হচ্ছে ভারত, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সোমালিয়া, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া, সিসিলি দ্বীপ, আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ। সর্বমোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৮৬ হাজার। যা পৃথিবীর ইতিহাসে পঞ্চম বৃহত্তম ধ্বংসযজ্ঞ। ভয়াবহ এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ৩.২৫১০ ডিগ্রি এবং ৯৫.৭৯০ ডিগ্রি E (East); এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। যার দূরত্ব বাংলাদেশ থেকে ৯শ কিলোমিটার, এবং ভারত মহাসাগরের ৪ মাইল নিচে। সাগর অভ্যন্তরে প্রায় ৩২ বিলিয়ন টন TNT বিস্ফোরণ ক্ষমতা নিয়ে কেঁপেছিল এ ভূমিকম্পটি। যা পরবর্তীতে জন্ম দেয় শতাব্দীর ভয়াবহতম সুনামির। রিখটার স্কেলে ঐ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমার শক্তির চেয়ে প্রায় ১০ লাখ গুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল এই ভূমিকম্প। এর ফলে সৃষ্ট সুনামি ইতিহাসের অন্যতম সেরা ধ্বংসযজ্ঞের একটি হয়ে উঠে।
সুনামিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণঃ প্রলয়ংকারী এই জলোচ্ছ্বাসের ফলে প্রায় ৩ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। শুধু ইন্দোনেশিয়ায় মারা যায় ২ লাখ ২০ হাজার মানুষ। এছাড়া শ্রীলংকায় প্রাণহানির সংখ্যা ৩০ হাজার ৯৫৭ জন। থাইল্যন্ড, ভারতসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ মিলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার। সংগঠিত সুনামিতে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির উপর প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।
সুনামি পূর্বাভাসঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই ভিত্তিক সংগঠন National Oceanic and Atmospheric Administration (NOAA) এর সদস্য দেশ হচ্ছে ২৬টি। এই ২৬টি দেশের বাইরে অন্য কোনো দেশকে সুনামি পূর্বাভাস দেয়া হয় না। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় Pacific Tsunami Warning system (PTWS), যা এ পর্যন্ত ২০ বার সুনামির আগাম বার্তা দিয়েছে। সম্প্রতি জাপানের “কোবে” শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১৬০টি দেশের ৩ হাজার বিশেষজ্ঞ ১৮ মাসের মধ্যে ২ থেকে ৩ কোটি ডলার ব্যয়ে ভারত মহাসাগরে একটি সুনামি সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
সুনামি প্রতিরোধে করণীয়ঃ সুনামি ঠেকাতে বা এর ধ্বংসলীলা কমাতে বিজ্ঞানীরা অবশেষে প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা বলছেন। সাম্প্রতিক সুনামি কংক্রিটের দেয়াল টুকরো টুকরো করে দিলেও ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট প্রায় অক্ষত ছিল সব জায়গায়। প্রাকৃতিক এই দেয়ালের কারণে বেঁচে গেছে বহু মানুষ। কাজেই প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট না করে আরো বেশি যত্নবান হলে আমাদেরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট রক্ষা এবং বনভূমি নিধন বন্ধ করতে আমাদের আরো সচেষ্ট হতে হবে।
উপসংহারঃ অতি সম্প্রতি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে নতুন এক আতঙ্কের নাম সুনামি। সর্বগ্রাসী এই সুনামি তার বিধ্বংসী রূপ পৃথিবীকে চিনিয়েছে ভালভাবেই। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ হয়ত নির্মূল করা যাবে না, কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে এর ধ্বংসযজ্ঞ কমানো সম্ভব। প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস না করে এর প্রতি যত্নবান হতে হবে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে রক্ষা করতে হবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে গড়ে তুলতে হবে বৃক্ষ প্রাচীর।