20 May, 2018

খুলির আর্তনাত


মাঝে মাঝে বস্তুটাকে আমি চিল্লাতে শুনি।আরে না না,আমি ভিতু নই।কল্পনাশক্তির দৌড়ও বেশি আমার।সবচেয়ে বড় কথা আমি কখনো ভূতে বিশ্বাসটিশ্বাসও করিনি।অবশ্য আ বস্তুটা ভুত হলে অন্য কথা।তবে জিনিস টা যাই হোক না কেন এটা লিউক প্যাটকে যতোটা ঘেন্না করতে আমাকেও ততটাই করে। আমায় দেখলে চ্যাচায়।

বুঝলেন,ডিনার টেবিলে বসে কাউকে কোন ভয়ানক খুনের কায়দাটায়দার গল্প শোনাবেন না।কে বলতে পারে।আপনার পাশের লোকটা তার বাড়ির লোকজনের ব্যাপারে কি মতলব ভাজবে।মিসেস প্যাটের মির্ত্যুর জন্য যেমন আমি সবসময় নিজেকেই দূষি।আমি তো চাহিতাম তিনি বুড়ো বয়সে অবধি সুখেশান্তিতে বেঁচেবর্তে থাকুন,কিন্তু সেদিন ডিনার টেবিলে কেন যে মরতে গল্পটা বলতে গিয়েছিলাম।নইলে হয়ত-

মনে হয় সেইজন্যই বস্তুটা আমায় দেখলে এমন চিৎকার জড়ে।বেশ নরমসরম ভালোমানুষগোছের ছিলেন,তবে একবার আমি তাকে চিৎকার করতে শুনেছিলাম।ঘরের ভিতর থেকে পিস্তলের ফাঁকা আওয়াজ ভেবে ছিলাম বুঝি তার ছোট ছেলেটা গুলি চালিয়ে দিয়েছে।বস্তুটার চিৎকারের শব্দ অবিকল সেই রকম।শেষের দিকে একই রকম একটা তিক্ষন কাঁপুনি থাকে।কি বলছি বুঝতে পারছেন তো?এক্কেবারে একরকম।

আসল ব্যাপার টা হছে,ডাক্তার আর তার স্তীর মধ্যে যে গণ্ডগোল একটা চলছে আমি সেটা আগেভাগে একেবারে আঁচ করতে পারিনি।মাঝে মধ্যে একটু আধটু খিটিমিটি লেগে থাকত বটে,তখন মিসেস প্যাকাটের মুখটা লাল হয়ে উঠত আর লিউক বাজে বাজে কথা বলে ফেলত হড়বড় করে।তবে সে তো তার একেবারে ছোট

বেলার অভ্যাস।আমার জ্ঞাতিভাই।আমিতাকে ভালোই জানি।ইশকুলেও তো সেই একই রকম স্বভাব ছিল ওর।সত্যি বলতে

.কিসেই আত্বীয়তার সুত্রেই আমার এবাড়ির মালিকানা পাওয়া।ওর মিত্যু আর ওর ছেলে চালির দক্ষিন আফ্রিকায় প্রান হারাবার পর বংশে আর কেউ ছিল না ত!সম্পিত্তিটা বেশ ভালই।আমার মত একজন বুড়ো নাবিকের শেষ দিনগুলো বাগান করে কাটিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।

লোকে দেখবে নিজের বুদ্ধির কাজগুলো নিজের ভুলভ্রান্তি বেশি পরিষ্কার মনে রাখে।আমি ব্যাপার টা প্রাই খেয়াল করি।একদিন প্যাটদের সাথে রাত্তিরের খাবার খেতে খেতে ওদের সেই গল্পটা বলেছিলাম।সে ছিল নভেম্বেরের বৃষ্টি ভেজা রাত!সমুদ্রটা গোঙাছিচল-

–এই—এই-চুপ-কথা বলবেন না-চুপ করে শুনুন-এক্ষুনি শুনতে পাবেন-যোয়ার আসছে বুঝতে পারছেন তো?কেমন ভার করা শব্দ,তাই না?কেমন একটা-আরে-ওই তো-ওই যে হছে-ভয় পাবেনা,কোন ভয় নেই মশায়।আরে আপনাকে খেয়ে ফেলবে না-এ তো শুধু একটা চিৎকার-

যাক!আপনি যে চিৎকার টা শুনেছেন তাতেই আমি খুশি।নইলে কে ভাব ও বুঝি বাতাসের আওয়াজ,কিংবা আমার কল্পনা,বা ওইরকম কিছু একটা।না না,আজ রাতে আর হবে না।এক রাতে একবারের বেশি এ কখনো চিল্লায় না।

বাঃ বেশ বেশ-আগুনে আরও দু,একটা কাঠ গুঁজেদেন দেখি।আরেকটু পানীয় ঢেলে নিন। ব্লকটল নামের সেই বুড়ো ছুতোরকে মনে আছে আপনার?আরে ওই যে ক্লান্টার্ফ নামের জাহাজটা ডুববার পর যে জার্মান জাহাজটা আমাদের উদ্ধার করে সে খানে কাজ করত।উপকূল থেকে প্রাই শ পাঁচেক মেইল ভেতরে তুফানি দরিয়ার বুক থেকে আমাদের তুলে এনে ব্যাটা কেমন টলোমলো পায়ে গান ধরেছিল-“আহা দুর্বলাপাতা খোকাগুলানকে পাড়ে লও-”

টা সে ছিল সেইরকম একটা ঝরের রাত।আমি তখন কিছুদিন হল বাড়িতে আছি।অলিম্পিয়া জাহাজটার প্রথম সমুদ্রযাত্রার যাবার অপেক্ষায়।আর পরের যাত্রাতেই তো অলিম্পিক রেকর্ড ভাঙল-মনে আছে?মনে পড়েছে।

টা সে সন্ধেয় আকাশ বেশ মঘলা।সঙ্গে এক ঘেয়ে বৃষ্টি।প্যাকেটের সেদিন মেজাজ গরম। রান্না বান্না বেশ খারাপ হয়েছএ।তাতে প্যাকাটের মেজাজ আরও ছড়েছে।তার উপর আবার ঠাণ্ডা পড়েছে জমিয়ে।সব মিলিয়ে প্যাকেটের মেজাজ বেজায় চড়া।

বেচারা বউটার অবস্তা তোঁ বুঝতেই পারছেন।সে বশে বশে খালি একটা অয়েলশ রেয়ারবিট বানিয়ে কাচা শালগম আর আধাসেদ্ধ মাংসের ভুলচুক ঢাকবার চেষ্টা করে যাছিল।প্যাটের সেদিন সম্ভত কোন রোগি মারা ছিয়েছে।বিশ্রি আবহাওয়া, বাজে খাবার,সারাদিনের খাঁটুনি সব মিলিয়ে তার মেজাজ থই পাওয়া ভার।বলে,“আমার বউ আমায় বিষ খাওয়াবার চেষ্টা করছে দেখছিস?কোন দিন খাওয়েও দেবে হয়তো।”

খেয়াল করলাম কথাটা বউয়ের মনে বাজায় লেগেছে।ব্যাপার টা কে হালকা করে দেওয়ার জন্য বললাম,“ধুস।মিসেস প্যাট বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে অমন বোকার মতো কায়দায় খুন করতে জাবেন কেন?তারপর আমি জাপানিদের সেই কাঁচতন্ত আর কুঁচি কুঁচি করা ঘোড়ার লোম দিয়ে বিষ খাওয়াবার সুক্ষ কায়দাটার গল্প শুরু করে দিলাম।

প্যাট ডাক্তার।এসব ব্যাপারে ভালই জ্ঞানগম্যি আছে।কিন্তু আনিও কম যাই নাকি? বলে ফেললাম আয়ারল্যান্ডের সেই মহিলার গল্প তিন তিন বার বিধবা হয়েছিল।কেউ তাকে সন্দেহ করেনি।

গল্পটা শোনেন নি নাকি?চার নম্বরে তার শিকার জেগে ছিল।সে-ই তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে।মহিলার ফাঁসি হয়েছিল। খুন করিবার কায়দাটা দারুন ছিল মহিলার।

শিকার ঘুমোলে সরু একটা ফানেল দিয়ে তিনি তার কানের ভিতর কয়েক ফোটা গরম সিসে ঢেলে দিত।বাইরের থেকে দেখে কিচ্ছুটি বোঝবার জো নেই-

–না না- ওটা হাওয়ার শব্দ মশাই ঝড়টা ফের ঘুরে আছে কি না!ও আমি শব্দ শুনে বলতে পারি।তাছাড়া চিৎকার তো বললামই এক সন্ধেয় একবারে বেশি আসে না—

তা সে ডিনারের কিছুকাল পর মিমেস প্যাকাটি ঘুমের মধ্যে হঠাৎ মারাগেলেন।অলিম্পিয়ার পর যে ইষ্টিমারটা ছেঁড়েছিল,তাদের কাছেই আমি নিউ ইয়কে বসে খবর টা পাই।সে বছর আপনি তো লিওফ্রিক নামের জাহাহ ছিলেন।তাই,না?এই যে পানীয়টা চেখে দেখন দেখি একটু।একবারে খাঁটি,পুরনো হালসক্যাম্প মশাই।এ বাড়ি টা যখন আমার হল তখন এর সেলারের মধ্যে বোতলটা খুজে পেয়েছিলাম।বোতলটা অবশ্য বছর পচিশ আগে আমি লিউক কে কিনে এনে দিয়ে ছিলাম আমস্টারডাম থেকে।খুলেও দেখেনি এখনো।বেচারা বোধায় তার জন্য এখন ওপারে বশে দুঃখ পায়।

হ্যাঁ,তা কত অবধি বলেছিলাম গল্পটা?মিমেস প্যাকাটের আকস্নিক মিত্যু-হ্যাঁ।তার পর লিউক বোধ হয় এখানে একটু একা হয়ে গেল।মাঝেধ্যে আমি এসে দেখা করে জেতাম।কিউককে বেজায় ক্লান্ত আর চিন্তিত দেখাত।বলত ডাক্তারি আর চালাতে পারছে না।তবে কোন অ্যাসিসট্যানটও সে কিছুই রাখতে চায় না।এই ভাবে কয়েক বছর কেটে গেল। এক দিন লিউকের ছেলেটা আফ্রিকায় মারা গেল।এরপর লিউক কেমন অদ্ভুত একটা হয়ে গেল। শ্বাভিক মানুষের থেকে আলাদা।কিছু একটা ভর করেছিল ওর উপর।না না,পেশার ক্ষত্রে কোন ভুলভ্যান্তি করত না তা ঠিক,কিন্তু ওই কিরকম একটা যেন আচারন-মানে-বুঝতে পারছেন তো?কম বয়সে লিউকের গায়ের রঙ বাজায় ফর্সা ছিল।মাথার চুল ছিল লাল।ছিপছিপে গড়ন।মাঝ বয়সে এসে কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।আর ছেলের মিত্যু পর বেচারা ক্রমশই রোগা হয়ে যাছিল তার মাথা টা দেখলে মনে হত একটা চামড়ার মোড়া খুলি।চোখ গুলি কেমন যেন চকচক করতো সবসময়।দেখলে বুক কাপে।

মিমেস প্যাটের বাম্বল নামে পেয়ারের কুকুর ছিল একটা।এখন সেটা প্যাটের সঙ্গে সঙ্গে সব জায়গায় ঘুরত।ভারি ভাল স্বাভের কুকুর সেটা।মাঝেমদ্ধে দাঁত খিঁচিয়ে আচেনা লোকজন কে একটু ভয় দেখাত শুধু।কখনো কখনো স্ন্ধাবেলা প্যাট আর বাম্বল একা একা চুপচাপ বসে একে অন্যর দিকে চেয়ে থাকত।হয় তো বসে বসে পুরনোদিনের কথা ভাবত।মিসেস প্যাট যখন বেঁচে ছিলেন,বোধয় সেই সময় গুলর কথা।তখন এইরকম সন্ধে বেলা তিনি বসে থাকতেন ওই-যে ওই-যে চেয়ারটায় আপনি বসে আছেন ওইটাতে।আর এই আমার চেয়ার টায় বসত প্যাট।

বসে বসে থাকতে থাকতে বুড়ো মোটাসোটা কুকুর টা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ত।লাফাতে তো পারে না।তাই,প্যাটের চেয়ারের পায়া বেয়েই উপরে উঠে পরবার জন্য সেকি আপ্রান চেষ্টা তার। প্যাট তখন কংকালের মতো মাথার সামনে কয়লার টুকরার মতো জ্বলত দুটো চোখ নয়ে কুকুর টার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতো।মিনিট পাঁচেক একই রকম চলবার পর হঠাৎ কুকুর টা থর থর করে কাঁপতে শুরু করত আর এইসঙ্গে যে গুলি খেয়েছে এই রকম তরুণ আর্তনাত বেরিয়ে আসত তার গলা থেকে।আর তারপর প্যাটের চেয়ার থেকে ছিটকে নেমে পড়ে চেয়ারের তলায় গিয়ে লুকিয়ে কুঁই কুঁই করে ডাকতে থাকত।

আমার কল্পনাশক্তি খুব কম।তবু আমি হরফ করে বলতে পারি সেই শেষের মাসগুলো প্যাটের মুখখানা দেখলে বহু দুর্বল হৃদয় মানুষ ভিমি যেতেন। সেটার দিকে তাকালে একটা চামড়াঢাকা খুলি ছাড়া আর কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না।

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন