31 October, 2018

বাংলা ব্যাকরণ সারমর্ম ১-২৫

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাঁদের হৃদয়।
সারমর্ম: সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও জীবনবোধকে ভুলে ক্ষমতার লোভে কিছু মানুষের করায়ত্বের কারণে আধুনিক পৃথিবী আজ চরম সংকটের মুখোমুখি। অথচ যে মহৎ মানুষগুলোর অন্তরে মানুষকে ভালোবাসা তথা দেশপ্রেমের এক সহজাত অনুভব, উজ্জ্বল আলোর মতো জেগে আছে তারা আজ অবহেলিত, উপেক্ষিত।

অধম রতন পেলে কি হবে ফল?

অধম রতন পেলে কি হবে ফল?
উপদেশে কখনও কি সাধু হয় খল?
ভালো মন্দ দোষগুণ আধারেতে ধরে,
ভুজঙ্গ অমৃত খেয়ে গরল উগরে
লবণ জলধি জল করিয়া ভক্ষণ
জলধর করে দেখ সুধা বরিষণ।
সুজনে সু-যশ গায় কু-যশ ঢাকিয়া
কুজনে কু-রব করে সু-রব নাশিয়া।
সারমর্ম: সুজন-কুজন অর্থাৎ ভালো-মন্দ মানুষ নিয়েই এ জগৎ সংসার। যারা সুজন তারা অন্যের মঙ্গল চিন্তা করে এবং ভালো দিকগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু যারা কুজন তারা সব সময় অন্যের অনিষ্ট করার চিন্তায় মগ্ন থাকে এবং অন্যের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায়।

অন্ধকার গর্তে থাকে অন্ধ সরীসৃপ;

অন্ধকার গর্তে থাকে অন্ধ সরীসৃপ;
আপনার ললাটের রতনপ্রদীপ
নাহি জানে, নাহি জানে সূর্যালোকলেশ।
তেমনি আঁধারে আছে এই অন্ধ দেশ।
হে দন্ড-বিধাতা রাজা- যে দীপ্ত রতন
পরায়ে দিয়েছ ভালে তাহার যতন
নাহি জানে, নাহি জানে তোমার আলোক।
নিত্য বহে আপনার অস্তিত্বের শোক,
জনমের গ্লানি। তব আদর্শ মহান
আপনার পরিমাপে করি খান-খান
রেখেছে ধূলিতে। প্রভু, হেরিতে তোমার
তুলিতে হয় মাথা ঊর্ধ্বপানে হায়।
সে এক তরণী লক্ষ লোকের নির্ভর
খন্ড- খন্ড- করি তারে তরিবে সাগর ?
সারমর্ম: শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা, ধনসম্পদে পরিপূর্ণ এই দেশ আজ অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন। নিজেদের সুবিশাল ঐতিহ্য ভুলে সবাই বিভেদের বেড়াজালে বন্দি। তবুও আশার বাণী, অতীত হারানো ঐতিহ্য চেতনায় বলীয়ান হয়ে এই দেশ ফিরে পাবে তার হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য।

অহংকার-মদে কভু নহে অভিমানী।

অহংকার-মদে কভু নহে অভিমানী।
সর্বদা রসনারাজ্যে বাস করে বাণী।।
ভুবন ভূষিত সদা বক্তৃতার বশে।
পর্বত সলিল হয় রসনার রসে।।
মিথ্যার কাননে কবু ভ্রমে নাহি ভ্রমে।
অঙ্গীকার অস্বীকার নাহি কোন ক্রমে।
অমৃত নিঃসৃত হয় প্রতি বাক্যে যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর ?
সারমর্ম: প্রাণিকূলের মতো জীবনের অস্তিত্ব থাকলেই তাকে প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। প্রকৃত মানুষ হতে হলে তাকে হতে হবে নিরহংকার। যিনি কখনো মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করবেন না, সেই সাথে অঙ্গীকার ভঙ্গ করবেন না। আর তাঁর বাক্য হবে শ্রুতিমধুর ও হৃদয়গ্রাহী।

আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি নিখিল বন নন্দনে,

আমরা নতুন আমরা কুঁড়ি নিখিল বন নন্দনে,
ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা জীবন জাগে স্পন্দনে।
লক্ষ আশা অন্তরে
ঘুমিয়ে আছে মন্তরে
ঘুমিয়ে আছে বুকের ভাষা পাঁপড়ি পাতার বন্ধনে।
সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবো মোরা ফুটবো গো,
অরুণ রবির সোনার আলো দু’হাত দিয়ে লুটবো গো।
নিত্য নবীন গৌরবে
ছড়িয়ে দেব সৌরভে,
আকাশ পানে তুলব মাথা, সকল বাঁধন টুটবো গো।
সাগর জলে পাল তুলে দে, কেউবা হবে নিরুদ্দেশ,
কলম্বসের মতই বা কেউ পৌঁছে যাবে নতুন দেশ।
জাগবে সারা বিশ্বময়।
এ বাঙালী নিঃস্ব নয়,
জ্ঞান-গরিমা শক্তি-সাহস আজও এদের হয় নি শেষ।
সারমর্ম: আজকের শিশুরাই নতুন পথের নবীন পথিক। এরা আজ নব উদ্যমে, নব নব অভিযানে সারা বিশ্বে সাড়া জাগাবে। সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সৌরভ ছড়াবে। প্রমাণ করে দিবে বাঙালি অমিত তেজ, জ্ঞান-বুদ্ধিতে নিঃস্ব নয়, বরং বাঙালিরাই শ্রেষ্ঠ।

আমরা সিঁড়ি

আমরা সিঁড়ি
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরে তাকাও না পিছনের দিকে।
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।
তোমরাও তা জানো,
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর, চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্ধত অত্যাচারী পদধ্বনি।
তবু আমরা জানি,
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত,
আর, সম্রাট হুমায়ুনের মত
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন।
সারমর্ম: বর্তমান সভ্যতার বিকাশের মূলে রয়েছে শ্রমজীবীদের অক্লান্ত শ্রম। অথচ এই শ্রমজীবীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেছে শোষক শ্রেণি। এমনকি শ্রমজীবীদের অবদানটুকুও তারা স্মরণ করে না। তাই শোষক শ্রেণিদের প্রতি শ্রমজীবীদের সতর্ক বাণী অচিরেই শোষকদের অত্যাচারের স্বরূপ প্রকাশ পাবে, আর তখন তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী।

আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,

আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত,
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর বীর্যবান,
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান।
চলমান বেগে প্রাণ উচ্ছল
রে নবযুগের স্রষ্টাদল
জোর-কদম চলরে চল।
সারমর্ম: তারুণ্যে উদ্দীপ্ত তরুণ সমাজ ঘুণেধরা অতীতকে পেছনে ফেলে নব উদ্যমে সৃষ্টির উম্মাদনায় এগিয়ে যায়। তারা সৃষ্টি করবে নতুন জগৎ। এই প্রেরণায় বিপ্লবী হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়।

আমার গানের সবটুকু সুর সবটুকু আরাধনা

আমার গানের সবটুকু সুর সবটুকু আরাধনা
এই হৃদয়ের সব সৌরভ-বাসনার ব্যঞ্জনা
একাগ্র আর অকুণ্ঠ হয়ে বহু বাতায়ন দ্বারে
আঘাত হেনেছে, পেতেছে দুহাত দুরাশায় বারে বারে।
মেলেনি কিছুই।
বুঝেছি সেদিন মানুষ এমনই দীন,
এ মাটির কাছে আছে আমাদের এমনি অশেষ ঋণ।
অনাদি কালের বন্ধন আর বঞ্চনা একাসনে
চিরজীবনের শৃঙ্খলসম জড়ানো মানব-মনে।
তাই বেদনার বহ্নি ও প্রাণে মাধুর্যে সুনিবিড়,
ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তাই বাঁধিলাম নীড়।
তীক্ষ্ম নখর উদ্যত যার তারে ভালবাসিলাম
দুনয়নে যার হিংস্র আগুন আজো জপি তার নাম।
সারমর্ম: অজ্ঞতা ও হিংস্রতা এ পৃথিবীর মানবকূলকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। তবুও কিছু সংখ্যক মহৎ প্রাণের অধিকারীগণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত; কিন্তু তাঁদের শুনতে হয় বিবেকহীন মানুষের গঞ্জনা, সহ্য করতে হয় লাঞ্ছনা। তারপরও এই মহৎ প্রাণের অধিকারী সুমহান মানুষগুলো বিবেকহীন মানুষের কল্যাণের জন্য জীবনের বিনিময়ে অবিরাম কাজ করে যান।

আমার একার সুখ, সুখ নহে ভাই

আমার একার সুখ, সুখ নহে ভাই
সকলের সুখ সখা, সুখ শুধু তাই।
আমার একার আলো সে যে অন্ধকার,
যদি না সবারে অংশ দিতে আমি পাই।
সকলের সাথে বন্ধু, সকলের সাথে,
যাইব কাহারে বলো, ফেলিয়া পশ্চাতে।
একসাথে বাঁচি আর একসাথে মরি,
এসো বন্ধু, এ জীবন সুমধুর করি।
সারমর্ম: আত্মসুখ প্রকৃত সুখ নয়, প্রকৃত সুখ সমষ্টিগত। কেননা মানবকুল একে অন্যের সাথে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ। তাই সমষ্টিগতভাবে পরস্পরের সান্নিধ্যে জীবনকে সুখময় করে তোলার মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত সুখ নিহিত।

আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,

আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে-
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, ‘সুন্দর’-
সুন্দর হল সে।
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা।
এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব এ সত্য,
তাই এ কাব্য।
এ আমার অহংকার,
অহংকার সমস্ত মানুষের হয়ে।
মানুষের অহংকার-পটেই
বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প।
সারমর্ম: মানুষ সুন্দরের পূজারী। কারণ সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ হয়ে মানুষ পৃথিবীকে নতুন করে ভালোবাসে। তাই পৃথিবীর সৌন্দর্য ও ভালোবাসা সত্য এবং শ্রেষ্ঠ।

আমার একূল ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,

আমার একূল ভাঙ্গিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।
যে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনমভর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
সারমর্ম: মহৎ ব্যক্তিগণ কখনো সংকীর্ণ মনের পরিচয় দেন না। তাঁরা সব সময় অন্যের কল্যাণে নিয়োজিত থাকেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন অন্যের কল্যাণের মাঝেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত। তাই অন্যের দেওয়া আঘাত সহ্য করে যারা পরকে আপন করেন ভালোবাসা দিয়ে শত্রুর মন জয় করেন, তাদের মধ্যেই মনুষ্যত্বের লক্ষণ প্রকাশিত হয়।

আমি চাই মহতের মহৎ পরাণ

আমি চাই মহতের মহৎ পরাণ
মুকুতা-মাণিক্য-নিধি
আমারে দিও না বিধি
চাহিনে এ জগতে রাজত্ব সম্মান।
বাঞ্ছিত পরাণ পেলে
মেগে নেব মনুষ্যত্ব শ্রেষ্ঠ উপাদান
প্রাণের সাধক আমি, সাধনীয় প্রাণ।
সারমর্ম: একজন মননশীল হৃদয়বান মানুষের কাছে মহৎ প্রাণই কাম্য। ক্ষমতা, রাজত্ব বা সম্মান মহৎ প্রাণের নিকট কখনোই কাম্য নয়। তাই মহৎ প্রাণের অধিকারীগণ চান প্রকৃত মনুষ্যত্ব, যেখানে মনুষ্যত্বের বাঁধনে মানবজীবন হবে গৌরবম-মন্ডিত।

আমি যেন কোন এক বসন্তের রাতের জোনাকি,

আমি যেন কোন এক বসন্তের রাতের জোনাকি,
অথবা দিনের শেষে কোন নীল আকাশের পাখি,
আমি যেন ছোট নদী বুকভরা ছোট ছোট ঢেউ,
সে নদীতে স্নান করে গাঁয়ের মেয়েরা কেউ কেউ।
আমি যেন কোন এক পথশ্রান্ত অচেনা পথিক,
দুদ- তাকিয়ে থাকি যে-আকাশ আলো ঝিকমিক,
আমি যেন কত বন, কত মেঘ, বালুতীর,
অথবা অনেক রাতে একমুঠো চাঁদের আবির।
সারমর্ম: সৌন্দর্যময় এ পৃথিবী সকল নৈসর্গিক উপাদানে সমৃদ্ধ। এই অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনন্তকাল ধরে কবিচিত্তে হিল্লোল তুলছে। এরই বহিঃপ্রকাশ কবির নানা অনুষঙ্গে।

আমি মরু-কবি গাহি সেই বেদে-বেদুঈনদের গান,

আমি মরু-কবি গাহি সেই বেদে-বেদুঈনদের গান,
যুগে যুগে যারা করে অকারণ বিপ্লব-অভিযান
জীবনের আতিশয্যে যাহারা দারুণ উগ্র সুখে
সাধ করে নিল গরল-পিয়ালা, বর্শা হানিল বুকে।
আষাঢ়ের গিরি-নিঃস্রাব-সম কোন বাধা মানিল না,
বর্বর বলি যাহাদের গালি পাড়িল ক্ষুদ্রমনা,
কূপ-মন্ডুক ‘অসংযমী’র আখ্যা দিয়াছে যারে।
তারি তরে ভাই গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে।
সারমর্ম: কবি সেই সব মানুষের বন্দনা করেছেন যারা যুগে যুগে নিয়ে আসে বিপ্লব, করেছেন আত্মত্যাগ। কিন্তু সংকীর্ণমনারা এদেরকে উচ্ছৃঙ্খল বলে আখ্যা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এরাই নন্দিত, বন্দনীয় পূজনীয়।

আমি আলো এবং অন্ধকারকে চিনি

আমি আলো এবং অন্ধকারকে চিনি
ফুল এবং পাখিকে চিনি
সামান্য স্তন্যপ্রায়ী থেকে
বহুভোজী বহু প্রাণী চিনি;
শ্রমে প্রেমে ক্রোধে প্রতিশোধে
মানুষের মত কেউ নয়।
গড়ে ওঠে অরণ্যভোগী লোকালয়
-মানুষের শ্রমে,
গড়ে ওঠে মধুকুঞ্জ বংশধারা
মানুষের প্রেমে কামে,
জ্বলে ওঠে দাবানল
-মানুষের ক্রোধে,
লোকালয় অরণ্য হয়
-মানুষের ঘৃণায়, প্রতিশোধে।
সারমর্ম: প্রাণিজগতের মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। অরণ্যঘেরা পৃথিবীতে তিলে তিলে মানুষ গড়ে তুলেছে সভ্যতা। আবার মানুষের ক্রোধেই দাবানলের মতো জ্বলে পুড়ে সভ্যতার বিনাশ ঘটে।

আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে

আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।
তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।
সারমর্ম: আঠারো বছর বয়সের ধর্মই হলো মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আঘাত-সংঘাতের মধ্যে রক্তশপথ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এ বয়সই অদম্য দুঃসাহসে সকল বাধা-বিপদকে পেরিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। সেই সঙ্গে নব সৃষ্টির উল্লাসে মাতোয়ারা থাকে।

আসিতেছে শুভ দিন

আসিতেছে শুভ দিন
দিনে দিনে বহু বাড়িতেছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
হাতুড়ি, শাবল, গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড়-কাটা সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমাদের সেবিতে হইল যাহারা মজুর,মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদের গান
তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান।
সারমর্ম: দিনে দিনে শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। কিন্তু এই শ্রমজীবী মানুষ শোষিত, বঞ্চিত, ও অবহেলিত। তবে শ্রমজীবী মানুষদের যারা শোষণ করছে তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। কেননা, শ্রমজীবীদের নব উত্থানের সূচনা আসন্ন।

ইচ্ছা করে মনে মনে

ইচ্ছা করে মনে মনে
স্বজাতি হইয়া থাকি সর্বলোক সনে
দেশে দেশান্তরে; উষ্ট্রদুগ্ধ করি পান
মরুতে মানুষ হই আরব সন্তান
দুর্দম স্বাধীন, তিব্বতের গিরিতটে
নির্লিপ্ত প্রস্তুরপুরী মাঝে, বৌদ্ধ মঠে
করি বিচরণ। দ্রাক্ষাপায়ী পারসিক
গোলাপ কাননবাসী তাতার নির্ভীক
অশ্বারূঢ়, শিষ্টাচারী সতেজ জাপান
প্রবীণ প্রাচীন চীন নিশি দিনমান
কর্ম-অনুরত,-সকলের ঘরে ঘরে
জন্মলাভ করে লই হেন ইচ্ছা করে।
সারমর্ম: পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই মানবজীবন সার্থক হয়ে ওঠে। তাই প্রকৃত মানবপ্রেমিকগণ পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের মানুষকে অনুভব করেন আত্মীয় হিসেবে। আর এভাবেই প্রতিটি ঘরে ঘরে জন্মলাভ করে নিজেকে বিশ্বসভ্যতার অঙ্গনে ছড়িয়ে দিতে চান।

ইসলাম বলে, সকলের তবে মোরা সবাই,

ইসলাম বলে, সকলের তবে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের।
কারো আঁখি জলে কারো ঝাড়ে কিরে জ্বলিবে দীপ?
দু’জনার হবে বুলন্দ নসীব, লাখে লাখে হবে বদ নসীব।
এ নহে বিধান ইসলামের।
ঈদ-উল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা তা কর দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক সবার।
ভোগের পেয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে
তৃষাতুরের হিসসা আছে ও- পেয়ালাতে
দিয়া ভোগ কর, বীর, দেদার।
সারমর্ম: ইসলাম ধর্মে কোনো বিভেদ নেই, নেই কোনো অর্থনৈতিক বৈষম্য, সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি। তাই নিজের অর্জিত সম্পদ ঈদ-উল-ফিতরে দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়। কেননা ত্যাগের মধ্যেই মহানুভবতার পরিচয় নিহিত, ভোগে নয়। এসবই ইসলাম ধর্মের প্রকৃত তাৎপর্য বলে এ ধর্মকে শান্তি ও সাম্যের ধর্ম বলা হয়।

উড়িয়া মেঘের দেশে চিল কহে ডাকি;

উড়িয়া মেঘের দেশে চিল কহে ডাকি;
কি কর চাতক ভায়া ধূলি মাঝে থাকি।
কোথায় উঠেছি চেয়ে দেখ একবার
এখানে আসিতে পার সাধ্য কি তোমার।
চাতক কহিছে, তবু নিচে দৃষ্টি তব,
গদা ভাব কার কিবা ছোঁ মারিয়া লব।
মেঘ বারি ভিন্ন অম্ল জল নাহি খাই,
তাই আমি নিচে থেকে ঊর্ধ্বমুখে চাই।
সারমর্ম: পৃথিবীতে উঁচু-নিচু নানা শ্রেণির মানুষ বাস করে। অর্থের দিক থেকে ধনী হলেও ক্ষুদ্রমনা মানুষ অপরের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে বড় মনের মানুষ আর্থিকভাবে গরীব হলেও সমাজের সকলের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন।

এ জীবনে যে যাহারে প্রাণ ভরি ভালবাসিয়াছে

এ জীবনে যে যাহারে প্রাণ ভরি ভালবাসিয়াছে
উচ্চ হোক তুচ্ছ হোক দূরে কিংবা থাক তাহা কাছে,
পাত্র বা অপাত্র হোক, প্রেমেই প্রেমের সার্থকতা;
বিশ্বজয়ী প্রেম কভু বিশ্ব মাঝে জানে না ব্যর্থতা।
প্রেমিকের অশ্রুজলে মন্দাকিনী চির-প্রবাহিত,
প্রণয়ীর দীর্ঘশ্বাসে স্বর্গে গিয়া হয় সে বঞ্চিত,
সত্যের নিষ্ফল-প্রেম স্বর্গে গিয়া হয় সে সফল,
নন্দন-মান্দারে রয় প্রণয়ের পরিমল।”
সারমর্ম: প্রেম সার্থকতা খুজে পায় প্রেমের মাঝেই। প্রেমে ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই। প্রেমিকের অশ্রু আর প্রেমিকার দীর্ঘশ্বাস স্বর্গের উদ্যানে ফুল হয়ে ফোটে। মর্ত্যলোকে যে প্রেমকে নিস্ফল মনে হয়, তা সুশোভিত হয় স্বর্গের নন্দন কাননে।

এ দুর্ভাগা দেশ হতে হে মঙ্গলময়,

এ দুর্ভাগা দেশ হতে হে মঙ্গলময়,
দূর করে দাও তুমি সব তুচ্ছ ভয়
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর
দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার,
এই চিরপেষণযন্ত্রণা, ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি, দন্ডে গলে পরে
এই আত্ম-অবমান, অন্তরে বাহিরে
এই দাসত্বের রজ্জু, ত্রস্ত নত শিরে
সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারংবার
মনুষ্য-মর্যাদা-গর্ব চির পরিহার
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গলপ্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক-মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে।
সারমর্ম: লোকনিন্দা, ক্ষমতা ও মৃত্যুর ভয় মানুষের স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে। পরাধীনতার শৃঙ্খল ব্যক্তিত্বকে আঘাত করে আত্মাকে দুর্বল করে ফেলে। সুতরাং স্বাধীনভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে মনের ভেতরের সকল প্রতিকূলতাকে দূর করতে হবে।

এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে

এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা, এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে-
‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে;
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা-চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে
পথকুক্কুরের মত সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে।
দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার;
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার
মনে মনে।
সারমর্ম: শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের দুঃখের অবসান ঘটাতে হবে। শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে মনোবল জাগাতে হবে। ঐক্যবদ্ধ জনতার সামনে শোষক বা অত্যাচারী যত বড়ই ক্ষমতাবান হোক না কেন তার হীন কর্মের জন্য অপমানিত হবে এবং পরাজয় অনিবার্য।

একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে, দহিল হৃদয় মন সেই ক্ষোভানলে।

একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে, দহিল হৃদয় মন সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে,
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে।
সেথা দেখি একজন পদ নাহি তার,
অমনি জুতার খেদ ঘুচিল আমার।
পরের দুঃখের কথা করিলে চিন্তন,
আপনার মনে দুঃখ থাকে কতক্ষণ?
সারমর্ম: নিজের জুতো নেই বলে ক্ষোভের কিছু নেই। কারণ যার পা নেই সেই দুঃখীজনের কথা ভাবলেই এ দুঃখবোধ স্থান পাবে না। নিজের যা কিছু আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর অন্যের দুঃখ-কষ্ট, বেদনা-ক্ষোভ উপলব্ধি করার মধ্যেই মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত।

একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়

একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়
আগন্তুক! রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ
সূর্য-নক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশর ছায়াপথে
যে আলোক আসে নামি ধরণীর শ্যামল ললাটে
সে তোমার চক্ষু চুম্বি তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ
সখ্যডোরে দ্যুলোকের সাথে; যুগ-যুগান্তর হতে
মহাকালযাত্রী মহাবাণী পুণ্য মুহূর্তের তব
শুভক্ষণে দিয়াছে সম্মান; তোমার সম্মুখ দিকে
আত্মার যাত্রার পন্থ গেছে চলি অনন্তের পানে-
সেথা তুমি এক যাত্রী অফুরন্ত এ মহাবিস্ময়।
সারমর্ম: দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানবসভ্যতার সঙ্গে মানুষ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক অনুভব করে। প্রকৃতির সঙ্গেও রয়েছে মানুষের সুসম্পর্ক। প্রকৃতির সান্নিধ্যেই মানুষের জীবন বিকশিত হয়। কিন্তু এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ সঙ্গীহীন।

Posted By Md.ripon Mia

No comments:

Post a Comment

পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষ্যে শিবগঞ্জ উপজেলাবাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

 বিসমিল্লাহর রাহমানির রাহিম ঈদ বয়ে আনুক সবার জীনবে সুখ শান্তি ও কল্যাণের বার্তা ঈদের দিনের মতো সুন্দর হোক প্রতিটি দিন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর উপলক...