এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান,
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাবো- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি,
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
সারমর্ম: নতুন প্রজন্মের জন্য পুরাতন প্রজন্মকে স্থান ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান পৃথিবী নানা সংকটে জর্জরিত। তাই সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য সকল জীর্ণতা, ব্যর্থতা, গ্লানি দূর করে দিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য সুন্দর আবাসস্থল গড়ে তুলতে হবে।
ওই যে লাউয়ের জাংলা পাতা ঘর দেখা যায় একটু দূরে
কৃষক বালা আসছে ফিরে পুকুর হতে কলসী পুরে।
ওই কুঁড়েঘর উহার মাঝেই যে চিরসুখ বিরাজ করে,
নাইরে সে সুখ অট্টালিকায়, নাইরে সে সুখ রাজার ঘরে।
কত গভীর তৃপ্তি যে লুকিয়ে আছে পল্লীপ্রাণে,
জানুক কেহ নাই- বা জানুক সে কথা মোর মনই জানে
মায়ের গোপন বিত্ত যা তার খোঁজ পেয়েছে ওরাই কিছু
মোদের মত তাই ওরা আর ছুটে নাকো মোহের পিছু।
সারমর্ম: সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা আমাদের পল্লীগ্রাম। গ্রামের বধূদের পুকুর থেকে জল নিয়ে আসা এবং জীর্ণ কুটিরে বসবাসের মধ্যেও শান্তির ফল্গুধারা বয়ে যায়। কিন্তু ধনিক শ্রেণির প্রচুর্যের মধ্যেও এ সুখ নেই। তাই শান্ত সিগ্ধ পল্লির মমতাময় জীবন ছেড়ে প্রাচুর্যের মোহের দিকে কেউ ধাবিত হয় না।
কতবার এল কত না দস্যু, কত না বার
ঠগে ঠগে হল আমাদের কত গ্রাম উজাড়
কত বুলবুলি খেল কত ধান-
কত মা গাইল বর্গীর গান-
তবু বেঁচে থাকে অমর প্রাণ-
এ জনতার-
কৃষাণ, কুমোর, জেলে, মাঝি, তাঁতি আর কামার,
অমর দেশের মাটিতে মানুষ তাদের প্রাণ-
মূঢ় মৃত্যুর মুখে জাগে তাই কঠিন গান।
সারমর্ম: বাঙালির ইতহাস রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস। সুদীর্ঘকাল থেকে বাংলার বুকে নেমে এসেছে অত্যাচারের খড়গ। তবু বাংলার সংগ্রামী শ্রমজীবী মানুষ বহিরাগত আক্রমণের মুখেও অব্যাহত রেখেছে জীবনধারা।
কবি, তবে ওঠে এসো- যদি থাকে প্রাণ
তবে তাই লয়ে সাথে, তবে তাই করো আজি দান।
বড়ো দুঃখ বড়ো ব্যথা - সম্মুখে কষ্টের সংসার
বড়ই দরিদ্র, শূন্য বড় ক্ষুদ্র, বদ্ধ, অন্ধকার।
অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,
সাহস বিস্তৃত বক্ষপট। এ দৈন্য-মাঝারে, কবি,
একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি।
সারমর্ম: জাতীয় জীবনে সুখ-দুঃখ, হতাশা-ব্যথর্তার গ্লানি মোচন করে জাতির পুনরুজ্জীবনে কবিকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। কবি তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে জাতির সংকট উত্তরণে সাহস ও উৎসাহ যোগাবেন। একই সঙ্গে হতাশাগ্রস্ত জাতিকে দেখাবেন নবজীবনের সম্ভাবনা।
কহিল গভীর রাত্রে সংসার বিরাগী
‘গৃহ তেয়াগিব আমি ইষ্ট-দেব লাগি।
কে আমারে ভুলাইয়া রেখেছে এখানে!”
দেবতা কহিলা, “আমি।” শুনিল না কানে।
সুপ্তিমগ্ন শয্যার প্রান্তে ঘুমাইছে সুখে।
কহিল, “কে তোরা, ওরে মায়ার ছলনা।”
দেবতা কহিলা, “আমি”। কেহ শুনিল না।
ডাকিল শয়ন ছাড়ি, “তুমি কোথা প্রভু!”
দেবতা কহিলা, “হেথা”। শুনিল না তবু।
স্বপনে কাঁদিল শিশু জননীরে টানি,
দেবতা কহিলা, “ফির”। শুনিল না বাণী।
দেবতা নিঃশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, “হায়,
আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়!”
সারমর্ম: স্রষ্টার কাছে প্রিয় তাঁর সৃষ্টি। তাই তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসলে তাঁকে পাওয়া যায়। তাই সংসার ধর্ম ত্যাগ করে কখনো স্রষ্টাকে পাওয়া যাবে না। বরং গৃহে থেকেই স্রষ্টার সাধনা করা যায়।
কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল
মাঠ ভারে দেই আমি কত শস্য ফল;
পর্বত দাঁড়ায়ে রহে কি জানি কি কাজ
পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ।
বিধাতার অবিচারে কেন উঁচু নিচু,
সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু।
গিরি কহে, “সব হলে সমভূমি পারা
নামিত কি ঝরনার সুমঙ্গল ধারা?”
সারমর্ম: এ বিশ্বসংসারে সবাই একই রকম কর্তব্য পালন করে না। তাই বলে কাউকে ছোট বা অপ্রয়োজনীয় মনে করা যাবে না। বরং যে কেউ, যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন সবাইকে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। কারণ সবকিছুরই একে অপরের প্রতি একটা যোগসূত্র আছে।
কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টের করব মোরা পরিহাস।
রিক্ত যারা সর্বহারা, সর্বজয়ী বিশ্বে তারা,
গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর নয়কো তারা ক্রীতদাস।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।
আমরা সুখের স্ফীত বুকের ছায়ার তলে নাহি চরি।
আমরা দুঃখের বক্রমুখের চক্র দেখে ভয় না করি।
ভগ্ন ঢাকে যথাসাধ্য বাজিয়ে যাব জয়বাদ্য,
ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে ভিন্ন করব নীলাকাশ।
হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস।।
সারমর্ম: মানবজীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী তেমনি সংগ্রামমুখর। এই সংগ্রামে সুখের সঙ্গে দুঃখ কষ্ট বিদ্যমান। তাই দুঃখের সময় হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া যাবে না। বরং সকল দুঃখ-কষ্ট, প্রতিকূলতা জয় করে সম্মুখে এগিয়ে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ,
সমস্ত পৃথিবী চলিতেছে যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর,
‘যেতে আমি দেব না তোমায়।’ ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে,
‘যেতে নাহি দিব; যেতে নাহি দিব।’ সবে
কহে, ‘যেতে নাহি দিব।’ তৃণ ক্ষুদ্র অতি,
তাঁরেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে, ‘যেতে নাহি দিব।’
আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব,-
আঁধারে গ্রাস হতে কে টানিছে তারে,
কহিতেছে শতবার, ‘যেতে দিব নারে।’
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত্য ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে
গভীর ক্রন্দন, ‘যেতে নাহি দিব।’ হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
সারমর্ম: এ পৃথিবীতে কোনো প্রাণীই চিরস্থায়ী নয়। তবু এ পৃথিবী থেকে কেউ যেমন চলে যেতে চায় না তেমনি সবাই সবাইকে ধরে রাখতে চায়, কিন্তু সবাই ব্যর্থ। ইহকাল ছেড়ে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। এটাই জগতের বিধান।
কুকুর আসিয়া এমন কামড় দিল পথিকের পায়,
কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে বিষ লেগে গেল তায়।
ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা বিষম ব্যথায় জাগে,
মেয়েটি তাহার, তারি সাথে হায়., জাগে শিয়রের আগে।
বাপেরে সে বলে ভর্ৎসনা ছলে কপালে রাখিয়া হাত,
তুমি কেন বাবা ছেড়ে দিলে তারে, তোমার কি নেই দাঁত?
কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল, “তুইরে হাসালি মোরে,
দাঁত আছে বলে কুকুরে গায়ে দংশি কেমন করে?
কুকুরের কাজ কুকুর করেছে, কামড় দিয়েছে পায়,
তা’বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে মানুষের শোভা পায়?
সারমর্ম: দুর্জন ব্যক্তিরা হীন কর্ম করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা মহান, প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী, তারা কখনো আঘাত পেলেও পাল্টা আঘাত করবে না। বরং শত দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনার মধ্যেও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন।
কে বলে তোমারে বন্ধু, অস্পৃশ্য অশুচি
শুচিতা ফিরিছে সাদা তোমারি পিছনে।
তুমি আছ, গৃহবাসে তাই আছে রুচি,
নইলে মানুষ বুঝি ফিরে যেত বনে।
শিশুজ্ঞানে সেবা তুমি করিতেছ সবে,
ঘুচাইছ রাত্রিদিন সর্ব ক্লেদ গ্লানি।
ঘৃণার নাহিক কিছু স্নেহের মানবে,
হে বন্ধু, তুমিই একা জেনেছ সে বাণী।
নির্বিচারে আবর্জনা বহু অহর্নিশ
নির্বিকার সদা শুচি তুমি গঙ্গাজল।
নীলকণ্ঠ করেছেন পৃত্বীবে নির্বিষ।
আর তুমি? তুমি তারে করেছ নির্মল।
এস বন্ধু, এস বীর, শক্তি দাও চিতে
কল্যাণের কর্ম করি লাঞ্ছনা সহিতে।
সারমর্ম: অস্পৃশ্য, অশুচি বলে সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষদের অপবাদ দেয়া অন্যায়। তারা কাজ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সমস্ত জঞ্জাল পরিষ্কার করে পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী করে। তাদের নিকট থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে এবং আমাদের উচিত এই মেহনতি মানুষদের সম্মান করা।
কে তুমি খুঁজিছ জগদীশে ভাই, আকাশপাতাল জুড়ে
কে তুমি ফিরিছ বন জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে?
হায় ঋষি দরবেশ,
বুকের মানিককে বুকে ধরে তুমি খোঁজ তারে দেশ দেশ।
সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে,
স্রষ্টারে খোঁজো আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে।
ইচ্ছা-অন্ধ। আঁখি খোলো, দেখ দর্পণে নিজ কায়া,
দেখিবে তোমারি সব অবয়বে পড়েছে তাঁহার ছায়া।
সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি,
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।
সারমর্ম: বিধাতাকে পাওয়ার জন্য মানুষ সংসার ত্যাগ করে বৈরাগী হতে চায়। কিন্তু স্রষ্টা তার সৃষ্টির মধ্যেই বিরাজমান। তাই অন্তর্দৃষ্টি খুলে নিজেকে জানার মাধ্যমেই বিধাতাকে খুজে পাওয়া যায়।
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়েঘরে।
সারমর্ম: স্বর্গ ও নরক দূরে কোথাও নয়, মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। নিজের কর্মফলের মধ্য দিয়ে মানুষ স্বর্গ ও নরকের ফল ভোগ করে। যারা বিবেকবর্জিত অন্যায় করে বেড়ায় তারা পৃথিবীতেই নরক যন্ত্রণার ফল ভোগ করে। পক্ষান্তরে যারা হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ত্যাগ করে সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে তারা পৃথিবীতেই স্বর্গ সুখ লাভ করে।
ক্রন্দিছে নিখিল বন্দী, হে নবীন, মুক্ত কর তারে,
নিয়ে চল আলো অভিসারে।
পৃথিবীর অধিকার-বঞ্চিত যে ভিক্ষুকের দল-,
জীবনের বন্যাবেগে তাদের কর বিচঞ্চল। অসত্য অন্যায়
যত ডুবে থাক, সত্যের প্রসাদ
পিয়ে লভ অমৃতের স্বাদ।
অজস্র মৃত্যুরে লঙ্ঘি হে নবীন, চল অনায়াসে
মৃত্যুঞ্জয়ী জীবন-উল্লাসে।
সারমর্ম: এ পৃথিবীতে নবীনরাই মৃত্যুভয়কে জয় করে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে পারে। তাইতো শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে প্রতিবাদী হয়ে সংগ্রামের পথে যেতে হবে। মানবতার এ পথই চিরায়ত কল্যাণের
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা।
তোমার আদেশ, যেন রসনায় মম
সত্য বাক্য জ্বলি উঠে খর খড়গ সম।
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।
সারমর্ম: ক্ষমা মহৎ গুণ হলেও তা যেন সত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। যদি হয় তাহলে সেখানে দুর্বলতা প্রকাশ পায়। এজন্য অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় না দেওয়াই উত্তম। কেননা, অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী দুজনেই সমঅ
ক্ষুদ্র এই তৃণদল ব্রহ্মান্ডের মাঝে
সরল মাহাত্ম্য লয়ে সহজে বিরাজে;
পূরবের নব সূর্য, নিশীথের শশী
তৃণটি তাদেরি সাথে একাসনে বসি।
আমার এ গান এও জগতের গানে
মিশে যায় নিখিলের মর্ম মাঝখানে;
শ্রাবণের ধারাপাত, বনের মর্মর
সকলের মাঝে তার আপনার ঘর।
কিন্তু হে বিলাসী, তব ঐশ্বর্যের ভার।
ক্ষুদ্র রুদ্ধ দ্বারে শুধু একাকী তোমার।
সারমর্ম: তৃণলতা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তারও যোগসূত্র রয়েছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে সে সূর্য ও চাঁদের সঙ্গে সমগোত্রীয়। কবির সংগীতের সুরও মিশে যায় বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে। কিন্তু ভোগবিলাসীরা সম্পদকে একান্তভাবে নিজের মনে করে। যে কারণে তারা বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন।
খেয়া নৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে,
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
দুই তীরে দুই গ্রাম আছে জানাশোনা,
সকাল হইতে সন্ধ্যা করে আনাগোনা।
পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব, কত সর্বনাশ,
নূতন নূতন কত গড়ে ইতিহাস-
রক্তপ্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে
সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে!
সভ্যতার নব নব কত তৃষ্ণা ক্ষুধা
উঠে কত হলাহল, উঠে কত সুধা!
শুধু হেথা দুই তীরে, কেবা জানে নাম,
দোঁহাপানে চেয়ে আছে দুইখানি গ্রাম।
এই খেয়া চিরদিন চলে নদীস্রোতে-
কেহ যায় ঘরে, কেহ আসে ঘর হতে।
সারমর্ম: সভ্যতার উষালগ্ন থেকে পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিরাজমান। ফলে রক্ত সংঘাতের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন ইতহাস, সা¤্রাজ্য রচিত হচ্ছে। অথচ বাংলার গ্রাম এ থেকে ব্যতিক্রম। নেই কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত বরং তাদের মধ্যে রয়েছে প্রীতির বন্ধন। এখানে কেউ খেয়া পার হয়ে যায় অথবা কেউ আসে। অর্থাৎ তাদের মধ্যে সহজ সরল জীবনধারা বিরাজমান।
খোদা বলিবেন, হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধার অন্ন, তুমি কর নাই দান।
মানুষ বলিবে, তুমি জগতের প্রভু,
আমরা তোমারে কেমনে খাওয়াব, সে কাজ কী হয় কভু?
বলিবেন খোদা-ক্ষুধিত বান্দা গিয়াছিল তব দ্বারে
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।
সারমর্ম: স্রষ্টার কাছে প্রিয় তার সৃষ্টি, আর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হলো মানুষ। মানুষ ইচ্ছে করলেও স্রষ্টা সরাসরি সেবা করতে পারে না। তাই মানুষের মধ্যে যারা ক্ষুধার্ত তাদেরকে সেবা করলেই ¯স্রষ্টাকে সেবা করা হয়। বিনিময়ে ¯স্রষ্টা ক্ষুধার্তের সেবাকারীকে সমতুল্য সুখ দান করেন।
গাহি তাহাদের গান-
ধরণীর হাতে দিল যারা জানি ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে-ফলে।
বন্য-শ্বাপদ-সঙ্কুল জরা-মৃত্যু-ভীষণ ধরা
যাদের শাসনে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহারা।
সারমর্ম: যাদের কঠিন শ্রমে পৃথিবীর বুকে ফসল উৎপন্ন হয়েছে কবি তাদের জয়গান গেয়েছেন। শ্রমজীবীদের রক্ত ও ঘামেই সভ্যতার বিকাশ ঘটে। তাদের শ্রমেই পৃথিবী অনুপম সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে। তাই যে শ্রমজীবীরা জরা, মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাদেরই জয়গান গাওয়া উচিত।
চাব না পশ্চাতে মোরা, মানিব না বন্ধন ক্রন্দন
হেরিব না দিক-
গণিব না দিনক্ষণ, করিব না বিতর্ক বিচার-
উদ্দাম পথিক।
মুহূর্তে করিব পান মৃত্যুর ফেনিল উন্মত্ততা
উপকণ্ঠ ভরি –
খিন্ন শীর্ণ জীবনের শত লক্ষ ধিক্কার লাঞ্ছনা
উৎসর্জন করি।
সারমর্ম: যারা নব উদ্যমের পথিক তারা কখনো অতীতের মোহে আচ্ছন্ন হয় না, মানে না কোনো বাধা বন্ধন। বরং আত্মত্যাগের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে লাঞ্ছিত জীবনের পরিবর্তে সম্ভাবনাময় জীবনের লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যা
ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল,
গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।
মুহূর্তে নিমেষ কাল, তুচ্ছ পরিমাণ,
গড়ে যুগ যুগান্তর-অনন্ত মহান।
প্রত্যেক সামান্য ত্রুটি, ক্ষুদ্র অপরাধ,
ক্রমে টানে পাপপথে, ঘটায় প্রমাদ।
প্রিত করুণার দান, স্নেহপূর্ণ বাণী,
এ ধারায় স্বর্গসুখ নিত্য দেয় আনি।
সারমর্ম: ক্ষুদ্র থেকেই বৃহতের সৃষ্টি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা নিয়ে গড়ে ওঠে মহাদেশ, বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে মহাসাগর, তুচ্ছ মুহূর্ত নিয়ে যুগ যুগান্তর। আবার ছোট অপরাধ থেকেই সংঘটিত হয় বড় পাপ।
জগতের যত বড় বড় জয় বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহীয়ান।
কোন্ রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে,
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি কত বোন দিল সেবা,
বীরের স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারী,
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।
সারমর্ম: মানব সভ্যতায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় নারীর কোন স্থান হয়নি। অথচ পুরুষের সকল কাজের শক্তি, সাহস ও প্রেরণার যোগানদাতা হচ্ছে নারী।
জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখতে হলে
আগে তবে নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা হাঁট বার বার
পারিব বলিয়া সুখে হও আগুসর।
সারমর্ম: যে কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ সেই সাথে অনুশীলন। কেননা, জলে না নেমে যেমন সাঁতার শেখা যায় না, তেমনি আছাড় না খেলে হাঁটা যায় না। তাই হতাশ না হয়ে সকল দুঃখ কষ্ট সহ্য করে জয়ী হব এই মনোভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়াই উচিত।
জাতিতে জাতিতে ধর্মে নিশিদিন হিংসা ও বিদ্বেষ
মানুষে করিছে ক্ষুদ্র, বিষাইছে বিশ্বের আকাশ,
মানবতা মহাধর্ম রোধ করি করিছে উল্লাস
বর্বরের হিংস্র নীতি, ঘৃণা দেয় বিকৃত নির্দেশ।
জাতি-ধর্ম-দেশ উর্ধ্বে ঘৃণা উর্ধ্বে পাচ্ছ যেই দেশ,
সেথায় সকলে এক, সেথায় মুক্ত সত্যের প্রকাশ,
মানবসভ্যতা সেই মুক্ত সত্য লভুক বিকাশ,
মহৎ সে মুক্তি-সংজ্ঞা মঙ্গল সে নির্বার অশেষ।
জাতি-ধর্ম-রাষ্ট্র ন্যায় সকলি যে মানুষের তরে
মানুষ সবার উর্ধ্বে নহে কিছু তাহার অধিক।
সারমর্ম: মানুষের মধ্যে যে হিংসা বিদ্বেষ বিরাজমান তার মূল কারণ ধর্মীয় ও জাতিগত পার্থক্য। অথচ যেখানে মানবধর্মই বড় ধর্ম, সেখানে জাতিগত বিভেদের কারণে মানবতা ধুলায় লুণ্ঠিত। তাই মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে ধর্মীয় সংঘাত পরিহার করে পৃথিবীর মঙ্গল নিশ্চিত করতে মানবতাকেই দেশকালের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে।
জীবনে যত পূজা হলো না সারা
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।
যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরুপথে হারালো ধারা
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।
জীবনে আজো যারা রয়েছে পিছে
জানি হে, জানি তাও হয়নি মিছে
আমার অনাগত আমার অনাহত
তোমার বীণাতারে বাজিছে তারা
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।
সারমর্ম: এ বিশ্ব জগতে কোনো কর্মই তুচ্ছ বা মূল্যহীন নয়। আমরা দৈনন্দিন জীবনে অনেক কর্ম শুরু করে এর গুরুত্ব বিবেচনা না করে অসমাপ্ত রেখে দেই। কিন্তু এই অসমাপ্ত কাজের ভেতরেই হয়তো সুপ্ত আছে ভাবীকালের সম্ভাবনা। তাই ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় জীবনের জন্য অসমাপ্ত কাজের প্রতি হতাশ হওয়ার কোনো অবকাশ নেই।
জীবন্ত ফুলের ঘ্রাণে,
দুপুরের মিহি ঘুম ছিঁড়ে কুঁড়ে গেল :
জেগে দেখি আমি
আমার ঘরেতে ওড়ে ছোট এক বুনো মৌমাছি,
ডানায় ডানায় যার সোঁদাগন্ধ অজানা বনের।
কেমন সুন্দর ওই উড়ন্ত মৌমাছি।
অশ্রান্ত করুণ ওর গুণগুণানিতে
কেঁপে ওঠে মাটির মসৃণতম গান,
আর দূর পাহাড়ের বন্ধুর বিষন্ন প্রতিধ্বনি।
যেন আজ বাহিরের সমস্ত পৃথিবীর আর সমস্ত আকাশ
আমার ঘরের মাঝে তুলে নিয়ে এল
কোথাকার ছোট এক বুনো মৌমাছি।
সারমর্ম: ঘরের চারদেয়ালের কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে প্রকৃতির সান্নিধ্য যেমন পাওয়া যায় না তেমনি প্রকৃতিকে অনুভবও করা যায় না। এই কৃত্রিম পরিবেশের মধ্যে যদি কখনো লীলাময়ী প্রকৃতি মুক্তহস্তে সৌন্দর্য বিতরণ করে তাহলে আবার মানুষের হৃদয়ে অনির্বচনীয় ভাবের হিল্লোল তুলে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তা কখনো অস্বীকার করা যায় না।
Posted By Md.Ripon Mia
No comments:
Post a Comment