20 May, 2018

কিসমতের বিচার


সুন্দর আর বাদশার সেবা-যত্নের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে কিসমতকে। কিসমতের কাজ হচ্ছে প্রতিদিন ভোরে সুন্দর আর বাদশাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা, তাদের নাস্তা দেওয়া। নাস্তা শেষে বাগানে ওদের নিয়ে বেড়ানো। দুপুরে, যখন ঘড়ির কাঁটা ঠিক একটার ঘরে যাবে, তখন বাদশা ও সুন্দরকে গোসল করানো এবং প্রতিদিন লেকের পাড়ে কিংবা মাঠে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া।

কিসমত গাঁও-গেরামের মানুষ। এসব অভিজাত দামি কুকুরছানাকে কীভাবে লালন-পালন কিংবা সেবা-যত্ন করতে হয় সে জানত না। তাই প্রথম প্রথম একটু সমস্যাই হয়েছে বলা যায়।
এখন আর কোনো সমস্যা হয় না।



দুই.
প্রতিদিন সুন্দর আর বাদশাকে যথাযথ সেবা-যত্ন করে যাচ্ছে কিসমত। তার সেবাযত্নে সুন্দর আর বাদশা দিনেদিনে অনেক বড় হয়েছে। এ-কদিনে কিসমতের সাথে ওদের বেশ ভাব জমে গেছে। বলা যায়, ওরা কিসমতের একপ্রকার অনুগত হয়ে গেছে। তবে কিসমত যা বলে তা বাদশা পুরোপুরি মানলেও সুন্দরকে প্রায়ই অবাধ্য হতে দেখা যায়। অর্থাৎ এখনও ছোটবেলার স্বভাব পুরোটাই বহন করে চলেছে সুন্দর।

সুন্দরকে কিসমত যদি বলে দৌড় দাও, সুন্দর হাঁটতে থাকে। শিশুদের পেছনে ছুটতে বারণ করে কিসমত যদি বলে, সুন্দর নট মুভ। সুন্দর তা না শুনে শুরু করে লেটস মুভ। অনেকটা ব্যাকরণের বিপরীত শব্দ সাজানোর মতো। মাটি খুঁড়তে নিষেধ করলে খোঁড়ার জন্য আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
এই নিয়ে কিসমত আছে মহাবিপদে। আশেপাশের লোকজন কিসমতকে বকাঝকা করে, ধমক দেয়। লোকজনের বকাঝকা নিয়ে কিসমতের মন খারাপ। কিসমত বুঝতে পারে না, কুকুরের অন্যায়ের জন্য সে কেন বকাঝকা আর ধমক খাবে।

তিন.
আজ দুপুরে আরও বড়রকমের একটা ঝামেলা হয়ে গেছে পাশের বাড়ির জলি ম্যাডামের সাথে। ম্যাডাম তাকে রীতিমতো দু’চারটা চড়-থাপ্পরও দিয়েছে। কিসমতের অপরাধ সুন্দর তার পেছনে পেছনে ছুটে গিয়েছে।
জলি ম্যাডাম কোত্থেকে এসে মাত্র গাড়ি থেকে নেমেছে, আর অমনি সুন্দর তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে ম্যাডামের পেছনে পেছনে তার বাড়িতে ঢুকে গেছে। আর যায় কোথায় কিসমত। ম্যাডাম গেটের বাইরে ফিরে এসে সুন্দরের চেয়েও ভয়ানক ভঙ্গি ধারণ করে, বিচিত্র সাধু-কথ্য-চলতি ভাষায় কিসমতকে আক্রমণ করে বসল।

ওই ব্যাটা গাঁইয়ার বাচ্চা, দেখিস না তোর কুত্তার বাচ্চা কুত্তা আমার পেছনে পেছনে বাড়িতে ঢুইকা পড়ছে। তোগো বদমাশ কুত্তা ক্যান আমাদের বাড়িতে ঢুকবে? ছোটোলোকের জাত, ইতরের ছাও, অসভ্য-জানোয়ার–একটা থাপ্পর দিয়া সব কয়টা দাঁত ফেইলা দেব।

ম্যাডামের বিরতিহীন গালাগাল আর রুদ্রমূর্তিতে কিসমতের ভেতরটা যেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, তেমন সে ভয়ও পেল। ভয়ে ভয়ে আর অনুনয়ের সাথে ক্ষমা চাইল জলি ম্যাডামের কাছে।
ম্যাডাম, আমার ভুল হইয়া গেছে। এইবারের মতো মাফ কইরা দেন?
কিন্তু তার অনুনয়ে কোনো কাজ হয়নি। জলি ম্যাডাম ধারাবাহিকভাবে অগ্নিমূর্তি রূপ ধারণ করে কিসমতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিসমতকে চড়থাপ্পর দিতে শুরু করেছে।

এই ব্যাটা ভুল হবে কেন? তুই একলাই কুত্তা পালছ নাকি? আমি পালি না? আমার বাড়ির কুত্তা কোনোদিন তোদের বাড়িতে ঢুকছে নাকি?
জ্বী ঢুকেছে কয়েকদিন। কিসমতের সরল জবাব।
চোওওওপ। মুখে মুখে তর্ক করিস। শহরে আইসা চালাক হইয়া গেছ?
কিসমত খুঁজে পায় না, কখন সে মুখে মুখে তর্ক করল। মনে হয়, বড়লোকদের সাথে কথা বলা মানেই মুখে মুখে তর্ক। তাই চুপ থাকাই ভালো মনে করল কিসমত।
চুপচাপ জলি ম্যাডামের বাড়িতে ঢুকে সুন্দরকে গেটের বাইরে নিয়ে আসে সে। সুন্দর বাইরে বেরিয়েই ঘটিয়ে দেয় আরেক কাণ্ড। ম্যাডামের সামনে গিয়ে উচ্চৈস্বরে ঘেউ করে তাকে তিরস্কার করে। ম্যাডাম ভয়ে কিছুটা দূরে সরে যায়। দূরে গিয়ে ফের কিসমতকে গালাগাল দিতে থাকে।
এই ব্যাটা ফাজিল, তোর কুকুর এখান থেকে নিবি নাকি তোর মালিকের কাছে বিচার দেব?
ম্যাডামের কাছে কিসমত এখন একজন আসামী। তাই কিসমত যা বলবে তাই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তারচে বরং চুপ থাকা ছাড়া কোনো গতন্ত্যর নেই মনে করে সুন্দরকে নিয়ে সে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।
এদিকে ম্যাডাম বকবক করেই যাচ্ছে। কিসমত শুনেও না শোনার ভান করে। ম্যাডাম কিছুক্ষণ বকবক করে কোনো জবাব না পেয়ে নিজ বাড়ির গেটে মাথা ঢুকায়।
মনে মনে হাসে কিসমত। হাসতে হাসতে সুন্দর আর বাদশাকে নিয়ে প্রতিদিনের মতো ঘুরতে বেরিয়ে যায়।
চার.
ভালোয় ভালোয় বিকালের ভ্রমণ শেষে দুই গৃহপালিত কুকুর নিয়ে বাসায় ফিরে আসে কিসমত। কিন্তু তাকে নিয়ে ঝামেলার শুরু বাসায় ফিরে আসার পর। অবশ্য গেট দিয়ে ঢুকে পাশের বাসার ম্যাডামকে দেখেই কিসমত বুঝতে পেরেছিল যে কিছু একটা ঝামেলা তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই হলো। গেট দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতে তার মালিক ম্যাডাম তাকে ডাকল। সুন্দর আর বাদশাকে যার যার ঘরে রেখে ম্যাডামের কাছে এগিয়ে গেল কিসমত।
কাছে আসতেই মালিক ম্যাডাম তাকে বলল, কিসমত মিয়া?
জ্বি ম্যাডাম।
তুমি নাকি জলি আপার সাথে বেয়াদবি করেছ?
কিসমত কী জবাব দেবে বুঝে ওঠতে পারল না। কথা বলতে গিয়ে আবার কী ভুল হয়ে যায় কে জানে! যদিও তার বলতে ইচ্ছে করছে যে, ম্যাডাম আমি কোনো বেয়াদবি করি নাই। যদি কোনো বেয়াদবি করে থাকে সে আপনের সুন্দর; আর বাকি বেয়াদবি করেছে আপনের জলি আপা। কিন্তু প্রকাশ্যে মুখের উপর ম্যাডামকে এ কথা বলার সাহস তার নাই। সে জানে গরীব হলে যেমন পদে পদে ভুল তেমন বিপদ। তারচে চুপ থাকাই ভালো।
কিসমতের চুপ থাকার সুযোগটি কাজে লাগাল জলি ম্যাডাম। সে মালিক ম্যাডামকে উসকানি দিয়ে ক্ষ্যাপাতে চেষ্টা করল। সে বলল, দ্যাখেন আপা কেমন বেয়াদপ ফাজিল, আপনের কথার জবাব দেয় না।
জলি ম্যাডাম সফল হয়। কিসমতের ওপর ক্ষেপে যায় তার মালিক ম্যাডাম।

এই বেয়াদব কোথাকার। কথা বলছিস না কেন?–ছোটলোকের বাচ্চাদের নিয়ে এই এক ঝামেলা জলি আপা। গ্রাম থেকে এসে ভাত-কাপড় পেয়েই চালাক আর বেয়াদব হয়ে যায়। এখন মন চাচ্ছে এক থাপ্পর দিয়ে ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেই।
মালিক ম্যাডামের কথায় খুব আহত হল কিসমত। এখানে চাকরি করার পর মালিক ম্যাডাম সম্পর্কে যে ধারণা ও শ্রদ্ধা ছিল তা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল তার মন থেকে। এখানে চাকরি করার পর সে কখনো ম্যাডামের কাছ থেকে কটু কথা যেমন শুনেনি, দেখেনি কোনো খারাপ ব্যবহার। অথচ আজ ম্যাডামের যে কী হলো! আসলে বড়লোকদের চরিত্র বোধহয় একই হয়। কারোটা তাড়াতাড়ি ধরা যায়, কারোটা ধরা পড়ে একটু দেরিতে। সুন্দর আর বাদশার কোনো দোষ না ধরে শুধু শুধু তাকে অপমান করছে। বিনা কারণে সে অপমান সহ্য করবে? দুমুঠো ভাতের জন্য? এমন ভাত না খেলেই কি নয়? দরকার হয় গ্রামে গিয়ে না খেয়ে মরে যাবে সে। তবু বিনা কারণে বড়লোকদের অপমান সহ্য করবে না।
কিসমতকে চুপ থাকতে দেখে ম্যাডাম ফের বলল, এই বজ্জাত, কথা বলিস না ক্যান? যা এখনই জলি আপার পায়ে ধরে মাফ চা আর দশবার কানে ধরে উঠবস কর, নয়ত এখুনি তোকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেব।
কিসমত আরেকবার আহত হল ম্যাডামের কথা শুনে। না, এখানে চাকরি করে সে বারবার আহত হতে চায় না। তাই দুই ম্যাডামকে অবাক ও বোকা বানিয়ে কিসমত বলল, না আমি মাফ চামু না, কানে ধরে উঠবসও করব না। আমি কোনো অন্যায় করি নাই। আমাকে বরখাস্ত করনেরও দরকার নাই। আমিই নিজ থাইকা আপনের চাকরি ছাইড়া দিলাম। আপনের কুকুর নিয়া আপনেই থাকেন। আমি গেলাম। খোদা হাফেজ।
দুই ম্যাডাম কী বলবে কিছুই বুঝে ওঠতে পারল না। তার আগেই কিসমত গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন