অপরের দুঃখ কথা করিলে চিন্তন আপনার মনে দুঃখ থাকে কতক্ষণ
পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ বাস করে আর তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা দুঃখ-কষ্ট, অভাববোধ আছে। তবে সে দুঃখ-কষ্টগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। আর কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের চিন্তা করা কোনো মানুষের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। কেননা শুধুমাত্র নিজের ভোগ-বিলাস আর স্বার্থরক্ষার জন্য মানবজীবন নয়। মানুষ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে সমাজবদ্ধভাবে বাস করে। এই সমাজবদ্ধ জীবনে স্বার্থপরের মতো শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে ভাবা উচিত নয়। বরং চারপাশের সমস্ত দুঃখী, অভাবী মানুষের দুঃখকে উপলব্ধি করতে হবে।অন্যের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত। অন্যের দুঃখ-কষ্টকে নিজের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করতে পারলে নিজের দুঃখগুলো ভুলে থাকা যায়। যে ব্যক্তির পা নেই তার কথা চিন্তা করলে নিজের জুতা না থাকার অভাব বা কষ্ট নিতান্তই নগন্য মনে হয়। মহৎপ্রাণ ব্যক্তিগণ নিজেদের দুঃখ, বেদনা, হতাশা, ব্যর্থতাকে ভুলে অপরের কল্যাণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। অপরের কল্যাণে নিজেদের স্বার্থ চিন্তা পরিহার করেছেন বলেই তাদের জীবন হয়েছে মহান। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়েছে তাদের মহৎ ত্যাগের কথা।
মানুষ কেবল নিজের জন্য জন্মগ্রহণ করেনি। শুধুমাত্র নিজের ভোগবিলাস, পাওয়া না পাওয়ার হিসেবে ব্যস্ত থাকলে সেই মানুষ কোনোদিনও জীবনের প্রকৃত সুখের সন্ধান পায় না। অন্যদিকে, নিজের দুঃখ-কষ্টকে বড় করে না দেখে যে ব্যক্তি অন্যের দুঃখ- বেদনাকে উপলব্ধি করতে পারে এবং সে দুঃখ লাঘবে সহায়তা করে সেই প্রকৃত সুখী। যে সত্যিকারের মানুষ সে অপরের দুঃখে ব্যথিত হয় এবং অন্যের দুঃখ দূর করতে নিজের সুখ বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করে না। অপরের দুঃখ-কষ্টকে উপলব্ধি করে সে নিজেদের দুঃখের কথা ভুলে যায়। জীবনের সত্যিকার সুখের দেখা পায় সে, যে অপরের দুঃখ-বেদনার কথা ভেবে ব্যক্তিগত দুঃখকে মনে স্থান দেয় না।
শিক্ষা: স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে এই মহৎ জীবনকে সার্থক করতে হলে, কেবল নিজের স্বার্থচিন্তা না করে, অন্যের দুঃখ-বেদনাকে উপলব্ধি করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, অপরের দুঃখ-বেদনা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই মানব জীবনের সত্যিকারের সুখ নিহিত।
তৃষ্ণার জল যখন আশার অতীত মরীচিকা তখন সহজে ভোলায়
মানুষ সমাজে বাস করে। এই সমাজ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন এর মতো মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণ করে থাকে। তথাপি প্রাপ্তির মাঝেও কিছু অপ্রাপ্তি থেকে যায়। অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণে সমাজ ব্যর্থ হয়। আর ক্রমাগত ব্যর্থতা মানুষকে হতাশায় জর্জরিত করে তোলে।সে তার বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। তপ্ত মরুভূমিতে পথিক যখন তৃষ্ণার্ত হয় তখন সে চারদিকে হন্যে হয়ে জল খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু সূর্যের প্রখর তাপে মরুভূমিতে জল পাওয়া সহজ নয়। মরুভূমির বালিতে তীর্যকভাবে সূর্যকিরণ পতিত হলে তা দূর থেকে পানির মতো দেখা যায়, যাকে মরীচিকা বলে। পথিকের কাছে মনে হয় সামনে পানি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু যখন সে সামনে এগিয়ে যায় তখন পানির মতো দেখতে মরীচিকা আরও দূরে সরে যায়।
মানুষের জীবনও এরকম মরুভূমির মরীচিকার মতো। মরীচিকার পেছনে যেমন মরুভূমির পথিক বুদ্ধি-জ্ঞানহীনের মতো ছুটতে থাকে তেমনি কাক্সিক্ষত বস্তু না পাওয়ার বেদনায় মানুষ বিবেকহীন হয়ে পড়ে। এর ফলে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। সমাজে সৃষ্টি হয় চরম বিশৃংখলা।
শিক্ষা: অভাব মানুষকে বিভ্রান্ত করে অনিশ্চিত জীবনের পথে ছুটতে বাধ্য করে। যা তাকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অতিরিক্ত প্রাপ্তিও আবার মানুষকে বিপথের দিকে ঠেলে দেয়। তাই মানুষের জীবনে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি দুই-ই থাকা উচিত।
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। চারপাশের জীব-জগৎ নিয়েই মানুষ জীবনযাপন করে। কেননা, সৃষ্টিকর্তা বহুরকম উপাদান দিয়ে পৃথিবীকে সাজিয়েছেন। প্রত্যেক জীবের সাথে অন্য জীবের কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক রয়েছে। জ্ঞান-বুদ্ধির অধিকারী মানুষও সেই সম্পর্ক বা বন্ধনে আবদ্ধ। যে সৃষ্টিকর্তা তাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন মানুষের কর্তব্য তাঁর উপাসনা করা, তাঁকে খুশি করা। মানুষ তাঁকে খুশি করতে পারে উপাসনালয়ে প্রার্থনা করার মাধ্যমে এবং তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবেসে সেবা করে।স্রষ্টার সৃষ্টিকে না ভালোবেসে, মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে যদি আমরা সারা দিন রাত তাঁকে ডাকি তিনি খুশি হবেন না। কেননা, সৃষ্টিকর্তা সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন পরম ভালোবেসে। ক্ষুদ্র থেকে বিশাল সবকিছুর প্রতিই তাঁর দৃষ্টি রয়েছে। আর সব কিছু তিনিই লালন-পালন করছেন। তাই তাঁর সৃষ্টির সেবার মাঝেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। সৃষ্টির বৈচিত্র্যতার মাঝেই রয়েছে স্রষ্টার বিশালত্ব। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে, সংসার ত্যাগী হয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে তাঁকে খুঁজলে পাওয়া যায় না। আমাদের সমাজে যারা ঐশ্বর্যশালী মানুষ তাদের উচিত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
এতে অসহায় মানুষগুলো খুশি হবে। মানুষের এই খুশিই সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করবে। সমাজ হবে সুন্দর। শুধু মানুষ নয়, পশু পাখিকেও ভালোবাসতে হবে। তাকে পেতে হলে জীবে দয়া করতে হবে। তাইতো সব ধর্মের মূল কথা জীবে দয়া করা। স্রষ্টার সৃষ্টি যে কত মূল্যবান তা আমরা বৌদ্ধ ধর্মের ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ এই বাণী থেকে বুঝতে পারি। হযরত মুহাম্মদ (স.) সব সময় জীবের সেবা করতেন এবং মানুষকে সবসময় জীবের প্রতি সদয় হতে উৎসাহিত করেতেন। সর্বোপরি সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টার বহিঃপ্রকাশ। তাই ঈশ্বরকে সেবা করতে হলে তাঁর সৃষ্টিকেই সেবা করতে হবে।
শিক্ষা: সৃষ্টিবিহীন যেমন স্রষ্টার কথা ভাবা যায় না, ঠিক তেমনি সৃষ্টিকে বাদ দিয়ে স্রষ্টাকে খোঁজা বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে? কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে, কভু আশীবিষে দংশেনি যারে
সুখ এবং দুঃখ দুটি বিপরীত বিষয়। এরা একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। একটি না থাকলে অন্যটির মর্ম বোঝা যায় না। অন্ধকার না থাকলে যেমন আলো বোঝা যায় না। যখন কারো হাত কাটে তার ব্যাথা কেবল ঐ ব্যক্তিই বুঝে অন্য কেউ নয়। কষ্ট বা বেদনার যে অনুভূতি তা কেবল ব্যক্তি নিজেই বোঝে। আমরা পাশের মানুষ শুধু সমবেদনাই জানাতে পারি। তার কষ্টটা কখনো অনুভব করতে পারি না। পৃথিবীতে মানুষের জীবন সুখ-দুঃখ মিলিয়েই গড়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা দুঃখের চেয়ে সুখটাই বেশি ভোগ করে। তাই দুঃখী ব্যক্তির দুঃখ তারা বুঝতে পারে না। আমাদের সমাজে অনেক ধনী লোক আছে সোনার চামচ মুখে নিয়ে যাদের জন্ম হয়েছে।কখনো কখনো তারা দরিদ্র মানুষদের গণ্যই করে না। যারা সুখী এবং সম্পদশালী তারা গরীবের কষ্ট কখনো বুঝতে পারে না। তাই গরীবকে তারা অবহেলা করে, অবজ্ঞা করে। গরীবের কষ্ট তারা কখনও বোঝার চেষ্টাও করে না। তারা ধনী ও গরীবের মাঝে এক বিভেদের দেয়াল তৈরি করেছে। সমাজে উঁচুতলার লোকেরা গরীব খেটে খাওয়া মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে চায় না। বরং তাদেরকে আরও বেশি কষ্টে ভোগায়। ধনীরা কখনোই গরীবের কষ্টে সামিল হতে চায় না। কারণ তারা এই কষ্টের মূল্যায়নই করে না। তারা ভুলে যায়, যে সুখের পাহাড় তারা গড়েছে সেটা ঐ গরীব মানুষেরই কষ্টের ফসল। যাকে শাপে কামড় দেয় কেবল সে-ই বিষের যন্ত্রনা অনুভব করতে পারে। সুখে থেকে কখনো অন্যের দুঃখকে অনুভব করা যায় না।
শিক্ষা: যে মানুষ প্রতিনিয়ত দুঃখ-কষ্ট পাচ্ছে সে-ই কেবল এর যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে। কেউ কেউ হয়তো দায়বোধ থেকে দুঃখী মানুষকে কখনো সমবেদনা জানায়। কিন্তু তা কেবল সমবেদনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন নহে বিদ্যা, নহে ধন হলে প্রয়োজন
মানুষের জ্ঞানের ধারক ও বাহক হচ্ছে গ্রন্থ। গ্রন্থ পাঠ করে মানুষ তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করে, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটায়। নিজের ও অন্যের প্রয়োজনে সেই বিদ্যাকে কাজে লাগায়। বিদ্যার আলোকে জগৎকে উদ্ভাসিত করে। শাশ্বত সত্য-সুন্দরের পথ নির্দেশ করে। কিন্তু বিদ্যা যদি কেবল গ্রন্থগতই হয় তবে তা কোনো কাজেই লাগে না।গ্রন্থগত বা পুঁথিগত বিদ্যা মানুষকে যথার্থ জ্ঞানী করে তুলতে পারে না। বিদ্যাকে জীবনের উপযোগী করে তোলার মধ্যেই এর যথার্থ উদ্দেশ্য নিহিত। কাজেই তত্ত্বীয় জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক জ্ঞানও থাকা দরকার। বিদ্যা অর্জন করে তাকে কাজে লাগাতে হবে। কেবল মুখস্থ করে লেখাপড়া করলে তা প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা যায় না।
যে জ্ঞান ব্যবহারিক জীবনে কোনো কাজে আসে না সে জ্ঞান দ্বারা নিজেরও যেমন কোনো উপকার হয় না তেমনি জগতেরও কোনো কল্যাণসাধন হয় না। আর যে বিদ্যা প্রয়োজনের সময় কাজে ব্যবহার করা যায় না প্রকৃতপক্ষে সে বিদ্যার কোনো মূল্য নেই। তেমনি মানুষের জীবনে ধন-সম্পদেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ ধন-সম্পদ অর্জনের জন্য প্রয়োজন হয় কঠোর পরিশ্রম।
পরের ধন-সম্পদকে নিজের মনে করা কিংবা নিজের ধন-সম্পদ অন্যের কাছে জমা রেখে নিজের বলে হিসাব করা চরম বোকামি। কারণ অন্যের নিকট জমা রাখা ধনসম্পত্তি প্রয়োজনের সময় কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। সুতরাং সার্থক ও সুন্দর জীবনের জন্যে বিদ্যাকে যেমন আত্মস্থ করতে হবে, ঠিক তেমনি ধন-সম্পদ অন্যের কাছে অহেতুক গচ্ছিত না রেখে নিজের আয়ত্তে রাখতে হবে। যাতে বৃহত্তর মানবকল্যাণে তা কাজে লাগানো যায় তথা দেশ ও দশের মঙ্গলে ব্যবহার করা যায়।
শিক্ষা: গ্রন্থগত বিদ্যা আর অন্যের আয়ত্বে থাকা ধন কোনো প্রয়োজনে আসে না। মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়ার মধ্য দিয়েই এসবের সার্থকতা।
আশার অন্ত নাইকো বটে আর সকলের অন্ত ঘটে
আমাদের বেঁচে থাকার অন্যতম অনুপ্রেরণা হলো আশা। এই আশার কারণেই আমরা স্বপ্ন দেখি, ভালো ভাবে বেঁচে থাকতে চাই এই ধরায়। আশা-আকাঙ্ক্ষায় না থাকলে মানবজীবন এত কর্মচঞ্চল হতো না। মানুষের সকল কর্মস্পৃহা স্থবির হয়ে পড়ত। মানুষের এই আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো শেষ নেই।একটির পর অন্য একটি দ্রব্য পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ সর্বদাই তাড়িত। কারো যদি মাটির ঘর থাকে তবে তার আশা থাকে টিনের ঘর তৈরি করার। টিনের ঘর হওয়ার কিছুদিন পরই দালান করার বাসনা তার মনে জাগে। আবার দালান বাড়ি করার পর একটি গাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ঐ ব্যক্তি।
প্রতিনিয়ত আশা পূর্ণতার স্বপ্ন নিয়েই তার সারাটি জীবন কাটে। এভাবে কোনো একটি জিনিস পাওয়ার পর তার মনের মধ্যে ঐ দ্রব্যটি নিয়ে আর তেমন আখাঙ্ক্ষা কাজ করে না। বর্তমান এই আধুনিক জগতে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। যেমন একজন মানুষ হয়তো ভালো একটি বস্তু পাওয়ার আশা করল।
অনেক কষ্টে তা পেলেও কিছুদিন পর ঐ বস্তুর প্রতি তার আগের আগ্রহ থাকে না। নতুন অন্য বস্তু পাওয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে যায়। অর্থাৎ কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা উপাদানকে পাওয়ার আশা একদিন সমাপ্ত হয় কিন্তু আশার কখনো সমাপ্তি ঘটে না। প্রতিক্ষণই নিত্যনতুনভাবে আশা তার অন্তরে জাগ্রত হয়।
শিক্ষা: মানুষ আশার পেছনে মরীচিকার মতো প্রতিনিয়তই ছুটে চলেছে। মৃত্যুৎ পর্যন্ত চলতে থাকবে তার এই অসীম আকাঙ্ক্ষার। তাই অল্প আশা-আকাঙ্ক্ষাতে তুষ্ট থাকাই শ্রেয়।
এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি
বেঁচে থাকার তাগিদে অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু সমাজের এক শ্রেণির মানুষ যাবতীয় অর্থসম্পদ নিজেদের কুক্ষীগত করতে সদা সচেষ্ট। এই বিত্তবান শ্রেণির লোকেরা নিজেদের অঢেল ধন-সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও সম্পদের লোভ ত্যাগ করতে পারে না। তাদের এই বিকৃত লোভের শিকার হয় দরিদ্র ও অসহায় মানুষেরা। প্রাচীনকাল থেকেই এই ধারা প্রচলিত হয়ে আসছে।জমিদাররা যেমন বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও সামান্য খাজনার জন্য দরিদ্র প্রজার সহায়-সম্বলটুকু কেড়ে নিতে কুণ্ঠিতবোধ করতো না, তেমনি বর্তমানেও ক্ষমতাপিপাসু একটা শ্রেণি নিজেদের জন্য একের পর এক সম্পদের ইমারত গড়ে তুলছে। আর এই সম্পদ আহরণের নেশায় মত্ত হয়ে তারা নিজেদের মানবতাকে বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না।
তারা সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের অধিকারবঞ্চিত করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় বানিয়ে চলে ক্রমাগত। কেননা তাদের আরো সম্পদ, আরো ভোগ-বিলাসিতার প্রয়োজন। বিত্তবানদের এই ধরণের বিকৃত অর্থলিপ্সার কোনো সীমা নেই বরং দিনে দিনে তাদের লালসা বাড়তেই থাকে। অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও, আরো পাওয়ার ইচ্ছা তাদেরকে অমানুষে পরিণত করে। নিজেদের সম্পদ আরো বাড়িয়ে তোলার নেশায় তারা ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, সাদা-কালো কোনো কিছুই বাছ-বিচার করে দেখে না। কেউ তিনবেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারলেই খুশি, আবার কেউ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না; আরো সম্পদের অভাবে সে কাতর। আরো সম্পদশালী হতে গিয়ে তারা সুদ, ঘুষ, চুরির মতো নানারকম দুর্নীতির আশ্রয় নেয়।
এমনকী অর্থলিপ্সায় কাতর এই বিত্তবান লোকগুলো গরিবের মুখের অন্ন, মাথা গোঁজার নিরাপদ আশ্রয়, ন্যূনতম শিক্ষা প্রভৃতি মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় আকাশচুম্বী করে তোলে। আর এভাবেই সমাজে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বাড়তে থাকে। দরিদ্রের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ধনীরা হয় আরো ধনী, অন্যদিকে যারা দরিদ্র তারা আরো বেশি দরিদ্র হয়ে পড়ে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান না দিতে পেরে তারা অনাহারে-অর্ধাহারে, বস্তির ঘুপচি ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।
শিক্ষা: এ পৃথিবীতে ধনীদের পাশাপাশি গরিবদেরও বাঁচার অধিকার আছে। পুঁজিবাদী বিত্তবানদের উচিত গরিবের সম্পদ আত্মসাৎ করে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধির নিলর্জ্জ মোহ পরিহার করা এবং তাদের দিকে সাহায্য, সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়া।
আমার একার সুখ, সুখ নহে ভাই সকলের সুখ, সখা, সুখ শুধু তাই
সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার মাঝেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত। নিজের সুখ-দুঃখকে বড় মনে না করে অপরের সুখ-দুঃখকে নিজের করে নেওয়ার মাঝেই সুখ। মানুষ জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, সুকোমল হৃদয়ের কারণে অন্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা। মানুষ পরের উপকারে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে, যা অন্য কোনো প্রাণী পারে না। তাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য পৃথিবীতে মানুষের জন্ম হয়নি।কিন্তু তা না করে অধিকাংশ মানুষ শুধু স্বীয় স্বার্থ হাসিলের মানসিকতায় ডুবে থাকে। অন্যের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আপদ-বিপদ প্রভৃতির প্রতি নিয়োজিত থাকা উচিত। অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত না রাখলে আত্মার বিনাশ ঘটে। মানুষের প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। প্রকৃতি তার সামগ্রিক রূপ, রস, গন্ধ মানুষের মঙ্গলের জন্য বিলিয়ে দেয়। যেমন-ফুলের সৌরভ, সৌন্দর্য তার নিজের হলেও সকলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়।
তেমনিভাবে নদী, তরু, চন্দ্র, সূর্য, সাগর প্রভৃতি নিজেদের বিলিয়ে দেয় অকাতরে। যারা মহৎ লোক তারা অপরের সুখ শান্তির জন্য নিজের সুখ-দুঃখ, আনন্দ- বেদনা ভুলে গিয়ে অপরের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে নিজের মনে করে গ্রহণ করে। সকলের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে, সবাইকে নিয়ে সমাজের উন্নতির কথা চিন্তা করে। তারা সবার সুখে সুখী এবং সবার দুঃখে দুঃখী। গরীব, অসহায়, দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তারা সুখী হয়।
শিক্ষা: নিজের সুখ খোঁজার মাঝে প্রকৃত সুখ পাওয়া যায় না। সবার সুখে সুখী এবং সবার দুঃখে দুঃখী হয়ে মানবকল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মাঝেই প্রকৃত সুখ নিহিত।
উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই
মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর মৃত্যুবরণ করে। মানুষের মৃত্যুর পর স্বভাবতই তাকে আর কেউ মনে রাখে না। জন্ম ও মৃত্যুর এই মাঝামাঝি সময়ে মানুষ যে সময়টুকু পৃথিবীতে অবস্থান করে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময়ের কর্মফলই তার পরিচয়কে সুস্পষ্ট করে।জীবনে মানুষ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয়। এই প্রতিবন্ধকতাকে রুখতে তাদের নানা আয়োজন, উদ্যোগ চোখে পড়ে। লক্ষ্যকে পূরণ করতে গিয়ে কেউ বেছে নেয় অন্যায়ের পথ। ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে তারা নিতান্ত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। জীবনাবসানকালে পৃথিবীর বুকে তারা ঘৃণার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। জীবনে ও মরণে উভয় কালেই তারা ঘৃণিত।
অন্যদিকে যারা সৎ কাজ করে, মানবকল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয় তারা স্থান পায় গৌরবময় ইতিহাসের পাতায়। যুগে যুগে যেসকল মানুষ আত্মত্যাগ করে গেছেন তারা হয়েছেন মহামানব। এসব মহামানব সকল ভয়-ভীতি, বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে মৃত্যুকে জয় করেছেন। তাঁদের দেখানো পথ সকল অন্ধকারকে দূরে ঠেলে দিয়েছে আলোর সন্ধান। মানব মুক্তির জন্য তারা দ্ব্যর্থহীন চিত্তে কাজ করে গেছেন।
চে গুয়েভারা, নেলসন ম্যান্ডেলা, আব্রাহাম লিংকন প্রমুখ ব্যক্তিগণের অবদান চিরদিন পৃথিবীর বুকে লেখা থাকবে তাঁদের আত্মত্যাগের জন্য। সংকট উত্তরণে এসব মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছিল, ভবিষ্যতেও ঘটবে। সমাজ দেশ ও জাতির কল্যাণে সামান্য একটু কাজই বদলে দিতে পারে জনসাধারণের সাধারণ জীবনপরিচয়। সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে ভয়-ভীতিকে বিসর্জন দিয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে যাঁরা নিঃশেষ জীবন দান করতে পারেন তারাই সভ্যতার অগ্রগামী পথিক।
শিক্ষা: জীবনে সফলতা অর্জনের মূল চাবিকাঠি হলো উত্তম পথটি নির্বাচন করা। মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করাই হলো সেই উত্তম পথ। তাই আমাদের মানবকল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করা উচিত।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে, আসে নাই কেহ অবনি পরে। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে
পৃথিবীতে কোনো মানুষই চিরস্থায়ী নয়। মানুষ কেবল চিরস্থায়ী থাকতে পারে তার মহৎ কর্মের মাধ্যমে। কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে দীর্ঘ সময়। মানুষের যথার্থ পরিচয় নিহিত কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার মাধ্যমে। যারা শুধু নিজের সুখ নিয়ে ব্যস্ত থাকে তারা প্রকৃত সুখের সন্ধান পায় না।জীবনে কেউ যদি ভালো কাজ না করে তবে সে জীবন অর্থহীন। মানবজীবন শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, সবার সুখ তার মধ্যে জড়িয়ে থাকে। কারণ ব্যক্তিস্বার্থের ক্ষুদ্র পরিসরে মানবস্বার্থের চিন্তার অবকাশ থাকে না। অন্যের মঙ্গলের উদ্দেশ্যে কাজ করার মধ্যেই আত্মা প্রকৃত অর্থে সুখী হয়। মানুষ সুখের জন্য দিশেহারা, তারা কাজের মধ্যে সুখ খুঁজে পেতে চায়।
তাই মানুষের প্রতি স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে পৃথিবীতে কম সংখ্যক মানুষ আছে যারা নিজের কথা চিন্তা না করে, অন্যের সুখ-শান্তি তথা কল্যাণের কথা চিন্তা করে। অপরের সুখ-শান্তির মাঝে নিজের পরম সুখের ঠিকানা খুঁজে পায়। যেমন- মাদার তেরেসা মেসোডেনিয়া ছেড়ে কলকাতায় এসে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জেলে কাটিয়েছেন জীবনের ২৭টি বছর, তাছাড়া মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মাগান্ধী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের কল্যাণে। বিশ্বের যা কিছু মহান, মহৎ কর্ম, যা মানব সভ্যতাকে স্বর্ণ শিখরে নিয়ে গেছে তার মূলে রয়েছে মহৎ মানুষের ভূমিকা।
অপরের কল্যাণ সাধনের জন্য তারা তাদের নিজেদের সুখ শান্তি, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস সবকিছু বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেননি।
শিক্ষা: সংকীর্ণ স্বার্থপরতায় বিভোর মানুষ কোনো দিন সুখ নামক বস্তুটির দেখা পায় না। তাই মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াই প্রকৃত মানুষের কাজ।
উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে তিনি মধ্যম যিনি চলেন তফাতে
পৃথিবী অজস্র মানুষের সমারোহে প্রাণচঞ্চল। এ সব মানুষের ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, অভ্যাস পৃথক। কিন্তু চাল-চলন, আচার ব্যবহারে সমগ্র মানবসমাজকে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়Ñ উত্তম, মধ্যম, অধম। এদের শ্রেণি চরিত্র ভিন্নতর অভিধায় চিহ্নিত। উত্তম সকল ক্ষেত্রেই উৎকৃষ্ট। সকলের উপর তার অবস্থান।অধম সকল ক্ষেত্রেই নিকৃষ্ট। সকলের নিচে তার অবস্থান। এই দুই শ্রেণি সম্পর্কে সমাজে স্পষ্ট ধারণা পোষণ করে। এই দুয়ের মধ্যবর্তী মধ্যম শ্রেণিকে নিয়েই সমস্যা। মানুষ এ শ্রেণিকে নিয়েই ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে। তাই সমাজ, তাদের ব্যাপারে সদা সতর্ক। কিন্তু যিনি উত্তম তাকে নিয়ে কারো কোনো ভয় বা শঙ্কা নেই। কারণ তার দ্বারা কোনো অকল্যাণ সাধিত হয় না।
পাপ-পঙ্কিলতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। চরিত্রগুণে সে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে। তাই সব শ্রেণী- পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর সহজ অবস্থান লক্ষণীয়। সমাজ তাঁর ব্যাপারে শঙ্কামুক্ত। অধমের ক্ষেত্রেও মানুষ একইভাবে শঙ্কামুক্ত। কারণ সমাজ তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করে না। তার অসৎ চরিত্র, খারাপ মনোবাসনা, মন্দ কাজ সম্পর্কে সকলেই জ্ঞাত। তার কাছে প্রতারিত হবার ভয়ে সবাই সচেতন। কিন্তু মধ্যম শ্রেণি নিয়ে সবাই সব সময় সংশয়াপন্ন। মধ্যম নিজ শ্রেণি থেকে অধমে রূপান্তরিত হয় না, আবার উত্তমে ও উত্তরণ ঘটাতে অক্ষম।
শ্রেণিচ্যুতির আশঙ্কায় সতর্ক পদক্ষেপে তার অভিযাত্রা। দুর্বল মানসিকতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, এ অভিযাত্রার সঙ্গী। প্রয়োজনে সে নিকৃষ্ট কাজ করে। আবার প্রয়োজনে কখনো কখনো ভালো কাজেও তার সরব উপস্থিতি। প্রকৃত পক্ষে এ শ্রেণি সুবিধাবাদী হবার ফলে জনসাধারণের প্রতারিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বিশ্ব সমাজে ছদ্মবেশধারীর মতোই তার আচরণ। এ ধরণের শ্রেণি চরিত্রের কারণে অধম থেকে সে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে, উত্তমের সঙ্গেও প্রাণখুলে হাসতে, মেলামেশা করতে পারে না।
শিক্ষা: মধ্যমের দ্বিধা-সংশয়, ভয়-ভীতি, দোলাচল একরকম অধমেরই নামান্তর। জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে মধ্যবিত্ত মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
কৃষ্ণ বলিয়া যারে তুমি আজি কর হীন অপমান রুধির তাহারো নহেত কৃষ্ণ- বহে সে-ও একই প্রাণ
কালো-সাদা সবাই স্রষ্টার সৃষ্টি। কালো ও সাদা হওয়ার পেছনে কারও হাত নেই। তা হয় স্রষ্টার ইচ্ছায়। তাই তাদের অবহেলা অপমান করার নির্বোধের কাজ। একটা সময় ছিল, যখন কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হত। তাদের ভোটাধিকার ছিল না, উচ্চ মর্যাদার চাকরি করতে পারত না, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারত না, সাদাদের সাথে একই টেবিলে বসতে পারত না। কিন্তু আধুনিক সমাজে কালো চামড়া মানুষ ও সাদা চামড়ার মানুষ বলে কাউকে বৈষম্য করা হয় না। কৃষ্ণাঙ্গরাও এখন পৃথিবীর শীর্ষ মর্যাদার পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা, জাতিসংঘের সাবকে মহাসচিব কফি আনান। এছাড়া নেলসন মান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, মাইকেল জ্যাকসন প্রমুখ কালো হলেও পৃথিবীর উচ্চ মর্যাদার আসন লাভ করেছেন।তাই কালো মানুষদের অবহেলা অপমান করা অযৌক্তিক। তাদের রক্ত, অস্তি-মজ্জা যেরকম, সাদা মানুষেরও ঠিক একইরকম। প্রতিটি মানুষকে যাচাই করা দরকার তার কর্ম দিয়ে। যারা মহৎ কর্ম সম্পাদন করেন, তারা সাদা না কালো সেটা মুখ্য বিষয় নয়। মূলত সাদা এবং কালো প্রত্যেকের শরীরে একই রক্তধারা বয়ে চলেছে। একই প্রাণের ধারা উভয়ের মাঝে বিরাজমান।
শিক্ষা: ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বৈষম্য করা উচিত নয়। প্রতিটি মানুষই স্রষ্টার সৃষ্টি, তাদের অবহেলা অপমান করা-স্রষ্টাকে অপমান করার শামিল।
গতিই জীবন, স্থিতিতে মৃত্যু
এ বিশ্বজগত স্থিতিশীল নয়। অনন্তকাল ধরে এটি তার আপন নিয়মে চলছে। যেদিন এর ব্যত্যয় ঘটবে সেদিন মহাপ্রলয় সংগঠিত হবে। এ বিশ্বজগতের মতো মানুষের জীবনও চলমান। এই চলমান জীবনে বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে প্রতি পদে পদে সংগ্রাম করতে হয়। কঠোর পরিশ্রম ও সংগ্রাম মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে পৌছে দেয়। নদী যখন বয়ে চলে তখন তার বুকে ময়লা আবর্জনা জমে না। কিন্তু যদি নদীর গতি রোধ করা হয় তাহলে নদীটি ছোট হয়ে যেতে থাকে।এবং এক সময় এটি বিলীন হয়ে যায়। বিবর্তনবাদের জনক বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন বলেছেন- “প্রকৃতির জগতে যে অধিকতর যোগ্য সেই টিকে থাকবে।” অর্থাৎ সকল বাধা বিপত্তিকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে যারা এগিয়ে যেতে পারে তারাই প্রকৃত পরিশ্রমী। তাদের হাতেই রয়েছে সাফল্যের চাবিকাঠি। আর যারা অলস, কর্মহীন তারা জড় পদার্থের মতো। এরা সমাজ সভ্যতার কোনো উপকারতো করেই না বরং গতিশীল জীবনকে ব্যাহত করে। কর্মহীন জীবন মৃত্যুরই নামান্তর।
সুতরাং গতিশীলতা ছাড়া মানবজীবন যথার্থ পরিচয় বহন করে না। গতিশীলতাই মানুষের সকল কর্মকে সফল করে তোলে। মৃত্যু অবধি মানুষ এই গতিশীলতাকে পুঁজি করে জীবন পরিচালনা করে এবং সাফল্য লাভ করে।
শিক্ষা: ব্যক্তিজীবন ও জাতীয় জীবন উভয় ক্ষেত্রেই উন্নতির চাবিকাঠি গতিময়তা। যে জাতি পরিশ্রমী সে জাতির উন্নতি অগ্রগতি কেউ রুখতে পারে না। তাই কর্মহীন জীবন কখনোই কাম্য হতে পারে না।
কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে, হেন কালে আকাশেতে উঠিলেন চাঁদা, কেরোসিন শিখা বলে- “এসো মোর দাদা
মানুষ ভেদে চরিত্রে পার্থক্য থাকলেও পৃথিবীর সব মানুষের চরিত্র কিছু বৈশিষ্ট্যে সাদৃশ্যপূর্ণ। মানব চরিত্রের তেমনি একটি বৈশিষ্ট্যকে কেরোসিন শিখার মাধ্যমে রূপায়ণ করা হয়েছে। অর্থ-বিত্ত, সামাজিক পদমর্যাদা ইত্যাদির স্বপ্নে বিভোর হয়ে কখনও কখনও নিজের অতি আপনজনকেও চিনতে পারে না। মানুষ যখন টাকা-পয়সা, পদমর্যাদা প্রভৃতি দিক থেকে সমাজে উচ্চ অবস্থান অর্জন করে তখন সে তার আপন মানুষজন আত্মীয় স্বজনকে অবহেলা করে। অবহেলাই কোনো কোনো সময় অস্বীকারে রূপ নেয়।মানুষ যখন চিন্তা করে তার দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক রাখলে তার পদমর্যাদা নষ্ট হতে পারে তখন তার দরিদ্র আপনজনদের আর স্বীকৃতি দিতে চায় না। অথচ এই মানুষটিই আবার তার চেয়ে উচ্চ পদস্থ কারও তোষামোদ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। সেই উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির সাথে সত্যিকার অর্থে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও সে কাল্পনিক সম্পর্ক তৈরি করেই তা সবাইকে জানাতে চায়। সে মনে করে এতে সে সামাজিকভাবে আরও মর্যাদা পাবে, এবং অন্যরা তাকে আরও সমাদর করবে।
এভাবে সে নিজেকে প্রচার করে গর্ববোধ করে। যেখানে নিজের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনদের যে স্বীকার করতেও কুন্ঠাবোধ করে সেখানে দূরের একজন উচ্চ-পদস্থ ব্যক্তির সাথে সে জোর করে কাল্পনিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। মূলত মানুষ নিজের চেয়ে অবস্থানে ছোটদের চরমভাবে অস্বীকার করে, আর বড়দের তোষামদ করে আপন করে নিতে চায়।
শিক্ষা: পদমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান মানুষকে অন্ধ করে দেয়। এর প্রলোভনে মানুষ নিজের আপন মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে, দূরের মানুষকে আপন করার চেষ্টা করে। এতে করে সে তার নিজস্বতাকে হারিয়ে ফেলে, কিছুই অর্জন করতে পারে না।
তোমার মাপে হয়নি সবাই, তুমিও হওনি সবার মাপে তুমি মর কারো ঠেলায়, কেউ-বা মরে তোমার চাপে
মানুষের চাহিদা অফুরন্ত। এই অফুরন্ত চাহিদা পূরণে মানুষ পরস্পরের সাথে এক বিচিত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। একে অপরকে পেছনে ফেলার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। এভাবে অন্যের প্রতি লোভ ও ঈর্ষা মানুষকে করে তোলে আক্রমণাত্মক। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যের ক্ষতি করতেও মানুষ পিছপা হয় না।কোনো মানুষই সর্বগুণ সমৃদ্ধ নয়। দৈহিক সৌন্দর্য ও ধন সম্পদ সবার সমান থাকে না। এটাই বাস্তবতা। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এ বাস্তবতা মেনে নিতে পারে না। তাই প্রত্যেক মানুষই নিজের অবস্থানে হয় অসুখী। যা নিজের নেই সেটার প্রতিই মানুষের আকর্ষণ তীব্র। এই না থাকা জিনিসগুলো অর্জন করার জন্য মানুষ ব্যগ্র হয়ে ওঠে।
আমৃত্যু মানুষ ছুটতে থাকে স্বপ্ন পূরণের আশায়। একটি স্বপ্ন পূরণ হলে আবার ধাওয়া করে অন্য স্বপ্নের পেছনে। এভাবে মানুষের আকাখ্ক্ষা শুধু বাড়তেই থাকে। এর কোনো শেষ হয় না। যেন অবিরাম চলছে মানুষের পাওয়া না পাওয়ার যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে মানুষ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সবাই মনে প্রাণে চেষ্টা করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে নিজে বিজয়ী হতে। এই বিজয়ের নেশায় মানুষ তার বিবেক, বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব সব বিসর্জন দেয়। নিজের চাহিদা মিটাতে অন্যের ওপর চালায় নির্যাতন। অপরকে পদদলিত করে নিজের অবস্থানে পৌঁছাতে দ্বিধাবোধ করে না।
শিক্ষা: স্বল্প পরিসরের এই জীবনে মানুষ যদি শুধুমাত্র অর্থ-সম্পদ, মান-মর্যাদা অর্জনের পেছনে ছুটতে থাকে তাহলে তারা এই সুন্দর পৃথিবীর কোনো আনন্দ উপভোগ করতে পারবে না। তাই মানুষের উচিত নিজের যা আছে তাই নিয়েই সুখী হওয়ার চেষ্টা করা।
নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভাল, যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো
মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আর সেই ভুলের সুযোগ নেয় নিন্দুক। মানুষের ছোট বড় দোষ ত্রুটি নিয়ে কুৎসা রটনা করে বেড়ানোই নিন্দুকের কাজ। ফলে আমরা নিন্দুকের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। প্রকৃত পক্ষে নিন্দুক আমাদের ক্ষতির চেয়ে উপকারই বেশি করে।আমাদের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে নিন্দুক আমাদেরকে খাঁটি মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। নিন্দুকেরা মানুষের ভুল গুলো নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠে। এর দ্বারা মূলত ভুলকারী ব্যক্তিকে সে সচেতন করে তোলে। যা প্রকৃত অর্থেই ইতিবাচক। যে ব্যক্তি বন্ধুর ভুল ধরিয়ে না দিয়ে কেবল প্রশংসা করে চলে, সে কখনই প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। কারণ ঐ বন্ধুর এক তরফা প্রশংসা তার জীবনকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে।
কিন্তু নিন্দুক সারাক্ষণই ওঁৎ পেতে থাকে, মানুষ কখন কি ভুল করে, সেই ভুলের সূত্র ধরে সে নানা কথা বলে বেড়ায়। সকলের কাছে নিন্দা করে বেড়ায়। ফলে নিন্দুকের ভয়ে মানুষ সাবধান থাকে। সকল প্রকার দোষ ত্রুটি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কোনো কাজ করার আগে নিন্দুকের ভয়ে মানুষ অনেক বার চিন্তা করে। নিন্দুক যদি না থাকত, তাহলে মানুষ কোনো ভুল করার আগে চিন্তা করার প্রয়োজনবোধ করতো না। তাই মানুষকে ভুল থেকে দূরে রাখতে এবং অকল্যাণ কর্মতৎপরতা থেকে মুক্তি দিতে নিন্দুকের তুল্য কেউ নেই।
শিক্ষা: নিন্দুক আমাদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে সংশোধিত হবার সুযোগ করে দেয়। ফলে আমাদের ব্যক্তি জীবন ও সমাজজীবনে ত্রুটি বিচ্যুতির পরিমাণ অনেকাংশেই কমে যায়।
পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন
মানুষ একা বাস করতে পারে না। তাকে সমাজের মধ্যে বাস করতে হয়। সমাজে প্রতিটি মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাস করে। মানুষের অন্যতম মানবিক এবং নৈতিক গুণ হচ্ছে একে অপরের কল্যাণসাধন করা। মানুষ শুধু নিজের কথা চিন্তা করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে না। মানুষকে তার চারপাশের জগৎ নিয়েও ভাবতে হয়।যে ব্যক্তি সর্বদা অন্যের কল্যাণ এবং উপকারের কথা চিন্তা করে, সেই ব্যক্তি সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হন। কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে কেউ যখন নিজের ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তখন সে অন্যের ক্ষতি করতেও পিছপা হয় না।
অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করা চরম অন্যায় হিসেবে বিবেচিত। অন্যায়কারীরা নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে সমাজ, দেশ এবং জাতির চরম ক্ষতিসাধন করে। এরা সমাজের মানুষের নিকট ঘৃণ্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। অন্যায়কারীরা সব সময় হীনমন্যতায় ভোগে। তাই তাদের মন-মানসিকতায় শুদ্ধি আসে না। ফলে তারা তাদের কর্মক্ষেত্র তথা জীবনে উন্নতি করতে পারে না। পরের অনিষ্টকারী ব্যক্তিরা অপরের জন্য পাতা ফাঁদে নিজেরাই পতিত হয়। নিজ স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে মহাবিপদ ডেকে আনে।
শিক্ষা: প্রত্যেক মানুষেরই উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপরের মঙ্গল কামনা করা, অপরের মঙ্গল করার চেষ্টা করা। তবেই নিজের কল্যাণ সাধিত হবে।
ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ
প্রাণীকূলের মধ্যে সবচেয়ে পরিশ্রমী প্রাণী ধরা হয় পিপড়া এবং মৌমাছিকে। শুধু কর্মই যদি শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হত তবে মানুষের আগে শ্রেষ্ঠত্ব পেত পিপড়া এবং মৌমাছি। মানুষকে অন্য সকল প্রাণী থেকে শ্রেষ্ঠ করেছে তার জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি এবং চিন্তা করার ক্ষমতা। পরিশ্রমের পাশাপাশি এই তিনের সমন্বয় প্রতিটি মানুষকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে। মানুষ মাত্রই ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করবে। প্রতিটা মানুষের বর্তমান জুড়ে থাকে তার ভবিষ্যতের ভাবনা।কাজেই ভবিষ্যতই হল মানব জাতির একমাত্র চিন্তার স্থল। ভবিষ্যতের কর্ম-পরিকল্পনাই ঠিক করে দেয় জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে কারা বসবে। কে নেতৃত্ব দেবে আগামীর পৃথিবীকে। ক্ষুদ্র পিপীলিকা আর মৌমাছি যদি আগত শীতের জন্য সারা বছর খাদ্য সঞ্চয় করে ভবিষ্যতকে নিরাপদ করতে পারে; তবে মানুষ হিসেবে আমাদেরও উচিত ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবা। সাধারণ মানুষ আর জ্ঞানীজনদের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় কর্ম পরিকল্পনা। আজকের পৃথিবী উন্নত বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্বে বিভক্ত শুধু ভবিষ্যতের কর্মপন্থা আর তার বাস্তবায়নের জন্য।
প্রকৃত জ্ঞানী যারা তারাই ঠিক করে রাখে আগামী দিন কি করবে। ভবিষ্যতের ভাবনায় যাদের বর্তমান কাটে তারাই প্রকৃত জ্ঞানী। কারণ, বলা হয়ে থাকে “একটি ভাল পরিকল্পনা কর্ম সম্পাদনের অর্ধেক পথ অতিক্রম করে।” কাজেই ভবিষ্যৎ নিযে যে যত ভাবে তার উন্নতি তত বেশি বেগবান হয়।
শিক্ষা: মানুষ অতীত থেকে শুধু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারে। জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতকে সাজানোর কোন বিকল্প নেই। আর তাই ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই সকল উন্নয়নশীল জাতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার।
Post By Md.Ripon Mia
No comments:
Post a Comment