সৃষ্টির কথা ভাবে যারা আগে সংহারে করে ভয়,
যুগে যুগে সংহারের আঘাতে তাদের হয়েছে লয়।
কাঠ না পুড়ায়ে আগুন জ্বালাবে বলে কোন অজ্ঞান?
বনস্পতি ছায়া পাবে বীজ নাহি দিলে তার প্রাণ?
তলোয়ার রেখে খাপে এরা, ঘোড়া রাখিয়া আস্তাবলে
রণজয়ী হবে দন্তবিহীন বৈদান্তিকী ছলে!
প্রাণ-প্রবাহের প্রবল বন্যা বেয়ে খরস্রোতা নদী
ভেঙ্গেছে দুকূল; সাথে সাথে ফুল ফুটায়েছে নিরবধি।
জলীধর মহা-তৃষ্ণা জাগিয়েছে যে বিপুল নদীস্রোতে
সে কি দেখে, তাঁর স্রোতে কে ডুবিল, কে মরিল তার পথে?
মানে না বারণ, ভরা যৌবন শক্তি-প্রবাহ ধায়
আনন্দ তার মরণ-ছন্দে কূলে কূলে উথলায়।
সারমর্ম: জীবন ও প্রকৃতিতে ধ্বংস ও সৃষ্টির খেলা প্রতিনিয়ত চলমান। অন্ধকারকে, পুরাতনকে ভাঙতে না পারলে নতুনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই নবতর জীবন আস্বাদনের জন্য কুসংস্কার, ভ্রান্তির প্রাচীর ভেঙে ফেলে নবজীবনের পথে যাত্রা করতে হবে।
হউক সে মহাজ্ঞানী মহাধনবান,
অসীম ক্ষমতা তার অতুল সম্মান,
হউক বিভব তার সম সিন্ধু জল,
হউক প্রতিভার তার অক্ষুন্ন উজ্জ্বল।
হউক তার বাস রম্যহর্ম্য মাঝে,
থাকুক সে মণিময় মহামূল্য সাজে।
কিন্তু সে সাধে কি কভু জন্মভূমি হিত,
স্বজাতির সেবা যেবা করেনি কিঞ্চিৎ।
জানাও সে নরাধমে জানাও সত্বর,
অতীব ঘৃণিত সে পাষন্ড বর্বর।
সারমর্ম: ধন, জ্ঞান, ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও যে কোনোদিন দেশ, জাতির কথা চিন্তা করেনি সে সকলের কাছেই ঘৃণিত। অনেক কিছু থাকার পরও দেশের মানুষের কাছে সে অমানুষ বলেই বিবেচিত হয়। তাই সকলেরই উচিত নিজ সাধ্য অনুযায়ী দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য কাজ করা।
হায় হায় জনমিয়া যদি না ফুটালে
একটি কুসুম নয়ন কিরণে
একটি জীবনব্যথা যদি না জুড়ালে
বুকভরা প্রেম ঢেলে বিফল জীবনে
আপনারে রাখিলে ব্যর্থ জীবন-সাধনা
জনম বিশ্বের তবে পরার্থে কামনা।
সারমর্ম: পরের কল্যাণ সাধনের মধ্য দিয়েই মানুষের জীবন সার্থক হয়ে ওঠে। মানুষ কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্যই পৃথিবীতে আসেনি। তাই অন্যের দুঃখ দূর করতে না পারলে মানব জীবন ব্যর্থ।
হায় ঋষি-দরবেশ,
বুকের মানকে বুকে ধরে তুমি খোঁজ তারে দেশ-দেশ?
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজ-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।
ইচ্ছা-অন্ধ ! আখি খোলো, দেখ দর্পণে নিজ কায়া,
দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে পড়েছে তাঁহার ছায়া।
শিহরি উঠো না, শাস্ত্রবিদদের করো নাক বীর ভয়-
তাহারা খোদার খোদ প্রাইভেট সেক্রেটারী’ তা নয়!
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি!
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি!
সারমর্ম: স্রষ্টা তাঁর সষ্টির মাঝেই বিরাজমান। মানুষ দেশে দেশে যে স্রষ্টাকে খুঁজছে তা তার নিজের মধ্যে এবং সকল জীবের মধ্যে রয়েছেন। সকলের মাঝেই তিনি প্রকাশিত। তাই সকল জীবকে ভালোবাসতে হবে, তবেই স্রষ্টাকে পাওয়া যাবে।
হাস্য শুধু আমার সখা! অশ্রু আমার কেহই নয়?
হাস্য করে অর্ধজীবন করেছি তো অপচয়।
চলে যারে সুখের রাজ্য, দুঃখের রাজ্য নেমে আয়,
গলা ধরে কাঁদতে শিখি গভীর সমবেদনায়।
সুখের সঙ্গ ছেড়ে করি দুঃখের সঙ্গে বসবাস,
ইহাই আমার ব্রত হউক, ইহাই আমার অভিলাষ।
যেথায় ক্লান্তি, যেথায় ব্যাধি, যন্ত্রণা ও অশ্রুজল,
ওরে তোরা হাতটি ধরে আমায় সেথায় নিয়ে চল।
পরের দুঃখে কাঁদতে শেখা- তাহাই শুধু চরম নয়,
মহৎ দেখে কাঁদতে জানা- তবেই কাঁদা ধন্য হয়।
সারমর্ম: সুখ নয়, দুঃখ-কান্নাই জীবনের চরম সত্য, কেননা বেশিরভাগ মানুষের জীবনই দুঃখময়। সেইসব দুখী মানুষের ব্যথার ভাগী হওয়া, তাদের দুঃখ দূর করার চেষ্টাই হওয়া উচিত জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। মহৎ ব্যক্তিরা দুখীর দুঃখে সমব্যথী হন, তাদের দুঃখ-যন্ত্রণা দূর করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। তাই মহৎ ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
“হে কবি, নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”
সারমর্ম: প্রকৃতিতে বসন্ত এলেও কবি হৃদয় বসন্তের সৌন্দর্যকে বরণ করে নিচ্ছে না। কোনো এক গভীর বেদনার কারণে কবি বসন্তের আগমনে উদাসীন। মানুষের হৃদয়ের গভীরে কোনো গোপন দুঃখবোধ থাকলে বাইরের সৌন্দর্য আনন্দ তার কাছে অর্থহীন হয়ে যায়।
হে বঙ্গ, ভান্ডরে তব বিবিধ রতন-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।
সারমর্ম: নিজ মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে যারা অন্য ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে বিখ্যাত হতে চান তারা কখনোই সফল হতে পারেন না। মাতৃভাষার মতো এত ঐশ্বর্য অন্য কোনো ভাষায় নেই। এ সত্যকে উপলব্ধি করে কবি বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন হলেন।
হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়-
এবার কঠিন কঠোর গদ্যে আনো
পদ-লালিত্য ঝংকার মুছে যাক,
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো।
প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা-
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়-
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
সারমর্ম: কাব্যের স্নিগ্ধতা নয়, গদ্যের কঠোরতাই জীবন সংগ্রামে প্রয়োজন। বঞ্চিত, নিপীড়িত শ্রেণির মানুষের জীবনে তাই আজ গদ্যের কঠোরতাই কাম্য। ক্ষুধা আর দারিদ্র্য যাদের জীবনে নিত্যসঙ্গী তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং বঞ্চনার অবসান ঘটানোই কবির প্রত্যাশা।
হে চির-দীপ্ত, সুপ্তি ভাঙাও
জাগার গানে,
তোমার শিখাটি উঠুক জ্বলিয়া
সবার প্রাণে।
ছায়া ফেলিয়াছে প্রলয়ের নিশা,
আঁধারে ধরণী হারায়েছে দিশা
তুমি দাও বুকে অমৃতের তৃষা
আলোর ধ্যানে।
ধ্বংস-তিলক আঁকে চক্রীরা
বিশ্ব-ভালে;
হৃদয়-ধর্ম বাঁধা পড়ি ফাঁদে
স্বার্থ-জালে,
মৃত্যু জ্বালিছে জীবন-মশাল,
চমকিছে মেঘে খর তরবার,
বাজুক তোমার মন্ত্র ভয়াল
বজ্র-তানে।
সারমর্ম: মানবসমাজের সর্বত্রই আজ দুষ্ট লোকের দৌরাত্ম্য। তারা নিজেদের স্বার্থে মানুষের শান্তিকে বিনষ্ট করে জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। এ পরিস্থিতিতে এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন যিনি তার আলোয় সকলকে আলোকিত করবেন। তার নেতৃত্বেই মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করবে।
হে মহামানব, একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম-নগরের ভিড়ে,
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বার বার,
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার।
এই যে আকাশ, দিগন্ত মাঠ, স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি,
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল,
এখানে চরম দুঃখে কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটাতে জমেছে নির্জনতার কালো,
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।
সারমর্ম: গ্রামের মানুষের জীবন দুঃখ-দুর্দশায় পরিপূর্ণ। মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের জীবন বিপর্যস্ত। তাই কবি এমন এক মহামানবের প্রত্যাশা করছেন যিনি এই সকল গ্রামের অসহায় মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করবেন।
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান!
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিষ্টের সম্মান
কণ্টক মুকুট শোভা, দিয়াছ তাপস,
অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হল তরবার।
দুঃসহ দাহনে তব হে দর্প তাপস,
অম্লান স্বর্গেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ।
শীর্ণ করপুট ভরি সুন্দরের দান
যতবার নিতে যাই হে বুভুক্ষু, তুমি
অগ্রে আসি, কর পান। শূন্য মরুভূমি
হেরি মম কল্পলোক।
সারমর্ম: দারিদ্র্য নিষ্ঠুর হলেও তা মানবজীবনকে মহিমান্বিত করে তোলে। দারিদ্র্য মানুষের ভয়, লজ্জা, সংকোচ দূর করে স্পষ্টভাষী ও সাহসী করে তোলে। দারিদ্র্যের অভিশাপে জীবনের সৌন্দর্য বিনষ্ট হয় এবং স্বপ্ন মরুভূমিতে রুপান্তরিত হয়।
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমান হতে হবে তাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমান হতে হবে তাদের সবার সমান।
মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।
বিধাতার রুদ্র রোষে দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান।
সারমর্ম: এ পৃথিবীতে মর্যাদার দিক থেকে সকল মানুষই সমান। কিন্তু যারা গরীব, দুঃখী মানুষদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তারা মূলত সৃষ্টিকর্তাকেই অপমান করে। সৃষ্টিকর্তার বিচারে একদিন তাদেরকেও অবহেলিত ও বঞ্চিতদের কাতারে দাঁড়াবে হবে।
হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম, “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরে আসি-
“কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীর পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।”
সারমর্ম: কবি তাঁর অতীতের বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে বর্তমানের প্রতি উদাসীন। তিনি কিছুতেই তাঁর অতীতকে ভুলতে পারছেন না। তাই বসন্তের আগমনে কবিমনে আনন্দের শিহরণ জাগেনি, বসন্তের প্রতি যেন তাঁর তীব্র বিমুখতা।
Post By Md.Ripon Mia
No comments:
Post a Comment