ছয় বীর

সুকুমার রায়
সে প্রায় ছয়শত বৎসর আগেকার কথা— সে সময়ে ইংরাজ ও ফরাসীতে প্রায়ই যুদ্ধ চলিত। দুই পক্ষেই বড় বড় বীর ছিলেন— তাঁহাদের আশ্চর্য বীরত্বের কাহিনী ইউরোপের দেশ বিদেশে লোকে অবাক হইয়া শুনিত।
ইংলন্ডের রাজা তৃতীয় এড্‌ওয়ার্ড তখন খুব বড় সৈন্যদল লইয়া ফ্রান্সে যুদ্ধ করিতে ছিলেন। ফ্রান্সের উত্তর দিকে সমুদ্রের উপকূলে ইংলন্ডের খুব কাছাকাছি একটি শহর আছে, তাহার নাম ‘ক্যালে’ (Calais)। এই শহরটির উপর বহুকাল ধরিয়া ইংরাজদের চোখ ছিল— কারণ, এইটি দখল করিতে পারিলে, ফ্রান্সে যাওয়া-আসার খুবই সুবিধা হয়। এড্‌ওয়ার্ড জলস্থল দুইদিক হইতে এই শহরটিকে ঘেরাও করিয়া ফেলিলেন। ‘ক্যালে’ শহরে সৈন্য সামন্ত বেশী ছিল না, কিন্তু সেখানকার দুর্গ বড় ভয়ানক। তার চারিদিকে উঁচু দেয়াল ঘেরা— সেই দেয়ালের বাহিরে প্রকাণ্ড খাল— এক একটা ফটকের সামনে পোল— সেই পোল দুর্গের ভিতর হইতে গুটাইয়া ফেলা যায়। সে সময়ে কামান ছিল বটে— তাহার গোলাতে মানুষ মরে কিন্তু দুর্গ ভাঙে না। সুতরাং জোর করিয়া দুর্গ দখল করা বড় সহজ ছিল না। কিন্তু এড্‌ওয়ার্ড তাহার জন্য ব্যস্ত হইলেন না— তিনি শহরের পথঘাট আটকাইয়া, প্রকাণ্ড তাম্বু গাড়িয়া দিনের পর দিন নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। মতলবটি এই যে, যখন দুর্গের ভিতরের খাবার সব ফুরাইয়া আসিবে আর ভিতরের লোকজন ক্রমে কাহিল হইয়া পড়িবে, তখন তাহারা আপনা হইতেই হার মানিবে; মিছামিছি লড়াই হাঙ্গামা করিবার দরকার হইবে না।
‘ক্যালে’র লোকেরা যখন দেখিল, ইংরাজেরা চারিদিক হইতে পথঘাট ঘিরিয়া ফেলিতেছে, তখন তাহারা শিশু, বৃদ্ধ, অক্ষম এবং দুর্বল লোকদিগকে এবং স্ত্রীলোকদিগকে শহরের বাহিরে পাঠাইয়া দিল। তারপর কিছুদিন ধরিয়া ইংরাজ ও ফরাসিতে রেষারেষি চলিতে লাগিল। ফরাসীদের মতলব, বাহির হইতে দুর্গের ভিতর খাবার পৌঁছাইবে— ইংরাজের চেষ্টা যে সেই খাবার কিছুতেই ভিতরে যাইতে দিবে না। ডাঙার পথে খাবার পৌঁছান একরূপ অসম্ভব ছিল— কারণ, সেদিকে ইংরাজের খুব কড়াক্কড় পাহারা। সমুদ্রের দিকেও ইংরাজের যুদ্ধ-জাহাজ সর্বদা ঘোরাঘুরি করিত কিন্তু অন্ধকার রাতে তাহাদের এড়াইয়া, ফরাসি নাবিকেরা মাঝে মাঝে রুটি, মাংস, শাক সব্‌জি প্রভৃতি শহরের মধ্যে পৌঁছাইয়া দিত। মোঁরৎ ও মেস্ত্রিয়েল নামে দুইজন নাবিক এই কাজে আশ্চর্য সাহস ও বাহাদুরি দেখাইয়াছিল। একবার নয়, দুইবার নয়, তাহারা বহুদিন ধরিয়া এই রকমে সে শহরে খাবার জোগাইয়াছিল। ইংরাজেরা তাহাদের ধরিবার জন্য কতবার কত চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু প্রতিবারেই তাহারা ইংরাজ জাহাজগুলিকে ফাঁকি দিয়া পলাইত।
এইরকমে ছয়মাস কাটিয়া গেল, তবু দুর্গের লোকেরা দুর্গ ছাড়িয়া দিবার না পর্যন্ত করে না। তখন রাজা এড্‌ওয়ার্ড কিছু ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। তিনি আরো লোকজন আনাইয়া সমুদ্রের তীরে দুর্গ বানাইলেন, সেখানে খুব জবরদস্ত্‌ পাহারা বসাইলেন, সমুদ্রের ধারে পাহাড়ে বড় বড় পাথর ছুঁড়িবার যন্ত্র বসাইলেন। নৌকার সাধ্য কি সেদিক দিয়া শহরে প্রবেশ করে! খাবার আসিবার পথ যখন বন্ধ হইতে চলিল, দুর্গের লোকদেরও তখন হইতে ক্ষুধার কষ্ট আরম্ভ হইল, তাহারা দুর্বল হইয়া পড়ায় তাহাদের নানারকম রোগ দেখা দিতে লাগিল। তবু তাহারা মাঝে মাঝে দল বাঁধিয়া ইংরাজদের শিবির হইতে খাবার কাড়িয়া আনিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু তাহাতে যেটুকু জুটিত তাহা অতি সামান্য। দুর্গের সৈন্যেরা মাসের পর মাস ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করিয়াও, আশ্চর্য তেজের সঙ্গে দুর্গ রক্ষা করিতে লাগিল— তাহাদের এক ভরসা এই যে, ফরাসি রাজা ফিলিপ নিশ্চয়ই সৈন্য সামন্ত লইয়া তাহাদের সাহায্য করিতে আসিবেন।
একদিন সত্য সত্যই দেখা গেল, শহর হইতে কিছু দূরে ফরাসি সৈন্যদল আসিয়া হাজির হইয়াছে। তাহাদের রঙিন নিশান আর সাদা তাম্বুগুলি দুর্গের লোকেরা যখন দেখিতে পাইল, তখন তাহাদের আনন্দ দেখে কে! তাহারা ভাবিল, আমাদের এত দিনের ক্লেশ সার্থক হইল। যাহা হউক, ফিলিপ আসিয়াই ইংরাজেরা কোথায় কেমনভাবে আছে, তাহার খবর লইয়া দেখিলেন যে, এখান হইতে ইংরাজদের হটান বড় সহজ হইবে না। ‘ক্যালে’ ঢুকিবার পথ মাত্র দুইটি, একটি একেবারে সমুদ্রের ধারে— সেদিকে ইংরাজের বড় বড় যুদ্ধ-জাহাজ চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয়। আর একটি পথে পোলের উপর দিয়া নদী পার হইতে হয়— সেই পোলের উপর ইংরাজেরা রীতিমত দখল জন্মাইয়া বসিয়াছে। পোলের মুখে দুর্গ বসাইয়া বড় বড় যোদ্ধারা তাহার মধ্যে তীরন্দাজ লইয়া প্রস্তুত রহিয়াছে— তাহারা প্রাণ থাকিতে কেহ পথ ছাড়িবে না। ইহা ছাড়া আর সব জলাভুমি, সেখান দিয়া সৈন্য সামন্ত পার করা এক দুরূহ ব্যাপার।
ফিলিপ তখন ইংরাজ শিবিরে দূত পাঠাইয়া প্রস্তাব করিলেন, “আইস! তোমরা একবার খোলা ময়দানে আসিয়া আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর।” এড্‌ওয়ার্ড উত্তর দিলেন, “আমি আজ বৎসরখানেক এইখানে অপেক্ষা করিয়া আছি, ইহাতে আমার খরচপত্র যথেষ্ট হইয়াছে। এতদিন দুর্গের লোকেরা কাবু হইয়া আসিয়াছে, এখন তোমার খাতিরে আমি এমন সুযোগ ছাড়িতে প্রস্তুত নই। তোমার রাস্তা তুমি খুঁজিয়া লও।”
তিন দিন ধরিয়া দুই দলে আপসের কথাবার্তা চলিল, কিন্তু তাহাতে কোনরূপ মীমাংসা হইল না। তখন ফিলিপ অগত্যা তাঁহার সৈন্যদের লইয়া আবার বিনা যুদ্ধেই ফিরিয়া গেলেন। তাঁহাকে ফিরিতে দেখিয়া দুর্গবাসীদের মন একেবারে ভাঙিয়া পড়িল। এতদিন তাহারা যে ভরসায় সকল কষ্ট ভুলিয়া ছিল, এখন সে ভরসাও আর রহিল না। তখন তাহারা একেবারে নিরাশ হইয়া সন্ধির প্রস্তাব করিল।
এড্‌ওয়ার্ড বলিলেন, “সন্ধি করিতে আমি প্রস্তুত আছি, কিন্তু তোমরা আমায় বড় ভোগাইয়াছ, আমার অনেক জাহাজ ডুবিয়াছে, টাকা ও সময় নষ্ট হইয়াছে, এবং অন্য নানারকমের ক্ষতি হইয়াছে। আমি ইহার ষোল-আনা শোধ না লইয়া ছাড়িব না। আমার সন্ধির শর্ত এই, —ক্যালের দুর্গ শহর টাকাকড়ি লোকজন সমস্ত আমার হাতে ছাড়িয়া দিতে হইবে— আমার যেমন ইচ্ছা ফাঁসি, কয়েদ, জরিমানা ইত্যাদি দন্ডবিধান করিব এবং ইহাও জানিও যে, আমি যে শাস্তি দিব তাহা বড় সামান্য হইবে না।”
ইংরাজ দূত দখন ক্যালের লোকেদের এই কথা জানাইল, তাহারা এমন শর্তে সন্ধি করিতে রাজী হইল না। তাহারা বলিল, “রাজা এড্‌ওয়ার্ড স্বয়ং একজন বীরপুরুষ, তাঁহাকে বুঝাইয়া বলুন, তিনি এমন অন্যায় দাবী কখনও করিবেন না।” ইংরাজ দলের ধনী এবং সম্ভ্রান্ত লোকেরা তখন তাহাদের পক্ষ লইয়া রাজাকে অনেক বুঝাইলেন। ক্যালের লোকেরা কিরূপ সাহসের সহিত কত কষ্ট সহ্য করিয়া, বীরের মত দুর্গ রক্ষা করিয়াছে, সে সকল কথা তাঁহারা বার বার বলিলেন। এমন শত্রুকে যে সম্মান করা উচিত একথা এক বাক্যে সকলে স্বীকার করিলেন। কিন্তু এড্‌ওয়ার্ডের প্রতিজ্ঞা অটল। অনেক বলা-কওয়ার পর, তিনি একটু নরম হইয়া এই হুকুম দিলেন— “ক্যালের লোকেরা যদি ক্ষমা চায় তবে তাহাদের ছয়জন প্রতিনিধি পাঠাইয়া দিক— তাহারা দুর্গের চাবি লইয়া, খালি পায়ে খালি মাথায় গলায় দড়ি দিয়া আমার কাছে আসুক এবং সকলের হইয়া শাস্তি গ্রহণ করুক। তাহা হইলে আর সকলকে মাপ করিতে পারি, কিন্তু এই ছয়জনের আর রক্ষা নাই।”
ইংরাজ দূত আবার দুর্গে গিয়া এই হুকুম জানাইল। দুর্গের লোকেরা রাজার আদেশ জানিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া অপেক্ষা করিতেছি— এই হুকুম শুনিয়া তাহারা স্তব্ধ হইয়া গেল। তখন ক্যালের সম্ভ্রান্ত ধনী বৃদ্ধ সেন্ট পিয়ের বলিয়া উঠিলেন, “বন্ধুগণ, আমার জীবন দিয়া যদি তোমাদের বাঁচাইতে পারি, তবে ইহার চাইতে সুখের মৃত্যু আমি চাহি না। আমি ছয়জনের মধ্যে প্রথম প্রতিনিধিরূপে দাঁড়াইলাম।” এই কথায় চারিদিকে ক্রন্দনের রোল উঠিল— অনেকে সেন্ট পিয়েরের পায়ে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে আরও পাঁচজন লোক অগ্রসর হইয়া, তাঁহার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল এবং বলিল, “আমরাও মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি।” এই দৃশ্য দেখিয়া ইংরাজ দূতের চক্ষে জল আসিল— তিনি বলিলেন, “রাজা এড্‌ওয়ার্ড যাহাতে ইঁহাদের প্রতি সদয় হন, আমি সে জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিব।” ছয়জন প্রতিনিধিকে রাজার সভায় উপস্থিত করা হইল। তাঁহারা শান্তভাবে রাজার সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিলেন। তারপর সেন্ট পিয়ের ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, “আমাদের ‘ক্যালে’বাসী বন্ধুগণ এতদিন অসহ্য দুঃখ কষ্ট সহ্য করিয়া দুর্গ রক্ষা কারিয়াছেন। তাঁহাদের অযোগ্য প্রতিনিধি আমরা, আজ তাঁহাদের জীবনরক্ষার জন্য দুর্গের চাবি আপনার কাছে দিতেছি। এখন আমরা সম্পূর্ণভাবে আপনার ইচ্ছা ও আদেশের অধীনে রহিলাম।”
সভাশুদ্ধ লোকে স্তম্ভিত হইয়া তাঁহাদের দিকে চাহিয়া রহিল। ছয়জনের সকলেই বয়সে বৃদ্ধ; বহুদিন অনাহারে তাঁহাদের শরীর শুকাইয়া গিয়াছে, তাহাদের গম্ভীর প্রশান্ত মুখে কষ্টের রেখা পড়িয়াছে, এক একজন এত দুর্বল যে, চলিতে পা কাঁপে, অথচ তাঁহাদের মন এখনও তেজে পরিপূর্ণ। তাঁহাদের দেখিয়া ইংরাজ যোদ্ধাগণের মনে শ্রদ্ধার উদয় হইল। সকলেই বলিতে লাগিল, “ইহাদের উপর শাস্তি দিয়া প্রতিশোধ লওয়া উচিত নয়।” যিনি দূত হইয়া গিয়াছিলেন তিনি বলিলেন, “ইঁহাদের শাস্তি দিলে রাজা এড্‌ওয়ার্ডের কলঙ্ক হইবে— ইংরাজ জাতির কলঙ্ক হইবে।” কিন্তু এড্‌অয়ার্ডের মন গলিল না— তিনি জল্লাদ ডাকিতে হুকুম দিলেন। তখন ইংলন্ডের রানী ফিলিপা বন্দীদের মধ্যে কাঁদিয়া পড়িলেন এবং দুই হাত তুলিয়া ভগবান যীশুর দোহাই দিয়া এড্‌অয়ার্ডকে বলিলেন, “ইহাদের তুমি ছাড়িয়া দাও।” তখন এড্‌ওয়ার্ড আর ‘না’ বলিতে পারিলেন না।
ছয় বীরকে মুক্তি দিয়া রানী তাহাদিগকে তাঁহার নিজের বাড়িতে লইয়া, পরিতোষ পূর্বক ভোজন করাইলেন এবং নানা উপহার দিয়া বিদায় দিলেন। ইঁহাদের বীরত্বের কথা ফরাসীরা আজও ভোলে নাই— ইংরাজও তাহা স্মরণ করিয়া রাখিয়াছেন।