01 November, 2018

বাংলা ব্যাকরণ সারমর্ম ৫১-৭৫

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি
শ্রাবণ গগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
সারমর্ম: মহাকালের প্রতীক তরীতে কেবল সোনার ফসলরূপ মহৎ সৃষ্টিকর্মের স্থান হয়। কিন্তু ব্যক্তিসত্তাকে অনিবার্যভাবে হতে হয় মহাকালের নিষ্ঠুর করাল গ্রাসের শিকার। অর্থাৎ এ নশ্বর পৃথিবীতে মহৎ কর্মের স্থান হলেও ব্যক্তি মানুষের স্থান


তব কাছে এই মোর শেষ নিবেদন-

তব কাছে এই মোর শেষ নিবেদন-
সকল ক্ষমতা মম করহ ছেদন
দৃঢ় বলে, অন্তরের অন্তর হইতে
প্রভু মোর! বীর্য দেহ সুখেরে সহিতে
সুখেরে কঠিন করি। বীর্য দেহ দুখে
যাহে দুঃখ আপনারে শান্তস্মিত মুখে
পারি উপেক্ষিতে। ভকতিরে বীর্য দেহ
কর্মে যাহে হয় সে সফল, প্রীতি স্নেহ
পুণ্যে উঠে ফুটে। বীর্য দেহ ক্ষুদ্র জনে
না করিতে হীন জ্ঞান, বলের চরণে
না লুটিতে। বীর্য দেহ চিত্তেরে একাকী
প্রত্যহের তুচ্ছতার উর্ধ্বে দিতে রাখি।
বীর্য দেহ তোমার চরণে পাতি শির
অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির।
সারমর্ম: ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত মনুষ্যত্ব ফুটে ওঠে। বৃক্ষ যেভাবে অপরের সুখের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়, মানুষের মনোভাব সেরূপ হতে হবে। এ জন্য কেউ আঘাত করলে আমরা যেন আঘাতকারীর প্রতি ক্রুদ্ধ না হই। এই মানবিক গুণাবলিকেই মানবজীবনের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।


তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি

তারপর এই শূন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি
যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।
শত কাফনের, শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি,
গণিয়া গণিয়া ভুল করে গণি সারা দিনরাত জাগি।
এই মোর হাতে কোদাল ধরি কঠিন মাটির তলে,
গাড়িয়া দিয়াছি কত সোনামুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।
মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে মিশায়ে বুক,
আয়-আয় দাদু, গলাগলি ধরি কেঁদে যদি হয় সুখ।
সারমর্ম: প্রিয়জন হারানোর যে ব্যথা তা প্রতিটি মানুষের জন্যই অত্যন্ত দুর্বিষহ। এই ব্যথা তার জন্য আরো বেশি তীব্র আরো বেশি মর্মান্তিক যার একাধিক স্বজন চলে গেছে না ফেরার দেশে এবং তাদের তিনি নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিয়েছেন। তাই মাটিই তার পরম ভালোবাসার স্থান। স্বজন হারানোর ব্যথায় শোকার্ত মানুষ তাই জীবিতদের আঁকড়ে ধরে দুঃখকে প্রশমিত করতে চান।


তোমার ন্যায়ের দন্ড- প্রত্যেকের করে

তোমার ন্যায়ের দন্ড- প্রত্যেকের করে
অর্পণ করেছ নিজে, প্রত্যেকের পরে
দিয়েছ শাসনভার হে রাজাধিরাজ।
সে গুরু সম্মান তব, সে দুরূহ কাজ
নমিয়া তোমারে যেন শিরোধার্য করি
সবিনয়ে, তব কাজে যেন নাহি ডরি
কভু কারে।
সারমর্ম: ন্যায় এবং সত্যের ধারক পরম করুণাময় স্রষ্টা প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সঞ্চারিত করেছেন ন্যায়-অন্যায় বোধ, বিবেকবোধ আর শাসন করার ক্ষমতা। বিনীত ব্যক্তি স্রষ্টা প্রদত্ত শক্তি এবং ক্ষমতা নির্ভীকচিত্তে, সঠিকভাবে প্রযোগ করতে চান। আর এ জন্য তিনি স্রষ্টার কৃপা প্রার্থনা করেন।


তোমার মাপে হয়নি সবাই

তোমার মাপে হয়নি সবাই
তুমিও হওনি সবার মাপে
তুমি সর কারো ঠেলায়
কেউ-বা সরে তোমার চাপে।
তুমি ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি,
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে
মধুর ঠেকে ভোরের আলো
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুঁজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালমন্দ, যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
সারমর্ম: পৃথিবীর কোনো মানুষই অর্থ-সম্পদ, মান মর্যাদায় সমান নয়। এই অমোঘ সত্য সবাইকে মানতে হবে, না হলে মানবজীবন দুঃখে পর্যবসিত হবে। জীবনে চলার পথে বহু বাধা-বিপত্তি মানবজীবনকে স্থবির করে দেয়। ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, মঙ্গল-অমঙ্গল মানব অস্তিত্বের সঙ্গে বিদ্যমান। তাই যারা দুঃখ, অমঙ্গল, ব্যর্থতাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে তাদের জীবনেই সার্থকতা নিহিত।



তোমাদেরি মাঝে আসে মাঝে মাঝে রাজার দুলাল ছেলে,

তোমাদেরি মাঝে আসে মাঝে মাঝে রাজার দুলাল ছেলে,
পরের দুঃখে কেঁদে কেঁদে যায় শত সুখ পায়ে ঠেলে।
কবি-আরাধ্য প্রকৃতির মাঝে কোথা আছে এর জুড়ি?
অবিচারে মেঘ ঢালে জল, তাও সমুদ্র হতে চুরি।
সৃষ্টির সুখে মহাখুশি যারা তারা নর নহে, জড়;
যারা চিরদিন কেঁদে কাটাইল, তারাই শ্রেষ্ঠতর।
মিথ্যা প্রকৃতি, মিছে আনন্দ, তারাই শ্রেষ্ঠতর।
মিথ্যা প্রকৃতি, মিছে আনন্দ, মিথ্যা রঙ্গিন সুখ;
সত্য সত্য সহস্রগুণ সত্য জীবের সুখ।
সারমর্ম: আবহমানকাল ধরে পৃথিবীতে অনেক মহৎ ব্যক্তির আগমন ঘটেছে যারা মানব সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। মানবকল্যাণের জন্য নিজের স্বার্থকে বলি দিয়ে পরার্থে জীবন বিলিয়ে দিয়েই তারা শান্তি পান। এ জন্য বলা হয়, পরের জন্য ত্যাগের মধ্যেই মানুষের প্রকৃত সুখ নিহিত। এ সত্য তারা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন।



তোমাতে আমার পিতা-পিতামহগণ

তোমাতে আমার পিতা-পিতামহগণ
জন্মেছিলে একদিন আমারি মতন।
তোমারি এ বায়ুতাপে তাহাদের দেহ
পুষেছিলে পুষিতেছ আমায় যেমন।
জন্মভূমি জননী আমার যেথা তুমি
তাহাদেরও সেই রূপ তুমি মাতৃভূমি।
তোমারি কোড়েতে মোর পিতামহগণ
নিদ্রিত আছেন সুখে জীবলীলা শেষে।
তাদের শোণিত অস্থি সকলি এখন
তোমার দেহের সঙ্গে গিয়েছে মা মিশে।
তোমার ধূলিতে গড়া এ দেহ আমার
তোমাদের ধূলিতে কালে মিলাবে আবার।
সারমর্ম: আবহমান কাল ধরে পূর্বপুরুষগণ জন্ম ভূমির আলো বাতাসে বড় হয়ে আবার জন্মভূমির মাটিতেই মিশে গেছেন। তেমনি বর্তমান কালের মানুষও একদিন পূর্বপুরুষদের মতো জন্মভূমির মাটিতে বিলীন হয়ে যাবে। এজন্যই প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষ জন্মভূমির প্রতি কৃতজ্ঞ।



তোমার প্রেম যে বইতে পারি

তোমার প্রেম যে বইতে পারি
এমন সাধ্য নাই।
এ সংসারে তোমার আমার
মাঝখানেতে তাই-
কৃপা করে রেখেছ, নাথ,
অনেক ব্যবধান-
দুঃখ-সুখের অনেক বেড়া
ধন জন-মান।
আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে
আভাসে দাও দেখা-
কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
রবির মৃদু রেখা।
শক্তি যারে দাও বহিতে
অসীম প্রেমের ভার
একেবারে সকল পর্দা
ঘুচায়ে দাও তার।
সারমর্ম: এ বিশ্বের সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন মহান ¯স্রষ্টা। তিনি সবার মধ্যেই অবস্থান করেন। আকার-ইঙ্গিতে তার পরিচয়ও দেন। কিন্তু ভক্তরা তা উপলব্ধি করতে পারে না। কারণ ধন, জন, মান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য ভক্ত প্রার্থনা করেন, আকার-ইঙ্গিতে নয় বরং সকল বাধাকে অতিক্রম করে তিনি যেন ভক্তের সম্মুখে নিজেকে প্রকাশ করেন।


থাকো স্বর্গে, হাস্যমুখে-করো সুধা পান

থাকো স্বর্গে, হাস্যমুখে-করো সুধা পান
দেবগণ। স্বর্গে তোমাদের সুখস্থান,
মোরা পরবাসী। মর্ত্যভূমি স্বর্গ নহে,
সে যে মাতৃভূমি-তাই তার চক্ষে বহে
অশ্রুজলধারা, যদি দু’দিনের পরে
কেহ তারে ছেড়ে যায় দু’ দন্ডের তরে।
যত ক্ষুদ্র, যত ক্ষীণ, যত অভাজন,
যত পাপীতাপী, মেলি ব্যগ্র আলিঙ্গন।
সবারে কোমল বক্ষে বাঁধিবারে চায়-
ধূলিমাখা তনুস্পর্শে হৃদয় জুড়ায়
জননীর। স্বর্গে তবে বহুক অমৃত,
মর্ত্যে থাক সুখে-দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত
প্রেমধারা অশ্রুজলে চিরশ্যাম করি
ভূতলের স্বর্ণখন্ড-গুলি।
সারমর্ম: দেবতাদের বাসস্থান স্বর্গে রয়েছে অবারিত সুখ। অন্যদিকে পৃথিবীতে সুখ যেমন আছে তেমনি আছে দুঃখও। পৃথিবী তার সকল সন্তানকে প্রেম-ভালোবাসা আর স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। তাই স্বর্গ নয়, সুখ-দুঃখে ঘেরা মাতৃস্নেহ বিজড়িত এই সত্যলোকই মানুষের কাছে প্রিয়।


দন্ডিতের সাথে

দন্ডিতের সাথে
দন্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে
সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার। যার তরে প্রাণ
কোন ব্যথা নাহি পায়, তার দন্ডে দান
প্রবলের অত্যাচার। যে দ- বেদনা
পুত্ররে না পার দিতে, সে কারেও দিও না।
যে তোমার পুত্র নহে, তারও পিতা আছে,
মহাঅপরাধী হবে তুমি তার কাছে।
সারমর্ম: বিচারকের আসনে যিনি বসেন, সুষ্ঠু ন্যায় বিচার সম্পাদন করাই তার দায়িত্ব। দোষীকে শাস্তি দিয়ে সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনার মহান ব্রত তার। তবে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে তাকে হতে হয় নিরপেক্ষ এবং সহানুভূতিশীল। যাকে শাস্তি প্রদান করা হলো তার দুঃখে যদি বিচারকের প্রাণ কাঁদে তবেই সে বিচার শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে।



দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,

দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর,
হে নব সভ্যতা। হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন, পুণ্যছায়া রাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবার-ধান্যের মুষ্ঠি বল্কল-বসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন,
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব,
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব।
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার;
পরানে স্পর্শিতে চাইছিড়িঁয়া বন্ধন,
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।
সারমর্ম: নাগরিক সভ্যতা কেড়ে নিয়েছে মানুষের অরণ্য লালিত স্নিগ্ধ জীবনকে। ভোগ, বাসনায় পরিপূর্ণ নগরে আধুনিক জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা থাকলেও নেই প্রাণের উচ্ছ্বাস। যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ মানুষ হারিয়ে ফেলেছে মানবিকতা, সহমর্মিতা, জীবনের সৌন্দর্য। তাই মানুষ আজ সে আরণ্যক জীবন ফিরে পেতে চায়।


দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার

দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার।
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছে জোয়ান হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
সারমর্ম: পৃথিবীতে শান্তি, সাম্য আর স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন এমন একজন তরুণ নেতার যে সঠিক পথে সকল মানুষকে চালিত করতে পারবে। এ পৃথিবীর পথ নানা প্রতিবন্ধকতায় পরিপূর্ণ। এই প্রতিকূল অবস্থায় মানুষ প্রতিনিয়ত পথ হারাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মানুষকে উত্তরণের জন্য সমগ্র বিশ্বের হাল ধরবে যে সাহসী তরুণ, তাকেই এখানে আহ্বান করা হয়েছে।


দুঃখী বলে, ‘বিধি নাই, নাহিক বিধাতা;

দুঃখী বলে, ‘বিধি নাই, নাহিক বিধাতা;
চক্রসম অন্ধ ধরা চলে।’
সুখী বলে,‘কোথা দুঃখ, অদৃষ্ট কোথায়?
ধরণী নরের পদতলে।’
জ্ঞানী বলে,-‘কার্য আছে, কারণ দুর্জ্ঞেয়;
এ জীবন প্রতীক্ষা কাতর।’
ভক্ত বলে,-‘ধরণীর মহারসে সদা
ক্রীড়ামত্ত রসিক শেখর।’
ঋষিবলে,-‘ধ্রুব তুমি, বরেণ্য ভূমান।’
কবি বলে,-‘তুমি শোভাময়।’
গৃহী আছি,-‘জীবনযুদ্ধে ডাকি হে কাতরে,
দয়াময় হও হে সদয়।’
সারমর্ম: বিচার বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা, মন মানসিকতায় পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ একে অপরের থেকে পৃথক। দুঃখী ব্যক্তির কাছে জীবন চির দুঃখময় আর সুখীর কাছে জীবন হলো চির সুখের। তেমনিভাবে জ্ঞানী তার কাজের দ্বারা, ভক্ত তার ভক্তি দ্বারা, ঋষি তার দর্শন দ্বারা জীবন ও জগৎকে বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। গৃহী মানুষ প্রতিনিয়ত জীবনযুুদ্ধে বিপর্যস্ত তাই সে স্রষ্টার কাছে করুণা প্রার্থনার মধ্য দিয়ে জীবনের অর্থ খুঁজে পায়।


দৈন্য যদি আসে আসুক, লজ্জা কিবা তাহে?

দৈন্য যদি আসে আসুক, লজ্জা কিবা তাহে?
মাথা উঁচু রাখিস।
সুখের সাথী মুখের পানে যদি না চাহে
ধৈর্য ধরে থাকিস।
রুদ্ররূপে তীব্র দুঃখ যদি আসে নেমে,
বুক ফুলিয়ে দাঁড়াস।
আকাশ যদি বজ্র নিয়ে মাথায় পড়ে ভেঙে
র্ঊর্ধ্বে দু’হাত বাড়াস।
সারমর্ম: জীবনের চলার পথে দুঃখ, দারিদ্র্যের মতো নানা প্রতিবন্ধকতা এসে জীবনকে রুদ্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তাতে ভয় পেয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলা উচিত নয়। বরং সকল প্রতিকূল অবস্থাকে মোকাবেলা করার সাহস হৃদয়ে ধারণ করতে হবে।


দ্যাখ, মানুষের কষ্ট থাকে না, হয় দিনে লোক খাঁটি

দ্যাখ, মানুষের কষ্ট থাকে না, হয় দিনে লোক খাঁটি
সোনার ফসল ফলায় যখন পায়ের তলার মাটি
মাটিরই যদি না এ হেন মূল্য মানুষের দাম নেই?
এই সংসারে এই সোজা কথা সব আগে বোঝা চাই।
বিশ্বপিতার মহাকারবার এই দিন দুনিয়াটা,
মানুষই তাহার মহামূল্যধন, কর্ম তাহার খাটা;
তাঁরি নাম নিয়ে খাটিবে যে জন, অন্ন তো তার মুখে,
বিধাতার এই সাচ্চা বাচ্চা কখনো পড়ে না দুঃখে।
তবে যে একথায় দেখিবারে পাই গরিবের দুর্গতি,
অর্থ তাহার- চেনা না সে তার শক্তির সংহতি।
সারমর্ম: এ পৃথিবীতে প্রকৃত খাঁটি মানুষ মাটিতেও সোনা ফলাতে পারে। সে পরিশ্রম ও মেধা দ্বারা সকল দুঃখ, কষ্টকে লাঘব করতে পারে। কর্মব্যস্ততাই জীবনকে সফল করে আর অলসতা জীবনকে ব্যর্থ করে।


ধন্য আশা কুহকিনী। তোমার মায়া

ধন্য আশা কুহকিনী। তোমার মায়া
অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি।
দাঁড়াইত স্থিরভাবে, চলিত না হায়
মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি।
ভবিষ্যৎ অন্ধ, মূঢ় মানবসকল
ঘুরিতেছে কর্মক্ষেত্রে বর্তুল-আকার,
তব ইন্দ্রজালে মুগ্ধ, পেয়ে তব বল।
বুঝিছে জীবনযুদ্ধে হায় অনির্বার
নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে
নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে।
সারমর্ম: জীবনে চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে আশা মানুষকে সঞ্জীবিত করে। আশা আছে বলেই মানুষ তার ভবিষ্যতকে না জেনেও সেই পথেই অগ্রসর হয়, বর্তমানকে সাদরে গ্রহণ করে। অর্থাৎ সংসারচক্রে আশাই মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা।


ধান করো, ধান হবে, ধুলোর সংসারে এই মাটি

ধান করো, ধান হবে, ধুলোর সংসারে এই মাটি
তাতে যে যেমন ইচ্ছা খাটি।
বসে যদি থাক তবু আগাছায় ধরে কিছু ফুল
হলদে-নীল তারি মধ্যে, রুক্ষ মাটি তবু নয় ভুল
ভুল থেকে সরে সরে অন্য কোন নিয়মের চলা,
কিছু না কিছুর খেলা, থেমে নেই হওয়ার শৃঙ্খলা,
সৃষ্টি মাটি এত মত।
তাইতো আরও বেশি ভাবি
ফলাবো না কেন তবে আশ্চর্যের জীবনের দাবি।
সারমর্ম: জগৎ ও জীবন চলমান। চলমান এই জীবনে মানুষ নিজ খুশি মতো পরিশ্রম করে এবং তার ফল লাভ করে। পরিশ্রম না করলেও জীবন পৃথিবীর নিয়মে চলতে থাকবে। কিন্তু পরিশ্রম করাটাই বাঞ্ছনীয়। কারণ এর মাধ্যমেই জীবন সার্থক ও সুন্দর হয়ে ওঠে।


ধুপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে,

ধুপ আপনারে মিলাইতে চাহে গন্ধে,
গন্ধ সে চাহে ধুপেরে রহিতে জুড়ে।
সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে
ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।
ভাব পেতে চায় রূপের মাঝার অঙ্গ,
রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।
অসীম সে চাহে সীমার নিবিড় সঙ্গ,
সীমা চায় হতে অসীমের মাঝে হারা।
প্রলয়ে সৃজনে না জানি এ কার যুক্তি
ভাব হতে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসা।
বন্ধ ফিরিছে খুঁজিয়া আপন মুক্তি,
মুক্তি মাগিছে বাঁধনের মাঝে বাসা।
সারমর্ম: পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত রূপ অরূপের লীলাখেলা চলছে। তাই সীমা অসীমের মাঝে হারিয়ে যেতে চায়, মূর্ত বিমূর্তের মাঝে মিশে যেতে চায়। অরূপ ঈশ্বর এবং রূপময় জগতের এই পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিনিয়ত চলমান।


নর কহে ধূলিকণা, তোর জন্ম মিছে,

নর কহে ধূলিকণা, তোর জন্ম মিছে,
চিরকাল পড়ে রলি চরণের নিচে।
ধূলিকণা কহে, ভাই, কেন কর ঘৃণা?
তোমার দেহের আমি পরিণাম কিনা।
মেঘ বলে সিন্ধু তব জনম বিফল
পিপাসায় দিতে নার এক বিন্দু জল।
সিন্ধু বলে পিতৃনিন্দা কর কোন মুখে?
তুমিও অপেয় হবে পড়িলে এ বুকে।
সারমর্ম: মানুষ যখন নিচু অবস্থান থেকে উঁচু অবস্থানে উন্নীত হয় তখন সে স্বভাবতই ভুলে যায় তার অতীতকে। এ ধরনের মানুষ তার অতীতকে স্বীকার তো করেই না বরং নানাভাবে তাকে অবহেলা করে। সে ভুলে যায় তার আপন অস্তিÍত্বকে, আপন উত্থানের শক্তিকে। এ ধরনের মানসিকতা কোনো সমাজেই কাম্য নয়।


নমি আমি প্রতিজনে, আদ্বিজ চন্ডাল,

নমি আমি প্রতিজনে, আদ্বিজ চন্ডাল,
প্রভু, ক্রীতদাস।
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু-বিশ্বমূলে অণু;
সমগ্রে প্রকাশ।
নমি কৃষি তন্তুজীবী স্থপতি, তক্ষক,
কর্ম, চর্মকার।
অদ্রিতলে শিলাখন্ড- দৃষ্টি অগোচরে
বহু অদ্রি-বার।
কত রাজ্য, কত রাজা গড়িছ নীরবে
হে পূজা, হে প্রিয়।
একত্বে বরেণ্য তুমি, শরণ্য এককে-
আত্মার আত্মীয়।
সারমর্ম: বিন্দু থেকেই সিন্ধুর সৃষ্টি। ঠিক তেমনিভাবে একটি সভ্যতা প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদানের সম্মিলনে গড়ে ওঠে। তাই কোনো মানুষকে ছোট ভাবা বা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই মানবসমাজের প্রতিটি মানুষকে তাই সমানভাবে সম্মান, শ্রদ্ধা করতে হবে।


নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,

নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল।
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান।
স্বর্ণ করে নিজ রূপে অপরে শোভিত,
বংশী করে নিজ সুরে অপরে মোহিত।
শস্য জন্মাইয়া নাহি খায় জলধরে
সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত তরে।
সারমর্ম: তারাই মহৎ যারা অপরের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেন। নদী, গাছপালা, মেঘ-বৃষ্টি, স্বর্ণ-রৌপ্য প্রভৃতি অপরের মঙ্গল সাধনের জন্য আত্মোৎসর্গ করে। যারা প্রকৃত ভালো মানুষ তারা এদের মতোই অপরের কল্যাণ কামনায়, অপরের সুখের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন।

নদীতীরে মাটি কাটে সাজাইতে পাঁজা

নদীতীরে মাটি কাটে সাজাইতে পাঁজা
পশ্চিমী মজুর। তাহাদেরি ছোট মেয়ে
ঘাটে করে আনাগোনা, কত ঘষামাজা।
ঘটি-বাঁটি-থালা লয়ে আসে ধেয়ে ধেয়ে।
দিবসে শতেক বার পিতল-কঙ্কণ
পিতলের থালি পড়ে বাজে ঠন ঠন।
বড় ব্যস্ত সারাদিন। তারি ছোট ভাই,
নেড়ামাথা, কাদামাথা, গায়ে বস্ত্র নাই,
পোষা পাখিটির মতো পিছে পিছে এসে
বসি থাকে উচ্চ পাড়ে দিদির আদেশে,
স্থির ধৈর্যভরে। ভরা ঘট লয়ে সাথে,
বাম কক্ষে থালি, যায় বালা ডানহাতে
ধরি শিশু কর। জননীর প্রতিনিধি,
কর্মভারে অবনত অতি ছোট দিদি।
সারমর্ম: কাজে কর্মে, স্নেহের বাঁধনে, শাসনের আবেষ্টনে প্রতিটি মেয়েই তার মায়ের প্রতিনিধি। সংসারের ছোট-বড় নানা কাজ সে মায়ের মতোই সয়ত্নে করার চেষ্টা করে। নিজের ছোট ভাইটিও তার মাতৃসুলভ স্নেহে সিক্ত। কেবল স্নেহ দিয়েই নয়, মায়ের মতো শাসন করেও সে তার ভাইটিকে তার সংস্পর্শে রাখে।




নদী আর কালগতি একই সমান,

নদী আর কালগতি একই সমান,
অস্থির প্রবাহ করে উভয়ে প্রয়াণ।
ধীরে ধীরে নীরব গমনে গত হয়;
কিবা ধনে, কিবা স্তবনে ক্ষণেক না রয়।
উভয়েই গত হলে আর নাহি ফিরে,
দুস্তর সাগর শেষে গ্রাসে উভয়েরে।
বিফলে বহে না নদী যথা নদী ভরা,
নানা শস্য শিরোরত্নে হাস্যময়ী ধরা।
কিন্তু কাল, সদাত্মা ক্ষেত্রে শোভাকর,
উপেক্ষায় রেখে যায় মরু ঘোরতর।
সারমর্ম: নদী এবং কাল নীরবে ধাবমান। নদী যেমন সাগরে পতিত হয় তেমনি কালও পতিত হয় মহাকালে। সেখান থেকে তাদের ফেরা কখনো সম্ভব নয়। নদী প্রবাহিত হওয়ার সময় শত বাধাকে উপেক্ষা করেও তার চারপাশকে শস্য-শ্যামল করে তোলে। কিন্তু সময়কে উপেক্ষা করলে মানুষ জীবনে কোনো কাজেই সফল হতে পারে না।


নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো,

নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো,
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।
সবাই মোরে ছাড়তে পারে বন্ধু যারা আছে,
নিন্দুক সে ছায়ার মতো থাকবে পাছে পাছে।
বিশ্বজনে নিঃস্ব করে পবিত্রতা আনে,
সাধজকজনে নিস্তারিতে তার মতো কে জানে?
বিনামূল্যে ময়লা ধুয়ে করে পরিষ্কার,
বিশ্ব মাঝে এমন দয়াল মিলবে কোথা আর?
নিন্দুক, সে বেঁচে থাকুক বিশ্বহিতের তরে,
আমার আশা পূর্ণ হবে তাহার কৃপা ভরে।
সারমর্ম: নিন্দুক তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের কারণে সকলের কাছেই ঘৃণার পাত্র। তার কাজই হলো পরচর্চা করা, যার কারণে কোনো মানুষই তাকে পছন্দ করে না, তার সঙ্গ প্রত্যাশা করে না। কিন্তু এই নিন্দুকই পরচর্চার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মানুষের দোষ ত্রুটিগুলো চোখের সামনে তুলে ধরে এবং এর ফলে মানুষ নিজেকে শোধরানোর সুযোগ পায়। তাই প্রকৃতপক্ষে নিন্দুককে ঘৃণা করা উচিত নয়।



পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি

পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও।
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ,
সুখ সুখ করি কেঁদো না আর;
যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
সারমর্ম: কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য এ পৃথিবীতে মানুষের আগমন ঘটেনি। অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার মধ্যেই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। অন্যের কল্যাণসাধনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই মানুষ প্রকৃত সুখ খুঁজে পায়। তাই নিজের কল্যাণ নয় পরের কল্যাণসাধনে মনোনিবেশ করতে হবে।


Posted By Md. Ripon Mia

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন