14 May, 2018

একটি সত্য ঘটনা



“বাসায় কাজের লোক না থাকলে আমার কি যে ঝামেলা যায়, এ কথাটা শাহেদ কখনোই বুঝলো না। হুট করে কয়েকজন বন্ধু নিয়ে বাসায় ফিরলো। কি আর করা! অগত্যা রান্না বান্না করে সবাইকে খাইয়ে বিদায় দিতে দিতে রাত ১২টা বেজে গেল। আমিও থালাবাটিগুলো নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। সব ধুয়ে অবসর হতে হতেই ভাবলাম কাল সকালের নাশতার জন্যেসবজি কেটে ফ্রিজে রেখে দিই।সকালে উঠে ক’টা রুটি বানিয়ে,সবজিটা ভেজে দিলেই হবে। আর ডিম তো আছেই পোচ করে দেবক্ষন।
বেডরুমে ঢুকে দেখি বাহ শ্রীমান তার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কি আরামেরএকটা ঘুম দিয়েছেন! পুরুষমানুষগুলো কি যে স্বার্থপরহয়! এই যেমনআমার ছেলেটা। নয় বছর বয়স হয়েছে, ওর সব কিছু এখনো আমাকেই করে দিতে হয়। মেয়েটাপাঁচ বছরের। অথচ দেখো কি লক্ষী। আজো যখন বাসায় এত গেস্ট, মেয়েটা আমাকে টেবিলেপ্লেট সাজাতে সাহায্য করলো। গ্লাসগুলোসাজিয়েদিল। আর ছেলেটা বসে বসে তখনকার্টুন দেখছিল।
আমি বাথরুমে ঢুকে মুখহাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর মুখে ক্রিম ঘঁষতে ঘঁষতে একদম বিছানায়। শরীর আর বইছে না। ওয়াল ঘড়িতে দেখলাম সময় রাত দেড়টা বাজে।হাত বাড়িয়ে বেডসুইচ অফ করেশুয়ে পড়লাম।আমার বাঁদিকে শাহেদ,ডানপাশে মেয়ে টায়রা আর ওর পাশে দেয়াল বরাবর ছেলে টোকন। ওদের দিকে একবারতাকিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টায় ডুবে গেলাম।
চোখটা লেগে এসেছিল প্রায়। কোন একআজানা কারনে ঘুমটা ভেঙ্গে গেছে। পাশ ফিরে শুতেগিয়ে হোঁচট খেলাম মনে মনে। বাইরের স্ট্রীট ল্যাম্পের আলো পর্দা ছাড়িয়ে আমার ঘরে এসে এক চিলতে ফিতের মত পড়ে থাকে প্রতিদিন। আজো পড়েছে। সে আলোয় আমি দেখলাম, সম্পূর্ন অপরিচিত মোটা, কালো, মধ্যবয়স্ক এবং কুৎসিতএক লোক মুখ হা করে আমার পাশে ঘুমুচ্ছে। আমার সমস্তশরীর যেন অবশ হয়ে আসতে চাইলো। কেমন যেন বিশ্রী একটা গন্ধ চারপাশে। কোনমতে পাশ ফিরে দেখলাম ঐপাশে কালোকালো দু’টো অপরিচিত ছেলেমেয়ে পাশাপাশি শুয়েআছে। কিছুই ......বুঝতে পারছি না! এবারআমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, বিছানাটা আমার নয়, এমনকি বাড়ীটাও। কেমন যেন পুরনো দিনের একটা বাড়ী। হায়হায়, এ আমি কোথায়?বাড়ী যদি অন্যের হয় বেডসুইচটা কিআছে? কোন কিছু না ভেবেই আমিলাফ দিয়ে উঠে বসে হাত বাড়িয়ে বেড সুইচটা অন করে দিলাম। আলো জ্বলে উঠতেই আমার বুকটা যেন আরো হিম হয়েউঠলো। দেখি, আমার বর শাহেদ আরছেলেমেয়ে দু’টো বিছানায় উঠে বসে আছেআর একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওদেরদৃষ্টিতে হিমশীতল শূণ্যতা বুঝিবা মৃত মানুষের চোখ। আমি চীৎকার করতে করতে ছুটে গেলাম দরজার দিকে।ঘাড়ঘুরিয়ে একঝলক শুধু দেখলাম ওরা সেই একই ভাবে বসে আছে তবে দৃষ্টিটা আমার উপর।
কোনরকমে গিয়ে কিচেনে ঢুকলাম। ঢুকতেই আমার হৃৎপিন্ডটা বের হয়েআসবার উপক্রম হল। দেখি অনেকগুলোঅচেনা মহিলা আমারই রান্নাঘরে। পিঠা বানাচ্ছিলবুঝিবা । তাদের সামনে ছড়ানো চালের গুঁড়ি, কোড়ানোনারিকেল আর গুড়। ওরা হাসিআনন্দেকলকল করছিল। আমি ঢুকতেই সবাই খুবঅবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে, সবারই চোখ ভয়ে বিস্ফারিত। তারপরই ওরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, ভূ—উ—ত, ভূ—উ—ত বলে।আর একজন আমার গায়ে ছুড়ে দিলো চালের গুঁড়াগুলো। আমি পাগলের মতো ওই ঘর থেকেও বেরিয়ে এলাম।
এখন আমি বেডরুমে ঘুরছি, রান্নাঘর-ড্রইংর ুম সব ঘুরছি। ভোজবাজির মত উধাও হয়ে গেছে সব। কেউ নেই। এমন কি আমার স্বামী বা ছেলেমেয়েরাও কোথাও নেই। ডাইনিং টেবিলে বসে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ডায়েরী লিখছি।কেন লিখছি তাও জানিনা। আমার সারা গায়ে এখনো চালের গুঁড়া লেগে আছে,গলায় হাতে,কাপড়ে। এত রাতে, এত্তো বড় একটা বাড়ীতে আমি একা। আমার মতো ভীতু মানুষ একদম একা। কি করে এটা সম্ভবহলো জানিনা। আমি কাঁদছি আরবিড়বিড় করে ডাকছি, শাহেদ, শাহেদ—“

এটা আমার ছোট খালার লেখা একটাডায়েরীর অংশবিশেষ। আঠারো বছর আগে মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে উনিঘুমন্ত অবস্থাতেই হার্ট এটাককরা মারা যান। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হলো, উনি যেরাতে মারা যান ডায়েরীটা সে রাতের। মারা যান ঠিকরাত দেড়টায়, যখন আমার খালু আরখালাতো ভাইবোন টায়রা, টোকন ঘুমিয়ে ছিল। খালু টয়লেটে যাবার জন্যে রাত দুইটায় ঘুমথেকে উঠে দেখেন খালার সারা শরীর চালের গুঁড়ায় মাখামাখি আর তার শরীরটা তখনো গরম। ডাক্তার এসে মত দেন যেউনি রাত দেড়টায় পৃথিবী ছেড়েছেন।

No comments:

Post a Comment

ইসমাইল হোসেন