বাঁদরটা কিন্তু চন্দ্রস্বামীকে আক্রমণ করল না। বরং সে হাত দিয়ে বাঁদিকের পথটাকে দেখাতে লাগল। চন্দ্রস্বামী প্রথমে একটু হক্চকিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর তাঁর মনে হল, বাঁদরটা বোধহয় তাঁকে বাঁদিকের রাস্তাটায় যেতে বলছে। মনে মনে হেসে তিনি ভাবলেন, ” বাঁদরটাকে ত নিরীহই মনে হচ্ছে। ঠিক আছে, দেখাই যাক্ না, কেন ও আমায় ওইদিকে যেতে বলছে। আমার পক্ষে তো যে কোন পথই সমান। বনে এসেছি কিছু কাঠ-কুটো জোগাড়ের আশায়। সেটা হয়ে গেলেই হল।” তিনি বাঁদিকের রাস্তায় চলতে লাগলেন।
যেই তিনি বাঁদিকে চলতে লাগলেন, অমনি কী আশ্চর্য! বাঁদরটা তাঁর সামনে এসে লাফাতে লাফাতে তাঁকে পথ দেখিয়ে যেতে লাগল। একটু পরপরই সে পেছন ফিরে ফিরে দেখছিল তিনি তাকে অনুসরণ করছেন কিনা। চন্দ্রস্বামীর বেশ মজা লাগল। বাঁদরটা তাঁকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
বেশ কিছুদূর যাবার পর তিনি বাঁদরটার সঙ্গে এক বিশাল জামরুল গাছের তলায় এসে দাঁড়ালেন। বাঁদরটা খুব উত্তেজিত হয়ে কিচির মিচির করতে করতে গাছ বেয়ে উঠে গেল আর তাঁকে ইশারায় ডাকতে লাগল। চন্দ্রস্বামী ওপর দিকে তাকাতেই প্রথমাবধি সব ঘটনার কারণ তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। যে গাছটার তলায় তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, দেখলেন সেটার সারা গায়ে মোটা লতা জড়িয়ে উপরে উঠেছে। একটা মেয়ে-বাঁদর, খুব সম্ভবতঃ সে এই প্রথম বাঁদরটার বৌ, লতার বাঁধনে জড়িয়ে গিয়েছে। সে প্রচণ্ড জোরে যতই টানাটানি করছে, ততই আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে। হয়তো এই জন্যই বাঁদরটা বুদ্ধি করে তাঁকে ডেকে এনেছে। তিনি গাছে উঠে তীক্ষ্ণ কুঠারের সাহায্যে লতাজাল কেটে মেয়ে-বাঁদরটাকে উদ্ধার করলেন।
চন্দ্রস্বামী এবার ফেরার পথ ধরলেন। জান কি, বাঁদরদুটো এবার কি করল? তিনি দেখলেন, তারা দুজনেই তাঁর পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল আর তাঁকে বিচিত্র এক নাম না জানা ফল উপহার দিল। তিনি অবাক হলেও সেটা হাত পেতে গ্রহণ করলেন।
সেদিন তিনি প্রচুর কাঠ সংগ্রহ করতে পারলেন। বাড়ি ফিরতে তাঁর সেদিন বেলা গড়িয়ে গেল। মধ্যাহ্ণভোজন শেষ করে তিনি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ফলটি ভাগ করে খেলেন। আঃ, কি মিষ্টি আর সুস্বাদু খেতে ফলটি! দুজনেই বললেন, কোথা থেকে বনের প্রাণী এই ফল পেল?
দু’এক বছর পর সেই গ্রামে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হল। খাবার জোগাড় করতে না পেরে বেশির ভাগ গ্রামবাসী নিজেদের ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেল। একদিন চন্দ্রস্বামীও স্ত্রীকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে বনে গেলেন ফলমূলের সন্ধানে। তাঁরা যখন গভীর বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ভীলদের একটা দলের সঙ্গে তাঁদের দেখা হল। ভীলরা যখন তাঁদের সব কথা জানল, তখন তারা দয়াপরবশ হয়ে তাঁদের খাদ্য দিল আর নিজেদের গ্রামে আশ্রয় দিল।
ভীলদের গ্রামে এসে চন্দ্রস্বামী ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তিনি বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, শক্তিশালী ও উদ্যমী পুরুষ ছিলেন। কালক্রমে সকলেই তাঁকে এক সাহসী ভীলযোদ্ধা বলে মেনে নিল। তাঁর ব্যবহারে সবাই এত মুগ্ধ আর বশীভূত হয়ে গেল যে ভীলদের দলপতি তাঁকে তাদের প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করলেন আর তাতে কিন্তু কেউ আপত্তিও করলেন না।
এভাবে অনেকদিন কেটে গেল। ভীলদের রাজা বুড়ো হয়েছেন; তাঁর কোন ছেলেপুলে নেই। তাই তাঁর মৃত্যুর পর তিনি চন্দ্রস্বামীকেই রাজসিংহাসনে বসাতে চাইলেন। এভাবেই সকল ভীলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মাথায় নিয়ে চন্দ্রস্বামী ভীলদের রাজা হলেন।
চন্দ্রস্বামী বহুকাল ধরে রাজত্ব করছেন। চারদিকে শান্তি, সন্তোষ ও সমৃদ্ধি ছড়িয়ে রয়েছে। কিছুকাল ধরেই একটা বিচিত্র ব্যাপার সকলে খেয়াল করছিল, চন্দ্রস্বামীর সন্তানরা আর তাদের সমসাময়িক লোকজন – সবারই কালের নিয়মে বয়স বেড়েছে, তাদের চুল ধীরে ধীরে সাদা হয়ে যাচ্ছে, শরীর লোলচর্ম হচ্ছে, কিন্তু রাজা আর তার স্ত্রীর চেহারায় বয়স কোন ছাপ ফেলেনি। তাঁরা ভীলরাজ্যে প্রথমদিন যেমন এসেছিলেন, তেমনই আছেন। সেরকমই সুন্দর, স্বাস্থ্যবান আর যুবক।
একদিন কয়েকজন গন্যমান্য মানুষ রাজাকে এই কারণটা জিজ্ঞাসা করলে তিনি সেই হনুমান আর ফলের গল্পটা বললেন। কিছু বিশ্বাস আর কিছু অবিশ্বাসে প্রজারা পরদিন থেকেই সেই বন তোলপাড় করে ফেলল সেই ফলের জন্য। কিন্তু হায়! চিরযৌবন আর সুস্বাস্থ্য প্রদায়ী সেই ফলের গাছটাই কোথাও পাওয়া গেল না। ভাল কাজ করার জন্য যে বিশেষ ফল হাতে পেয়েছিলেন চন্দ্রস্বামী, সেটা কি আর এত সহজেই চাইলেই পাওয়া যায়?
No comments:
Post a Comment